** আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত **

কিছু কথা....

আপনাদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করতে হলে লেখাটি আমাকে ইমেইল করুন। আমি সেটা নির্দিষ্ট বিভাগে, আপনার নাম দিয়ে প্রকাশ করবো।

আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?

!! আমার ব্লগের সাথে যুক্ত থাকুন !!

ইমেইল এর মাধ্যমে সমস্ত পোষ্টের নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য, নিচের ফাঁকা ঘরে আপনার ইমেইল এড্রেস লিখে ‘সাবস্ক্রাইব’ বাটন-এ ক্লিক করুন।

Blank

Comming Soon

কবিতা সমগ্র

আমার নিজের ও কবিদের লেখা কবিতার সংরক্ষণ

Saturday, August 16, 2025

হাতে-খড়ি





হাতে-খড়ি

স্বপন কুমার

(রালিবেড়া, পুরুলিয়া) 

মতিলাল পড়ে আছে ভেঁড়রা ঝোপের পাশে। সেই সময় মতিলালদের বাড়িতে আসছে তার মামা। তার মামা দেখল কে যেন পড়ে আছে ঝোপের কাছে। তা দেখে মতির মামা, মতিদের বাড়িতে ঢুকল। মতির বাবা শান্তিরাম বাড়িতেই ছিল। শালাকে দেখে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেয়ে গীতাকে ডেকে শান্তি বলল, “এদিকে শোন গীতা, তোর মামা এসেছে; এক ঘটি জল দে।”

গীতা এক ঘটি জল মামাকে দিল ও খাট পেতে দিল বসতে। মামা খাটে বসেই জামাইদাকে বলল, “ওখানে কে পড়ে আছে?”

শান্তি বলল, “মতি। তোমার সাধের ভাগনা।”

মামা আশ্চর্য হয়ে বলল – “হ্যাঁ! তার কী হয়েছে?”

শান্তি – “আর বলোনা। সেই গত সরস্বতী পূজোর থেকে যে মদ গিলছে; এখন পুরো মাতাল। এখন তার হুঁশ নেই।”

মামা বলল – “যাও ওকে তুলে নিয়ে এসো। এভাবে কেউ পড়ে থাকতে দেয়?”

শান্তি বলল – “থাক। আর পারিনা। বিরক্ত হয়ে গেছি। নেশা কাটলেই ঠিক চলে আসবে।”

ওর মামা তো ভেবে পাচ্ছে না। ভাগনা তো খুব ভাল ছেলে ছিল। এরকম হল কীভাবে? তা জানার জন্যই মামার মনে আগ্রহ বেড়ে গেল। জামাইদাকে বলল – “খুলে বলতো জামাইদা! ছেলেটা এমন হল কীভাবে?”

শান্তি বলল – “এর কান্ড শুনলে দুঃখ পাবে।” মামা তাই আরো জিদ ধরল জানার জন্য। না, বলতেই হবে।

শান্তি বলল – “আগে চা-জল পান হোক; তারপর বলছি।”

জল পান পর্ব শেষ হল। শান্তি শালাকে যা শোনাল তা নিম্নরূপ।

গত পৌষ সংক্রান্তির পর একটু একটু শীত কমতে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময় মতি ও তার বন্ধুরা মিলে সরস্বতী পূজোর আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। তখন মতি সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। যত পাড়ার চ্যাংড়াদের সঙ্গে তার ওঠা-বসা। এমন সময় একদিন মতি এসে বাবাকে বলল – “বাবা রাতে আমাদের সরস্বতী পুজার মিটিং আছে, আমাকে যেতে হবে।”

বাবা বাধা দিতে পারেনি। বলল – “যাও। তবে বেশি রাত করিস না।”

ছেলে কোন মতে দুগাল ভাত গিলে মিটিংএ চলে গেল।

গ্রামে আড্ডা দেওয়ার মাচানে আলোচনা শুরু হল। এবছর পূজো এমন হবে, যাতে গ্রামের সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। পূজোর তিন দিন সবাইকে মণ্ডপে থাকতে হবে। পূজোর পরে মঙ্গলবারে প্রতিমা বিসর্জন হবে। তাতে ডি.জে. বক্স করা হবে। খুব ধুমধামের সাথে নাচতে নাচতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে। কীভাবে পূজোর খরচ জোগাড় করতে হবে তা স্থির করা হল। চাঁদা তুলতে কে কে যাবে তা ঠিক করা হল। কত টাকা তুলতে হবে, তাও ঠিক হল। লক্ষ্য পঞ্চাশ হাজার টাকা।

যারা চাঁদার দায়িত্বে ছিল তারা পরের দিন থেকেই রাস্তায় নেমে পড়ল। রাস্তার উপর তারা বাঁশের ফটক তৈরি করে চাঁদা তোলার ব্যবস্থা করল। কোন গাড়িই ছাড়া যাবে না। একটি বাইক আসছে দেখে মতি চেঁচিয়ে বলল – “দেখ! একটা মোটর সাইকেল আসছে। চাঁদা না নিয়ে কোনমতে ছাড়া যাবে না।”

সকলে – “এই দাঁড়ান - দাঁড়ান!”

আরোহী – “কী হয়েছে?”

মতি – “সরস্বতী পূজোর চাঁদাটা দিয়ে যান।”

আরোহী – “সে তো অনেক দেরি আছে! দেব অবশ্যই দেব; তবে আজকে নয়, পরে।”

সকলে একসাথে – “না এমন করবেন না।”

আরোহী - দেখো; আমি তো প্রতিদিন আসি।”

মতিরা দেখল তা অবশ্য সত্যি।

মতি – “এনাকে ছেড়ে দাও।”

আরোহী চলে গেলেন। একটু পরে আবার একজন এসে পড়লেন। মতিরা তাঁকে ছাড়তে চাইছে না। সকলে – “পূজোর চাঁদাটা দিয়ে যান।”

আরোহী – “না; দেব না। কী করবি করেনে।” মনে হয় এভাবে পথ আটকে চাঁদা তোলাটা আরোহীর পছন্দ হয়নি। মতি দেখল, এ তো মুশকিলে পড়া গেল।

আরোহী তার বন্ধুকে মতিদের ভিডিও করতে বলল। আর নিজে মতিদের নাম ঠিকানা জানতে চাইলেন।

এবার মতিরা ভয় পেয়ে গেল। তারা কেউ নাম ঠিকানা বলতে চাইছে না, ভিডিও করছেন বলে।

আরোহী – “বল; ভয় কীসের? কত তোদের দম আছে তা দেখেই ছাড়ব।”

কোনো উপায় না দেখে আরোহীদের ‘সরি’ বলে যেতে বলল। কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটি মোটর সাইকেল এসে দাঁড়াল। মতিরা চাঁদা চাইলে সে পাঁচ টাকা দিতে রাজি হয়। মতিরা ২০ টাকা চায়। আরোহী ৫ টাকার বেশি দিতে রাজি নয়। অবশেষে ৫ টাকা নিয়েই তারা আরোহীকে ছেড়ে দিল। এরপরে আরেকটা বাইক এসে পড়ল। মতিরা আন্দাজ করল, বোধহয় এরা স্বামী-স্ত্রী। লোকটা হেসে বললেন, “কী ব্যাপার! সরস্বতী পূজো আসছে তাই?”

মোতিরা বলল – “হ্যাঁ স্যার। চাঁদাটা দিয়ে যান।” মোতিরা ভাবল ইনি অবশ্যই কিছু দিয়ে যাবেন। ভদ্রলোক – “হ্যাঁ-হ্যাঁ দেব, আমার নামটা লেখ তাহলেই দেব।”

মতি – “কী নাম স্যার?”

ভদ্রলোক – “ব্রঁজ্ঞাহ্মণ্য মাহান্তা।”

মতি লিখল – ‘বঙ্গাভন মাহান্তা’।

ভদ্রলোক – “দেখি, তোরা তো নামটাই লিখতে পারলি না। আর তোরা সরস্বতী পূজা করবি। আগে ভালো করে লিখ।”

দু-চার বার লিখে দেখল, ঠিক হল না।

ভদ্রলোক তাই বললেন – “আমাকে এখন ছাড়। পরে যখন লিখতে পারবি, তখন, নিবি।”

মতিরা কোনো উপায় না দেখে ছেড়ে দিল। ভদ্রলোকটিকে ছাড়ার আগে আরেক জন এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিও চাঁদা দিতে রাজি আছেন, তবে তাঁর প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হবে। বোধহয় তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, কী করে ফাঁকি দেওয়া যায়?

তাঁর প্রশ্ন – “স্কুল” বানানের প্রথমে ‘ই’ নেই কেন? ছেলেরা থতমত খেয়ে গেল। তবুও ছেলেরা

বলল – “অতসব ছাড়ুন চাঁদাটা দিন – না।”

ভদ্রলোক – “না বলতে পারলে আমিও চাঁদা দেব না।” কোনো উপায় না দেখে তাঁকেও ছেড়ে দিতে হল। এইভাবে সারাবেলা কেটে গেল। মাত্র ষাট টাকা হয়েছে। সবাই নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরল।

রাত্রে তারা আবার এক জায়গায় মিলিত হল। সবাই চিন্তিত। কীভাবে পঞ্চাশ হাজার তোলা যায়? অবশেষে সিদ্ধান্ত হল, যেখানে বড় গাড়ি চলে সেখানে গিয়ে চাঁদা আদায় করতে হবে। তাতে মনে হয় আদায় ভালো হবে।

কথামতো অনেকেই পরের দিন রাস্তায় নামল। এরমধ্যে একটি ট্রাকটর বালি নিয়ে যাচ্ছিল। তারা গাড়ি আটকাল। তারা ড্রাইভারকে বলল সরস্বতী পূজার চাঁদাটা দিতে।

ড্রাইভার বলল – “দেখ, আমার কাছে পয়সাপাতি নাই।”

ছেলেরা – “না! কিছু দিতেই হবে। নাহলে ছাড়া যাবে না।”

ড্রাইভার – “দেখ, আমার কাছে বালি ছাড়া কিছুই নাই।”

মতি – “বালিই দাও।”

ড্রাইভার – “নাও, একধামা নামিয়ে দিচ্ছি।”

মতি – “ওকে, ঠিক আছে।”

একধামা বালি নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার চলে গেল। একটি ছেলে বলে উঠল – “বালি নিয়ে কী হবে?”

মতি – “হবে; যখন এইভাবে এক ট্রাকটর বালি হবে, তখন বিক্রি করে দেব।”

এবার একটি ধান বোঝাই লরি এসে পড়ল। সবাই ঘিরে ধরল। চাঁদা দিতেই হবে। ড্রাইভার একশো টাকা দিতে রাজি হল। এরা বেশি চাইল। এর মধ্যেই সুবোধের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

সুবোধ বলল – “না, একশো টাকায় হবে না। পাঁচশো দিতে হবে। দেখছেন না এই রোডে দশ টনের বেশি মাল বহন নিষিদ্ধ।”

অনেক কথা কাটা-কাটির পর ড্রাইভার পাঁচশো টাকা দিতে বাধ্য হল। সবার মুখে হাসির ছাপ। এই সময় একটি সুমো এসে পড়ল। চাঁদা চাইলে সুমোর ড্রাইভার বলল – “গাড়িতে সিরিয়াস প্যাসেন্ট আছে। ছেড়ে দাও।”

অবস্থা বুঝে ছেলেরা তর্ক না করে ছেড়ে দিল। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এল, তাই সেদিনের মতো সবাই বাড়ি ফিরল। সারাদিনে হাজার খানেক টাকা আদায় হল। এর মধ্যেই মদন এসে পড়ল। সে জানতে চাইল, “আজ কত টাকা উঠল?”

মতি বলল – “হাজার খানেক।”

মদন – “ঠিক আছে। আজ রাত্রে সবাই আসবি। কিছু আলোচনা আছে।”

রাত্রে আবার সবাই মিলিত হল। মদন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল – “দেখ, গ্রামের সবাই জেনে গেছে, এবছর পূজো ধূমধাম করে হবে। তাই পিছোলে হবে না। কিছু একটা করতেই হবে।”

সবাই চুপ। কী করা যায়? হঠাৎ মদনের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে প্রস্তাব করল, “হাই ওয়েতে অনেক গাড়ি যায়, সেখানে চাঁদা আদায় করলে ভালো হবে।”

সবাই সম্মতি দিল।

ঠিক পরের দিন হাইওয়েতে চাঁদা আদায় করতে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। হাইওয়েতে হাত দিলেও গাড়ি দাঁড়াচ্ছে না। রসিদ বই দেখেই হর্ন বাজিয়ে দ্রুত গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে। তাই মতি একটা বুদ্ধি খাটাল। পাকা সড়কের উপর নিজের সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে দিল। সেই সময় একটি ট্রাক আসছিল, সবাই চিৎকার করে বলতে লাগল – “দাঁড়ান; দাঁড়ান।”

ড্রাইভার হর্ন বাজিয়ে সাইকেলটিকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে যাবার চেষ্টা করল। তাতেই ঘটল বিপত্তি! পাশ কাটাতে গিয়ে ট্রাকের পিছনের চাকা সাইকেলের উপর দিয়ে চলে গেল। ড্রাইভার দেখছে এরা অনেকজন আছে তাই আর দাঁড়ালো না।

মতি ভয় পেয়ে বলল – “মদনদা, এখানে হবে না। চলো বাড়ি যাই। মা বকবে, সাইকেলটাও দুমড়ে গেছে। মাকে কি বলবো?”

বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্তই সবাই গ্রহণ করল।

মতি বলল – “সাইকেলটা?”

মদন বলল – “চল, এখন বাড়ি যাই।”

তারপর সবাই চাঁদাতুলে সাইকেলটা সারিয়ে দিল।

এরপর সবাই রাত্রে মিলিত হল। আজও সবাই চুপ। কী করা যায়?

মদন নীরবতা ভেঙে বলল – “হাইওয়েতে আর চাঁদা তোলা যাবে না। কখন কী ঘটে যাবে বলা মুশকিল। কিছু একটা উপায় বার করতে হবে। গ্রামে চাঁদা তুললে কেমন হয়? কিন্তু এত টাকা উঠবে কী?”

মতি বলল – “দাদা; নদীতে জল কমেছে ও চুনা মাছ প্রচুর হয়েছে, ধরে বিক্রি করলে কেমন হয়?”

মদন তার কথায় সায় দিয়ে বলল – “এছাড়াও আরো কিছু করতে হবে।”

সুবোধ বলল – “এখনো অনেকের ধান ঝাড়া হয়নি। যদি আমরা ঝেড়ে দিই, তাহলে অনেক টাকা আসবে।”

মদন বলল – “ওসব ঠিক আছে। তবে যদি আমরা চেন্নাইয়ে কাজ করতে যাওয়া ছেলেদেরকে ডাকি তাহলে তাদের কাছে একটা মোটা টাকা পাওয়া যাবে ও সবাই মিলে বেশ মজা হবে।”

কথামত পরের দিন সকালে কাঁসাই নদীতে অনেকে মাছ ধরতে গেল। কেজি সাতেক মাছ পাওয়া গেল। দুজন মাছ বিক্রি করতে বাজারে গেল। আর বাকিরা খাওয়া-দাওয়া সেরে রাখালদের বাড়িতে ধান ঝাড়তে শুরু করল। মাছ বিক্রি করে হাজার খানেক ও ধান ঝাড়াই করে হাজার তিনেক টাকা আয় হল।

রোজগার মন্দ নয়, কিন্তু সবার স্কুল কামাই হতে লাগল। অনেকের মা-বাবা তাদেরকে বকতে শুরু করল। অনেকে বলতে লাগল তোদেরকে আর সরস্বতী পূজা করতে হবে না। ভাল করে পড়াশুনা কর। সারাদিন খেটে সবার গা-হাত-পা ব্যাথা করতে শুরু করল। তার উপর বাড়িতে মা-বাবার বকুনি। তাই অনেকে আবার স্কুল যেতে শুরু করল। সাথে-সাথে রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে গেল।

মতির মা, মতিকেও বকতে শুরু করল কিন্তু তার বাবা মতিকে কিছুই বলল না। উল্টে মতির মাকেই বকতে লাগল। “ছেড়ে দাও না, কদিনের তো ব্যাপার। তাছাড়া, এতে মতির একটা শিক্ষা হবে যে, পড়াশুনা থেকে রোজগার করা কত কঠিন? মতি, তা - হাড়ে হাড়ে টের পাবে।”

মতির মা ভেবে দেখল, কথাটা মন্দ নয়। তাই চুপ করে গেল।

দিন কতক পর মদন আবার সবাইকে রাত্রে ডেকে আলোচনা শুরু করল – “দেখো পূজো সামনে চলে এল, এরপর শুরু না করলে আর পারা যাবে না। আমাদের যদি পঞ্চাশ হাজার নাও হয়, কিছু কাট-ছাঁট করে তিরিশ হাজারেও ভালোভাবে করা যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, এই তিরিশ হাজার টাকা কিন্তু ওঠাতেই হবে। এর মধ্যে বালি বিক্রি করে চার হাজার পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে এদিক-ওদিক করে প্রায় দশ হাজার হয়ে গেছে। তাহলে আর কত বাকি থাকল? কুড়ি হাজার। এর মধ্যে দশ হাজার বাইরে কাজ করতে যাওয়া ছেলেদের কাছে পাওয়া যাবে। আমি ফোন করে দিয়েছি। তাহলে বাকি থাকছে আর দশ হাজার। এই দশ হাজার আমরা জোগাড় করতে পারব না?”

সবার মনে একটা আশার আলো ফুটে ওঠল।

মতি বলল – “তাহলে পূজোটা ভালোভাবেই হবে।”

মদন – “অবশ্যই। তবে এই দশ হাজার টাকা সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে ওঠাতে হবে। বাকি টাকাটা আমরা যদি পাঁচশো করে দিই, তাহলেই হয়ে যাবে।”

মতির উপরও ধার্য হল পাঁচশো টাকা। মতি বাড়িতে এসে বাবাকে বলল – “পূজোর চাঁদা পাঁচশো

টাকা দিতে হবে।”

তার বাবা দিতে অস্বীকার করল। মতিও জিদ ধরে বসল।

মতি – “তাহলে আমিও আর স্কুল যাব না।”

মতির বাবা – “যেতে হবে না। চল আমার সাথে কাজ করবি।”

মতি দেখল মহা মুশকিল। সে সবার সামনে বলেছে, “আমিও পাঁচশো টাকা দেব।”

মতি তাই ভেবে আলাদা ফন্দি এঁটে বলল টাকাটা না দিলে, আমি খাবার খাব না।” অনেক বোঝানোর পরেও মতি খাবার মুখে দিল না।

উপায় না দেখে মতির বাবা মতিকে টাকাটা দিয়ে দিল।

ওদিকে আবার সুবোধের বাবা টাকা দিতে নারাজ। সুবোধের বাবার কথা – “যা; যা পারবি কর। আমি দেব না।”

তখন সুবোধ কথাটা মদনদাকে বলল। মদন কয়েকজনকে নিয়ে সুবোধের বাবার কাছে এল আর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টাকাটা দিতে বলল।

সুবোধের বাবা বলল – “না, দিতে পারব না। পাঁচশো টাকা অনেক।”

মদন বলল – “দেখুন বিবেচনা করে, আমরা মোড় থেকে চা খেয়ে আসছি।”

সুবোধের বাবা ভাবতে লাগল কী করা যায়? মদনের কাজ কারবার, সুবোধের বাবা অনেকবার দেখেছে। ওর সঙ্গে ঝামেলা না করায় ভাল। তাই সে সুবোধের মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে টাকাটা দিতে রাজি হল।

তবুও দু’হাজার টাকার ঘাটতি হল। তাই মদন প্রস্তাব দিল – “এই দু’হাজার টাকা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দুজন শিক্ষক আছে, তাদের কাছে নিতে হবে। তাই তারা প্রাইমারি স্কুলে গেল এবং তাদের কাছে দু’হাজার টাকা চাঁদা চাইল। প্রথমে তারা দিতে রাজি হননি কিন্তু মদন যখন বলল – “না দিলে স্কুলে তালা পড়বে।” তখন দু’জন শিক্ষকেই দেখলেন, নিজেদের কিছু গাফিলতি আছে। তাই তারা বাধ্য হয়ে টাকাটা দিয়ে দিলেন।

ইতিমধ্যে চেন্নাই-গুজরাটে কাজ করতে যাওয়া ছেলেরা এসে পড়ল। সেই রাত থেকেই প্যান্ডেলের কাজ শুরু হল। বাজার করতে যাওয়া ছেলেরাও বাজার করে নিয়ে এল। পাশের গ্রাম থেকে প্রতিমাও আনা হল। প্যান্ডেলের কাজ শেষ করে সবাই খেতে গেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার অনেকে ফিরে এল রাত্রিতে থাকার জন্য। কালকে সকাল ন’টার মধ্যে পূজো শুরু হবে।

কয়েকজন প্রতিমার আশপাশটা সাজাতে শুরু করল। বাকি কয়েকজন তাস খেলতে শুরু করল। মতি কাছেই বসে ছিল। সে তাস খেলতে জানে না। তাই সুবোধ মতিকে তাসগুলো চিনিয়ে দিতে লাগল। 29, কলব্রিজ, ফিস প্রভৃতি কীভাবে খেলতে হয় তা বোঝাতে লাগল। প্রথমদিকে মতির অসুবিধা হলেও পরে শিখে গেল। এভাবে চলতে চলতে কখন যে রাত দু’টা বাজল, বোঝায় গেল না। তাই সকলে শুয়ে পড়ল।

সকালে সাউন্ড বক্সে গান বাজতেই সবার ঘুম ভেঙে গেল। শুরু হল পূজোর প্রস্তুতি। কেউ কেউ ফুল তুলতে গেল। মেয়েরা পূজো মন্ডপের চারপাশে ভালো করে গোবর জল দিয়ে ঝাট দিয়ে দিল। সুন্দর করে আলপনা এঁকে সাজিয়ে দিল। সকাল আটটায় পুরোহিত আসার কথা। তাই সবাই স্নান সেরে পুষ্পাঞ্জলী দিতে হাজির। পূজারী ঠাকুর চলে এসেছেন। পূজো শুরু হল। হোম-আরতী-যজ্ঞ সবই হল। সবাই পুষ্পাঞ্জলী দিল। তারপর প্রসাদ নিয়ে যে-যার বাড়ি ফিরল। মতিরা কয়েকজন থেকে গেল প্রসাদ বিতরণ ও দেখভালের জন্য। কচিকাচারা সাউন্ড বক্সের গানের তালে নাচতে লাগল। বেশ একটা উৎসবের মেজাজ।

রাত্রে মণ্ডপে থাকার জন্য চেন্নাই-গুজরাটে, কাজ করা বন্ধুরা সহ অনেকেই এল। বাইরে খাটতে যাওয়া বন্ধুরা সদ্য এসেছে, তাই তাদের হাতে অনেক টাকা। তাছাড়া খৈনি, বিড়ি, গুটখা ইত্যাদি সবসময় পকেট ভর্তি।

বাইরে সাউন্ডবক্সে মন মাতানো গান, আলোর ঝিকিমিকি আর ভেতরে ধূপের গন্ধ যেন একটা অদ্ভুত আমেজ তৈরি করেছে। অনেকেই তাস খেলতে বসে গেল। আজ মতিও খেলছে। এর মধ্যেই কেউ বিড়ি টানছে, কেউ খৈনী খাচ্ছে আবার কেউ গুটখা চিবোচ্ছে।

মতির কিন্তু বিড়ির ধোঁয়া সহ্য হল না। তাই সে বিরক্ত হয়ে বলল – “দাদা বিড়িটা অন্ততঃ বাইরে টেনে এসো।”

প্রকাশ বলল – “লে একটা বিড়ি টান, দু’টান দিলেই মেজাজ চাঙ্গা হয়ে যাবে।”

মতি অন্তর থেকে না চাইলেও কিছু একটা ভেবে বিড়িটা ধরাল। কয়েক টান দিয়ে ভালো না লাগায় ফেলে দিল। কিছুক্ষণ পর তার একটা অনুভূতি হল, মনে হল শরীরে কিসের যেন একটা অভাব। তাই এক গ্লাস জল পান করল। তাতেও অজানা অভাব বোধটা গেল না। তাই একটা বিড়ি আবার ধরাল এবং খেলায় মন দিল। ক্রমশ রাত বাড়তে বাড়তে অনেকে অবসন্ন বোধ করল। তাই সবাই খেলা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

দ্বিতীয় রাতও এভাবে পার হয়ে গেল। ঘোর বিপত্তি শুরু হল তৃতীয় রাত্রে। প্রকাশ তার বন্ধুকে নিয়ে দু’বোতল মদ এনে সরস্বতী প্রতিমার পিছনে লুকিয়ে রাখল।

যখন রাত্রি বার’টা বাজল, সারা গ্রাম নিঃশব্দ; কেবল বক্সখানা কম আওয়াজে বাজছে, তখন প্রকাশ বলল – “আজ জমে যাবে, কেউ কোনো আওয়াজ করো না। আমি দু’বোতল মদ এনেছি। সবাই একটু একটু পান করবো আর মজা করে তাস খেলবো।”

অনেকে আপত্তি করল – “এখানে ওসব করা যাবে না।”

প্রকাশ বলল – “খৈনী-বিড়ি সব চলল আর এতেই আপত্তি! মনের ভক্তিটাই আসল, বুজলে। তাছাড়া আমরা তো বেশি করে খাচ্ছি না। সবাই ভাগ করলে মাত্র এককাপ করে হবে। তাতে কারো নেশা হবে না।”

অনেকের ধারনাও তাই, ‘এক কাপে কিছুই হবে না’। তাছাড়া মজা করার এমন সময় আর হয় না। বতর গেলে বছর যায়। তাই ‘জাস্ট একটু মজা’ করার জন্য সবাই পান করল। তাস খেলা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই নিজের নিজের বর্ণনা বেশি করে করতে লাগল। প্রকাশ দেখল অনেকের একটু একটু নেশা লেগেছে। তাই সবাইকে শুতে বলল। শুরু হল ‘গুডনাইট’ বলার ধুম। প্রকাশ ওদেরকে ভয় খাইয়ে দিল – “গ্রামের কেউ যদি আসে তো, সবার মুশকিল হবে।”

ধীরে ধীরে সবাই শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। সকালে মদন এসে সবার ঘুম ভাঙাল। হটাৎ তার নজর পড়ল, প্রতিমার দিকে এবং বলল – “হ্যা রে ঘটের নারকেলটা দেখছি না, কে নিয়ে গেল?”

সবাই নিরুত্তর। তাই মদনও চুপ করে গেল। সে হয়তো ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে।

আজ মঙ্গলবার, আজকের সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন হবে। তাই সবাই তোড়-জোড় শুরু করে দিল। ডি.জে-র মালিককে ফোন করা হল, যাতে সে যথা সময়ে ডি.জে. সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে আসে। এদিকে মদন প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষ্যে সিদ্ধি-ভাঙ এর ব্যবস্থা করল। যাতে সবাই খুব আনন্দ করতে পারে।

সন্ধ্যা নামতেই কাউকে স্বেচ্ছায়, কাউকে বুঝিয়ে সিদ্ধি বা ভাঙ খাওয়ানো হল। সবার মধ্যে যেন, একটা নেশাচ্ছন্ন ভাব। আনন্দ-ফুর্তি চরমে উঠল। ডি.জে. আসতেই প্রতিমা গাড়িতে চাপানো হল বিসর্জনের জন্য। তার আগে আগে ডি.জে. গাড়ি ও উদ্দাম নাচ করতে থাকা চ্যাংড়ার দল। গ্রামের প্রায় সমস্ত মানুষ বিসর্জন দেখতে বেরোল। কোলের সন্তানও বাদ গেল না। কে কার কথা শোনে? ডি.জে-র কান ফাটা শব্দে কারো কথা শোনাও সম্ভব নয়। এই বিকট শব্দে নাচতে নাচতে বিসর্জনের গাড়িও এগিয়ে চলল। মতিও ভাঙ খেয়ে উন্মাদের মতো নাচতে লাগল। মেয়েরা পিছনে উলুধ্বনি দিতে লাগল। কেউ কেউ নাচতেও লেগে গেছে। সঙ্গে জয়ধ্বনি - জয় মা সরস্বতী কী? – জয়, আসছে বছর আবার হবে। এভাবে এগোতে এগোতে রাস্তায় কেউ পড়ে থাকল, আবার অনেকে টলতে টলতে প্রতিমা বিসর্জনের ঘাটে পৌঁছাল। প্রতিমা ধীরে ধীরে জলের মধ্যে জয়ধ্বনির সাথে বিসর্জন হল। এর সঙ্গে কার কত কী যে বিসর্জন হল তার হিসাব কে রাখে। সে যাক, এবার যে যার বাড়ি ফিরল। এবছরের মতো সরস্বতী পূজো শেষ হল।

সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন মতির মা মতির বাবাকে বলল – “তুমি দেখেছ? মতি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।”

মতির বাবা - হ্যাঁ দেখেছি। তার কাজেও বিশেষ মন নেই। আগে খাবার চেয়ে নিত। এখন না ডাকলে আসে না। কী যে হল?”

হঠাৎ এক রবিবার মতি বলল – “বাবা আমি আজ তালতলের হাট যাব।”

মতির বাবা – “কেন? কী নিবি?”

মতি বলল – “এমনি যাব।”

মতির বাবা দেখল যাক, এমনিতেই মন খারাপ একটু ঘুরে আসুক, তাতে হয়তো তার মনটা ভালো হবে।”

 তাই তার বাবা বলল – “যা, যখন মন চাইছে।”

হাটে গিয়ে মতি বন্ধুদের সাথে মদ ও শূকর মাংস ভাজা খেয়ে বেশ চাঙগা হল। মতির মনে এক চিন্তা ঘিরে ধরল। এবার যদি বাড়ি যাই তো বাবা জেনে যাবে ‘মতি মদ্যপান করেছে’। তাই মতি বন্ধুদের বলল – “বাড়ি গেলে তো বাবা টের পেয়ে যাবে।”

এক বন্ধু বলল – “কোনো চিন্তা নাই, এর ব্যবস্থা আছে। নে, একটা গুটখা চিবা; তাতে কেউ বুঝতে পারবে না।”

মতি একটা দোষ চাপা দিতে আরেকটা দোষ করে বসল। তাছাড়া আর উপায়ও নেই। বাড়িতে এসেই মতি শুয়ে পড়ল। যাতে কেউ টের না পায়।

এইভাবে প্রতি রবিবার তালতলের হাট যাওয়া মতির রুটিন হয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ এক রবিবার তাদের ‘মদ্যপান’ একটু বেশিই হয়েছিল। তাতে মতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যায়। অনেকে তাকে চিনতে পারল। তাই মতির বন্ধুরা নেশা কাটানোর জন্য মাথায় জল দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর মতির হুঁশ এল। ভয়ে মতি আর বাড়ি যেতে চাইছে না। এর মধ্যেই কে মতির বাবাকে ফোন করে দিয়েছে, মতি তালতলের হাটে ‘মদ্যপান’ করে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। ‘সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না’ - তা মতি বুঝতে পারল।

অবশেষে একজন সাইকেলে চাপিয়ে মতিকে বাড়ি পৌঁছে দিল। শান্তি তো ক্ষেপে ছিলই। আগে পিছে না ভেবে গরু বাগালের চাবুকটা নিয়ে মতিকে কয়েক ঘা দিতেই মতির মা তার বাবার হাত থেকে চাবুকটা কেড়ে নিল আর বলল – “এতো বড়ো ছেলেকে কেউ মারে। কখন কী করে বসবে বলা যায় না।” তা শুনে মতি যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল। মতি ভাবল – ‘যাক তাহলে বাঁচা গেল’।

শান্তিপূর্ণভাবে কিছুদিন কেটে গেল। মদ যে মতিকে খেয়ে ফেলেছে, তার প্রমাণ - মতি আরো সুযোগ খুঁজতে লাগল। কীভাবে তালতলের হাট যাওয়া যায়? বাবা তো আর যেতে দেবে না।

এবার মতির তালতলের হাট যাওয়া বন্ধ হল। তাই সে মাঝে মধ্যে অন্য গ্রাম থেকে মদ আনিয়ে মদ্যপান চালাতে লাগল খুব সতর্কভাবে। সাথে গুটখা চিবানোটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

মতি ও তার বন্ধুরা মাঝে মধ্যে স্কুল যেতে লাগল। পকেটে গুটখা, তাই তারা ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে কোনার দিকে বসত। যাতে করে গুটখার পিক ফেলতে সুবিধা হয়। একদিন এক শিক্ষকের নজরে পড়ল গুটখার পিক ফেলে ক্লাস রুমের কোনাগুলো নোংরা করে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বসা ছেলেদের উঠিয়ে বললেন – “কে কে ওখানে গুটখার পিক ফেলেছো?”

তারা কোনো কথায় বলল না। কারণ, মুখে তারা গুটখা পুরে রেখেছে। মাস্টার মশায় একটা বুদ্ধি খাটালেন – “কী করা যায়? কী করলে ছেলেরা ক্লাসে আর গুটখা খাবে না ও পিক ফেলবে না।” তাই মাস্টার মশায় বললেন – “তোমরা এসো, মিড-ডে-মিলের ওখান থেকে বালতিতে জল ও সাবান গুঁড়ি নিয়ে এসো, আর নোংরা জায়গাটা পরিষ্কার করো।”

তাদের পিছনে মাস্টার মশাইও যেতে লাগলেন। হঠাৎ মতি ও তার বন্ধু শিবু সিড়িতে না নেমে বারান্দার উলটো দিকে দৌড় দিয়ে এক ছাদের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে গেল। মাস্টার মশাই দেখলেন – “এ তো মহা মুশকিল! তাদের পা ভাঙলে কী হতো?”

তাই মাস্টার মশাই সঙ্গে সঙ্গে হেড মাস্টারকে খবর দিলেন। তিনিও ছেলেদের দুর্বুদ্ধি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। অতি সত্ত্বর অভিভাবকদের ডাকলেন। মতির বাবা এল কিন্তু শিবুর বাবা চেন্নাইয়ে কাজে যাওয়ার জন্য আসতে পারল না। মতির বাবা সব শুনে হেডস্যারকে বলেই দিল – “মতিকে যেভাবে হোক, দরকার হলে ঠেঙিয়ে পা ভেঙে দিন, তবুও তাকে ঠিক রাস্তায় নিয়ে আসুন। আমি কিচ্ছু বলব না। আপনার হাতেই সব ছেড়ে দিলাম।”

হেডস্যারের তথা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাত বাঁধা। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে, তার কৈফিয়ৎ কে দেবে? সমাজের অধিকাংশ মানুষ তথা প্রশাসন কাদের পক্ষে দাঁড়াবে? তাই তিনি যে ঔষুধে কাজ হবে না, তবুও সেই ঔষুধটাই দিলেন – ‘একটু জ্ঞান দিয়ে দু’জনকেই ছেড়ে দিলেন’।

শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আপসোস কি-বা, করা যায়? সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা নীরব দর্শক মাত্র।

নানা বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে বছর খানেক পার হল। হটাৎ একদিন চেন্নাইয়ে কাজ করতে যাওয়া জনা-কয়েক বন্ধু গ্রামে ফিরল। তারা মতির সাথে ঘুরতে গেল। সেখানে খুব জমিয়ে মদ পান করল। মতি তো প্রায় বেহুঁশ। তাই তার বন্ধুরা মতিকে, মতির ঘরের কাছে পৌঁছে দিয়ে পালিয়ে গেল।

মতির বাবা দুপুরের খাবার খেয়ে হাত ধুতে বাইরে বেরোতেই দেখতে পেল মতি ঝোপের কাছে পড়ে আছে। তা দেখে সে আর মতিকে তুলতেও গেল না। এমন সময়েই মতির মামা এসে এই দৃশ্যটা দেখতে পায়। কথা শোনাতে শোনাতে শান্তির চোখে জল গড়িয়ে পড়ল। অশ্রুসিক্ত হয়ে সে শালাকে বলল – “আজ শান্তির ঘরে, শান্তি বিসর্জনের সাথে মতিও ঘনান্ধকারে ডুবে গেছে।”

মতির মামা অশোকও তা শুনে নির্বাক। তবুও অশোক সাধের ভাগনাকে ঘরে তুলে কয়েক বালতি জল মাথায় ঢেলে দিল। তাতেই মতির চেতনা ফিরল।

ধীরে ধীরে মতি, গ্রামে মাতাল বলেই পরিচিতি লাভ করল এবং অদ্ভুত এক উপাধি পেল – ‘মাতলা’। মাতলা বলেই গ্রামে তাকে ডাকা শুরু হল। যখন মতিকে গ্রামের লোক মাতলা বলে ডাকে, তখন রাগে শান্তির চোখ লাল হয়ে ওঠে। কারোর সাথে মতির নিয়ে কথা উঠলে বলে – “তোমাদের মতির যেন, আমার মতির মতো দশা না হয়।” 

সমাপ্ত

Monday, July 23, 2018

‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


‘গৃহদাহ’ উপন্যাসটি অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এক অনবদ্য সামাজিক দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস। ত্রিকোণ প্রেম যে নরনারীর জীবনে কি ভয়াবহ পরিণতি ঘটতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমান এই উপন্যাসটি। ত্রিকোণ প্রেমের মধ্য দিয়ে যে সমাজে নরনারীর জীবন যে কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে তা উপন্যাসটিতে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গুলি হল মহিম,সুরেশ,অচলা ও কেদারবাবু। উপন্যাসের শুরুতেই দেখতে পাই মহিম ও সুরেশ খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তারা একে অপরকে ছাড়া পরিপূর্ণ ছিল না। সুরেশ ধনীর সন্তান কিন্তু মহিম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দুই বন্ধুর মধ্যে ব্রাহ্ম মেয়ে অচলার উপস্থিতি তাদের সুসম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরতে শুরু করে। মহিম অচলাকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন একদিনের জন্যেও সুখের হয়নি। কারণ অচলার সঙ্গে সুরেশরও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই এই তিনজনের মধ্যে একটা ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরই পরিণামে মহিম অচলার দাম্পত্য জীবনে গভীর অশান্তির সৃষ্টি হয়। আমরা এই উপন্যাসে মহিম ও অচলার দাম্পত্য কলহের চিত্রগুলি সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার প্রচেষ্টা করব। ডঃ সুকুমার সেনের মতে - “গৃহদাহের সমস্যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও কৃত্রিম, এবং প্লটপরিকল্পনার শৈথিল্যে সে কৃত্রিমতা ঢাকা পড়িতে পারে নাই। স্বামিনিষ্ঠা হইতে যে প্রেম নারী হৃদয়ে জন্মায় তাহার মূল সুদুরবিসারী, তাহা প্রতিদিনের ভুলভ্রান্তি মান-অভিমান সহ্য করিয়া টিকিয়া থাকে, এবং অবস্থার বিপাকে এমন নারীর দেহ অশুদ্ধি ঘটিলেও তাহার পাতিব্রত্যের হানি হয় না। ইহাই গৃহদাহের তত্ত্বকথা।”১৮ উপন্যাসের শুরুতেই আমরা লক্ষ্য করি মহিম ও সুরেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তারা একে অপরকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসত। হঠাৎ দেখা যায় মহিম এক ব্রাহ্ম মেয়ে অচলার প্রেমে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনা শুনে সুরেশ মহিমকে এই বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু মহিম সুরেশের কথাতে কোন গুরুত্ব না দিয়ে অবিচল থেকে যায়। মহিমের এই স্থির মনোভাব লক্ষ্য করে সুরেশ তাই রেগে গিয়ে বলতে পারে - “তুমি সমস্ত জগতের বরেণ্য পূজনীয়, হিন্দুর সন্তান হয়ে কিনা একটি রমণীর মোহে জাত দেবে।”১৯ সুরেশের এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে সুরেশ নিজের ধর্ম সম্পর্কে কতটা সচেতন। সুরেশ এর পর মহিমকে নানারকম বিদ্রুপ করতে ছাড়েনি। তাই সুরেশ মহিমকে তার ভবিষ্যৎবানী করে বলতে পারে - “কিন্তু দুঃসময়ে সে যদি না তোমাকে ছেড়ে চলে আসে ত আমার নামের বদলে যা ইচ্ছে বলে ডেক, আমি দুঃখ করব না।”২০ সুরেশ মহিমকে একথাও বলতে ভুলেনি যে সে তার মঙ্গল ভিন্ন কখনো অমঙ্গল কামনা করতে পারেনি। সুরেশ এরপর মহিমকে একমাস সময় দিল যেন এই সময়ের মধ্যে সে অচলার সঙ্গে কোন দেখাশুনা না করে। এই সময়ের মধ্যে সে মহিমের জন্য ভালো মেয়ের সন্ধান করতে থাকে। এই সময়ে সুরেশ যদি মেয়ের সন্ধান দিতে না পারে তবে সে তাকে বলে তোমার যা ইচ্ছে তাই হবে। এই কথা শুনে মহিম কোন কথাই বলল না। কিন্তু সুরেশ যে মহিমের শুভকামনায় কিরূপ মর্মান্তিক বিচলিত হয়েছে, তা মহিম সম্পূর্ণভাবে অনুমান করতে পারে। সুরেশ মহিমের ব্রাহ্ম মন্দিরে যাওয়া নিয়ে বিদ্রুপ করতে থাকে। সুরেশ ছিল নাস্তিক, অর্থাৎ ঠাকুর দেবতায় সে বিশ্বাস করত না। মহিম তাই সুরেশকে খোঁচা দিয়ে বলতে থাকে যে তুমি তো ঠাকুর দেবতা মান না তাহলে আমি ব্রাহ্মের মন্দিরে যাই আর হিন্দুর মন্দিরে যাই, তাতে তোমার কি আসে যায়। এই প্রশ্নের উত্তরে সুরেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলে - “যা নেই তা আমি মানিনে। ভগবান নেই , ঠাকুর দেবতা মিছে কথা! কিন্তু যা আছে, তাদের তো অস্বীকার করিনে। সমাজকে আমি শ্রদ্ধা করি, মানুষকে পূজা করি। আমি জানি মানুষের সেবা করাই মনুষ্য জন্মের চরম সার্থকতা। যখন হিন্দুর ঘরে জন্মেছি তখন হিন্দু সমাজ রক্ষা করাই আমার কাজ।”২১ সুরেশের এই কথার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি যে সুরেশ তার ধর্মকে অন্তর থেকে কতটা ভালবাসে। তাই সে একথাও বলতে ভোলেনি যে প্রান থাকতে আমি তোমাকে ব্রাহ্ম ঘরে বিবাহ করতে দেব না। কিন্তু এইসব কথা শুনেও মহিম কিন্তু নিজের সিন্ধান্তে অটল থেকে যায়। সুরেশ মহিমকে এরপর বলে ব্রাহ্মরা আমাদের সমাজকে সন্দ বলে ফেলে গেছে। এই কারণের জন্যেই সুরেশ ব্রাহ্মদের একেবারে সহ্য করতে পারে না। সুরেশের এই কথা শুনে মহিমের দৃঢ়চেতা মন কিছুটা কোমল হতে শুরু করে।

এই ঘটনার কিছুদিন পর সুরেশ মহিমের বাসায় এসে খবর পেল যে মহিম সকালবেলা বাইরে বেরিয়েছে কিন্তু এখনো ফিরে নাই। এই কথা শুনে সুরেশ মনে মনে অনুমান করল যে মহিম নিশ্চয় পটল ডাঙ্গায় কেদার মুখুজ্যের বাড়ীতে অচলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। এই কথা সন্দেহ করতে তার মনে কোন সংশয় দেখা যায় না। তাই সে তখন মহিমের প্রতি রেগে বিদ্বেষে জ্বলতে থাকে। এই অবস্থায় সুরেশের বুকের মধ্যে আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাতের মত প্রজ্জলিত হয়ে উঠল। সে তৎক্ষণাৎ কোন বিচার বিবেচনা না করেই গাড়িতে উঠে পটলডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সুরেশ সেখানে গিয়ে খবর পেল যে মহিম আজ দশ বারো দিন সেখানে আসেনি। এই কথা শুনে সুরেশের উত্তপ্ত মন কিছুটা হলেও শীতল হয়ে গেল। সুরেশ এরপর কেদার মুখুজ্যের সঙ্গে মহিমের বিষয়ে বিশদে আলোচনা করতে লাগল। মহিমের একমাত্র সম্বল একটা ভাঙ্গা চালের বাড়ী ছাড়া তেমন কোন কিছু নেই তা সুরেশ কেদারবাবুকে জানিয়ে দেয়। এই কথা শুনে কেদারবাবু অবাক হয়ে যায়। তিনি এইসব সম্বন্ধে যে জ্ঞাত নয় তা সুরেশকে জানায়। এছাড়াও মহিমের আর্থিক পরিস্থিতি এবং নানারকম আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি সুরেশ সুস্পষ্টভাবে কেদারবাবুকে জানিয়ে দেয়। কেদারবাবু সুরেশের এইসব কথা শুনে হতচকিত হয়ে যান। তাই মহিমের প্রতি কেদারবাবুর বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। সুরেশ এইসব গোপন কথা কেদারবাবুকে জানিয়ে দিয়ে তার কাছে খুব প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। সুরেশ ও কেদারবাবুর এইসব কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ অচলা প্রবেশ করে। অচলাকে দেখে সুরেশ মুগ্ধ হয়ে যায়। অচলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে সুরেশ তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হতে শুরু করে। সুরেশের কথা শুনে কেদারবাবু মহিমের প্রতি কতটা বিরূপ হয়েছিল তা তার কথাতেই অনুমান করা যায়। যখন তিনি অচলাকে বলেন – “কে জানত, সে এমন বিশ্বাসঘাতক, এমন মিথ্যাবাদী।”২২ বাবার মুখে এই কথা শুনে অচলার মুখ পাণ্ডুর হয়ে গেল। কারণ অচলা মহিমকে আন্তরিক ভাবে খুব ভালবাসত। তাই ভালোবাসার মানুষের প্রতি এই অকথ্য কথা শুনে তার খুব খারাপ লাগল। অচলা নিজে মহিমকে খুব বিশ্বাস করত। কারণ অচলাকে মহিম তার দুরাবস্থার কথা গোপন রাখেনি। তাই তাকে বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যাবাদী বলাতে অচলার অসহ্য যন্ত্রণা হয়ে থাকে।

সুরেশের মুখে মহিম সম্পর্কে এই কথাগুলি শুনে কেদারবাবু সুরেশকে খুব বিশ্বাস করতে লাগল। তাই সুরেশের প্রতি কেদারবাবুর একটা দূর্বলতা দেখা দিল। সুরেশ এই ব্যাপারটা অনুমান করে সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে এরপর প্রতিদিন কেদারবাবুর গৃহে যাতায়াত করতে লাগল। দিনে দিনে কেদারবাবুর সাথে সুরেশের সম্পর্কের উন্নতি হতে লাগল। এই বাড়ীতে নিত্য নৈমিত্তিক আসা যাওয়া করার সুবাদে সুরেশ ও অচলার মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হতে লাগল। প্রথম প্রথম অচলা সুরেশের মুখে মহিমের সম্পর্কে খারাপ কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারত না। কিন্তু সুরেশ অনেকরকম কলাকৌশলে অচলাকে মহিমের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করে। এইজন্যই সুরেশ অচলাকে বলে - “সে যে আপনাকে একখানা অস্বচ্ছল ভাঙা মেটে বাড়ীতে টেনে নিয়ে যেতে চায়, সে কথা কি আপনাকে তার বলা কর্তব্য নয়?”২৩ সুরেশ এই কথা গুলি বলে অচলার মনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু অচলা এই কথা শুনে কোন উত্তরই দেয় না। অচলার জবাব না পেয়েও সুরেশ অনুমান করল যে তার কথায় কাজ হয়েছে। অর্থাৎ অচলাকে মহিমের প্রতি কিছুটা হলেও বিরূপ মনোভাব তৈরি করতে সে সক্ষম হয়েছে। সুরেশ এরপর অচলার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি দেখাবার চেষ্টা করে। সুরেশ অচলার কাছে জানতে পারে যে অচলাকে মহিম তার সব খবরই পূর্বেই জানিয়ে দেয়। অচলার মুখে এইসব কথা শুনে সুরেশ লজ্জায় পড়ে যায় এবং নিজেকে অপরাধী মনে করে অচলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু অচলা সুরেশের এই আচরণে নিজেকে লজ্জিত মনে করে। তাই অচলা সুরেশকে বলে যে মহিমের সম্বন্ধে আপনার কোন কাজই আমি অন্যায় বলে ভাবতে পারিনি। অচলার মুখে এই কথা শুনে সুরেশের মনের জোর বেড়ে যায়। এছাড়াও অচলা সুরেশকে মাঝে মাঝে তাদের বাড়ী আসার জন্য অনুরোধ করে। এই কথা শুনে সুরেশ মনে মনে খুব আনন্দিত হয়। কারণ এই সুযোগটাই সে প্রার্থনা করছিল। এখান থেকে সুরেশ বাড়ী ফিরে সেখানে মহিমকে দেখে অবাক হয়ে গেল। মহিম তখন জানায় সুরেশ যেহেতু তার বাড়ীতে খোঁজ করতে গিয়েছিল তাই সে তার সাথে দেখা করতে এখানে এসেছে। সুরেশ যে পটলডাঙ্গায় কেদারবাবুর বাড়ীতে গিয়েছিল এই কথা মহিমের কাছে গোপন করে দেয়। সুরেশ তখন মহিমকে অনুরোধ করে কাল একবার পটলডাঙ্গায় যাওয়ার জন্য। উত্তরে মহিম বলে যে কাল সকালের গাড়িতে সে বাড়ী চলে যাবে। সুরেশ কিন্তু কাল তাকে সেখানে যাবার জন্য অনেক অনুরোধ করে। সুরেশের এই বারবার অনুরোধ করার কারণটা মহিমের মনে একটা খটকা লাগে। মহিমকে রাজী করাতে না পেরে অবশেষে সুরেশ নিজে গিয়ে মহিমের কথা সেখানে বলে আসার জন্য অনুমতি চায়। সুরেশের এই কথা শুনে মহিম অবাক হয়ে যায়। এর যথার্থ কোন কারণ সে অনুমান করতে পারে না।

সুরেশ মনে মনে অসংশয় অনুভব করতে লাগল যে এই কয়দিন মহিম যে অচলার কাছে যায় নি তা তার অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারে নাই বলেই তা সম্ভব হয়েছে। এই কথা অনুভব করে আজ আর তার ভালো লাগল না। কারণ একদিন না একদিন হাসি গল্পে উপহাসে সব কথা অচলার কানে গিয়ে পৌঁছাবে। তখন সব জেনে গিয়ে অচলা সুরেশকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকবে। এইসব কথা চিন্তা ভাবনা করে সুরেশের ভিতর কাঁপতে লাগল। তাই সে এই সমস্যার সমাধান করার জন্য সকালবেলায় কেদারবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হল। সুরেশ সেখানে গিয়ে খবর পেল যে কেদারবাবু বাড়ীতে নেই কিন্তু অচলা বাড়ীতেই আছে। সুরেশের প্রয়োজন তো অচলার সঙ্গেই তাই সে মনে মনে খুব খুশি হল। বেয়ারা খবর দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে সুরেশের কাছে অচলা প্রবেশ করল। সুরেশ প্রথমেই অচলাকে জানায় যে মহিমকে সে এখানে আসার জন্য অনেক অনুরোধ করলেও তা অগ্রাহ্য করে সে বাড়ী চলে গেল। উত্তরে অচলা জানায় তার বাড়ীতে বিশেষ কোন কাজের জন্য হয়তো সে যেতে বাধ্য হয়েছে। অচলার এই কথা শুনে সুরেশ কিন্তু খুশি হয়নি। কারণ সে চেয়েছিল যে এই কথা শুনে অচলা উত্তেজিত হয়ে উঠবে। তাই সে অচলাকে পুনরায় জানায় যে দু এক মিনিটের জন্য এখানে এসে আপনাকে তা বলে যাওয়া তার কর্তব্য ছিল। সুরেশের এই কঠিন কথা শুনেও কিন্তু অচলা মহিমের প্রতি যথেষ্ট আস্থা দেখায়। অচলার এই অবস্থা দেখে সুরেশ ভিতরে ভিতরে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যায়। তাই সে তখন অচলার প্রতি নিজের আস্থা অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই সে অচলাকে বলে যে মহিম ও আপনাকে আমি পৃথক করে দেখিনে। আপনারা দুজনেই আজ থেকে আমার অভিন্ন। অচলার প্রতি এই সহানুভূতি দেখিয়ে সুরেশ অচলার মনে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করেন। উত্তরে অচলা জানায় যে – “আপনাকে যাচাই করার শুভদিন না আসা পর্যন্ত আমি কিন্তু আপনার বন্ধুকেই দোষী করতে পারব না সুরেশবাবু।”২৪ সুরেশ এরপর অচলার সহানুভূতি পাওয়ার জন্য অতিতে সে মহিমের যে উপকার করেছিল তার বিশদ বর্ণনা দিতে লাগল। সুরেশ নানারকম ভাবে মহিমের দোষ ত্রুটি আলোচনা করে অচলাকে বিরক্ত করার প্রচেষ্টা করল। কিন্তু মহিমের ভুল ত্রুটিকে অচলা তেমন কোন গুরুত্ব দিতে বাধ্য হল না। তাই সুরেশ অশ্রুকণ্ঠে বলতে পারে - “যখন জনেনই তখন এই ভিক্ষা আজ আমাকে দিন যে, অজ্ঞানে যে শত্রুতা আপনাদের করেছি, সে অপরাধ আর যেন আমার বুকে না বেঁধে।”২৫ সুরেশের এই কথা অচলার নিজের অন্তরটা যেন দুলে উঠে। অচলা তার অশ্রুকে আর বাগ মানাতে পারল না। কেদারবাবু হঠাৎ চলে এলে তাকেও সুরেশ মহিমের বাড়ী যাবার খবর জানিয়ে দেয়। মহিমের কথা শুনে কেদারবাবু রেগে যায়। কেদারবাবুর এই আচরণ দেখে সুরেশ ভিতরে খানিকটা খুশি হয়। অচলার মতো কেদারবাবুও সুরেশকে মাঝে মাঝে তাদের বাড়ী আসার জন্য অনুরোধ করে। সুরেশের কাছে যে তিনি কৃতজ্ঞ তা বারে বারে কেদারবাবু বলতে লাগলেন। সুরেশ এরপর প্রায় দিনই কেদারবাবুর বাড়ীতে যাতায়াত করতে লাগল। অচলার সঙ্গে সুরেশের মেলামেশাতে তাদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরি হতে দেখা যায়। যে ব্রাহ্মদের সুরেশ এক মুহূর্ত দেখতে পারত না সেই ব্রাহ্ম মেয়ে অচলার প্রতি দূর্বলতাবশতঃ সে ব্রাহ্ম ঘরে খাওয়া দাওয়া করতেও লাগল। এতেই বোঝা গেল যে অচলার প্রতি সুরেশ কতটা অনুরক্ত হয়ে উঠেছিল। অচলাকে যে সে অনেক গুরুত্ব দিয়ে মান্য করত সে কথা সুরেশ অচলার কাছে প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করল না। সুরেশের এই কথা শুনে অচলা হতচকিত হয়ে গেল। সুরেশ অচলার প্রতি এতটাই পাগল হয়ে উঠেছিল যে অচলার হাত ধরতেও তার কোন কুণ্ঠাবোধ হয়নি। সুরেশ অচলাকে কাছে টেনে দিতেই অচলা সুরেশের গায়ের উপর এসে পড়ল। এই আলিঙ্গন অবস্থায় অচলা নিজেকে লজ্জিত বোধ করল। সুরেশের এই ব্যাবহারে আমরা বুঝতে পারি যে সুরেশ অচলার প্রতি কতটা গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। সুরেশের আলিঙ্গনে কিন্তু অচলাকে আমরা বাধা দিতে লক্ষ্য করিনি। তাই এই আচরণের জন্য অচলার ক্ষীণ হলেও যে সহমত ছিল তা বলা যায়। কেদারবাবু হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করলে অচলা ভয়ে তাদের আলিঙ্গন জোর করে ছাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে। অচলার প্রতি মোহের বশে সুরেশ কেদারবাবুর বাড়ীতে খাবার খেতেও বাদ দিল না। আহারাদির পর সুরেশ কেদারবাবুর বাড়ীতে বিশ্রাম নিলেন। কিন্তু সুরেশের ঘুম এল না। ঘরের বাইরে মধ্যাহ্ন সূর্য আকাশে জ্বলতে লাগল এবং ভিতরে আত্মসংযমের আত্মগ্লানি ততোধিক ভীষণ তেজে সুরেশের বুকের ভিতর জ্বলতে লাগল। এমনি করে সমস্ত বেলাটা অন্তরে বাইরে পুড়িয়া আধমরা হয়ে যখন সে উঠে বসল তখন জানালা খুলে দেখল যে, তখন বেলা পড়ে গেছে। কেদারবাবু এসে তাকে ঘুমের কথা জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে জানায় যে দিনে তার ঘুমের অভ্যেস নেই তাই সে ঘুমোতে পারেনি। কেদারবাবু এরপর সুরেশের কাছে অনুমতি নেয় যে কোন গড়িমসি না করে সবকিছু স্পষ্ট করে মহিমকে একটা চিঠি লিখে জানানো প্রয়োজন। কেদারবাবুর এই কথাটা শুনে সুরেশের পিঠের উপর মর্মান্তিক চাবুকের মতো যেন মারল, তাই সে তৎক্ষণাৎ চমকে উঠল। সুরেশের এই আচরণ দেখে কেদারবাবু সুরেশকে বলে যে নিষ্ঠুর কর্তব্য কি করে করতে হয় তা তো তুমিই আমাকে শিক্ষা দিয়েছ। অতএব এখন তো তোমার এখান থেকে পিছন ফিরলে চলবে না। কেদারবাবুর এই কথাকে সহমত জানিয়ে সুরেশ বলে যে এই ব্যাপারে অচলার মতামত একবার নেওয়া প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্তে অচলার যে পুরোপুরি মতামত আছে তা কেদারবাবু সুরেশকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। তাই আজ রাতের মধ্যে এই কাজটা কেদারবাবু সেরে ফেলতে চান। সুরেশ তখন বলে যে এত তাড়াহুড়ো না করে দু একদিন দেখে নেওয়া দরকার। সুরেশের এই কথা শুনে কেদারবাবু রেগে গিয়ে বলে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আর কোন প্রয়োজন নেই। কারণ মহিমের সব জেনেশুনে কেদারবাবু আর তার হাতে মেয়েকে সমর্পণ করতে পারবেন না। তাই এই বিশ্রী ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করা যায় ততই মঙ্গল। সুরেশ তখন ভয়ে তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে এতে কেদারবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যায়। এই কথা শুনে সুরেশের মুখ দিয়ে একটা আরামের নিঃশ্বাস পড়ল। কিন্তু সে আর কোন কথা না বলে প্রায় চুপচাপ থেকে গেল। কেদারবাবু সুরেশের আচরণে সম্পূর্ণ ব্যপারটা মনে মনে অনুমান করতে পারলেন। এই অনুমান যাচাই করার জন্য সে অন্ধকারে ঢিল ফেলিল। সুরেশ যে তার কত উপকারী বন্ধু সেকথা কেদারবাবু বারবার সুরেশকে জানাতে ভুললেন না। কেদারবাবুর এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরেই আবার বলে যে এর চেয়েও তারা দুজন তার কাছে বড় উপকার প্রত্যাশা করছেন। কেদারবাবুর এই কথার অর্থ সুরেশ বুঝতে পারে না। কেদারবাবু একথা বলতেও ভোলেনি যে তারা ব্রাহ্ম হলেও তার মেয়ে অচলা কিন্তু মনে প্রানে হিন্দুই রয়ে গেছে। কেদারবাবুর এই কথা শুনে সুরেশ কিছুটা অনুমান করতে পারে। কেদারবাবু আরও বলে অচলা যে ব্রাহ্মগিরি একেবারেই পছন্দ করে না। কেদারবাবুর এই কথা বলার মূল উদ্দেশ্যটা সুরেশ পুরোপুরি আন্দাজ করতে পারে তাই সে একথা শুনে বিস্ময়ে মুখ তুলে চায়। কেদারবাবু এরপর সরাসরি সুরেশকে বলে যে মেয়ের একটি সম্বন্ধ যেমন তোমার হাতে ভেঙ্গে গেল তেমনই আর একটি নতুন সম্বন্ধ তোমাকেই গড়ে তুলতে হবে। সুরেশ এতে রাজী হয় এবং তা করার জন্য সে যে প্রাণপণ চেষ্টা করবে তা বলতে দ্বিধা করে না।

কেদারবাবু সমাজের গোলযোগের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য খুব তাড়াতাড়ি অচলার বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু তিনি জানেন যে অচলা একগুঁয়ে মেয়ে তাই তার মতামত না নিয়ে একাজ সম্পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ কেদারবাবু ভালোভাবেই জানতেন যে অচলা খুব সহজে মহিমকে ত্যাগ করবে না। তাই অচলার বিয়েতে তার মতকেই তিনি প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেন। কেদারবাবুর এই কথা শুনে সুরেশের মনে আবার আঘাত লাগলো, তাই সে অচেতন হয়ে গেল। দুপুরের সময় তার নিজের উচ্ছৃঙ্খল প্রণয় নিবেদনের বীভৎস আচরণ স্মরণ করে নিদারুণ লজ্জায় সমস্ত মুখ তার রাঙা না হয়ে কালিবর্ণ হয়ে গেল। সুরেশের এই অন্যমনস্কতা দেখে কেদারবাবু নতুন একটা চাল চেলে সুরেশকে বিশ্বাসী বলে মহান করে তুললেন। কেদারবাবু বলেন যাকে সারাজীবন কাছ থেকেও একতিল বিশ্বাস হয় না কিন্তু তোমাকে দু-ঘণ্টার মধ্যে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হয়। কেদারবাবু যে তার মনের গোপন কথা নিঃসংশয়ে তাকে বলতে পারে একথা সরাসরি তার কাছে স্বীকার করে নেয়। নিজের দুর্দশা দুরবস্থার কাহিনী বন্ধুবান্ধব থাকতে সুরেশকে বলতে তার কোন সংকোচবোধ হয় না। কেদারবাবু এর জন্য গুঢ় কারণকেই দায়ী করে। কেদারবাবু তাই তার নিজের ব্যক্তিগত সমস্ত অভাব অভিযোগের কথা তার কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। বর্তমানে তার আর্থিক পরিস্থিতির কথাও তিনি সুরেশের কাছে গোপন করলেন না।এই অভাব অভিযোগের মধ্য দিয়েও তিনি যে খুব কষ্ট করে তার মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলেছেন একথা জানাতেও ভোলেনি। তার এই আর্থিক অনটনের কথা তিনি আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি কিন্তু সুরেশকে বিশ্বাসী মনে করে সবকিছু খোলা মনে জানিয়ে দেন। কেদারবাবুর এই আচরণে আমরা অনুমান করতে পারি যে তিনি সুরেশকে খুব কাছের মানুষ ভাবতে শুরু করেন। এই কথাটিই কেদারবাবু সুরেশকে পরোক্ষ ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমরা পূর্বেই জেনেছি যে সুরেশ হল পরোপকারী। অন্যের বিপদে সে নিজেকে সে স্থির রাখতে পারে না সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানেও তার বিরুদ্ধাচরণ ঘটতে দেখা গেল না। কেদারবাবুর আর্থিক অবনতির কথা শুনে সুরেশ জানতে চাইল যে বর্তমানে তার ঋণের পরিমাণের কথা। কেদারবাবু সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলে যে এখন তার ঋণের পরিমাণ হল তিন-চার হাজার টাকা। এই কথা শুনে সুরেশ তৎক্ষণাৎ তা দিয়ে সাহায্য করার কথা ঘোষণা করল। কেদারবাবু তার এই কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। তাই সে সুরেশকে যে জামাতা করতে ইচ্ছুক তা ইঙ্গিতে জানিয়ে দেন। এই কথা শুনে সুরেশ ও অচলা দুজনেই সে সময় লজ্জায় পড়ে যায়। কেদারবাবু এরপর পরেরদিন সুরেশকে এখানে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করে দেয়। ফলে আমরা লক্ষ্য করি যে প্রায় দিনই সুরেশ তার বাড়ীতে আসা যাওয়া শুরু করে দেয়। তাই অচলার সঙ্গে সুরেশের মেলামেশিতে একটা গভীর সম্পর্কের ভীত গড়তে শুরু করে।

কেদারবাবু সুরেশকে যে কি বন্ধনে বান্ধতে চাইছেন তা সুরেশ সবকিছু বুঝতে পেরে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে না বোঝার ভান করে অচলার কাছে জানতে চায়। কারণ সে অচলাকে জিজ্ঞাসা করে অচলার মনের কথাটা যাচাই করার চেষ্টা করে। কিন্তু অচলা এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর দেয়নি। সুরেশ তখন সঠিক উত্তর না পেয়ে অচলাকে বলে যে তোমার বাবা যদি আমাদের বিয়ে দিতে সম্মত হয় তাতে তোমার মত আছে কিনা? সুরেশের এই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ অচলা নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেয় যে তাকে বিয়ে করা তার কোনদিনই সম্ভব নয়। এইভাবেই কৌশলে সুরেশ অচলার মন বোঝার চেষ্টা করে। তাই সুরেশ বুঝে যায় যে অচলাকে তার নিজের করে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই কথা শুনে সুরেশের মন হতাশ হয়ে যায়। এরপর অচলা দীপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দেয় সে মহিমকে যদি না পায় তবুও কোন অবস্থাতেই সে সুরেশকে মনের কোনে স্থান দিতে পারবে না। অচলার এতবড় অহংকারের কথা শুনে সুরেশ মনে খুব আঘাত পায়। কিন্তু সুরেশ তার দুঃখের কথা অচলার কাছে প্রকাশ করে না। এরপর অচলা ও সুরেশের মধ্যে কেদারবাবুকে টাকা ধার দেওয়ার ব্যপারে কিছুক্ষণ আলোচনা চলল। অচলা সুরেশকে বলে যে তুমি আমাকে নিজের করে না পেলে হয়তো আর বাবাকে অতগুলো টাকা ধার দিতে চাইবে না। অচলার এই কথা শুনে সুরেশ রাজী হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে যে তোমাকে আমি পাই বা না পাই তোমার বাবাকে যে টাকা দেব বলে কথা দিয়েছি তা দেবই। সুরেশ এরপর বলে যে আমি যে কোন মানুষকে বিপদে পড়লে সাহায্য করে থাকি। তাতে আমি কোন স্বার্থ দেখি না। সুরেশ এই কথার দ্বারা বোঝাতে চায় যে সে পরোপকারী। সে অচলাকে একথাও বলে সে খুব বেশি ভদ্রলোক না হলেও খুব বেশি ছোট নয়। তাই সে কেদারবাবুকে সাহায্য করতে চেয়েছে যখন সে তা জীবন দিয়েও করবে। এই সাহায্যে যে অচলার কোন গুরুত্ব নেই তা সুরেশ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে দেয়। এই কথার মধ্য দিয়ে সুরেশ যে একজন মহৎ ব্যাক্তি তাই সে অচলার কাছে ব্যক্ত করে। কারণ এই কথা ভেবে যদি অচলা তার প্রতি কিছুটা হলেও আকৃষ্ট হয় এই কৌশল তাই সে ব্যবহার করল। কিন্তু সে জানায় যে কেদারবাবু এরপর এই টাকাটা তার কাছে নিতে রাজী হবেন কিনা এটাই তার এখন সন্দেহ হচ্ছে। সুরেশ যে অনেক টাকার মালিক, তাই তার এই ক্ষুদ্র টাকা ফেরৎ না পেলেও কিছু আসে যায়নি। একথা সে অচলাকে সগর্বে জানিয়ে দেয়। এই টাকাটা যদি অচলার সুখের জন্য কোন কাজে লাগে তাহলে তা ভেবে সে নিজেকে খুব সুখী মনে করবে। সেই কাজে এই টাকাটা দিতে সুরেশের মনে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ হবে না। এই কথার দ্বারা সুরেশ বোঝাতে চাইল যে সে অচলাকে অন্তর থেকে কতটা ভালোবাসে। তাই সে অচলার সুখের জন্য যে কোন স্বার্থত্যাগ করতে পারে।

কেদারবাবুকে টাকাটা দেওয়া পর্যন্ত অচলা যেন তার মতামতের কথা বাবাকে না জানায় তার জন্য সুরেশ তাকে বারবার অনুরোধ করে। অচলা যে টাকার লোভে এই বিয়েতে মত দিল না একথা শুনে তার প্রতি সুরেশের শ্রদ্ধা যে আরো বেড়ে গেল তা দৃঢ়কণ্ঠে বলে। অচলা এই বিয়েতে মত দিলে সুরেশ যে ভয়ে পিছিয়ে দাঁড়াত একথা বলতেও সে দ্বিধা করেনি। তার যে, কোন কাজেই অসম্ভব নয় তা সুরেশ জানিয়ে দেয়। এই কথাগুলির মধ্য দিয়ে সুরেশ অচলার কাছে সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করে। তাছাড়া সে যে একজন সৎ ব্যাক্তি তাও জানাতে চায়। সুরেশ এরপর তার কৃতকর্মের জন্য ব্যথিত হয়ে অচলার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেয়। সুরেশ চলে যাবার পর অচলার দুই চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। সুরেশকে যে অচলা মনের কোনে একটা জায়গা দিয়ে ফেলেছিল তা এই ঘটনার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি। অচলা প্রথম থেকেই মহিমকে মনে প্রানে ভালোবাসত অন্যদিকে আবার নতুন করে সুরেশের সঙ্গে সংস্পর্শে আসার ফলে তাকেও মনে খানিকটা জায়গা দিয়ে ফেলেছিল। এইজন্য অচলার মন দোলাচল প্রবৃত্তিতে ভরে উঠেছিল। অচলার মনে দোলাচল প্রবৃত্তির ফলে শুধু তার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল তাই নয় সাথে সাথে মহিম ও সুরেশের জীবনেও গভীর প্রভাব দেখা যায়। কেদারবাবু বাড়ীতে এসে যখন অচলার কাছে জানতে পারে যে সুরেশ চলে গেছে তাছাড়া কালকে এখানে আসার জন্য অচলা বলেনি। তৎক্ষণাৎ কেদারবাবু রেগে গিয়ে অচলাকে খুব তিরস্কার করেন। অচলা এরপর বাবার কাছে জানতে চায় যে কোন শর্তে তিনি সুরেশবাবুর কাছে টাকাটা নিতে চাইছেন। এই কথা শুনে কেদারবাবু হতভম্ব হয়ে কোন উত্তর দিতে পারেনি। এরপর পিতা ও কন্যার মধ্যে টাকা নেবার রহস্য নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। কেদারবাবু যে সুরেশকে অচলার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছেন তা তিনি ইঙ্গিতে মেয়েকে জানিয়ে দেন। অচলা পিতার উদ্দেশ্যের কথা সব বুঝতে পেরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অচলা সমস্ত ব্যপারটা গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত মনের মধ্যে স্পষ্ট করে উপলব্ধি করবার জন্য সেখানেই স্তব্ধ হয়ে গেল। অচলা তখন গভীরভাবে ভাবতে লাগল যে দুজন বন্ধু আজ তার মনের মধ্যে স্থান নিয়েছে তাদের যে কোন একজনকে তাকে ত্যাগ করতেই হবে। কিন্তু দুজনের মধ্যে কাকে সে ত্যাগ করবে তা ভেবে পায় না। এই নিয়ে তার মনের মধ্যে দোলাচলতার সৃষ্টি হয়। কারণ মহিমের সঙ্গে তার অনেকদিনের পরিচয়। মহিমের সঙ্গে সে মনেপ্রাণে জড়িয়ে তাকে যে জীবনের প্রিয়পাত্র হিসাবেই মনে করে নিয়েছিল। তাই সে মহিমকে ত্যাগ করার কথা এর পূর্বে কখনো ভাবেনি। অন্যদিকে কিছুদিন ধরে সুরেশের সাথে পরিচয়ের ফলে অচলার তার সাথে একটা বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠে। সুরেশের পরোপকারী মহান ব্যক্তিত্বকে মনে করেও অচলা তাকে কিছুটা হলেও ভালোবেসে ফেলে। তাই তাকেও ত্যাগ করতে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।

পূর্বের কথামতোই সুরেশ কেদারবাবুকে টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন। এইজন্য কেদারবাবুর ভাবগতিক মনে হয় যে তার মনের এত স্ফূর্তি বুঝি যুবক বয়সেও ছিলনা। তার ফলে সুরেশ পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিল। তাই কেদারবাবুর বাড়ীতে সুরেশের অবাধ যাতায়াত চলতে থাকে। অচলার সাথে তার কথা বার্তা হলেও কিন্তু অচলা তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু যেহেতু সে তার বাবাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে তাই অচলা তাকে তা প্রকাশ করত না। মহিমের অনুপস্থিতে যে অচলার মন ভারাক্রান্ত তা সে সুরেশকে বুঝিয়ে দেয়। সুরেশের সাথে মেলামেশা করলেও অচলার মনে কিন্তু মহিমের স্থান ছিল সর্বাগ্রে। অচলা পরক্ষণেই উলটো সুরে কথা বলে মহিমকে চিঠি লিখতে বাধা দেওয়ার কথা বলে। এই কথা অচলার মুখে শুনে সুরেশ নিজেকে দোষী ভেবে আত্মদহনে দগ্ধ হয়ে ছটফট করতে থাকে। তখন অচলা তৎক্ষণাৎ সুরেশকে জানায় যে আপনার কোন দোষ নেই একথা আমি খুব ভালোভাবে বিশ্বাস করি। অচলার মুখে এই কথা শুনে সুরেশ বুকে কিছুটা বল পায়। অচলা যে তাকে খুব শ্রদ্ধা করে তাও দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করে। অচলার এই করুণামিশ্রিত কথা শুনে সুরেশের চোখে জল এসে যায়। এইজন্য অচলাকে না পাবার জন্য সুরেশ অচলার কাছে খুব দুঃখ করতে থাকে। অচলা সুরেশের দুঃখের কথা শুনে বিগলিত হয়ে বলে সে কোন দিনই তার বাবার অবাধ্য নয় তাই সে বাবার কথা অনুযায়ী সুরেশরই অধিকারিণী। এই কথা শুনে সুরেশ মনে খুব আনন্দিত হয়ে অচলাকে কাছে টেনে বারবার চুম্বন করতে থাকে। সুরেশ আনন্দের সহিত তাই বলতে পারে – “এই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার অচলা, এর বেশি আর চাইনে। কিন্তু এটুকু থেকে যেন আমাকে বঞ্চিত করো না।”২৬ এইভাবে সুরেশকে প্রশ্রয় দিয়ে অচলা নিজের জীবনকে আর বেশি জটিল করে তোলে।

একদিন সন্ধ্যে বেলা বায়োস্কোপ দেখে ফেরার পথে যখন সুরেশ অচলার হাত ধরে তাকে নিচে নামায় তখন উভয়েই একসঙ্গে চেয়ে দেখে তাদের সামনেই মহিম দাঁড়াইয়া আছে। মহিমকে দেখে তারা দুজনেই যেন পাথরে রূপান্তরিত হয়ে গেল। মহিম সুরেশকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। উত্তরে সুরেশ প্রথমে কোন সদুত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে ঢোক গিলে মহিমের সাথে সৌজন্যমূলক কিছু আচরণ করতে লাগল। মহিমের এতদিন কোন খোঁজ খবর না পেয়ে তারা সবাই যে খুব উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল তা সুরেশ জানায় মহিমকে। এইজন্য তারা সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল একথা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে। মহিম এরপর অচলার কাছে জানতে চাইল যে কোন সুত্রে তাদের সাথে সুরেশের আলাপ পরিচয় হয়ে উঠল। উত্তরে অচলা মুখ তুলিয়া ঠিক যেন মরিয়া হয়ে বলে তিনি তার বাবাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এর চাইতে সে বেশি কিছু বলতে পারবে না। তাই সে বাকি কথা তার বাবার কাছে জানার জন্য অনুরোধ করল। অচলার মুখে এইসব কথা শুনে মহিম সঙ্গে সঙ্গে সুরেশের কাছে তার টাকা ধার দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। সুরেশ তখন মহিমকে খুব অসংলগ্ন ভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করে। সুরেশের এই কথার অর্থ মহিম কিছু বুঝতে পারে না। তাই মহিম তার কাছে পরিষ্কার ভাবে জানতে চাইল। সুরেশ কিন্তু কোন কথা স্পষ্ট করে বলল না। সবকিছু ঘটনাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। মহিম সবচেয়ে অবাক হয়ে গেল যে ব্রাহ্মদের সুরেশ দেখতে পারত না সেই ব্রাহ্ম পরিবারের দুঃখে সে আর্থিক সাহায্য করেছে। তাই সে বারবার সুরেশের কাছে এর যথার্থ কারণ জানতে চাইল। মহিমের কথার উত্তর দিতে না পেরে সুরেশ তা এড়িয়ে যাবার জন্য খুব সুচতুর ভাবে বাড়ী যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। সুরেশ এরপর জানায় যে এইসবের স্পষ্ট উত্তর সে কেদারবাবুর কাছে পেয়ে যাবে। মহিম তখন বলে যে এইসব উত্তর তার শোনার খুব কৌতূহল ছিল কিন্তু কেদারবাবুর অপেক্ষায় বসে থাকবার তার এখন সময় নেই। তাই মহিম কেদারবাবুকে অপেক্ষা না করে বাড়ী চলে গেল। মহিম যেতে যেতে বাইরে অচলাকে দেখতে পেল কিন্তু তারা উভয়েই কথা বলল না।

মহিম কতকগুলি জরুরি ঔষধ কিনে নিয়েই রাতের গাড়িতেই বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সুরেশ মহিমের বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখে যে সে আর সেখানে ফিরে আসেনি। সুরেশ একদিন বিকেলবেলা কেদারবাবুর বাড়ীতে চা খেতে খেতে এইসব খবর নিয়েই আলোচনা করতে লাগল। কিন্তু সেই সময়েই দুর্গ্রহের মতো ধীরে ধীরে মহিম আসিয়া অকস্মাৎ ঘরের কাছে দাঁড়াইল। মহিমকে লক্ষ্য করে তারা সকলেই মুখ তুলে চাইল এবং সকলের মুখের ভাবে একটা পরিবর্তন দেখা দিল। কেদারবাবু বিরস মুখে প্রায় জোর করেই একটু হেসে মহিমকে অভ্যর্থনা করলেন। এতদিন বাড়ীতে থাকার কারণ কেদারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে মহিম জানায় যে বাড়ীতে তার বিশেষ কাজ ছিল। সুরেশ এরপর মহিমকে চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। একথার উত্তর মহিম দেওয়ার পূর্বেই অচলা জানিয়ে দেয় সে চা খায় না। অচলার মহিমের ব্যপারে কথা বলাটা সুরেশ খুব ভালোভাবে দেখেনি। কিন্তু মনে মনে সে দুঃখ পেয়েই চুপচাপ থেকে গেল। মহিমের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে অচলা যে কতটা সচেতন তা আমরা লক্ষ্য করতে পারি। এর দ্বারাই আমরা অনুমান করতে পারি মহিমকে সে অন্তর থেকে কতটা ভালবাসত। চা খাওয়ার পর তাদের আজ সকলের বায়োস্কোপ দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তাই কেদারবাবু অচলাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বলেন। কিন্তু অচলা সঙ্গে সঙ্গে জানায় যে আজকে সে বায়োস্কোপ দেখতে যাবে না। অচলার মুখে এই কথা শুনে কেদারবাবু আশ্চর্য হয়ে যায়। অচলার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে সুরেশের মনে অভিমান হয়ে যায়। কিন্তু তখনকার মতো সব অভিমান ও ক্রোধকে সুরেশ সংযত করে নেয়। তাই সে অচলাকে পুনরায় যাবার জন্য অনুরোধ না করে কেদারবাবুকেই নিয়ে যেতে চায়। তারা উভয়েই অনুমান করে যে অচলার হয়তো শরীর খারাপ হয়ে থাকবে। যার জন্য সে যেতে চাইছে না। একথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে অচলা বলে তার শরীর ঠিকই আছে। এই অবস্থায় কেদারবাবু অস্বস্তিতে পড়ে নানারকম কৌশল খুঁজে অচলার না যাবার কারণ খুঁজতে থাকে। কিন্তু অচলা তার কোন অসুবিধাকেই মেনে নিতে চায়নি। অচলার এই রকম আচরণ দেখে কেদারবাবু রেগে গিয়ে অচলাকে তাদের সঙ্গে যাবার জন্য জোর করতে থাকে। বাবার এই উগ্রমূর্তি দেখে অচলা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কেদারবাবুর এই আচরণ দেখে সুরেশ বিরক্ত হল এবং যাবার জন্য অনুমতি চাইল। কারণ অচলাকে জোর করে রাজী করাতে সুরেশ ইচ্ছুক ছিল না। কেদারবাবু এরপর নিজের অভদ্র আচরণে মনে মনে লজ্জিত হল এবং সুরেশের কথায় রাগ করলেন। কিন্তু সেই রাগটা স্বয়ং সুরেশকে দেখাতে না পেরে তা তিনি মহিমের উপর রাগ দেখালেন। মহিমের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে কেদারবাবু জানায় যে তারা এখন ব্যস্ত আছে তাই এখন সে এখান থেকে যেতে পারে। তাকে পরে এসে কথা বলার জন্য জানায়। মহিম এই কথা শুনে অপমানিত হয়ে বলে আপনার কি আমার সাথে বিশেষ কোন কাজ আছে? এই কথা শুনে কেদারবাবু বলে যে তার সাথে দু একটা বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। এই কথা শুনে মহিম বাড়ী চলে যায়।

সুরেশ ও কেদারবাবু এরপর বাইরে চলে গেলেন। সুরেশ কেদারবাবুকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। মহিম কিছুদূর যেতে পিছন থেকে একটি ডাক শুনতে পেল। তখন সে পিছন ফিরে দেখে যে অচলাদের বাড়ীর বেয়ারা তাকেই ডাকছে, তাই সে এই ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বেয়ারা এসে মহিমকে জানায় আপনাকে দিদিমণি একবার তার কাছে যেতে বলল। এই কথা শুনে মহিম অচলার কাছে ফিরে এলো। মহিমকে কাছে পেয়ে অচলা বলে - “তুমি কি তোমার কসাই বন্ধুর হাতে আমাকে জবাই করবার জন্য রেখে গেলে? যে তোমার উপর এতবড় অকৃতজ্ঞতা করতে পারলে, তার হাতে আমাকে ফেলে যাচ্ছো কি করে?”২৭ এই কথা বলেই অচলা মহিমের কাছে ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। অচলার এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি সে সুরেশকে কতটা ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখত। সে মহিমকে এই কথা বলে নিজের দুঃখকে কিছুটা হলেও লাঘব করার চেষ্টা করে। তাছাড়া মহিমকে সে একটু সচেতন হয়ার জন্য আবেদন করে। অচলা তারপর তার ডানহাতটি টেনে নিয়ে নিজের আঙুল থেকে সোনার আংটিটি খুলে তাহার আঙ্গুলে পরিয়ে দিল। এই আচরণ দ্বারা অচলা বোঝাতে চাইল যে, সে মহিমের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে দিল। মহিম যেন কোন অবস্থাতেই তাকে ভুলে না যায় তাই আংটিটি স্মৃতি হিসাবে তার কাছে থাকবে। অচলা এরপর মহিমের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে একটি নমস্কার করে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে চলে গেল। মহিম কোন কথা বলতে না পেরে চুপচাপ বাড়ী ছেড়ে চলে গেল। মহিম পথ চলতে চলতে সুরেশের পূর্ব আচরণের কথা অনুমান করতে পারল। কেদারবাবু যে টাকার লোভেই সুরেশকে এতটা আপন করে তুলেছেন তা বুঝতে মহিমের মনে কোন সংশয় দেখা দেখা দিল না। সুরেশ যাকে ভালোবাসে তাকে পাওয়ার জন্য সে কি যে দিতে না পারে তা মহিমের খুব ভালভাবেই জানা ছিল। তাই কেদারবাবুর সাথে সুরেশের এতদুর সম্পর্কের কারণ তার জানতে বাকি রইল না। এত বাধা বিরুদ্ধ ভেদ করে অচলা যে আবার তার কাছে ফিরে আসতে পারবে এটা মহিম বিশ্বাস করতে পারল না। স্মৃতিস্বরুপ অচলার দেওয়া সোনার আংটির দিকে চেয়েও মহিমের কিছুমাত্র সান্ত্বনা লাভ হল না। তাই মহিমের মন ছটফট করতে লাগল। সে মনে করল এই ব্যাপারটা একটা স্থায়ী সমাধান তাড়াতাড়ি করা দরকার। তাই সে সিন্ধান্ত নিল যা হবার তা হক, কিন্তু এই সমস্যার চরম একটা মীমাংসা খুব তাড়াতাড়ি প্রয়োজন। মহিম এইজন্য এর সমাধানের জন্য প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য মহিম কেদারবাবু বাসায় গেলেও বাড়ীতে কাউকে দেখতে পেল না। তাই খালি হাতেই মহিমকে ফিরতে হল। কিন্তু সে এত সহজে হার মানবার পাত্র নয় তাই পরের দিনই আবার সে কেদারবাবুর বাড়ীতে যায়। কেদারবাবুকে নমস্কার করে ঘরে ঢুকতেই সে দূরে দেখতে পেল খোলা জানালার ধারে একটা সোফার উপর পাশাপাশি বশে আছে অচলা ও সুরেশ। তারা তখন উভয়েই একটি ছবির বই নিয়ে দেখিতেছিল। কেদারবাবু মহিমের কাছে প্রথমেই তার আর্থিক অবস্থার কথা জানতে চায় এবং এনিয়ে তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতেও ছাড়েনি। কেদারবাবু মহিমকে নানারকম উপদেশ দিতে থাকে। এইসব শুনে মহিম ভিতরে ভিতরে খুব অসহিষ্ণু হয়ে উঠে। কেদারবাবু এরপর সুরেশ ও অচলাকে এইঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে অনুরোধ করে। কারণ সে মহিমের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে একাকী আলোচনা করতে চায়। কেদারবাবুর কথা শুনে সুরেশ উঠে পড়লেও অচলা কিন্তু এখান থেকে যেতে রাজী হল না। অচলা তার বাবাকে সরাসরি জানিয়ে দেয় যে তার এখানে থাকাটা খুব প্রয়োজন। অচলার এই আচরণে সুরেশের রাগ হয় এবং সে তাই এই ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যায়। নিজ কন্যার এই আচরণে কেদারবাবুও খুশি হলেন না কিন্তু মনকে সংযত করে চুপ করে গেলেন। কেদারবাবু মহিমকে এখন কোন দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে নিষেধ করলেন কারণ তাতে সে অকর্মণ্য হয়ে যাবে। নিজের উন্নতি সাধন করে কৃতী হয়ে দায়িত্ব নেবার পরামর্শ দেয় কেদারবাবু। মহিম এই কথা শুনে বলে যে আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য, কিন্তু আপনার কন্যার কি তাই ইচ্ছা? কেদারবাবু এরপর মহিমের অসহায়তার কথা বলে, এজন্যই সে তার মেয়েকে মহিমের হাতে তুলে দিতে রাজী নয়। এইসব নিয়ে আলোচনা করে মহিম ও কেদারবাবুর মধ্যে বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মহিম কেদারবাবুর মমতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জানায় সে অচলার নিজস্ব মতামত না জেনে সে এই সিদ্ধান্ত থেকে এক পা নড়বে না। এই কথা শুনে অচলা কোন কথা বলতে পারে না। মহিম উদগ্রীব হয়ে অচলার কাছে এর উত্তর জানতে চাইল। এরই মধ্যে সুরেশ প্রবেশ করে তার এক পরিচিত বন্ধুর প্লেগ রোগের আক্রান্তের খবর জানায়। সেই বন্ধুর উদ্দেশ্যে তাকে এখুনি ছুটে সেখানে যেতে হবে। তাই সুরেশ সেখানে যাবার সময় মহিমকেও যাবার জন্য একবার অনুরোধ করে। মহিম সেখানে যেতে না চাইলে সুরেশ তাকে যথেষ্ট ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে। মহিমের ঐ অপমান অচলা মেনে নিতে পারেনি বলে, সে সুরেশকেও এর পাল্টা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে ছাড়েনি। মহিমের যে ঐ প্লেগ রোগীর কাছে যাওয়া হবে না তাও অচলা দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দেয়। অচলার ঐ কথা শুনে সুরেশের মুখ কালিবর্ণ হয়ে গেল। অচলার এই রুঢ় আচরণে তার পিতা মনে মনে আশঙ্কিত হয়ে পড়লেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুরেশ ও অচলার মধ্যে তর্কবিতর্ক এমন জায়গায় পৌঁছায় যা অভাবনীয়। অচলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে মহিমের উপর তার একটা অধিকার আছে। তাই তার ভালো মন্দ বিচার করে অচলা। এইজন্যই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মহিম ঐ প্লেগ রোগীর কাছে সে কিছুতেই যেতে দিতে পারে না। সুরেশকে যে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না তাও অচলা জানাতে কোন দ্বিধাবোধ করেনি।

সুরেশ এরপর অচলার কাছে তার সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট ভবে জানতে চায়। অচলা জানিয়ে দেয় সে তাকে কোন দিন মেনে নিতে পারবে না। এটাই তার স্থির সিদ্ধান্ত। এই কথা শুনে সুরেশ রেগে গিয়ে কেদারবাবু ও অচলাকে অশ্রাব্য কথা বলতে শুরু করে। তাদের তিনজনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা যেন রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। কেদারবাবুর টাকা ধার নেওয়ার জন্য সে যথেষ্ট কথা শোনায়। সুরেশের এই কথা শুনে কেদারবাবু ও অচলা খুব দুঃখ পেয়ে ভেঙ্গে পড়ে। কেদারবাবু সুরেশের এইরূপ দেখে অবাক হয়ে যায়। সুরেশ যে এত খারাপ হতে পারে কেদারবাবু কোনদিন ভাবতেও পারেনি। কেদারবাবু ও অচলাকে যতরকম ভাবে অপমান করা যায় তাই করে সুরেশ সেখান থেকে চলে গেল। মহিম এই ঘটনার কোন খবরই পেল না। কেদারবাবু বাধ্য হয়ে অবলীলাক্রমে কন্যার সঙ্গে মহিমের বিবাহের সম্মতি দিলেন। অচলার প্রতি স্নেহে, প্রেমে, কৃতজ্ঞতায় মহিমের সমস্ত হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। মহিম চিরদিনই নিঃশব্দ প্রকৃতির লোক তাই সে আবেগ উচ্ছ্বাস কোনদিন প্রকাশ করিতে পারে না। কেদারবাবু মন স্থির করলেন যে মেয়ের বিয়েতে কোনরকম ধূমধাম হৈচৈ করবেন না। তাই তিনি শুভকর্মের আয়োজন যতটা নিঃশব্দ হইতে পারে, তাহার ত্রুটি করেন নাই। সুরেশ যে হঠাৎ এসে আবার কোন কাণ্ড ঘটাতে পারে সেই দুশ্চিন্তা কিন্তু কেদারবাবুর মনে রয়ে গেল। অচলা হঠাৎ সংবাদপত্রে সুরেশের খবর দেখে এবং পিতাকে সেই খবরের কথা আগ্রহের সঙ্গে জানায়। পিতা ও কন্যা সংবাদপত্রে সুরেশের মহৎ কাজের খবর পেয়ে আনন্দিত হয়। তখন কেদারবাবু অনুমান করে যে সেদিন সুরেশ তাদের সাথে ঐ রকম খারাপ ব্যবহার করার পর অনুতপ্ত হয়েই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু অচলা তার পিতার কথাকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করতে পারল না। অচলা পিতাকে বলে যে পরকে উপকার করা তার একটা স্বভাব তাই সে মুমুর্ষ রোগীর সেবা করার জন্যই সেখানে চলে গেছে। পরের বিপদে ঝাপিয়ে পড়া যে তার এটা কোন নতুন ঘটনা নয় সে কথাও অচলা পিতাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই অচলা পিতাকে খুশি করার জন্যই তার মতকেই মেনে নেয়। সুরেশের এই মহৎ কাজের পরিচয় পেয়ে কেদারবাবুর মনে সুরেশের প্রতি পুনরায় আস্থা জেগে উঠে। যার জন্য তাদের পূর্বের সমস্ত বাদ-বিবাদের কথা ভুলে যায়। কেদারবাবু সুরেশের প্রতি সৌজন্যের জন্য অচলাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে খবর নেওয়ার কথা বলে। বাবার এই মতামতে নিজেই উৎসাহী হয়ে যখন অচলা টেলিগ্রামের জন্য কাগজ আনতে যায়, ঠিক সেই সময়েই সামনেই সুরেশকে দেখতে পায়। সুরেশের শুষ্ক, শ্রীহীন চেহারা দেখে অচলা চমকে যায়। অচলা তখন সুরেশের কাছে তার কুশল সংবাদ জানতে চায়। অচলার সামনে পূর্বের কৃতকর্মের কথা ভেবে সুরেশ লজ্জিত হয়ে পড়ে। তাই সুরেশ আর্তকণ্ঠে অচলাকে জিজ্ঞাসা করে তার আচরণের জন্য তাকে সে মাফ করতে পেরেছে কিনা? উত্তরে অচলা ওষ্ঠাধারে একটুখানি হাসির সঙ্গে বলে সে প্রয়োজন তার হয় নি। অচলার মুখে এই কথা শুনে সুরেশ খুশি হয়। অচলা এরপর সুরেশকে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে যায়।

সুরেশ কেদারবাবুকে বলে যে মহিমের পত্রে বিবাহের সংবাদ শুনেই সে তাড়াতাড়ি এখানে চলে এসেছে। সুরেশের এই কথা শুনে কেদারবাবু লজ্জায় চঞ্চল হয়ে উঠলেন। কিন্তু অচলার মুখের ভাবে তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। সুরেশ এরপর ফরজাবাদের বিপদ সংকুল ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ দিতে লাগল। সেখানে তার যে কোন বিপদ হয়নি তাও কেদারবাবুকে জানায়। কিন্তু হঠাৎ সুরেশের ক্ষতের ব্যান্ডেজটি পড়ে যাওয়ায় তা দেখে কেদারবাবু চমকে উঠেন। তৎক্ষণাৎ ঐ ব্যান্ডেজটি তুলে অচলা সুরেশের ক্ষতে নিজে বেন্ধে দেয়। অনেকদিন পর কেদারবাবুর বাড়ীতে এসে ভদ্র ব্যভহার পেয়ে সুরেশ মনে খুব শান্তি পেল। অচলা ও মহিমের বিবাহ খুব ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেল। বিবাহ সভায় সুরেশকে এক পলকের জন্য দেখা গিয়েছিল কিন্তু তারপর আর দেখা গেল না। বিয়ের পর অচলা স্বামীর সঙ্গে স্বামীর গ্রামের বাড়ীতে এসে উপস্থিত হল। অচলা এই প্রথম কোন পল্লীগ্রাম নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেল। পালকি থেকে নেমে পল্লীগ্রামের মেটে বাড়ীর খড়গুলো, স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার দরজা যে এতই সংকীর্ণ ক্ষুদ্র – উপরে বাঁশের আড়া ও মাচা এত কদাকার ইহা অচলা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। এইসব গৃহে জীবন যাপন করিতে হইবে উপলব্ধি করে তার বুক যেন ভেঙ্গে গেল। স্বামীসুখ, বিবাহের আনন্দ সমস্তই একমুহূর্তে মায়া মরীচিকার মত তার হৃদয় থেকে বিলীন হয়ে গেল। অচলার শ্বশুর বাড়ীতে স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না। তাই পাড়ার এক ঠানদিদি এসে বরবধূকে বরণ করে চলে গেল। মহিম যে কোথায় চলে গেল তাকে দেখতে না পেয়ে অচলা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। জীবনের সমস্ত স্বাদ গন্ধ তার অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যার সময় মহিম মৃণালকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ী ফিরে এল। মৃণাল অচলাকে দেখে তার রূপের প্রশংসা করতে লাগল। মৃণাল ঠাট্টা তামাশা করতে খুব ভালবাসত। মৃণাল যেহেতু পাড়াগাঁয়ের একজন সহজ সরল মেয়ে তাই তার ঠাট্টা তামাসার মধ্যে কোন রহস্য ছিলনা। মৃণাল তাই মহিমকে ঠাট্টা করে বলে – “আমাকে বিয়ে করলে ঠকে মরতে ভাই।”২৮ মৃণালের এই ঠাট্টা শুনে মহিম বিরক্ত প্রকাশ করে।

মৃণাল এরপর নববধূ অচলাকেও ঠাট্টা করতে বাদ দেয়নি। অচলাকে ঠাট্টা তামাসা করে মৃণাল বলে যে মহিমের সাথে তার বিয়ে হবার কথা ছিল কিন্তু মা ষড়যন্ত্র করে তাদের এই বিয়ে সম্পূর্ণ হতে দেয়নি। যার জন্য তাকে একজন বুড়োর সাথে ঘর করতে হচ্ছে তা সে অচলাকে অকপটে জানায়। অচলা যেন তাকে সতীন ভেবে রাগ না করে একথাও বলতে ভোলেনি মৃণাল। এইসব ঠাট্টা তামাসা করে সমস্ত ঘরটা আলো করে মৃণাল দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। এইসব হাসি ঠাট্টার সঙ্গে অচলার কোন পূর্ব ধারণা ছিল না। তাই মৃণালের সব পরিহাসই তার কাছে কাঁটার মতো বিঁধতে লাগলো। যার জন্য লজ্জায় সে একেবারে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। এতবড় নির্লজ্জ প্রগলভতা যে কোন স্ত্রীলোক পৃথিবীতে থাকতে পারে তা অচলা কোনদিন ভাবতেও পারেনি। কিন্তু তবুও তাহার মনে হইতে লাগিল ইহার আগমনে তাহার নির্বাসণের অর্ধেক বেদনা যেন দূর হয়ে গেল। মৃণালের পরিচয় এবং মহিমের সঙ্গে তার সম্বন্ধ জানার জন্য অচলা উৎসুক হয়ে উঠল। মৃণাল নিজেই তার পরিচয় অচলার কাছে জানায়। মৃণালের পরিচয়ে অচলার মনে নানারকম রহস্যের সৃষ্টি হয়। যদিও মৃণালের ঠাট্টা তামাসা শুনে অচলার তাকে ভালো লেগে যায়। মৃণাল যে ঠাট্টা তামাসায় খুব পারদর্শী তা নিজেই অচলার কাছে স্বীকার করে নেয়। উত্তরে অচলা তাকে জানায় যে এইসব ঠাট্টা তামাসা কোন ভদ্রমহিলা উচ্চারন করতে পারেনা। অচলার এই কথাতেও মৃণাল কিন্তু কোন লজ্জিত হল না। কিছুক্ষণ মেলামেশার পর মৃণাল অচলাকে ছোট বোন হিসাবে মেনে নেয়। এই পল্লীগ্রামে তার ভবিষ্যৎ জীবন যে কেমন অতিবাহিত হবে তা অচলা এই বাড়ীতে পা দিয়েই অনুমান করতে পারে। তাই সে নিজের একাকীত্ব দূর করার জন্য মৃণালের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। মৃণাল এরপর অচলাকে জিজ্ঞাসা করে পূর্বে সে মহিমের এইসব কথা জানত কিনা? তখন অচলা জানায় মহিমের এইসব কথা আমাকে আগে না বলার জন্য আমি মহিমের প্রতি আশ্চর্য বোধ করছি। অচলা এরপর মহিমের সাথে মৃণালের বিয়ের ব্যপারে স্পষ্ট করে জানতে চায়। মৃণাল সেই সময় অন্যমনস্কতার জন্য তাদের বিয়ের কথা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করে। মৃণালের এই দুরকম কথার জন্য অচলার মনে রহস্যের ডানা বাঁধে এবং আরো বেশি জটিল হয়ে যায়। অচলা তখন মৃণালকে বলে তোমাদের দুইজনের বিবাহ হলেই বোধহয় ভালো হত। অচলার এই কথা শুনে অনুমান করা যায় যে এই ব্যপারটি নিয়ে কতটা গভীরে চিন্তা করে। অচলার এই কথা শুনে মৃণালের মনে আঘাত লাগে। সে তখন অচলার মুখের প্রতি চোখ তুলে বলে সেই বিয়ে ভাগ্যে ছিল না বলেই বোধহয় হয়নি। এই বিয়েতে তাদের বাধার কারণ জানতে চায় অচলা। অচলার প্রশ্নের ধরন শুনে মৃণাল হঠাৎ চমকে যায়। আসলে অচলা যে এই ব্যাপারটি সত্য বলে মেনে নিবে তা মৃণাল ভাবতেও পারেনি। মৃণাল তাই অচলাকে আস্বস্ত করার জন্য তার মুখের দিকে চেয়ে বলে তুমি এসব ব্যাপার নিয়ে কি উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছ? মৃণালের সব ঠাট্টা তামাসা গুলোকে যে অচলা অতি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে তা মৃণাল এবার বুঝতে পারে। তাই মৃণাল অচলাকে স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসের মনোভাব ত্যাগ করার জন্য উপদেশ দেয়। মৃণালের এই উপদেশের দ্বারা তার পাতিব্রত্যের যথার্থ চিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে।

অচলার এই অসহায়ত্ব বোধ করে মৃণাল তাকে একেবারে আপন করে নিল। মৃণাল তাই অচলাকে সমাজের আচার আচরণ কর্তব্য সম্বন্ধেও উপদেশ দিতে লাগল। মৃণাল তাই অচলাকে ঘর পরিষ্কার করতে বলল কিন্তু তাতে তার দাসীরা আপত্তি জানায় এবং সেই কাজ তারা নিজেরা করতে চায়। মৃণাল দাসীদের এই আচরণে বিরক্ত হয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিতে থাকে। মৃণালকে খুশি করার জন্য অচলা সঙ্গে সঙ্গে ঘর পরিষ্কার করার জন্য নিজের হাতে ঝাঁটা তুলে নেয়। অচলার এই ব্যবহারে মৃণাল খুশি হয়ে যায়। তাই এরপর মৃণালের সঙ্গে অচলার হাসি ঠাট্টা চলতে দেখা যায়। মৃণাল অচলাকে পুনরায় উপদেশ দেয় যেদিন সে স্বামী পুত্র ঘরকন্না নিয়ে নাবার খাবার সময় পাবে না, শুধু তখনি তো এই মেয়ে মানুষ জন্মটার যথার্থ সার্থক হবে। তাই মৃণাল অচলাকে আশীর্বাদ করে যেন সে স্বামীপুত্র, ঘরসংসার নিয়ে সুখে জীবনযাপন করতে পারে। মৃণালের উপস্থিতি অচলা ও হরির মাকে একাকীত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি দেয়। মৃণাল অচলার সাথে হাসি ঠাট্টা করতে করতে বাড়ী যাবার কথা বারবার বলতে থাকায় অচলার মনে ভারি পীড়া দিতে লাগল। কারণ মৃণালের কাজে, কথায়, আচারে ব্যবহারে এতবড় একটা সহজ আত্মীয়তা ছিল, যার আড়ালে স্বছন্দে দাঁড়াইয়া অচলা উঁকি মারিয়া তাহার নতুন জীবনের অচেনা ঘর কন্নাকে চিনে নেবার সময় পেয়েছিল। এর চেয়েও মৃণালকে তার ভাল করে ও বিশেষ করে চিনে নেবার সময় পেয়েছিল। মৃণালের সাংসারিক অবস্থা যে ভালো ছিল না, তা তার সম্পূর্ণ অলংকার বর্জিত হাত দুখানির দিকে চাইলেই অনুমান করা যায়। মৃণালের জীবনের কোন প্রতিকুলতাই যে দুঃখ দিয়া তার জীবনযাত্রার পথে অবসন্ন করে বসিয়ে দিতে পারে না। হৃদয়ের আনন্দ নিরানন্দ ছাড়া বাইরের কোন কিছুর যেন অস্তিত্ব নাই- এমনি এই সহজ সরল মূর্খ পাড়া গাঁয়ের মেয়েটার ভাব। মৃণালের সংস্পর্শে বেশ কয়েকদিন থাকিয়া অচলা বেশ বুঝতে পারছিল যে পদ্ম যেমন পাঁকের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াও সমস্ত মলিনতার অতীত, ঠিক তেমনি যেন এই লেখাপড়া না জানা দরিদ্র পল্লীলক্ষ্মীটিও সর্বপ্রকার সাংসারিক দুঃখ দরিদ্রের ক্রোড়ে অহোরাত্র বাস করেও সমস্ত বেদনা – যন্ত্রণার উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। মৃণালের না আছে দেহের ক্লান্তি, না আছে মুখের শ্রান্তি। অনবরত সে নানারকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। সুতরাং অচলাকেও সে সকল অনভস্ত্য কাজের মধ্যে অবিশ্রান্ত টেনে নিয়ে চলেছিল। অচলা সব কাজে অনভস্ত্য হলেও কিন্তু কোন কাজে অনীহা দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। অচলা এটাকে বড় লজ্জা বলে মনে মনে বোধ করত।

এখান থেকে মৃণালের বাড়ী যাবার কথা শুনে অচলা তাকে তামাসা করে বলে - “বাপের বাড়ী এসে কে এত শীঘ্র ফিরে যায় বল তো? তা হবে না – আমি যতদিন না কলকাতায় ফিরে যাব, ততদিন তোমাকে থাকতেই হবে।”২৯ অচলার এই কথা শুনে মৃণাল তার সাংসারিক দুঃখের কাহিনী সব স্পষ্ট করে তাকে জানিয়ে দেয়। বৃদ্ধ স্বামী ও অসুস্থ শাশুড়ির সেবা করতে করতে যে তার প্রান ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছে তা মৃণাল দুঃখের সঙ্গে অচলাকে জানায়। তাছাড়া তার শাশুড়ির যে তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে তাও মৃণাল অসংকোচে জানিয়ে দেয়। মৃণাল যে পৃথিবীতে কোন মানুষকে ভালবাসতে পারে না একথা অচলা বিশ্বাস করতে পারে না। মৃণাল এখান থেকে যাই যাই করতে করতে আরো কিছুদিন এখানে কেটে যায়। এই দেখে অচলা বুঝতে পারল যে যাবার দিকে তার মুখে যত তাড়া, কাজের দিকে তত নয়। এখান থেকে চলে যেতে তার যে মন চায় না তা অচলা বুঝতে পারে। তাই অচলার মৃণালের পূর্বের ঠাট্টা তামাসা গুলি সত্যি মনে হতে শুরু করে। মহিমের প্রতি আর যে একটা দূর্বলতা আছে তা অচলার মনে সন্দেহ হয়। এখানে এসে মৃণালের সাথে মহিমের হাসি ঠাট্টার কথা শুনে অচলার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠেছে, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে সূচ ফুটতে লাগল। অচলা তার মনকে যতই এইসব ঘটনা মিথ্যা বলে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে কিন্তু তখনই কোথা হইতে সংশয়ের বিপরীত তর্ক তাহার হৃদয়ের মধ্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারবার মুখ তুলে তাহাকে ভেংচাইতে থাকে। মহিমের অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য এইখানে যেন অতিশয় বাড়াবাড়ি বলে অচলার মনে হয়। তার মনে হয় যে ভিতরে যদি কোন কারনেই নেই তবে মহিম মৃণালের তামাসাকে মেনে নিতে অস্বীকার করছেই বা কেন? অচলা লক্ষ্য করে মৃণালের রহস্যলাপের সুত্রপাতের মহিম লজ্জিত মুখে কোনমতে তাড়াতাড়ি অন্যত্র পালিয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। মহিমের এই আচরণ দেখে অচলার মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয় যেটাকে সে কোন মতেই মন থেকে দূর করতে পারে না। অচলার তখন মৃণালের এখানে পড়ে থাকার জন্য কোন গোপন সম্পর্কের কথা মাথায় আসে। তার মনে হয় নিশ্চয়ই মহিমের প্রতি মৃণালের একটা দূর্বলতা আছে তাই সে তাকে ছেড়ে নিজের ঘর যেতে চাইছে না। মৃণাল রান্না করে নিজের হাতে মহিমকে খাবার দিত এটা অচলা আর মেনে নিতে পারছিল না। তাই সে মৃণালকে রান্না করা থেকে মুক্তি দেবার কথা বলে নিজে রান্না করতে চাইল। কারণ এই অধিকার যে পরহস্তের থেকে কেড়ে নিয়ে নিজ হাতে নিতে চাইল।

অচলার রান্না করার আগ্রহ দেখে মৃণাল প্রথমে নানা অজুহাতে তাকে বাধা দিতে লাগল । কিন্তু দৃঢ়চেতা অচলা মৃণালের কোন যুক্তিকেই গুরুত্ব দিল না। অচলার নিজ হাতে রান্না করার আগ্রহের কারণ মৃণাল কিছুই বুঝতে পারল না। তাই সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ে মৃণাল হাসি চাপিয়া কৃত্রিম অভিমানের সুরে ঘাড় নাড়িয়া বলিল - “বা রে মেয়ে। একে একে বুঝি তুমি আমার সব কেড়ে নিতে চাও?”৩০ মৃণালের এই কথা শুনে অচলা তাদের মধ্যেকার গোপন সম্পর্কের যে রহস্য তা আরো বেড়ে যায়। মৃণাল নিজেকে বারবার সতীন বলে পরিচয় দেওয়াতেই অচলার বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় ব্যাথায় সজোরে ঘা দিল। তাই অচলা এক মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে সংক্ষেপে বলল সে আজকে নিজের হাতে রান্না করবেই। এই কথা শুনে মৃণাল বুঝতে পারল যে অচলার খুব রাগ হয়েছে। তাই সে বেশি তর্কবিতর্ক না করে বিষণ্ণ মুখে একটুখানি চুপ করে থাকে। মৃণাল পরক্ষণে অচলাকে রান্না করতে অনুমতি দিয়ে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলল। তাদের এই তর্কবিতর্কের সময় মহিম যে ঘরেই আছে তা তারা উভয়েই ভুলে গিয়েছিল। তাই তারা উভয়েই তাকে দেখে অপ্রতিভ হয়ে গেল। মহিম তখন অচলাকে জানায় মৃণাল এখানে যে কয়েকদিন আছে সেই রান্না করুক, এতে তার আপত্তি কেন? অচলা যে কেন মৃণালকে রান্না করতে নিষেধ করেছিল তার কারণ মহিমের জানা ছিল। কিন্তু সে কথা মহিম স্পষ্ট করে বলতে পারিল না। মহিমের এই কথা শুনে অচলার মন আরও জ্বলে উঠল এবং তার সন্দেহ উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। কিন্তু অচলা রাগ চেপে বলল সে রাঁধতে যাচ্ছে বলেই এই বাদানুবাদ। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে একপ্রকার জোর করেই রান্না করতে চলে গেল। অচলা রান্না করতে খুব ভালো জানলেও কিন্তু মনে দুশ্চিন্তার জন্য মন দিয়ে তা করতে পারল না। অচলার মনে অনবরত একটা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। তাই তার বিগত দিনের সমস্ত ঘটনা নড়তে চড়তে কেবলই খচখচ করে বিঁধতে লাগল। তখন তার মনে সংকোচ বোধ হয় যে মহিম তাকে কোনদিনই তেমন করিয়া ভালোবাসিতে পারে নাই। তার বিবাহের পূর্বে সুরেশকে নিয়ে যে সংঘর্ষ উপস্থিত হয়েছিল তা খুঁটিয়া খুঁটিয়া মনে করিয়া আজ সহসা সে যেন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেল, যে মহিম তার প্রতি চিরদিনই উদাসীন। এমনকি পিতার অভিমতে যখন তার সুরেশের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক হয়েছিল তখনও মহিমকে সে কোন বিচলিত হতে দেখে নি। এইসব চিন্তা ভাবনা করে অচলা স্থির সিন্ধান্ত নিল যে মহিম তাকে কখনই মন থেকে ভালবাসতে পারেনি। এইসব চিন্তা ভাবনা করে অচলার মন বিচকিত হয়ে পড়ে। খবার সময় মৃণাল খাবার খেতে আসেনি, তাই দেখে অচলা তার খোঁজ করতে যায়। মৃণালের কাছে গিয়ে অচলা জানতে পারে যে তার জ্বর হয়েছে। মৃণালের জ্বর আসার কথা অচলা বিশ্বাস করে না। তাই সে ভাবে যে মৃণাল রাগের জন্য খেতে চাইছে না। একথা মৃণালকে অচলা সরাসরি জানিয়েও দেয়। মৃণাল তখন তার স্বামীর দিব্য দিয়ে প্রমান করার চেষ্টা করে যে সে রাগ করে নাই।

অচলা এরপর মৃণালের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলল তা খুবই রুঢ় প্রকৃতির কিন্তু মৃণাল তাতেও কোনকিছু মনে করল না। মৃণাল যে ব্রাহ্ম মেয়ের হাতে খেতে চায় না একথা বলতেও অচলা দ্বিধাবোধ করল না। অচলার এইসব কথা শুনে মৃণাল হত বুদ্ধির মত স্তব্ধ হয়ে যায়। খানিক পরে মৃণালের সে ভাব কেটে গেলেও নির্বাক হয়েই বসে রইল। মৃণালের শাশুড়ি অতিশয় শুচিবাই প্রকৃতির মহিলা, তাই সে বিশ্বাস করে মৃণালের রান্না করা খাবার খায়। এই জন্য মৃণালের মনে সংকোচ হয় সে যদি জানতে পারে যে মৃণাল অন্য ধর্মের হাতে ছোঁয়া খাবার খেয়েছে তবে তিনি তার হাতে আর জলস্পর্শ করবে না। এই কারণের জন্যই মৃণাল অচলার রান্না করা খাবার খেতে চাইছিল না। অচলা এই কথা জানতে পারলে পাছে দুঃখ পায় তাই সে একথা প্রকাশ না করে কৌশলে তা এড়িয়ে যায়। কারণ অচলা যদি একথা সত্য জানতে পারত তবে তার মুখ দিয়া কোন কথা উচ্চারন হইত না। মৃণালের কাছ থেকে অচলা চলে গিয়ে রান্না ঘরের কাজকর্ম করে শুয়ে পড়ল। মৃণাল ও অচলা বাকবিতণ্ডার ফলে তাদের উভয়েই সেইদিন দুপুর বেলা না খেয়ে অভুক্ত অবস্থায় থেকে গেল। বিকেলবেলায় মৃণাল হঠাৎ বাড়ী যাওয়ার সিন্ধান্ত নিল। তাই মৃণাল যাওয়ার পূর্বে অচলাকে নমস্কার করতে যায়। কিন্তু পূর্বের ঝগড়ার জেরে তার সাথে অচলা কোন কথা বলল না। সেখান থেকে মৃণাল এরপর মহিমের কাছে গিয়ে জানায় সে যেন আর একবার তাকে এখানে নিয়ে আসে। মহিমের সাথে সাক্ষাৎ করেই মৃণাল দুঃখ নিয়েই স্বামীর ঘরে চলে যায়। মৃণালের হঠাৎ চলে যাওয়াতে অচলা অবাক হয়ে যায়। তাই সে মনে মনে খুব দুঃখ পায়। মহিম উত্তেজিত হয়ে অচলাকে জানায় মৃণালের সঙ্গে যে তোমার বনিবনাও হবে না, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ মৃণালের সাথে কোনদিন কারো ঝগড়া হয় নি। মহিমের কথা শুনে অচলা রেগে গিয়ে বলে আমার সঙ্গে যে পাড়া সুদ্ধ লোকের চিরকাল ঝগড়া হয় তাই বা কে বললো? মহিমের কথাতে অচলা যে কতখানি রেগে গিয়েছিল তা আমরা তার এই কথার মধ্য দিয়ে অনুমান করতে পারি। এইসব কথা বাদ দিয়ে মহিম এরপর অচলার অভুক্ত থাকার কারণ জানতে চাইলে অচলা সঙ্গে সঙ্গে রেগে জ্বলে যায়। অচলা তখন মহিমকে ইঙ্গিতে জানাতে চায় সে তার চেয়ে মৃণালকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। একথা শুনে মহিম যেন আকাশ থেকে পড়ল। অচলা মহিমকে একথা জানাতেও দ্বিধাবোধ করে না যে সে জেনে শুনেই তাকে মৃণালকে দিয়ে অপমান করেছে। কারণ অচলার ধারণা মহিম নিশ্চয়ই জানত যে মৃণাল তার হাতের ছোঁয়া খাবার খেতে চাইবে না। তাই অচলা তার এই অপমানের জন্য মহিমকেই দায়ী করে। অচলা ও মহিমের নববিবাহিত জীবনে মৃণালের আবির্ভাবের পর থেকেই তাদের মধ্যে একটা অবিশ্বাস বোধ কাজ করে। মৃণালের উপস্থিতিতে তার মুখে মহিমকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা শুনে অচলার মনে স্বামী সম্পর্কে একটা রহস্য ডানা বাঁধে। যা তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা বিশাল অশান্তির সৃষ্টি হয়। এই জন্যই তাদের দাম্পত্য কলহের চিত্র আমাদের চোখে ধরা পড়ে। মহিমের সাথে মৃণালের সম্পর্কের কথা ভেবে অচলার মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মহিম অচলাকে তাদের এই সম্পর্কের কথা স্পষ্টভাবে কিছু জানায় নি। এই জন্যই অচলার মন আরো জটিল হতে শুরু করে। যা তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য অনেকখানি দায়ী। মহিম যদি স্পষ্টভাবে তাদের সম্পর্কের কথা আচলাকে জানিয়ে দিত, তাহলে হয়তো অচলা এতখানি ভেঙ্গে পড়ত না। পরিবর্তে যখনি সেই কথা উঠেছে তখনি মহিম যেন সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। মহিমের এই আচরণে অচলার সন্দেহ আরও বেশি জোরালো হয়।

উপন্যাসের ষোড়শ পরিচ্ছেদে হঠাৎ আমরা দেখতে পাই মহিমের গ্রামের কুঁড়ে ঘরে সুরেশের আবির্ভাব। কিছুক্ষণ আগে অচলা ও সুরেশের মধ্যে যে বাদানুবাদের কথা চলছিল তার কিছুটা অংশ সুরেশ বাইরে থেকেই শুনেছিল। অচলার রুঢ় ব্যাবহারের ইঙ্গিত সে বাইরে থেকেই প্রায় সবই শুনে। তাই সুরেশ অচলা সম্পর্কে মহিমকে সচেতন করে দেয়। সুরেশের মুখে এইসব কথা শুনে মহিম লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। সুরেশ এরপর মহিম ও অচলার সম্পর্ক সম্বন্ধে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে দ্বিধাবোধ করেনা। কিছুক্ষণ পর অচলা হঠাৎ দরজা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করে হাসিমুখেই সুরেশের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। অচলার প্রফুল্ল হাসিমুখে সুখসৌভাগ্যের প্রসন্ন বিকাশ কল্পনা করে সুরেশের বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় জ্বলিয়া উঠিল। কারণ দাম্পত্য জীবনে মহিম ও অচলা সুখে থাক এটা সুরেশ মন থেকে কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সুরেশ অচলার কাছে তাদের পূর্বে ঝগড়ার কারণ জানতে চাইল। অচলা তখন সুরেশের মুল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পেরে তাকে বিদ্রুপ করে। অচলার মুখে রুঢ় কথা শুনে সুরেশ গম্ভীর হয়ে গেল। সৌজন্যের আচরণে তাদের উভয়ের শ্লেষের এই সকল প্রচ্ছন্ন ঘাত প্রতিঘাতে মনে মনে মহিম খুব অধীর হয়ে গেল। কি করিয়া তাদের মধ্যে এই ঘাত প্রতিঘাত বন্ধ করবে তা মহিম চিন্তা করতে পারল না। অচলার সঙ্গে তর্কে পরাস্ত হয়ে হঠাৎ সুরেশই তার প্রতিকার চেয়ে হাত জোড় করল। মহিমের বাড়ীর দুরাবস্থার কথা টেনে এনে সুরেশ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। অচলা সহ্য করতে না পেরে তার যথার্থ উত্তর কড়া ভাষায় শুনিয়ে দেয়। অচলার সাথে কোন কথাতেই পেরে না উঠে একসময় সুরেশ চুপচাপ হয়ে যায়। অচলা সেখান থেকে চলে যেতেই সুরেশের বুকের জ্বালাটা যেন বেড়ে গেল। সুরেশ মহিমের গৃহে প্রবেশ করতেই তাদের নব দম্পতির কলহের যে সুচনা হয়েছিল তা তাকে সাময়িক মনের শান্তি দিলেও তা কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারল না। যার জন্য সুরেশ ভিতরে ভিতরে জ্বলে যেতে লাগল। অচলার বিয়ের পর সুরেশ নিজেকে আত্মসংযম করে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার মনে হয় আত্মসংযম তার সত্য বস্তু নয়, এটা তার আত্মপ্রতারণা। তাই এক সপ্তাহ না কাটিতেই এই মিথ্যা সংযমের মোহ তার বিস্ফারিত হৃদয় হইতে ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হয়ে তাকে সম্পূর্ণ রূপে সংকুচিত করে আনতে লাগল। মন তাহার বারবার বলিতে লাগল যে এই স্বার্থ ত্যাগের ফলে সে নিজে কি পেল?

সুরেশ তাই পীড়িত মন নিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনকে অভিশাপ দিতে লাগল। সে মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল যে তাদের দাম্পত্য জীবনে যেন তারা কেউই সুখী না হয়। তাই সে তাদের দাম্পত্য জীবনের চিত্র দেখার কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে অবশেষে মহিমের ঘরে এসে উপস্থিত হল। সুরেশ এরপর শান্তশিষ্ট মহিমকে তার সামাজিক অবনতির কথা স্মরণ করে দিতে লাগল। সমাজের সাথে তার যে কোন বিরোধ দেখা যায় নি একথা মহিম অকপটে জানিয়ে দেয়। উত্তরে সুরেশ জানায় সমাজের কোন ব্যাক্তি যে তার বাড়িতে খেতে আসেনি এটা কি যথেষ্ট অপমানকর নয়? তখন মহিম জানায় যে কোন ব্যাক্তিকে সে খাবার জন্য নিমন্ত্রণই করেনি। তাই তাদের আসার কোন কথাই উঠে না। তাদের বউভাতের অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ না করার জন্য সুরেশ যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করে। মহিম তখন জানায় যে যেহেতু তাদের বউভাতের কোন অনুস্থানেই তারা করেনি, তাই সেখানে নিমন্ত্রণের কথা আসে না। দুই বন্ধুতে এই নিয়ে তীব্র বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। সুরেশ চাই যে কোন ইস্যু তৈরি করে মহিমের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তাকে বিড়ম্বনায় ফেলা। তাই মহিম সুরেশের প্রশ্নগুলি খুব সতর্ক ভাবে শুনে শান্ত মাথায় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। এরপর মহিম টিউশন পড়ার জন্য যেতে চাইল। কিন্তু অচলা সুরেশকে বিশ্বাস করত না বলে মহিমকে আজ সেখানে যেতে নিষেধ করল। কারণ একাকী অচলাকে পেয়ে সুরেশ যদি কোন খারাপ ব্যবহার করে বসে। কারণ পূর্বের অভিজ্ঞতায় অচলার এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। অচলা যে সুরেশকে মনে মনে খুব ভয় করত তা সে প্রকাশ না করে বলে যে অতিথিকে ফেলে রেখে তোমার আজ যাওয়া হবে না। মহিম তখন অচলাকে জানায় যে তাতে অতিথি সৎকারের কোন অসুবিধা হবে না, কারণ তুমি তো রইলে। মহিমের কথার উত্তরে অচলা বলে সে অতিথিকে ঠিকঠাক সময় দিতে পারবে না কারণ রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। অচলার শত বাধা সত্ত্বেও মহিম দৃঢ়চেতা মন নিয়েই পড়াতে চলে গেল। মহিমের এই আচরণ নিয়ে সুরেশ অচলার অসম্মানের কথা মনে করিয়ে দেয়। অচলা নিজেও বুঝতে পারে যে মহিম তার অনুরোধ কোনদিনই শোনে না। সুরেশের উপস্থিতিতে তার এই অপমান আরও বেশি করে মনে আঘাত দিতে লাগল। রাত্রে শোবার ঘরে মহিম অচলার কাছে জানতে চায় যে সুরেশ এখানে কতদিন থাকবে? এই কথা শুনে অচলা নিমেষে জ্বলে উঠল। কঠোর কণ্ঠে অচলা স্বামীর কাছে একথা বলার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। অচলার মুখে এই কথা শুনে মহিম অবাক হয়ে যায় কারণ সে সোজা ভাবেই কথাটির উত্তর জানতে চেয়েছিল, তাতে কোন রহস্যের আবরণ ছিল না। মহিমের প্রশ্নের ধরনে অচলা মনে করেছিল যে মহিম তাদের দুজনের পুরানো সম্পর্কের কথা হয়তো এখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই অচলা স্বামীর সংকীর্ণ মনোভাবের প্রশ্ন শুনেই রেগে গিয়েছিল। স্বামী স্ত্রীর বোঝাপড়ার অভাবে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি আমরা লক্ষ্য করতে পারি।

সকালে মৃণালের সাথে এবং পরে সুরেশের ব্যঙ্গবিদ্রূপের জেরে অচলার মন ভালো ছিল না। তারপর আবার স্বামীর মুখে অবিশ্বাসের কথা শুনে অচলা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল। এইসব চিন্তা করে সেই রাত্রে অচলার ঘুম আসল না। তাহার মনের মধ্যে সারাদিন যে বিরক্ত উত্তরোত্তর জমা হয়ে উঠতেছিল, সামান্য একটা কলহের আকারে তা বাহির হয়ে যেতে পারলে সে হয়ত নিজেকে সুস্থ বোধ করত। কিন্তু এমন করে তার মুখ বন্ধ করে দেওয়ায় সে নিজের মধ্যেই শুধু অন্তরদগ্ধ হয়ে পুড়তে লাগল। এইসব ঘটনা কল্পনা করে অচলা নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে গভীর রাত্রি পর্যন্ত বিনিদ্র থেকে ছটফট করতে লাগল। সকালে উঠে অচলা বাইরে এসে দেখে সুরেশ বহুক্ষণ পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া ঘরের সমস্ত জানালা খুলে একখানা চেয়ার টেনে কলেজের বইখানি পড়ছে। অচলাকে দেখে সুরেশ অনুমান করতে পারে যে সারারত্রি তার ঘুম হয়নি। অচলার চোখের নিচে কালি পড়িয়াছে, গণ্ড পাংশু, ওষ্ঠ মলিন – সে যত দেখতে লাগল ততই তাহার দুই চক্ষু ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হতে লাগল। কিন্তু দৃষ্টি কিছুতেই ফেরাতে পারল না। সুরেশের চাহনির ভঙ্গিতে অচলা বিস্মিত হইল কিন্তু এর অর্থ কিছুই বুঝতে পারল না। অচলা এরপর তার সাথে সৌজন্যমূলক বাক বিনিময় করল। তারপর সুরেশকে জানায় যে রাত্রে ঘুম না হওয়ায় নিজের পোড়া মুখ লোকের সামনে দেখাতে লজ্জিত মনে হয়। সুরেশ এই সুযোগে মহিমের কর্তব্যহীনতার কথা বলে অচলার মনকে বিষিয়ে দিতে চায়। কিন্তু অচলা তাতে তেমন কোন গুরুত্ব দেয় নি। সুরেশ তখন বুঝতে পারে যে অচলা তার কাছে সবকিছু গোপন করার চেষ্টা করছে। তাই অচলার কাছে সুরেশ স্পষ্ট করে কিছু জানতে চায়। সুরেশ সাহস পেয়ে এরপর অচলাকে জিজ্ঞাসা করে সে এখানে সুখে আছে কি? উত্তরে অচলা আরক্ত হয়ে জানায় যে এই প্রশ্ন করা আপনার উচিত হয়নি। আমি যে এখানে সুখে থাকতে পারি না একথা আপনার মনে হওয়াই অন্যায়। অচলার এই আচরণ সুরেশ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তাই সে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। সুরেশ তাই দুঃখের সঙ্গে অচলাকে বলতে পারে - “কেবল মাস দুই পূর্বে এ ভাবনা ভাবা শুধু যে আমার উচিত ছিল না তাই নয়, এ ভাবনায় অধিকার ছিল। আজ দুমাস পরে সব অধিকার যদি ঘুচে থাকে ত থাক, সে নালিশ করিনে এখন শুধু সত্যি কথাটা জেনে যেতে চাই। এসে পর্যন্ত একবার মনে হচ্ছে জিতেছ, একবার মনে হচ্ছে হেরেছ, আমার মনটা ত তোমার অজানা নেই- একবার সত্যি করে বলত অচলা কি?”৩১ সুরেশের মুখে এইসব কথা শুনে অচলার অশ্রুর ঢেউ পর্যন্ত ফেনাইয়া উঠল। কিন্তু প্রাণপণে তাহাদের শক্তি প্রতিহত করে অচলা বেগে মাথা নেড়ে বলল সে ভালো আছে। এরপর সুরেশের নিজের কথা বলে অচলার মন বোঝার চেষ্টা করে। অচলা সুরেশের সাথে তাদের পূর্বের কথা আলোচনা করতে বিরক্ত বোধ করে। অচলা তাই একসময় সেখান থেকে পালানোর কথা চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু সুরেশ অচলার এই মনোভাব অনুমান করে তার পালানোর পথ দুই হাত দিয়ে রুদ্ধ করে বলে যে তার সব কথা তাকে শুনতেই হবে। সুরেশের চোখে সেই দৃষ্টি দেখে অচলা শিউরে ওঠে। কিন্তু ভয়ে তার কথা সে শুনতে রাজী হয়। সুরেশ তখন অচলাকে জানায় যে তার ভয়ের কোন কারণ নেই সে তার গায়ে হাত দেবে না কারণ সেই জ্ঞানটা তার মধ্যে এখনো বর্তমান আছে।

তাই সুরেশ অচলাকে দৃঢ় ভাবে বলে - “আমি তোমার উপর সমস্ত অধিকার হারালেও, আমার উপর তোমার সমস্ত অধিকার বর্তমান আছে।”৩২ উত্তরে অচলা জানায় যে একথা মনে রেখে তার কোন লাভ নেই। একথা যেন সজোরে আঘাত করিয়া সুরেশকে পলকের জন্য বিবর্ণ করে ফেলল। সেই মুহূর্তে অচলা নিজেও অনুভব করল, অনুতাপের কথা তার নিজের পিঠের উপর সজোরে আসিয়া পড়িল। তাই ক্ষণকাল চুপ থেকে অচলা কোমল কণ্ঠে বলিল - “সুরেশবাবু, এসব কথা আমারও শোনা পাপ, আপনারও বলা উচিত নয়। কেন আপনি এসব কথা তুলে আমাকে দুঃখ দিচ্ছেন?”৩৩ অচলার এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে সে পূর্বের কথা ভুলে নতুন করে জীবনটাকে শুরু করতে চায়। অচলা যে কারও দুঃখ অনুভব করতে পারে তা নিয়ে সুরেশ সংশয় প্রকাশ করে। উত্তরে অচলা জানায় যে পাষাণ নয়, তাই তার মনে দুঃখ বিরাজ করে। অচলার এই কথা শুনে সুরেশ সন্তুষ্ট প্রকাশ করে। অচলার এই কথাকেই সে চিরজীবনের সম্বল করে বাঁচার রসদ খুঁজে পায়। সুরেশ তখন অচলার দুঃখের বোঝা বহন করতে সম্মত হয়। এই কথা শুনে অচলা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ ঘরে মহিম প্রবেশ করে। মহিমকে দেখে সুরেশ ও অচলা চমকে গেল। অচলা লজ্জায় পাশের ঘরে চলে গেল। কিন্তু মহিম কোন কিছু না বুঝতে পেরে হতবুদ্ধির মতো দাড়িয়ে রইল। মানবচিত্ত যে অবস্থায় সবার চেয়ে বেশি অসংকোচে ও অবলীলাক্রমে মিথ্যা উদ্ভাবন করতে পারে, সুরেশের তখন সেই অবস্থা। সে মহিমের কাছে তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চোখ মুছে হাসির সঙ্গে উদারভাবে স্বীকার করল সে সত্যিই ভারি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু মহিম তার জন্য কোন উদ্বেগ প্রকাশ করল না, এমনকি তার কারণ পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসা করল না। সুরেশ নিজেই এবার কেদারবাবুর মেয়ের প্রতি অভিমানের কথা মহিমকে বলতে থাকে। আসলে সুরেশ চাতুরী করে মুল ঘটনাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। মহিম কিন্তু সুরেশের এইসব কথা শুনতে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করে। তার জন্যই সুরেশের কথাকে কোন গুরুত্ব দিতে চায়নি। মহিম চলে যেতেই সুরেশ যেন এক লজ্জার মুখ থেকে হাঁপ ছেড়ে বেঁচে গেল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার অযাচিত জবাবদিহির সমস্ত নিস্ফলতা রাগে অভিমানে সারা শরীরে জ্বালা করতে লাগল।

মহিম ও সুরেশের কথোপকথনের সমস্ত বৃত্তান্ত অচলা আড়াল থেকে শুনেছিল। তাই অচলা মহিমকে জিজ্ঞাসা করিল যে - “আমার বাবা তোমার কাছে এমন কিছু গুরুতর অপরাধ করেছেন?”৩৪ এই প্রশ্নের কোন অর্থ বুঝতে না পেরে মহিম কোন উত্তর দিল না। তাই অচলা পুনরায় এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। মহিম তখন অচলাকে বলে কথাগুলোর অর্থ বোঝা তার পক্ষে কঠিন, তাই সে কোন উত্তর দিতে পারবে না। অচলার বাবার অসুখের খবরে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য মহিমের প্রতি যথেষ্ট রাগ করে অচলা। অচলার এই কথা মহিম কিছুতেই মানতে রাজী হয়নি। অচলার বাবার শরীর নিয়ে আলোচনা করায় তাদের স্বামী স্ত্রীর কথোপকথনে যথেষ্ট রাগ অভিমানের দৃশ্য দেখা যায়। এতে তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহ একটা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। অচলার বাবাকে মহিম গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য অচলার মনে খুব আঘাত লাগে। তাই সে বারে বারে মহিমকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। অচলা তখন মহিমের সাথে এ নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করতে চাইলে মহিম সরাসরি জানায় তার এখন সময় নেই। মহিমের ব্যস্ততা দেখে অচলা খুব রেগে যায়। কারণ সে চাইছিল যে মহিমের সঙ্গে বোঝাপড়া ভালোভাবে করে নিয়ে নিজের মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করবে। মহিম বাইরে চলে গেলে অচলা সুরেশর খবর নিতে তার ঘরে যায়। অচলাকে দেখেই সুরেশ অনুমান করতে পারে যে মহিমের সঙ্গে নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটিয়ে এসেছে। কিন্তু সুরেশ সাহস করে তার মনের কৌতূহল জিজ্ঞাসা করতে পারে না। সুরেশকে জামা কাপড় গোছাতে দেখে অচলা অবাক হয়ে যায় এবং কারণ জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে সুরেশ জানায় যে আজই তাকে বাড়ী ফিরে যেতে হবে। সুরেশের বাড়ী ফেরার কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। এতে অচলা কোন বাধা দেবার চেষ্টা না করে বরং তাকে এই কাজে সে সাহায্য করে। মহিমের সাথে সুরেশের কেদারবাবু সম্পর্কে যে আলোচনা হয়েছিল তা জানার জন্য অচলা সুরেশের কাছে কৌতূহল দেখায়। তখন সুরেশ ও অচলার এই নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হতে দেখা গেল। সুরেশ প্রথমে অনুমান করে যে মহিম বোধহয় এই ঘটনাটা সম্পর্কে অচলাকে সম্পূর্ণ জানায়। কিন্তু অচলা অকপটে জানায় যে মহিম তাকে কিছুই বলেনি, সে নিজেই লুকিয়ে তাদের কথা শুনেছে। সুরেশ মহিমকে একথা বলার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। অচলা তখন এর জন্য নিজের স্বার্থ দেখে সুরেশকে ক্ষমা চাইতে নিষেধ করল। অচলার ধারণা তার মঙ্গলের জন্যই সুরেশ এই কথাগুলি মহিমকে জানায়। সুরেশ যা করেছে তার জন্য অচলা তাকে সরাসরি সমর্থন করতে তার কোন দ্বিধা বোধ হয়নি।

সুরেশ যে এই লজ্জার জন্যই এখনি বাড়ী যেতে চাইছে তাই অনুমান করে অচলা তাকে আরও দুদিন থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। সুরেশের প্রতি অচলার মন যে কতটা বিহ্বল হয়েছিল তা অনুমান করা যায় যখন সে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারে - “বাড়ী আপনার বন্ধুর একার নয়, এর উপর আমারও তো কিছু অধিকার আছে। সেই জোরে আজ আমি নিমন্ত্রণ করছি, আমার অতিথি হয়ে অন্ততঃ আর কিছুদিন থাকুন।”৩৫ অচলার সাহস দেখে সুরেশ খুশি হয়ে গেল। অচলা যে তাকে অন্তর থেকে এতটা ভালোবাসে তা সুরেশ ভালোভাবেই অনুমান করতে পারে। এরই মধ্যে মহিম এসে অচলাকে ব্যাগ গোছানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে, অচলা কোন উত্তর দেয়নি। বরং সুরেশকেই লক্ষ্য করে পূর্ব প্রসঙ্গের সুত্র ধরে তার সাথে কথা বলতে লাগল। সুরেশ যে তার পরম আত্মীয় তাই তাকে আজ বাড়ী যেতে দেবে না বলে অচলা দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে দেয়। সুরেশের বাড়ী যাবার নিয়ে আলোচনা করেও অচলা ও মহিমের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদের কথা চলতে থাকে। অচলা ও মহিমের এই অশান্তি দেখে সুরেশ মনে মনে খুব খুশি হয়। তাই সে অচলার কথা শুনে আরও দুদিন এখানে থেকে যেতে সম্মত হয়ে যায়। মহিম ও অচলার দাম্পত্য কলহের জন্য আমরা এজন্য সুরেশকে দায়ী করতে পারি। সুরেশ যদি এই সময় তাদের মধ্যে উপস্থিত না থাকত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য কলহের সীমাটা এতটা অতিক্রম করত না। সুরেশ যদি তাদের দাম্পত্য জীবনের মঙ্গল আশা করত তাহলে অচলার কথা শুনে আরও সেখানে থেকে যেতে রাজী হয়ে জেত না। কারণ সুরেশই তাদের দাম্পত্য জীবনের অভিশাপ। তাই তার উপস্থিতি যে তাদের পক্ষে ভয়ানক তা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। রাত্রে অচলা ও মহিমের মধ্যে তর্ক বিতর্কের ফলে অচলাকে সুরেশের নিয়ে কথা বলে মহিম। এই কথা শুনে অচলা যথেষ্ট অপমানিত হয়। তাই সে মহিমকে সরাসরি জানিয়ে দেয় এত অপমান সহ্য করে সে মহিমের সাথে সংসার করতে পারবে না। এইজন্যই সে এখান থেকে তার বাবার কাছে চলে যেতে চায়। অচলার এই সিদ্ধান্তে আমরা যথেষ্ট অনুমান করতে পারি তদের দাম্পত্য জীবনে কলহের কতখানি তীব্রতা আকার নিয়েছে। অচলার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে মহিম ভয় পেয়ে যায়। তাই সে অচলাকে ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করে। সে বুঝতে পারে তাহলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। মহিম তাকে একথাও বলে সে যদি ভুল করে তাকে ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়ী চলে যায়, তবে কোনদিন তার ভুল ভাঙ্গে তখন সে তাকে জানাতে বলে, তাহলে সে সব অভিমান ভুলে তাকে তখনই নিয়ে আসবে। মহিমের এই কথা শুনে অচলার চোখ দিয়া একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। অচলা তাই মহিমকে জানায় মানুষের বারবার ভুল হয় না। তাই মহিমকে আর সে কষ্ট স্বীকার করতে হবে না। মহিম এরপর অচলার সঙ্গে কথায় পেরে না উঠে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। অচলা তখন রাগের বশে মহিমকে জানায় আমার সঙ্গে তুমি যদি তামাসা কর তাহলে ভুল করছ কারণ আমি কাল-পরশু এখান থেকে চলে যাব। মহিম তখন অচলাকে বলে আমি তোমাকে এখান থেকে যেতে দিতে চায়নি। মহিমের এই কথা শুনে অচলা রেগে গিয়ে বলে তুমি আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে এখানে ধরে রাখবে? সেটা তোমার দ্বারা কখনই সম্ভব হবে না।

অচলার এই কথা শুনে মহিম বলে কাল পরশু এখন অনেক দেরি আছে তাই তখন বিবেচনা করে দেখা যাবে। মহিম এই কথা অচলাকে বলে সেই সময় শান্ত করার চেষ্টা করে। এই নিয়ে জাতে আর বেশি আলোচনা না হয় তাই তাতে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে। পরদিন অচলার কাছে সুরেশ বাড়ী যাবার জন্য অনুমতি নিতে চাইলে উত্তরে অচলা তাকে বলে সেও কাল তার সাথে একসাথেই কলকাতায় ফিরে যাবে। অচলার হঠাৎ এই কথা শুনে সুরেশ অবাক হয়ে যায়। সুরেশ মনে মনে তাদের দাম্পত্য জীবনের একটা গভীর রহস্যের কথা চিন্তা করে। কিন্তু অচলা তাকে জানায় যে তার বাবাকে অসুস্থতার জন্য একবার দেখতে যাবে। সুরেশ কিন্তু অচলার এই সিন্ধান্তের কথা একটা রহস্যের অনুমান ক্রেতে পারে। সুরেশ মহিমকে জানায় সে আজই বাড়ী যাবে তাছাড়া সে অচলার কাল কোলকাতায় যাবার কথাও জিজ্ঞাসা করে। মহিম তখন রেগে গিয়ে তাকে আজই তার সাথে পাঠিয়ে দেবার কথা বলে। স্বামীর মুখে এই কথা শুনে অচলার খুব অভিমান হয় তাই সে সুরেশকে আজকের দিনটা থেকে যেতে অনুরোধ করে কারণ কালকে সে তার সাথেই কোলকাতায় যেতে চায়। স্ত্রীর ওদ্ধত্য দেখে সুরেশের মুখে বিবর্ণ হয়ে যায়। তাই সে মাথা হেট করে বলতে লাগল তার এখানে আর থাকার কোন প্রয়োজন নেই। সুরেশকে এই কথা বলতে শুনে অচলা ব্যাথিত হয়ে ওঠে। তাই অচলা কোনদিক লক্ষ্য না করে সুরেশকে বলিতে লাগল - “তোমার আমি কোন কাজেই লাগলুম না সুরেশবাবু, কিন্তু তুমি ছাড়া আর আমাদের অসময়ে বন্ধু কেউ নেই। তুমি বাবাকে গিয়ে বল, এরা আমাকে বন্ধ করে রেখেছে, কোথাও যেতে দেবে না,- আমি এখানে মরে যাবো। সুরেশবাবু আমাকে তোমরা নিয়ে যাও- যাকে ভালবাসিনে তার ঘর করবার জন্য আমাকে তোমরা ফেলে রেখে দিয়ো না।”৩৬ অচলার এই কথা শুনে সুরেশের খুব রাগ হয়। তাই সে মহিমকে বলে - “তুমি জানো মহিম, উনি ব্রাহ্ম মহিলা। নামে স্ত্রী হলেও ওর উপর পাশবিক অত্যাচার বলপ্রয়োগের তোমার অধিকার নেই।”৩৭ সুরেশের এই কথার প্রতিবাদ করে মহিম সঙ্গে সঙ্গে জানায় সে অচলার সে অচলার প্রতি কোনদিনই পাশবিক অত্যাচার করেনি। সে অচলাকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দিয়েছে একথাও নিঃসংশয়ে জানিয়ে দেয়। তাই সে সুরেশকে অনুরোধ করে কাল যেন সে সঙ্গে করেই অচলাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। বিকেল বেলায় অচলা ঘরে প্রবেশ করে টেবিলের উপর একটি ক্ষুদ্র চিঠি দেখতে পায়। চিঠিতে বার তারিখ উল্লেখ নেই কিন্তু মৃণাল কর্তৃক মহিমের যে এই চিঠি তা অচলা বুঝতে পারে। মৃণাল মহিমকে লিখেছে - “মেজদামশাই গো করছ কি? পরশু থেকে তোমার পথ চেয়ে চেয়ে তোমার মৃণালের দুটি চোখ ক্ষয়ে গেল যে।”৩৮ এই চিঠিটা পড়িয়া অচলার, মহিম ও মৃণালকে নিয়ে যে সন্দেহ ছিল তা আবার জোরালো হল। অচলার মনে সন্দেহ হল মৃণাল কেন মহিমের পথ চেয়ে বসে থাকার কথা বলে? এইজন্য মহিমের প্রতি অচলার যে অবশিষ্ট শ্রদ্ধাটুকু ছিল তাও এবার সব চলে গেল। অচলার মনে হয় মহিম মৃণালের প্রতি আকৃষ্ট বলেই, তাকে সে সহ্য করতে পারে না। তাই এই ঘটনার পর অচলার এখান থেকে কলকাতায় যাবার ইচ্ছাটা আবার জোরদার হয়। সুরেশের আশা পর্যন্ত এমনই একটা উৎকট ও অবিচ্ছিন্ন কলহের ধারা এ বাড়ীতে বয়ে চলেছিল যে তার সঙ্গে মাতামাতি করে অচলা বাকি সব ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু আজ মৃণালের দুই ছত্র চিঠি পড়ে আরো পুরান সংশয়কে নতুনভাবে তার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিল।

সেইদিন রাত্রে অচলা স্বামীর সঙ্গে অভিমানে জন্য একাকী দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। মহিম ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে অচলার দরজার সম্মুখে দাড়িয়ে দেখল, কপাট বন্ধ তাই ঠেলে দেখল তা ভিতর থেকে বন্ধ। মহিম তখন বার দুই ডেকে কোন উত্তর না পেয়ে তার শান্তি ভঙ্গ করার চেষ্টা করল না। কিন্তু অতি কঠিন পরীক্ষার দায় হইতে আপাততঃ ছুটি পেয়ে নিজেও যেন বেঁচে গেল। মহিম সেখান থেকে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু অচলার অভাব তার মনকে গভীরভাবে আঘাত করল যার জন্য তার ঘুম আসল না। সে তখন উঠে গিয়ে অচলাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসার জন্য চিন্তা করল। কিন্তু এইসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে হঠাৎ মহিম ঘুমিয়ে পড়ে। মহিমের ঘুম ভেঙ্গে গেলেও কিন্তু সে উঠতে পারল না। কারণ তার বাড়ীতে যে আগুন জলতে দেখে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সেই কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে তার মাথার ভিতর দিয়া সমস্ত পৃথিবী যেন খেলিয়া গেল। মহিম তখন এই অবস্থায় অচলাকে বাঁচানোর জন্য তার ঘরের দিকে ছুটে যায়। কারণ তখনও পর্যন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। মহিমের ঘরে এই আগুন কার দ্বারা লাগানো হয়েছিল তা আমাদের কাছে অজ্ঞাতেই থেকে যায়। মহিম এই আগুন লাগার ঘটনাটা নিরর্থক চেঁচামেচি না করে অসময়ে পাড়ার লোককে জাগানোর কথা চিন্তা করল না। কারণ মহিম বুঝতে পেরেছিল এই আগু আর বেশিদূর ছড়াতে পারবে না। মহিম অচলার ঘরটিতে আগুন লাগার সম্ভাবনা দেখে অচলার ঘরের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগল। ভিতর থেকে অচলা জানায় সে ভালো আছে। মহিম তখন অচলাকে ঘরে আগুন লাগার কথাটা জানিয়ে দেয়। ঘরে আগুনের কথা শুনে অচলা চিৎকার করে উঠে এবং তারপর সে আর কোন কথা বলতে পারে না। এই ভয়টাই মহিমের ছিল কারণ সে জানত যে ঘরে আগুন লাগা এর আগে অচলা কোনদিন দেখেনি। এই জন্যই আগুনের দৃশ্য দেখে অচলার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। সমস্ত ঘরে বিশাল আগুন দেখে অচলার সংজ্ঞা হারিয়ে যেতে লাগল। ঠিক সেই সময় মহিম জ্বলন্ত ঘরে হঠাৎ ঘরে ঢুকে গিয়ে মূর্ছিতা স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। মহিম এরপর বাড়ীর অন্য সকলকে সাবধান করার জন্য চিৎকার করতে লাগল। মহিমের চিৎকার শুনে সুরেশ পাংশু মুখে বাইরে বের হয়ে এল। অচলা তখন ভয় পেয়ে দুই হাত দিয়ে স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আগুন যখন বড় ঘরের চালে লাগল তখন মহিম অচলার গহনা গুলি উদ্ধারের জন্য যেতে চাইল। কিন্তু অচলা এই বিপদের মধ্যে তাকে সেখানে যেতে দিতে বাধা দিতে লাগল। অচলা তাই স্বামীকে বলে - “প্রতিশোধ নেবার এই কি সময় পেলে? কিছুতেই ওর মধ্যে তোমাকে আমি যেতে দেব না। যাক সব পুড়ে যাক।”৩৯

অচলার এই কথাটির মধ্য দিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে স্বামীকে সে খুব ভালবাসত। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার টানেই অচলা তাকে বাধা দেয়। কিন্তু দৃঢ়চেতা মহিম স্ত্রীর বাধা অতিক্রম করে সেই আগুনে মধ্যে ছুটে চলে গেল। এতক্ষণ পর্যন্ত সুরেশ স্থির ভাবেই দাড়িয়ে ছিল কিন্তু হঠাৎ সে এখান থেকে পালাবার জন্য প্রস্তুতি করতেই অচলা তার কোঁচার খুঁট ধরে ফেলে কঠোর কণ্ঠে বলে - আপনি কোথায় যাবেন? অচলার এই প্রশ্ন শুনে সুরেশ হতভম্ব হয়ে, সঠিক কোন উত্তর দিতে পারে নাই। অচলা তখন এই আগুন লাগানোর জন্য সুরেশকেই সন্দেহ করে। তাই অচলা দৃঢ়ভাবে সুরেশকে বলতে পার - “তিনি গেলেন তার জিনিস বাঁচাতে। আপনি কে? আপনাকে যেতে আমি কোনমতেই দেব না।”৪০ অচলার এই কথার মধ্যে স্নেহ, ভালোবাসার কোন স্থান ছিল না। এ যেন সে অনধিকারীর উৎপাতকে তিরস্কার করে দমন করে। মহিম অচলার সব গহনা গুলি উদ্ধার করে এসে অচলার পায়ের কাছে সেগুলি রেখে দেয়। পরের দিন সকালে স্বামীর মুখের প্রতি চেয়ে অচলার বুকের ভিতরটা হাহারবে কেঁদে উঠল। কারণ সে বুঝতে পারে তাকে সময়ে অসময়ে না বুঝে সে অনেক দুঃখ দিয়েছে। এইসব পূরানো কথা ভেবে অচলার প্রান আকুল হয়ে উঠল। গ্রামের লোক চারিদিকে ঘুরে ফিরে চেঁচামেচি করিতেছিল। তারা এইসব ঘটনা আলোচনা করে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সমালোচনা করতে লাগল। গ্রামের লোকের কিছুদূরে মহিম দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার পুড়ে যাওয়া ঘরের দিকে চেয়ে রইল এবং তা দেখে তার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। সমস্তই সে শুনতে পাচ্ছিল কিন্তু কৌতূহল বন্ধ করার মত মনের অবস্থা তার ছিল না। অন্য জাতীতে মহিম বিয়ে করেছে বলে এ নিয়ে গ্রামের লোকেরা নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে এবং এই বিপদের জন্য তাকেই তারা দায়ী করে। মহিমের এই ভুলের জন্য গ্রামের লোকেরা তাকে অচলাকে বাপের বাড়ী পৌঁছিয়ে দিয়ে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য জানায়। গ্রামের লোকের মুখে এই কথা শুনে মহিম সঙ্গে সঙ্গে রেগে যায় এবং যথেষ্ট প্রতিবাদ করে। মহিমের কথা শুনে গ্রামবাসীরা যা বলল তা মুখে উচ্চারণের যোগ্য নয়। অচলা এইসব কথাবার্তা শুনে বারবার কাঁদতে লাগল। মহিম অচলাকে বাড়ী যাবার জন্য ব্যবস্থা করলে অচলা কিন্তু মহিমকে ছেড়ে যেতে চায়নি। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার বন্ধনের জন্য অচলা তাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। অচলার কথা শুনে মহিম নিজে কোন সিন্ধান্ত গ্রহণ করতে না পেরে অচলাকেই পরামর্শ দিতে বলে। উত্তরে অচলা কিন্তু কোন ভালো উপদেশ দিতে পারে না। মহিম ও অচলা এখন কোথায় বসবাস করবে তা তারা সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অচলার মনে একবার সেই মুহূর্তে মৃণালের কথা মনে পড়ে কিন্তু লজ্জায় তা স্বামীর কাছে সে উচ্চারন করতে পার না। তাই অচলা মহিমকে তার সাথে কলকাতায় যেতে বলে। কারণ অচলা জানায় তোমার এখানে শুভানুধ্যায়ী লোকের বড় অভাব, তাই তোমাকে এখানে একা রেখে কিছুতেই যেতে পারব না। তাই অচলা স্বামীকে দৃঢ় কণ্ঠে জানাতে পারে - “আমার গলায় ছুরি দিলেও, এখানে তোমাকে একলা ফেলে রেখে আমি যেতে পারব না।”৪১ অচলার এই কথা শুনে তার মধ্যে আমরা গ্রাম বাংলার গ্রাম্য সতী লক্ষ্মী নারীর মতোই তাকে মনে হয়।

মহিমের ভিতরটা তোলপাড় করতে শুরু করল তাই সে কোন স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারল না। অচলা তখন তাকে বেশি ভাবনা চিন্তা করতে বারণ করে। অচলা বলে যে তার গয়না গুলো দিয়ে পশ্চিমে তারা একটা বাড়ী অনায়াসে কিনতে পারবে। স্বামীর সমস্ত ভার অচলা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। মহিম তখন অচলাকে জানায় সে এইসময় তার সাথে যেতে পারবে না। অচলা স্বামীর কথায় সম্মত হয়ে সন্ধ্যের সময় যেতে চায়। অচলা মনে মনে অনুমান করে যদি তার স্বামী তার সাথে না যায় তবে সে মৃণালের বাড়ীতে রাত্রি যাপন করবে। এই কথা মনে করে অচলার মুখশ্রী গম্ভীর ও বিবর্ণ হয়ে গেল। স্ত্রীর এই মনের সন্দেহ কিন্তু মহিম বুঝতে পারল না। মহিম তখন অচলাকে জিজ্ঞাসা করে সে কলকাতার কোথায় যাবে? উত্তরে অচলা বলে তার বাবার কাছে। একথা শুনে মহিম সেখানে যেতে সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে। অচলা তখন মহিমকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। অবশেষে সে তাকে বলে দু একদিন থেকে তার পশ্চিমে চলে যাবে। কিন্তু তাতেও রাজী হল না। অচলা জানত যে মহিম হল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একবার যা সিন্ধান্ত নেয় তার কোন পরিবর্তন হয় না। তাই অচলা বলে তাহলে তারা এখান থেকেই পশ্চিমে চলে যাবে। অচলা তার গয়না বিক্রির কথা বললে মহিম তাতে বাধা দেয়। মহিমের কথা শুনে অচলা একটা গুরুতর আঘাত ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর অচলা বলে কেন পারবে না তা সে জানতে চায়। কিন্তু মহিম কোন উত্তর না দেওয়ার জন্য উভয়েই তারা নিস্তব্ধ হয়ে রইল। এরপর অচলা রেগে গিয়ে স্বামীকে অনেকগুলো প্রশ্ন করে আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরল। মহিম তখন অচলাকে বলে - “তুমি যা দিতে চাচ্চো, তা নিতে পারলে আজ আমার সুখের সীমা থাকত না। কিন্তু কিছুতেই নিতে পারিনে। দুঃখ দেখে তোমার মতো আরও একজন আরও ঢের বেশি আমাকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেও যেমন দয়া, এও তেমন দয়া, কিন্তু এতে না তোমাদের, না আমার কারও শেষ পর্যন্ত ভালো হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।”৪২ এই কথা শুনে অচলা আর সহ্য করতে পারল না।অচলা কান্না ভুলে গিয়ে এর যথার্থ প্রতিবাদ করার জন্যই জ্বলন্ত চোখ দুটি উপরে তুলিবা মাত্র স্বামীর দিকে চেয়ে দেখতে পেল যে সেখান থেকে কিছুদূরে একটি নিমগাছের তলায় সুরে হাতে মাথা রেখে আকাসের দিকে মুখ তুলে চুপ করে পড়ে আছে। অচলা এই দৃশ্য দেখে কোন প্রতিবাদ করতে পারল না এবং উদ্ধত্য মাথা তার এমনিতেই নিচ হয়ে গেল। মহিম কিছুক্ষণ থেমেই বলল - “অচলা নিজেকে রিক্ত করে দান করবার অনেক দুঃখ, কিন্তু ঝোঁকের ওপর হয়ত তাই এক মুহূর্তে পারা যায়, কিন্তু তার ফলভোগ হয় সারা জীবন ধরে। আমি জানি একটা ভুলের জন্য তোমাদের মনস্তাপের অবধি নেই। আবার একটা ভুল হয়ে গেলে, তুমি না পারবে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে, না পারবে আমাকে মাফ করতে। এই ক্ষতি সইবার মতো সম্বল তোমার নেই, একথা আজ টের না পেতে পার, দুদিন পরে পারবে। তাই তোমার কাছ থেকে কিছুই আমি নিতে পারব না।”৪৩

মহিমের এই কথাগুলি শুনে হয় যে অচলার পূর্বের সমস্ত অভিযোগগুলি তার মনকে বিচলিত করে তুলেছিল। তাই মহিম হয়ত পূর্বের ভুল আর করতে চায়নি বলেই এই সিন্ধান্ত নেই। স্বামীর মুখে এই কথাগুলি শুনে অচলার বুকের ভিতর বিঁধিল। স্বামী যে তাকে এখনো আপন করে নিতে পারেনি একথা অনুমান করে অচলা। এর জন্য সে মৃণালকে দায়ী করে তার স্মৃতিতে রাগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তাই অচলাও এবার মহিমকে কঠিন কণ্ঠে বলতে পারে – “তুমি এতক্ষণ ধরে যা বোঝাচ্ছ সে আমি বুঝেছি। হয়ত তোমার কথাই সত্যি নয়ত তোমার মুখ দেখে দয়া হওয়াতেই আমার যথা সর্বস্ব দিতে চেয়েছিলুম। হয়ত দুদিন পরে আমাকে সত্যি এরজন্য আমাকে অনুতাপ করতে হতো, সব ঠিক, কিন্তু দ্যাখো অপরের মনের ইচ্ছে বুঝে নেবার মত যত বুদ্ধিই তোমার থাক, তোমাকে বুঝিয়ে দেবার জিনিস আছে। স্ত্রীর জিনিস জোর করে নেওয়া তো দুরের কথা, হাত পেতে নেবার সম্বল তোমারই বা কি আছে? আর তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না। এতুকু বুদ্ধি যে এখনো তোমাতে বাকি আছে, আজ থেকে তাই আমার সান্ত্বনা। কিন্তু যেখানেই থাকি, একদিন না একদিন তোমাকে সব কথা বুঝতেই হবে। হবেই হবে।”৪৪ অচলা এই কথাগুলি বলে হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে কান্না বন্ধ করতে লাগল। ঘরে আগুন লাগার পর থেকে সুরেশ নিজেকে অপরাধী মনে করে কারও সাথে তেমন ভাবে কথা বলতে পারল না। রাত্রের ট্রেনে অচলা ও সুরেশকে স্টেশনে ছাড়তে গেল মহিম। মহিম ও অচলার মধ্যে গয়না নেওয়াকে কেন্দ্র করে যে কথাবার্তা হয় তাতে তাদের উভয়ের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝির একটা পরিচয় আমরা লক্ষ্য করি। মহিম ও অচলার দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই আমরা তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির জন্যই অশান্তি হতে দেখা যায়। মহিমের দৃঢ়চেতা মনোভাবের জন্যও অচলা তাকে আপন করে নিতে পারেনি। মৃণালের ঠাট্টা তামাসায় মহিমকে কেন্দ্র করে তার যা কথা সে সব শুনে মনে গভীর সন্দেহ দেখা যায়। উপন্যাসে আমরা অচলার দোলচল প্রবৃত্তির জন্যও তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের চিত্র দেখতে পাই। এইসব কারণের জন্যই উভয়ের মধ্যে দাম্পত্য জীবন একদিনের জন্যও সুখের হতে পারেনি। যা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে - “অচলা মহিমকে আঁকড়ে ধরতে পারনি, সুরেশকেও প্রত্যাখান করতে পারেনি। সে মৃণালকে সব কথা যথাসময়ে বলতে পারেনি- শুধু মৃণালকেই নয়, যথাসময়ে কোন কথা ঠিক ভাবে ঘোষণা করতে না পারার ফলেও অচলার আচার আচরণ –কথাবার্তায় সমঞ্জস্য হারিয়ে গেছে।”৪৫ মহিম ও অচলার দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য আমরা প্রধানত অচলাকেই দায়ী করতে পারি। কারণ দোলাচল প্রবৃত্তির জন্যই তাএর দাম্পত্য জীবনে কোনদিন সুখের হতে পারেনি। অচলা এর দ্বারা শুধু নিজের জীবনকেই শেষ করেনি বরং সাথে সাথে মহিম ও সুরেশের জীবনের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। অচলা এই দুই পুরুষকেই একসাথে নিয়ে চলতে গিয়েই সব অশান্তির সৃষ্টি হয়। অচলা কিন্তু তার ভুল কখনো শোধরানোর চেষ্টা করেনি। যা উপন্যাসটিকে একটি ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। মহিম ও অচলার দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য সুরেশও কম দায়ী নয়। নব দাম্পতি যখন বিয়ে করে গ্রামের বাড়ীতে চলে যায়। বিয়ের সাতদিনের মধ্যে প্রতিহিংসা পরায়ণ মন নিয়ে সুরেশ সেখানে উপস্থিত হয়। সেইসময় ঐখানে যদি সুরেশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা না যেত তবে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবনের অবস্থাটা এতটা শোচনীয় হত না। কারণ সুরেশের উপস্থিতি সেখানে আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করেছে। তাই সুরেশের জন্যই অচলা মন দিয়ে ঘর সংসার করতে না পেরে তার সাথে কলকাতায় ফিরে যেতে চেয়েছে। উপন্যাসের মধ্যে এইসব নানারকম কারনেই আমরা অচলা ও মহিমের দাম্পত্য জীবনে কলহের চিত্র খুঁজে পাই।




তথ্যসূত্র

১৮. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (পঞ্চম খণ্ড), সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯, প্রথম আনন্দ সংস্করণ ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-২২৭
১৯. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড), অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯, দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা-৪৩৫
২০. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৫
২১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৬
২২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯
২৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪১
২৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৮
২৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৯
২৬. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড),অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯, দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা- ৪৬০
২৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪৬৩
২৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪৮০
২৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪৮৫
৩০. ঐ পৃষ্ঠা-৪৮৬
৩১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৪
৩২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫
৩৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫
৩৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৬
৩৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৮
৩৬. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড), অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯,দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা- ৫০২
৩৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫০২
৩৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৩
৩৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৮
৪০. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৮
৪১. ঐ পৃষ্ঠা-৫১০
৪২. ঐ পৃষ্ঠা-৫১১
৪৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫১১
৪৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫১১
৪৫. বাংলা উপন্যাসের কালান্তর, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং,কলকাতা-৭৩, সপ্তম সংস্করণ নভেম্বর ২০১৬, অগ্রহায়ণ ১৪২৩, পৃষ্ঠা-১৯৩