** আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত **

কিছু কথা....

আপনাদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করতে হলে লেখাটি আমাকে ইমেইল করুন। আমি সেটা নির্দিষ্ট বিভাগে, আপনার নাম দিয়ে প্রকাশ করবো।

আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?

!! আমার ব্লগের সাথে যুক্ত থাকুন !!

ইমেইল এর মাধ্যমে সমস্ত পোষ্টের নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য, নিচের ফাঁকা ঘরে আপনার ইমেইল এড্রেস লিখে ‘সাবস্ক্রাইব’ বাটন-এ ক্লিক করুন।

Thursday, July 19, 2018

‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)



‘চোখের বালি’ রবীন্দ্রনাথের এক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এখানে ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্র বিশ্লেষণে লেখক অনন্যপূর্ব গভীরতা ও কৌশল দেখিয়েছেন। এই প্রতিভা দক্ষিণহস্তের সুধাভাণ্ডে সুধার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও বামকরের বিষভাণ্ডও একেবারে শুন্য নয়। আশার পাতিব্রত্য, রাজলক্ষ্মীর পুত্রস্নেহ, অন্নপূর্ণার সাত্ত্বিকতা, বিহারীর উন্নত হৃদয় – এই মাধুর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে বিনোদিনীর বিলাসলীলা ও মহেন্দ্রের নগ্ন দূর্বলতার একটু তিক্ত রসও গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। অতিভোগে চোখের বালির আরম্ভ, অবসাদ ও উচ্ছৃঙ্খলতা এর দ্বিতীয় অবস্থা, প্রকৃত মাধুর্যে এর শেষ। এই জন্যে রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু সত্ত্বেও চোখের বালি ট্র্যাজেডি হতে পারেনি। ট্র্যাজেডি নয় বলিয়া এই উপন্যাসে করুণ রসের অভাব নাই। মহেন্দ্র আশাকে ত্যাগ, রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু, বিহারী ও বিনোদিনীর একক জীবন এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র ঘটনায় এই উপন্যাসের করুণাধারা প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ফল্গুধারার মতো বহমান। এই রচনায় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সম্পর্কে যথেষ্ট পরিপক্কতা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই উপন্যাস সম্পর্কে বলেন – ‘এই প্রথম আঁতের কথা বলিলাম।’ উপন্যাসে প্রধান চরিত্র মহেন্দ্র – বিহারী – আশা – বিনোদিনী এরা পরস্পরের মধ্যে মানসিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে কতকটা স্বভাবের তাড়নায়। বিনোদিনী বিধবা, আশা বিবাহিতা – এই দুই নারীতত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেছেন আশ্চর্য কৌশলে। সাহিত্যের যৌনতাকে ডেকে আনার জন্যে রবীন্দ্রনাথ সমাজ থেকে যথেষ্ট নিন্দাবাদ শুনেছিলেন। তবুও একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, চোখের বালি মানুষের অন্তর্জীবনের এক অভ্রান্ত দলিল। এই উপন্যাসে দাম্পত্যের মধ্যে যে কলহ বা অশান্তি আছে সেই চিত্রগুলি আমরা খোঁজার চেষ্টা করব।

উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পাই, মহেন্দ্রের মা রাজলক্ষ্মী তার ছেলের সাথে বিনোদিনীর বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মহেন্দ্র এই বিয়েতে প্রথমে রাজী হয় না। তখন রাজলক্ষ্মী ঐ একই প্রস্তাব বিহারীকে দেয় এবং বিহারীও ঐ প্রস্তাবকে স্বীকার করে না। তখন রাজলক্ষ্মী তার জন্মভূমি বারাসাতের গ্রাম সম্পর্কীয় এক ভ্রাতৃস্পুত্রের সঙ্গে উক্ত কন্যা বিনোদিনীর বিবাহ সম্পন্ন করলেন। কিছুদিন পর বিনোদিনী বিধবা হল। মহেন্দ্র এত বেশি মাতৃভক্ত যে সে বিয়ে করতে চায় না। কারণ তার ধারণা যে বিয়ে করলে বউ এসে তাদের মাতা-পুত্রের সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে দেবে। মাতা রাজলক্ষ্মী বিয়ের সম্বন্ধে পুত্রকে খুব একটা জোরও করতেন না। এই বিষয়ে রাজলক্ষ্মী ও মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার মধ্যে তর্কাতর্কি হয়ে বাদানুবাদ হয়ে যায়। মহেন্দ্র তার কাকিমা অন্নপূর্ণাকে খুব মান্য করত। মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার একটি পিতৃ-মাতৃহীন বোনঝি ছিল। অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের সঙ্গে তার বোনঝির বিবাহ দিয়ে কোনো সূত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে নিজের কাছে আনিয়া সুখী দেখতে চান। যদিও মহেন্দ্র বিবাহে নারাজ, তবু কাকির এই মনোগত ইচ্ছাটি তার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলে মনে হত। মহেন্দ্র অন্নপূর্ণাকে জানায়, যে বিহারীকে সে তার বোনঝির সঙ্গে বিবাহে রাজী করিয়ে দিয়েছে। তাই মেয়ে দেখিবার দিন ঠিক করার জন্য অনুরোধ করল। অন্নপূর্ণা এই কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। কারণ বিহারীকে সে খুব ভালভাবেই জানতেন। বিহারীকে অন্নপূর্ণা নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। এরপর একদিন মহেন্দ্র ও বিহারী অন্নপূর্ণার ঐ বোনঝিকে দেখতে গেল। মেয়ে দেখার পরেই সঙ্গে সঙ্গেই বিহারী তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যায়। কারণ বিহারী মেয়ে দেখার আগেই মনে মনে এই বিয়েতে রাজী হয়ে গিয়েছিল অন্নপূর্ণা দেবীর সম্মানার্থে। কারণ অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতই ভক্তি করতো। মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে যখন মেয়েটি তাদের জন্য পান সেজে নিয়ে এল, তখন সেই অবকাশে মহেন্দ্র ঐ কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখে নিল। এই অনাথিনীকে দেখে মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগল। তাই সে অনাথিনীর দিকে আর একবার ফিরে চাইল। এই অনাথিনী মেয়েটির নাম আশালতা। মেয়েটিকে দেখার পর মহেন্দ্র মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তাই মহেন্দ্র ব্যঙ্গচ্ছলে বিহারীকে বলে সে আমাকে বিয়ে করবে। বিহারী তখন বলে – “তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন – তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”১ এই কথাগুলি শুনে আমাদের মনে হয় যে বিহারী মহেন্দ্রকে অন্তর থেকে কতটা ভালবাসত। সে নিজের প্রিয় জিনিসও যে তৎক্ষণাৎ বন্ধুর জন্য ত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু মহেন্দ্র তখন বিহারীকে জানায় সে তার সাথে মসকরা করছে। সেই দিন সারারাত্রি মহেন্দ্র মনে মনে আশাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করল এবং কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। যাইহোক আশাকে দেখার পর তার উপর মহেন্দ্রের যে একটা দূর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই পরের দিন সকালে মহেন্দ্র বিহারীকে কাকিমার দোহায় দিয়ে অপ্রত্যক্ষ ভাবে আশাকে বিয়ে করার কথা জানায়। বিহারী মহেন্দ্রকে জানায় যে সেটা করলে তো সবথেকে ভাল হয়। বিহারীর কাছে সম্মতি পেয়ে মহেন্দ্র বাড়ি গিয়ে মাকে জানায় সে আশাকে বিয়ে করতে চায়। প্রথমে মা রাজলক্ষ্মী এতে কিছুতেই রাজী হতে চায় না। কারণ রাজলক্ষ্মী জানায় যে আশার তিনকুলে কেও নেই তাই তার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে সে সুখী হবে না। মহেন্দ্র কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে মাকে জানায় যে মেয়েটিকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই সে তাকে বিয়ে করতে চায়। মাতা রাজলক্ষ্মী এই ব্যাপারে অন্নপূর্ণার ষড়যন্ত্রকে ইঙ্গিত করে তাকে নানারকম কুরুচিকর ভাষায় গালাগালি দেয়। অন্নপূর্ণা এই সব কথা শুনে মহেন্দ্রের সঙ্গে আশার বিয়েতে রাজী হতে পারে না। এই কথা শুনে মহেন্দ্র, মা ও কাকিমার উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে চলে যায়। মহেন্দ্র ছোটবেলা থেকেই মায়ের আদরে লালিতপালিত। সে ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, তাই সে ভীষণ একগুঁয়ে। মা রাজলক্ষ্মী এই কথাটা খুব ভালোভাবেই জানত বলে অন্নপূর্ণার কাছে নতমস্তকে বলে – “যে যাহা চায়, না পাইলে যাহা খুশি করিতে পারে।”২ এরপর অন্নপূর্ণার কথায় বিহারী আশাকে মহেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দিতে রাজী হয়। বিহারী এই সিদ্ধান্তে যে কতটা মর্মাহত হয়েছিল তা জানা যায় তার কথাতেই। যখন সে বলে – “তুমি যেমন আদেশ করিবে তাহাই হইবে। কিন্তু আমাকে আর কখনো কাহারও সঙ্গে বিবাহের জন্য অনুরোধ করিয়ো না।”৩ এরপর রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা এবং মহেন্দ্রের মধ্যে নিষ্ঠুর নিগুঢ়নীরব ঘাত-প্রতিঘাত চলতে চলতে বিবাহের দিন শেষ হল।

আশা সজ্জিতসুন্দর দেহে লজ্জিতমুগ্ধ মুখে আপন নূতন সংসারে প্রথম পদার্পণ করল। তার এই দাম্পত্যের মধ্যে কোথাও যে কোনো কাঁটা আছে, তা তার সহজ সরল হৃদয়ে অনুমান করা গেল না। বরঞ্চ জগতে তাহার একমাত্র মাতৃস্থানীয় অন্নপূর্ণার কাছে আসিতেছে বলিয়া আশ্বাসে ও আনন্দে তার সর্বপ্রকার ভয় সংশয় সব দূর হয়ে গেল। রাজলক্ষ্মী বিয়ের পর মহেন্দ্রকে জানায় যে এখন বউমা কিছুদিন তার জ্যাঠার বাড়িতে গিয়ে থাকুক। কিন্তু মায়ের এই আদেশকে মহেন্দ্র কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাতা ও পুত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এইখানেই মাতা পুত্রের মধ্যে সুসম্পর্কের বন্ধন দূর্বল হতে শুরু করে। এরপর রাজলক্ষ্মী হঠাৎ অপরিমিত উৎসাহে নববধূকে ঘরকন্নার কাজ শেখাতে লাগলেন। ভাড়ার ঘর, রান্নার ঘর, ঠাকুর ঘরেই আশার দিনগুলি কাটতে লাগল। ক্রমান্বয়ে দেখা গেল রাজলক্ষ্মী পুত্রবধূ আশার উপর শারীরিক নির্যাতন করতে শুরু করল। এই দেখে অন্নপূর্ণার দুঃখের সীমা থাকল না, কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু মহেন্দ্র মায়ের এই আচরণ দেখে খুব রেগে যায়। তাই মহেন্দ্র মাকে উত্তেজিত ভাবে বলে – “বউকে ঘরের কাজে আমি দাসীর মতো খাটিতে দিতে পারিব না।”৪ তারপর সে মাকে দৃঢ় কণ্ঠে জানায় সে আশাকে লেখাপড়া শেখাতে চায়। এই কথা শুনে রাজলক্ষ্মী নববধূর হাত ধরে টেনে এনে মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপিত করিয়া দেন। এরপর তার যত রাগ তারই বহিঃপ্রকাশ অন্নপূর্ণার উপর দেখালেন। কারণ অন্নপূর্ণাকে রাজলক্ষ্মী সহ্য করতে পারত না। এরপর মহেন্দ্র স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নিজের কলেজ, লেখাপড়া, সামাজিকতা, এক্সামিন, বন্ধুকৃত্য সবকিছু জলাঞ্জলি দিল। স্ত্রীর উন্নতি সাধন করতে গিয়ে তাকে নিয়ে সে ঘরে প্রবেশ করল। কাজের প্রতি দৃকপাত বা লোকের প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্রও করল না। মহেন্দ্রের এইসব আচার-আচরণ দেখে রাজলক্ষ্মী ঈর্ষায় জ্বলে উঠে। তার ফলেই মাতা ও পুত্রের মধ্যে সম্পর্ক একেবারে চরমে উঠে গেল। সাময়িক মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবন অনেক মধুময় হয়ে উঠল। তারা সবসময় পাশাপাশি থেকে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল। এই জন্য তাদের দাম্পত্যের বন্ধন অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠল।

অনাথিনী আশালতা স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে দিন দিন জীবন সম্পর্কে সজীবতা লাভ করল। আসলে পূর্বে আশালতা এত ভালবাসা কারও কাছে পায় নি। তাই আশা নববধূযোগ্য লজ্জাভয় দূর করে দিয়ে সৌভাগ্যবতী স্ত্রীর মহিমায় মুহূর্তের মধ্যেই স্বামীর পদপ্রান্তে অসংকোচে আপন সিংহাসন অধিকার করল। ফলে পুনরায় রাজলক্ষ্মী ও অন্নপূর্ণার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটল। কারণ রাজলক্ষ্মীর ধারণা ছিল আশার এই বাড়বাড়ন্তের জন্য অন্নপূর্ণার যথেষ্ট ইন্ধন ছিল। মহেন্দ্র আশাকে নিজে লেখাপড়া শেখাতে লাগল। আশার লেখাপড়াতে বেশি মনোযোগ থাকার জন্য মহেন্দ্র সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এটাকেই বেশি গুরুত্ব দিল। ফলে মহেন্দ্রের নিজের লেখাপড়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। মহেন্দ্র আশাকে একটু বেশিই ভালোবাসত। তাইতো মহেন্দ্র বলতে পারে – “আমাকে ছাড়িয়া তুমি যত সহজে পড়া করতে পার, তোমাকে ছাড়িয়া তত সহজে আমি আমার পড়া করিতে পারি না।”৫ এই বক্তব্যটি মহেন্দ্রের স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় দেয়। মহেন্দ্র আশার প্রতি ভালোবাসার জন্য প্রিয় বন্ধু বিহারীর ঘরে প্রবেশ করা পর্যন্ত সহ্য করতে পারল না। কারণ সে শুধুমাত্র স্ত্রীর সাথেই সময় দিতে চাইল। মহেন্দ্র বিহারীকে একজন শত্রু হিসাবে ভাবতে শুরু করল। কারণ মহেন্দ্রের মনে একটা সন্দেহ ছিল যে, বিহারী মনে মনে আশাকে ভালোবাসত। এই কথা ভেবেই মহেন্দ্র প্রিয় বন্ধুকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। একসময় বিহারীর সঙ্গে আশার বিবাহ প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল; তাই মহেন্দ্রের মনে তাদের দুজনকে নিয়ে একটা সন্দেহ থেকেই যায়। মহেন্দ্রের এই আচরণ বিহারী অনুমান করতে পারত এবং মহেন্দ্র এই নিয়ে আমোদ করত।

মহেন্দ্র আশার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজলক্ষ্মী এটা ভালোচোখে দেখেনি। রাজলক্ষ্মী বাড়ি থেকে কয়দিন বারাসাতে যাওয়ার জন্য মহেন্দ্রের কাছে অনুমতি নিতে যায়। মহেন্দ্র এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষন না করেই মাকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দেয়। ছেলের এই আচরণে মায়ের মনে খুব দুঃখ হয়। তাই উদাসী মন নিয়েই রাজলক্ষ্মী কিছুদিনের জন্য বারাসাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। নিজের গ্রামে গিয়ে রাজলক্ষ্মীর কিছুটা অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও ছেলের প্রতি অভিমানবশতঃ কোলকাতায় আর ফিরতে চাইল না। গ্রামে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে না নেওয়ার জন্য রাজলক্ষ্মীর প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। এমন সময় বিনোদিনী এসে তাকে আশ্রয় দিল এবং তার সেবা শুশ্রূষা করতে লাগল। বিনোদিনীর সেবাযত্ন পেয়ে রাজলক্ষ্মী খুব খুশি হয়ে গেল। বিনোদিনীর সেবাযত্নে আহ্লাদিত হয়ে রাজলক্ষ্মী মনের আবেগে বলতে পারে – “মা, তুই আমার ঘরের বউ হলি নে কেন, তা হইলে তোকে বুকের মধ্যে করিয়া রাখিতাম।”৬ এরমধ্যে অন্নপূর্ণাও ঘরসংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে কাশীতে চলে যান। মহেন্দ্র ও আশার অবিশ্রাম মিলনের মধ্যে একটা শ্রান্তি ও দূর্বলতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মহেন্দ্র ঘরসংসারের প্রতি বিমুখ হয়ে ওঠে। গৃহের মধ্যে অনিয়মিত কার্যকলাপ ঘটতে থাকে। মহেন্দ্র ও আশা একাকী বসবাস করতে থাকায় তাদের মধ্যে একসময় বিরক্তিভাব চলে আসে। এইজন্যই মহেন্দ্র মাকে তাড়াতাড়ি আসার জন্য চিঠি লেখে। রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের চিঠি পেয়ে কলিকাতায় ফিরে এল। রাজলক্ষ্মী আসার সময় একাকী না এসে বিধবা বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে আসিল। এই বিনোদিনীর আগমনের মধ্য দিয়েই তাদের সংসারে বিষবৃক্ষের বীজ বপন হয়ে গেল। বিনোদিনীর উপস্থিতিতে আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবন আস্তে আস্তে কলুষিত হতে লাগল। যেহেতু বিনোদিনী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা তাই সে খুব সচেতন। এখানে এসে বিনোদিনী সংসারের সমস্ত কাজে ও রাজলক্ষ্মীর সেবাযত্নে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করে দিল। তার এই কাজকর্ম ও সেবাযত্ন দেখে রাজলক্ষ্মী তার প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ করতে থাকে। এইজন্যই রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে করত। তাই বিনোদিনীকে বিশ্বাস করে রাজলক্ষ্মী বাড়ির সমস্ত কাজের ভার তুলে দিলেন। তাছাড়া তিনি তার সংসারের সমস্ত দায়িত্ব বিনোদিনীকে দিতে কোনো দ্বিধাবোধ করল না। এই সুযোগটাকে বিনোদিনী নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে লাগল।

বিনোদিনীর সঙ্গে আশার অত্যধিক মেলামেশা মহেন্দ্র খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। তাই মহেন্দ্র তার মাকে বারবার অনুরোধ করে যাতে বিনোদিনীকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেওয়া হয়। ছেলের কথা শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে বিনোদিনীর আচরণ সংযত করতে বলল। বিনোদিনী যাতে সাবধান হয় একথাও রাজলক্ষ্মী বারবার জানিয়ে দেয়। তারপর থেকে বিনোদিনী অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্বক আশাকে দূরে দূরে রাখিল। বিনোদিনী আশাকে তাই অভিমান করে বলল – আমি ভাই কে? আমার মতো অবস্থার লোক আপন মান বাঁচিয়ে চলতে না জানলে, কোন দিন কী ঘটে বলা যায় কি? আশা কান্নাকাটি করলেও বিনোদিনী নিজের যায়গায় স্থির থাকে। এদিকে মহেন্দ্র, আশার সাংসারিক অপটুতায় ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। মহেন্দ্রের এই আচরণ আশালতা অন্তরে অনুমান করতে পারে। মহেন্দ্র প্রথমে বিনোদিনীকে সহ্য করতে পারত না। তাই সে বিনোদিনীর সাথে কথা বলত না। এইজন্য বিনোদিনীর মনে খুব দুঃখ হয়। কিন্তু আশালতা বিনোদিনীর সঙ্গে খুব ভালোভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আশালতাই বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রের বন্ধুত্ব সম্পর্ক তৈরি করার জন্য কারিগর হয়ে ওঠে। আশালতার এই প্রয়াসে মহেন্দ্র প্রথম প্রথম খুব অনীহা প্রকাশ করত। কিন্তু আশা তার লক্ষ্যে অবিচল থেকে যায়। আশালতার বারবার প্রয়াসে মহেন্দ্র ও বিনোদিনী পাশাপাশি আসতে শুরু করে। তারা উভয়েই পাশাপাশি আসার ফলে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আশালতা যেহেতু খুব সহজসরল গ্রাম্য মেয়ে তাই সে বুঝতে পারেনি যে স্বামীর সাথে বিনোদিনীর এই সম্পর্কই যে তাদের দাম্পত্য জীবনে গভীর প্রভাব পড়বে। এরপর বিনোদিনী দিনে দিনে মহেন্দ্রকে মনে মনে ভালোবাসতে শুরু করল। মহেন্দ্র ও আশার সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে বিনোদিনী ভিতরে ভিতরে হিংসায় জ্বলে ওঠে। সে ভাবে যে এই সুখের ঘরসংসার আমার হতে পারত, কিন্তু একটু ভুলের জন্য তা আজ সম্ভব হয়নি। তাই সে তাদের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে একটা অশান্তি করার চেষ্টা করল। আশার এই সুখের সংসারকে সে কোনভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। মহেন্দ্র ছোটবেলা থেকে যাকিছু কাছে দেখেছে, তাকেই সে নিজের বলে নিতে চেয়েছে। মহেন্দ্র এই স্বভাববশতই বিধবা বিনোদিনীকেও নিজের কাছে দেখে তাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিল। রাজলক্ষ্মী ও আশার পূর্ণ সমর্থনের ভিত্তিতে বিনোদিনী ভিতরে ভিতরে মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনে চোরাস্রোতের সৃষ্টি করতে থাকে।

আশা যখন প্রথম মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর মধ্যে সাক্ষাৎ করায় তারপর মহেন্দ্র কিন্তু খুব উদগ্রীব হয়ে যায়। আশাকে মহেন্দ্র বারবার জিজ্ঞাসা করে বিনোদিনীর প্রতিক্রিয়া। আশা ও মহেন্দ্রের কথোপকথন কালে হঠাৎ বিহারী এসে পড়ে। বিহারীর মানুষ চেনার ক্ষমতা একটু বেশিই ছিল। তাই সে বিনোদিনী সম্পর্কে আশাকে বলে – “বৌঠান লক্ষণ ভালো নয়। এসব ভোলাইবার কথা। তোমার চোখের বালিকে আমি দেখিয়াছি। আরো যদি ঘন ঘন দেখিতে পাই, তবে সেটাকে দুর্ঘটনা বলিয়া মনে করিব না, সে আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি। কিন্তু মহিনদা যখন এত করিয়া বেকবুল যাইতেছেন তখন বড়ো সন্দেহের কথা।”৭ আসলে বিহারী এই কথাটির সাহায্যে আশা ও মহেন্দ্র উভয়কেই আগেভাগে সাবধান করতে চেয়েছিল। বিহারীর আশার প্রতি একটু দূর্বলতা ছিল। তাই সে চাইত আশার দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয়, তাতে কোনো অশান্তি যেন না আসে। কিন্তু মহেন্দ্র মনে মনে বিনোদিনীর প্রতি একটা আকর্ষণের সৃষ্টি হয় যা আশার কাছে সে গোপন রাখে। আশা এরপর মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর বারবার সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়। মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে বিনোদিনী এসে পড়ায় তার গুরুত্ব মহেন্দ্রের কাছে বেড়ে যায়। বিনোদিনীকে তারা দুইজনেই খুব মান্য করতে লাগল। তারা তাদের দাম্পত্য জীবনের কোন সমস্যার সমাধানের জন্য বিনোদিনীকে বিচারক হিসাবে স্বীকৃতি দেবার চেষ্টা করত। বিনোদিনী খুব সচেতন, তাই এই সুযোগটাকে সে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাবার চেষ্টা করল। মহেন্দ্র ও রাজলক্ষ্মীকে সেবাযত্ন করে বিনোদিনী তাদের মনে নিজের স্থান করে নিল। মহেন্দ্রের মন আস্তে আস্তে আশার দিক থেকে ঘুরে গিয়ে বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণ বাড়তে লাগল। বিনোদিনী এটা খুব ভালোভাবেই অনুমান করতে পেরেছিল। তাই বিনোদিনী সাহস পেয়ে মাঝে মাঝে আশাকে মহেন্দ্রের কাছে ভৎর্সনা করতেও দ্বিধা বোধ করল না। বিনোদিনীর নিজের হাতে তৈরি পশমের জুতো এবং পশমের গলাবন্ধ মহেন্দ্রের কোমল মানসিক সংস্পর্শের মতো বেষ্টন করল। আশা তার নিজস্বতা হারাতে লাগল এবং কতকটা বিনোদিনীকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতে লাগল। আশা বুঝতে পারে যে মহেন্দ্র পূর্বের মতো আর তাকে ভালোবাসে না। কিন্তু তবুও সে স্বামীর প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারল না। আশালতা একবারও মনে ভাবে না যে বিনোদিনী তার দাম্পত্য জীবনের গভীরে ঢুকে কোন অশান্তি করতে পারে। মহেন্দ্র ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা করতে লাগল যাতে বিহারী তাদের ঘরে বেশি আসা যাওয়া না করে। বিহারী মহেন্দ্রের এই কৌশল খুব ভালোভাবেই অনুমান করতে পারে। কিন্তু আশার প্রতি দূর্বলতা বশতঃ সে অপমানিত হয়েও তাদের দাম্পত্য জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবাড়িতে আসা যাওয়া করতে লাগল। বিহারী ইঙ্গিতে আশাকে তার দাম্পত্য জীবনে সর্বনাশের কথা বলতে লাগল। তাই বিহারী বলতে পারে – “বৌঠান, চিকিৎসা করিয়া রোগ সারানোর চেয়ে রোগ না হইতে দেওয়াই ভালো।”৮ বিহারী তখন মনস্থির করল যে তার দূরে থাকা চলবে না, যেমন করে হোক ইহাদের মাঝখানে থেকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে।

বিহারী আহ্বান – অর্ভ্যথনার অপেক্ষা না রেখেই মহেন্দ্রের ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করতে লাগল। এমনকি বিহারী বিনোদিনীকেও অনুরোধ করে বলে – “এই ছেলেটিকে ইহার মা মাটি করিয়াছে, বন্ধু মাটি করিয়াছে, স্ত্রী মাটি করিতেছে – তুমিও সেই দলে না ভিড়িয়া একটা নতুন পথ দেখাও - দোহাই তোমার।”৯ বিহারী যে সমস্ত মাটি করতে এসেছে, এটা বিনোদিনীর বুঝতে বাকী রইল না। বিহারী তার বন্ধু মহেন্দ্রকে সাবধান করে বলে – “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও, করো – বরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে সরল হৃদয়া সাধ্বী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না।”১০ অর্থাৎ বিহারী মহেন্দ্রকে বিনোদিনীর ফাঁদে পড়া থেকে সাবধান করে দেয়। মহেন্দ্র বিহারীর এই কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে যায়। তাই মহেন্দ্র বিহারীকে জানায় যে তার এখানে আসা যাওয়া করা বিনোদিনীর ভালো লাগে না, তাতে সে বিরক্ত হয়। বিহারী তারপর বিনোদিনীর কাছে এসে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করে। এরপর বিনোদিনী এখান ছেড়ে বাড়ি যাবার কথা বললে মহেন্দ্র তাতে অপ্রত্যক্ষ ভাবে বাধা দেয়। তাই মহেন্দ্র ও আশার বারবার অনুরোধে বিনোদিনী এখানেই থেকে যায়। এই ঘটনার পর মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর সম্পর্ক অনেক গভীর হতে শুরু করে। মহেন্দ্রের মনে বিনোদিনীর প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। মহেন্দ্র তাই খড় কুটোর মতো বিনোদিনীকে ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর একটা অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক হতে দেখা যায়। বিনোদিনী মনে মনে বিহারীকে খুব সম্মান করত। বিহারীও বিনোদিনীর মধ্যে যোগাযোগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। যা দেখে মহেন্দ্র সহ্য করতে পারত না। বিনোদিনী কিন্তু মহেন্দ্রকে অগ্রাহ্য করেই নিজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বিহারীকে শ্রদ্ধা করতে লাগল। বিহারীও তাতে সমান ভাবে যোগ দিল। কারণ সে দেখল যে বিনোদিনীকে যদি মহেন্দ্রের মন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় তবে আশার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়ে উঠবে। বিহারীর মনে বিনোদিনীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি দিনে দিনে বাড়তে লাগল। সে পূর্বের ন্যায় বিনোদিনীকে আর অবজ্ঞা করত না। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে পূর্বের মতো কাছে পাবার জন্য চেষ্টা করলেও বিনোদিনী কিন্তু তাকে আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইল না। মহেন্দ্র এরপর আশাকে মানসিক ভাবে প্রতিপদে তীব্র আঘাত করতে লাগল। তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা অশান্তি যেন লেগে গেল। আশা বুঝতে পারে যে তার চারদিকেই সমস্ত যেন উলট পালট হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তা প্রতিকারের কোন উপায় তার জানা ছিল না।

বিনোদিনী বিহারীকে এত বিশ্বাস করতে শুরু করল যে কোন পরামর্শ সে বিহারীর কাছেই নিতে শুরু করল। বিনোদিনীর এই বাড়াবাড়ি দেখে মহেন্দ্র খুব বিরক্তি বোধ করল। বিনোদিনীর অভাব সে কোন মতেই মেনে নিতে পারছিল না। তাই তার মানসিক অবস্থা ক্রমশ অবনতি হতে লাগল। যার ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে ক্রমশ কালো মেঘ দেখা দিতে লাগল। আশার কিন্তু স্বামীর প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালোবাসা ছিল। যার জন্য সে স্বামীকে বলতে পারে – “আমাকে তোমার দাসীর মতো শাসন করো। আমাকে তোমার চরণাশ্রয়ের যোগ্য করিয়া লও।”১১ মহেন্দ্র রেগে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে কলেজের কাছেই একটি বাসা নিয়ে চলে গেল পড়ার অজুহাত দিয়ে। মহেন্দ্রের একটা জ্বালা বিনোদিনীর অন্তরে জ্বলছে, তা হিংসার না প্রেমের, না উভয়েরেই মিশ্রণ তা বিনোদিনী ঠিক ভেবে পায় না। তাই সে তীব্র আত্মশক্তিতে উচ্চারণ করতে পারে – “ সে যাইবে কোথায়? সে ফিরিবেই। সে আমার।”১২ মহেন্দ্রের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতে বিহারী মনে মনে খুব ব্যথিত হয়েছিল। তাই বিহারী বিনোদিনীকে বলতে পারে – “আশাকে তুমি দেখিয়ো। সে সরলা, কাহাকেও আঘাত করিতেও জানে না, নিজেকে আঘাত হইতে বাঁচাইতেও পারে না।”১৩ বিনোদিনী তখন বুঝতে পারে যে আশার জন্য করুণায় বিহারীর হৃদয় ব্যথিত, সে তার কাছে কেও নয়। আশার পথের কাঁটা দূর করবার জন্যই, আশার সমস্ত সুখ সম্পূর্ণ করিবার জন্যই বিহারীর জন্ম। এই কথা ভেবে বিনোদিনী খুব ভেঙ্গে পড়ে। তখন তার মনে আক্ষেপ হয়, যে কোন পুরুষকেই সে জয় করতে পারছে না। তাই এরপর সে সংহার মূর্তি ধারণ করল। মহেন্দ্র কলেজে থাকা কালীন আশার দেওয়া তিনখানি চিঠি পেল। চিঠিগুলি পড়ে সে বুঝতে পারল না যে চিঠিগুলি কে লিখেছে আশা না বিনোদিনী ! কারণ চিঠিতে যে বিষয় লেখা ছিল তা বিনোদিনীর বলে মনে হল। চিঠির বিষয় তার মনে একটা টানা পোড়েনের সৃষ্টি হল। এর মধ্যে বিহারী মহেন্দ্রকে তার কাছে গিয়ে বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে জানায় যে আশা তারজন্য কান্নাকাটি করছে। তাই মহেন্দ্র এই কথা শুনে বিহারীর সঙ্গে বাড়ি চলে আসে।

মহেন্দ্র ঘরে ফিরে আসা মাত্র তার মুখ দেখেই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের মতো একমুহূর্তেই কেটে গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করে লজ্জায় সে মহেন্দ্রের সামনে মুখ তুলতেই পারল না। এই চিঠির জন্য আশা মহেন্দ্রের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করল। মহেন্দ্র আশাকে পূর্বের মত কাছে টেনে নিল। বিনোদিনী তাই মহেন্দ্রের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করল। বিনোদিনীর এই আচরণ দেখে মহেন্দ্র খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। বিনোদিনী ঈর্ষায় এবার বাড়ি ছাড়বার জন্য নিতান্তই উঠে পড়ে লাগল। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীর সঙ্গে যে দুরত্ব তৈরি হয়েছিল তা দূর করার চেষ্টা করল। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীকে বারবার অনুরোধ করতে লাগল বাড়িতে থেকে যাবার জন্য। বিনোদিনী তখন অনুরাগের বশে বলে – “কিসের জন্য এত অনুনয়-বিনয়। আমি থাকিলেই কী, আর না থাকিলেই কী। আপনার তাহাতে কী আসে যায়।”১৪ মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণের ফলে তার হাত চেপে ধরে রুদ্ধ সজলস্বরে বলে – “যদি তাহাতে আমার আসে যায়, তবে তুমি থাকিবে?”১৫ বিনোদিনী মহেন্দ্রের এই ব্যবহারে অনুমান করতে পারে যে মহেন্দ্র তার প্রতি কতটা অনুরক্ত। সেই সুযোগে বিনোদিনী কথা দেয় যে যতক্ষণ না তোমরা আমাকে বিদায় দিবে ততক্ষণ আমি এবাড়িতে রইলাম। এতে আশা ও মহেন্দ্র খুব খুশি হয়। আশা বুঝতে পারল না যে এতে তার জীবনের কতবড় ক্ষতি হল। বিনোদিনীই যে তার দাম্পত্য জীবনের মাঝে কাঁটা হয়ে উঠবে তা সে কিছুতেই অনুমান করতে পারল না। বিহারী বিনোদিনীকে দেবীর মতো শ্রদ্ধা করতে লাগল। মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণের ফলে আশাকে আর সহ্য করতে পারল না। তাই তাদের দাম্পত্য জীবনে ঘন কুয়াশার আবির্ভাব দেখা দিল। মহেন্দ্র হঠাৎ তার কাকিমা অন্নপূর্ণা দেবীকে দেখা করার জন্য কাশী চলে যায়। মহেন্দ্রকে দেখে অন্নপূর্ণার যেমন আনন্দ হল, তেমনি আবার আশার সঙ্গে তার মায়ের কোনো বিরোধের সন্দেহ করে দুঃখও লাগল। কিন্তু মহেন্দ্র আশাকে নিয়ে তার মার সম্বন্ধে কোন অভিযোগের কথা না তোলায় অন্নপূর্ণার সমস্ত আশঙ্কা দূর হল। মহেন্দ্র কাশী থেকে বাড়ি ফেরার পরেই মাসীর সাথে একবার দেখা করার জন্য আশার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। মহেন্দ্র তাতে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতিও দিল। বিহারী এই খবর শুনে অবাক হয়ে গেল। তাই মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বিহারীর একটা সন্দেহ দেখা দিল। বিহারী তখন চাতুরীবশতঃ আশার সঙ্গে বিনোদিনীকে কাশীতে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিল। এই কথা শুনে মহেন্দ্র রাগে গর্জন করে উঠল। মহেন্দ্র তখন বুঝতে পারে সে যে বিনোদিনীকে ভালোবাসে তাকে দূর করার জন্যই বিহারীর এইরকম প্রস্তাব। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে যে ভালোবাসে তা উচ্চস্বরে অস্বীকার করে। তাছাড়া মহেন্দ্র বিহারীকে দৃঢ়কণ্ঠে বলে যে তুমি আশাকে ভালোবাসো। এই কথা শুনে বিহারী ক্ষোভে দুঃখে মহেন্দ্রের বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। বিহারী তাকে ভালোবাসে এই কথা শুনে আশা স্বামীর মুখের প্রতি লজ্জায় ঘৃণায় আর মুখ তুলতে পারছিল না। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ভালোবাসার কথা অস্বীকার করায় সে নিজেকে আর সংবরণ করিতে পারিল না। কারণ তার মনে হল এতে বিনোদিনী রাগবশতঃ তাকে বাদ দিয়ে বিহারীকে ভালোবাসতে পারে। মহেন্দ্র এই দোটানায় পড়ে তার নিজের উপর আর বিশ্বাস রাখতে পারে না। তাই তো সে আশাকে জিজ্ঞাসা করে – “চুনি, তুমি আমাকে কতখানি ভালোবাস ঠিক করিয়া বলো।”১৬

মহেন্দ্রের মধ্যে একটা ভালো মানুষী সত্ত্বাও যে ছিল তা আমরা দেখতে পায়। তাই তো সে আশাকে বলতে পারে – “ তুমি আর কাহাকেও বিবাহ করিলে ঢের বেশি সুখী হইতে পারিতে।”১৭ বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে অন্তর থেকে খুব ভালবেসে ছিল। তাই সে বিহারীকে চিঠি দিয়ে প্রেম নিবেদন করতেও দ্বিধা বোধ করে না। আশাকে বিহারী ভালোবাসে এই কথা শোনার পর বিহারী নিজেকে মনে মনে অপরাধী বলে ভাবতে শুরু করে। তাই বিহারী অনুরাগের বশে দেশ ছেড়ে পশ্চিমে চলে যায়। দারোয়ান বিহারীকে বাড়িতে না পেয়ে তার চিঠি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিনোদিনীর এই চিঠি মহেন্দ্র দারোয়ানের কাছে পেয়ে যায়। চিঠিটি পেয়ে মহেন্দ্র কৌতূহল বশতঃ সেটি খুলে পড়তে লাগল। চিঠিখানি পড়ে মহেন্দ্র বিনোদিনীর মনের গতি ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারল না। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীকে কাছে পাবার জন্য আকুল হয়ে গেল। মহেন্দ্র তখন স্থির করল নিজেকে ধরা দিয়া হোক বা না দিয়া হোক বিনোদিনীর মন যেকোন অবকাশে পুনরায় ফেরাতে হবে। আসলে মহেন্দ্র, আশা ও বিনোদিনী দুজনকেই কাছে পেতে চেয়েছিল। তাই তার জীবন ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল। বিনোদিনী তার পাঠানো পত্র খোলা অবস্থায় ফেরত পেল। তখন সে ভাবল যে বিহারী এই চিঠি পড়ে তার কোন উত্তর না দিয়েই তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই তার বিহারীর প্রতি মনে মনে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মহেন্দ্র কৌশলে হঠাৎ আশাকে কাশীতে তার মাসীর সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করল। এই কথা শুনে আশা চুপচাপ বসে রইল। আসলে বিনোদিনীর সঙ্গে সন্ধি করিবার জন্য বাধাহীন অবসর চেয়ে মহেন্দ্রের মন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অধীর হয়ে উঠেছিল। আশাকে চুপ করে থাকতে দেখে মহেন্দ্রের মনে রাগের সঞ্চার হল। মহেন্দ্র তাই আশাকে বলে – “আমার উপর মনে মনে তোমার কোন সন্দেহ জন্মিয়াছে নাকি। তাই আমাকে চোখে চোখে পাহারা দিয়া রাখিতে চাও?”১৮ হঠাৎ মহেন্দ্রের এই উগ্রতা দেখে আশা বিস্মিত ও ভীত হয়ে পড়ল। মহেন্দ্র কেন এত উগ্র হয়ে গেল তার কারণ সরল বালিকা আশার বোঝার কোন ক্ষমতা ছিল না। আশা এরপর মহেন্দ্রের কাছে ক্ষমা চায়। আশা মহেন্দ্রকে জানায় যে তার মাসীকে দেখতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু তোমাকে ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। মহেন্দ্র তখন আশাকে বলে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। মহেন্দ্র এই কথা যে অনুরাগের বশে জানায় তা আমরা অনুমান করতে পারি। তাই আশা মহেন্দ্রকে সন্দেহমুক্ত করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে কাশী যেতে রাজী হয়ে যায়। আশার জেদাজেদিতে মহেন্দ্র তাকে কাশী যেতে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেয়। আসলে মহেন্দ্র ভিতরে ভিতরে যেটা চাইছিল সেটাই সে অবশেষে পেল। মহেন্দ্র আশাকে ইঙ্গিতে জানায় সে তার অনেকখানি আপন। মহেন্দ্র তাই আশাকে বলে – “আচ্ছা যাও, কিন্তু তোমার চোখের আড়ালে আমি যদি নষ্ট হইয়া যাই, তাহা হইলে কী হইবে।”১৯ কিন্তু মহেন্দ্রের এই কথায় আশা কোন গুরুত্বই দিল না। আশা কাশী যাওয়ার পূর্বে মহেন্দ্রের সমস্ত ভার বিনোদিনীকে দিয়ে চলে গেল। সহজ সরল বালিকা আশা কোন দিন মনেও ভাবে না যে বিনোদিনী তার স্বামীকে তার থেকে আলাদা করে দিতে চায়। বিনোদিনী একাকী মহেন্দ্রকে তার পক্ষে নিয়ে নেবার একটা সুযোগ পেয়ে গেল।

আশা কাশী যাবার পর প্রথম প্রথম বিনোদিনী মহেন্দ্রের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করত। তাই সে মহেন্দ্রকে ফাঁকি দিয়া পালায়, ধরা দেয় না। রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে দেখে আদেশ করে যে মহেন্দ্রকে যেন সে চোখে চোখে রেখে সেবাযত্ন করে। বিনোদিনী প্রথমে তা অস্বীকার করলেও পরে তা মেনে নেয়। তাই বিনোদিনী মহেন্দ্রের সেবাযত্ন খুব ভালোভাবে করতে লাগল। মহেন্দ্র এতে খুশি হয়ে বিনোদিনীর প্রতি তার আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। বিনোদিনীকে তাই সে অন্তরের গভীরে স্থান দিতে লাগল। মহেন্দ্র সময়ে অসময়ে বিনোদিনীকে কাছে পেতে চাইল কিন্তু বিনোদিনীর তাতে তেমন সায় ছিল না। বিনোদিনীর উপর তাই মহেন্দ্রের অনুরাগের সৃষ্টি হয়। যারফলে মহেন্দ্র আশাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার জন্য চিঠি লিখে। আশা কাশীতে থাকার সময় হঠাৎ একদিন সেখানে বিহারী উপস্থিত হয়। বিহারীকে দেখে আশা মাসীকে জানায় সে যেন এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যায়। অন্নপূর্ণা কিন্তু বিহারীকে দেখে আশার এই বিরক্তি ভাবের কারণ অনুমান করতে পারে না। আশা তখন চিঠি দিয়ে এইসব ঘটনা মহেন্দ্রকে জানাতে দ্বিধাবোধ করে না। আশার অনুপস্থিতিতে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর ঘনিষ্ঠতা খুব বেড়ে গেল। তাদের মধ্যে একটা প্রনয়াসক্ত দেখা দিল। মহেন্দ্রের স্বভাব হল যাকে কাছে পায় তাকেই নিজের অধিকার বলে মনে করে। এইজন্যই সে বিনোদিনীকে কাছে পেয়ে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করে।

মহেন্দ্র মনে মনে সন্দেহ করত যে বিনোদিনী বিহারীকে খুব ভালোবাসে, তাই তার খুব হিংসা হত। এজন্যই সে বিহারীর কাছ থেকে বিনোদিনীকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর একান্তে ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য একদিন বিহারীর চোখে পড়ে যায়। বিহারী তখন বুঝতে পারে যে সে যেটা সন্দেহ করেছিল সেটাই ঠিক। মহেন্দ্র বিহারীকে তখন অনেক অপমান করল। বিহারী মহেন্দ্রের কাছে অপমানিত হয়ে কোন কথা বলল না। বিহারীকে অপমান করায় কিন্তু বিনোদিনীর খুব অসহ্য লাগল। তাই বিনোদিনী মনে মনে মহেন্দ্রকে খুব ঘৃণা করতে লাগল। বিনোদিনী বিহারীকে ধরতে এলে বিহারী বিনোদিনীকে ঠেলে দেয় এতে বিনোদিনীর হাত কেটে রক্ত বের হয়। বিহারীর এই আঘাতকে বিনোদিনী রাগ না করে বরং পরম সৌভাগ্য হিসাবে মেনে নেয়। বিহারীকে বিনোদিনী অন্তর থেকে ভালোবাসতো বলেই এটা সম্ভব। বিনোদিনীকে আবার মহেন্দ্র ভালোবাসার কথা বললে বিনোদিনী তা সুকৌশলে স্বীকারও করে। তাই বিনোদিনী মহেন্দ্রকে বলতে পারে – “মাথায় করিয়া রাখিব। ভালোবাসা আমি জন্মাবধি এত বেশি পাই নাই যে, চাই না বলিয়া ফিরাইয়া দিতে পারি।”২০ বিহারীর কাছে হঠাৎ গোপন রহস্যের কথা ধরা পড়ে যাওয়ায় মহেন্দ্রের মনে একটা মুক্তির আনন্দ উপস্থিত হল। মহেন্দ্র এরপর তাই আরও বেশি করে বিনোদিনীকে কাছে পেতে চাইল। মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর ঘনিষ্ঠতা দেখা সত্ত্বেও রাজলক্ষ্মী কোন ভ্রূক্ষেপই করল না। কারণ রাজলক্ষ্মী চাইত যেকোন মূল্যে তার সন্তান সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করুক। বিনোদিনীর কাছে রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ হল তার ছেলের যাতে কোন অসুবিধে না হয়।

মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি প্রনয়াসক্ত হলেও বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে তার মনে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। তাই তো বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে দিয়ে বিহারীকে ডেকে এনে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে চায়। বিনোদিনীর এইসব আচরণ মহেন্দ্রের ভালো লাগে না। আশা কাশী হতে বাড়ি ফিরে দেখল মহেন্দ্র তার সাথে পূর্বের মতো ব্যবহার করছে না। আশা এতে খুব মর্মাহত ও নিজেকে অপমানিত বোধ করে। বিনোদিনীকে মহেন্দ্র যে ভালোবাসিতে পারে এ সম্ভবনাও আশার মনে কখনও উদয় হয় নাই। সংসারের অভিজ্ঞতা তাহার কিছুই ছিল না। তাই পৃথিবী সংসার সমস্ত আশার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেল। আশা তখন অনুভব করল যে বিহারী যে কাশী গিয়েছিল সেই খবর পেয়েই হয়তো মহেন্দ্রের মনে রাগ হয়েছে। নানারকম ভাবনা চিন্তা করে আশা তার মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোন কিছুতেই সে নিজের মনকে শান্ত করতে পারল না। এই সব চিন্তা করতে করতে আশার হৃদস্পন্দন স্তব্দ হয়ে গেল। মহেন্দ্র আশা ও বিনোদিনী উভয়কেই আলাদা আলাদা দৃষ্টিতে নিজের অধিকারে রাখতে চায়। মহেন্দ্রের ধারণা হয় বিনোদিনীর সঙ্গে তার যে পবিত্র সম্বন্ধ তাতে তার দাম্পত্য জীবনের কোন ব্যাঘাত হবে না। হঠাৎ একদিন মধ্যরাত্রিতে মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণে তার ঘরে চলে যায়। বিনোদিনী মহেন্দ্রের এই আচরণ ভালো চোখে দেখেনি। আশা একদিন মহেন্দ্রের জামার পকেটে হাত দিতেই একখানি চিঠি পেয়ে যায়। চিঠিটি বিনোদিনী কর্তৃক মহেন্দ্রকে লেখা। চিঠিটি পড়ে স্বামীর প্রতি সন্দেহে আশার মন একেবারে ভেঙ্গে যায়। আশা অনুমান করে যে মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর একটা অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মহেন্দ্র যে বিনোদিনীকে ভালোবাসিতে পারে একথা আশা কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। তাই তো বিনোদিনী চিঠিতে মহেন্দ্রকে বলতে পারে – “একসময় মনে করিতে তুমি আশাকে ভালোবাসিতেছ, সেও মিথ্যা; এখন মনে করিতেছ তুমি আমাকে ভালোবাসিতেছ, এও মিথ্যা। তুমি কেবল নিজেকে ভালোবাসো।”২১ চিঠিখানি পড়ে আশার সমস্ত পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গেল।

রাজলক্ষ্মী সবকিছু বুঝতে পেরে বিনোদিনীকেই সমস্ত কিছুর জন্য দোষারোপ করতে লাগল। তখন বিনোদিনী উগ্র হয়ে বলে – “তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়া তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই? একবার ঠাওর করিয়া দেখো দেখি।”২২ বিনোদিনী একদিক থেকে ঠিকই বলেছিল। কারণ আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের অশান্তির জন্য রাজলক্ষ্মী কিছুটা হলেও দায়ী। কারণ রাজলক্ষ্মী যদি পূর্ণ যৌবনা বিধবা বিনোদিনীকে ঘরে এনে স্থান না দিত তাহলে হয়ত আশার দাম্পত্য জীবন এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠত না। বিনোদিনীর ঈর্ষায় তার দুই চক্ষে আগুন জ্বলে উঠল। বিনোদিনী চিন্তা করল সংসারে যদি অপরাধীই হতে হয় তবে অপরাধের যত লাঞ্ছনা তাই কেন ভোগ করবে? অপরাধের যত সুখ তা হতে কেন বঞ্চিত হবে। মহেন্দ্রকে মুখের উপর বিনোদিনী ঘৃণা করতে ইতস্ততঃ বোধ করে না। তাছাড়া মহেন্দ্রকে বিনোদিনী ভীরু কাপুরুষ বলে অপমানিত করে। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে তার সঙ্গে সমস্ত পরিত্যাগ করে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের অনুরোধ স্বীকার করে না। মহেন্দ্র কিন্তু জোর পূর্বক তাকে নিয়ে যেতে চায়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সেই মুহূর্তে বলে – “চারিদিকে আগুন জ্বালাইয়া তুলিয়াছ, এখন আর নিবাইতেও পারিবে না, পালাইতেও পারিবে না।”২৩ এই কথার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি যে মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণে কতটা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মহেন্দ্র মায়ের কাছেও এই কথা বলতে কোন দ্বিধা বোধ করে না। বিনোদিনী শেষমেষ তার সঙ্গে যেতে রাজী হয়।

বিনোদিনী হঠাৎ বিহারীর কাছে চলে যায়। বিনোদিনী বিহারীর কাছে গিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা প্রার্থনা করে। বিনোদিনী বিহারীকে জানায় যে মহেন্দ্র তাকে ভালোবাসে এবং তাকে নিয়ে সে গৃহত্যাগ করতে প্রস্তুত। বিনোদিনী বিহারীকে এও জানায় সে মহেন্দ্রকে ভালোবাসে না। বিনোদিনী বিহারীকে খুব ভালোবাসত বলেই এই অসময়ে একাকী তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে কোন দ্বিধাবোধ করে না। বিনোদিনী বলে তুমি যদি আশাকে ভালো না বাসিতে তবে আমার দ্বারা আশার আজ এমন সর্বনাশ হতো না। সবকিছু ঘটনা শোনার পর বিহারী বিনোদিনীকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ঘরে না দেখতে পেয়ে সেই রাত্রেই বিহারীর কাছে চলে যায়। সেখানে এসে সে বিহারীর কাছে বিনোদিনীর খোঁজ করে। কারণ মহেন্দ্রের মনে সন্দেহ হয়েছিল যে বিনোদিনী ভালোবাসার টানে বিহারীর কাছেই যাবে। মহেন্দ্র বিহারীর কাছে বিনোদিনীর খোঁজ নিতে চাইলেও কিন্তু বিহারী বিনোদিনীর কোন খবর দিতে পারল না। মহেন্দ্র হতাশ হয়ে সেখান থেকে ঝড়ের বেগে চলে গেল। বিনোদিনীকে গ্রামে গিয়ে পাড়ার লোকের অনেক ভর্ৎসনা সহ্য করতে হল। পাড়ার লোকে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর অবৈধ সম্পর্কের নানারকম কথা প্রচার করতে লাগল। বিনোদিনী এই সব কথা শুনে অধৈর্য হয়ে বিহারীকে একটা চিঠি দিল। চিঠির উত্তরের আশায় বিনোদিনী অস্থির হয়ে উঠল। গ্রামে বিনোদিনীর কাছে হঠাৎ মহেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল। মহেন্দ্রকে দেখে বিনোদিনী লোকলজ্জার ভয়ে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণে যেতে চাইল না। এই ঘটনা জানাজানি হতেই গ্রামের মধ্যে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হল। তাই বিনোদিনীর গ্রামে থাকা অসহ্য হয়ে উঠল। ফলে বিনোদিনী মহেন্দ্রের সাথে গ্রাম থেকে বিদায় নিল।

মহেন্দ্রের নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে রাজলক্ষ্মীর আহার নিদ্রা বন্ধ হল। এমন সময় মহেন্দ্র বিনোদিনীকে পটলডাঙার বাসায় রেখে নিজে বাড়ীতে ফিরে এল। মহেন্দ্র মাকে জানায় তার পড়ার সুবিধার্থে তাকে কলেজের কাছে বাসা নিয়েই থাকতে হবে। মা এতে সম্মতি দেয় কিন্তু জানায় বউমা যেন কোন কষ্ট না পায়। রাজলক্ষ্মী এখন আশাকে মেয়ের মতো খুব ভালবাসতে থাকে। তাই আশার নিয়ে তার চিন্তাভাবনা হয়। মহেন্দ্র সেই রাত্রিতেই কাউকে না জানিয়ে ঘর হতে বিদায় নিল। বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বশতঃ মহেন্দ্র আর ঘরে থাকতে পারল না। মহেন্দ্রের মনে এখন সমস্ত ধ্যান জ্ঞান শুধুমাত্র বিনোদিনী। বিনোদিনীর জন্য সে ঘর, সংসার, স্ত্রী, বন্ধু সমস্তকেই পরিত্যাগ করে। বিনোদিনী নিজেকে অসহায় মনে করে মহেন্দ্রের উপরেই ভরসা করতে থাকে। কিন্তু সে বিহারীকে কোনভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। বিনোদিনীর হৃদয় কোন অবস্থাতেই সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দিতে জানে না, নৈরাশ্যকে সে স্বীকার করে না। মহেন্দ্র বিনোদিনীর সঙ্গে একঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করলে বিনোদিনী তাতে রাজী হয় না। মহেন্দ্র বিনোদিনীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। তাই সে বলতে পারে – “আমি অত্যন্ত হতভাগ্য যে, আমি তোমাকে ভালোবাসিয়াছি।”২৪

মহেন্দ্র বিনোদিনীর উপেক্ষাকে সহ্য করতে না পেরে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। তাই সে ঠিক করে বিনোদিনীকে উপেক্ষার পরিবর্তে উপেক্ষা করবে। মহেন্দ্র বিনোদিনীর এই উদ্ধ্যতের জন্য বিহারীকেই দায়ী করে। কারণ মহেন্দ্র মনে করে তার প্রশ্রয়েই বিনোদিনীর এত বাড়বাড়ন্ত। তাই সে প্রতিশোধ নেবার জন্য বিহারীর ঘরে গেল। কিন্তু বিহারীকে ঘরে পাওয়া গেল না। বিহারীকে ঘরে না পেয়ে মহেন্দ্রের সন্দেহ বাড়তে লাগল। কিন্তু পরে বেয়ারার কাছে খবর পেল বিহারী চার-পাঁচ দিন আগে পশ্চিমে চলে গেছে। এই কথা শুনে মহেন্দ্রের সমস্ত সন্দেহ দূর হল। বিহারীর ঘরে মহেন্দ্র একখানা বিনোদিনীর চিঠি পেয়ে মনকে আর ঠিক রাখতে পারল না। মহেন্দ্র সেই চিঠিখানা এনে বিনোদিনীকে দিল। বিনোদিনী অনুমান করল যে বিহারী চিঠি পড়ে কোন উত্তর দিল না। তাই বিহারীর এই আচরণে বিনোদিনীর অভিমান হল। মহেন্দ্রের কাছে বিহারীর পশ্চিমে যাওয়ার খবর শুনে বিনোদিনীর বিশ্বাস হয় না। তাই সে পুনরায় খেমিকে বিহারীর খবর নিতে তার ঘরে পাঠায়। খেমির কথা শুনে বিনোদিনীর পূর্ণ বিশ্বাস হল। এথেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে বিনোদিনী মহেন্দ্রকে খুব একটা বিশ্বাস করত না। এদিকে রাজলক্ষ্মীর ধারণা হয় যে আশারই আচরণে ও স্বভাবদোষেই মহেন্দ্র বাড়ী ত্যাগ করেছে। এই জন্য রাজলক্ষ্মী আশাকে নানারকম ভাবে তিরস্কার করতে থাকে। আশা এই ভর্ৎসনা শুনে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদতে লাগল। মহেন্দ্র হঠাৎ পুনরায় লজ্জায় ঘৃণায় বাড়ীতে ফিরে এল। মহেন্দ্রকে দেখে আশা কিন্তু পূর্বের মতো তারসাথে আচরণ করতে পারল না। তার মনে হল মহেন্দ্র তার নয়, সে বিনোদিনীর। এই কথা ভেবে আশার হৃদয়ে গ্লানির সঞ্চার হল। তাই আশা কোনভাবেই মহেন্দ্রকে মনের মধ্যে স্থান দিতে পারল না। বিনোদিনীর মহেন্দ্র যেন আশার পক্ষে পরপুরুষ বলে অনুভূত হল। তাই সে মহেন্দ্রের ঘরে প্রবেশ করতে পারল না। মহেন্দ্রের প্রতি আশার এই আচরণে রাজলক্ষ্মী প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করল। মহেন্দ্র তার অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য আশাকে হৃদয়ে বাঁধতে চাইল। কিন্তু মহেন্দ্র ও আশার সম্পর্ক আর পূর্বের মতো সচল দেখা গেল না। কারণ আশা মহেন্দ্রকে আর পুরোপুরি মনে স্থান দিতে পারছিল না। রাজলক্ষ্মী বুঝতে পারল যে বউমা মহেন্দ্রকে পূর্বের মতো আর দৃঢ়বন্ধনে বাঁধতে পারছে না। মহেন্দ্র ঠিক করেছিল যে সাতদিন বিনোদিনীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না। রাজলক্ষ্মীর কথা মতো আশা বিহারীকে আসার জন্য অনুরোধ করে। আশার মুখে বিহারীর কথা শুনে মহেন্দ্রের হৃদয়ক্ষতে ঘা পড়ল। মহেন্দ্র ও আশার এরপর তর্কবিতর্কে তাদের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকে গেল। বিহারীর কথা মনে আসতেই মহেন্দ্রকে বিনোদিনীর সম্বন্ধে চিন্তা অধীর করে তুলল। মহেন্দ্রের সন্দেহ হল হয়তো বিহারী পশ্চিম থেকে এসে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। তাই মহেন্দ্রের প্রতিজ্ঞা রক্ষা হল না। রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডেকে বিহারীকে আসার জন্য অনুরোধ করল। মায়ের এইকথা শুনে মহেন্দ্র তখন নিজেকে বিশ্বের পরিত্যাক্ত বলে বোধ করল। মহেন্দ্র বিহারীর খোঁজে তার ঘরে গিয়ে বেয়ারার কাছে জানতে পারে যে বিহারী বালিতে একটি বাগান নিয়ে কাজে ব্যস্ত আছে। মহেন্দ্রের সন্দেহ হয় যে এরমধ্যে বিহারী ও বিনোদিনীর মধ্যে নিশ্চয় সাক্ষাৎ হয়েছে। বিহারীর কোন খবর না পেয়ে বিনোদিনী তার প্রতি সমস্ত আশা ভরসা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সে বুঝতে পারে যে মহেন্দ্রের আনুগত্যে তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের কাছে বিহারীর খবর জানতে চায়। মহেন্দ্র কোন খবর দিতে না পারায় বিনোদিনী তাকে প্রবল ভর্ৎসনা করে। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে বলে – “বন্ধুর ঠিকানা যদি বাহির করিতে না পার, তবে প্রেমের কথা আমার কাছে উচ্চারণ করিয়ো না। বিহারী – ঠাকুরপোর সঙ্গে তুমি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছ, তোমাকে কে বিশ্বাস করিতে পারে।”২৫ বিনোদিনীর ভর্ৎসনাতে মহেন্দ্র নিজেকে অপমান বোধ করে প্রবল গর্জে উঠে।

মহেন্দ্র তার সঙ্গে বিনোদিনীকে বাইরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। বিনোদিনী তাতে রাজী হল এই শর্তে কোন জায়গায় সে দুদিনের বেশি থাকবে না, শুধুমাত্র ঘুরে বেড়াবে। এদিকে মহেন্দ্র বিহারীকে সঙ্গে নিয়ে যাবার সংকল্প নিয়ে বাড়ী থেকে বেরোলেও তা ভুলে যায়। কোচম্যানের কাছে সমস্ত সংবাদ পেয়ে আশা ও রাজলক্ষ্মীর মন বিচলিত হয়ে পড়ে। রাজলক্ষ্মী অভিমানে ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমে চলে গেল। অন্নপূর্ণা কাশী থেকে বাড়ী ফিরে বিহারীকে নিজে গিয়ে বালি থেকে নিয়ে এল। বিহারীর প্রতি আশার যে অভিমান ছিল তা ক্রমেই কমে যেতে লাগল। মহেন্দ্রকে ছাড়া বিরহিণী আশাকে দেখে বিহারীর মন আকুল হয়ে উঠে। পশ্চিমে গিয়ে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়ে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। বিনোদিনী বারে বারে মহেন্দ্রকে বুঝিয়ে দেয় সে তাকে ভালোবাসে না। বিনোদিনীর মুখে বিহারীর কথা শুনে মহেন্দ্র রেগে যায়। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে তাই অবিচল মুখে বলে – “তোমার ভালোবাসার চেয়ে তোমার ছুরি আমার হৃদয়ে সহজে প্রবেশ করিবে।”২৬ বিহারীর প্রতি বিনোদিনী প্রবল ভালোবাসা প্রকাশ করতেই বলতে পারে – “কিন্তু যতদিন বিহারীর আশা আছে, ততদিন আমি মরিতে পারিব না।”২৭ বিনোদিনীর কাছে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে মহেন্দ্র স্থির করল সে বাড়ী ফিরে যাবে। বিনোদিনীর গৃহে হঠাৎ বিহারীর আবির্ভাব দেখা গেল। বিনোদিনী বিহারীকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু বিহারী তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। বিহারী বিনোদিনীকে অপবিত্র বলে বোধ করতে থাকে। বিনোদিনী তাকে জানায় যে, সে অপবিত্র নয়। সে কেবলমাত্র তার পথ চেয়েই বসে আছে। বিহারীর কাছে বিনোদিনী সমস্ত সংবাদ পেয়ে মহেন্দ্রের সমস্ত চাতুরী বুঝতে পারল। বিনোদিনীকে বিহারী বিশ্বাস করলে বিনোদিনী খুশিতে ভরে ওঠে। বিহারীর অবর্তমানে বিনোদিনী তার সমস্ত ঘটনা সে বলে।

বিনোদিনীর কাছে বিহারীকে দেখে মহেন্দ্র গর্জে উঠল। হিংসায় সে জ্বলে পুড়ে যেতে লাগল। মহেন্দ্র, বিহারী ও বিনোদিনীকে প্রবলভাবে ভর্ৎসনা করতে থাকে। বিহারী সেই সময় মহেন্দ্রকে জানায় সে বিনোদিনীকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক। বিহারীর এই কথা শুনে মহেন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে যায়। বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে এই বিয়ে করতে নিষেধ করে। কারণ সে জানায় যে বিধবাকে বিয়ে করলে সমাজে তাকে লাঞ্ছিত হতে হবে। বিহারী তখন বিনোদিনীকে ভালোবাসার কথা সরাসরি জানায়। বিহারী ও বিনোদিনীর মধ্যে মনের বন্ধন অটুট রইল। মহেন্দ্র বাড়ী ফিরে গেলেও বাড়ীতে তার কর্তৃত্ব পূর্বের মতো দেখা গেল না। মহেন্দ্র দেখে যে আশা এখন বাড়ীর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে। মহেন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকে। তাই সে মায়ের কাছে ক্ষমাভিক্ষা প্রার্থনা করে। মহেন্দ্রের মনে সমস্ত গ্লানি মুছে গিয়ে আবার পূর্বের মতো সব সম্পর্কের দ্বার খুলে গেল। মহেন্দ্র ও বিহারীর বন্ধুত্বের সম্পর্কের বন্ধন আরো দৃঢ় হল। অন্নপূর্ণা আশাকে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে বিনোদিনীকে নিয়ে কাশীতে চলে গেল। পূর্বের মতো আশা ও মহেন্দ্র দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করল। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ ছোটগল্পের অনেক মিল খুঁজে পায়। এই উপন্যাস ও ছোটগল্পটির রচনাকাল প্রায় সমকালীন। তাই এদের মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। নষ্টনীড়-এর ভূপতি, চারুলতা ও অমলের সঙ্গে চোখের বালির মহেন্দ্র, আশা, বিনোদিনী ও বিহারীর মিল খুঁজে পায়। দুইক্ষেত্রেই প্রেমের দুর্বার আকর্ষণকে আমাদের মনকে নাড়া দেয়।

ডঃ সুকুমার সেনের মতে – “সমাজের ও যুগযুগান্তরাগত সংস্কারের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ চোখের বালির বিষয়।”২৮

অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে – “বালবিধবা বিনোদিনীর চিত্তে পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার জাগরণ ও তার মানসিক পরিবর্তনের টানাপোড়েন এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।”২৯

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে – “চোখের বালিকে উপন্যাস সাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তক বলা যাইতে পারে। অতি আধুনিক উপন্যাসে বাস্তবতা যে বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, এখানেই তাহার সূত্রপাত। নৈতিক বিচার অপেক্ষা তথ্যানুসন্ধান ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণই ইহাতে প্রধান লক্ষ্য। ইহাতে যে প্রেম বর্ণিত হইয়াছে তাহা সমাজনীতির দিক হইতে বিগর্হিত – কিন্তু এই প্রেমের বিচারে কোনো নীতিকথার আড়ম্বর নাই, আছে কেবল ইহার ক্রমপরিণতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।”৩০



‘চোখের বালি’ উপন্যাসে মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবনে কলহের মূল কারণ হল বিনোদিনীর আবির্ভাব। বিনোদিনীকে যদি রাজলক্ষ্মী সঙ্গে করে নিয়ে না আসত তবে হয়তো মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের পরিণতি এত দুঃখের হতো না। বিনোদিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে রাজলক্ষ্মী নিজের পুত্রের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে। কিন্তু এখানে রাজলক্ষ্মী একজন নারী হয়ে অপর একজন নারীর মনস্তত্ত্বের কথা ভাবে না। তাই আমরা এই দাম্পত্য কলহের জন্য রাজলক্ষ্মীকেও দায়ী করতে পারি। এছাড়া বিনোদিনীর, আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের প্রতি প্রতিহিংসার জন্য তার ক্রমশ দুর্নিবার আকর্ষণও এই কলহের জন্য দায়ী। মহেন্দ্রের প্রধান দূর্বলতা তার মন যথেষ্ট সবল ছিল না। তার মানসিকসত্ত্বা অপরের আশ্রয় না পেলে দাঁড়াতে পারত না। মহেন্দ্রের দুর্বল মনের জন্য সে ক্রমশ বিনোদিনীর প্রতি প্রনয়াসক্ত হয়। তাই তাদের দাম্পত্য কলহের জন্য মহেন্দ্রকেও দায়ী করতে হয়। আশা সহজ সরল হওয়ার জন্য মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর সম্পর্ক তৈরি করতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। সে কখনো ভাবতে পারে না যে বিনোদিনীর জন্য তাদের দাম্পত্য জীবনে কখনো অশান্তি আসতে পারে। তাই সে বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের সম্পর্কে অনুঘটক রূপে কাজ করে। তাই তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য আশাও কম দায়ী নয়। পরিশেষে বলতে পারি যে এই উপন্যাসে মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য কলহের জন্য কোন একটি চরিত্রকে দায়ী করা যুক্তিসঙ্গত নয়। এই দাম্পত্য কলহের জন্য প্রায় সব চরিত্রই কোন না কোন ভাবে দায়ী।









তথ্যসূত্র


১. রবীন্দ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯, চতুর্থ প্রকাশ জুলাই,২০০৯, পৃষ্ঠা-৪৯৩

২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫

৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫

৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৬

৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৯

৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৩

৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৫

৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৮

৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৮

১০. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৯

১১. ঐ পৃষ্ঠা-৫২৭

১২. ঐ পৃষ্ঠা-৫২৯

১৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩০

১৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩৬

১৫. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩৬

১৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৪

১৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৪

১৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৭

১৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৮

২০. ঐ পৃষ্ঠা-৫৫৭

২১. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭২

২২. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৪

২৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৫

২৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫৯৩

২৫. ঐ পৃষ্ঠা-৬০৭

২৬. ঐ পৃষ্ঠা-৬২১

২৭. রবীন্দ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯,চতুর্থ প্রকাশ জুলাই,২০০৯, পৃষ্ঠা-৬২১

২৮. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড),সুকুমার সেন,আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯, প্রথম আনন্দ সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৩১৮

২৯. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা – ৭৩, পুনর্মুদ্রণ-২০০৫-২০০৬, পৃষ্ঠা-৪৯৯

৩০. বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, শ্রী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা- ৭৩, নতুন পুনর্মুদ্রণ ২০০৮-২০০৯, পৃষ্ঠা-৮৩

2 comments:

  1. Merkur 37C Safety Razor Review – Merkur 37C
    The Merkur 37c is an excellent short handled febcasino.com DE safety razor. It is 메이피로출장마사지 more suitable for both heavy and non-slip hands deccasino and is 1xbet 먹튀 therefore a apr casino great option for experienced

    ReplyDelete