** আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত **

কিছু কথা....

আপনাদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করতে হলে লেখাটি আমাকে ইমেইল করুন। আমি সেটা নির্দিষ্ট বিভাগে, আপনার নাম দিয়ে প্রকাশ করবো।

আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?

!! আমার ব্লগের সাথে যুক্ত থাকুন !!

ইমেইল এর মাধ্যমে সমস্ত পোষ্টের নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য, নিচের ফাঁকা ঘরে আপনার ইমেইল এড্রেস লিখে ‘সাবস্ক্রাইব’ বাটন-এ ক্লিক করুন।

Blank

Comming Soon

কবিতা সমগ্র

আমার নিজের ও কবিদের লেখা কবিতার সংরক্ষণ

Monday, July 23, 2018

‘দত্তা’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘দত্তা’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী। ১৯০৩ সালে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প মন্দির শরৎচন্দ্রেরই রচনা। তখন কেউ অনুমান করতে পারেনি যে এই গল্পলেখকই কালে রবীন্দ্রনাথকে জনপ্রিয়তায় ম্লান করে দেবেন। ১৩১৯-২০ সনের ‘যমুনা’ পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালের ভারতী পত্রিকায় ‘বড়দিদি’ নামে শরৎচন্দ্রের একটি বড় গল্প প্রকাশিত হলে এটি পড়ে সাধারণ পাঠক মনে করেছিল, রবীন্দ্রনাথই বোধ হয় ছন্মনামে এই কাহিনীবিন্যাস রচনা করেছেন। কিন্তু এই গল্পটি যখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পড়ে দেখলেন তখন তিনি অনুমান করলেন এই গল্পটি যিনিই লিখে থাকুন, তিনি একজন অসাধারণ শিল্পী। আস্তে আস্তে অপরিচয়ের মেঘ সরে গেল। শরৎচন্দ্র স্নিগ্ধ আলোকে নিজের পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথের পাশেই উদিত হলেন। মাত্র বাইশ বৎসরেই সাহিত্য সাধনার মধ্যে তাঁর তিরিশখানি উপন্যাস ও গল্পসংকলন পাঠকসমাজে অসাধারণ প্রভাববিস্তার করেছিল। তিরিশ বৎসরেরও কম সময়ের মধ্যে এতগুলি শ্রেষ্ঠ ও বিচিত্র গ্রন্থ রচনা করে শরৎচন্দ্র অদ্ভুত মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন দেখছি অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যিক অল্প কিছুদিন সাহিত্য গগনে আতশ বাজির রোশনাই সৃষ্টি করেই কালের স্রোতে নিভে যান। কিন্তু শরৎচন্দ্র দীর্ঘদিন কথাসাহিত্যের সাধনা করেছেন, দীর্ঘতর দিন জনপ্রিয়তা রক্ষা করেছেন, এবং সম্প্রতি বাংলা কথাসাহিত্যের অভূতপূর্ব রূপান্তর হলেও সাধারণ পাঠক সমাজে এখনও তিনি একচ্ছত্র সম্রাট। শরৎচন্দ্রের দত্তা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি। উপন্যাসটি পুরোপুরি রোমান্টিক ধরনের সরস গল্প। শরৎচন্দ্র এটিকে ছোটগল্পের উপযোগী কাহিনীকে টানিয়া বুনিয়া দীর্ঘায়িত করেছেন। চার্লস গারভিসের ‘লিওলা ডেলস ফরচুন’ উপন্যাস কাহিনীর সঙ্গে শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’র মিল গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়। শরৎচন্দ্র যে এই উপন্যাসটি প্লটের জন্য খানিকটা ইংরেজী ঔপন্যাসিকের কাছে ঋণী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উপন্যাসের রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী যে পুরোপুরি বাঙালী এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে চরিত্র দুটির পরিস্ফুটতায় ইংরেজীর রঙ অনুভব করা যায়। উপন্যাসের ‘দয়াল’ চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের গোরার পরেশবাবুর ছাঁচে ঢালা। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলি হল বিজয়া, নরেন্দ্রনাথ, বিলাসবিহারী, রাসবিহারী ও দয়াল। উপন্যাসটিতে বিজয়া, নরেন্দ্রনাথ ও বিলাসের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র প্রকটিত হতে দেখা যায়। তাদের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বেই কলহের চিত্র আমরা লক্ষ্য করতে পারি।

উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই জগদীশ, বনমালী ও রাসবিহারী খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। জগদীশ যেমন ছিল সবচেয়ে মেধাবী, তাহার অবস্থাও ছিল সবচেয়ে মন্দ। তার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পিতা যজমানি করে বিয়া পৈতা দিয়াই সংসার চালাইত। বনমালীর পিতাকে লোকে বিত্তশালী ব্যক্তি বলিয়া জানিত। কিন্তু তিনি পল্লীগ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন। রাসবিহারীদেরও অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল। তাহারা তিন বন্ধু ঝড় জল উপেক্ষা করেই পায়ে হেঁটে প্রত্যহ বাড়ী হইতে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করিত। এমনি করেই তিনবন্ধু একসঙ্গে এন্ট্রান্স পাশ করেছিল। বটতলায় বসে ন্যাড়া বটকে সাক্ষী করে তিনবন্ধু প্রতিদিন প্রতিজ্ঞা করত, জীবনে কখনও তাহারা পৃথক হবে না, কখনও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে না এবং উকিল হয়ে তিনজনেই একটা বাড়ীতে থাকবে। তিনজনে রোজগার করে সমস্ত টাকা একটা সিন্দুকে জমা করবে এবং তাই দিয়ে দেশের কাজ করবে। এ তো গেল তাদের তিন বন্ধুর ছেলেবেলার কল্পনা। কিন্তু বড় হয়ে তাহারা এই কাল্পনিক প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারল না। বন্ধুত্বের প্রথম পাকটা এলাইয়া গেল বি.এ. ক্লাসে। কেশব সেনের তখন কলিকাতায় প্রচন্ড প্রতাপ। বক্তৃতার খুব জোর। সে জোর পাড়াগাঁয়ের ছেলে তিনটি হঠাৎ সামলাইতে পারিল না – ভেসে গেল। এরফলেই বনমালী ও রাসবিহারী প্রকাশ্যে ব্রাহ্মধর্ম দীক্ষা নিয়ে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইলেন। কিন্তু জগদীশ ধর্মের কথা চিন্তা করে তা পারল না। কিছুকাল পর পিতার মৃত্যুতে বনমালী কৃষ্ণপুরের জমিদার ও রাসবিহারী তাহাদের রাধাপুরের সমস্ত বিষয়-আশয়ের একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে গেল। কিছুকাল পরে এই দুই বন্ধু ব্রাহ্ম পরিবারে বিবাহ করে বিদৃষী ভার্য্যা নিয়ে গৃহে ফিরে এলেন। কিন্তু জগদীশের সে সুবিধা হল না। সে যথাসময়ে আইন পাশ করে, এক গৃহস্থ ব্রাহ্মণের এগারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করে অর্থোপার্জনের নিমিত্ত এলাহাবাদে চলে যেতে হল। গ্রামের লোকের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে বনমালী গ্রাম ছেড়ে কলিকাতায় এসে বাস করল এবং জমিদারির উপর নির্ভর না করে ব্যবসা শুরু করে দিলেন। রাসবিহারীর অল্প আয় তাই সে গ্রামের লোকের অত্যাচার সহ্য করে গ্রামের থেকে গেল। অতএব তিন বন্ধুর একজন এলাহাবাদে, একজন রাধাপুরে এবং আর একজন কলিকাতায় বাসা করায়, আজীবন অবিবাহিত থেকে এক বাড়িতে বাস করে, এক সিন্দুকে টাকা জমা করে দেশ উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞাটা আপাততঃ স্থগিত রইল।

জগদীশের ছেলে হইলে সে বনমালীকে সুসংবাদ দিয়ে এলাহাবাদ থেকে চিঠিতে জানাল, তোমার মেয়ে হলে, তাকে পুত্রবধূ করব। কারণ তার দয়াতেই সে উকিল হয়ে সুখে আছে একথা কোনদিন ভুলে নাই। বনমালী উত্তরে জানাল যে এই আবেদন রাজী। তাছাড়া জগদীশের ছেলের দীর্ঘজীবন কামনা করলেন। এই ঘটনার দুই বছর পূর্বে তার অপর বন্ধু রাসবিহারীর যখন ছেলে হয়, সেও ঠিক এই প্রার্থনাই করেছিল। ব্যবসা বানিজ্য করে বনমালী এখন মস্ত ধনী। তাই সবাই তার মেয়েকে ঘরে আনতে চায়।

এই ঘটনার পঁচিশ বৎসর পর বনমালী খুব বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। কয়েক বৎসর নানারকম রোগে ভুগে এইবার শয্যা আশ্রয় করিয়া টের পেলেন, আর বোধ হয় উঠতে হবে না। তিনি চিরদিনই ভগবৎপরায়ণ ও ধর্মভীরু ছিলেন। একমাত্র সন্তান বিজয়ার বিবাহ দিয়ে যেতে পারলেন না এটা মনে করে কিছু ক্ষুণ্ণ হলেন। বিজয়াকে সে খুব ভালবাসত তাইতো ছেলের অনুপস্থিতি তাহার মনে কোন দুঃখ ছিল না। বিজয়াকেই সে তার প্রানের চেয়ে প্রিয় মনে করতেন। বিজয়ার উপর এতবড় সম্পত্তি রেখে যেতে তার মনে কোন দ্বিধা নেই কারণ সে বিশ্বাস করত যে তার মেয়ে সব কিছু তার বজায় রাখতে সক্ষম হবে। বনমালী মৃত্যুর আগে মেয়ে বিজয়াকে একটা অনুরোধ করে যায় যে – “জগদীশ যাই করুক আর যাই হোক, সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু তাকে ভালবাসি। দেনার দায়ে তার বাড়ীঘর কখনো বিক্রী করে নিস নে। তার একটি ছেলে আছে – তাকে চোখে দিখিনি, কিন্তু শুনেছি, সে বড় সৎ ছেলে। বাপের দোষে তাকে নিরাশ্রয় করিস নে মা, এই আমার শেষ অনুরোধ।”১ বাবার এই কথা শুনে বিজয়া অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল যে তোমার আদেশ আমি কোন দিন অমান্য করব না। জগদীশবাবু যতদিন বাঁচবেন, তাকে তোমার মতই মান্য করব। কিন্তু তার অবর্তমানে তার সমস্ত বিষয় ছেলেকে ছেড়ে দিতে রাজী হয়নি। কারণ সে জানায় ঐ ছেলে যদি লেখাপড়া শিখে থাকেন তবে অনায়াসেই পিতৃ-ঋণ শোধ করতে পারবেন। মেয়ের কথা শুনে বনমালী জানায় যে তার পিতার ঋণের পরিমাণ অনেক বেশী। তাই ছেলেমানুষ হয়ে তা শোধ করতে পারবে না। উত্তরে বিজয়া জানায় যে পিতার এই ঋণ শোধ করতে পারে না সে কুসন্তান, তাকে বেশী প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

বনমালী তার এই সুশিক্ষিতা তেজস্বিনী মেয়েকে খুব ভালোভাবেই চিনতেন। তাই বেশী পীড়াপীড়ি না করে মেয়ের উপরেই সমস্ত ভার দিয়ে দিলেন। মেয়েকে সে বিশেষ কোন আদেশ দিয়ে আবদ্ধ করে যেতে চায় না। বনমালী এই মেয়েকে বলে যে তার মেয়ের জন্মের আগে জগদীশ তার কাছে মেয়েকে ছেলের সঙ্গে বিবাহ দিতে চায়। তখন আমি বন্ধুর কথায় রাজী হয়েছিলাম বলে তিনি যেন মেয়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। তার এই কন্যাটি ছোট বেলায় মাতৃহীন হইয়াছিল বলে মাতাপিতা উভ্যের স্থান তিনিই পূর্ণ করেছিলেন। তাই বাবার কথা শুনে কোন সংকোচ বোধ না করে বিজয়া বলেছিল যে বাবা তুমি তাকে শুধু মুখের কথা দিয়েছিলে, মনের কথা দাও নি। মেয়ের এই কথা শুনে বনমালী এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে বিজয়া বলে তাহলে তো তার সাথে একবার সাক্ষাৎ করতে চাইতে? বনমালী জানায় যে রাসবিহারীর কাছে সে শুনেছিল যে ছেলেটি নাকি তার মায়ের মতো দুর্বল, তাই ডাক্তারেরা তার দীর্ঘজীবনের কোন আশায় করেনি। এই সব কথা শুনেই বনমালী তার সাথে দেখা করতে চায়নি। তার সাথে দেখা না করে বনমালী মনে করে যে তার বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। সেই সময় বনমালী যে জগদীশকে তার মনের কথাই দিয়েছিল তা বিজয়াকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়। তারপর একটু থেমে বললেন – আজ জগদীশকে সবাই জানে, একটা অকর্মণ্য জুয়াড়ি, অপদার্থ মাতাল। কিন্তু এই জগদীশেই একদিন তাদের সকলের চেয়েই ভালছেলে ছিল। সে প্রতিটি মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পারত। এই ভালোবাসায় তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জগদীশের স্ত্রী ছিলেন সতীলক্ষ্মী। তার মৃত্যুতে শোকে জগদীশ পাগল হয়ে গেছে। তার স্ত্রী মৃত্যুকালে পুত্র নরেনকে আশীর্বাদ করে বলে যেন ভগবানের উপর তার অচল বিশ্বাস থাকে। পরে দেখা গেছে নাকি মায়ের এই আশীর্বাদ টুকু ছেলে নরেন একেবারে নিষ্ফল করে নাই। নরেন এইটুকু বয়সেই ভগবানকে তার মায়ের মতোই ভালবাসতে শিখেছে। বনমালী তার মেয়েকে নরেন সম্পর্কে জানায় সে একজন ডাক্তার কিন্তু ডাক্তারি করে না। এখন সে তার মামার কাছে বর্মায় থাকে। বিলাসবাবুর আগমন সংবাদ ভৃত্য আলো দিতে এসে জানিয়ে যায়। বিলাসবিহারী হল রাসবিহারীর পুত্র। বনমালী ব্যবসায়ীর শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের জমিদারী অনেক বাড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সেসমস্ত তত্ত্বাবধানের ভার বাল্যবন্ধু রাসবিহারীর উপরেই ছিল। এই জন্যেই বিলাসের এই বাটীতে আসা-যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল।

দুইমাস হল বনমালীর মৃত্যু হয়েছে। বিজয়া একা হয়ে যাওয়ায় তার দেশের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা রাসবিহারীই করতে লাগল এবং সেই সূত্রে তার একপ্রকার অভিভাবক হয়ে বসলেন। কিন্তু যেহেতু রাসবিহারী গ্রামে থাকতেন সেই জন্য তার পুত্র বিলাসবিহারীর উপরেই বিজয়ার সমস্ত খবরদারীর ভার পড়ল। সেই তার প্রকৃত অভিভাবক হয়ে উঠল। একদিন হঠাৎ বিলাসবাবু বৃদ্ধ মাতাল জগদীশের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন। জগদীশ বিজয়ার পিতৃবন্ধু ছিলেন। বিলাস তখন বিজয়াকে জানায় যে জগদীশ মুখুজ্জ্যে তার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন, কিন্তু তিনি তার মুখ পর্যন্ত দেখতেন না। জগদীশবাবু টাকা ধার করতে দুবার এসেছিল। কিন্তু তার বাবা চাকর দিয়ে তাকে বাড়ীর বাইরে বার করে দিয়েছিলেন। বিলাসের পিতা জগদীশবাবুকে সহ্য করতে পারতেন না, একথা শুনে বিজয়া তাকে একপ্রকার সমর্থন করেন। বিজয়ার কথা শুনে বিলাসবাবু খুব উৎসাহিত হয়েছিল। তাই বিলাসবাবুকে বলতে শুনি – বন্ধুই হোক আর যাই হোক দুর্বলতার বশে কোন মতেই ব্রাহ্মসমাজে চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিৎ নয়। বিলাসবাবু তখন বিজয়াকে জানায় এখন যদি জগদীশবাবুর পুত্র তার বাবার সমস্ত ঋণ শোধ করতে না পারে তবে আইন মতে তার সম্পত্তি আমাদের হাতে নেওয়া উচিত। তাই সেটা ছেড়ে দেবার আমাদের কোন অধিকার নেই। কারণ সেই টাকায় আমরা সমাজের অনেক সৎকার্য করতে পারি। এছাড়া জগদীশবাবু কিংবা তার ছেলে আমাদের সমাজভুক্ত নয় যে তার উপর কোন প্রকার দয়া করা আবশ্যক। বিজয়ার সম্মতি পেলেই রাসবিহারীবাবু এইসব ঠিক করে ফেলবেন বলেই বিলাসকে এখানে পাঠিয়েছেন। তখন বিজয়া মৃত পিতার শেষ কথাগুলো স্মরণ করে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ সাহস করে জবাব দিতে পারল না। বিজয়াকে ইতস্ততঃ করতে দেখে বিলাস রেগে গিয়ে বলল আপনাকে ইতস্ততঃ করতে আমি কোন মতেই দিব না। অর্থাৎ এই কর্মে সে যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তা জানিয়ে দিল। বিজয়া যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব করে মহাপাপ করেছেন তা বিলাস জানিয়ে দেয়। বিলাস এরপর জানায় সে ঠিক করেছে যে ঐ বাড়ীটায় ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেবে। বিলাস এরপর বিজয়াকে পিতার পূর্ব কথা মনে করিয়ে দিয়ে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। তাই আপনার পিতার প্রতিশোধ নিয়ে এই কাজ করা উচিত। বিজয়া এই কথা শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এই কাজ করে তার কত নামধাম হবে তা মনে করিয়ে দেয় বিলাস। হিন্দুরা স্বীকার করবে যে ব্রাহ্মসমাজে মানুষ আছে, হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে। যাকে তারা নির্যাতন করে দেশ থেকে বিদায় করে দিয়েছিল, সেই মহাত্মারই মহীয়সী কন্যা তাদের মঙ্গলের জন্য এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে এর জয়গান হবে। এত বড় নামের লোভ সংবরণ করা বিজয়ার পক্ষে সম্ভব হল না। কিন্তু পিতার কথাগুলি মনে করে দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। বিজয়া এরপর জগদীশবাবুর ছেলের কথা বিলাসের কথা জানতে চাইল।

বিলাস বিজয়াকে জানায় যে তার ছেলে বর্তমানে গ্রামেই আছে। বিলাস তার বিশ্রী চেহারার বর্ণনা বিজয়াকে জানায়। জগদীশ বাবুর বাড়ীটা দখল করে নিলে কেউ গোলমাল করবে না কারণ তার প্রতি কোন ব্যক্তিরই কোন সহানুভূতি ছিল না। বিলাস বিজয়াকে একথা জোর করে আশ্বাস দেয়। বিলাস বিজয়াকে কিছুদিনের জন্য গ্রামে যাওয়ার জন্য আবেদন জানায়। বিজয়া বিলাসের কাছে এর কারণ জানতে চায়। উত্তরে বিলাস জানায় তার প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। প্রজাদের এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করা যে মহাপাপ তা তাকে জানিয়ে দেয়। এই কথা শুনে বিজয়ার সমস্ত মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়া এরপর জানায় সে পিতার কাছে জেনেছে তাদের গ্রামের বাড়ী বসবাসের অযোগ্য। এই কথা শুনে বিলাস জানায় সে দশ দিনের মধ্যে ঐ ঘরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বসবাসের যোগ্য করে দেবে। বিলাস রুঢ় কণ্ঠে জানায় যে আপনাকে সামনে রেখে আমি যে কি করতে পারি তা বোধ করি সীমা – পরিসীমা নেই। বিজয়াকে গ্রামে যেতে রাজী করিয়ে বিলাস প্রস্থান করল। কিন্তু বিজয়া সেখানেই চুপ করে বসে রইল। বিজয়া এই গ্রামের যেসব কথা পিতার কাছে শুনেছে তা স্মরণ করতে লাগল। তখন গ্রামের কথা শুনে তাহার কিছুমাত্র মনযোগ আকর্ষণ করতে পারত না। কিন্তু আজ ঐ গ্রামের কথা মনে করে তার আকর্ষণ বেড়ে গেল। কারণ সে অনুমান করল যে ঐ বাড়ীতে তার সাত পুরুষের বাস। তাই সেই বাড়ীর প্রতি তাহার একটা আকর্ষণ দেখা গেল। বিজয়ার পরলোক গত পিতৃদেবের সমস্ত গ্রাম সম্বন্ধে কথা গুলি স্মরণ করে তাহার প্রছন্ন বেদনার অকস্মাৎ এক মুহূর্তেই তাহার মনের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই কথা চিন্তা করতে করতে সে অনুমান করে যে ভিটার সঙ্গে তার জন্মাবধী পরিচয় নাই, তা আজ তাকে দুর্নিবার শক্তিতে টানতে লাগল।

বহুকাল পর জমিদার বাটি বিলাসের তত্ত্বাবধানে মেরামত হতে লাগল। কলকাতা থেকে বিচিত্র আসবাব পত্র গরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে প্রতিদিন আসতে লাগল। জমিদারের একমাত্র কন্যা দেশে বাস করতে আসবেন, ঐ সংবাদ প্রচারিত হওয়া মাত্র কেবল কৃষ্ণপুর নয় আশে পাশের সমস্ত গ্রামের মানুষ হৈ চৈ করতে লাগল। ঘরের পাশে জমিদারের বাস চিরদিনেই লোকের অপ্রিয় তাতে জমিদারের না থাকাটাই প্রজাদের কাছে একটা অভ্যাস হইয়া দাঁড়িয়েছে। সুতরাং নতুন করে তার বাস করবার বাসনটা সকলের কাছেই একটা অন্যায় উৎপাতের মত প্রতিভাত হল। গ্রামের লোকের কাছে একটা জনশ্রুতি ছিল যে জমিদার কন্যার সঙ্গে রাসবিহারীর পুত্র বিলাসের বিবাহ স্থির হয়ে গেছে। পূর্ব পরিকল্পনার মতই শরৎকালের প্রারম্ভেই এ মধুর প্রভাতে মস্ত দুই ওয়েলারবাহিত খোলা ফিটনে চড়ে তরুণী কন্যা নরনারীর সভয় কৌতূহল দৃষ্টির মাঝখানে পিতৃ পিতামহের পুরাতন আবাসস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। পাঁচ ছয়দিন পর একদিন বিজয়া চা পানের পর বিলাস বাবুর সঙ্গে বিষয় সম্পত্তি সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতেছিলেন, বেহারা আসিয়া জানাল একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তখন তাকে এইখানে নিয়ে আসতে বলল। বেহারার পিছনে একজন চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবক তার কাছে বসল। এই লোকটির আচরণে বিন্দুমাত্র সংকোচ দেখা গেল না। তাহার আগমনে বিলাস ও বিজয়া উভয়েই বিস্মিত হয়ে গেল। সে নিজের পরিচয় বলতে গিয়ে জানায় যে পূর্ণ গাঙ্গুলি তাহার মামা, বিজয়ার প্রতিবেশী এবং পাশের বাড়িটাই তার। সে বিজয়াকে প্রশ্ন করল যে পিতৃ-পিতামহের কালের দুর্গা পূজো না কি আপনি বন্ধ করে দিতে চান? এর মানে কি? তার প্রশ্ন শুনে বিজয়া বিজয়া আশ্চর্য এবং মনে মনে বিরক্ত হল কিন্তু কোন উত্তর দিল না। বিলাস উত্তর দিয়ে জানায় যে আপনি কি মামার হয়ে ঝগড়া করতে এসেছেন না কি? কিন্তু কার সাথে কথা বলতে এসেছেন, তা ভুলে যাবেন না। আগন্তুক বিলাসের এই কথা শুনে হেসে জিভ কেটে বলে সে সব আমি সব বুঝি এবং এখানে ঝগড়া করতেও আসিনি। বরং এই কথাটি আমার বিশ্বাস হয়নি বলেই ভাল করে যাচাই করার জন্যই এসেছি। উত্তরে বিলাস জানায় যে তার বিশ্বাস না হওয়ার কারণ কি? আগন্তুক তখন বলে নিরর্থক প্রতিবেশীর ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার জন্য সে একথা মন থেকে বিশ্বাস করতেও পারেনি। ধর্মমত নিয়ে তর্ক বিতর্ক বিলাসের কাছে ছোট বেলা হতেই খুব দক্ষ। বিলাস তাই তার এই কথা শুনে উৎসাহে প্রদীপ্ত হয়ে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের কণ্ঠে বলে - “আপনার কাছে নিরর্থক বোধ হলেই যে কারও কাছে তার অর্থ থাকবে না, কিম্বা আপনি ধর্ম বললেই সকলে তাকে শিরোধার্য করে মেনে নেবে, তার কোন হেতু নেই। পুতুল পুজো আমাদের কাছে ধর্ম নয়, এবং তার নিষেধ করাটাও আমরা অন্যায় বলে মনে করিনে।”২ বিলাসের এই কথা শুনে আগন্তুক তখন বিজয়ার সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। তার বিস্ময় বিজয়াকে মনে মনে আঘাত করল। কিন্তু সে ভাব গোপন করে সহজ ভাবেই বিলাসের মতামতকেই সমর্থন করল। আগন্তুক তখন হতাশ হয়ে জানায় সে তার কাছে এই সিন্ধান্ত আশা করেনি। আগন্তুক এরপর বলে এই পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের সমস্ত আপনার প্রজারা আনন্দ করে তাই তা আপনি বন্ধ করে দেবেন না। এই জন্যই আপনার এই কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনে। দুঃখী প্রজাদের কথা শুনে বিজয়ার কোমল হৃদয় ব্যাথায় ভরে গেল। আগন্তুকের বেশি কথা বলা দেখে বিলাস বিরক্ত হয়ে বলে আপনার সঙ্গে তর্ক করার আমাদের কোন সময় নেই। বিলাস এও জানায় আপনাদের পুজো করার ব্যপারে আমাদের কোন বাধা নেই, কিন্তু ঢাক ঢোল পিটিয়ে রত্রিদিন কানের কাছে বাজানোতে বাধা আছে। বিলাসের সাথে আগন্তুকের এই ব্যাপারে কথা কাটাকাটিতে ঝগড়া খুব চরম সীমায় পৌঁছায়। বিলাসের বাবাকে অপমান করার জন্য আগন্তুকের উপর বিলাস খুব রেগে যায়। বিলাসের এই রূপ দেখে কিন্তু আগন্তুকের ভয়ের কোন চিহ্নমাত্র চেখা গেল না। তাদের উভয়ের বাকবিতণ্ডা দেখে বিজয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। আগন্তুকের প্রতি বিলাসের এই খারাপ ব্যবহার দেখে বিজয়া লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়া এরপর বিলাসকে বলে মাত্র তিন চারদিন তারা একটু গোলমাল করলে কোন অসুবিধা হবে না। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়। পরিশেষে বিজয়া আগন্তুককে জানিয়ে দেয় প্রতি বছরের মতো এবছরেও তারা তাদের পুজো করুক, তাতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। বিজয়ার এই কথা শুনে আগন্তুক ও বিলাসবাবু উভয়েই বিস্ময়ে অবাক হয়ে বিজয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একথা বলে দেওয়া দরকার যে এই অপরিচিত যুবকটিই তাদের সর্বপ্রধান আসামী জগদীশের পুত্র নরেন্দ্রনাথ।

বিজয়া এরপর বিলাসের কাছে জানতে চাইল ঐ তালুকটা নেওয়ায় আপনার বাবার মতামত কি? বিলাস সঙ্গে সঙ্গে তার বাবার মতামতকে সমর্থন করে। বিলাসের পিতার মতামতকে অগ্রাহ্য করে বিজয়া আগন্তুককে পুজো করার অনুমতি দিলে তাতে বিলাস মনে মনে ক্ষুণ্ণ হয়। তাই বিলাস রেগে গিয়ে বিজয়াকে বলে - “বেশ, আপনার এস্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান নিন, কিন্তু এরপরে বাবাকে আমায় সাবধান করে দিতেই হবে, নইলে পুত্রের কর্তব্যে আমার ত্রুটি হবে।”৩ বিলাসের এই অচিন্তনীয় রুঢ় ব্যবহারে বিজয়া বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। বিজয়া এজন্য বিলাসের কাছে তার আচরণের জন্য সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে নেয়। তাই বিজয়া ভেবেছিল বিলাস বুঝি এরপর এনিয়ে আর কোন কথা বলবে না। কিন্তু বিলাস আবার জানায় যে পূর্ণ গাঙ্গুলিকে জানিয়ে দিন যে পূর্বের অনুমতিটিই যেন সে মেনে চলে, অর্থাৎ পুজো যেন বন্ধ করে। বিজয়া এই কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয় একথা জানাতে দ্বিধা বোধ করে না। এই কথা শুনে বিলাস খুব রেগে যায়। তাই সে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারে - “আপনি যদি তাকে সমস্ত গ্রামের মধ্যে অশ্রদ্ধার পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তাহলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।”৪ বিলাস যে কতটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে পারে তা আমরা তার এই কথাতেই অনুমান করতে পারি। বিলাসের এই কথা শুনে বিজয়ার অন্তরটা অকস্মাৎ ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু সে নিজেকে আত্মসংযম করে নিল। বিজয়া তাই শান্তভাবেই জবাব দিল আপনি যা পরেন করবেন কিন্তু অপরের ধর্মে কর্মে আমি বাধা দিতে পারব না। এই নিয়ে তাদের আলোচনা করতে করতে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে অবনতি দেখা যায়। বিজয়া ও বিলাসের মধ্যে ঝগড়া একটা চরম জায়গায় পৌঁছে যায়। বিজয়ার আচরণে রাসবিহারীও বিরক্ত হয়ে যায়। তাই তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেবার কথা বলে হুমকি দেয় বিজয়াকে। তার কথা শুনে বিজয়া কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকে যায়, যেন সে তার অপরাধটা একপ্রকার স্বীকার করে নেয়। বিজয়ার এই কোমল ভাব দেখে রাসবিহারী খুশি হয়ে বিষয় সংক্রান্ত অন্যান্য কথাবার্তা সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকল। জগদীশের বাড়ীটা খুব তাড়াতাড়ি দখল করে সমাজকে দান করার কথা বললেন। জগদীশের সাথে বিজয়ার বাবার ঋণ সম্পর্কে শর্তের সমস্ত কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় রাসবিহারী। এই কথা শুনে বিজয়া জানায় জগদীশ বাবুর ছেলেকে একবার এখানে ডেকে আরও কিছুদিন সময় দিয়ে দেখলে হয় না, যদি কোন উপায়ে তা ফিরিয়ে নিতে পারে। বিজয়ার এই কথা শুনে জগদীশ ছেলের প্রতি একটা দুর্বলতার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। বিজয়া যে এই বাড়ীটা দখল করতে ইচ্ছুক নয় তার এই সহানুভূতি সম্পন্ন কথা শুনেই অনুমান করা যায়। কিন্তু জগদীশের ছেলে যে তার কোন ব্যবস্থা করতে পারবে না, তা রাসবিহারী সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াকে জানিয়ে দেয়। পিতার কথা শেষ না হতেই বিলাস গর্জন করে বলে সে পারলেই আমরা দেব কেন? কারণ তার সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। তাই সেই বাড়ী এখন আইনত আমাদের। বিলাস এরপর জগদীশ বাবু সম্পর্কে নানারকম কুরুচিকর মন্তব্য করে। বিলাসের এই আচরণে বিজয়া মনে মনে খুব দুঃখ পায়। তাই বিজয়া রাসবিহারীর মুখের দিকে চেয়ে শান্ত কণ্ঠে জানায়, জগদীশ বাবু আমার বাবার বন্ধু ছিলেন, তার সম্বন্ধে সসম্মানে কথা বলতে বাবা আমাকে আদেশ দিয়ে গেছেন। বিলাস এরপর পুনরায় গর্জন করে উঠে। তাই রাসবিহারী তাকে চুপ করতে বললেন। বিলাস তখন রেগে গিয়ে বলে - “এসব বাজে সেন্টিমেন্ট আমি কিছুতেই সইতে পারিনে - তা সে কেউ রাগই করুক, আর যাই করুক। আমি সত্য কথা বলতে ভয় পাইনে, সত্য কাজ করতে পেছিয়ে দাঁড়ায়নে।”৫

রাসবিহারী তখন উভয় পক্ষকেই শান্ত করবার চেষ্টা করল। বিজয়া বলে তার বাবা মৃত্যুর পূর্বে তাকে আদেশ করে গিয়েছিলেন, ঋণের দায়ে তার বাল্য বন্ধুর প্রতি যেন আমি অত্যাচার না করি। একথা বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস বলে তবে তিনি কেন সমস্ত দেনাটা নিজে ছেড়ে দিয়ে গেলেন না শুনি? বিলাসের কথার কোন উত্তর না দিয়ে রাসবিহারীকে পুনরায় বিজয়া বলে জগদীশ বাবুর পুত্রকে ডেকে পাঠিয়ে সমস্ত কথা জানানো হয়, এই আমার ইচ্ছে। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস তাকে বিদ্রূপ করতে লাগল। বিজয়া এর কোন উত্তর দিল না। রাসবিহারী একাজ করতে পারবে কিনা তা জানতে চাইল। রাসবিহারী অতিশয় ধূর্ত লোক। তাই তিনি ছেলের ঔদ্ধ্যতের জন্য মনে মনে বিরক্ত হলেও বাইরে বিজয়ার মতকেই সমীচীন প্রমান করবার জন্য চেষ্টা করলেন। বিজয়ার সাথে বিলাসের তর্কবিতর্কের জন্য তাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। তাই তার একে অপরকে আর সহ্য করতে পারছিল না। দিঘড়ায় স্বর্গীয় জগদীশ বাবুর বাড়ীটা সরস্বতীর পরপারে। আজ হঠাৎ বিজয়া বিকেল বেলায় দারোয়ান কানাই সিংকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বাইরে বের হলেন। বিজয়া চলিতে চলিতে হঠাৎ একস্থানে এসে তার চোখে পড়ল নদীর মধ্যে গোটাকয়েক বাঁশ একত্র করে পরপারের জন্য একটা সেতু প্রস্তুত করা আছে। এটি ভালো করে দেখবার জন্য বিজয়া যখন জলের ধারে পৌঁছল তখন দেখতে পেল কিছু দূরে বসিয়া একজন খুব মনোযোগ সহকারে মাছ ধরিতেছে। বিজয়ার সাড়া পেয়ে লোকটি মুখ তুলিয়া নমস্কার করল। যে মাছ ধরছিল সে যে সেইদিনের সেই আগন্তুক, পূর্ণ বাবুর ভাগিনেয় তা বিজয়া চিনতে পারল। বিজয়া তখন প্রতি নমস্কার করে তার কাছে এসে কথাবার্তা বলল। বিজয়া তাকে তার বাড়ীর সন্ধান জানতে চাইল। সে তখন জানায় তার বাড়ী দিঘড়ায়, এই বাঁশের পুল দিয়ে যেতে হয়। গ্রামের নাম শুনিয়া বিজয়া তাকে জিজ্ঞাসা করে তার জগদীশ বাবুর ছেলের সাথে পরিচয় আছে কিনা? বিজয়া যে জগদীশ বাবুর বাড়িটি দেনার দায়ে কিনে নিয়েছে তা জানিয়ে দেয় ঐ লোকটি। বিজয়া তখন তাকে জিজ্ঞাসা করে যে ঐ বাড়িটি কেমন? বাড়িটি যে খুব ভালো তা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় ঐ লোকটি। লোকটি তখন বিজয়াকে ঐ বাড়িটির দিকে নিয়ে যায়। পথে যেতে যেতে নরেন সম্পর্কে অনেক কথা জানতে চায় বিজয়া। বিজয়া তখন ঐ ভদ্রলোককে জানায় নরেন বাবুকে দেনাটা শোধ করে দেওয়ার জন্য। উত্তরে ভদ্রলোকটি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয় তা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলে বিজয়া অনুমান করে যে তার সাথে নরেনের খুব ভালো পরিচয় আছে। বিজয়ার এই কথা শুনে ভদ্রলোকটি শুধু হাসল কিন্তু কোন কথা বলল না। ভদ্রলোকটি এরপর চলে যেতেই বিজয়া কিছুক্ষণ বিমনা হয়ে গিয়েছিল। বিজয়া এরপর রাসবিহারীকে নোটিশ দিয়ে জগদীশ বাবুর ঘরটি দখল রদ করতে বলে। এই কথা শুনে রাসবিহারী অবাক হয়ে যায়। বিজয়া বলে তিনি হয়ত অপমানের ভয়ে এখানে আসতে পারেন নি। কারণ তিনি ভেবেছেন নিশ্চয় তার প্রার্থনা আমরা মঞ্জুর করব না। বিজয়া এরপর রাসবিহারীকে নোটিশ করতে বলে জানায় এটাই তার শেষ অনুরোধ। কিন্তু রাসবিহারী বিজয়ার এই অনুরোধ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সে জানায় আমার কাছে কর্তব্য বোধ সবচেয়ে বড় তা সে যত কঠিনই হোক না কেন। এদিকে বিলাস এই বাড়িটি দখল করার জন্য পিতাকে জোরজবরদস্তি করতে থাকে। পুত্রের কথা শুনে রাসবিহারী কোন কথা বলে না। বিজয়াও খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নীরবে সম্মতি দিল বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার পরদুঃখে স্নেহ কোমল নারীচিত্ত রাসবিহারীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও বিলাসের প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল।

রাসবিহারী এরপর বিজয়াকে বলে বিলাস যা করতে চেয়েছিল, তা স্বার্থের জন্যেও নয়,রাগের জন্যেও নয়, শুধু কর্তব্য বলেই চেয়েছিল। তারপর রাসবিহারী নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য জানায় একদিন আমার বিষয়, তোমার বাবার বিষয় সব এক হয়েই তোমাদের দুজনের হাতে পড়বে, যেদিন বুদ্ধি দেবার জন্যে এ বুড়োকেও খুঁজে পাবে না। তিনি এই কথার দ্বারা বিজয়াকে বলতে চাইলেন যে বিজয়া ও বিলাসের বিবাহ বন্ধনে এক সুত্রে জীবন যাপনের কথা। রাসবিহারী মনে মনে ইচ্ছা ছিল নিজের ছেলের সাথে বিবাহ দেবার। রাসবিহারীর এই অকাট্য যুক্তির কথা শুনে বিজয়া কোন বিরুদ্ধাচরণ না করে চুপচাপ থেকে গেল। নিজের ছেলের মহান কৃতিত্বকে বোঝানোর জন্য তাই রাসবিহারী জানায় সে ছেলেমানুষ হলেও কিন্তু অনেকদুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজ করে। তাই মাঝে মাঝে জমিদারির কাজ ওর চাল বুঝতে আমাকেও স্তম্ভিত হয়ে চিন্তা করতে হয়। এই কথা শুনে বিজয়া কোন উত্তর দিল না। রাসবিহারী তখন বলে এই সমাজ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় বিলাস যে কিরকম উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তা মুখে প্রকাশ করে বলা যায় না। রাসবিহারী পুত্রের কাজ বড়াই করে বলে বিজয়াকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। কারণ বিজয়ার সম্পত্তির প্রতি রাসবিহারীর একটা লোভ ছিল। তাই যদি বিজয়াকে ছেলের বউ করা যায় তবে তার সমস্ত সম্পত্তি তাদের আয়ত্তে চলে যাবে। পরের দিন বিজয়া আবার দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে ঘুরতে চলে গেল। বিজয়া দেখে ঠিক সেইখানে আজও সেই লোকটি মাছ ধরছিল। এদিন কিন্তু তার সাথে কোন কথা না বলে চলে যেতে চাইছিল কিন্তু কানাই সিং তার সাথে কথা বলল। দারয়ানের কথা কানে যাওয়ামাত্রই তার মুল পর্যন্ত বিজয়ার আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে ভদ্রলোকটি তার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখে। কথা বলতে বলতে একবার নিজেকে ডাক্তার বলে ফেললেও কিন্তু পরক্ষণে তা অস্বীকার করে জানায় তার প্রতিবেশী একজন ডাক্তার। বিজয়া অনুমান করে যে জগদীশ বাবুর ছেলে নরেন এই ভদ্রলোকটির একজন বন্ধু। ভদ্রলোকটি বিজয়াকে জানায় যে নরেনবাবু তার দরিদ্র কৃষকদের চাষবাস নিয়ে লেখাপড়া শেখায় বিনামূল্যে। বিজয়া নরেন বাবুর গৃহে স্কুলের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। গরীব চাষিদের সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করার শিক্ষাই দিতে তার এই স্কুল। ভদ্রলোকটি বিজয়াকে জানায় ওই স্কুল দেখতে যাবার জন্য অনুরোধ করে। লোকটি বলে মাঠের মাঝখানে গাছের তলায় বাপ-ব্যাটা –ঠাকুরদায় মিলে সেখানে পাঠশালা বসে। এইসব কথা শুনে বিজয়া তৎক্ষণাৎ সেখানে যাবার জন্য উদ্যত হয়ে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই কৌতূহল দমন করে বলল না আজ থাক। এরপর বিজয়াকে খানিকটা এগিয়ে দিতে আসে ঐ ভদ্রলোকটি। মিনিট পাঁচ ছয় বিজয়া কোন কথা বলিল না, ভিতরে ভিতরে তার কেমন যেন লজ্জা করিতে লাগল অথচ এই লজ্জার কারণ সে কিছু খুঁজে পেল না। লোকটি এরপর বিজয়াকে বলে - “আপনি ধর্মের জন্যই যখন তার বাড়ীটা নিচ্ছেন – এই ক’বিঘে জমি যখন ভালো কাজেই লাগছে তখন এটা ত আপনি অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারেন?”৬ এইকথা গুলি বলে লোকটি মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। উত্তরে বিজয়া জানায় এই অনুরোধ করার আপনার কোন অধিকার আছে কি তার তরফ থেকে। লোকটি তখন স্পষ্টভাবে বলে এ অধিকার দেবার ওপর নির্ভর করে না, নেবার ওপর নির্ভর করে। এই অনুরোধ গৃহীত হলে তার নিজস্ব কোন লাভ হবে না। তাই সে নিরন্ন দরিদ্র কৃষকদের কথা ভেবেই এই অনুরোধ জানায়। তাদের সেবার অধিকার সকলেরই আছে,তাই সে নরেনের কাছে অনুমতি চাইতে যাবে না। ভদ্রলোকটি তার কথার ইঙ্গিতে বিজয়াকে বুঝিয়ে দিতে চায় সেই হল নরেন বাবু। কিন্তু বিজয়া তা বুঝতে পারেনি। বিজয়ার সাথে ভদ্রলোকটির কথাবার্তার মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের উৎপত্তি দেখতে পায়। কিন্তু এরমধ্যেই দুইদিন ঐ ভদ্রলোকের সাথে খোলামেলা কথা বলে বিজয়ার তার প্রতি একটা আকর্ষণের সৃষ্টি হয়।

বাড়ীর মধ্যে এসে বিজয়ার দুইটা কথা মনকে সর্বাপেক্ষা অধিক আচ্ছন্ন করিল, তার মধ্যে একটা হল ঐ ভদ্রলোকটির নাম না জানা এবং দ্বিতীয় হল দুইদিন পরে তিনি কোথায় চলে যাবেন। এই দুটি প্রশ্ন তার শতবার মুখে এসে পড়লেও কেবল লজ্জাতেই মুখ বাধিল। বিজয়ার এই আচরণ দেখে আমরা অনুমান করতে পারি ঐ ভদ্রলোকটির প্রতি তার মন খুব আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। তাই বিজয়ার মনে শুধু তার কথাই চিন্তা করতে লাগল। এমন সময় পরেশের মা এসে বিজয়াকে জানায় বিলাসবাবু বহুক্ষণ ধরে বাইরে বসবার ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই কথা শুনে বিজয়ার মন শ্রান্তি ও বিরক্তিতে ভরে গেল। বিলাসবাবুই যে এ বাড়ীর ভবিষ্যৎ কর্তৃপক্ষ, এ সংবাদ আত্মীয় পরিজন কারও জানতে বাকি ছিল না। সেই কারনেই তার আদর যত্নের ত্রুটি হতে পারত হত না। বিজয়া কোন কথা না বলে উপরে তার ঘরে চলে গেল। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে বিজয়া বিলাসবাবুর ঘরে গেল। বিলাস বলে - “তুমি নিশ্চয় ভেবেছ, আমি রাগ করে এতদিন আসিনি। যদিও রাগ আমি করি নে, কিন্তু করলেও যে সেটা আমার পক্ষে কিছুমাত্র অন্যায় হত না, সে আজ আমি তোমার কাছে প্রমান করব।”৭ বিলাস এতদিন বিজয়াকে আপনি বলিয়া ডাকিত কিন্তু আজ হঠাৎ তুমি সম্বোধনের কারণ কিছুমাত্র উপলব্ধি করতে না পারলেও বিজয়া যে অখুশি হয়নি তা তার মুখ দেখে বোঝা গেল। কিন্তু সে কোন কথা না বলে ঘরের মধ্যে এসে বসে পড়ল। বিলাস অচলাকে জানায় তাদের ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা সে বড়দিনের ছুটিতে করতে চায়। এরজন্য সে সমস্ত ঠিক করে ফেলেছে, এমনকি নিমন্ত্রণ করা পর্যন্ত হয়ে গেছে একথা বিজয়াকে জানায়। তার জন্য তাকে কাল থেকে খুব ঘুরতে হয়েছে। এরপর এই অনুষ্ঠান করা তার একটা তালিকা কাগজে লেখা বিজয়াকে দেখতে দেয় বিলাস। কিন্তু বিজয়া এতে খুব একটা কৌতূহল প্রকাশ না করে চুপচাপ থেকে গেল। বিজয়ার এই মৌন অবস্থা দেখে বিলাস অবাক হয়ে তার কারণ জিজ্ঞাসা করল। বিজয়া তখন ধীরে ধীরে বলল- আমি ভাবছি, আপনি যে নিমন্ত্রণ করে এলেন, এখন তাদের কি বলা যায়? বিজয়ার এই কথার কোন অর্থ বুঝতে পারল না বিলাস। বিজয়া তখন জানায় মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে সে এখনো কিছু স্থির করে উঠতে পারেনি। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস রাগে গর্জে উঠে। তাই তো বিলাস বিজয়াকে বলে – “তার মানে কি? তুমি কি ভেবেছ, এই ছুটির মধ্যে না করতে পারলে আর শীঘ্র করা যাবে? তারা ত কেউ তোমার – ইয়ে নন যে, তোমার যখন সুবিধে হবে, তখনই তারা এসে হাজির হবে? মন স্থির হয়নি, তার অর্থ কি শুনি?”৮ বিলাসের রাগে চোখ দুটি জ্বলতে লাগল। বিজয়া বহুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকে আস্তে আস্তে বলল - “আমি ভেবে দেখলুম, এখানে এ নিয়ে সমারোহ করবার দরকার নেই।”৯ বিজয়ার কথা শুনে বিলাস জানায় এই কাজ সমারোহ তারা করবে না। বরং তার কাজ নিঃশব্দে সমাধা করবার জ্ঞান তার আছে। তোমাকে সে জন্য চিন্তা করতে হবে না। বিজয়া তখন মৃদু কণ্ঠে জানায় যে এখানে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কোন সার্থকতা নেই। তাই সেটা হবে না। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস রেগে যায় এবং বিজয়া যে সত্যিই ব্রাহ্ম মহিলা এতে সে সন্দেহ প্রকাশ করে। বিজয়া এই কথা শুনে তীব্র আঘাতে যেন চমকে মুখ তুলে চায় কিন্তু আপনাকে সংযত করে বলে আপনি বাড়ী গিয়ে শান্ত হয়ে ফিরে এলে তার পরে আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হবে - এখন থাক। বিলাস এরপর বিজয়ার সংস্রব একেবারে পরিত্যাগ করার কথা বলে ধমক দিতে লাগল। বিজয়া এই কথা শুনে তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। তাই বিজয়া নিঃসংশয়ে বলতে পারে - “আপনার দায়িত্ব বোধ যখন এত বেশি, তখন আমার অনিচ্ছায় যাদের নিমন্ত্রণ করে অপদস্থ করবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের ভার নিজেই বহন করুন, আমাকে অংশ নিতে অনুরোধ করবেন না।”১০ বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস দুই চক্ষু প্রদীপ্ত করে জোর গলায় বলে – “আমি কাজের লোক - কাজই ভালোবাসি, খেলা ভালোবাসিনে - তা মনে রেখো বিজয়া।”১১ বিজয়া স্বাভাবিক শান্ত সুরে তার এই কথা গ্রহণ করে। এই কথার মধ্যে যে শ্লেষটুকু ছিল তা বিলাসকে একেবারে উন্মত্ত করিয়া দিল। তাই সে চিৎকার করে বলে আচ্ছা, তুমি যাতে না ভোলো তার আমি চেষ্টা করব। কিছুক্ষণ পর বিজয়া জানায় যে এ বাড়ী যে নিতেই হবে তা কিন্তু এখনো স্থির হয়নি। এই কথা শুনে বিলাস রাগে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। তাই সে রাগে মাটিতে জোরে পা ঠুকিয়া পুনরায় চিৎকার করে বলে – হয়েছে, একশবার হয়েছে। আমি সমাজের মান্য ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করে এনে তাদের অপমান করতে পারব না- এ বাড়ী আমাদের চাইই। এ আমি করে তবে ছাড়ব- এই তোমাকে আজ আমি জানিয়ে গেলুম। বিলাসের এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে এই বাড়ীতে ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করার জন্য সে কতটা উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল। বিজয়ার সাথে বিলাসের এই ঘর দখল করা নিয়ে যে বাকবিতণ্ডা হয় তা চরম পর্যায়ে চলে যায়। তাই তাদের মধ্যে যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল তা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। বিলাস যে মনে মনে বিজয়াকে বিয়ে করার সংকল্প করে তা যেন তার মন থেকে একেবারে শেষ হয়ে যায়। বিজয়া কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তেই অটুট থেকে যায়। বিলাসের ঔদ্ধত্যের কাছে সে কিন্তু মাথা নিচু করেনি। তাই এখানে আমরা বিজয়ার আচরণ দেখে মনে হয় সে একজন মালিকের ভুমিকায় উত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই সে তার কর্মচারীকে গুরুত্বহীন ভাবে দেখতে শুরু করে।
জগদীশ বাবুর বাড়ীটা বিজয়ার দখল করার কোন ইচ্ছেই ছিল না। কারণ তার বাবা মৃত্যুকালে তাকে যে উপদেশ দিয়েছিল তাকে মান্যতা দেবার জন্যই সে এমন আচরণ করে। সেইদিন হতে বিজয়ার মনের মধ্যে এই আশাটা অনুক্ষণ যেন তৃষ্ণার মত জাগছিল যে, সেই অপরিচিত লোকটি যাবার পূর্বে একবার অন্তত তার বন্ধুকে নিয়ে তার কাছে অনুরোধ করতে আসবে। তাদের মধ্যে যা কথা হয়েছিল সমস্ত গুলি তার অন্তরের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটি শব্দ পর্যন্ত বিজয়া ভুলে যায় নাই। বিজয়ার এই আচরণে আমরা লক্ষ্য করে অনুমান করে বলতে পারি যে বিজয়া এই ভদ্রলোকটির প্রতি একটা ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তাই সে তার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। নদী তিরের পথে এখন আর তার সাথে বিজয়ার সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মনে মনে আশা করত যে, একবার না একবার তিনি তার কাছে দেখা করতে আসবেনই। বিলাসের সাথে বিজয়ার যে বিরাট তর্কাতর্কি হয় তা জেনেও রাসবিহারী কোন গুরুত্বই দেয় নি। তাই সে বিজয়ার কাছে এমন ভাব দেখায় যেন ছেলের সঙ্গে যে ইতিমধ্যে তার কোন কথা হয়েছে তার আভাস ছিল না। এই নিয়ে যে আর কোন প্রকার আন্দোলন উঠতে পারে তা যেন তার মনেই আসতে পারে না। তাই বিজয়া তার কাছে নিজেই কথাটা উত্থাপন করিতে পারিল না। পৌষের ঠিক প্রথম দিনটিতে পিতা পুত্র একসঙ্গে বিজয়ার সঙ্গে দেখা করলেন। রাসবিহারী বিজয়াকে জানায় আর বেশি দিন নেই তাই তাড়াতাড়ি সমস্ত গুছিয়ে ফেলতে হবে। বিজয়া তখন একটু বিস্মৃত হয়ে বলে সে নিজের ইচ্ছায় চলে না গেলে, কিছুই হতে পারে না। রাসবিহারী তৎক্ষণাৎ বিজয়াকে জানায় কালকে নরেন বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে। এই কথা শুনে বিজয়ার বুকের ভিতর খুব আঘাত লাগল। রাসবিহারীকে বিজয়া জিজ্ঞাসা করে তার জিনিসগুলোর খবর? এই কথা শুনে বিলাস সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রূপ করে। বিলাসের কথা শুনে বিজয়া চুপ করে থাকে কিন্তু তার মুখের উপর একটা বেদনার চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। তাই বিজয়ার এই দৃশ্য দেখে রাসবিহারী ছেলেকে রেগে গিয়ে বলে – “ওটা তোমার দোষ বিলাস। মানুষ যেমন অপরাধীই হোক ভগবান তাকে যত দণ্ডই দিন, তার দুঃখে আমাদের দুঃখিত হওয়া, সমবেদনা প্রকাশ করা উচিত। আমি বলছিনে যে, তুমি অন্তরে তার জন্যে কষ্ট পাচ্ছ না, কিন্তু বাইরেও সেটা প্রকাশ করা কর্তব্য।”১২ রাসবিহারীর এই কথা দ্বারা বিজয়ার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে নিজের ছেলেকে তার কাছে জাহির করার চেষ্টা করে। বিলাস এরপর নরেনের কথা শুনে রেগে গিয়ে পুনরায় বিজয়াকে বিদ্রূপ করে। তার পিতা তখন বারবার তার এই আচরণে তাকে অপমান করে। পিতার কথা শুনে বিলাস বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা অনুতপ্ত না হয়ে জবাবা দেয় - “পরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, পরের ক্লেশ নিবারন করার শিক্ষা আমার আছে, কিন্তু যে দাম্ভিক লোক বাড়ী বয়ে অপমান করে যায়, তাকে আমি মাফ করিনে। অত ভণ্ডামি আমার নেই।”১৩ তার জবাব শুনে রাসবিহারী ও বিজয়া উভয়েই অবাক হয়ে যায়। বিলাস এরপর বিজয়াকে জানিয়ে দেয় পূর্ণবাবুর ভাগিনেয়টিই যে আসলে জগদীশ বাবুর পুত্র নরেন।

নরেনের এই পরিচয় পেয়ে বিজয়ার সমস্ত মুখ মুহূর্তের মধ্যে একেবারে শুষ্ক বিবর্ণ হয়ে যায়। এদিকে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য জগদীশ বাবুর ঘরটি মন্দিরের জন্য ও ওপর ঘরগুলি অতিথিদের জন্য সজ্জিত করার কাজ চলতে থাকে। এই কাজে বিলাস নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তত্ত্বাবধান করে। নরেনের পরিচয় জানতে পেরেই তার জন্য বিজয়ার মন ছটফট করতে থাকে। তাই সে নরেনের খবর জানার জন্য আকুল হয়ে শেষ পর্যন্ত পরেশকে তার কাছে পাঠায়। নরেনের খবর সে যদি এনে দেয় তবে তাকে একটি কাপড় দেবার লোভ দেখায় বিজয়া। পরেশ যখন এই খবর আনতে গেল তখন থেকেই বিজয়া খবরের আশায় শূন্য দৃষ্টিতে সেইদিকে চেয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইল। নরেনের খবর জানার জন্য বিজায়র কৌতূহল আর ধরা দিচ্ছিল না। তাই সে অধীর আগ্রহে পথপানে চেয়ে রইল। বিজয়ার এই আচরণ দেখে আমরা অনুমান করতে পারি যে নরেনের প্রতি তার মনে একটা দুর্বলতা ছিল। পরেশ এসে বিজয়াকে জানায় নরেন সেখানে নেই, কোথায় চলে গেছে। এই কথা শুনে বিজয়া অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ বারান্দার মধ্যে নরেনের আবির্ভাব ঘটে। সে ঘরে পা দিয়েই হাত তুলে সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াকে নমস্কার করে। নরেন তখন বিজয়াকে বলে আপনি কেন নরেন বাবুর খবর জানতে চান? তার সাথে কি কোন দরকার আছে? আসলে নরেন জানত যে বিজয়া তার প্রকৃত পরিচয় জানে না। তাই বিজয়া নরেনের এই ছলচাতুরী দেখে তাকে বিদ্রুপের সঙ্গে বলে দরকার না থাকলে কেউ কি কারো খবর জানতে চায়? নরেন যখন নিজের পরিচয় ইঙ্গিতে জানায় তখন বিজয়া সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে কারণ সে পূর্বেই বিলসের কাছে এই পরিচয় পেয়েছিল। বিজয়া তখন নরেনকে বলে এই সত্য পরিচয়টি অনেকদিন পূর্বেই আপনার মুখ থেকে বার হওয়া উচিত ছিল। বিজয়ার এই কথা শুনে নরেনের মুখ মলিন হয়ে গেল। বিজয়া তাই নরেনকে বিদ্রূপ করে জানায় - “অন্য পরিচয়ে নিজের আলোচনা শোনা, আর লুকিয়ে আড়ি পেতে শোনা দুটোই কি সমান বলে আপনার মনে হয় না?”১৪ বিজয়ার মুখে এই কথা শুনে নরেন লজ্জায় একেবারে কালো হতে গেল। নরেন এরপর অকপটে জানায় আপনার সঙ্গে অনেকরকম আলোচনার মধ্যে নিজের আলোচনাও ছিল বটে, কিন্তু তাতে আমার মন্দ কোন অভিপ্রায় ছিল না। শেষ দিনটাতে আপনাকে আমার পরিচয় দেব বলে মনেও করেছিলাম কিন্তু হয়ে উঠল না। নরেন এসব কথা বলে নিজের দোষ ত্রুটি সমস্ত স্বীকার করে নেয়। নরেন এরপর বাড়ী যেতে চাইলে বিজয়া তাকে কিছুতেই যেতে দেয় না। তাই বিজয়া তাকে খাবার খাইয়ে তবেই বিদায় করে। নরেনের প্রতি আচরণ দেখে বিজয়ার মনে একটা ভালোবাসার গভীর আকর্ষণ আমরা অনুভব করতে পারি। বিজয়া তখন নরেনকে জিজ্ঞাসা করে সে কবে বর্মায় যাচ্ছে? উত্তরে নরেন জানায় পরশুদিন সে চলে যাবে। এরপর সে বলতে থাকে, তবু আপনার আচরণ দেখে বাইরের কারোর বলবার জো নেই যে আমি আপনার লোক নই। আসলে বিজয়ার সেবাযত্ন দেখে নরেন অভিভুত হয়ে যায়। তাই সে বিজয়ার গুণগান করতে ছাড়ে না। নরেনের যাবার পূর্বে সে বিজয়াকে জানায় আজকের এই দিনটা তার চিরকাল মনে থাকবে। নরেন যাবার সময় বিজয়া তাকে একটু দাঁড়াতে বলে। নরেন ফিরে এসে দাঁড়াতেই বিজয়া তার মাইক্রোস্কোপটা কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাই সে তার দাম জিজ্ঞাসা করে? নরেন উত্তরে জানায় সে পাঁচশো টাকার বেশি দামে তা কিনলেও এখন কিন্তু দু-আড়াইশো টাকায় বিক্রি করতে চায়। নরেনের বিক্রি করার আগ্রহ দেখে বিজয়া খুব ব্যাথিত হয়। এবং জিজ্ঞাসা করে এত কম দামে সেটা বিক্রি করার কারণ? নরেন উত্তরে জানায় যে তার এখন টাকার খুব প্রয়োজন। তাই শুনে বিজয়া ঐ যন্ত্রটা কেনবার আগ্রহ দেখায়। তাই সে পরের দিন এই যন্ত্রটা নরেনকে দেখাতে বলে। পরের দিন দুশো টাকার বিনিময়ে এই যন্ত্রটা নরেন বিজয়াকে বিক্রি করে দেয়। নরেন এই যন্ত্রটা সমস্ত ব্যবহার করতে শিখিয়ে দেয় বিজয়াকে। কিন্তু এই যন্ত্রটা সম্পর্কে বিজয়া কিছুই বুঝতে পারে না। বিজয়া তাই ব্যবহার করতে না পেরে যন্ত্রটিকে খারাপ বলে উপহাস করে। কিন্তু পরক্ষণে যন্ত্রটি নিজের কাছেই রেখে দেয় বিজয়া। সেদিনও বিজয়া নরেনকে ঘরে বসিয়ে না খাইয়ে ছাড়ে না। বিজয়া তখন যন্ত্রটি নিতে চায়নি। বিজয়ার এই ব্যবহার দেখে নরেন রেগে গিয়ে বলে তবে কেন আমাকে এত কষ্ট করে এটা বয়ে নিয়ে আনতে বললে। নরেনের এই কথা শুনে বিজয়া জানায় কষ্ট তো আমার জন্য করেননি, করেছেন নিজের জন্য। নরেনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিজয়া পুনরায় বলে - “আচ্ছা, আমিই না হয় নেব, আপনাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। আপনি খেতে আরম্ভ করুন।”১৫ এই কথা শুনে নরেন নিজেকে অপমানিত বোধ করে বলে আপনাকে আমার প্রতি দয়া করতে তো আমি অনুরোধ করিনি। নরেনের এই কথা শুনে আমরা বুঝতে পারি সে অভিমানের সুরে বিজয়াকে একথা বলে। বিজয়া তখন বিদ্রূপ করে বলতে থাকে আজ না করলেও সেদিন কিন্তু মামার হয়ে অনুরোধ করতে এসেছিলেন। এই কথা শুনে নরেন দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারে - “সে পরের জন্যে, নিজের জন্যে নয়। এ অভ্যাস আমার নেই।”১৬ এই কথাটা যে খুব সত্য তা বিজয়া এতদিন বুঝতে বাকি ছিল না। তাই তার এই কথা শুনে বিজয়ার একটু গায়েও লাগিল। বিজয়া ও নরেনের এই কথোপকথনের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না বরং তাদের মধ্যে একটা অভিমানের ছোঁয়া দেখা যায়। তার একে অপরের প্রতি মনে মনে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। তাই তাদেরকে মাঝে মাঝে ঠাট্টা তামাশা করতেও আমরা লক্ষ্য করি।

বিজয়া যে যন্ত্রটাকে এই মাত্র ভাঙা বলিয়া উপহাস করেছিল তার সাহায্যেই কি অপূর্ব এবং অদ্ভুত ব্যপার না তার দৃষ্টিগোচর হল। নরেন তাকে বোঝাতে শুরু করলে হঠাৎ সে বুঝতে পারে যে বিজয়া তা না শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। বিজয়া প্রত্যুত্তরে জানায় সে তার কথা সব মন দিয়ে শুনছে। নরেন তাকে জিজ্ঞাসা করলে বিজয়া কোন উত্তর দিতে না পেরে জানায় যে একদিনে সব জানা সম্ভব নয়। বিজয়া এরপরে নরেনের কাছে ছবি আঁকা শেখার জন্য কৌতূহল প্রকাশ করে। নরেন তখন জানায় অন্যমনস্ক হয়ে কোন শিক্ষাই শেখা যায় না। আসলে বিজয়া এইসব বলে নরেনের মনটাকে যাচাই করার চেষ্টা করেছিল। বিজয়া যে নরেনকে ভিতরে ভিতরে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল তা তার এই আচরণ দেখেই আমরা অনুমান করতে পারি। বিজয়া তখন ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে আমি যদি কিছুই শিখতে না পারি তবে আমার মাথায় সত্যিই শিং বেরোবে। বিজয়ার এই কথা শুনে নরেন হেসে ফেটে পড়ল, এবং বলল এটাই হল আপনার উচিত শাস্তি। বিজয়া ও নরেনের কথা বলতে বলতে রাত্রি হয়ে যায়। তাই বিজয়া উঠে গিয়ে আলো আনতে যায়। বিজয়া দ্রুতপদে বাহির হতেই সম্মুখেই রাসবিহারী ও বিলাসকে বসে থাকতে দেখে অকস্মাৎ যেন ভূত দেখে থেমে গেল। বিলাসের মুখের উপর কে যেন এক ছোপ কালি মাখিয়ে দিয়েছে। বিজয়ার নরেনের সাথে মেলামেশা দেখে বিলাস খুব রেগে যায়। কারণ সে বিজয়াকে নিজের বাগদত্তা হিসাবে মনে করত। কিন্তু বিজয়া যে তাকে অন্তর থেকে ভালবাসত না এটা তার ধারনা ছিল না। রাসবিহারী তখন বিজয়াকে জানায় তারা প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছে। তুমি ওঘরে নরেনের সাথে ব্যাস্ত থাকায় আমরা তোমাকে ডাকি নি। রাসবিহারী তখন বিজয়াকে বলে নরেন তোমার কাছে কি চাইতে এসেছে? পাশের ঘরে যেন শব্দ না পৌঁছায় তার জন্য বিজয়া মৃদুস্বরে জানায় একটা মাইক্রোস্কোপ উনি বিক্রি করে বর্মায় যেতে চান। সে যন্ত্রটিই তিনি আমাকে দেখাচ্ছিলেন। বিলাস এই কথা শুনে গর্জন করে বলে – ঠকাবার আর জায়গা পেলে না। বিলাসের কথা অগ্রাহ্য করে বিজয়া জানিয়ে দেয় সেই যন্ত্রটি সে নিতে চায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিলাস যে চেঁচামেচি করে নরেনকে বিদ্রূপ করতে থাকে তা নরেন ওঘরে বসে শুনতে পায়। বিলাসের ইচ্ছায় ছিল যাতে তার সব কথা ওঘরে পৌঁছায়। রাসবিহারী সব কথা শুনে কালিপদকে বলতে পাঠায় যে এসব ফন্দি এখানে খাটবে না। কিন্তু যাকে বলতে হবে সে নিজের কানেই সমস্ত শুনেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই কালিপদ যাওয়ার উপক্রম করতেই বিজয়া তাকে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জানায় তুমি শুধু আলো দিয়ে এসো গে, যা বলবার আমি নিজেই বলব। বিলাস তখন শ্লেষের সঙ্গে পিতাকে বলে - “কেন বাবা, তুমি মিথ্যে অপমান হতে গেলে ওর হয় ত এখনো কিছু দেখিয়ে নিতে বাকি আছে।”১৭ এও কথা শুনে রাসবিহারী কোন কথা বললেন না। কিন্তু ক্রোধে বিজয়ার মুখ রাঙা হয়ে গেল। এটা বিলাস লক্ষ্য করেও মাইক্রোস্কোপ নিয়ে নানারকম বিদ্রূপ করে জোরে জোরে হাসতে লাগল। নরেনকে বিজয়ার কাল খাওয়ানোর কথা সে জানতে পেরেছিল এবং আজ তাদের উচ্চহাস্যও সে নিজের কানে শুনেছিল। তাছাড়া বিজয়ার আজকের বেশভূষার পারিপাট্যও দেখে বিলাস আশ্চর্য হয়ে গেল। এই সব দেখে শুনে বিলাস ঈর্ষায় জ্বলে মরতেছিল। তাই তার দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিল না। কারণ এই সব দেখে বিলাস অনুমান করতে পেরেছিল যে নরেনকে বিজয়া মনের মধ্যে স্থান দিয়ে দেয়। বিজয়ার আচরণ দেখে সে অনুমান করে যে নরেনের প্রতি গভীরভাবে বিজয়া প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। বিজয়া যে তাকে একেবারে গুরুত্বই দিতে চায়নি সেটাও বিলাস বুঝতে পারে। রাসবিহারী যখন বিজয়াকে জানায় যে নরেনকে বল কাল এসে যেন টাকাটা নিয়ে যায়। বিজয়া তখন বলে যে আপনার সঙ্গে আমি কাল কথা বলব। কারণ তার বাড়ী যেতে রাত হয়ে যাচ্ছে – আবার অনেক দূরে যেতে হবে, তাই ওর সঙ্গে আমার কিছু আলোচনা করবার আছে। বিজয়ার এই কথা শুনে বৃদ্ধ রাসবিহারী মনে মনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেও বাইরে তার কোন প্রকাশ করলেন না। তিনি চেয়ে দেখলেন তার পুত্রের চোখ দুটি অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝক ঝক করছে এবং কি একটা বলবার জন্য যেন যুদ্ধ করছে। পুত্রের এই অবস্থা লক্ষ্য করে রাসবিহারী পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে কালকে আসার কথা বলেই চলে গেল। বিজয়া এরপর নরেনের কাছে গিয়ে বলে আপনি সমস্ত কথা নিজের কানে শুনেছেন বলেই বলছি যে, আপনার সম্বন্ধে তারা যে সব অসম্মানের কথা বলেছেন, যে তাদের অনধিকার চর্চা। বিজয়ার এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে নরেনের প্রতি কতটা সহানুভূতিসম্পন্ন। তাই বিজয়া তাদের অপকর্মের জন্য প্রতিশোধ নেবারও কথা ঘোষণা করে। কারণ তার ভালোবাসার মানুষকে অপমান করায় তার মনে খুব আঘাত লাগে। কিন্তু নরেন তার জন্য তাদের সাথে বিজয়া কোন খারাপ ব্যবহার করে এটা করতে সে নিষেধ করে। নরেন এরপর যেতে চাইলে, বিজয়া তাকে কাল বা পরশু একবার আসবার জন্য অনুরোধ করে। উত্তরে নরেন জানায় তার সময় হবে না। এই কথা শুনে বিজয়ার দুই চোখের মধ্যে জল পড়িতে লাগিল। বিজয়াকে কোন কথা বলতে না শুনে নরেন মনে করে সে তার প্রতি রাগ করেছে। তাই নরেন তাকে বলে আপনি নিজে এত হাসতে পারেন, আর আপনারই এত সামান্য কথায় রাগ হয়? নরেন এরপর তাকে জানায় যে আপনাকে আমার সর্বদা মনে পড়বে- আপনি ভারি হাসতে পারেন। নরেনের এই শেষ কথা শুনে বিজয়ার চোখের জল বাগ মানতে না পেরে টপটপ করে মাটির উপর ঝরে পড়ল। হাত দিয়ে মুছতে গেলে পাছে নরেন বুঝতে পারে তাই নিঃশব্দে নতমুখে দাড়িয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নরেন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বিজয়ার চিবুক তুলে ধরে লক্ষ্য করলেন যে বিজয়া কাঁদছে। তখন বিজয়া দ্রুতবেগে পিছনে গিয়ে তার চোখ মুছে ফেলল। বিজয়ার এই কান্নার কারণ নরেন তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। এইসব ব্যাপার তার বুদ্ধিতে বোঝা গেল না। বিজয়া যে নরেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে হারানোর আশঙ্কায় কেঁদে ওঠে তা সে কোনমতেই অনুমান করতে পারেনি। কারণ নরেনের এই ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। বিজয়া নরেনকে মাইক্রোস্কোপের ব্যাগটা হাতে তুলতে দেখে রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠে ওটা আমার, আপনি রেখে দিন। এই কথা বলেই বিজয়া কান্না আর চাপাতে না পেরে দ্রুতপদে ঘর হতেই বেরিয়ে গেল। বিজয়ার এই আচরণ খুব গভীর ভালোবাসার লক্ষণ। কাউকে অন্তর থেকে ভালো না বাসলে এইভাবে তার উদ্দেশ্যে কাঁদতে পারা সম্ভব নয়। তাই এখানে আমরা স্পষ্টই অনুভব করি থাকি বিজয়া নরেনকে গভীরভাবে ভালোবাসে। অনুভুতি লক্ষ্য করা যায় না একথা অস্বীকার করা যাবে না।

বিলাসবিহারীর প্রচণ্ড কীর্তিতে পল্লীগ্রামে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার শুভদিন আগত হয়ে গেল। একে একে সমস্ত অতিথিগনের সমাগম ঘটতে লাগল। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে সমস্ত অতিথিদের কাছে রাসবিহারী ঘোষণা করে দেয় যে বিলাস ও বিজয়া কিছুদিনের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। এই কথা শুনে বিজয়া ক্ষোভে, বিরক্তিতে, ভয়ে তার কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। কিন্তু সে স্পষ্টভাবে কিছু প্রকাশ করল না। বিজয়ার এই মৌন অবস্থাকে রাসবিহারী তার সম্মতি হিসাবে মেনে নেয়। তাই সে অথিতিদিগকে জানিয়ে দেয় যে ফাল্গুন মাসেই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হবে। বিজয়া সঙ্গে সঙ্গে বাবার মৃত্যুর এক বছরের কথা বলতেই রাসবিহারী সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে তা বৈশাখ মাসে হবে। রাসবিহারী এরপর বিজয়াকে জানিয়ে দেয় তিনি নরেনকে তার টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন তাই বিজয়া যেন আর তা না দেয়। এই কথা শুনে বিজয়া বলে তিনি দুবার নেবার লোক নন। এমন একদিন ছিল, যখন বিলাসের হাতে আত্মসমর্পণ করা বিজয়ার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ছিল না। কিন্তু আজ শুধু বিলাস কেন পৃথিবীর কোন লোকের মধ্যে কেবল একটিমাত্র লোক ছাড়া আর কেহ স্পর্শ করেছে একথা ভাবলেও তার সর্বাঙ্গ ঘৃণায় ও লজ্জায় এমনকি পাপে সে ভয় পেয়ে গেল। তাই শুধুমাত্র নরেনকেই মনে মনে চিন্তা করতে থাকে। বিলাসের সাথে বিজয়ার বিয়ে পাকা হলেও কিন্তু তাকে মনে মনে ঘৃণা করত। তাই আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পাই দয়াল ও তার ভাইঝি নলিনী কৌশলে বিজয়ার সাথে নরেনের বিয়ে দেয়। তার আগে আমরা দেখতে পাই বিলাসের সাথে বিজয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্য তাদের মেলামেশা বেড়ে যায়। এইজন্য বিজয়াকে বিরক্ত না করে নরেন তাদের বাড়ীতে যাওয়া আসা প্রায় ছেড়ে দেয়। কিন্তু দয়াল বাবুর বাড়ীতে তার তার যাতায়াত বাড়তে থাকে। এই জন্যই নরেনের সঙ্গে দয়ালের ভাইঝি নলিনীর মেলামেশাতে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা অনুমান করে বিজয়া ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিন্তু দয়ালবাবু বিজয়ার বাবার পুরানো পত্র দেখে যে তিনি তার মেয়েকে জগদীশ বাবুর ছেলের সাথে বিয়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। তাই তিনি কোন ভুল না করে স্বর্গীয় বনমালীবাবুকে শ্রদ্ধা জানাতেই এরপর বিজয়াকে নরেনের সাথে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। দয়ালবাবু ও তার ভাইঝির সাহায্য নিয়ে অবশেষে বিজয়া ও নরেনের বিবাহ সম্পন্ন করে। বিজয়া তার ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়।



তথ্যসূত্র

১. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড), অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯, দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা-৩৩৪
২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪০
৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪২
৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪৩
৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪৪
৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫১
৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
৮. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
৯. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
১০. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৪
১১. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৪
১২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৫
১৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৫
১৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৯
১৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৫
১৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৫
১৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৭

Sunday, July 22, 2018

‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


          রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস। যোগাযোগ যখন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় (আশ্বিন ১৩৩৪ হইতে চৈত্র ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় তখন এর নাম ছিল ‘তিনপুরুষ’। বিশ্বকবির ইচ্ছা ছিল এই উপন্যাসের কাহিনী সুত্র তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবেন। কিন্তু অল্প রচনা করেই তার সেই ইচ্ছার বদল ঘটে। যে অবিনাশ ঘোষালের বত্রিশ বৎসরের জন্মদিনের প্রসঙ্গ নিয়ে উপন্যাসের শুরু হয়েছিল তার জন্মের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েই বিশ্বকবি উপন্যাসের কাহিনীর ইতি করে দিলেন। এই কারনেই দুই তিন সংখ্যায় বাহির হইবার পর কবি উপন্যাসের নামের পরিবর্তন করে ‘যোগাযোগ’ রাখলেন। যোগাযোগ উপন্যাসটির কাহিনী সুত্র লেখক ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতেই রচনা করেছেন। এই উপন্যাসের মুল চরিত্র দুটি হল মধুধুসুদন ঘোষাল এবং তার স্ত্রী কুমুদিনী। এই উপন্যাসে নরনারীর হৃদয় দ্বন্দ্বের অবসানের বহু বহু পরের ঘটনাই রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথমে উল্লেখ করেছেন। যার ফলে তিনি পূর্বের ইতিহাস পরে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেছেন – “কিন্তু আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যা বেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো।”৩১ উপন্যাসটিতে আমরা অবলোকন করতে পারি তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সাথে ধনতান্ত্রিক সমাজের লড়াই। উপন্যাসে বিপ্রদাস চ্যাটার্জি হল সামন্ত তন্ত্রের প্রতিভূ এবং মধুসূদন ঘোষাল ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বেকার একটা সংঘর্ষ বিদ্যমান ছিল। এই পূর্বের সংঘাতের প্রতিশোধ নেবার জন্যই মধুসূদন তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্রদাসের বোন কুমুদিনীকে বিয়ে করতে রাজী হয়। বিপ্রদাস এই অভিসন্ধির কথা বুঝতে পেরে তাতে রাজী ছিল না। কিন্তু কুমুদিনীর জেদের কাছে তাকে হার স্বীকার করতে হয়। প্রবল আবেগের বশে কুমুদিনী মধুসুদনের সাথে বিয়ে করতে এককথায় রাজী হয় যায়। ফল স্বরূপ বিবাহের পর থেকেই মধুসূদন ও কুমুদিনীর সংসারে অশান্তির ছায়া নেমে আসতে শুরু করে। তাই তাদের দাম্পত্য জীবন একদিনের জন্যও সুখের হতে পারেনি। মধুসূদন ও কুমুদিনীর দাম্পত্য জীবনের কাহিনীই এই উপন্যাসের মুখ্য বিষয়। তাই আমরা এখানে মধুসূদন ও কুমুদিনীর দাম্পত্য কলহের চিত্র নানান দিক দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করব।

          উপন্যাসের প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় মধুসুদনের বংশ পরিচয় ও পূর্ব ইতিহাসের বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় থেকে নবম অধ্যায় পর্যন্ত কুমুদিনীর পৈতৃক ইতিহাসের বর্ণনা করা হয়েছে। আসলে উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র মধুসূদন ও কুমুদিনীর পরস্পর সম্পর্কের বিশেষত্ব টুকু বুঝিবার জন্য লেখক এই বর্ণনা করেছেন। দুই বংশের পূর্ব ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে তাদের উভয়ের মধ্যে অতীতে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। পূর্বে চাটুজ্যেদের বেশি ধনসম্পদ থাকার জন্য ঘোষালরা তাদের সঙ্গে কোনদিক দিয়েই পেরে ওঠে না। বারবার চাটুজ্যেদের কাছে ঘোষলরা পরাস্ত হয়। তাই সেই পূর্বের দ্বন্দ্বের হার ঘোষালরা কিন্তু মনে প্রানে ভুলতে পারে না। তাই লেখক একজায়গায় বলেছেন – “যারা মারে তারা ভোলে, যারা মার খায় তারা সহজে ভুলতে পারে না।”৩২ অতীতে আমরা দেখতে পাই চাটুজ্যেরা অর্থের জোরে শত অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে যায়। কিন্তু চিরদিন সবার সমান চলে না আর তাই এখানেও তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি। ভাগ্যের চাকার পরিবর্তনে ঘোষালদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ঘোষালদের এই পরিবর্তন মধুসূদন ঘোষালের হাত ধরেই ঘটে। মধুসূদন ব্যবসা বানিজ্য করে হঠাৎ খুব ধনী হয়ে যায়। পরিবর্তে বিপ্রদাস চাটুজ্যের ধার দেনায় আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে দেখা যায়। মধুসুদনের ব্যবসা বানিজ্যে উন্নতি দেখে তার মা তাকে বিয়ে করতে বলে। কিন্তু মধুসূদন কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হয়নি। এতে তার মায়ের মন হতাশ হয়ে যায়। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন মধুসুদনের মনের পরিবর্তন হয়। যার ফলে সে নিজেই তার বিয়েতে সম্মতি জানায়। একথা শুনে মধুসুদনের আত্মীয়স্বজন সবাই খুব খুশি হয়। তার বিয়ের জন্য নানাদিকে মেয়ে দেখা শুরু হয়। ঘটক নানাদিক থেকে অনেক কুলবতী, রূপবতী, ধনবতী, গুনবতি,বিদ্যাবতী কুমারীদের খবর নিয়ে আসে। কিন্তু কিছুতেই মধুসুদনের মেয়ে পছন্দ হয় না। অবশেষে মধুসূদন দৃঢ়কণ্ঠে জানায় যে বিয়ে যদি তাকে করতেই হয় তবে চাটুজ্যেদের মেয়ে বিপ্রদাসের বোন কুমুদিনীকেই করবে। মধুসূদন তাই বলতে পারে - “ঐ চাটুজ্যেদের ঘরের মেয়ে চাই।”৩৩ মধুসুদনের এই কথার মধ্যে অনুমান করা যায় যে পূর্বের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্যই তার এই সিন্ধান্ত। তাই তো উপন্যাসে লেখককে বলতে শুনি - “ঘা খাওয়া বংশ, ঘা খাওয়া নেকড়ে বাঘের মতো, বড়ো ভয়ংকর।”৩৪

          উপন্যাসের দশম পরিচ্ছেদে আমরা লক্ষ্য করতে পারি ক্ষয়িষ্ণু বিপ্রদাসের কাছে হঠাৎ নীলমণি ঘটকের আবির্ভাব। ঘটক বিপ্রদাসকে বলে যে কুমুর জন্য এক ভালো পাত্রের সন্ধান আছে যা তাদের ঘরেরই উপযুক্ত। বিপ্রদাস তখন সেই সৎপাত্রের নাম জানতে চায়। উত্তরে ঘটক মধুসূদন ঘোষালের নাম বলতেই সঙ্গে সঙ্গে বিপ্রদাস তা অস্বীকার করে। বিপ্রদাসের এই বিয়েতে অস্বীকারের কারণ হল সে পূর্বেই মধুসূদনকে চিনত যে তিনি খুব একটা ভালো প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না। তাই বিপ্রদাসের সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা দেরি হয় নি। তাই বিপ্রদাস রাজী যে নয় তা অপ্রত্যক্ষ ভাবে জানায় - “বয়সের মিল আছে এমন মেয়ে আমাদের ঘরে নেই।”৩৫ ঘটক কিন্তু এই বিয়েতে বিপ্রদাসকে রাজী করাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। ঘটক তাই মধুসুদনের নানারকম গুণগান করে বিপ্রদাসের মন ভোলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তবুও সে বিপ্রদাসকে কোন অবস্থাতেই রাজী করাতে পারলেন না। প্রথমবারের আগমনে সফলতা না পাওয়ায় নীলমণি ঘটককে দ্বিতীয়বার বিপ্রদাসের বাড়ীতে আসতে হয়। এতেই আমরা অনুমান করতে পারি যে এই বিয়েটা সম্পন্ন করতে ঘটক কতখানি বদ্ধপরিকর। দ্বিতীয়বার নীলমণি ঘটকের আগমনে তাই বিপ্রদাস কোন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। যার ফলে বিপ্রদাসের মনে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। তাই সে বাধ্য হয়ে বোন কুমুদিনীর সাথে আলোচনা করতে বাধ্য হয়। প্রথমবার ঘটকের সঙ্গে মধুসুদনের আলোচনা শুনেই কুমদিনী দৈব্যের উপর ভরসা করেই এই বিয়েতে মানসিক ভাবে রাজী হয়ে যায়। কুমুর স্বভাবের প্রধান গুন ছিল দৈব্য নির্ভরতাবশতঃ তাই বিয়েতে মনে মনে রাজী হয়ে যায়। বিবাহ যে জীবনের কি জিনিস তা কুমুর ধারণার মধ্যে ছিল না। সাধারন কোন ঘটনার মতোই বিবাহকে সে মনে করত। বিবাহ ব্যপারে নিজের যে একটা পছন্দ – অপছন্দ বলে উপসর্গ আছে এসব ধ্যান ধারণা কখনই কুমুর মাথায় আসেনি। তাই কুমুদিনী তার দাদাকে নিঃসংশয়ে বলতে পারে - “যার কথা বলছ তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ঠিক হয়েই গেছে।”৩৬ বিপ্রদাস কুমুর এই কথা শুনে তাকে এ ব্যাপারে ভালো করে বিচার বিশ্লেষণ করে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে অনুমতি দেয়। কিন্তু কুমু সঙ্গে সঙ্গে বলে যে তার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা সে নিয়েছে। প্রমান স্বরূপ কুমু দাদাকে সৎসাহসের সঙ্গে বলতে পারে - “আমি তোমার এই পা ছুঁয়ে বলছি, আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”৩৭ কুমুর এই কথা শুনে বিপ্রদাস ভয়ে চমকে উঠে। কিন্তু বিপ্রদাস নিজেকে নিঃসহায় বলে মনে করে। সে বুঝতে পারে যে এটা তার এক্তিয়ার ভুক্ত নয়। তাই তাকে গুমরে গুমরে মরতে হয়। বিপ্রদাস যেহেতু বোনের স্বভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল তাই অনুমান করতে পারে যে কুমু দৈব্য সংকেতেরবশেই মধুসূদনকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। বিপ্রদাস কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। তাই সে ক্রমাগত কুমুকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল । কিন্তু কুমু কিছুতেই তার সিধান্তের পরিবর্তন করতে রাজী হল না। অবশেষে বিপ্রদাস তার বোনের সিন্ধান্তকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হল। যার ফলে কুমুদিনী ও মধুসূদনের বিয়ের প্রস্তাব প্রায় পাকা হয়ে গেল। এর পরেই বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিল। মধুসূদন যেহেতু খুব ধনবান ব্যক্তি তাই সে বিয়েতে অনেক খরচ পত্র করার জন্য প্রস্তুতি নিল।

          মধুসূদন ও কুমুদিনীর বিয়ের প্রস্তাব পাকা হওয়ার সাথে সাথেই দু-পক্ষের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। বিয়ের অনুষ্ঠিত জায়গাকেই কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে। কিছুদিন দু- পক্ষের এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা হওয়া সত্ত্বেও অবশেষে বরপক্ষের জেদের কাছে বিপ্রদাসকে নতি স্বীকার করতে হয়। তাই বিয়ের অনুষ্ঠানের স্থান ঠিক হয় হুগলীর নুর নগরে যা মধুসূদনের পৈতৃক ভিটা ছিল। এদিকে বিয়ের কথা চিন্তা করে কুমুদিনীর সর্বাঙ্গে একটা নতুন প্রানের রঙ লাগল। আপন মনগড়া মানুষের সঙ্গে মিলনের আনন্দ তাকে অহরহ পুলকিত করে তোলে। কুমুদিনী মধুসূদনের নাম শুনেই তাকে মনে মনে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। এমনকি কুমুদিনী তাকে দেবতার আসনে স্থান দিয়েছিল। বহুপূর্বে নুরনগরের পাশে শেয়াকুলি গ্রাম ঘোষালদের দখলে ছিল। কিন্তু দুই বংশের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে ঐ গ্রামের দখল কেড়ে নেয় চাটুজ্যেরা। তাই মধুসূদন সেই পূর্ব প্রতিশোধ স্পৃহার জন্যই বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান সেইখানেই করতে চায়। মধুসূদনের এই সিন্ধান্ত শুনে সবাই অনুমান করতে পারে যে চাটুজ্যেদের উপর টেক্কা দেবার জন্যই মধুসূদনের এই পরিকল্পনা। এই সিন্ধান্তের ফলেই দুই পক্ষের মধ্যে মন কষাকষি হতে দেখা যায়। মদুসুদন অর্থের অহংকারে যে এই স্পর্ধা দেখায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই পক্ষের বিবাদের সুচনা দেখে কন্যাপক্ষের সবাই এর জন্য কুমুদিনীকে দায়ী করে। কুমু তার নিজের বদনাম সবার মুখে বারবার শুনে নিজেকে লজ্জিত মনে করে। ফলে কুমু মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। তাই কুমু মধুসূদনকে আর দেবতার আসনে স্থান দিতে পারে না। এই জায়গা থেকেই আমারা অনুমান করতে পারি যে কুমুদিনীর মনে মধুসূদনের উচ্চস্থান ক্রমাগত লোপ পেতে থাকে। তাই কুমু রুদ্ধস্বরে দাদাকে বলতে পারে - “দাদা, কিছুই বুঝতে পারছি নে।”৩৮ কুমু একথা বলেই কাপড় দিয়ে কেঁদে উঠল। বিপ্রদাস তখন বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে - “লোকের কথায় কান দিস নে বোন।”৩৯ বিপ্রদাসের সান্ত্বনা সত্ত্বেও কুমুর মনে দ্বিধা দেখা যায়। কুমুর মনে দ্বিধা দেখে তাই বিপ্রদাস বলে-“তোর মনে যদি একটুও খটকা থাকে বিয়ে এখনো ভেঙ্গে দিতে পারি।”৪০ দাদার এই কথা শুনে কুমুদিনী লজ্জায় পড়ে যায়। বিয়ের দশদিন আগে গোপনে অসুস্থ শরীর নিয়ে বিপ্রদাস মধুসূদনকে স্টেশনে অভ্যর্থনা জানাতে যায়। কিন্তু মধুসূদন সেখানে বিপ্রদাসকে নানারকম ভাবে অসম্মান করে। মধুসূদন ও বিপ্রদাসের কথায় আমরা দ্বন্দ্বের রূপ লক্ষ্য করি। বিপ্রদাস এইসব ঘটনা প্রকাশ না করে গোপনেই রেখে দেয়।

          নুরনগরে এসে বরযাত্রীরা নানা জায়গায় পাখি হাঁস ইত্যাদি শিকার করে এলাকাবাসীকে জ্বালাতন করে তোলে। দিন দিন এই ঘটনার ফলে গ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। এই কথা বিপ্রদাসের কানে গেলে সে চুপ করে থাকে এবং অন্যদেরও শান্ত থাকতে অনুরোধ করে। কারণ সে চাইছিল যে বিয়ের আগে যেন আর নতুন করে কোন সংঘাতের সৃষ্টি না হয়। বিয়েটা যাতে সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন হয়ে যায়। বরপক্ষের এই অত্যাচারের কথা কুমুদিনীর কানে পৌঁছালে সে আর ঠিক থাকতে পারে না। তাই সে দাদাকে অনুরোধ করে জানায় বরপক্ষের এই আচরণ নিয়ন্ত্রন করার জন্য। কিন্তু বিপ্রদাস বোনকে উত্তরে জানায় বরপক্ষের ভুল বোঝার জন্য একথা না বলাই শ্রেয়। দাদার এই সিদ্ধান্তকে কুমু কিছুতেই মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি। কুমু দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারে – “তা বুঝুক ভুল। মান-অপমান শুধু ওদের একলার নয়?”৪১ কুমুর এই কথা শুনে বিপ্রদাস বোনকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বিবাহের দুই দিন আগে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান অয়োজন করা হল। বরের বাসা থেকে দামি গয়না থেকে আরম্ভ করে খেলার পুতুল পর্যন্ত সওগাতের ঘটা দেখে কন্যাপক্ষের সকলে অবাক হয়ে গেল। অবশেষে লোক জনকে খাওয়ানকে কেন্দ্র করে বৈবাহিক কুরুক্ষেত্রের সৃষ্টি হল। এই সব ঘটনা দেখে মধুসূদনের ছোট ভাই রাধু রাগে গর্জে করে উঠে। তাই সে দাদাকে বিয়ে না করে চলে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু মধুসূদন রেগে গিয়ে তা অস্বীকার করে। মধুসূদনের মনোভাব দেখে অনুমান করা যায় যে একশো বছর পূর্বে চাটুজ্যেরা যে রকম আড়ম্বর করে ঘোষালদের জ্বালাতন করেছিল তারই প্রতিশোধ নেবার জন্যই মধুসূদন এই বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিপ্রদাসে শরীর অসুস্থ থাকার জন্য বিয়ের সময় সে রোগশয্যায় পড়ে গেল। তার জন্যই কিছুটা সৌজন্যের জন্য মধুসূদন বরযাত্রীদের কনে বাড়ীতে যাবার পথে বেশি ধূমধাম করতে নিষেধ করে দেয়। বিয়ে সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকার কারনে কুমুদিনীর সর্বশরীর কাঁপতে শুরু করল। দাদার ভগ্ন শরীর দেখে কুমুদিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ছোটবেলা থেকেই কুমুদিনীর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল দাদা বিপ্রদাস। তাই কুমুদিনী ছিল একেবারে দাদা অন্তপ্রান। কারণ ছোটবেলা থেকে সে দাদার কাছেই শিক্ষাদীক্ষা আচার-আচরণ আদর্শ সমস্ত শিখে বড়ো হয়ে উঠেছিল। তাই কুমুদিনী দাদার আদর্শকে পাথেয় করে চলতে শুরু করে।

          স্বামীর আচার আচরণ দেখে কুমু তাকে ভয় করতে শুরু করে। এইকথা ভেবেই বিয়ের সময় কুমুর মনে হয় তার জন্য বাসা নেই, আছে ফাঁস। মধুসূদন খুব কঠিন মনের মানুষ তা কুমুর বুঝতে বাকি থাকে না। বিবাহটা এমন ভাবে সম্পন্ন হল যে সকলের মন খারাপ হয়ে গেল। বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের প্রথম সংস্পর্শ মাত্রই এমন একটা বেসুর বাজনা ঝনঝনিয়ে উঠল যে তার মধ্যে উৎসবের সংগীত কোথায় গেল তলিয়ে। বিয়ের পর কুমুর মনে মনে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হল। তাই সে মনে মনে ভাবল তবে কি তাকে ঠাকুর প্রতারণা করলেন? কুমু এতটা ভেঙ্গে পড়েছিল যে নিজের প্রতি আর আস্থা রাখতে পারছিল না। সে নিজেকে আর ক্ষমা না করতে পেরে আত্মদহনে দগ্ধ হতে থাকে। তাই সে মনে করে তার সবচেয়ে বড় ভুল দাদার কাছে সংশয় লুকিয়ে রাখা। জ্বরের জন্য বিপ্রদাস বিবাহ সভায় উপস্থিত থাকতে পারল না। যদিও বিবাহ প্রায় সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল। বিবাহের পর দাদার অসুস্থতার জন্য কুমু দাদার কাছে দুইদিন থাকার জন্য স্বামীর কাছে মিনতির স্বরে আবেদন জানাল। কুমুর এই আবেদনে মধুসূদন রাজী হল না। স্বামীর এই আচরণে কুমু খুব দুঃখ পেল। ফলে কুমুর মনে স্বামীর প্রতি যেটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিল সেটুকুও ক্ষীণ হতে শুরু করল। এই ঘটনার ফলস্বরূপ নব দম্পতির দাম্পত্যজীবনে চিড় ধরতে শুরু করে। দাদার কাছে থেকে কুমু যে তার সেবা করতে পারবে না একথা মনে করে সে দুঃখে কাতর হয়ে পড়ে। কুমু শ্বশুরবাড়িতে যাবার আগে তাকে শেষবারের মতো দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে বিপ্রদাস। কিন্তু সে জানতে পারে যে কুমুর যেতে আর বেশি দেরি নেই। তাই দুঃখের সহিত বিপ্রদাস বলতে পারে – “না, এখানে ওর সময় ফুরোল। উনিশ বছর কাটতে পেরেছে, এখন এক ঘণ্টাও আর কাটবে না।”৪২ বিদায়ের সময় স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে বিপ্রদাসকে প্রনাম করতে আসে। মধুসূদন ভদ্রতা করে বললো – “তাই তো, আপনার শরীর তো ভালো দেখছি নে।”৪৩ উত্তরে বিপ্রদাস জানায় ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুণ। দাদাকে নিজের শরীরের উপর যত্ন নেওয়ার কথা বলেই কুমু দাদার পায়ের কাছে পড়ে কাঁদতে লাগল। হুলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি ঢাক কাঁসর নহবতের আওয়াজে সাইক্লোন ঝড় উঠল। নব দম্পতি এখান থেকে চলে গেল। তাদের চলে যাবার দৃশ্যটা দেখে বিপ্রদাসের বীভৎস লাগল। পূজা অর্চনায় বিপ্রদাসের কোন উৎসাহ না থাকলেও আজ ঠাকুরের কাছে হাত জোড় করে মনে মনে তাদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করতে লাগল। বিবাহের লঙ্কাকাণ্ডের সব শেষ অধ্যায়টা এখনো বাকী। বরকনের যাত্রা করার সময় ছিল সকালবেলা কুশণ্ডিকা সেরে। নবগোপাল তার জন্যই সব উদ্যোগ ঠিক করে রেখেছে। এমন সময় হঠাৎ মধুসূদন জানিয়ে দিল কুশণ্ডিকা হবে বরের ওখানে, মধুপুরীতে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে আবার একটা নতুন সংঘাতের সৃষ্টি হল। এই ঘটনায় বাপের বাড়ীর অপমান বুঝতে পেরে কুমুর মন অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে গেল। সে নিজেকে মনে মনে অপরাধিনী ভাবতে শুরু করল তার সমস্ত পূর্বপুরুষদের কাছে। কুমু মনে মনে তার ঠাকুরের প্রতি অভিমান করে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল - “আমি তোমার কাছে কী দোষ করেছি যে জন্যে আমার এত শাস্তি! আমি তো তোমাকেই বিশ্বাস করে সমস্ত স্বীকার করে নিয়েছি।”৪৪

          শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় কুমুদিনী মেয়েদের দলের গাড়িতে ছিল। তাদের সাথে যেতে যেতে নিজের সম্বন্ধে নানারকম কটূক্তি শুনে নিজেকে বিরক্ত বোধ করল। তাই কুমুদিনী গাড়ীর জানালার বাইরের দিকে চেয়ে থাকার চেষ্টা করল। যাতে তাদের কথাবার্তা তার কানে না পৌঁছায়। কুমু খুব দয়ালু ছিল তাই পথের মধ্যে এক অনাথিনী মেয়েকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দশটাকা অর্থ সাহায্য করে। এই জন্য তাকে গাড়ীর অন্য মেয়েদের কাছ থেকে অনেক কটূক্তি সহ্য করতে হয়। একজন মেয়ে বলে উঠে - “টাকা ওড়াতে শিখেছে, রাখতে শিখলে কাজে লাগত।”৪৫ কুমুর এই আচরণকে বাকীরা তার দেমাক বলেই মনে করল। কারণ তাদের মনে হল বাবুরা যাকে এক পয়সা দিয়ে সাহায্য করল না ইনি তাকে হঠাৎ ঝনাৎ করে দশ টাকা ফেলে দিয়ে নিজের গুমোরের পরিচয় দিলেন। কুমুর এই আচরণকে তারা কিছুতেই সহজ ভাবে মেনে নিতে পারল না। তাই তাদের মনে হল এটাও বুঝি সেই চাটুজ্যে – ঘোষালদের চিরকেলে রেষারেষির একটা অঙ্গ। কুমুর এই অসহায় অবস্থার সময় তার মেজো জা নিস্তারিণী বা মোতির মা তার উপর যথেষ্ট সহানুভূতি দেখায়। কুমু তার কাছেই এই প্রথম জানতে পারে যে তার দাদা কাউকে না জানিয়ে স্টেশনে বরযাত্রীদের অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল। একথা শুনে কুমু অবাক হয়ে যায়। মোতির মা বিপ্রদাসের খুব প্রশংসা করল। দাদার প্রতি প্রশংসা বাক্য শুনে কুমুর মন গলে গেল। মোতির মা বুঝতে পেরেছিল যে দাদার প্রতি কুমুর দরদ বেশি, তাই সে নানারকম করে তার দাদার কথাই আলোচনা করতে লাগল। মোতির মা এতে কুমুকে অসহায় অবস্থা থেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। আলোচনায় মোতির মা বিপ্রদাস সম্পর্কে বলে ওঠে - “মরে যাই। অমন দেবতার মত রূপ, এখনো ঘর খালি। কোন ভাগ্যবতীর কপালে আছে ঐ বর।”৪৬ দাদার স্টেশনে যাওয়ার কথা মনে করে কুমু নিজেকে অপরাধিনী বলে মনে হয়। অনবরত কুমুর মনে শুধুমাত্র অসুস্থ দাদার কথা মনে পড়তে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন বরকনে এক গাড়িতে উঠল তখন মধুসূদন পাশে বসে কুমুর দেহ মন সংকুচিত হয়ে গেল। কুমু মধুসূদনকে আপন করে নিতে পারছিল না কারণ আজ পর্যন্ত তার কাছ থেকে সে শুধু বাধাই পেয়েছে। মধুসূদনের আচার আচরণে যে একটা রুঢ়তার প্রমান পাওয়া গেল তারজন্যই কুমুকে এখনও পর্যন্ত তার থেকে দূরে ঠেকিয়ে রাখল। এখনও পর্যন্ত মধুসূদন মেয়েদের সাথে খুব বেশি মেলামেশা করেননি তাই সে নারীদের মন বুঝতে পারে না। মধুসূদন কুমুকে স্ত্রী হিসাবে মনে না করে দাসী হিসাবেই ভাবতে শুরু করে। স্ত্রী যে একজন প্রণয়ীর মতো হতে পারে তা মধুসূদনের স্থূল চরিত্রে অনুমান করতে পারে না। কুমুর সৌন্দর্য দেখে মধুসূদনের মনে তাকে বাস্তব না ভেবে একটা দৈব্য আবির্ভাব বলেই অনুমান করে। সেইজন্য মধুসূদন কুমুকে নিজের থেকে শ্রেষ্ঠ বোধ করলে এবং তার সাথে আচার আচরণ ও ব্যবহারের ধরন চিন্তা করতে লাগল। কুমুর সঙ্গে নানা অছিলায় মধুসূদন কথা বলতে লাগল। কুমু কিন্তু তার কোন উত্তরেই দিতে পারল না। কিন্তু মধুসূদন নিজেই উত্তরের আশায় ব্যর্থ হয়ে স্ত্রীকে নানারকম ভাবে সাহায্য করতে থাকে। এরদ্বারা আমরা বলতে পারি মধুসূদন স্ত্রীর সাথে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছিল। কিন্তু পূর্বের অপমান মনে রেখে কুমু তাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না। এইজন্যই কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য জীবনের প্রারম্ভে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যার ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের আবির্ভাব দেখতে পাই।

          কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কুমুর হাতের দিকে মধুসূদনের চোখ পড়ল। মধুসূদন তখন স্ত্রীর হাতে একটি আংটি লক্ষ্য করল। মধুসূদন তাই বাঁ হাতটা চোখের কাছে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করল আংটিটা কিসের? এটা যে নীলা তা মধুসূদনের অনুমান করতে সময় লাগে না। মধুসূদনের এইসব কথা শুনে কুমু কিন্তু চুপচাপ থাকে। মদুসুদন তখন কুমকে বলে - “দেখো নীলা আমার সয় না, ওটা তোমাকে ছাড়তে হবে।”৪৭ পূর্ব অভিজ্ঞতাবশতঃ নীলাকে মধুসূদন অপয়া বলে মনে করত। সেইজন্য সে তার স্ত্রীকে নীলার আংটি রাখতে দিতে চায় না। মধুসূদনের এই আচরণে আমরা অনুমান করতে পারি সে নিজের সিন্ধান্তকে জোর করে তার স্ত্রীর মনে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কুমুদিনী আস্তে আস্তে স্বামীর হাত থেকে তার হাতটি মুক্ত করার চেষ্টা করল। মধুসূদন তার হাতটি না ছেড়ে তাকে সে আংটিটা খুলে রাখতে বলে। মধুসূদনের এই কথায় কুমু রাজী হল না। এই আংটিটা কুমুর কাছে সাধারণ বস্তু ছিল না। কারণ একবার দাবাখেলায় জিতে তার দাদা এটি তাকে নিজের হাতের আংটি পারিতোষিক দিয়েছিল। কুমুর আচরণ দেখে মধুসূদনের হাসি পেল। এইখানে কুমু সাথে নিজের সাধর্ম্যের পরিচয় পেয়ে মধুসূদন একটু আরাম বোধ করল। মধুসূদন তখন ঐ নীলার আংটির পরিবর্তে নিজের হাতের থেকে একটি কমলহীরের আংটি খুলে কুমুকে দিতে চায়। কুমু আর সহ্য করতে না পেরে জোরপূর্বক তার নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নেয়। কুমুর এই আচরণ দেখে মধুসূদনের মনটা ঝেঁকে উঠল। স্ত্রীর কাছে নিজের কর্তৃত্বের খর্বতা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তাই শুষ্ক গলায় জোর করেই বলে – “দেখো, এ আংটি তোমাকে খুলতেই হবে।”৪৮ মধুসূদনের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে মধুসূদন তার কর্তৃত্ব সব জায়গায় বজায় রাখার চেষ্টা করে। মধুসূদনের এই দৃঢ় বাক্য শুনে নববধূর মুখ একেবারে লাল হয়ে যায়। মধুসূদন আবার ঐ আংটিটি খুলে দেবার জন্য কুমুকে আদেশ করে এবং নিজের হাতটি তার দিকে উদ্যত করে সেটি নেবার জন্য। এবার কিন্তু কুমু মধুসূদনের কথায় রাজী হয়ে আংটিটি খুলতে সম্মত হয়। কুমু তার নীলার আংটিটি খুলে ফেলার পর মধুসূদন যখন সেটি নেবার জন্য হাত বাড়ায় তখন কুমু তা দিতে অস্বীকার করে নিজের কাছেই রেখে দেবার কথা বলে। কুমুর এই আচরণে বিরক্ত হয়ে মধুসূদন গর্জন করে বলে – “রেখে কি লাভ? মনে ভাবছ, এটা ভারি একটা দামি জিনিস! এ কিছুতেই তোমার পরা চলবে না, বলে দিচ্ছি।”৪৯ উত্তরে কুমু জানায় আংটিটি সে আর পরবে না তাই একটি থলির মধ্যে ঐ নীলার আংটিটা রেখে দিল। কুমুর এই আচরণ দেখে মধুসূদন রুদ্ধস্বরে বলতে পারে - “কেন, এই সামান্য জিনিসটার উপরে এত দরদ কেন? তোমার তো জেদ কম নয়!”৫০ ঐ নীলার আংটি কে কেন্দ্র করে আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে যথেষ্ট বাগবিতণ্ডা হয়। যা তাদের নব দম্পতির মনে অশান্তির সৃষ্টি করে। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই নিজেদের জেদকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্যই তাদের জীবনে এতটা অশান্তির সৃষ্টি হয়। যার ফলে নব দম্পতির দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি হয় যা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

          এই আংটি কে কেন্দ্র করে নবদম্পতির মধ্যে যে মানসিক সংঘাতের সৃষ্টি হয় তাতে শেষ পর্যন্ত কুমুকে তার জেদের কাছে স্থির থাকতে দেখা যায়। মদুসুদন তখন কুমুর কাছে জানতে চেয়েছিল এই আংটির উৎস কি? মধুসূদন প্রথমে সন্দেহ করে যে এটি কুমু বোধ হয় মায়ের কাছ থেকে পায়, তাই এর জন্য তার এত মোহ। কিন্তু পরক্ষণে কুমুর কাছে মধুসূদন জানতে পারে বিপ্রদাস এই আংটিটি কুমুকে পারিতোষিক দিয়েছিল। বিপ্রদাসকে যেহেতু মধুসূদন চির প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করত, তাই তার কথা শুনে মধুসুদন কুমুর কাছে তার দাদার আর্থিক অবনতির কথা বলে খুব ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। মধুসূদন এ কথা বলতেও দ্বিধা করেন নি যে তার দাদার যেরূপ শনির দশা চলছে তাই তার দেওয়া কোন বস্তু সে তার ঘরে রাখতে দেবে না । মধুসূদন যেহেতু একজন স্থূল চরিত্রের মানুষ তাই সে নিজের স্ত্রীকে প্রণয়ীর মতো ভালবাসতে না পেরে জোর করেই স্ত্রীর মনের মধ্যে স্থান পাওয়ার চেষ্টা করে। স্বামীর এই স্থূল আচরণকে কুমু কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। পূর্বেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে কুমুর রূপ সৌন্দর্য মধুসূদনের মনকে আকৃষ্ট করে। এর পর জানা গেল যে রূপ ছাড়া আরো একটা কারনে হঠাৎ কুমুদিনীর দর বেড়ে গেল স্বামীর কাছে। বিবাহের দিনে মধুসূদন টেলিগ্রামের দ্বারা জানতে পারে যে ব্যবসাতে তার প্রায় বিশ লাখ টাকা লাভ হয়েছে। মধুসূদনের ধারণা স্ত্রীর আবির্ভাবের জন্যই তার এই লাভ সম্ভব হয়েছে। তাই মধুসূদন কুমুকে পয়া বলে মনে করতে শুরু করে। কারণ মধুসূদনের মনে হল যে স্ত্রী ভাগ্যে ধন লাভ হল। কুমুর সৌন্দর্য যে খুব সুন্দর ছিল তার যথেষ্ট প্রমান আমরা পাই, যখন একজনকে বলতে শুনি - “সাবেক কালে এমন মেয়ের জন্যে রাজায় রাজায় লড়াই বেধে যেত, আজ তিসি চালানির টাকাতেই কাজ সিদ্ধি। কলিযুগে দেবতাগুলো বেরসিক। ভাগ্যচক্রের সব গ্রহ নক্ষত্রই বৈশ্যবর্ণ।”৫১

          মধুসূদন যখন কলকাতায় বাস করতে এলো তখন প্রথমে সে একটি পুরানো বাড়ী কিনেছিল। সেই চকমেলানো বাড়িটাই আজ তার অন্তঃপুর মহল। মদুসুদনের বাড়িটি ছিল খুব বিলাস বহুল। কুমুকে নিয়ে যখন মধুসূদন সেই বাড়ীতে গেল তখন কুমুর সৌন্দর্য দেখে বাড়ীর আত্মীয় স্বজনের খুব ভাল লাগল, কিন্তু পাড়া প্রতিবেশিরা ঈর্ষায় জ্বলে গেল। কুমুকে বরণ, স্ত্রী আচার প্রভৃতি কাজকর্ম সম্পাদনা করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। নিজের বাড়ীতে কুমুর একমাত্র বড় বোনের বিয়ের কথা স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তাদের বাড়ীতে কোন নতুন বউ আসতে সে কখনোই দেখেনি। তার জন্যই নববধূর এই কার্য প্রণালী সম্বন্ধে তার কোন পূর্ব জ্ঞান ছিল না। বাল্যকাল থেকে কুমু স্বামীর কামনায় শিবকে পূজা করে তাকেই সে স্বামী হিসাবে বরণ করে নেয়। কুমু তার নিজের মাকে সতীসাধ্বী নারীর আদর্শ রুপেই মান্য করত। দৈব্য নির্ভরতাকে বিশ্বাস করে কুমু মধুসূদনকে বিয়ে করে ভবিষ্যতে যে কোন বাধার সৃষ্টি হবে তা সে কোনদিন বিশ্বাসই করতে পারেনি। কারণ তার ধারণা ছিল দেবতা তার কোন অমঙ্গল করতে পারে না। দেবতার ইচ্ছাতেই যে তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে এটাও কুমুর মনে বিশ্বাস হয়। শ্বশুরবাড়িতে কুমুকে বরণের জন্য সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত ছিল। স্বামীর প্রতি সন্দেহের সঙ্গে কুমুর মনে হল – “রাজাও এলেন, কিন্তু মনে যাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল, বাইরে তাকে দেখলে কই? রূপেতেও বাধত না, বয়সেও বাধত না। কিন্তু রাজা? সেই সত্যকার রাজা কোথায়?”৫২ বাইরের ও ভিতরের অসামঞ্জস্যের জন্য কুমুর মন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। তাই সে তার মনকে কিছুতেই স্থির করতে পারল না। এরপর অন্দরমহলে তেতলায় কুমুর শোবার ঘর ঠিক হল। ঘরে মস্ত বড় খাট মেহগনি কাঠের, ফ্রেমে নেটের মশারি, তাতে সিল্কের ঝালর। একেবারে বিলাসবহুল ঘরের দৃশ্য দেখতে পাই। কিন্তু মধুসূদনের স্থূল চরিত্র বশতঃ বিছানার পায়ের দিকে পুরো বহরের একটি নিরাবরণ মেয়ের ছবি দেখা যায়। মেয়েটি যেন বুকের উপর দুইহাত চেপে লজ্জার ভান করছে। শোবার ঘরে এই নিকৃষ্ট শ্রেণীর ছবি দেখে আমরা অনুমান করতে পারি মধুসূদন কতটা নীচ চরিত্রের মানুষ। কুমু এইসব চিত্র দেখে তার মনেও স্বামী সম্পর্কে একই ধারণা হয়ে থাকে। কুমুর সাথে মোতির মার সুসম্পর্ক থাকার জন্য তার সাথেই নববধূর কালরাত্রি যাপনের দায়িত্ব পড়ল। যার জন্য মোতির মার সাথে কুমু শোবার ঘরে গেল। শ্বশুর বাড়ীতে একমাত্র মোতির মা ছিল কুমুর প্রতি সহানুভূতিশীল। সময়ে অসময়ে কুমুর প্রতি তার লক্ষ্য ছিল অবিস্মরণীয়। একমাত্র মোতির মা বাদে বাকী কোন ব্যক্তির সাথেই কুমু মেলামেশা করতে পারল না। তাই এখানে এসে পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে কুমু কিছুতেই পারছিল না। তাই একথা চিন্তা করে কুমুর মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। তাই মোতির মা কুমুকে বলে – “আমি কিছুক্ষণের জন্য যাই ঐ পাশের ঘরে-তুমি একটু কেঁদে নাও ভাই, চোখের জল যে বুক ভরে জমে উঠেছে।”৫৩

          কুমুকে এই সদুপদেশ দিয়ে মোতির মা এ ঘর ছেড়ে চলে গেল। একাকী কুমুর মনে হল এখন কান্নার সময় নয়, বড়ো দরকার হয়েছে নিজেকে ঠিক করা। কুমুর অন্তরে যে কাথাটা তাকে বারবার আঘাত করছিল তা হল তার নিজের কাছে নিজের অপমান। অর্থাৎ কুমু যে আত্মদহনে দগ্ধ হতে লাগল এটা আমরা অনুমান করতে পারি। এতকাল ধরে কুমু যা কিছু সংকল্প করে এসেছে ওর বিদ্রোহী মন সম্পূর্ণ তার উল্টো দিকে চলে গেছে। সেই অবাধ্য মনটাকে শাসন করবার একটু সময় পাচ্ছিল না, যার জন্য সে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কুমু তাই আর্তকণ্ঠে বলতে পারে - “ঠাকুর, বল দাও, বল দাও, আমার জীবন কালি করে দিয়ো না। আমি তোমার দাসী, আমাকে জয়ী করো, সে জয় তোমারই।”৫৪ মোতির মায়ের অনুপস্থিতে কুমুর একাকীত্বের সুযোগ পেয়ে তার কাছে একটি পরিণত বয়সী আঁটসাঁট গড়নের শ্যাম বর্ণ সুন্দরী বিধবা মহিলা প্রবেশ করে। এই মহিলাটি হল কুমুর জা শ্যামাসুন্দরী। সে কুমুর ঘরে ঢুকেই বললে - “মোতির মা তোমাকে একটু ছুটি দিয়েছে সেই ফাঁকে এসেছি, কাউকে তো কাছে ঘেঁষতে দেবে না, বেড়ে রাখবে তোমাকে-যেন সিঁধকাটি নিয়ে বেড়াচ্ছি, ওর বেড়া কেটে তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাব।”৫৫ শ্যামাসুন্দরী কুমুর স্বামীর বয়সের আধিক্যের খোঁটা দিয়ে কুমুর মনকে দূর্বল করার চেষ্টা করল। কুমু তার জা এর কাছে এসব ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শুনে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মধুসূদনের ভাগ্যে যে এত সুন্দরী বৌ জোটতে পারে সে কথা ভেবে শ্যামা অবাক হয়ে যায়। কারণ তার মতে মধুসূদন কুমুকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার যোগ্য নয়। শ্যামা তাই কুমুর মন বোঝার জন্য বলে – “সত্যি করে বলো ভাই, আমাদের বুড়ো দেওরটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”৫৬ শ্যামার এই প্রশ্ন শুনে কুমু অবাক হয়ে যায়, তাই কোন জবাব দিতে পারে না। কুমুর মৌনব্রত দেখে শ্যামা কিন্তু কুমুকে বিব্রত করার জন্য আশা ত্যাগ করে নি। শ্যামা তাই আবার কুমুকে বলে –“বুঝেছি, তা পছন্দ না হলেই বা কী, সাত পাক যখন ঘুরেছ তখন একুশ পাক উলটো ঘুরলেও ফাঁস খুলবে না?”৫৭ শ্যামার এই কথা শুনে কুমু এর অর্থ বুঝতে পারে নি। শ্যামা এর পর কুমুকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে থাকে এবং তাকে সাবধানও করে দেয়। শ্যামা জবাব দেয় – “খোলসা করে কথা বললেই কি দোষ হয় বোন? মুখ দেখে কি বুঝতে পারি নে? তা দোষ দেব না তোমাকে। ও আমাদের আপন বলেই কি চোখের মাথা খেয়ে বসেছি? বড়ো শক্ত হাতে পড়েছ বউ, বুঝে সুঝে চোলো।”৫৮ শ্যামাসুন্দরী কিছুক্ষণের জন্য এসে কুমুর মনের মধ্যে ভারি একটা বিস্বাদ জাগিয়ে দিয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ মোতির মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে শ্যামা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাই সে মোতির মাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে কিছু কথা শুনিয়ে এখান থেকে বিদায় নিল। আজকে কুমুর সবচেয়ে দরকার ছিল মায়ার আচরণ, সেইটাই সে মনে মনে গড়ার জন্য বসেছিল। তার ঠাকুরকে সে সহায় করবার জন্য চেষ্টা করছিল কিন্তু সে সময় শ্যামা এসে তার স্বপ্ন বোনা জালে ঘা মারল। তাই কুমু নিজের দূর্বল মনকে শক্ত করার জন্য মনে মনে খুব জোর করে নিজেকে বলতে লাগল - “স্বামীর বয়স বেশি বলে তাকে ভালবাসি নে, একথা কখনোই সত্যি নয়-লজ্জা লজ্জা! এ যে ইতর মেয়েদের মতো কথা। শিবের সঙ্গে সতীর বিয়ের কথা কি ওর মনে নেই? শিব নিন্দুকরা তার বয়স নিয়ে খোঁটা দিয়েছিল, কিন্তু সে কথা সতী কানে নেন নি।”৫৯ স্বামীর বয়স বা রূপ নিয়ে এ পর্যন্ত কুমুর মনে কোন চিন্তাই ছিল না। সাধারণত যে ভালোবাসা নিয়ে স্ত্রী পুরুষের বিবাহ সত্য হয়, যার মধ্যে রূপগুণ দেহমন সমস্তই মিলে আছে, তার যে প্রয়োজন আছে এ কথা কখনো ভাবেনি। পছন্দ করে নেওয়ার কথাটাকে কুমু তাই রঙ মাখিয়ে চাপা দিতে চায়।

          কুমু যখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এইসব ভাবতে থাকে ঠিক তখনই হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে ফুলকাটা জামা ও জরির পাড়ওয়ালা ধুতি পড়ে তার কাছে আবির্ভাব হল। তাকে দেখে কুমু কোলের উপর টেনে নিয়ে তার নাম জানতে চায়। ছেলেটি খুব ঘটা করে তার নাম জানালে শ্রী মোতিলাল ঘোষাল। বাড়ীর সকলের কাছে তার পরিচয় হাবলু বলে। কুমুর মন ভারাক্রান্ত হওয়ার জন্য তার বুকের ভিতরটা টনটন করছিল তখন এই ছেলেকে বুকে চেপে ধরে তার যেন প্রান ফিরে বাঁচল। সেই সময় কুমু এই ছেলেটিকে ঠাকুর ঘরের তার আরাধ্য গোপাল বলে মনে মনে ভাবতে লাগল। তার জন্য কুমুর মনে শান্তি বিরাজ করল। তাই কুমু হাবলুকে পেয়ে খুব আদর করতে লাগল। কুমু যত মধুসূদনের হৃদয় মধ্যে গ্রহণ করতে বাধা পায় ততই সে তার দেবতাকে দিয়ে তার স্বামীকে আবৃত করার চেষ্টা করে। রাত্রে কুমু মধুসুদনের রূঢ় আচরণের কথা চিন্তা করে কাঁদতে লাগল। মোতির মা কুমুর এই অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাই সে কোন কথা বলতে পারে না। কুমুর এই অবস্থার কথা মোতির মা এই প্রথম বুঝতে পারল যা সে ভাবতেও পারেনি। মোতির মা যেহেতু কুমুকে খুব ভালবাসত তাই তার দুঃখে সেও চিন্তিত হয়ে পড়ে। কুমুকে ভালবাসার জন্য মোতির মার পূর্ব ভূমিকা হয় তার দাদার মহত্ত্বের পরিচয়ে। পরের দিন সকালেই কুমু দাদার টেলিগ্রাম পেল। এখানে আসার পর থেকে কুমু দাদার জন্য খুবই চিন্তিত ছিল তাই টেলিগ্রামটি পেয়ে তার মনে সাময়িক শান্তি ফিরে এল। টেলিগ্রাম পড়ে কুমু তার দাদার শরীরের কোন খবর না পেয়ে আবার চিন্তা করতে লাগল। তাই কুমুর মনে দাদার বিপদের কথা সন্দেহ হতে লাগল। তার অনুমান হয় দাদা হয়তো তার বিপদের কথা কুমুকে গোপন রাখতে চায়। কুমুর মনে হয় যে দাদার খবর তার সবসময় প্রত্যক্ষগোচর ছিল, আজ ভাগ্যের পরিহাসে তার কাছে সবই অবরুদ্ধ। ফুলসজ্জার দিনে কুমুর মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। তাই সে চাইছিল একটু একাকী থেকে মনকে প্রস্তুত করে নেবে। কিন্তু সেই সুযোগ কুমু কিছুতেই জোগাড় করতে পারছিল না। বিপ্রদাসের শরীর খুব খারাপ থাকার জন্য কুমুর ফুলসজ্জার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারল না। তাই বিপ্রদাস তার প্রতিনিধি হিসাবে নবগোপালকে অনুষ্ঠানে পাঠিয়ে দিয়ে তার কর্তব্য পালন করে। বিপ্রদাসের কথাতে নবগোপাল এল কুমুর ফুলসজ্জার সওগাত পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। কুমু এই অনুষ্ঠানে তার বাপের বাড়ীর কাউকে দেখতে না পেয়ে খুব দুঃখ পেল। কুমুর মনে হল পূর্ব সংঘাতের জেরেই তারা কেউ এখানে উপস্থিত হয় নি। তাই কুমু মনে মনে বুঝলে - “সন্ধি এখনো হল না, হয়তো কোন কালে হবে না।”৬০ ফুলসজ্জার রাত্রিতে কুমুর বুকটা ভয়ে দুরদুর করে কাঁপতে লাগল। কুমুর ঠাণ্ডা হাত ঘামছে, মুখ বিবর্ণ হতে দেখা যায়। বিপদের সংকেত বুঝে কুমু তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মোতির মায়ের কাছে। মোতির মাকে কুমু অনুরোধ করে তাকে কিছু সময়ের জন্য নির্জন স্থানে নিয়ে যাবার জন্য। বিপদের সংকেত বুঝে মোতির মা কুমুকে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মধুসুদন শোবার ঘরে গিয়ে কুমুকে দেখতে পায়নি। কুমুর খোঁজ না পেয়ে বাড়ীর সকলে তাকে অনুসন্ধান করতে থাকে। এই খবর পেয়ে মোতির মা বিপদের আশঙ্কা বুঝে ভয় পেতে শুরু করে। কুমুর ঘরে ঢোকা অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও কিন্তু সে দরজা খুলল না। মোতির মা বিপদের সংকেত বুঝে তাই জোর করে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই দেখা গেল যে কুমু মুর্ছিত হয়ে মেঝের উপর পড়ে আছে।

          নববধূর মুর্ছা যাওয়ার খবর রটে গেল চারিদিকে গোলমাল পড়ে গেল। বাড়ীর সমস্ত লোক তাকে সুস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর যখন কুমুর চেতনা ফিরে এলো তখন সে বুঝতে পারল না সে কোথায় আছে। অজ্ঞানবশতঃ তাই কুমু তার দাদাকে ডাকতে থাকে। কুমুকে অভয়দান করে মোতির মা জানায় সে থাকতে তার কোন ভয় নেই। মোতির মা কুমুর মুখটা বুকের উপর তুলে নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। মোতির মায়ের অতি যত্নে কুমু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে পড়ল। কুমু এরপর ঠাকুরের নাম করে প্রনাম করতে লাগল। এ থেকেই সহজে অনুমান করা যায় যে কুমু কতটা দৈব্য নির্ভরশীল। মোতির মা লোকলজ্জা দূর করার জন্য কুমুকে শোবার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। এরই মধ্যে শ্যামাসুন্দরী কৌতূহলবশতঃ হাঁপাতে হাঁপাতে মধুসূদনকে নববধূর মুর্ছার ঘটনা সব জানায়। মধুসুদন এই কথা শুনে রাগে জ্বলে যায় এবং উত্তেজিত হয়ে তার কারণ জিজ্ঞাসা করে। শ্যামা মধুসুদনকে বেশি করে উত্তেজিত করার জন্য বলে – “তা তো বলতে পারিনে, দাদা দাদা করেই বউ হেদিয়ে গেল। তা একবার কি দেখতে যাবে?”৬১ কুমুর মুখে দাদার কথা শুনে মধুসুদন যে খুব বিরক্ত প্রকাশ করে এটা শ্যামার জানা ছিল। তাই মধুসুদন এই কথা শুনে অভিমান করে। শ্যামা তখন মধুসূদনকে ধৈর্য ধরার কথা বলে। মধুসুদন কুমুর প্রতি বিরক্ত হয়ে তাই বলে - “রোজ রোজ উনি মুর্ছা যাবেন আর আমি ওঁর মাথায় কবিরাজি তেল মালিশ করব এই জন্যেই কি ওঁকে বিয়ে করেছিলুম?”৬২ শ্যামাসুন্দরী মনে মনে মধুসুদনের প্রতি কামজ মোহে আকৃষ্ট হয়েছিল। তাই সে মধুসূদনকে একান্তে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু মধুসূদন শ্যামকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। এজন্য শ্যামার মনে খুব দুঃখ হত। তাই শ্যামা যে কোন প্রকারে মধুসুদন ও কুমুর সম্পর্কটাকে ছিন্ন করার জন্য পাগল হয়ে যায়। তাই শ্যামা, মধুসূদন ও কুমুকে একা পেলেই প্ররোচনা দিয়ে তাদেরকে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করে। মধুসূদনের বিরক্তির সুর শুনে তাই শ্যামা খুব আনন্দ হয়। কারণ সে তার উদ্দেশ্যের কিছুটা হলেও সফল হতে শুরু করে। তাই শ্যামা মধুসূদনের কাছে কুমুর প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেনা।

          মধুসূদন শ্যামার কাছে কুমুর কথা শুনে মন খারাপ করে বসে রইল। মধুসূদনের এই অবস্থা দেখে শ্যামা সুযোগ বুঝে তার প্রতি সমব্যাথি বলে নিজেকে প্রমান করতে চায়। কারণ শ্যামার ইচ্ছা ছিল এই সুযোগে মধুসূদনের মনের কোনে স্থান করে নেওয়ার। তাই শ্যামা বিগলিত সুরে বলতে পারে - “ঠাকুরপো, অমন মন খারাপ কোরো না, দেখে সইতে পারি নে।”৬৩ এর আগে মধুসূদনের এত কাছে গিয়ে শ্যামার স্বান্তনা দেওয়ার সাহস আমরা দেখতে পাইনি। শ্যামা আজ বুঝতে পেরেছে যে মধুসূদন আর আগের মতো নেই তার ভাবের পরিবর্তন হয়েছে। মধুসদনের দৃঢ়তা আজ নেই। আজ ও দুর্বল তাই নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্কতা ওর নেই। শ্যামা তাই এই সুযোগটাকে সদ ব্যবহার করার চেষ্টা করে। মধুসূদনের হাতে হাত দিয়ে শ্যামা অনুমান করে যে মধুসূদনের এতে বিরক্তিবোধ হয়নি। শ্যামাসুন্দরী আজ মধুসূদনের দুর্বল মানসিকতার সুযোগ নিয়ে তার নিকটে চলে গেল। তাই শ্যামা আজকে তার অনেক দিনের আশা পূর্ণ করতে পারে। স্বামীর প্রতি কুমুর অবহেলার জন্যই, মধুসূদন শ্যামাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যার ফলে শ্যামা ও মধুসূদনের একটা অবৈধ কামের সম্পর্কের আবির্ভাব দেখা যায়। যা কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য জীবনকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। নবদাম্পতির দাম্পত্য জীবনে কলহের দৃশ্য দেখা যায়। কুমু এরপর হঠাৎ স্বামীর ঘরে এলে তা দেখে শ্যামা লজ্জিত হয়ে চলে যায়। যাবার সময় বলে যায় - “ঐ আসছে বউ, আমি যাই ভাই। কিন্তু দেখো ওর সঙ্গে রাগারাগি কোরো না, আহা ও ছেলেমানুষ!”৬৪ শ্যামাসুন্দরীর এই কথার মধ্য দিয়ে কুমু ও মধুসূদন উভয়ের কাছে নিজের চরিত্রের সমন্বয় সাধন করার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। কুমু তার মনকে দৃঢ় করে পুনরায় স্বামীর কাছে ফিরে এলো কিন্তু স্বামীর কঠিন আচরণে আবার তার মন ভেঙ্গে গেল। মধুসূদন কঠিন স্বরে কুমুকে বলে – “বাপের বাড়ী থেকে মুর্ছো অভ্যেস করে এসেছ বুঝি? কিন্তু আমাদের এখানে ওটা চলতি নেই। তোমাদের ঐ নুরনগরি চাল ছাড়তে হবে।”৬৫ স্বামীর কাছে এই কথা শুনে কুমু কোন উত্তর দিল না। কুমুর মৌন অবস্থা দেখে মধুসূদন অবাক হয়ে আবার বেশি রেগে গেল। মধুসূদনের মনে মনে কুমুর প্রতি ভালবাসার জন্য একটা আশঙ্কা জেগেছে বলেই তার এই নিস্ফল রাগ। মধুসূদনের নানারকম অপমান জনিত কথা শুনে কুমু ধীরে ধীরে বলল – “তুমি আমাকে অপমান করতে চাও? হার মানতে হবে। তোমার অপমান মনের মধ্যে নেব না।”৬৬ কুমু কাকে লক্ষ্য করে এই কথা বলে তা মধুসূদন বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে যায়। মধুসূদন তখন বক্রোক্তি করে বললে - “তুমি তোমার দাদার চেলা, কিন্তু জেনে রেখো আমি তোমার সেই দাদার মহাজন, তাকে এক হাটে কিনে আর এক হাটে বেচতে পারি।”৬৭ মধুসূদন যে কুমুর দাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ একথা কুমুর মনে দেগে দেবার জন্য মুঢ় আর কোন কথা খুঁজে পেল না। তাছাড়া মধুসূদনের কাছে বিপ্রদাস যে একজন ক্ষুদ্র মানুষ তাই বলতে চায় মধুসুদন। স্বামীর মুখে দাদার প্রতি অপমানজনক কথা শুনে কুমু খুব দুঃখ পায়। যার ফলে স্বামীর প্রতি ক্ষুদ্রকনা মাত্র ভালোবাসা তার মনে ঠাই পেল না।

          কুমু দাদার প্রতি অপমান সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে আবেদন করে – “দেখো নিষ্ঠুর হও তো হোয়ো, কিন্তু ছোট হোয়ো না।”৬৮ কুমুর এই কথা শুনে মধুসূদন রেগে গিয়ে কর্কশকণ্ঠে বলে উঠল - “কী! আমি ছোটো! আর তোমার দাদা আমার চেয়ে বড়ো?”৬৯ কুমু তখন স্বামীকে জানায় তাকে বড়ো জেনেই সে তার ঘরে এসেছে। কুমুর কথা শুনে মধুসূদন ব্যঙ্গ করে বলে – “বড়ো জেনেই এসেছ, না টাকার লোভে?”৭০ নবদম্পতির মধ্যে এইভাবে কথা কাটাকাটি হতেই হঠাৎ কুমু রাগ করে খোলা ছাদের মধ্যে চলে যায়। ডঃ সুকুমার সেনের মতে- “মধুসূদন কুমুকে দৈব্যলব্ধ বস্তুর মতো ভাবিয়াছিল এবং কুমুর মন পাইবার জন্য সে বুদ্ধিবিবেচনা মতো চেষ্টাও করিয়াছিল। কিন্তু কুমুর অন্তরের সবচেয়ে কোমল স্থানে বারবার আঘাত করিয়া সে বিচ্ছেদকে বাড়াইয়াই চলিয়াছিল। বিপ্রদাসের উপর কুমুর অগাধ ভক্তি ও স্নেহ মনে পড়িলে মধুসূদনের মনে আগুন জ্বলিয়া যাইত।”৭১ ইচ্ছার বাইরে জোর করে কুমুকে নিজের বশবর্তী করা যে খুব সহজ নয় তা মধুসূদন অনুমান করতে পারে। দাদা বিপ্রদাসের কাছে সে ধৈর্যের দীক্ষা নিয়েছে। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করার জন্যই কুমু শ্বশুরবাড়িতে এসেছিল। কিন্তু যাকে সে সবকিছু আত্মসমর্পণ করতে চায় সে তো তার আত্মার ও আত্মসমর্পণের কোন মুল্য বোঝে না। উপরন্তু বারবার কুমুর মনে বেদনা দিয়া তার মনের আবরণকেই শক্ত করে তুলেছে। কুমু তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগল সে যদি ইহ জন্মে স্বামীর সহধর্মিণী নাই হতে পারে তবে দাসী রূপেই কর্তব্যকর্মে অটুট থাকবে। পরদিন কুমু ভোরে স্নান সেরে যখন তার দাদার টেলিগ্রামটি ব্যাগে রাখতে গেল তখন ঐ স্থানে তার নীলার আংটিটি দেখতে পেল না। কুমু তখন অনুমান করতে পারল যে আংটিটি কোথায় যেতে পারে? পূর্ব অভিজ্ঞতায় কুমু জানত যে আংটিটিকে তার স্বামী একেবারেই পছন্দ করত না। তাই এটা যে তার স্বামীই হস্তগত করেছে তাতে কুমুর মনে কোন সন্দেহ রইল না। সকাল বেলা মানস পুজার পর কুমুর মুখে একটি শান্তির ভাব এসেছিল সেটা মিলিয়ে গিয়ে চোখে আগুন জলে উঠল। স্বামীর এই আচরণে কুমুর মন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কুমু এই ঘটনা মোতির মাকে সব জানিয়ে নিজের মনকে হালকা করে। কুমুর কাছে সবকিছু শুনে মোতির মা জানায় যে স্বামী তার সাথে ঠাট্টা করে এসব করেছে পরে আবার ওটা দিয়ে দেবে। কুমু তখন বলে সে আর তা ফিরে নেবে না। মোতির মা বুঝতে পারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে রাগ অভিমানের পালা শুরু হয়। মোতির মা কুমুকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে কুমু কিন্তু অভুক্ত থেকে গেল।

          কুমু মধুসূদনের রূঢ় আচরণে দিনদিন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। কুমু বারাবার নিজের মনকে তৈরি করতে চাইলেও মধুসূদনের আচরণে তা বিনষ্ট হয়। কুমু তাই মোতির মাকে বিরহের স্বরে জানাতে পারে যে আজ থেকে তার নিজের মর্জি বলে কিছু থাকল না, যা কিছু রইল সব স্বামীর উপরে। তাই সে নিজেকে মধুসূদনের দাসী বলে ভাবতে লাগল। মধুসূদনের প্রতি বিদ্রূপ করে কুমুকে মোতির মাকে বলে – “স্ত্রী যাদের দাসী তারা কোন জাতের লোক?”৭২ মোতির মা তখন মধুসূদনের সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে কুমুকে জানায়। মধুসূদন শুধু অন্যকেই গোলামি করায় তা নয়, নিজের গোলামি নিজে করে। মধুসুদনের কোন ভুলের জন্য সে নিজেও তার প্রায়শ্চিত্ত করে। মোতির মা জানায় মধুসূদন আত্মীয় বলে কাউকে মানে না। এ বাড়ীতে কর্তা থেকে চাকর-চাকরানী পর্যন্ত সবাই গোলাম। মোতির মায়ের কাছে এই কথা শুনে কুমু চুপ করে থেকে বললে - “আমি সেই গোলামিই করব। আমার রোজকার খোরপোশ হিসেবমত রোজ রোজ শোধ করব। আমি এ বাড়ীতে বিনা মাইনের স্ত্রী বাঁদী হয়ে থাকব না। চলো আমাকে কাজে ভর্তি করে নেবে। ঘর কন্নার ভার তোমার উপরেই তো আমাকে তুমি তোমার অধীনে খাটিয়ে নিয়ো, আমাকে রানী বলে কেউ যেন ঠাট্টা না করে।”৭৩ কুমুর এই কথা শুনে মোতির মা তার সাথে ঠাট্টা করতে করতে নিয়ে চলে যায়। তখন ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কুমু বললে - “দেখো ভাই, নিজেকে দেব বলেই তৈরি হয়ে এসেছিলুম, কিন্তু ও কিছুতেই দিতে দিলে না। এখন দাসী নিয়েই থাকুক। আমাকে পাবে না?”৭৪ কুমু এই কথার দ্বারা বলতে চায় সে নিজের মনকে প্রস্তুত করেই এসেছিল স্বামীকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু স্বামী তার দৃঢ় আচরণে এই মন নিতে পারল না। তাই কুমু বলে এখন তার মন সে পাবে না, দেহ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। নবদম্পতির মধ্যে মানসিক মিল আর সম্ভব নয় তাই তাদের শারীরিক মিলনই এখন একমাত্র সম্পদ। মোতির মা তখন জানায় যে মধুসুদন হল কাঠুরের মত, সে গাছকে পায় না কাঠ পায়। কিন্তু মালী গাছকে রাখতে জানে, সে পায় ফুল, পায় ফল। কুমু কাঠুরের হাতে পড়েছে, সে ব্যবসাদার। তাই মধুসুদনের মনে কোন দরদ নেই কোথাও?

          এক সময় কুমু তার শোবার ঘরে ফিরে এসে দেখল তার টিপাইয়ের উপর এক শিশি লজেন্স। হাবলু এটি তার ত্যাগের অর্ঘ্য গোপনে রেখে গেছে। বালকের এই লজেন্সের ভাষায় একসঙ্গে ওকে কাঁদালে হাসালে। কুমু তখন হাবলুকে খুঁজতে বাইরে বেরিয়ে দেখে সে দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ মা তাকে এ ঘরে যাতায়াত করতে বারন করে দিয়েছিল। তাই হাবলু এই ঘর থেকে দূরে দুরেই থাকত। কুমু তখন হাবলুকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে তার কোলে বসাল। কুমু ঘরে গৃহসজ্জার মধ্যে পুতুল স্থানীয় যা কিছু ছিল তা দুজনে নাড়াচাড়া করে খেলতে লাগল। কুমু যখন বুঝতে পারল কাঁচের কাগজ চাপাটির প্রতি হাবলুর খুব কৌতূহল তাই সে তাকে ভালোবেসে ঐ কাগজ চাপাটি দিয়ে দেয়। হাবলু সেটি পেয়ে আহ্লাদ রাখতে না পেরে সেটা নয়েই লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেল। হাবলুর হাতে এই কাগজ চাপাটি দেখে মধুসুদন তা কেড়ে নেয় এবং তাকে চোর অপবাদ দিয়ে মারতেও ছাড়েনি। কুমুকে এই সব কথা মোতির মা জানায়। সে কুমুকে এও জানায় যে হাবলুকে চুরি যে আমি শেখাচ্ছি একথাও ক্রমে উঠবে। মোতির মায়ের মুখে মধুসুদনের এই নিষ্ঠুর আচরণ শুনে কুমু কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে রইল। হঠাৎ মধুসুদন ঘরে আসতেই তা দেখতে পেয়ে মোতির মা চলে গেল। মধুসুদন সেই কাগজ চাপাটি হাতে করে নিয়ে এসে যথাস্থানে রেখে দিল। এরপর নিশ্চিত প্রত্যয়ের কণ্ঠে শান্ত স্বরে বললে – “হাবলু তোমার ঘর থেকে এটা চুরি করে নিয়েছিল। জিনিসপত্র সাবধান করে রাখতে শিখো।”৭৫ মধুসুদন হাবলুকে একপ্রকার চোর বলেই গণ্য করল কিন্তু কুমু তার অভিমতকে স্বীকার করল না। প্রত্যুত্তরে কুমু তাকে জানায় ঐ দ্রব্যটি সে ভালোবেসে হাবলুকে দিয়েছিল। কুমুর এই কথা শুনে মধুসুদন রেগে গিয়ে গর্জন করে বলে- “এমনি করে ওর মাথা খেতে বসেছ বুঝি? একটা কথা মনে রেখো, আমার হুকুম ছাড়া জিনিসপত্র কাউকে দেওয়া চলবে না। আমি এলোমেলো কিছুই ভালবাসি নে।”৭৬ কুমুও রাগের মুখে স্বামীর প্রতিবাদ করে বলে – “তুমি নাও নি আমার নীলার আংটি?”৭৭ স্ত্রীর কথা শুনে মধুসুদন সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নেয়। এইভাবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খুব বাদানুবাদের ফলে তা চরম সীমায় পৌঁছে যায়। এতে তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের জেরে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে যায়। কুমু তখন স্বামীকে বলে- “তাতেও তোমার ঐ কাঁচের ঢেলাটার দাম শোধ হল না?”৭৮ প্রত্যুত্তরে মধুসুদন জানায় – “আমি তো বলেছিলুম, ওটা তুমি রাখতে পারবে না।”৭৯ তখন কুমু রুদ্ধ্বস্বরে বলে – “তোমার জিনিস তুমি রাখতে পারবে, আর আমার জিনিস আমি রাখতে পারব না।?”৮০ স্ত্রীর কথা শুনে মধুসদন দৃঢ় কণ্ঠে জানায় এ বাড়ীতে তোমার স্বতন্ত্র জিনিস বলে কিছু নেই। এই কথা শুনে রেগে গিয়ে কুমু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কুমু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে শ্যামা ঘরে প্রবেশ করে কুমুকে খুঁজতে থাকে। মধুসুদন তখন তাকে খোঁজার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। উত্তরে শ্যামা জানায়- সকাল থেকে ওর খাবার নিয়ে বসে আছি, এ বাড়ীতে এসে বউ কি খাওয়াও বন্ধ করবে? এই কথা শুনে মধুসূদন কুমুর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে। মধুসুদনের স্ত্রীর প্রতি অবহেলা লক্ষ্য করে শ্যামা ভিতরে ভিতরে খুশি হয়েও দেওরকে উপদেশ দিতে ছাড়েনি। শ্যামার এই উপদেশ শুনে মধুসূদন গর্জন করে বলে - “কিছু করতে হবে না, যাও চলে! খিদে পেলে আপনিই খাবে।”৮১ মধুসুদনের এই কথা শুনে শ্যামা যেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে চলে গেল। কারণ শ্যামা চেয়েছিল যে মধুসুদনের সাথে একাকী কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। মধুসুদনের মাথায় রক্ত চড়তে লাগল।

          স্বামীর প্রতি বিমুখ হয়ে কুমু এরপর ভাড়ার ঘরে আশ্রয় নিল। কুমুকে এখানে দেখে মোতির মা অবাক হয়ে গেল। কুমু তাকে বলল - “এ বাড়ীতে আমি সেজবাতি সাফ করব, আর এইখানে আমার স্থান।”৮২ মোতির মা তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত কুমুর জেদের কাছে তার চেষ্টা হার মেনে যায়। তখন মোতির মা তার সাথে শুতে চাইলে কুমু তার সেই আবেদনকে একেবারে অস্বীকার করে। মধুসূদন রাতে শুতে এসে সব খবর শুনল। প্রথমে সে স্ত্রীর অনুপস্থিতিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইল না। তাই সে যখন শুতে গিয়ে দেখল যে কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। প্রত্যেক শব্দেই সে তাই কুমুকে অনুভব করতে লাগল। তার যখন মনে হল যে কুমু দরজার বাইরে দাড়িয়ে আছে তাই সে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেখে কেউ কোথাও নেই। রাত যত বাড়তে থাকে মধুসুদনের মন তত ছটফট করতে থাকে। মধুসুদনের এই অবস্থা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি সে কুমুকে আন্তরিক ভাবে খুব ভালবাসত। বাইরে সে কুমুকে যেমন অবজ্ঞা প্রকাশ করত অন্তরে কিন্তু সে তাকে অবজ্ঞা করতে পারল না। অথচ সে তার নীতির কাছে হার মেনে এগিয়ে গিয়ে কোন কাজ করবে না এটা স্থির করে নিয়েছিল। মধুসূদন তাই পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু তার ঘুম এলো না। রাত যত বাড়তে লাগল তার মন তত ছটফট করতে লাগল। তাই সে উঠে পড়ে তার মনের কৌতূহলকে কিছুতেই সামলাতে পারল না। একটা লণ্ঠন হাতে নিয়ে কুমুর ঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। ঘরের সামনে এসে সে কিছুক্ষণ কান পেতে রইল, কিন্তু ভিতরে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তখন সে অতি সাবধানে দরজা খুলে দেখতে পায় কুমু মেঝের উপর মাদুর পেতে অচেতন ভাবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই মধুসূদন মন খারাপ করে চোরের মত সেখান থেকে পালিয়ে গেল। শ্যামা মধুসূদনকে সবসময় অনুসরণ করত এটা আমরা পূর্বেই জেনেছি। এত রাত্রেও শ্যামার নজর এড়াতে পারেনি মধুসূদন। শ্যামা মধুসূদনকে এত রাত্রে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু মধুসূদন শ্যামাকে এ নিয়ে কোন সদুত্তর দিল না। মধুসুদনের প্রতি একটা দূর্বলতা সবসময় শ্যামার মধ্যে ছিল। তাই শ্যামা একটু হেসে বললে - “আজ ঘুম থেকে উঠেই তোমার মতো ভাগ্যবান পুরুষের মুখ দেখলুম, আমার দিন ভালোই যাবে। ব্রত সফল হবে।”৮৩ শ্যামা এই কথা বলে তার মনের মানুষকে খুশি করতে চায়। মধুসূদন ও কুমু সুখে শান্তিতে সংসার করুক এটা শ্যামা কখনই চাইত না। তাই সে সব সময় তাদের সমস্ত গতিবিধির উপর নজর রাখত। শ্যামা আস্তে আস্তে মধুসূদনকে নিজের দিকে টানতে কিছুটা সফল হতে থাকে। তাই সে প্রাণপণ দিয়ে এই চেষ্টা করতে থাকে। এর জন্য নব দম্পতির জীবনে একটা অশান্তি সবসময় বিরাজ করতে থাকে। যার ফলে তাদের স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে কলহ সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

          মধুসূদন কুমুর ঘর থেকে হতাশ হয়ে এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাইরে লন্ঠনটা রাখলে, যদি কুমু আসে। কুমুর সেই সুপ্ত মুখ ও হাতখানা সে কিছুতেই ভুলতে পারল না। এসব কথা চিন্তা করে তার ঘুম হল না তাই সে উঠে গেল। মধুসূদন আলো জালিয়ে কুমুর ডেস্কের দেরাজ খুললে। তাতে সে একটি ব্যাগ দেখতে পেল। যার ভিতরে বিপ্রদাসের টেলিগ্রামটি দেখে মধুসুদনের মন ঈর্ষায় ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বিপ্রদাসকে মনে মনে লোপ করে দিলে। কুমুর মনে তার দাদার উপস্থিতিকে লুপ্ত করার জন্য মধুসূদন অস্থির হয়ে পড়ে। পুঁতির থলিটি আজ সে ফেলে দিতে পারল না। কারণ কুমু যে সাধারন মেয়ে নয় তা মধুসূদন আজ অনুমান করতে পারে। তাই সে বুঝতে পারে যে তাকে জোর করে কিছু করানো যাবে না। মধুসূদন তাই মনে মনে অনুমান করে - “কুমুদিনীকে নিজের জীবনের সঙ্গে শক্ত বাঁধনে জড়াবার একটা মাত্র রাস্তা আছে, সে কেবল সন্তানের মায়ের রাস্তা।”৮৪ মধুসূদন বুঝতে পারছিল যে আস্তে আস্তে তাদের দাম্পত্য জীবন একেবারে ছিন্ন হতে থাকে, তাই সে সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য এই কথা চিন্তা করে। কুমু যে এখন আর সাধারণ নেই অসাধারণ হয়ে উঠেছে এর জন্য মধুসূদন মোতির মাকেই দায়ী করে। কুমু যেহেতু সবসময় মোতির মায়ের সাথেই আলোচনা করত তাই মধুসুদনের ধারণা তার ইন্ধনেই কুমু এত বাড়বাড়ন্তের অবস্থা দেখা যায়। তাই মধুসূদন রাগের বশে নবীনের কাছে তার স্ত্রীর নামে অভিযোগ করতে পারে। মোতির মা যখনই কুমুকে অকৃত্রিম ভালোবাসার সঙ্গে আদর যত্ন করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল ঠিক তখনই বাড়ীর মেয়েরা এই ঘটনা নিয়ে মধুসূদনকে প্ররোচনা দিতে শুরু করে। মোতির মায়ের বিরুদ্ধে মধুসুদনের অভিযোগ তারই প্রকৃষ্ট ফল বলে অনুমান করা যায়। মধুসুদনের এই অভিযোগের কথা নবীন সঙ্গে সঙ্গে মোতির মাকে জানায় এবং তারা উভয়েই খুব ভয় পেয়ে যায়। কুমু কোন কিছুতেই এখানকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিল না, তাই সে খুব অস্বস্তি বোধ করল। মোতির মা, নবীন, এবং হাবলু ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকেই মনের মণিকোঠায় স্থান দিতে পারে নি। অনেকদিন দাদার চিঠি না পেয়ে কুমু অস্থির হয়ে উঠল। মোতির মা তাকে এই দুঃখ থেকে স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে কুমু মোতির মাকে অনুরোধ করে তার দাদাকে একটি টেলিগ্রাম করে দেবার জন্য। মোতির মা কুমুর এই অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেল। মোতির মা কুমুকে শোবার ঘরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে কুমুর সেই ঘরে কোন অধিকার নেই। কুমুর এই অবনতির কথা চিন্তা করে মোতির মার গিয়ে জানায় যে মধুসুদনের ডেস্কের মধ্যে খোঁজ করতে যে কুমুর কোন চিঠি সেখানে আছে কি? নবীন এই কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেল। উত্তরে মোতির মা জানায় নবীন যদি না যায় তবে সে নিজেই এই কাজটি করবে। নবীন তখন সাহসের সঙ্গে বলে দিনের বেলা অনেক লোক থাকে তাই রাতের বেলা সে এটি দেখে খবর দিতে পারবে। মোতির মা এরপর নবীনকে একখানি টেলিগ্রাম করতে বলে কুমুর দাদাকে। এই কথা শুনে নবীন জানায় যে দাদাকে জানিয়েই তা সে করবে। কিন্তু মোতির মা তার দাদাকে একথা জানাতে নিষেধ করে। নবীন একথা শুনে অবাক হয়ে যায় কারণ এ বাড়ীতে কোন কাজ কর্তাকে ছাড়া করা যায় না। কিন্তু স্ত্রীর কাছে নবীন তর্কে হার মেনে যায় এবং অফিসের দারোয়ানকে দিয়ে টেলিগ্রাম করতে দেয়। কুমুকে নবীনও খুব ভালবাসত। তার জন্যই সে এতবড় দুঃসাহসিক কাজের ভার নিতে পারল।

          কুমু ও মধুসুদনের মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে তাদের দুরত্ব আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। সেই সুযোগে শ্যামা মধুসুদনের সেবাযত্ন করে নিজেকে তার কাছে সর্বস্ব আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কিন্তু মধুসুদনের মনে এখনো কুমুর অবস্থান থাকার জন্য সে শ্যামাকে তেমন ভাবে গ্রাহ্য করল না। কিন্তু শ্যামা আশা ত্যাগ করল না, যথারীতি সেবাযত্ন চালিয়ে গেল। কারণ মধুসুদনের এই ব্যবহারে সে মনে দুঃখ পেয়ে ঈর্ষাতে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। শ্যামা প্রতিদিন মধুসুদনের আহারের সময় কাছে বসে সেবাযত্ন করে। শ্যামা মাঝে মাঝে তাকে কুমুর কথা বলে তার মনোভাব জানার চেষ্টা করে। মধুসূদন কুমুর জন্য অনেক অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু তবুও কুমুকে যে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে পায় না। যার জন্য মধুসুদনের মন আরো বেশি জটিল হতে শুরু করে। মধুসূদন হঠাৎ অফিসে মস্ত একটা জরুরী কাজ করবার ভান করে ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়ল। সামনে একটি খাতা দেখে সে লোকচক্ষুর প্রতারনা করার উদ্দেশ্যে সেটা খুলে বসল। এই খাতাতে তার বাড়ীর সমস্ত চিঠি ও টেলিগ্রাম রওনা হওয়ার দিনক্ষণ লেখা থাকে। খাতা খুলে সে দেখতে পেল যে আজকের তারিখে একটি কুমুর টেলিগ্রাম বিপ্রদাসের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই চিঠি দেখে মধুসূদনের মাথা খুব গরম হয়ে যায়। তাই রেগে গিয়ে তৎক্ষণাৎ দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে এই টেলিগ্রাম কোন ব্যক্তির দ্বারা পাঠানো হয়েছে। দারোয়ান সঙ্গে সঙ্গে নবীনের কথা বললে মধুসূদন তাকে ডাকতে বলে। মধুসূদনের তলব শুনে নবীন পাংশুবর্ণ মুখে এসে হাজির হয়। মধুসুদনের প্রশ্নের কোন উত্তর নবীন দিতে পারল না। কোন উত্তর না পেয়ে মধুসূদন সবেগে হাত নেড়ে নবীনকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করে দেয়।

          নবীন ঘরে গিয়ে মুখ শুকনো করে মোতির মাকে সব কিছু জানিয়ে দিল। নবীন তার স্ত্রীকে বলে যে তাদের এখানে বসবাস আর চলবে না, দাদা তাদের উভয়কেই এখান থেকে বিতাড়িত করবে। এখান থেকে তাদের বিতাড়নের সম্ভবানার কথা আলোচনা করতে থাকে নবীন ও তার স্ত্রী। নবীনের স্ত্রী এরপর স্বামীকে কর্তাবাবুর দেরাজ সন্ধান করতে বলে। মোতির মায়ের একথা শুনে নবীন চমকে যায়। তাই ভয়ের সঙ্গে সে হাত জোড় করে বলল - “দোহাই তোমার মেজোবউ–সাপের গর্তে হাতি দিতে যদি বলতে আমি দিতুম, কিন্তু দেরাজে না।”৮৫ নবীনের এই কথার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি সে তার দাদাকে অন্তর থেকে কতটা ভয় করত। তাই এই দুঃসাহাসিক কাজ করতে রাজী হল না। কিন্তু মোতির মা তার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে তার জেদের মধ্যেই স্থির হয়ে রইল। সে অনুমান করে যে এই দেরাজের মধ্যে কুমুর চিঠি বিদ্যমান আছে। স্ত্রীর কথাকে নবীন সম্পূর্ণ সমর্থন করে কিন্তু তার অন্তরে যে ভয় তা কিন্তু থেকেই যায়। কিন্তু তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার জন্যই নবীন এই দুঃসাহসিক কাজ করতে রাজী হয়। সেই রাত্রেই নবীনের কাছে মোতির মা খবর পায় যে কুমুর নামে একটা চিঠি ও একটা টেলিগ্রাম দেরাজে আছে। মোতির মা এই খবর পেয়ে আত্মদহনে দগ্ধ হতে লাগল। কারণ সে কুমুর দুরাবস্থার কথা চিন্তা করতে লাগল। এই গোপন ব্যাপারটি জানতে পেরে কুমু মধুসূদনের প্রতি সমস্ত আশা আখাঙ্খা ত্যাগ করে। সে জানতে পারে যে স্বামী তাকে শত্রুর চেয়ে বেশি ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখে। তাই তার মন একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তার এই অপমান যে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।

          কুমুর প্রতি মধুসূদনের এই কঠোর আচরণ দেখে কুমু চিন্তা করতে থাকে যে ঐ অপমান নিয়ে তার সারাজীবন এভাবে থাকা সম্ভব নয়। কঠিন দায়বশতঃ তাই কুমু পন করল যে তার মনের মধ্যে কিছুতেই সে আর পুনরায় আগুন জ্বলতে দেব না। তাই সে আজ নিজের মনকে স্থির করে পরবর্তীকালে সে সংসার ধর্মের সত্যপথে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ব্রতী করবে। এই জন্যই কুমু দরজা বন্ধ করে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে লাগল। তার এই কাজে সবচেয়ে সহায় হল তার দাদার উপদেশের কথা। তাই কুমু তার দাদার কাছ থেকে ধৈর্যের আশ্চর্য গভীরতা থেকেই শিক্ষা লাভ করতে চেষ্টা করল। কুমু নিজের মনকে একাগ্রতা করার জন্য সেই দুপুরে পুরো উপবাসী থেকে গেল। এরপর কুমু তার ঠাকুরের বিগ্রহ মূর্তিকে অন্তরের মধ্যে বসিয়ে ছাদের এককোণে গিয়ে আসন পেতে বসল। কুমু তার ঠাকুরের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বলতে পারে - “ঠাকুর, আর কখনো যেন তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ না ঘটে; তুমি আমাকে কাঁদিয়ে তোমার আপন করে রাখো।”৮৬ কুমুর এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে সে নিজেকে পূর্বের থেকে অনেকখানি সংযত করতে পেরেছে। অনেকদিন দাদার কোন সংবাদ না পেয়ে কুমুর মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। এমনি করে একদিকে অভিমানের বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মুক্তির আনন্দ, অন্যদিকে দাদার জন্য ভবনার পীড়িত হৃদয়ের ভার, দুইই একসঙ্গে নিয়ে আবার তার সেই কোটরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে। তার পাঠানো টেলিগ্রামের কোন উত্তর না পেয়ে কুমুর মন রহস্যে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ে। স্বামীর প্রতি কোন অধিকার দেখাতে না পেরে কুমু নিজেকে বারবার ধিক্কার দিতে লাগল। এদিকে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় না থাকার জন্য মধুসূদন তার ব্যবসার কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ল। কুমুর অস্তিত্বকে মধুসূদন তার মনে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারল না। তাই শোবার সময় বিছানায় যাবার আগে কুমুর জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু অনেক রাত্রি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কুমুর দেখা না পেয়ে মধুসূদন নিজেকে লজ্জিত বোধ করল। কুমুর এই সাহসের জন্য মধুসূদন মেজো বউ মোতির মাকেই সন্দেহ করে। তাই মধুসূদন রেগে গিয়ে গর্জনের সঙ্গে নবীনকে জানায় যে মেজো বউকে এখান থেকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। উত্তরে নবীন জানায় মেজো বউ তাতে সম্মত আছে। নবীনের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ মধুসূদন পুনরায় জানায় যে মেজোবউ এখান থেকে দেশে যেতে পারবে না। মধুসূদন নবীনকে বলে যে তার নাম করে বলতে এখন তার এখান থেকে যাওয়া চলবে না। যখন সময় বুঝব তখন যাবার দিন আমিই ঠিক করে দেব। নবীন দাদার পূর্বের কথা উল্লেখ করলে তা শুনে মধুসূদন রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দাদার উত্তেজিত অবস্থা দেখে নবীন ভয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

          রাত্রিবেলায় কুমুর চিন্তায় মধুসূদনের ঘুম হল না। তাই সে লণ্ঠন হাতে নিয়ে মধ্য রাত্রিতে কুমুর ঘরে যায়। কুমুর প্রতি সে খুব অন্যায় করছে একথা বারবার মনে করে মধুসূদন আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকে। এরদ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি যে স্থূল চরিত্রের মধুসূদনের কঠিন হৃদয়ের মধ্যে একটা তরতাজা মায়া-মমতা-ভালোবাসার অস্তিত্ব বর্তমান। এইজন্যই সে মধ্যরাত্রিতে ছুটে যায় কুমুর কাছে। মধুসূদন প্রথমে স্থির করল কুমুর অজ্ঞাতেই সে সারারাত তার পাশে জেগে বসে থাকবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না। মধুসূদন কুমুর বুকের উপর থেকে হাতটি সরিয়ে নিতেই সঙ্গে সঙ্গে কুমু পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মধুসূদন আর ধৈর্য ধরতে না পেরে কুমুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল - “বড়োবউ তোমার দাদার টেলিগ্রাম এসেছে।”৮৭ এই কথা শুনে কুমু দ্রুত ঘুম থেকে উঠে বসল এবং বিস্মিত চোখ মেলে মধুসূদনের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। স্বামীর কাছ থেকে টেলিগ্রামটি নিয়ে কুমু সঙ্গে সঙ্গে পড়তে লাগল। কুমু এরপর জিজ্ঞাসা করল যে দাদার কোন চিঠি এসেছে কি? উত্তরে মধুসুদন জানায় যে কোন চিঠি আসেনি। মধুসূদনের এই মিথ্যা কথা বলার কারণ হল যে কুমুর মনে তার দাদার অস্ত্বিত্বের লোপ। স্বামী স্ত্রী এই মধ্যরাত্রে এই ঘরে কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ কুমুর সংকোচ বোধ হল। কুমু যখন উঠব উঠব বোধ করছে তখন মধুসূদন হঠাৎ বলে উঠল - “বড়োবউ আমার উপর রাগ কোরো না।”৮৮ কুমু কোন উত্তর না দেওয়ার জন্য মধুসূদন পুনরায় বলে - “তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ?”৮৯ কুমু তখন উত্তরে জানায় যে কোন রাগ করে নি। মধুসূদনের এই আচরণ দেখে কুমু আশ্চর্য হয়ে যায়। এটাকে যে দৈব্যের বানী বলে মনে করতে থাকে। কুমুর মনে হল যে ঠাকুর হয়তো প্রার্থনায় রাজী হয়েছে। তাই নিজেকে আনন্দে আর নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। মধুসূদন এরপর কুমুকে ঘরে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কুমু তাতে রাজী হয়ে স্বামীর সাথে ঘরে যায়। কুমু ও মধুসূদনের জীবনের এই পর্যন্ত এই সময়টাকে আমরা একটা মিলনের দৃশ্য অনুভব করতে পারি। তারা নিজেদের মনের সমস্ত দ্বন্দ্ব ভুলে মনকে সূচিকা করে একে অপরের স্নেহে আবদ্ধ হয়ে যায়। কুমু মন দিয়ে সুখে শান্তিতে স্বামীর সাথে থাকার জন্য মনকে তৈরি করতে লাগল। তাই কুমু মোতির মায়ের সাথে সংসারের নানারকম কাজে সহায়তা করতে লাগল। কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য জীবন সুখের দেখে শ্যামার গাত্রজ্বালা শুরু হয়ে গেল। কুমু আনন্দের সঙ্গে মোতির মাকে জানায় কালরাত্রে মধুসূদন তাকে দাদার দেওয়া টেলিগ্রাম দেয়। কুমুর এই কথা শুনে মোতির মা কুমকে তার দাদার একটি চিঠির কথাও জানায় যা মধুসূদনের কাছে আছে। কুমু এই কথা বুঝতে পারে যে তার স্বামী এই চিঠির কথা গোপন করেছে। কুমু তখন মোতির মাকে এই চিঠি তার কাছে এনে দিতে অনুরোধ করে। উত্তরে মোতির মা জানায় সেই চিঠি মধুসূদনের দেরাজে আছে, তাই সেখান থেকে বের করা খুব সহজ কাজ নয়। মধুসূদনের এই চিঠির গোপনীয়তাকে কুমু ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই সে আবার স্বামীর প্রতি পুনরায় বিরূপ হয়ে যায়। মোতির মা হয়ত যদি কুমুকে এই খবর না জানাত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবন কিছুদিন সুখের হতে পারত। কিন্তু এই কথা শুনে কুমু তার স্বামীর প্রতি আর বিশ্বাস রাখতে পারল না। তাই তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে শুরু করল। মোতির মা কুমুকে জানায় যে মধুসূদন যখন অফিসে থাকবে সেই সময় গোপনে কুমু গিয়ে যেন তার দাদার চিঠি দেখে নেয়। এই কথা কুমু রাগে গর্জন করে বলতে থাকে - “নিজের চিঠিও কি চুরি করে পড়তে হবে?”৯০

          এতসব ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও কুমু নিজের রাগকে সংযত করার চেষ্টা করল। তাই ছাদে গিয়ে একটি গানকে বারবার গেয়ে মনকে স্থির করতে লাগল। কুমু হঠাৎ একদিন সকলের সামনেই মধুসূদনের দেরাজে গিয়ে তার দাদার চিঠি পড়তে লাগল। ঠিক সেই সময় কুমুকে এ স্থানে দেখে মধুসূদন অবাক হয়ে গেল। মধুসূদন তাকে এখানে আসার কারণ জানতে চাইল। উত্তরে কুমু জানায় তার দাদার চিঠির খোঁজ নিতেই সে এখানে এসেছে। মধুসূদন তখন বিড়ম্বিত হয়ে জানায় – “এ চিঠি আমিই তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলুম, সেই জন্য তোমার এখানে আসবার তো দরকার ছিল না।”৯১ কুমু একটুখানি চুপ থেকে মনকে শান্ত করে বলল - “এ চিঠি তুমি আমাকে পড়তে দিতে ইচ্ছে কর নি, সেজন্য এ চিঠি আমি পড়ব না। এই আমি ছিঁড়ে ফেললুম। কিন্তু এমন কষ্ট আমাকে আর কখনো দিয়ো না। এর চেয়ে কষ্ট আমার আর কিছু হতে পারে না।”৯২ এই কথা বলে কুমু মুখে কাপড় দিয়ে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল। মধুসূদনের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল আজ দুপুরে কুমুর সাথে সে অনেক কথা বলবে এবং তাকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে। কিন্তু এই চিঠিকে কেন্দ্র করে তার সেই আশা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়। পালের নৌকায় হঠাৎ পাল কেটে গেলে তার যে দশা হয় ঠিক সেইরকমই দশা এখন মধুসূদনের। তাই সে বেশি দেরি না করে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি অফিসে চলে গেল। অফিসে গিয়েও সে চিন্তা থেকে মুক্তি পেল না তাই কোন কাজ করতে না পেরে আজ অনেক আগেই অফিস থেকে বাড়ী ফিরে এল।

          সমস্ত ঘটনা শুনে নবীন ও মোতির মা বুঝতে পারল যে এবারে তাদের ভিত গেল ভেঙ্গে। তাই পালিয়ে বাঁচবার আশ্রয় তাদের আর কোথায় পাওয়া গেল না। এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে মোতির মায়ের কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু কুমুর কথা চিন্তা করে তার মন বিচলিত হয়ে উঠল। নবীন তার স্ত্রীকে জানায় যে তার দাদা এমন সুন্দর বউ ঘরে পেয়ে তাকে ঠিকমতো রাখতে পারল না, সমস্ত নষ্ট করে দিলে, ভালো জিনিসের ভাঙ্গা টুকরো দিয়েই অলক্ষ্মী বাসা বাঁধে। স্বামীর কথা শুনে মোতির মা বললে – “সে কথা তোমার দাদার বুঝতে দেরি হবে না। কিন্তু তখন ভাঙা আর জোড়া লাগবে না।”৯৩ মধুসূদন এরপর নবীনকে আবার তলব করল। সঙ্গে সঙ্গেই নবীন ও মোতির মা তার কাছে গেল। মধুসূদন জানতে চাইল কুমু কিভাবে তার দাদার চিঠির সন্ধান পেল? নবীন সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে জানায় এই খবর সে নিজেই দিয়েছে। নবীনের এই কথা শুনে মধুসূদন রাগে গর্জন করে বলে – “হঠাৎ তোমার এত সাহস বেড়ে উঠল কোথা থেকে?”৯৪ মধুসূদন এরপর তাদেরকে আদেশ দেয় যাতে তারা কাল সকালের ট্রেনেই দেশে চলে যায়। দাদার কথাতে সম্মত হয়ে নবীন সেখান থেকে চলে যায়। নবীন ও মোতির মায়ের শাস্তির খবর শুনে কুমু নিজেকে আত্মধিক্কার দিতে লাগল। কারণ সে জানত যে তার জন্যই আজ তাদের এই শাস্তির বিধান। তাই কুমু নিজেও তাদের সাথে রজবপুরে যাওয়ার জন্য জিনিসপত্র গোছাতে থাকে। কুমুর এই আচরণে মধুসূদন অবাক হয়ে যায়। মধুসূদন তখন সন্দেহ করে যে মোতির মা ও নবীন তাকে সঙ্গে যাবার জন্য খেপিয়ে তুলেছে। তাই মধুসূদন নবীনকে এইজন্য খুব ধমক দেন। নবীন কিন্তু দাদার কথায় আর কোন নরম মনোভাব না দেখিয়ে জোর গলায় জানায় - “বড়োবউরানীকে খেপাবার জন্যে সংসারে আর কারও দরকার হবে না, তুমি একাই পারবে। আমরা থাকলে তবু যদি বা কিছু ঠাণ্ডা রাখতে পারতুম, কিন্তু সে তোমার সইল না।”৯৫ এই কথা শুনে মধুসূদন রেগে তার ধারণাতেই স্থির থাকল। দুই ভাইয়ের মধ্যে এই নিয়ে খুব বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হল। মোতির মা এইসব কথা শুনে যখন কুমুর কাছে গেল তখন কুমু তাকে তাদের সঙ্গে রজবপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। মোতির মা বারবার কুমুকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কুমু কিন্তু তাদের সাথে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠল। শেষমেষ মোতির মা কুমুর কাছে হার মেনে নিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজী হয়ে গেল। মোতির মা ও কুমু একসাথে যখন কাপড় গোছাতে লাগল তখন হঠাৎ সেই ঘরে মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটে। মধুসূদন এসে কুমুকে হুকুম করে জানায় তার যাওয়া হবে না। কুমু সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর এই হুকুম স্বীকার করে নিল।

          মধুসূদন কুমুকে ভালোবেসে আংটি দিতে চাইলে কুমু তা নিতে অস্বীকার করে বলে - “আমার যে-আংটির দরকার ছিল সে তুমি পরতে বারণ করেছ, আর আমার আংটির দরকার নেই।”৯৬ কিন্তু কিছু পরে স্বামীর হুকুমের জেরে কুমু তিনটি আংটি পরতে রাজী হয় এবং মধুসূদন সেগুলি তাকে পরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর মধুসূদন ভেবে পেল না কি বলবে। তাই হঠাৎ তার মুখ লাল হয়ে উঠল এবং ধিক্কার দিয়ে কুমুকে বলে - আচ্ছা যাও। আবার রেগে বলল - “দাও আংটি গুলো ফিরিয়ে দাও।”৯৭ কুমু তৎক্ষণাৎ আংটি গুলি খুলে রেখে দিয়ে চলে গেলো। এতদিন মধুসূদনের জীবনযাত্রার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল কিন্তু বর্তমানে তার জীবনযাত্রায় হঠাৎ একটা অনিশ্চয়তা এসে সব গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছে। অফিস থেকে এসে বাড়ীতে রাত্রিটা যে কি করে কাটাবে তা সম্পূর্ণ তার কাছে অনিশ্চিত হয়ে যায়। রাত্রে মধুসূদন খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চিন্তায় কিছুতেই মধুসূদনের ঘুম আসতে চাইল না। রাত্রি যতই বাড়তে লাগল ততই মধুসূদনের ভিতরকার উপবাসী জীবটা অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে লাগল। মধুসূদন নিজেকে খুব একাকীত্বের সংকটে ভুগছিলেন। তাই মধুসূদন মধ্য রাত্রিতে কুমুর ঘরের দিকে গেল। সেখানে গিয়ে দরজা থেকে ভিতরে দুজন মহিলার আলাপ- আলোচনা শুনেই ফিরে গেল। সেখান থেকে যখন মধুসূদন ফিরছিল ঠিক তখনই তার নজরে পড়ে শ্যামাসুন্দরীকে। এত রাত্রে এখানে সে কি করছে একথা মধুসূদন শ্যামাকে জিজ্ঞাসা করে। শ্যামা উত্তরে জানায় যে তার পায়ের শব্দ শুনেই সে এখানে আসে। শ্যামার এই কথা শুনে মধুসূদন গর্জন করে বলে- “আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ো না, সাবধান করে দিচ্ছি। যাও শুতে।”৯৮ শ্যামা কয়দিন ধীরে ধীরে একটু একটু করে তার সাহসের ক্ষেত্র বাড়িয়ে চলেছিল। কিন্তু মধুসূদনের আজকের ভৎর্সনা শুনে সে অনুমান করল সে ভুল জায়গায় পা রেখেছে। শ্যামা তখন মধুসূদনকে কটাক্ষপাত করে চলে গেল। মধুসূদন এরপর ধৈর্য ধরতে না পেরে নবীনকে দিয়ে কুমুকে তার ঘরে তলব করে। কুমু তার ঘরে প্রবেশ করলে মধুসূদন তার কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করে। তাই মধুসূদন আর্তকণ্ঠে বলতে পারে –“আমাকে মাপ করো, আমি দোষ করেছি।”৯৯ মধুসূদনের এই অপ্রত্যাশিত মিনতি দেখে কুমু অবাক হয়ে যায়। মধুসূদন তখন স্ত্রীকে খুশি করার জন্য জানায় যে নবীন ও মোতির মাকে এবাড়ী ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না। তারা দুজন এবাড়ীতে তোমার সাথেই থাকবে।

          মধুসূদন সিন্ধান্ত নিয়েছিল যে নিজের মান খর্ব করেও কুমুর মান ভাঙাবার চেষ্টা করবে। স্বামীর এই কথা শুনে কুমু কোন উত্তর দিতে পারল না, বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। মধুসূদন হঠাৎ নবীন ও মোতির মাকে তার কাছে নিয়ে এসে তাদেরকে এ বাড়ীতে থাকার জন্য সব ঠিক করে ফেলল। নিজের সমস্ত আদর্শকে খর্ব করে মধুসূদন স্ত্রীকে খুশি করার চেষ্টা করল। মধুসূদন এরপর কুমুকে শোবার জন্য বিছানায় যেতে বললে কুমু জানায় তার মন এখনো তৈরি হয়নি তাই তার মন তৈরি হতে কিছু সময় প্রয়োজন। কুমুর এই কথা শুনে মধুসূদন প্রচণ্ড রেগে যায়। তাই মধুসূদন গর্জন করে বলতে পারে - “তুমি বলতে চাও, আমাকে তোমার ভালো লাগছে না।”১০০ মধুসূদন তখন কুমুকে জানায় যে তার দাদার কথাতেই সে এমন অবাধ্য হয়েছে। মধুসূদনের এই কথা শুনে কুমুর মনে ভীষণ রাগ হয়। তাই এই সময় তাদের উভয়ের মধ্যে নানারকম তর্কাতর্কিতে দুজনেই হতাশ হয়ে পড়ে। কুমুদিনী বিছানাতে না এসে ঘরের মধ্যেই দাড়িয়ে রইল। তখন মধুসূদন কুমুকে জিজ্ঞাসা করে – “বড়ো বউ, তোমার মন কি পাথরে গড়া?”১০১ কুমুর কোন উত্তর না পেয়ে মধুসূদন আবার কুমুকে বলে - “আমি তোমার অযোগ্য, কিন্তু আমাকে কি দয়া করবে না?”১০২ মধুসূদনের এই কথা শুনে কুমু লজ্জিত হয়ে স্বামীর পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইল। মধুসূদন তখন তাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে বুকে ধরে বলল – “না, তোমাকে আদেশ করব না, তুমি আপন ইচ্ছাতে আমার কাছে এসো।”১০৩ মধুসূদন বুঝতে পেরেছিল যে গায়ের জোরে কুমুর ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব নয়, তাই সে কুমুকে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিল। মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে একটা মেলবন্ধন আমরা পুনরায় লক্ষ্য করলাম। মধুসূদন এরপর কুমুর বাপের বাড়ীর শাড়ি গায়ে দেখে তার মনটা ভেঙ্গে গেল। তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমুকে শুতে যেতে বলে নিজে সোফায় বসে থাকল। কুমু এরপর ঠাকুরের উপর অভিমান করে। তাই সে নিজের অশুচিতা বা অসতীত্বের জন্য আজ তার প্রতি ভক্তি জাগল না। কুমু তাই বিদ্রোহিণী মনে বলতে পারে - “তোমাকে আমি সহ্য করব কি করে? কোন লজ্জায় আনব তোমার পূজা? তোমার ভক্তকে নিজে না গ্রহণ করে তাকে বিক্রি করে দিলে কোন দাসীর হাটে-যে হাটে মাছ মাংসের দরে মেয়ে বিক্রি হয়, যেখানে নির্মাল্য নেবার জন্যে কেউ শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজার অপেক্ষা করে না, ছাগলকে দিয়ে ফুলের বন মুড়িয়ে খাইয়ে দেয়।”১০৪ কুমুর এই প্রতিবাদী ভাবনায় আমরা বুঝতে পারি যে মধুসূদনের কামনা বাসনা ভরা মানসিকতাকে সে ভালো চোখে নেয় নি। কুমুর মনে মধুসূদনের যে ক্ষুদ্রখানি ভালোবাসা জমেছিল তা অকালে নষ্ট হয়ে গেল।

          কুমুর এই দুর্যোগ ভরা সময়ে শ্যামাসুন্দরী সুযোগ পেয়ে টিপ্পনী কাটতে থাকে। শ্যামা কুমুকে তার দাদার আসার খবর শুনিয়ে কুমুর মনকে বিহ্বল করে তোলে। শ্যামা এটা জাহির করতে চায় যে সে মধুসূদনের কত কাছের মানুষ। শ্যামা যখন জানতে পারল যে কুমু এই খবর জানে না তখন সে তার মনকে উসকিয়ে নানারকম কথা বলতে লাগল। কুমু এইসব কথা শুনে মধুসূদনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল। কুমু তখন হাবলুকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইল। কুমুর কাছে হাবলুর উপস্থিতিটাও মধুসূদনের চোখে সহ্য হল না। মধুসূদনের এই আচরণে কুমু মনে মনে খুব দুঃখিত হল। মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে এই নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব দেখা গেল। হাবলুর দেওয়া সাধারন একটি কাগজের মোড়ক নিয়েও তাদের উভয়ের মধ্যে অনেক তর্কাতর্কি হতে দেখা যায়। মধুসূদন সন্দেহ করে যে এই মোড়কটি কুমুর দাদা গোপনে তাকে পাঠিয়েছে। কুমু এই মোড়কটির সন্ধানের খবর মধুসূদনকে না জানালে মধুসূদন রাগে গর্জন করে উঠে। মধুসূদন তখন কুমুকে রুঢ় কণ্ঠে বলে – “এ তোমাদের নুরনগরি চাল, দাদার ইস্কুলে শেখা।”১০৫ মধুসূদন যখন জানতে পারল যে এই মোড়কটি হাবলু কুমুকে দিয়েছিল তখন সে নিজেকে লজ্জিত বোধ করল। মধুসূদন তারপর কুমুর হাত চেপে ধরে ঝাকানি দিয়ে বলল – “অসহ্য তোমার বাড়াবাড়ি।”১০৬ মধুসূদনের এই কথা শুনে কুমু রাগে লাল হয়ে গেল। কুমুর সাথে দ্বন্দ্বের ফলে মধুসূদনের নিজের অফিসের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কুমুর কাছে তার জীবন অতিবাহিত করা দুঃসহ হয়ে উঠল। এমন সময় শ্যামাসুন্দরী এসে কুমুকে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে কটাক্ষ করে এবং তাকে পরামর্শ দিতেও ভুলে না । কুমু এসব সহ্য করতে না পেরে নবীন ও মোতির মায়ের কাছে চলে যায়। সেখানে গিয়ে কুমু জানতে পারে যে তার দাদা কাল সত্যিই আসছে। দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কুমু চিন্তা ভাবনা করতে থাকলে নবীন তাকে আশ্বস্ত করে জানায় যে তার সব ব্যবস্থা সে করে দেবে। মধুসূদন কুমুকে আর সহ্য করতে পারল না। হঠাৎ মধুসূদন জ্যোতিষীর কাছ থেকে এসে কুমুর প্রতি তার মন সম্পূর্ণ কোমল হয়ে গেল। কুমুকে সে ঘরের লক্ষ্মী ভাবতে শুরু করল। আজ দাদার সাথে দেখা করার জন্য কুমুর মন একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল। কুমু খুব দয়ালু বশত মুরলী বেহারাকে একটি গরম জামা দান করে। মধুসূদন কুমুকে আবার পূর্বের মতো ভালোবাসার চেষ্টা করে। তাই তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কিছুটা হলেও মধুর হতে দেখা যায়।

          শ্যামাসুন্দরী মধুসূদনকে কাছে পাবার জন্য মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করলেও কিন্তু তাতে মধুসূদন বিরক্তিভাব দেখায়। ফলে শ্যামাসুন্দরীর মধ্যে প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতার সৃষ্টি হয়। মধুসূদন কুমুকে খুশি করার জন্য তার দাদার দেওয়া নীলার আংটিটি হাতে পরিয়ে দেয়। মধুসূদন এরপর কুমুর হাতে চুমু খেয়ে বলে – “ভুল করেছিলুম তোমার হাতের আংটি খুলে নিয়ে। তোমার হাতে কোনো জহরতে কোনো দোষ নেই।”১০৭ মধুসূদনের এই কথা শুনে শুধু কুমু নয় আমাদেরকেও অবাক করে দেয়। মধুসুদন কুমুকে তার বাপের বাড়ীর কালুদার সাথে দেখা করার জন্য বলে। কালুদার সাথে সাক্ষাৎ করে দাদার কথা শোনে কুমুর মনটা দাদার জন্য ছটফট করে উঠল। বাপের বাড়ীর স্মৃতিতে ভরে ওঠে তার মন। কুমু যখন বুঝতে পারল যে সে স্বামীর উপযোগী হতে পারছে না, তখন তাই সে বলতে পারে - “আমাকে তোমার করে নাও-হুকুম করো, শাস্তি দাও। আমার মনে হয় আমি তোমার যোগ্য নই।”১০৮ কুমুর মন ফিরে পাবার জন্য মধুসূদন কুমুর দাদার কাছ থেকে পাওয়া তার এসরাজটি এনে দেয়। এই ঘটনা থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে মধুসূদন কুমুর মন পাওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। মধুসূদন কুমুর এসরাজের বাজনা শুনে খুশি হয়ে কুমুকে কিছু দিতে চাইল। মধুসূদনের কাছে এতবড় সুযোগ পেয়ে কুমু মুরলী বেহারাকে শীতের কাপড় দিতে চায়। কুমুর কাছে এই কথা শুনে মধুসূদন অবাক হয়ে যায়। মধুসূদনের মন যদিও একটু আত্মত্যাগের ঢেউ উঠেছিল কিন্তু সামান্য বেহারার জন্য তুচ্ছ প্রার্থনায় ঠেকে গিয়ে আবার তলায় নেমে গেল।এই ঘটনার পর তাদের দুজনের মধ্যে সহজে কথাবার্তা বলা অসাধ্য হয়ে গেল। কুমুর কাছে উত্তেজনার কথা শুনে মোতির মায়ের ভয় লাগতে লাগল। কুমু এরপর প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়ল। মধুসূদনের ব্যবসা সব লণ্ডভণ্ড হতে লাগল। কিন্তু তাতে মধুসূদন খুব একটা মন দিতে পারল না। অফিসের কাজের ব্যস্ততায় কুমুকে তার দাদার চিঠি সে দিতে ভুলে যায়। কুমু যখন সেই চিঠি নবীনের কাছে পায় তখন দেখা গেল যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মধুসূদনের এই আচরণে কুমুর মন ভেঙ্গে যায়। তাই মধুসূদনকে সে ঘৃণার চোখে দেখতে লাগল। সে মনে মনে নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে লাগল। কুমু এই সংকটজনক অবস্থায় নিজের দাদাকেও ভুল বুঝতে লাগল। নবীন ও মোতির মা কুমুকে এই ভুল শোধরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করল। নবীনের কথা শুনে কুমু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে নিজেকে আরাম বোধ করল। দাদাকে ক্ষণকালের জন্য ভুল বোঝার জন্য কুমু নিজের উপর ধিক্কার দিল। নবীন কুমুকে তার দাদার কাছে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে কুমু প্রথমে তা অস্বীকার করে। কিন্তু নবীন নাছোড়বান্দা হয়ে কুমুকে শেষ পর্যন্ত তাতে রাজী করায়।

          রাত্রে মধুসূদন বাড়ী ফিরে অফিসের কাজে ব্যাস্ত থাকার সময় নবীন হঠাৎ গিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়। নবীন দাদাকে তার কাজে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলে মধুসূদন তা অস্বীকার করে। নবীন নানারকম কথাবার্তা বলে দাদার মনকে সহজ সরল করার চেষ্টা করতে লাগল। নবীন এরপর কুমুর বাপের বাড়ী যাওয়ার কথাটা মধুসূদনের কাছে পেশ করে। মধুসূদন এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাতে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়ে দেয়। নবীন এই সম্মতি আদায় করে খুশি হয়ে চলে যায়। কুমুকে তার দাদার কাছে চাওয়ার জন্য নবীনকেই সব দায়িত্ব দিয়ে দেয় মধুসূদন। রাত্রি যখন বাড়তে লাগল তখন মধুসূদনের কাজে বিরক্তি লাগল এবং মনে মনে কুমুর কাছে যেতে চাইল। তাই কাজ রেখে দিয়ে মধুসূদন শোবার ঘরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে সে দেখে কুমু তখন ঘুমোচ্ছে। মধুসূদন প্রথমে একটা আওয়াজ করাতেই কুমু হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে চমকে উঠে বসল। মধুসূদনকে দেখে কুমু বিস্মিত হল কারণ আজ তার এখানে আসার কোন কথা ছিল না। কুমুর ভাব দেখে মধুসূদন খুব রেগে গিয়ে বলে – “আমাকে কোনমতেই সইতে পারছ না, না?”১০৯ স্বামীর এ হেন কথা শুনে কুমু কোন উত্তর দিতে পারল না। মধুসূদন এরপর কুমুর দাদার প্রসঙ্গ তুলে তুলোধনা করতে লাগল। দাদার নাম শুনেই কুমু শক্ত হয়ে উঠল। কুমু জানায় যে তার দাদার কাছে সে যেতে চায়নি এবং এর জন্য সে কারো কাছে দরবার করতেও বলেনি। কুমু ও মধুসুদনের বাকবিতণ্ডা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। কুমুও আর অত সহজে মধুসূদনকে ছেড়ে দেয় না। কুমু সবচাইতে বেশি আঘাত পায় যখন মধুসূদন তাকে বিছানায় শোবার অধিকারের কথা বলে অপমান করে। এই কথা শোনে কুমু তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে চলে যায়। মধুসূদন তখন ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় শ্যামাসুন্দরীকেই শিকার করে নেয়। শ্যামার এতদিনের চেষ্টা সফল হয়ে যায়। মধুসূদন ও শ্যামার মিলনের দৃশ্য নবীন ও মোতির মায়ের চোখকে এড়িয়ে গেল না। তাই পরের দিন যখন কুমু বাপের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন নবীন ও তার স্ত্রী মনে করেছিল যে এইসময় কুমুর চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা। নবীন তাই কুমুকে তাড়াতাড়ি বাপের বাড়ী থেকে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করে। কুমু রাগে, দুঃখে, অপমানে, ঘৃণায় বাড়ী ছেড়ে দাদার কাছে চলে গেল। মধুসূদনের আদেশ ছিল যতদিন না সে ডেকে পাঠায় ততদিন কুমুর ফিরে আসার দরকার নেই।

          কুমু চলে যাবার পর মধুসূদন ও শ্যামাসুন্দরীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। এই দেখে শ্যামাও একটু একটু করে মধুসূদনের কাছে এগোতে লাগল। তারমধ্যে কোন সংযমবোধ কাজ করল না। মধুসূদন শ্যামাকে নিজের স্থান দিতে কোন কুণ্ঠাবোধ করল না। মধুসূদন ও শ্যামার এইসব কাণ্ড দেখে বাড়ীর সমস্ত কর্মচারীরা অবাক হয়ে গেল। মধুসূদন শ্যামাকে নিজের বিছানায় স্থান দিতেও কোন কুণ্ঠাবোধ করল না। নবীন ও মোতির মা এই দেখে চিন্তা করল যে এইসময় কুমুকে ডেকে না আনলে এবার আর ঠেকানো যাবে না। নবীন ও মোতির মা কুমুকে বাপের বাড়ীতে দেখতে গিয়ে বাড়ীর এই সমস্ত ঘটনা সব বিস্তারিত ভাবে জানিয়ে দেয়। মধুসূদন ও শ্যামার এই সম্পর্কের কথা শুনে কুমু একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তাই স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা একেবারেই লুপ্ত হয়ে যায়। বিপ্রদাস যখন মধুসূদনের এইসব নোংরামির খবর শুনে তখন সেও বিদ্রোহে গর্জন করে কুমুকে তার স্বামীর কাছে যেতে নিষেধ করে দেয়। কুমুর এই সংকটজনক অবস্থায় দাদা বিপ্রদাস তাকে বিদ্রোহের জন্য উজ্জীবিত করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জানা যায় যে কুমু সন্তানসম্ভবা। এরফলেই কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য বিচ্ছেদ কেটে গিয়ে তাদের মিলন সংযোগ তৈরি হয়। অর্চনা মজুমদারের মতে – “সন্তান জন্মের পর মধুসূদনের সন্তানকে মধুসূদনের হাতেই তুলে দেবে বলে কুমুদিনী তার বিরূপ মন নিয়ে মধুসূদনের বাড়ীতে ফিরে এল।”১১০ সন্তানের জন্যই কুমু ও মধুসুদন তাদের বিরূপ মানসিকতাকে ছিন্ন করে মিলন মাধুর্যে মিশে যায়।









তথ্যসূত্র

৩১. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৩৭৩

৩২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৭৩

৩৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৭৫

৩৪. রবীন্দ্র রচনাবলী (নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯,দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৩৭৫

৩৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৮৬

৩৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৮৮

৩৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৮৮

৩৮. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯১

৩৯. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯১

৪০. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯১

৪১. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৩

৪২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৮

৪৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৮

৪৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৯

৪৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪০০

৪৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪০১

৪৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪০২

৪৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪০২

৪৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪০২

৫০. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৩

৫১. রবীন্দ্র রচনাবলী (নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯,দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪০৪

৫২. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৪

৫৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৫

৫৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৫-৪০৬

৫৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৬০. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৯

৬১. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৯

৬২. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৭০. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৭১. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড), সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯, প্রথম আনন্দ সংস্করণ জানুয়ারি-১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৩৬৭-৩৬৮

৭২. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪১২

৭৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪১২

৭৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪১২

৭৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৭. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮০. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮১. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮২. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৪

৮৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৫

৮৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪২১

৮৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৩

৮৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৫

৮৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৬

৮৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৬

৯০. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৮

৯১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩০

৯২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩০

৯৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩০

৯৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩১

৯৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৩

৯৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৪

৯৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৪

৯৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৫

৯৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৬

১০০. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৮

১০১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯

১০২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯

১০৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯

১০৪. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯,দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪৪০-৪৪১

১০৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৬

১০৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৬

১০৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪৫৬

১০৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪৫৮

১০৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪৬৯

১১০. রবীন্দ্র উপন্যাস পরিক্রমা,অর্চনা মজুমদার,দে’জ পাবলিশিং,কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ ১৯৭০, পৃষ্ঠা-১২৯