
‘দত্তা’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)
সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী। ১৯০৩ সালে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প মন্দির শরৎচন্দ্রেরই রচনা। তখন কেউ অনুমান করতে পারেনি যে এই গল্পলেখকই কালে রবীন্দ্রনাথকে জনপ্রিয়তায় ম্লান করে দেবেন। ১৩১৯-২০ সনের ‘যমুনা’ পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালের ভারতী পত্রিকায় ‘বড়দিদি’ নামে শরৎচন্দ্রের একটি বড় গল্প প্রকাশিত হলে এটি পড়ে সাধারণ পাঠক মনে করেছিল, রবীন্দ্রনাথই বোধ হয় ছন্মনামে এই কাহিনীবিন্যাস রচনা করেছেন। কিন্তু এই গল্পটি যখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পড়ে দেখলেন তখন তিনি অনুমান করলেন এই গল্পটি যিনিই লিখে থাকুন, তিনি একজন অসাধারণ শিল্পী। আস্তে আস্তে অপরিচয়ের মেঘ সরে গেল। শরৎচন্দ্র স্নিগ্ধ আলোকে নিজের পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথের পাশেই উদিত হলেন। মাত্র বাইশ বৎসরেই সাহিত্য সাধনার মধ্যে তাঁর তিরিশখানি উপন্যাস ও গল্পসংকলন পাঠকসমাজে অসাধারণ প্রভাববিস্তার করেছিল। তিরিশ বৎসরেরও কম সময়ের মধ্যে এতগুলি শ্রেষ্ঠ ও বিচিত্র গ্রন্থ রচনা করে শরৎচন্দ্র অদ্ভুত মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন দেখছি অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যিক অল্প কিছুদিন সাহিত্য গগনে আতশ বাজির রোশনাই সৃষ্টি করেই কালের স্রোতে নিভে যান। কিন্তু শরৎচন্দ্র দীর্ঘদিন কথাসাহিত্যের সাধনা করেছেন, দীর্ঘতর দিন জনপ্রিয়তা রক্ষা করেছেন, এবং সম্প্রতি বাংলা কথাসাহিত্যের অভূতপূর্ব রূপান্তর হলেও সাধারণ পাঠক সমাজে এখনও তিনি একচ্ছত্র সম্রাট। শরৎচন্দ্রের দত্তা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি। উপন্যাসটি পুরোপুরি রোমান্টিক ধরনের সরস গল্প। শরৎচন্দ্র এটিকে ছোটগল্পের উপযোগী কাহিনীকে টানিয়া বুনিয়া দীর্ঘায়িত করেছেন। চার্লস গারভিসের ‘লিওলা ডেলস ফরচুন’ উপন্যাস কাহিনীর সঙ্গে শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’র মিল গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়। শরৎচন্দ্র যে এই উপন্যাসটি প্লটের জন্য খানিকটা ইংরেজী ঔপন্যাসিকের কাছে ঋণী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উপন্যাসের রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী যে পুরোপুরি বাঙালী এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে চরিত্র দুটির পরিস্ফুটতায় ইংরেজীর রঙ অনুভব করা যায়। উপন্যাসের ‘দয়াল’ চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের গোরার পরেশবাবুর ছাঁচে ঢালা। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলি হল বিজয়া, নরেন্দ্রনাথ, বিলাসবিহারী, রাসবিহারী ও দয়াল। উপন্যাসটিতে বিজয়া, নরেন্দ্রনাথ ও বিলাসের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র প্রকটিত হতে দেখা যায়। তাদের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বেই কলহের চিত্র আমরা লক্ষ্য করতে পারি।
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই জগদীশ, বনমালী ও রাসবিহারী খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। জগদীশ যেমন ছিল সবচেয়ে মেধাবী, তাহার অবস্থাও ছিল সবচেয়ে মন্দ। তার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পিতা যজমানি করে বিয়া পৈতা দিয়াই সংসার চালাইত। বনমালীর পিতাকে লোকে বিত্তশালী ব্যক্তি বলিয়া জানিত। কিন্তু তিনি পল্লীগ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন। রাসবিহারীদেরও অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল। তাহারা তিন বন্ধু ঝড় জল উপেক্ষা করেই পায়ে হেঁটে প্রত্যহ বাড়ী হইতে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করিত। এমনি করেই তিনবন্ধু একসঙ্গে এন্ট্রান্স পাশ করেছিল। বটতলায় বসে ন্যাড়া বটকে সাক্ষী করে তিনবন্ধু প্রতিদিন প্রতিজ্ঞা করত, জীবনে কখনও তাহারা পৃথক হবে না, কখনও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে না এবং উকিল হয়ে তিনজনেই একটা বাড়ীতে থাকবে। তিনজনে রোজগার করে সমস্ত টাকা একটা সিন্দুকে জমা করবে এবং তাই দিয়ে দেশের কাজ করবে। এ তো গেল তাদের তিন বন্ধুর ছেলেবেলার কল্পনা। কিন্তু বড় হয়ে তাহারা এই কাল্পনিক প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারল না। বন্ধুত্বের প্রথম পাকটা এলাইয়া গেল বি.এ. ক্লাসে। কেশব সেনের তখন কলিকাতায় প্রচন্ড প্রতাপ। বক্তৃতার খুব জোর। সে জোর পাড়াগাঁয়ের ছেলে তিনটি হঠাৎ সামলাইতে পারিল না – ভেসে গেল। এরফলেই বনমালী ও রাসবিহারী প্রকাশ্যে ব্রাহ্মধর্ম দীক্ষা নিয়ে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইলেন। কিন্তু জগদীশ ধর্মের কথা চিন্তা করে তা পারল না। কিছুকাল পর পিতার মৃত্যুতে বনমালী কৃষ্ণপুরের জমিদার ও রাসবিহারী তাহাদের রাধাপুরের সমস্ত বিষয়-আশয়ের একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে গেল। কিছুকাল পরে এই দুই বন্ধু ব্রাহ্ম পরিবারে বিবাহ করে বিদৃষী ভার্য্যা নিয়ে গৃহে ফিরে এলেন। কিন্তু জগদীশের সে সুবিধা হল না। সে যথাসময়ে আইন পাশ করে, এক গৃহস্থ ব্রাহ্মণের এগারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করে অর্থোপার্জনের নিমিত্ত এলাহাবাদে চলে যেতে হল। গ্রামের লোকের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে বনমালী গ্রাম ছেড়ে কলিকাতায় এসে বাস করল এবং জমিদারির উপর নির্ভর না করে ব্যবসা শুরু করে দিলেন। রাসবিহারীর অল্প আয় তাই সে গ্রামের লোকের অত্যাচার সহ্য করে গ্রামের থেকে গেল। অতএব তিন বন্ধুর একজন এলাহাবাদে, একজন রাধাপুরে এবং আর একজন কলিকাতায় বাসা করায়, আজীবন অবিবাহিত থেকে এক বাড়িতে বাস করে, এক সিন্দুকে টাকা জমা করে দেশ উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞাটা আপাততঃ স্থগিত রইল।
জগদীশের ছেলে হইলে সে বনমালীকে সুসংবাদ দিয়ে এলাহাবাদ থেকে চিঠিতে জানাল, তোমার মেয়ে হলে, তাকে পুত্রবধূ করব। কারণ তার দয়াতেই সে উকিল হয়ে সুখে আছে একথা কোনদিন ভুলে নাই। বনমালী উত্তরে জানাল যে এই আবেদন রাজী। তাছাড়া জগদীশের ছেলের দীর্ঘজীবন কামনা করলেন। এই ঘটনার দুই বছর পূর্বে তার অপর বন্ধু রাসবিহারীর যখন ছেলে হয়, সেও ঠিক এই প্রার্থনাই করেছিল। ব্যবসা বানিজ্য করে বনমালী এখন মস্ত ধনী। তাই সবাই তার মেয়েকে ঘরে আনতে চায়।
এই ঘটনার পঁচিশ বৎসর পর বনমালী খুব বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। কয়েক বৎসর নানারকম রোগে ভুগে এইবার শয্যা আশ্রয় করিয়া টের পেলেন, আর বোধ হয় উঠতে হবে না। তিনি চিরদিনই ভগবৎপরায়ণ ও ধর্মভীরু ছিলেন। একমাত্র সন্তান বিজয়ার বিবাহ দিয়ে যেতে পারলেন না এটা মনে করে কিছু ক্ষুণ্ণ হলেন। বিজয়াকে সে খুব ভালবাসত তাইতো ছেলের অনুপস্থিতি তাহার মনে কোন দুঃখ ছিল না। বিজয়াকেই সে তার প্রানের চেয়ে প্রিয় মনে করতেন। বিজয়ার উপর এতবড় সম্পত্তি রেখে যেতে তার মনে কোন দ্বিধা নেই কারণ সে বিশ্বাস করত যে তার মেয়ে সব কিছু তার বজায় রাখতে সক্ষম হবে। বনমালী মৃত্যুর আগে মেয়ে বিজয়াকে একটা অনুরোধ করে যায় যে – “জগদীশ যাই করুক আর যাই হোক, সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু তাকে ভালবাসি। দেনার দায়ে তার বাড়ীঘর কখনো বিক্রী করে নিস নে। তার একটি ছেলে আছে – তাকে চোখে দিখিনি, কিন্তু শুনেছি, সে বড় সৎ ছেলে। বাপের দোষে তাকে নিরাশ্রয় করিস নে মা, এই আমার শেষ অনুরোধ।”১ বাবার এই কথা শুনে বিজয়া অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল যে তোমার আদেশ আমি কোন দিন অমান্য করব না। জগদীশবাবু যতদিন বাঁচবেন, তাকে তোমার মতই মান্য করব। কিন্তু তার অবর্তমানে তার সমস্ত বিষয় ছেলেকে ছেড়ে দিতে রাজী হয়নি। কারণ সে জানায় ঐ ছেলে যদি লেখাপড়া শিখে থাকেন তবে অনায়াসেই পিতৃ-ঋণ শোধ করতে পারবেন। মেয়ের কথা শুনে বনমালী জানায় যে তার পিতার ঋণের পরিমাণ অনেক বেশী। তাই ছেলেমানুষ হয়ে তা শোধ করতে পারবে না। উত্তরে বিজয়া জানায় যে পিতার এই ঋণ শোধ করতে পারে না সে কুসন্তান, তাকে বেশী প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।
বনমালী তার এই সুশিক্ষিতা তেজস্বিনী মেয়েকে খুব ভালোভাবেই চিনতেন। তাই বেশী পীড়াপীড়ি না করে মেয়ের উপরেই সমস্ত ভার দিয়ে দিলেন। মেয়েকে সে বিশেষ কোন আদেশ দিয়ে আবদ্ধ করে যেতে চায় না। বনমালী এই মেয়েকে বলে যে তার মেয়ের জন্মের আগে জগদীশ তার কাছে মেয়েকে ছেলের সঙ্গে বিবাহ দিতে চায়। তখন আমি বন্ধুর কথায় রাজী হয়েছিলাম বলে তিনি যেন মেয়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। তার এই কন্যাটি ছোট বেলায় মাতৃহীন হইয়াছিল বলে মাতাপিতা উভ্যের স্থান তিনিই পূর্ণ করেছিলেন। তাই বাবার কথা শুনে কোন সংকোচ বোধ না করে বিজয়া বলেছিল যে বাবা তুমি তাকে শুধু মুখের কথা দিয়েছিলে, মনের কথা দাও নি। মেয়ের এই কথা শুনে বনমালী এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে বিজয়া বলে তাহলে তো তার সাথে একবার সাক্ষাৎ করতে চাইতে? বনমালী জানায় যে রাসবিহারীর কাছে সে শুনেছিল যে ছেলেটি নাকি তার মায়ের মতো দুর্বল, তাই ডাক্তারেরা তার দীর্ঘজীবনের কোন আশায় করেনি। এই সব কথা শুনেই বনমালী তার সাথে দেখা করতে চায়নি। তার সাথে দেখা না করে বনমালী মনে করে যে তার বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। সেই সময় বনমালী যে জগদীশকে তার মনের কথাই দিয়েছিল তা বিজয়াকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়। তারপর একটু থেমে বললেন – আজ জগদীশকে সবাই জানে, একটা অকর্মণ্য জুয়াড়ি, অপদার্থ মাতাল। কিন্তু এই জগদীশেই একদিন তাদের সকলের চেয়েই ভালছেলে ছিল। সে প্রতিটি মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পারত। এই ভালোবাসায় তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জগদীশের স্ত্রী ছিলেন সতীলক্ষ্মী। তার মৃত্যুতে শোকে জগদীশ পাগল হয়ে গেছে। তার স্ত্রী মৃত্যুকালে পুত্র নরেনকে আশীর্বাদ করে বলে যেন ভগবানের উপর তার অচল বিশ্বাস থাকে। পরে দেখা গেছে নাকি মায়ের এই আশীর্বাদ টুকু ছেলে নরেন একেবারে নিষ্ফল করে নাই। নরেন এইটুকু বয়সেই ভগবানকে তার মায়ের মতোই ভালবাসতে শিখেছে। বনমালী তার মেয়েকে নরেন সম্পর্কে জানায় সে একজন ডাক্তার কিন্তু ডাক্তারি করে না। এখন সে তার মামার কাছে বর্মায় থাকে। বিলাসবাবুর আগমন সংবাদ ভৃত্য আলো দিতে এসে জানিয়ে যায়। বিলাসবিহারী হল রাসবিহারীর পুত্র। বনমালী ব্যবসায়ীর শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের জমিদারী অনেক বাড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সেসমস্ত তত্ত্বাবধানের ভার বাল্যবন্ধু রাসবিহারীর উপরেই ছিল। এই জন্যেই বিলাসের এই বাটীতে আসা-যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল।
দুইমাস হল বনমালীর মৃত্যু হয়েছে। বিজয়া একা হয়ে যাওয়ায় তার দেশের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা রাসবিহারীই করতে লাগল এবং সেই সূত্রে তার একপ্রকার অভিভাবক হয়ে বসলেন। কিন্তু যেহেতু রাসবিহারী গ্রামে থাকতেন সেই জন্য তার পুত্র বিলাসবিহারীর উপরেই বিজয়ার সমস্ত খবরদারীর ভার পড়ল। সেই তার প্রকৃত অভিভাবক হয়ে উঠল। একদিন হঠাৎ বিলাসবাবু বৃদ্ধ মাতাল জগদীশের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন। জগদীশ বিজয়ার পিতৃবন্ধু ছিলেন। বিলাস তখন বিজয়াকে জানায় যে জগদীশ মুখুজ্জ্যে তার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন, কিন্তু তিনি তার মুখ পর্যন্ত দেখতেন না। জগদীশবাবু টাকা ধার করতে দুবার এসেছিল। কিন্তু তার বাবা চাকর দিয়ে তাকে বাড়ীর বাইরে বার করে দিয়েছিলেন। বিলাসের পিতা জগদীশবাবুকে সহ্য করতে পারতেন না, একথা শুনে বিজয়া তাকে একপ্রকার সমর্থন করেন। বিজয়ার কথা শুনে বিলাসবাবু খুব উৎসাহিত হয়েছিল। তাই বিলাসবাবুকে বলতে শুনি – বন্ধুই হোক আর যাই হোক দুর্বলতার বশে কোন মতেই ব্রাহ্মসমাজে চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিৎ নয়। বিলাসবাবু তখন বিজয়াকে জানায় এখন যদি জগদীশবাবুর পুত্র তার বাবার সমস্ত ঋণ শোধ করতে না পারে তবে আইন মতে তার সম্পত্তি আমাদের হাতে নেওয়া উচিত। তাই সেটা ছেড়ে দেবার আমাদের কোন অধিকার নেই। কারণ সেই টাকায় আমরা সমাজের অনেক সৎকার্য করতে পারি। এছাড়া জগদীশবাবু কিংবা তার ছেলে আমাদের সমাজভুক্ত নয় যে তার উপর কোন প্রকার দয়া করা আবশ্যক। বিজয়ার সম্মতি পেলেই রাসবিহারীবাবু এইসব ঠিক করে ফেলবেন বলেই বিলাসকে এখানে পাঠিয়েছেন। তখন বিজয়া মৃত পিতার শেষ কথাগুলো স্মরণ করে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ সাহস করে জবাব দিতে পারল না। বিজয়াকে ইতস্ততঃ করতে দেখে বিলাস রেগে গিয়ে বলল আপনাকে ইতস্ততঃ করতে আমি কোন মতেই দিব না। অর্থাৎ এই কর্মে সে যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তা জানিয়ে দিল। বিজয়া যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব করে মহাপাপ করেছেন তা বিলাস জানিয়ে দেয়। বিলাস এরপর জানায় সে ঠিক করেছে যে ঐ বাড়ীটায় ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেবে। বিলাস এরপর বিজয়াকে পিতার পূর্ব কথা মনে করিয়ে দিয়ে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। তাই আপনার পিতার প্রতিশোধ নিয়ে এই কাজ করা উচিত। বিজয়া এই কথা শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এই কাজ করে তার কত নামধাম হবে তা মনে করিয়ে দেয় বিলাস। হিন্দুরা স্বীকার করবে যে ব্রাহ্মসমাজে মানুষ আছে, হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে। যাকে তারা নির্যাতন করে দেশ থেকে বিদায় করে দিয়েছিল, সেই মহাত্মারই মহীয়সী কন্যা তাদের মঙ্গলের জন্য এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে এর জয়গান হবে। এত বড় নামের লোভ সংবরণ করা বিজয়ার পক্ষে সম্ভব হল না। কিন্তু পিতার কথাগুলি মনে করে দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। বিজয়া এরপর জগদীশবাবুর ছেলের কথা বিলাসের কথা জানতে চাইল।
বিলাস বিজয়াকে জানায় যে তার ছেলে বর্তমানে গ্রামেই আছে। বিলাস তার বিশ্রী চেহারার বর্ণনা বিজয়াকে জানায়। জগদীশ বাবুর বাড়ীটা দখল করে নিলে কেউ গোলমাল করবে না কারণ তার প্রতি কোন ব্যক্তিরই কোন সহানুভূতি ছিল না। বিলাস বিজয়াকে একথা জোর করে আশ্বাস দেয়। বিলাস বিজয়াকে কিছুদিনের জন্য গ্রামে যাওয়ার জন্য আবেদন জানায়। বিজয়া বিলাসের কাছে এর কারণ জানতে চায়। উত্তরে বিলাস জানায় তার প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। প্রজাদের এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করা যে মহাপাপ তা তাকে জানিয়ে দেয়। এই কথা শুনে বিজয়ার সমস্ত মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়া এরপর জানায় সে পিতার কাছে জেনেছে তাদের গ্রামের বাড়ী বসবাসের অযোগ্য। এই কথা শুনে বিলাস জানায় সে দশ দিনের মধ্যে ঐ ঘরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বসবাসের যোগ্য করে দেবে। বিলাস রুঢ় কণ্ঠে জানায় যে আপনাকে সামনে রেখে আমি যে কি করতে পারি তা বোধ করি সীমা – পরিসীমা নেই। বিজয়াকে গ্রামে যেতে রাজী করিয়ে বিলাস প্রস্থান করল। কিন্তু বিজয়া সেখানেই চুপ করে বসে রইল। বিজয়া এই গ্রামের যেসব কথা পিতার কাছে শুনেছে তা স্মরণ করতে লাগল। তখন গ্রামের কথা শুনে তাহার কিছুমাত্র মনযোগ আকর্ষণ করতে পারত না। কিন্তু আজ ঐ গ্রামের কথা মনে করে তার আকর্ষণ বেড়ে গেল। কারণ সে অনুমান করল যে ঐ বাড়ীতে তার সাত পুরুষের বাস। তাই সেই বাড়ীর প্রতি তাহার একটা আকর্ষণ দেখা গেল। বিজয়ার পরলোক গত পিতৃদেবের সমস্ত গ্রাম সম্বন্ধে কথা গুলি স্মরণ করে তাহার প্রছন্ন বেদনার অকস্মাৎ এক মুহূর্তেই তাহার মনের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই কথা চিন্তা করতে করতে সে অনুমান করে যে ভিটার সঙ্গে তার জন্মাবধী পরিচয় নাই, তা আজ তাকে দুর্নিবার শক্তিতে টানতে লাগল।
বহুকাল পর জমিদার বাটি বিলাসের তত্ত্বাবধানে মেরামত হতে লাগল। কলকাতা থেকে বিচিত্র আসবাব পত্র গরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে প্রতিদিন আসতে লাগল। জমিদারের একমাত্র কন্যা দেশে বাস করতে আসবেন, ঐ সংবাদ প্রচারিত হওয়া মাত্র কেবল কৃষ্ণপুর নয় আশে পাশের সমস্ত গ্রামের মানুষ হৈ চৈ করতে লাগল। ঘরের পাশে জমিদারের বাস চিরদিনেই লোকের অপ্রিয় তাতে জমিদারের না থাকাটাই প্রজাদের কাছে একটা অভ্যাস হইয়া দাঁড়িয়েছে। সুতরাং নতুন করে তার বাস করবার বাসনটা সকলের কাছেই একটা অন্যায় উৎপাতের মত প্রতিভাত হল। গ্রামের লোকের কাছে একটা জনশ্রুতি ছিল যে জমিদার কন্যার সঙ্গে রাসবিহারীর পুত্র বিলাসের বিবাহ স্থির হয়ে গেছে। পূর্ব পরিকল্পনার মতই শরৎকালের প্রারম্ভেই এ মধুর প্রভাতে মস্ত দুই ওয়েলারবাহিত খোলা ফিটনে চড়ে তরুণী কন্যা নরনারীর সভয় কৌতূহল দৃষ্টির মাঝখানে পিতৃ পিতামহের পুরাতন আবাসস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। পাঁচ ছয়দিন পর একদিন বিজয়া চা পানের পর বিলাস বাবুর সঙ্গে বিষয় সম্পত্তি সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতেছিলেন, বেহারা আসিয়া জানাল একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তখন তাকে এইখানে নিয়ে আসতে বলল। বেহারার পিছনে একজন চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবক তার কাছে বসল। এই লোকটির আচরণে বিন্দুমাত্র সংকোচ দেখা গেল না। তাহার আগমনে বিলাস ও বিজয়া উভয়েই বিস্মিত হয়ে গেল। সে নিজের পরিচয় বলতে গিয়ে জানায় যে পূর্ণ গাঙ্গুলি তাহার মামা, বিজয়ার প্রতিবেশী এবং পাশের বাড়িটাই তার। সে বিজয়াকে প্রশ্ন করল যে পিতৃ-পিতামহের কালের দুর্গা পূজো না কি আপনি বন্ধ করে দিতে চান? এর মানে কি? তার প্রশ্ন শুনে বিজয়া বিজয়া আশ্চর্য এবং মনে মনে বিরক্ত হল কিন্তু কোন উত্তর দিল না। বিলাস উত্তর দিয়ে জানায় যে আপনি কি মামার হয়ে ঝগড়া করতে এসেছেন না কি? কিন্তু কার সাথে কথা বলতে এসেছেন, তা ভুলে যাবেন না। আগন্তুক বিলাসের এই কথা শুনে হেসে জিভ কেটে বলে সে সব আমি সব বুঝি এবং এখানে ঝগড়া করতেও আসিনি। বরং এই কথাটি আমার বিশ্বাস হয়নি বলেই ভাল করে যাচাই করার জন্যই এসেছি। উত্তরে বিলাস জানায় যে তার বিশ্বাস না হওয়ার কারণ কি? আগন্তুক তখন বলে নিরর্থক প্রতিবেশীর ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার জন্য সে একথা মন থেকে বিশ্বাস করতেও পারেনি। ধর্মমত নিয়ে তর্ক বিতর্ক বিলাসের কাছে ছোট বেলা হতেই খুব দক্ষ। বিলাস তাই তার এই কথা শুনে উৎসাহে প্রদীপ্ত হয়ে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের কণ্ঠে বলে - “আপনার কাছে নিরর্থক বোধ হলেই যে কারও কাছে তার অর্থ থাকবে না, কিম্বা আপনি ধর্ম বললেই সকলে তাকে শিরোধার্য করে মেনে নেবে, তার কোন হেতু নেই। পুতুল পুজো আমাদের কাছে ধর্ম নয়, এবং তার নিষেধ করাটাও আমরা অন্যায় বলে মনে করিনে।”২ বিলাসের এই কথা শুনে আগন্তুক তখন বিজয়ার সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। তার বিস্ময় বিজয়াকে মনে মনে আঘাত করল। কিন্তু সে ভাব গোপন করে সহজ ভাবেই বিলাসের মতামতকেই সমর্থন করল। আগন্তুক তখন হতাশ হয়ে জানায় সে তার কাছে এই সিন্ধান্ত আশা করেনি। আগন্তুক এরপর বলে এই পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের সমস্ত আপনার প্রজারা আনন্দ করে তাই তা আপনি বন্ধ করে দেবেন না। এই জন্যই আপনার এই কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনে। দুঃখী প্রজাদের কথা শুনে বিজয়ার কোমল হৃদয় ব্যাথায় ভরে গেল। আগন্তুকের বেশি কথা বলা দেখে বিলাস বিরক্ত হয়ে বলে আপনার সঙ্গে তর্ক করার আমাদের কোন সময় নেই। বিলাস এও জানায় আপনাদের পুজো করার ব্যপারে আমাদের কোন বাধা নেই, কিন্তু ঢাক ঢোল পিটিয়ে রত্রিদিন কানের কাছে বাজানোতে বাধা আছে। বিলাসের সাথে আগন্তুকের এই ব্যাপারে কথা কাটাকাটিতে ঝগড়া খুব চরম সীমায় পৌঁছায়। বিলাসের বাবাকে অপমান করার জন্য আগন্তুকের উপর বিলাস খুব রেগে যায়। বিলাসের এই রূপ দেখে কিন্তু আগন্তুকের ভয়ের কোন চিহ্নমাত্র চেখা গেল না। তাদের উভয়ের বাকবিতণ্ডা দেখে বিজয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। আগন্তুকের প্রতি বিলাসের এই খারাপ ব্যবহার দেখে বিজয়া লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়া এরপর বিলাসকে বলে মাত্র তিন চারদিন তারা একটু গোলমাল করলে কোন অসুবিধা হবে না। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়। পরিশেষে বিজয়া আগন্তুককে জানিয়ে দেয় প্রতি বছরের মতো এবছরেও তারা তাদের পুজো করুক, তাতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। বিজয়ার এই কথা শুনে আগন্তুক ও বিলাসবাবু উভয়েই বিস্ময়ে অবাক হয়ে বিজয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একথা বলে দেওয়া দরকার যে এই অপরিচিত যুবকটিই তাদের সর্বপ্রধান আসামী জগদীশের পুত্র নরেন্দ্রনাথ।
বিজয়া এরপর বিলাসের কাছে জানতে চাইল ঐ তালুকটা নেওয়ায় আপনার বাবার মতামত কি? বিলাস সঙ্গে সঙ্গে তার বাবার মতামতকে সমর্থন করে। বিলাসের পিতার মতামতকে অগ্রাহ্য করে বিজয়া আগন্তুককে পুজো করার অনুমতি দিলে তাতে বিলাস মনে মনে ক্ষুণ্ণ হয়। তাই বিলাস রেগে গিয়ে বিজয়াকে বলে - “বেশ, আপনার এস্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান নিন, কিন্তু এরপরে বাবাকে আমায় সাবধান করে দিতেই হবে, নইলে পুত্রের কর্তব্যে আমার ত্রুটি হবে।”৩ বিলাসের এই অচিন্তনীয় রুঢ় ব্যবহারে বিজয়া বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। বিজয়া এজন্য বিলাসের কাছে তার আচরণের জন্য সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে নেয়। তাই বিজয়া ভেবেছিল বিলাস বুঝি এরপর এনিয়ে আর কোন কথা বলবে না। কিন্তু বিলাস আবার জানায় যে পূর্ণ গাঙ্গুলিকে জানিয়ে দিন যে পূর্বের অনুমতিটিই যেন সে মেনে চলে, অর্থাৎ পুজো যেন বন্ধ করে। বিজয়া এই কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয় একথা জানাতে দ্বিধা বোধ করে না। এই কথা শুনে বিলাস খুব রেগে যায়। তাই সে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারে - “আপনি যদি তাকে সমস্ত গ্রামের মধ্যে অশ্রদ্ধার পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তাহলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।”৪ বিলাস যে কতটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে পারে তা আমরা তার এই কথাতেই অনুমান করতে পারি। বিলাসের এই কথা শুনে বিজয়ার অন্তরটা অকস্মাৎ ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু সে নিজেকে আত্মসংযম করে নিল। বিজয়া তাই শান্তভাবেই জবাব দিল আপনি যা পরেন করবেন কিন্তু অপরের ধর্মে কর্মে আমি বাধা দিতে পারব না। এই নিয়ে তাদের আলোচনা করতে করতে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে অবনতি দেখা যায়। বিজয়া ও বিলাসের মধ্যে ঝগড়া একটা চরম জায়গায় পৌঁছে যায়। বিজয়ার আচরণে রাসবিহারীও বিরক্ত হয়ে যায়। তাই তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেবার কথা বলে হুমকি দেয় বিজয়াকে। তার কথা শুনে বিজয়া কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকে যায়, যেন সে তার অপরাধটা একপ্রকার স্বীকার করে নেয়। বিজয়ার এই কোমল ভাব দেখে রাসবিহারী খুশি হয়ে বিষয় সংক্রান্ত অন্যান্য কথাবার্তা সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকল। জগদীশের বাড়ীটা খুব তাড়াতাড়ি দখল করে সমাজকে দান করার কথা বললেন। জগদীশের সাথে বিজয়ার বাবার ঋণ সম্পর্কে শর্তের সমস্ত কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় রাসবিহারী। এই কথা শুনে বিজয়া জানায় জগদীশ বাবুর ছেলেকে একবার এখানে ডেকে আরও কিছুদিন সময় দিয়ে দেখলে হয় না, যদি কোন উপায়ে তা ফিরিয়ে নিতে পারে। বিজয়ার এই কথা শুনে জগদীশ ছেলের প্রতি একটা দুর্বলতার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। বিজয়া যে এই বাড়ীটা দখল করতে ইচ্ছুক নয় তার এই সহানুভূতি সম্পন্ন কথা শুনেই অনুমান করা যায়। কিন্তু জগদীশের ছেলে যে তার কোন ব্যবস্থা করতে পারবে না, তা রাসবিহারী সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াকে জানিয়ে দেয়। পিতার কথা শেষ না হতেই বিলাস গর্জন করে বলে সে পারলেই আমরা দেব কেন? কারণ তার সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। তাই সেই বাড়ী এখন আইনত আমাদের। বিলাস এরপর জগদীশ বাবু সম্পর্কে নানারকম কুরুচিকর মন্তব্য করে। বিলাসের এই আচরণে বিজয়া মনে মনে খুব দুঃখ পায়। তাই বিজয়া রাসবিহারীর মুখের দিকে চেয়ে শান্ত কণ্ঠে জানায়, জগদীশ বাবু আমার বাবার বন্ধু ছিলেন, তার সম্বন্ধে সসম্মানে কথা বলতে বাবা আমাকে আদেশ দিয়ে গেছেন। বিলাস এরপর পুনরায় গর্জন করে উঠে। তাই রাসবিহারী তাকে চুপ করতে বললেন। বিলাস তখন রেগে গিয়ে বলে - “এসব বাজে সেন্টিমেন্ট আমি কিছুতেই সইতে পারিনে - তা সে কেউ রাগই করুক, আর যাই করুক। আমি সত্য কথা বলতে ভয় পাইনে, সত্য কাজ করতে পেছিয়ে দাঁড়ায়নে।”৫
রাসবিহারী তখন উভয় পক্ষকেই শান্ত করবার চেষ্টা করল। বিজয়া বলে তার বাবা মৃত্যুর পূর্বে তাকে আদেশ করে গিয়েছিলেন, ঋণের দায়ে তার বাল্য বন্ধুর প্রতি যেন আমি অত্যাচার না করি। একথা বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস বলে তবে তিনি কেন সমস্ত দেনাটা নিজে ছেড়ে দিয়ে গেলেন না শুনি? বিলাসের কথার কোন উত্তর না দিয়ে রাসবিহারীকে পুনরায় বিজয়া বলে জগদীশ বাবুর পুত্রকে ডেকে পাঠিয়ে সমস্ত কথা জানানো হয়, এই আমার ইচ্ছে। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস তাকে বিদ্রূপ করতে লাগল। বিজয়া এর কোন উত্তর দিল না। রাসবিহারী একাজ করতে পারবে কিনা তা জানতে চাইল। রাসবিহারী অতিশয় ধূর্ত লোক। তাই তিনি ছেলের ঔদ্ধ্যতের জন্য মনে মনে বিরক্ত হলেও বাইরে বিজয়ার মতকেই সমীচীন প্রমান করবার জন্য চেষ্টা করলেন। বিজয়ার সাথে বিলাসের তর্কবিতর্কের জন্য তাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। তাই তার একে অপরকে আর সহ্য করতে পারছিল না। দিঘড়ায় স্বর্গীয় জগদীশ বাবুর বাড়ীটা সরস্বতীর পরপারে। আজ হঠাৎ বিজয়া বিকেল বেলায় দারোয়ান কানাই সিংকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বাইরে বের হলেন। বিজয়া চলিতে চলিতে হঠাৎ একস্থানে এসে তার চোখে পড়ল নদীর মধ্যে গোটাকয়েক বাঁশ একত্র করে পরপারের জন্য একটা সেতু প্রস্তুত করা আছে। এটি ভালো করে দেখবার জন্য বিজয়া যখন জলের ধারে পৌঁছল তখন দেখতে পেল কিছু দূরে বসিয়া একজন খুব মনোযোগ সহকারে মাছ ধরিতেছে। বিজয়ার সাড়া পেয়ে লোকটি মুখ তুলিয়া নমস্কার করল। যে মাছ ধরছিল সে যে সেইদিনের সেই আগন্তুক, পূর্ণ বাবুর ভাগিনেয় তা বিজয়া চিনতে পারল। বিজয়া তখন প্রতি নমস্কার করে তার কাছে এসে কথাবার্তা বলল। বিজয়া তাকে তার বাড়ীর সন্ধান জানতে চাইল। সে তখন জানায় তার বাড়ী দিঘড়ায়, এই বাঁশের পুল দিয়ে যেতে হয়। গ্রামের নাম শুনিয়া বিজয়া তাকে জিজ্ঞাসা করে তার জগদীশ বাবুর ছেলের সাথে পরিচয় আছে কিনা? বিজয়া যে জগদীশ বাবুর বাড়িটি দেনার দায়ে কিনে নিয়েছে তা জানিয়ে দেয় ঐ লোকটি। বিজয়া তখন তাকে জিজ্ঞাসা করে যে ঐ বাড়িটি কেমন? বাড়িটি যে খুব ভালো তা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় ঐ লোকটি। লোকটি তখন বিজয়াকে ঐ বাড়িটির দিকে নিয়ে যায়। পথে যেতে যেতে নরেন সম্পর্কে অনেক কথা জানতে চায় বিজয়া। বিজয়া তখন ঐ ভদ্রলোককে জানায় নরেন বাবুকে দেনাটা শোধ করে দেওয়ার জন্য। উত্তরে ভদ্রলোকটি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয় তা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলে বিজয়া অনুমান করে যে তার সাথে নরেনের খুব ভালো পরিচয় আছে। বিজয়ার এই কথা শুনে ভদ্রলোকটি শুধু হাসল কিন্তু কোন কথা বলল না। ভদ্রলোকটি এরপর চলে যেতেই বিজয়া কিছুক্ষণ বিমনা হয়ে গিয়েছিল। বিজয়া এরপর রাসবিহারীকে নোটিশ দিয়ে জগদীশ বাবুর ঘরটি দখল রদ করতে বলে। এই কথা শুনে রাসবিহারী অবাক হয়ে যায়। বিজয়া বলে তিনি হয়ত অপমানের ভয়ে এখানে আসতে পারেন নি। কারণ তিনি ভেবেছেন নিশ্চয় তার প্রার্থনা আমরা মঞ্জুর করব না। বিজয়া এরপর রাসবিহারীকে নোটিশ করতে বলে জানায় এটাই তার শেষ অনুরোধ। কিন্তু রাসবিহারী বিজয়ার এই অনুরোধ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সে জানায় আমার কাছে কর্তব্য বোধ সবচেয়ে বড় তা সে যত কঠিনই হোক না কেন। এদিকে বিলাস এই বাড়িটি দখল করার জন্য পিতাকে জোরজবরদস্তি করতে থাকে। পুত্রের কথা শুনে রাসবিহারী কোন কথা বলে না। বিজয়াও খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নীরবে সম্মতি দিল বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার পরদুঃখে স্নেহ কোমল নারীচিত্ত রাসবিহারীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও বিলাসের প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল।
রাসবিহারী এরপর বিজয়াকে বলে বিলাস যা করতে চেয়েছিল, তা স্বার্থের জন্যেও নয়,রাগের জন্যেও নয়, শুধু কর্তব্য বলেই চেয়েছিল। তারপর রাসবিহারী নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য জানায় একদিন আমার বিষয়, তোমার বাবার বিষয় সব এক হয়েই তোমাদের দুজনের হাতে পড়বে, যেদিন বুদ্ধি দেবার জন্যে এ বুড়োকেও খুঁজে পাবে না। তিনি এই কথার দ্বারা বিজয়াকে বলতে চাইলেন যে বিজয়া ও বিলাসের বিবাহ বন্ধনে এক সুত্রে জীবন যাপনের কথা। রাসবিহারী মনে মনে ইচ্ছা ছিল নিজের ছেলের সাথে বিবাহ দেবার। রাসবিহারীর এই অকাট্য যুক্তির কথা শুনে বিজয়া কোন বিরুদ্ধাচরণ না করে চুপচাপ থেকে গেল। নিজের ছেলের মহান কৃতিত্বকে বোঝানোর জন্য তাই রাসবিহারী জানায় সে ছেলেমানুষ হলেও কিন্তু অনেকদুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজ করে। তাই মাঝে মাঝে জমিদারির কাজ ওর চাল বুঝতে আমাকেও স্তম্ভিত হয়ে চিন্তা করতে হয়। এই কথা শুনে বিজয়া কোন উত্তর দিল না। রাসবিহারী তখন বলে এই সমাজ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় বিলাস যে কিরকম উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তা মুখে প্রকাশ করে বলা যায় না। রাসবিহারী পুত্রের কাজ বড়াই করে বলে বিজয়াকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। কারণ বিজয়ার সম্পত্তির প্রতি রাসবিহারীর একটা লোভ ছিল। তাই যদি বিজয়াকে ছেলের বউ করা যায় তবে তার সমস্ত সম্পত্তি তাদের আয়ত্তে চলে যাবে। পরের দিন বিজয়া আবার দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে ঘুরতে চলে গেল। বিজয়া দেখে ঠিক সেইখানে আজও সেই লোকটি মাছ ধরছিল। এদিন কিন্তু তার সাথে কোন কথা না বলে চলে যেতে চাইছিল কিন্তু কানাই সিং তার সাথে কথা বলল। দারয়ানের কথা কানে যাওয়ামাত্রই তার মুল পর্যন্ত বিজয়ার আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে ভদ্রলোকটি তার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখে। কথা বলতে বলতে একবার নিজেকে ডাক্তার বলে ফেললেও কিন্তু পরক্ষণে তা অস্বীকার করে জানায় তার প্রতিবেশী একজন ডাক্তার। বিজয়া অনুমান করে যে জগদীশ বাবুর ছেলে নরেন এই ভদ্রলোকটির একজন বন্ধু। ভদ্রলোকটি বিজয়াকে জানায় যে নরেনবাবু তার দরিদ্র কৃষকদের চাষবাস নিয়ে লেখাপড়া শেখায় বিনামূল্যে। বিজয়া নরেন বাবুর গৃহে স্কুলের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। গরীব চাষিদের সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করার শিক্ষাই দিতে তার এই স্কুল। ভদ্রলোকটি বিজয়াকে জানায় ওই স্কুল দেখতে যাবার জন্য অনুরোধ করে। লোকটি বলে মাঠের মাঝখানে গাছের তলায় বাপ-ব্যাটা –ঠাকুরদায় মিলে সেখানে পাঠশালা বসে। এইসব কথা শুনে বিজয়া তৎক্ষণাৎ সেখানে যাবার জন্য উদ্যত হয়ে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই কৌতূহল দমন করে বলল না আজ থাক। এরপর বিজয়াকে খানিকটা এগিয়ে দিতে আসে ঐ ভদ্রলোকটি। মিনিট পাঁচ ছয় বিজয়া কোন কথা বলিল না, ভিতরে ভিতরে তার কেমন যেন লজ্জা করিতে লাগল অথচ এই লজ্জার কারণ সে কিছু খুঁজে পেল না। লোকটি এরপর বিজয়াকে বলে - “আপনি ধর্মের জন্যই যখন তার বাড়ীটা নিচ্ছেন – এই ক’বিঘে জমি যখন ভালো কাজেই লাগছে তখন এটা ত আপনি অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারেন?”৬ এইকথা গুলি বলে লোকটি মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। উত্তরে বিজয়া জানায় এই অনুরোধ করার আপনার কোন অধিকার আছে কি তার তরফ থেকে। লোকটি তখন স্পষ্টভাবে বলে এ অধিকার দেবার ওপর নির্ভর করে না, নেবার ওপর নির্ভর করে। এই অনুরোধ গৃহীত হলে তার নিজস্ব কোন লাভ হবে না। তাই সে নিরন্ন দরিদ্র কৃষকদের কথা ভেবেই এই অনুরোধ জানায়। তাদের সেবার অধিকার সকলেরই আছে,তাই সে নরেনের কাছে অনুমতি চাইতে যাবে না। ভদ্রলোকটি তার কথার ইঙ্গিতে বিজয়াকে বুঝিয়ে দিতে চায় সেই হল নরেন বাবু। কিন্তু বিজয়া তা বুঝতে পারেনি। বিজয়ার সাথে ভদ্রলোকটির কথাবার্তার মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের উৎপত্তি দেখতে পায়। কিন্তু এরমধ্যেই দুইদিন ঐ ভদ্রলোকের সাথে খোলামেলা কথা বলে বিজয়ার তার প্রতি একটা আকর্ষণের সৃষ্টি হয়।
বাড়ীর মধ্যে এসে বিজয়ার দুইটা কথা মনকে সর্বাপেক্ষা অধিক আচ্ছন্ন করিল, তার মধ্যে একটা হল ঐ ভদ্রলোকটির নাম না জানা এবং দ্বিতীয় হল দুইদিন পরে তিনি কোথায় চলে যাবেন। এই দুটি প্রশ্ন তার শতবার মুখে এসে পড়লেও কেবল লজ্জাতেই মুখ বাধিল। বিজয়ার এই আচরণ দেখে আমরা অনুমান করতে পারি ঐ ভদ্রলোকটির প্রতি তার মন খুব আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। তাই বিজয়ার মনে শুধু তার কথাই চিন্তা করতে লাগল। এমন সময় পরেশের মা এসে বিজয়াকে জানায় বিলাসবাবু বহুক্ষণ ধরে বাইরে বসবার ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই কথা শুনে বিজয়ার মন শ্রান্তি ও বিরক্তিতে ভরে গেল। বিলাসবাবুই যে এ বাড়ীর ভবিষ্যৎ কর্তৃপক্ষ, এ সংবাদ আত্মীয় পরিজন কারও জানতে বাকি ছিল না। সেই কারনেই তার আদর যত্নের ত্রুটি হতে পারত হত না। বিজয়া কোন কথা না বলে উপরে তার ঘরে চলে গেল। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে বিজয়া বিলাসবাবুর ঘরে গেল। বিলাস বলে - “তুমি নিশ্চয় ভেবেছ, আমি রাগ করে এতদিন আসিনি। যদিও রাগ আমি করি নে, কিন্তু করলেও যে সেটা আমার পক্ষে কিছুমাত্র অন্যায় হত না, সে আজ আমি তোমার কাছে প্রমান করব।”৭ বিলাস এতদিন বিজয়াকে আপনি বলিয়া ডাকিত কিন্তু আজ হঠাৎ তুমি সম্বোধনের কারণ কিছুমাত্র উপলব্ধি করতে না পারলেও বিজয়া যে অখুশি হয়নি তা তার মুখ দেখে বোঝা গেল। কিন্তু সে কোন কথা না বলে ঘরের মধ্যে এসে বসে পড়ল। বিলাস অচলাকে জানায় তাদের ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা সে বড়দিনের ছুটিতে করতে চায়। এরজন্য সে সমস্ত ঠিক করে ফেলেছে, এমনকি নিমন্ত্রণ করা পর্যন্ত হয়ে গেছে একথা বিজয়াকে জানায়। তার জন্য তাকে কাল থেকে খুব ঘুরতে হয়েছে। এরপর এই অনুষ্ঠান করা তার একটা তালিকা কাগজে লেখা বিজয়াকে দেখতে দেয় বিলাস। কিন্তু বিজয়া এতে খুব একটা কৌতূহল প্রকাশ না করে চুপচাপ থেকে গেল। বিজয়ার এই মৌন অবস্থা দেখে বিলাস অবাক হয়ে তার কারণ জিজ্ঞাসা করল। বিজয়া তখন ধীরে ধীরে বলল- আমি ভাবছি, আপনি যে নিমন্ত্রণ করে এলেন, এখন তাদের কি বলা যায়? বিজয়ার এই কথার কোন অর্থ বুঝতে পারল না বিলাস। বিজয়া তখন জানায় মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে সে এখনো কিছু স্থির করে উঠতে পারেনি। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস রাগে গর্জে উঠে। তাই তো বিলাস বিজয়াকে বলে – “তার মানে কি? তুমি কি ভেবেছ, এই ছুটির মধ্যে না করতে পারলে আর শীঘ্র করা যাবে? তারা ত কেউ তোমার – ইয়ে নন যে, তোমার যখন সুবিধে হবে, তখনই তারা এসে হাজির হবে? মন স্থির হয়নি, তার অর্থ কি শুনি?”৮ বিলাসের রাগে চোখ দুটি জ্বলতে লাগল। বিজয়া বহুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকে আস্তে আস্তে বলল - “আমি ভেবে দেখলুম, এখানে এ নিয়ে সমারোহ করবার দরকার নেই।”৯ বিজয়ার কথা শুনে বিলাস জানায় এই কাজ সমারোহ তারা করবে না। বরং তার কাজ নিঃশব্দে সমাধা করবার জ্ঞান তার আছে। তোমাকে সে জন্য চিন্তা করতে হবে না। বিজয়া তখন মৃদু কণ্ঠে জানায় যে এখানে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কোন সার্থকতা নেই। তাই সেটা হবে না। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস রেগে যায় এবং বিজয়া যে সত্যিই ব্রাহ্ম মহিলা এতে সে সন্দেহ প্রকাশ করে। বিজয়া এই কথা শুনে তীব্র আঘাতে যেন চমকে মুখ তুলে চায় কিন্তু আপনাকে সংযত করে বলে আপনি বাড়ী গিয়ে শান্ত হয়ে ফিরে এলে তার পরে আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হবে - এখন থাক। বিলাস এরপর বিজয়ার সংস্রব একেবারে পরিত্যাগ করার কথা বলে ধমক দিতে লাগল। বিজয়া এই কথা শুনে তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। তাই বিজয়া নিঃসংশয়ে বলতে পারে - “আপনার দায়িত্ব বোধ যখন এত বেশি, তখন আমার অনিচ্ছায় যাদের নিমন্ত্রণ করে অপদস্থ করবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের ভার নিজেই বহন করুন, আমাকে অংশ নিতে অনুরোধ করবেন না।”১০ বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস দুই চক্ষু প্রদীপ্ত করে জোর গলায় বলে – “আমি কাজের লোক - কাজই ভালোবাসি, খেলা ভালোবাসিনে - তা মনে রেখো বিজয়া।”১১ বিজয়া স্বাভাবিক শান্ত সুরে তার এই কথা গ্রহণ করে। এই কথার মধ্যে যে শ্লেষটুকু ছিল তা বিলাসকে একেবারে উন্মত্ত করিয়া দিল। তাই সে চিৎকার করে বলে আচ্ছা, তুমি যাতে না ভোলো তার আমি চেষ্টা করব। কিছুক্ষণ পর বিজয়া জানায় যে এ বাড়ী যে নিতেই হবে তা কিন্তু এখনো স্থির হয়নি। এই কথা শুনে বিলাস রাগে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। তাই সে রাগে মাটিতে জোরে পা ঠুকিয়া পুনরায় চিৎকার করে বলে – হয়েছে, একশবার হয়েছে। আমি সমাজের মান্য ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করে এনে তাদের অপমান করতে পারব না- এ বাড়ী আমাদের চাইই। এ আমি করে তবে ছাড়ব- এই তোমাকে আজ আমি জানিয়ে গেলুম। বিলাসের এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে এই বাড়ীতে ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করার জন্য সে কতটা উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল। বিজয়ার সাথে বিলাসের এই ঘর দখল করা নিয়ে যে বাকবিতণ্ডা হয় তা চরম পর্যায়ে চলে যায়। তাই তাদের মধ্যে যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল তা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। বিলাস যে মনে মনে বিজয়াকে বিয়ে করার সংকল্প করে তা যেন তার মন থেকে একেবারে শেষ হয়ে যায়। বিজয়া কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তেই অটুট থেকে যায়। বিলাসের ঔদ্ধত্যের কাছে সে কিন্তু মাথা নিচু করেনি। তাই এখানে আমরা বিজয়ার আচরণ দেখে মনে হয় সে একজন মালিকের ভুমিকায় উত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই সে তার কর্মচারীকে গুরুত্বহীন ভাবে দেখতে শুরু করে।
জগদীশ বাবুর বাড়ীটা বিজয়ার দখল করার কোন ইচ্ছেই ছিল না। কারণ তার বাবা মৃত্যুকালে তাকে যে উপদেশ দিয়েছিল তাকে মান্যতা দেবার জন্যই সে এমন আচরণ করে। সেইদিন হতে বিজয়ার মনের মধ্যে এই আশাটা অনুক্ষণ যেন তৃষ্ণার মত জাগছিল যে, সেই অপরিচিত লোকটি যাবার পূর্বে একবার অন্তত তার বন্ধুকে নিয়ে তার কাছে অনুরোধ করতে আসবে। তাদের মধ্যে যা কথা হয়েছিল সমস্ত গুলি তার অন্তরের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটি শব্দ পর্যন্ত বিজয়া ভুলে যায় নাই। বিজয়ার এই আচরণে আমরা লক্ষ্য করে অনুমান করে বলতে পারি যে বিজয়া এই ভদ্রলোকটির প্রতি একটা ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তাই সে তার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। নদী তিরের পথে এখন আর তার সাথে বিজয়ার সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মনে মনে আশা করত যে, একবার না একবার তিনি তার কাছে দেখা করতে আসবেনই। বিলাসের সাথে বিজয়ার যে বিরাট তর্কাতর্কি হয় তা জেনেও রাসবিহারী কোন গুরুত্বই দেয় নি। তাই সে বিজয়ার কাছে এমন ভাব দেখায় যেন ছেলের সঙ্গে যে ইতিমধ্যে তার কোন কথা হয়েছে তার আভাস ছিল না। এই নিয়ে যে আর কোন প্রকার আন্দোলন উঠতে পারে তা যেন তার মনেই আসতে পারে না। তাই বিজয়া তার কাছে নিজেই কথাটা উত্থাপন করিতে পারিল না। পৌষের ঠিক প্রথম দিনটিতে পিতা পুত্র একসঙ্গে বিজয়ার সঙ্গে দেখা করলেন। রাসবিহারী বিজয়াকে জানায় আর বেশি দিন নেই তাই তাড়াতাড়ি সমস্ত গুছিয়ে ফেলতে হবে। বিজয়া তখন একটু বিস্মৃত হয়ে বলে সে নিজের ইচ্ছায় চলে না গেলে, কিছুই হতে পারে না। রাসবিহারী তৎক্ষণাৎ বিজয়াকে জানায় কালকে নরেন বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে। এই কথা শুনে বিজয়ার বুকের ভিতর খুব আঘাত লাগল। রাসবিহারীকে বিজয়া জিজ্ঞাসা করে তার জিনিসগুলোর খবর? এই কথা শুনে বিলাস সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রূপ করে। বিলাসের কথা শুনে বিজয়া চুপ করে থাকে কিন্তু তার মুখের উপর একটা বেদনার চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। তাই বিজয়ার এই দৃশ্য দেখে রাসবিহারী ছেলেকে রেগে গিয়ে বলে – “ওটা তোমার দোষ বিলাস। মানুষ যেমন অপরাধীই হোক ভগবান তাকে যত দণ্ডই দিন, তার দুঃখে আমাদের দুঃখিত হওয়া, সমবেদনা প্রকাশ করা উচিত। আমি বলছিনে যে, তুমি অন্তরে তার জন্যে কষ্ট পাচ্ছ না, কিন্তু বাইরেও সেটা প্রকাশ করা কর্তব্য।”১২ রাসবিহারীর এই কথা দ্বারা বিজয়ার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে নিজের ছেলেকে তার কাছে জাহির করার চেষ্টা করে। বিলাস এরপর নরেনের কথা শুনে রেগে গিয়ে পুনরায় বিজয়াকে বিদ্রূপ করে। তার পিতা তখন বারবার তার এই আচরণে তাকে অপমান করে। পিতার কথা শুনে বিলাস বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা অনুতপ্ত না হয়ে জবাবা দেয় - “পরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, পরের ক্লেশ নিবারন করার শিক্ষা আমার আছে, কিন্তু যে দাম্ভিক লোক বাড়ী বয়ে অপমান করে যায়, তাকে আমি মাফ করিনে। অত ভণ্ডামি আমার নেই।”১৩ তার জবাব শুনে রাসবিহারী ও বিজয়া উভয়েই অবাক হয়ে যায়। বিলাস এরপর বিজয়াকে জানিয়ে দেয় পূর্ণবাবুর ভাগিনেয়টিই যে আসলে জগদীশ বাবুর পুত্র নরেন।
নরেনের এই পরিচয় পেয়ে বিজয়ার সমস্ত মুখ মুহূর্তের মধ্যে একেবারে শুষ্ক বিবর্ণ হয়ে যায়। এদিকে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য জগদীশ বাবুর ঘরটি মন্দিরের জন্য ও ওপর ঘরগুলি অতিথিদের জন্য সজ্জিত করার কাজ চলতে থাকে। এই কাজে বিলাস নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তত্ত্বাবধান করে। নরেনের পরিচয় জানতে পেরেই তার জন্য বিজয়ার মন ছটফট করতে থাকে। তাই সে নরেনের খবর জানার জন্য আকুল হয়ে শেষ পর্যন্ত পরেশকে তার কাছে পাঠায়। নরেনের খবর সে যদি এনে দেয় তবে তাকে একটি কাপড় দেবার লোভ দেখায় বিজয়া। পরেশ যখন এই খবর আনতে গেল তখন থেকেই বিজয়া খবরের আশায় শূন্য দৃষ্টিতে সেইদিকে চেয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইল। নরেনের খবর জানার জন্য বিজায়র কৌতূহল আর ধরা দিচ্ছিল না। তাই সে অধীর আগ্রহে পথপানে চেয়ে রইল। বিজয়ার এই আচরণ দেখে আমরা অনুমান করতে পারি যে নরেনের প্রতি তার মনে একটা দুর্বলতা ছিল। পরেশ এসে বিজয়াকে জানায় নরেন সেখানে নেই, কোথায় চলে গেছে। এই কথা শুনে বিজয়া অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ বারান্দার মধ্যে নরেনের আবির্ভাব ঘটে। সে ঘরে পা দিয়েই হাত তুলে সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াকে নমস্কার করে। নরেন তখন বিজয়াকে বলে আপনি কেন নরেন বাবুর খবর জানতে চান? তার সাথে কি কোন দরকার আছে? আসলে নরেন জানত যে বিজয়া তার প্রকৃত পরিচয় জানে না। তাই বিজয়া নরেনের এই ছলচাতুরী দেখে তাকে বিদ্রুপের সঙ্গে বলে দরকার না থাকলে কেউ কি কারো খবর জানতে চায়? নরেন যখন নিজের পরিচয় ইঙ্গিতে জানায় তখন বিজয়া সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে কারণ সে পূর্বেই বিলসের কাছে এই পরিচয় পেয়েছিল। বিজয়া তখন নরেনকে বলে এই সত্য পরিচয়টি অনেকদিন পূর্বেই আপনার মুখ থেকে বার হওয়া উচিত ছিল। বিজয়ার এই কথা শুনে নরেনের মুখ মলিন হয়ে গেল। বিজয়া তাই নরেনকে বিদ্রূপ করে জানায় - “অন্য পরিচয়ে নিজের আলোচনা শোনা, আর লুকিয়ে আড়ি পেতে শোনা দুটোই কি সমান বলে আপনার মনে হয় না?”১৪ বিজয়ার মুখে এই কথা শুনে নরেন লজ্জায় একেবারে কালো হতে গেল। নরেন এরপর অকপটে জানায় আপনার সঙ্গে অনেকরকম আলোচনার মধ্যে নিজের আলোচনাও ছিল বটে, কিন্তু তাতে আমার মন্দ কোন অভিপ্রায় ছিল না। শেষ দিনটাতে আপনাকে আমার পরিচয় দেব বলে মনেও করেছিলাম কিন্তু হয়ে উঠল না। নরেন এসব কথা বলে নিজের দোষ ত্রুটি সমস্ত স্বীকার করে নেয়। নরেন এরপর বাড়ী যেতে চাইলে বিজয়া তাকে কিছুতেই যেতে দেয় না। তাই বিজয়া তাকে খাবার খাইয়ে তবেই বিদায় করে। নরেনের প্রতি আচরণ দেখে বিজয়ার মনে একটা ভালোবাসার গভীর আকর্ষণ আমরা অনুভব করতে পারি। বিজয়া তখন নরেনকে জিজ্ঞাসা করে সে কবে বর্মায় যাচ্ছে? উত্তরে নরেন জানায় পরশুদিন সে চলে যাবে। এরপর সে বলতে থাকে, তবু আপনার আচরণ দেখে বাইরের কারোর বলবার জো নেই যে আমি আপনার লোক নই। আসলে বিজয়ার সেবাযত্ন দেখে নরেন অভিভুত হয়ে যায়। তাই সে বিজয়ার গুণগান করতে ছাড়ে না। নরেনের যাবার পূর্বে সে বিজয়াকে জানায় আজকের এই দিনটা তার চিরকাল মনে থাকবে। নরেন যাবার সময় বিজয়া তাকে একটু দাঁড়াতে বলে। নরেন ফিরে এসে দাঁড়াতেই বিজয়া তার মাইক্রোস্কোপটা কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাই সে তার দাম জিজ্ঞাসা করে? নরেন উত্তরে জানায় সে পাঁচশো টাকার বেশি দামে তা কিনলেও এখন কিন্তু দু-আড়াইশো টাকায় বিক্রি করতে চায়। নরেনের বিক্রি করার আগ্রহ দেখে বিজয়া খুব ব্যাথিত হয়। এবং জিজ্ঞাসা করে এত কম দামে সেটা বিক্রি করার কারণ? নরেন উত্তরে জানায় যে তার এখন টাকার খুব প্রয়োজন। তাই শুনে বিজয়া ঐ যন্ত্রটা কেনবার আগ্রহ দেখায়। তাই সে পরের দিন এই যন্ত্রটা নরেনকে দেখাতে বলে। পরের দিন দুশো টাকার বিনিময়ে এই যন্ত্রটা নরেন বিজয়াকে বিক্রি করে দেয়। নরেন এই যন্ত্রটা সমস্ত ব্যবহার করতে শিখিয়ে দেয় বিজয়াকে। কিন্তু এই যন্ত্রটা সম্পর্কে বিজয়া কিছুই বুঝতে পারে না। বিজয়া তাই ব্যবহার করতে না পেরে যন্ত্রটিকে খারাপ বলে উপহাস করে। কিন্তু পরক্ষণে যন্ত্রটি নিজের কাছেই রেখে দেয় বিজয়া। সেদিনও বিজয়া নরেনকে ঘরে বসিয়ে না খাইয়ে ছাড়ে না। বিজয়া তখন যন্ত্রটি নিতে চায়নি। বিজয়ার এই ব্যবহার দেখে নরেন রেগে গিয়ে বলে তবে কেন আমাকে এত কষ্ট করে এটা বয়ে নিয়ে আনতে বললে। নরেনের এই কথা শুনে বিজয়া জানায় কষ্ট তো আমার জন্য করেননি, করেছেন নিজের জন্য। নরেনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিজয়া পুনরায় বলে - “আচ্ছা, আমিই না হয় নেব, আপনাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। আপনি খেতে আরম্ভ করুন।”১৫ এই কথা শুনে নরেন নিজেকে অপমানিত বোধ করে বলে আপনাকে আমার প্রতি দয়া করতে তো আমি অনুরোধ করিনি। নরেনের এই কথা শুনে আমরা বুঝতে পারি সে অভিমানের সুরে বিজয়াকে একথা বলে। বিজয়া তখন বিদ্রূপ করে বলতে থাকে আজ না করলেও সেদিন কিন্তু মামার হয়ে অনুরোধ করতে এসেছিলেন। এই কথা শুনে নরেন দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারে - “সে পরের জন্যে, নিজের জন্যে নয়। এ অভ্যাস আমার নেই।”১৬ এই কথাটা যে খুব সত্য তা বিজয়া এতদিন বুঝতে বাকি ছিল না। তাই তার এই কথা শুনে বিজয়ার একটু গায়েও লাগিল। বিজয়া ও নরেনের এই কথোপকথনের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না বরং তাদের মধ্যে একটা অভিমানের ছোঁয়া দেখা যায়। তার একে অপরের প্রতি মনে মনে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। তাই তাদেরকে মাঝে মাঝে ঠাট্টা তামাশা করতেও আমরা লক্ষ্য করি।
বিজয়া যে যন্ত্রটাকে এই মাত্র ভাঙা বলিয়া উপহাস করেছিল তার সাহায্যেই কি অপূর্ব এবং অদ্ভুত ব্যপার না তার দৃষ্টিগোচর হল। নরেন তাকে বোঝাতে শুরু করলে হঠাৎ সে বুঝতে পারে যে বিজয়া তা না শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। বিজয়া প্রত্যুত্তরে জানায় সে তার কথা সব মন দিয়ে শুনছে। নরেন তাকে জিজ্ঞাসা করলে বিজয়া কোন উত্তর দিতে না পেরে জানায় যে একদিনে সব জানা সম্ভব নয়। বিজয়া এরপরে নরেনের কাছে ছবি আঁকা শেখার জন্য কৌতূহল প্রকাশ করে। নরেন তখন জানায় অন্যমনস্ক হয়ে কোন শিক্ষাই শেখা যায় না। আসলে বিজয়া এইসব বলে নরেনের মনটাকে যাচাই করার চেষ্টা করেছিল। বিজয়া যে নরেনকে ভিতরে ভিতরে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল তা তার এই আচরণ দেখেই আমরা অনুমান করতে পারি। বিজয়া তখন ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে আমি যদি কিছুই শিখতে না পারি তবে আমার মাথায় সত্যিই শিং বেরোবে। বিজয়ার এই কথা শুনে নরেন হেসে ফেটে পড়ল, এবং বলল এটাই হল আপনার উচিত শাস্তি। বিজয়া ও নরেনের কথা বলতে বলতে রাত্রি হয়ে যায়। তাই বিজয়া উঠে গিয়ে আলো আনতে যায়। বিজয়া দ্রুতপদে বাহির হতেই সম্মুখেই রাসবিহারী ও বিলাসকে বসে থাকতে দেখে অকস্মাৎ যেন ভূত দেখে থেমে গেল। বিলাসের মুখের উপর কে যেন এক ছোপ কালি মাখিয়ে দিয়েছে। বিজয়ার নরেনের সাথে মেলামেশা দেখে বিলাস খুব রেগে যায়। কারণ সে বিজয়াকে নিজের বাগদত্তা হিসাবে মনে করত। কিন্তু বিজয়া যে তাকে অন্তর থেকে ভালবাসত না এটা তার ধারনা ছিল না। রাসবিহারী তখন বিজয়াকে জানায় তারা প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছে। তুমি ওঘরে নরেনের সাথে ব্যাস্ত থাকায় আমরা তোমাকে ডাকি নি। রাসবিহারী তখন বিজয়াকে বলে নরেন তোমার কাছে কি চাইতে এসেছে? পাশের ঘরে যেন শব্দ না পৌঁছায় তার জন্য বিজয়া মৃদুস্বরে জানায় একটা মাইক্রোস্কোপ উনি বিক্রি করে বর্মায় যেতে চান। সে যন্ত্রটিই তিনি আমাকে দেখাচ্ছিলেন। বিলাস এই কথা শুনে গর্জন করে বলে – ঠকাবার আর জায়গা পেলে না। বিলাসের কথা অগ্রাহ্য করে বিজয়া জানিয়ে দেয় সেই যন্ত্রটি সে নিতে চায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিলাস যে চেঁচামেচি করে নরেনকে বিদ্রূপ করতে থাকে তা নরেন ওঘরে বসে শুনতে পায়। বিলাসের ইচ্ছায় ছিল যাতে তার সব কথা ওঘরে পৌঁছায়। রাসবিহারী সব কথা শুনে কালিপদকে বলতে পাঠায় যে এসব ফন্দি এখানে খাটবে না। কিন্তু যাকে বলতে হবে সে নিজের কানেই সমস্ত শুনেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই কালিপদ যাওয়ার উপক্রম করতেই বিজয়া তাকে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জানায় তুমি শুধু আলো দিয়ে এসো গে, যা বলবার আমি নিজেই বলব। বিলাস তখন শ্লেষের সঙ্গে পিতাকে বলে - “কেন বাবা, তুমি মিথ্যে অপমান হতে গেলে ওর হয় ত এখনো কিছু দেখিয়ে নিতে বাকি আছে।”১৭ এও কথা শুনে রাসবিহারী কোন কথা বললেন না। কিন্তু ক্রোধে বিজয়ার মুখ রাঙা হয়ে গেল। এটা বিলাস লক্ষ্য করেও মাইক্রোস্কোপ নিয়ে নানারকম বিদ্রূপ করে জোরে জোরে হাসতে লাগল। নরেনকে বিজয়ার কাল খাওয়ানোর কথা সে জানতে পেরেছিল এবং আজ তাদের উচ্চহাস্যও সে নিজের কানে শুনেছিল। তাছাড়া বিজয়ার আজকের বেশভূষার পারিপাট্যও দেখে বিলাস আশ্চর্য হয়ে গেল। এই সব দেখে শুনে বিলাস ঈর্ষায় জ্বলে মরতেছিল। তাই তার দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিল না। কারণ এই সব দেখে বিলাস অনুমান করতে পেরেছিল যে নরেনকে বিজয়া মনের মধ্যে স্থান দিয়ে দেয়। বিজয়ার আচরণ দেখে সে অনুমান করে যে নরেনের প্রতি গভীরভাবে বিজয়া প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। বিজয়া যে তাকে একেবারে গুরুত্বই দিতে চায়নি সেটাও বিলাস বুঝতে পারে। রাসবিহারী যখন বিজয়াকে জানায় যে নরেনকে বল কাল এসে যেন টাকাটা নিয়ে যায়। বিজয়া তখন বলে যে আপনার সঙ্গে আমি কাল কথা বলব। কারণ তার বাড়ী যেতে রাত হয়ে যাচ্ছে – আবার অনেক দূরে যেতে হবে, তাই ওর সঙ্গে আমার কিছু আলোচনা করবার আছে। বিজয়ার এই কথা শুনে বৃদ্ধ রাসবিহারী মনে মনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেও বাইরে তার কোন প্রকাশ করলেন না। তিনি চেয়ে দেখলেন তার পুত্রের চোখ দুটি অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝক ঝক করছে এবং কি একটা বলবার জন্য যেন যুদ্ধ করছে। পুত্রের এই অবস্থা লক্ষ্য করে রাসবিহারী পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে কালকে আসার কথা বলেই চলে গেল। বিজয়া এরপর নরেনের কাছে গিয়ে বলে আপনি সমস্ত কথা নিজের কানে শুনেছেন বলেই বলছি যে, আপনার সম্বন্ধে তারা যে সব অসম্মানের কথা বলেছেন, যে তাদের অনধিকার চর্চা। বিজয়ার এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে নরেনের প্রতি কতটা সহানুভূতিসম্পন্ন। তাই বিজয়া তাদের অপকর্মের জন্য প্রতিশোধ নেবারও কথা ঘোষণা করে। কারণ তার ভালোবাসার মানুষকে অপমান করায় তার মনে খুব আঘাত লাগে। কিন্তু নরেন তার জন্য তাদের সাথে বিজয়া কোন খারাপ ব্যবহার করে এটা করতে সে নিষেধ করে। নরেন এরপর যেতে চাইলে, বিজয়া তাকে কাল বা পরশু একবার আসবার জন্য অনুরোধ করে। উত্তরে নরেন জানায় তার সময় হবে না। এই কথা শুনে বিজয়ার দুই চোখের মধ্যে জল পড়িতে লাগিল। বিজয়াকে কোন কথা বলতে না শুনে নরেন মনে করে সে তার প্রতি রাগ করেছে। তাই নরেন তাকে বলে আপনি নিজে এত হাসতে পারেন, আর আপনারই এত সামান্য কথায় রাগ হয়? নরেন এরপর তাকে জানায় যে আপনাকে আমার সর্বদা মনে পড়বে- আপনি ভারি হাসতে পারেন। নরেনের এই শেষ কথা শুনে বিজয়ার চোখের জল বাগ মানতে না পেরে টপটপ করে মাটির উপর ঝরে পড়ল। হাত দিয়ে মুছতে গেলে পাছে নরেন বুঝতে পারে তাই নিঃশব্দে নতমুখে দাড়িয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নরেন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বিজয়ার চিবুক তুলে ধরে লক্ষ্য করলেন যে বিজয়া কাঁদছে। তখন বিজয়া দ্রুতবেগে পিছনে গিয়ে তার চোখ মুছে ফেলল। বিজয়ার এই কান্নার কারণ নরেন তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। এইসব ব্যাপার তার বুদ্ধিতে বোঝা গেল না। বিজয়া যে নরেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে হারানোর আশঙ্কায় কেঁদে ওঠে তা সে কোনমতেই অনুমান করতে পারেনি। কারণ নরেনের এই ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। বিজয়া নরেনকে মাইক্রোস্কোপের ব্যাগটা হাতে তুলতে দেখে রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠে ওটা আমার, আপনি রেখে দিন। এই কথা বলেই বিজয়া কান্না আর চাপাতে না পেরে দ্রুতপদে ঘর হতেই বেরিয়ে গেল। বিজয়ার এই আচরণ খুব গভীর ভালোবাসার লক্ষণ। কাউকে অন্তর থেকে ভালো না বাসলে এইভাবে তার উদ্দেশ্যে কাঁদতে পারা সম্ভব নয়। তাই এখানে আমরা স্পষ্টই অনুভব করি থাকি বিজয়া নরেনকে গভীরভাবে ভালোবাসে। অনুভুতি লক্ষ্য করা যায় না একথা অস্বীকার করা যাবে না।
বিলাসবিহারীর প্রচণ্ড কীর্তিতে পল্লীগ্রামে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার শুভদিন আগত হয়ে গেল। একে একে সমস্ত অতিথিগনের সমাগম ঘটতে লাগল। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে সমস্ত অতিথিদের কাছে রাসবিহারী ঘোষণা করে দেয় যে বিলাস ও বিজয়া কিছুদিনের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। এই কথা শুনে বিজয়া ক্ষোভে, বিরক্তিতে, ভয়ে তার কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। কিন্তু সে স্পষ্টভাবে কিছু প্রকাশ করল না। বিজয়ার এই মৌন অবস্থাকে রাসবিহারী তার সম্মতি হিসাবে মেনে নেয়। তাই সে অথিতিদিগকে জানিয়ে দেয় যে ফাল্গুন মাসেই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হবে। বিজয়া সঙ্গে সঙ্গে বাবার মৃত্যুর এক বছরের কথা বলতেই রাসবিহারী সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে তা বৈশাখ মাসে হবে। রাসবিহারী এরপর বিজয়াকে জানিয়ে দেয় তিনি নরেনকে তার টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন তাই বিজয়া যেন আর তা না দেয়। এই কথা শুনে বিজয়া বলে তিনি দুবার নেবার লোক নন। এমন একদিন ছিল, যখন বিলাসের হাতে আত্মসমর্পণ করা বিজয়ার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ছিল না। কিন্তু আজ শুধু বিলাস কেন পৃথিবীর কোন লোকের মধ্যে কেবল একটিমাত্র লোক ছাড়া আর কেহ স্পর্শ করেছে একথা ভাবলেও তার সর্বাঙ্গ ঘৃণায় ও লজ্জায় এমনকি পাপে সে ভয় পেয়ে গেল। তাই শুধুমাত্র নরেনকেই মনে মনে চিন্তা করতে থাকে। বিলাসের সাথে বিজয়ার বিয়ে পাকা হলেও কিন্তু তাকে মনে মনে ঘৃণা করত। তাই আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পাই দয়াল ও তার ভাইঝি নলিনী কৌশলে বিজয়ার সাথে নরেনের বিয়ে দেয়। তার আগে আমরা দেখতে পাই বিলাসের সাথে বিজয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্য তাদের মেলামেশা বেড়ে যায়। এইজন্য বিজয়াকে বিরক্ত না করে নরেন তাদের বাড়ীতে যাওয়া আসা প্রায় ছেড়ে দেয়। কিন্তু দয়াল বাবুর বাড়ীতে তার তার যাতায়াত বাড়তে থাকে। এই জন্যই নরেনের সঙ্গে দয়ালের ভাইঝি নলিনীর মেলামেশাতে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা অনুমান করে বিজয়া ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিন্তু দয়ালবাবু বিজয়ার বাবার পুরানো পত্র দেখে যে তিনি তার মেয়েকে জগদীশ বাবুর ছেলের সাথে বিয়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। তাই তিনি কোন ভুল না করে স্বর্গীয় বনমালীবাবুকে শ্রদ্ধা জানাতেই এরপর বিজয়াকে নরেনের সাথে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। দয়ালবাবু ও তার ভাইঝির সাহায্য নিয়ে অবশেষে বিজয়া ও নরেনের বিবাহ সম্পন্ন করে। বিজয়া তার ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়।
তথ্যসূত্র
১. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড), অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯, দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা-৩৩৪
২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪০
৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪২
৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪৩
৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪৪
৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫১
৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
৮. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
৯. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
১০. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৪
১১. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৪
১২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৫
১৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৫
১৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৯
১৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৫
১৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৫
১৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৭











