** আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত **

কিছু কথা....

আপনাদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করতে হলে লেখাটি আমাকে ইমেইল করুন। আমি সেটা নির্দিষ্ট বিভাগে, আপনার নাম দিয়ে প্রকাশ করবো।

আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?

!! আমার ব্লগের সাথে যুক্ত থাকুন !!

ইমেইল এর মাধ্যমে সমস্ত পোষ্টের নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য, নিচের ফাঁকা ঘরে আপনার ইমেইল এড্রেস লিখে ‘সাবস্ক্রাইব’ বাটন-এ ক্লিক করুন।

Blank

Comming Soon

কবিতা সমগ্র

আমার নিজের ও কবিদের লেখা কবিতার সংরক্ষণ

Sunday, July 22, 2018

‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


          রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস। যোগাযোগ যখন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় (আশ্বিন ১৩৩৪ হইতে চৈত্র ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় তখন এর নাম ছিল ‘তিনপুরুষ’। বিশ্বকবির ইচ্ছা ছিল এই উপন্যাসের কাহিনী সুত্র তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবেন। কিন্তু অল্প রচনা করেই তার সেই ইচ্ছার বদল ঘটে। যে অবিনাশ ঘোষালের বত্রিশ বৎসরের জন্মদিনের প্রসঙ্গ নিয়ে উপন্যাসের শুরু হয়েছিল তার জন্মের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েই বিশ্বকবি উপন্যাসের কাহিনীর ইতি করে দিলেন। এই কারনেই দুই তিন সংখ্যায় বাহির হইবার পর কবি উপন্যাসের নামের পরিবর্তন করে ‘যোগাযোগ’ রাখলেন। যোগাযোগ উপন্যাসটির কাহিনী সুত্র লেখক ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতেই রচনা করেছেন। এই উপন্যাসের মুল চরিত্র দুটি হল মধুধুসুদন ঘোষাল এবং তার স্ত্রী কুমুদিনী। এই উপন্যাসে নরনারীর হৃদয় দ্বন্দ্বের অবসানের বহু বহু পরের ঘটনাই রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথমে উল্লেখ করেছেন। যার ফলে তিনি পূর্বের ইতিহাস পরে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেছেন – “কিন্তু আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যা বেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো।”৩১ উপন্যাসটিতে আমরা অবলোকন করতে পারি তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সাথে ধনতান্ত্রিক সমাজের লড়াই। উপন্যাসে বিপ্রদাস চ্যাটার্জি হল সামন্ত তন্ত্রের প্রতিভূ এবং মধুসূদন ঘোষাল ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বেকার একটা সংঘর্ষ বিদ্যমান ছিল। এই পূর্বের সংঘাতের প্রতিশোধ নেবার জন্যই মধুসূদন তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্রদাসের বোন কুমুদিনীকে বিয়ে করতে রাজী হয়। বিপ্রদাস এই অভিসন্ধির কথা বুঝতে পেরে তাতে রাজী ছিল না। কিন্তু কুমুদিনীর জেদের কাছে তাকে হার স্বীকার করতে হয়। প্রবল আবেগের বশে কুমুদিনী মধুসুদনের সাথে বিয়ে করতে এককথায় রাজী হয় যায়। ফল স্বরূপ বিবাহের পর থেকেই মধুসূদন ও কুমুদিনীর সংসারে অশান্তির ছায়া নেমে আসতে শুরু করে। তাই তাদের দাম্পত্য জীবন একদিনের জন্যও সুখের হতে পারেনি। মধুসূদন ও কুমুদিনীর দাম্পত্য জীবনের কাহিনীই এই উপন্যাসের মুখ্য বিষয়। তাই আমরা এখানে মধুসূদন ও কুমুদিনীর দাম্পত্য কলহের চিত্র নানান দিক দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করব।

          উপন্যাসের প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় মধুসুদনের বংশ পরিচয় ও পূর্ব ইতিহাসের বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় থেকে নবম অধ্যায় পর্যন্ত কুমুদিনীর পৈতৃক ইতিহাসের বর্ণনা করা হয়েছে। আসলে উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র মধুসূদন ও কুমুদিনীর পরস্পর সম্পর্কের বিশেষত্ব টুকু বুঝিবার জন্য লেখক এই বর্ণনা করেছেন। দুই বংশের পূর্ব ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে তাদের উভয়ের মধ্যে অতীতে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। পূর্বে চাটুজ্যেদের বেশি ধনসম্পদ থাকার জন্য ঘোষালরা তাদের সঙ্গে কোনদিক দিয়েই পেরে ওঠে না। বারবার চাটুজ্যেদের কাছে ঘোষলরা পরাস্ত হয়। তাই সেই পূর্বের দ্বন্দ্বের হার ঘোষালরা কিন্তু মনে প্রানে ভুলতে পারে না। তাই লেখক একজায়গায় বলেছেন – “যারা মারে তারা ভোলে, যারা মার খায় তারা সহজে ভুলতে পারে না।”৩২ অতীতে আমরা দেখতে পাই চাটুজ্যেরা অর্থের জোরে শত অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে যায়। কিন্তু চিরদিন সবার সমান চলে না আর তাই এখানেও তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি। ভাগ্যের চাকার পরিবর্তনে ঘোষালদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ঘোষালদের এই পরিবর্তন মধুসূদন ঘোষালের হাত ধরেই ঘটে। মধুসূদন ব্যবসা বানিজ্য করে হঠাৎ খুব ধনী হয়ে যায়। পরিবর্তে বিপ্রদাস চাটুজ্যের ধার দেনায় আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে দেখা যায়। মধুসুদনের ব্যবসা বানিজ্যে উন্নতি দেখে তার মা তাকে বিয়ে করতে বলে। কিন্তু মধুসূদন কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হয়নি। এতে তার মায়ের মন হতাশ হয়ে যায়। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন মধুসুদনের মনের পরিবর্তন হয়। যার ফলে সে নিজেই তার বিয়েতে সম্মতি জানায়। একথা শুনে মধুসুদনের আত্মীয়স্বজন সবাই খুব খুশি হয়। তার বিয়ের জন্য নানাদিকে মেয়ে দেখা শুরু হয়। ঘটক নানাদিক থেকে অনেক কুলবতী, রূপবতী, ধনবতী, গুনবতি,বিদ্যাবতী কুমারীদের খবর নিয়ে আসে। কিন্তু কিছুতেই মধুসুদনের মেয়ে পছন্দ হয় না। অবশেষে মধুসূদন দৃঢ়কণ্ঠে জানায় যে বিয়ে যদি তাকে করতেই হয় তবে চাটুজ্যেদের মেয়ে বিপ্রদাসের বোন কুমুদিনীকেই করবে। মধুসূদন তাই বলতে পারে - “ঐ চাটুজ্যেদের ঘরের মেয়ে চাই।”৩৩ মধুসুদনের এই কথার মধ্যে অনুমান করা যায় যে পূর্বের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্যই তার এই সিন্ধান্ত। তাই তো উপন্যাসে লেখককে বলতে শুনি - “ঘা খাওয়া বংশ, ঘা খাওয়া নেকড়ে বাঘের মতো, বড়ো ভয়ংকর।”৩৪

          উপন্যাসের দশম পরিচ্ছেদে আমরা লক্ষ্য করতে পারি ক্ষয়িষ্ণু বিপ্রদাসের কাছে হঠাৎ নীলমণি ঘটকের আবির্ভাব। ঘটক বিপ্রদাসকে বলে যে কুমুর জন্য এক ভালো পাত্রের সন্ধান আছে যা তাদের ঘরেরই উপযুক্ত। বিপ্রদাস তখন সেই সৎপাত্রের নাম জানতে চায়। উত্তরে ঘটক মধুসূদন ঘোষালের নাম বলতেই সঙ্গে সঙ্গে বিপ্রদাস তা অস্বীকার করে। বিপ্রদাসের এই বিয়েতে অস্বীকারের কারণ হল সে পূর্বেই মধুসূদনকে চিনত যে তিনি খুব একটা ভালো প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না। তাই বিপ্রদাসের সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা দেরি হয় নি। তাই বিপ্রদাস রাজী যে নয় তা অপ্রত্যক্ষ ভাবে জানায় - “বয়সের মিল আছে এমন মেয়ে আমাদের ঘরে নেই।”৩৫ ঘটক কিন্তু এই বিয়েতে বিপ্রদাসকে রাজী করাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। ঘটক তাই মধুসুদনের নানারকম গুণগান করে বিপ্রদাসের মন ভোলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তবুও সে বিপ্রদাসকে কোন অবস্থাতেই রাজী করাতে পারলেন না। প্রথমবারের আগমনে সফলতা না পাওয়ায় নীলমণি ঘটককে দ্বিতীয়বার বিপ্রদাসের বাড়ীতে আসতে হয়। এতেই আমরা অনুমান করতে পারি যে এই বিয়েটা সম্পন্ন করতে ঘটক কতখানি বদ্ধপরিকর। দ্বিতীয়বার নীলমণি ঘটকের আগমনে তাই বিপ্রদাস কোন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। যার ফলে বিপ্রদাসের মনে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। তাই সে বাধ্য হয়ে বোন কুমুদিনীর সাথে আলোচনা করতে বাধ্য হয়। প্রথমবার ঘটকের সঙ্গে মধুসুদনের আলোচনা শুনেই কুমদিনী দৈব্যের উপর ভরসা করেই এই বিয়েতে মানসিক ভাবে রাজী হয়ে যায়। কুমুর স্বভাবের প্রধান গুন ছিল দৈব্য নির্ভরতাবশতঃ তাই বিয়েতে মনে মনে রাজী হয়ে যায়। বিবাহ যে জীবনের কি জিনিস তা কুমুর ধারণার মধ্যে ছিল না। সাধারন কোন ঘটনার মতোই বিবাহকে সে মনে করত। বিবাহ ব্যপারে নিজের যে একটা পছন্দ – অপছন্দ বলে উপসর্গ আছে এসব ধ্যান ধারণা কখনই কুমুর মাথায় আসেনি। তাই কুমুদিনী তার দাদাকে নিঃসংশয়ে বলতে পারে - “যার কথা বলছ তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ঠিক হয়েই গেছে।”৩৬ বিপ্রদাস কুমুর এই কথা শুনে তাকে এ ব্যাপারে ভালো করে বিচার বিশ্লেষণ করে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে অনুমতি দেয়। কিন্তু কুমু সঙ্গে সঙ্গে বলে যে তার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা সে নিয়েছে। প্রমান স্বরূপ কুমু দাদাকে সৎসাহসের সঙ্গে বলতে পারে - “আমি তোমার এই পা ছুঁয়ে বলছি, আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”৩৭ কুমুর এই কথা শুনে বিপ্রদাস ভয়ে চমকে উঠে। কিন্তু বিপ্রদাস নিজেকে নিঃসহায় বলে মনে করে। সে বুঝতে পারে যে এটা তার এক্তিয়ার ভুক্ত নয়। তাই তাকে গুমরে গুমরে মরতে হয়। বিপ্রদাস যেহেতু বোনের স্বভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল তাই অনুমান করতে পারে যে কুমু দৈব্য সংকেতেরবশেই মধুসূদনকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। বিপ্রদাস কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। তাই সে ক্রমাগত কুমুকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল । কিন্তু কুমু কিছুতেই তার সিধান্তের পরিবর্তন করতে রাজী হল না। অবশেষে বিপ্রদাস তার বোনের সিন্ধান্তকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হল। যার ফলে কুমুদিনী ও মধুসূদনের বিয়ের প্রস্তাব প্রায় পাকা হয়ে গেল। এর পরেই বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিল। মধুসূদন যেহেতু খুব ধনবান ব্যক্তি তাই সে বিয়েতে অনেক খরচ পত্র করার জন্য প্রস্তুতি নিল।

          মধুসূদন ও কুমুদিনীর বিয়ের প্রস্তাব পাকা হওয়ার সাথে সাথেই দু-পক্ষের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। বিয়ের অনুষ্ঠিত জায়গাকেই কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে। কিছুদিন দু- পক্ষের এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা হওয়া সত্ত্বেও অবশেষে বরপক্ষের জেদের কাছে বিপ্রদাসকে নতি স্বীকার করতে হয়। তাই বিয়ের অনুষ্ঠানের স্থান ঠিক হয় হুগলীর নুর নগরে যা মধুসূদনের পৈতৃক ভিটা ছিল। এদিকে বিয়ের কথা চিন্তা করে কুমুদিনীর সর্বাঙ্গে একটা নতুন প্রানের রঙ লাগল। আপন মনগড়া মানুষের সঙ্গে মিলনের আনন্দ তাকে অহরহ পুলকিত করে তোলে। কুমুদিনী মধুসূদনের নাম শুনেই তাকে মনে মনে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। এমনকি কুমুদিনী তাকে দেবতার আসনে স্থান দিয়েছিল। বহুপূর্বে নুরনগরের পাশে শেয়াকুলি গ্রাম ঘোষালদের দখলে ছিল। কিন্তু দুই বংশের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে ঐ গ্রামের দখল কেড়ে নেয় চাটুজ্যেরা। তাই মধুসূদন সেই পূর্ব প্রতিশোধ স্পৃহার জন্যই বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান সেইখানেই করতে চায়। মধুসূদনের এই সিন্ধান্ত শুনে সবাই অনুমান করতে পারে যে চাটুজ্যেদের উপর টেক্কা দেবার জন্যই মধুসূদনের এই পরিকল্পনা। এই সিন্ধান্তের ফলেই দুই পক্ষের মধ্যে মন কষাকষি হতে দেখা যায়। মদুসুদন অর্থের অহংকারে যে এই স্পর্ধা দেখায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই পক্ষের বিবাদের সুচনা দেখে কন্যাপক্ষের সবাই এর জন্য কুমুদিনীকে দায়ী করে। কুমু তার নিজের বদনাম সবার মুখে বারবার শুনে নিজেকে লজ্জিত মনে করে। ফলে কুমু মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। তাই কুমু মধুসূদনকে আর দেবতার আসনে স্থান দিতে পারে না। এই জায়গা থেকেই আমারা অনুমান করতে পারি যে কুমুদিনীর মনে মধুসূদনের উচ্চস্থান ক্রমাগত লোপ পেতে থাকে। তাই কুমু রুদ্ধস্বরে দাদাকে বলতে পারে - “দাদা, কিছুই বুঝতে পারছি নে।”৩৮ কুমু একথা বলেই কাপড় দিয়ে কেঁদে উঠল। বিপ্রদাস তখন বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে - “লোকের কথায় কান দিস নে বোন।”৩৯ বিপ্রদাসের সান্ত্বনা সত্ত্বেও কুমুর মনে দ্বিধা দেখা যায়। কুমুর মনে দ্বিধা দেখে তাই বিপ্রদাস বলে-“তোর মনে যদি একটুও খটকা থাকে বিয়ে এখনো ভেঙ্গে দিতে পারি।”৪০ দাদার এই কথা শুনে কুমুদিনী লজ্জায় পড়ে যায়। বিয়ের দশদিন আগে গোপনে অসুস্থ শরীর নিয়ে বিপ্রদাস মধুসূদনকে স্টেশনে অভ্যর্থনা জানাতে যায়। কিন্তু মধুসূদন সেখানে বিপ্রদাসকে নানারকম ভাবে অসম্মান করে। মধুসূদন ও বিপ্রদাসের কথায় আমরা দ্বন্দ্বের রূপ লক্ষ্য করি। বিপ্রদাস এইসব ঘটনা প্রকাশ না করে গোপনেই রেখে দেয়।

          নুরনগরে এসে বরযাত্রীরা নানা জায়গায় পাখি হাঁস ইত্যাদি শিকার করে এলাকাবাসীকে জ্বালাতন করে তোলে। দিন দিন এই ঘটনার ফলে গ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। এই কথা বিপ্রদাসের কানে গেলে সে চুপ করে থাকে এবং অন্যদেরও শান্ত থাকতে অনুরোধ করে। কারণ সে চাইছিল যে বিয়ের আগে যেন আর নতুন করে কোন সংঘাতের সৃষ্টি না হয়। বিয়েটা যাতে সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন হয়ে যায়। বরপক্ষের এই অত্যাচারের কথা কুমুদিনীর কানে পৌঁছালে সে আর ঠিক থাকতে পারে না। তাই সে দাদাকে অনুরোধ করে জানায় বরপক্ষের এই আচরণ নিয়ন্ত্রন করার জন্য। কিন্তু বিপ্রদাস বোনকে উত্তরে জানায় বরপক্ষের ভুল বোঝার জন্য একথা না বলাই শ্রেয়। দাদার এই সিদ্ধান্তকে কুমু কিছুতেই মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি। কুমু দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারে – “তা বুঝুক ভুল। মান-অপমান শুধু ওদের একলার নয়?”৪১ কুমুর এই কথা শুনে বিপ্রদাস বোনকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বিবাহের দুই দিন আগে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান অয়োজন করা হল। বরের বাসা থেকে দামি গয়না থেকে আরম্ভ করে খেলার পুতুল পর্যন্ত সওগাতের ঘটা দেখে কন্যাপক্ষের সকলে অবাক হয়ে গেল। অবশেষে লোক জনকে খাওয়ানকে কেন্দ্র করে বৈবাহিক কুরুক্ষেত্রের সৃষ্টি হল। এই সব ঘটনা দেখে মধুসূদনের ছোট ভাই রাধু রাগে গর্জে করে উঠে। তাই সে দাদাকে বিয়ে না করে চলে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু মধুসূদন রেগে গিয়ে তা অস্বীকার করে। মধুসূদনের মনোভাব দেখে অনুমান করা যায় যে একশো বছর পূর্বে চাটুজ্যেরা যে রকম আড়ম্বর করে ঘোষালদের জ্বালাতন করেছিল তারই প্রতিশোধ নেবার জন্যই মধুসূদন এই বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিপ্রদাসে শরীর অসুস্থ থাকার জন্য বিয়ের সময় সে রোগশয্যায় পড়ে গেল। তার জন্যই কিছুটা সৌজন্যের জন্য মধুসূদন বরযাত্রীদের কনে বাড়ীতে যাবার পথে বেশি ধূমধাম করতে নিষেধ করে দেয়। বিয়ে সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকার কারনে কুমুদিনীর সর্বশরীর কাঁপতে শুরু করল। দাদার ভগ্ন শরীর দেখে কুমুদিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ছোটবেলা থেকেই কুমুদিনীর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল দাদা বিপ্রদাস। তাই কুমুদিনী ছিল একেবারে দাদা অন্তপ্রান। কারণ ছোটবেলা থেকে সে দাদার কাছেই শিক্ষাদীক্ষা আচার-আচরণ আদর্শ সমস্ত শিখে বড়ো হয়ে উঠেছিল। তাই কুমুদিনী দাদার আদর্শকে পাথেয় করে চলতে শুরু করে।

          স্বামীর আচার আচরণ দেখে কুমু তাকে ভয় করতে শুরু করে। এইকথা ভেবেই বিয়ের সময় কুমুর মনে হয় তার জন্য বাসা নেই, আছে ফাঁস। মধুসূদন খুব কঠিন মনের মানুষ তা কুমুর বুঝতে বাকি থাকে না। বিবাহটা এমন ভাবে সম্পন্ন হল যে সকলের মন খারাপ হয়ে গেল। বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের প্রথম সংস্পর্শ মাত্রই এমন একটা বেসুর বাজনা ঝনঝনিয়ে উঠল যে তার মধ্যে উৎসবের সংগীত কোথায় গেল তলিয়ে। বিয়ের পর কুমুর মনে মনে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হল। তাই সে মনে মনে ভাবল তবে কি তাকে ঠাকুর প্রতারণা করলেন? কুমু এতটা ভেঙ্গে পড়েছিল যে নিজের প্রতি আর আস্থা রাখতে পারছিল না। সে নিজেকে আর ক্ষমা না করতে পেরে আত্মদহনে দগ্ধ হতে থাকে। তাই সে মনে করে তার সবচেয়ে বড় ভুল দাদার কাছে সংশয় লুকিয়ে রাখা। জ্বরের জন্য বিপ্রদাস বিবাহ সভায় উপস্থিত থাকতে পারল না। যদিও বিবাহ প্রায় সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল। বিবাহের পর দাদার অসুস্থতার জন্য কুমু দাদার কাছে দুইদিন থাকার জন্য স্বামীর কাছে মিনতির স্বরে আবেদন জানাল। কুমুর এই আবেদনে মধুসূদন রাজী হল না। স্বামীর এই আচরণে কুমু খুব দুঃখ পেল। ফলে কুমুর মনে স্বামীর প্রতি যেটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিল সেটুকুও ক্ষীণ হতে শুরু করল। এই ঘটনার ফলস্বরূপ নব দম্পতির দাম্পত্যজীবনে চিড় ধরতে শুরু করে। দাদার কাছে থেকে কুমু যে তার সেবা করতে পারবে না একথা মনে করে সে দুঃখে কাতর হয়ে পড়ে। কুমু শ্বশুরবাড়িতে যাবার আগে তাকে শেষবারের মতো দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে বিপ্রদাস। কিন্তু সে জানতে পারে যে কুমুর যেতে আর বেশি দেরি নেই। তাই দুঃখের সহিত বিপ্রদাস বলতে পারে – “না, এখানে ওর সময় ফুরোল। উনিশ বছর কাটতে পেরেছে, এখন এক ঘণ্টাও আর কাটবে না।”৪২ বিদায়ের সময় স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে বিপ্রদাসকে প্রনাম করতে আসে। মধুসূদন ভদ্রতা করে বললো – “তাই তো, আপনার শরীর তো ভালো দেখছি নে।”৪৩ উত্তরে বিপ্রদাস জানায় ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুণ। দাদাকে নিজের শরীরের উপর যত্ন নেওয়ার কথা বলেই কুমু দাদার পায়ের কাছে পড়ে কাঁদতে লাগল। হুলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি ঢাক কাঁসর নহবতের আওয়াজে সাইক্লোন ঝড় উঠল। নব দম্পতি এখান থেকে চলে গেল। তাদের চলে যাবার দৃশ্যটা দেখে বিপ্রদাসের বীভৎস লাগল। পূজা অর্চনায় বিপ্রদাসের কোন উৎসাহ না থাকলেও আজ ঠাকুরের কাছে হাত জোড় করে মনে মনে তাদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করতে লাগল। বিবাহের লঙ্কাকাণ্ডের সব শেষ অধ্যায়টা এখনো বাকী। বরকনের যাত্রা করার সময় ছিল সকালবেলা কুশণ্ডিকা সেরে। নবগোপাল তার জন্যই সব উদ্যোগ ঠিক করে রেখেছে। এমন সময় হঠাৎ মধুসূদন জানিয়ে দিল কুশণ্ডিকা হবে বরের ওখানে, মধুপুরীতে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে আবার একটা নতুন সংঘাতের সৃষ্টি হল। এই ঘটনায় বাপের বাড়ীর অপমান বুঝতে পেরে কুমুর মন অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে গেল। সে নিজেকে মনে মনে অপরাধিনী ভাবতে শুরু করল তার সমস্ত পূর্বপুরুষদের কাছে। কুমু মনে মনে তার ঠাকুরের প্রতি অভিমান করে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল - “আমি তোমার কাছে কী দোষ করেছি যে জন্যে আমার এত শাস্তি! আমি তো তোমাকেই বিশ্বাস করে সমস্ত স্বীকার করে নিয়েছি।”৪৪

          শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় কুমুদিনী মেয়েদের দলের গাড়িতে ছিল। তাদের সাথে যেতে যেতে নিজের সম্বন্ধে নানারকম কটূক্তি শুনে নিজেকে বিরক্ত বোধ করল। তাই কুমুদিনী গাড়ীর জানালার বাইরের দিকে চেয়ে থাকার চেষ্টা করল। যাতে তাদের কথাবার্তা তার কানে না পৌঁছায়। কুমু খুব দয়ালু ছিল তাই পথের মধ্যে এক অনাথিনী মেয়েকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দশটাকা অর্থ সাহায্য করে। এই জন্য তাকে গাড়ীর অন্য মেয়েদের কাছ থেকে অনেক কটূক্তি সহ্য করতে হয়। একজন মেয়ে বলে উঠে - “টাকা ওড়াতে শিখেছে, রাখতে শিখলে কাজে লাগত।”৪৫ কুমুর এই আচরণকে বাকীরা তার দেমাক বলেই মনে করল। কারণ তাদের মনে হল বাবুরা যাকে এক পয়সা দিয়ে সাহায্য করল না ইনি তাকে হঠাৎ ঝনাৎ করে দশ টাকা ফেলে দিয়ে নিজের গুমোরের পরিচয় দিলেন। কুমুর এই আচরণকে তারা কিছুতেই সহজ ভাবে মেনে নিতে পারল না। তাই তাদের মনে হল এটাও বুঝি সেই চাটুজ্যে – ঘোষালদের চিরকেলে রেষারেষির একটা অঙ্গ। কুমুর এই অসহায় অবস্থার সময় তার মেজো জা নিস্তারিণী বা মোতির মা তার উপর যথেষ্ট সহানুভূতি দেখায়। কুমু তার কাছেই এই প্রথম জানতে পারে যে তার দাদা কাউকে না জানিয়ে স্টেশনে বরযাত্রীদের অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল। একথা শুনে কুমু অবাক হয়ে যায়। মোতির মা বিপ্রদাসের খুব প্রশংসা করল। দাদার প্রতি প্রশংসা বাক্য শুনে কুমুর মন গলে গেল। মোতির মা বুঝতে পেরেছিল যে দাদার প্রতি কুমুর দরদ বেশি, তাই সে নানারকম করে তার দাদার কথাই আলোচনা করতে লাগল। মোতির মা এতে কুমুকে অসহায় অবস্থা থেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। আলোচনায় মোতির মা বিপ্রদাস সম্পর্কে বলে ওঠে - “মরে যাই। অমন দেবতার মত রূপ, এখনো ঘর খালি। কোন ভাগ্যবতীর কপালে আছে ঐ বর।”৪৬ দাদার স্টেশনে যাওয়ার কথা মনে করে কুমু নিজেকে অপরাধিনী বলে মনে হয়। অনবরত কুমুর মনে শুধুমাত্র অসুস্থ দাদার কথা মনে পড়তে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন বরকনে এক গাড়িতে উঠল তখন মধুসূদন পাশে বসে কুমুর দেহ মন সংকুচিত হয়ে গেল। কুমু মধুসূদনকে আপন করে নিতে পারছিল না কারণ আজ পর্যন্ত তার কাছ থেকে সে শুধু বাধাই পেয়েছে। মধুসূদনের আচার আচরণে যে একটা রুঢ়তার প্রমান পাওয়া গেল তারজন্যই কুমুকে এখনও পর্যন্ত তার থেকে দূরে ঠেকিয়ে রাখল। এখনও পর্যন্ত মধুসূদন মেয়েদের সাথে খুব বেশি মেলামেশা করেননি তাই সে নারীদের মন বুঝতে পারে না। মধুসূদন কুমুকে স্ত্রী হিসাবে মনে না করে দাসী হিসাবেই ভাবতে শুরু করে। স্ত্রী যে একজন প্রণয়ীর মতো হতে পারে তা মধুসূদনের স্থূল চরিত্রে অনুমান করতে পারে না। কুমুর সৌন্দর্য দেখে মধুসূদনের মনে তাকে বাস্তব না ভেবে একটা দৈব্য আবির্ভাব বলেই অনুমান করে। সেইজন্য মধুসূদন কুমুকে নিজের থেকে শ্রেষ্ঠ বোধ করলে এবং তার সাথে আচার আচরণ ও ব্যবহারের ধরন চিন্তা করতে লাগল। কুমুর সঙ্গে নানা অছিলায় মধুসূদন কথা বলতে লাগল। কুমু কিন্তু তার কোন উত্তরেই দিতে পারল না। কিন্তু মধুসূদন নিজেই উত্তরের আশায় ব্যর্থ হয়ে স্ত্রীকে নানারকম ভাবে সাহায্য করতে থাকে। এরদ্বারা আমরা বলতে পারি মধুসূদন স্ত্রীর সাথে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছিল। কিন্তু পূর্বের অপমান মনে রেখে কুমু তাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না। এইজন্যই কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য জীবনের প্রারম্ভে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যার ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের আবির্ভাব দেখতে পাই।

          কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কুমুর হাতের দিকে মধুসূদনের চোখ পড়ল। মধুসূদন তখন স্ত্রীর হাতে একটি আংটি লক্ষ্য করল। মধুসূদন তাই বাঁ হাতটা চোখের কাছে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করল আংটিটা কিসের? এটা যে নীলা তা মধুসূদনের অনুমান করতে সময় লাগে না। মধুসূদনের এইসব কথা শুনে কুমু কিন্তু চুপচাপ থাকে। মদুসুদন তখন কুমকে বলে - “দেখো নীলা আমার সয় না, ওটা তোমাকে ছাড়তে হবে।”৪৭ পূর্ব অভিজ্ঞতাবশতঃ নীলাকে মধুসূদন অপয়া বলে মনে করত। সেইজন্য সে তার স্ত্রীকে নীলার আংটি রাখতে দিতে চায় না। মধুসূদনের এই আচরণে আমরা অনুমান করতে পারি সে নিজের সিন্ধান্তকে জোর করে তার স্ত্রীর মনে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কুমুদিনী আস্তে আস্তে স্বামীর হাত থেকে তার হাতটি মুক্ত করার চেষ্টা করল। মধুসূদন তার হাতটি না ছেড়ে তাকে সে আংটিটা খুলে রাখতে বলে। মধুসূদনের এই কথায় কুমু রাজী হল না। এই আংটিটা কুমুর কাছে সাধারণ বস্তু ছিল না। কারণ একবার দাবাখেলায় জিতে তার দাদা এটি তাকে নিজের হাতের আংটি পারিতোষিক দিয়েছিল। কুমুর আচরণ দেখে মধুসূদনের হাসি পেল। এইখানে কুমু সাথে নিজের সাধর্ম্যের পরিচয় পেয়ে মধুসূদন একটু আরাম বোধ করল। মধুসূদন তখন ঐ নীলার আংটির পরিবর্তে নিজের হাতের থেকে একটি কমলহীরের আংটি খুলে কুমুকে দিতে চায়। কুমু আর সহ্য করতে না পেরে জোরপূর্বক তার নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নেয়। কুমুর এই আচরণ দেখে মধুসূদনের মনটা ঝেঁকে উঠল। স্ত্রীর কাছে নিজের কর্তৃত্বের খর্বতা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তাই শুষ্ক গলায় জোর করেই বলে – “দেখো, এ আংটি তোমাকে খুলতেই হবে।”৪৮ মধুসূদনের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে মধুসূদন তার কর্তৃত্ব সব জায়গায় বজায় রাখার চেষ্টা করে। মধুসূদনের এই দৃঢ় বাক্য শুনে নববধূর মুখ একেবারে লাল হয়ে যায়। মধুসূদন আবার ঐ আংটিটি খুলে দেবার জন্য কুমুকে আদেশ করে এবং নিজের হাতটি তার দিকে উদ্যত করে সেটি নেবার জন্য। এবার কিন্তু কুমু মধুসূদনের কথায় রাজী হয়ে আংটিটি খুলতে সম্মত হয়। কুমু তার নীলার আংটিটি খুলে ফেলার পর মধুসূদন যখন সেটি নেবার জন্য হাত বাড়ায় তখন কুমু তা দিতে অস্বীকার করে নিজের কাছেই রেখে দেবার কথা বলে। কুমুর এই আচরণে বিরক্ত হয়ে মধুসূদন গর্জন করে বলে – “রেখে কি লাভ? মনে ভাবছ, এটা ভারি একটা দামি জিনিস! এ কিছুতেই তোমার পরা চলবে না, বলে দিচ্ছি।”৪৯ উত্তরে কুমু জানায় আংটিটি সে আর পরবে না তাই একটি থলির মধ্যে ঐ নীলার আংটিটা রেখে দিল। কুমুর এই আচরণ দেখে মধুসূদন রুদ্ধস্বরে বলতে পারে - “কেন, এই সামান্য জিনিসটার উপরে এত দরদ কেন? তোমার তো জেদ কম নয়!”৫০ ঐ নীলার আংটি কে কেন্দ্র করে আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে যথেষ্ট বাগবিতণ্ডা হয়। যা তাদের নব দম্পতির মনে অশান্তির সৃষ্টি করে। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই নিজেদের জেদকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্যই তাদের জীবনে এতটা অশান্তির সৃষ্টি হয়। যার ফলে নব দম্পতির দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি হয় যা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

          এই আংটি কে কেন্দ্র করে নবদম্পতির মধ্যে যে মানসিক সংঘাতের সৃষ্টি হয় তাতে শেষ পর্যন্ত কুমুকে তার জেদের কাছে স্থির থাকতে দেখা যায়। মদুসুদন তখন কুমুর কাছে জানতে চেয়েছিল এই আংটির উৎস কি? মধুসূদন প্রথমে সন্দেহ করে যে এটি কুমু বোধ হয় মায়ের কাছ থেকে পায়, তাই এর জন্য তার এত মোহ। কিন্তু পরক্ষণে কুমুর কাছে মধুসূদন জানতে পারে বিপ্রদাস এই আংটিটি কুমুকে পারিতোষিক দিয়েছিল। বিপ্রদাসকে যেহেতু মধুসূদন চির প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করত, তাই তার কথা শুনে মধুসুদন কুমুর কাছে তার দাদার আর্থিক অবনতির কথা বলে খুব ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। মধুসূদন এ কথা বলতেও দ্বিধা করেন নি যে তার দাদার যেরূপ শনির দশা চলছে তাই তার দেওয়া কোন বস্তু সে তার ঘরে রাখতে দেবে না । মধুসূদন যেহেতু একজন স্থূল চরিত্রের মানুষ তাই সে নিজের স্ত্রীকে প্রণয়ীর মতো ভালবাসতে না পেরে জোর করেই স্ত্রীর মনের মধ্যে স্থান পাওয়ার চেষ্টা করে। স্বামীর এই স্থূল আচরণকে কুমু কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। পূর্বেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে কুমুর রূপ সৌন্দর্য মধুসূদনের মনকে আকৃষ্ট করে। এর পর জানা গেল যে রূপ ছাড়া আরো একটা কারনে হঠাৎ কুমুদিনীর দর বেড়ে গেল স্বামীর কাছে। বিবাহের দিনে মধুসূদন টেলিগ্রামের দ্বারা জানতে পারে যে ব্যবসাতে তার প্রায় বিশ লাখ টাকা লাভ হয়েছে। মধুসূদনের ধারণা স্ত্রীর আবির্ভাবের জন্যই তার এই লাভ সম্ভব হয়েছে। তাই মধুসূদন কুমুকে পয়া বলে মনে করতে শুরু করে। কারণ মধুসূদনের মনে হল যে স্ত্রী ভাগ্যে ধন লাভ হল। কুমুর সৌন্দর্য যে খুব সুন্দর ছিল তার যথেষ্ট প্রমান আমরা পাই, যখন একজনকে বলতে শুনি - “সাবেক কালে এমন মেয়ের জন্যে রাজায় রাজায় লড়াই বেধে যেত, আজ তিসি চালানির টাকাতেই কাজ সিদ্ধি। কলিযুগে দেবতাগুলো বেরসিক। ভাগ্যচক্রের সব গ্রহ নক্ষত্রই বৈশ্যবর্ণ।”৫১

          মধুসূদন যখন কলকাতায় বাস করতে এলো তখন প্রথমে সে একটি পুরানো বাড়ী কিনেছিল। সেই চকমেলানো বাড়িটাই আজ তার অন্তঃপুর মহল। মদুসুদনের বাড়িটি ছিল খুব বিলাস বহুল। কুমুকে নিয়ে যখন মধুসূদন সেই বাড়ীতে গেল তখন কুমুর সৌন্দর্য দেখে বাড়ীর আত্মীয় স্বজনের খুব ভাল লাগল, কিন্তু পাড়া প্রতিবেশিরা ঈর্ষায় জ্বলে গেল। কুমুকে বরণ, স্ত্রী আচার প্রভৃতি কাজকর্ম সম্পাদনা করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। নিজের বাড়ীতে কুমুর একমাত্র বড় বোনের বিয়ের কথা স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তাদের বাড়ীতে কোন নতুন বউ আসতে সে কখনোই দেখেনি। তার জন্যই নববধূর এই কার্য প্রণালী সম্বন্ধে তার কোন পূর্ব জ্ঞান ছিল না। বাল্যকাল থেকে কুমু স্বামীর কামনায় শিবকে পূজা করে তাকেই সে স্বামী হিসাবে বরণ করে নেয়। কুমু তার নিজের মাকে সতীসাধ্বী নারীর আদর্শ রুপেই মান্য করত। দৈব্য নির্ভরতাকে বিশ্বাস করে কুমু মধুসূদনকে বিয়ে করে ভবিষ্যতে যে কোন বাধার সৃষ্টি হবে তা সে কোনদিন বিশ্বাসই করতে পারেনি। কারণ তার ধারণা ছিল দেবতা তার কোন অমঙ্গল করতে পারে না। দেবতার ইচ্ছাতেই যে তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে এটাও কুমুর মনে বিশ্বাস হয়। শ্বশুরবাড়িতে কুমুকে বরণের জন্য সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত ছিল। স্বামীর প্রতি সন্দেহের সঙ্গে কুমুর মনে হল – “রাজাও এলেন, কিন্তু মনে যাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল, বাইরে তাকে দেখলে কই? রূপেতেও বাধত না, বয়সেও বাধত না। কিন্তু রাজা? সেই সত্যকার রাজা কোথায়?”৫২ বাইরের ও ভিতরের অসামঞ্জস্যের জন্য কুমুর মন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। তাই সে তার মনকে কিছুতেই স্থির করতে পারল না। এরপর অন্দরমহলে তেতলায় কুমুর শোবার ঘর ঠিক হল। ঘরে মস্ত বড় খাট মেহগনি কাঠের, ফ্রেমে নেটের মশারি, তাতে সিল্কের ঝালর। একেবারে বিলাসবহুল ঘরের দৃশ্য দেখতে পাই। কিন্তু মধুসূদনের স্থূল চরিত্র বশতঃ বিছানার পায়ের দিকে পুরো বহরের একটি নিরাবরণ মেয়ের ছবি দেখা যায়। মেয়েটি যেন বুকের উপর দুইহাত চেপে লজ্জার ভান করছে। শোবার ঘরে এই নিকৃষ্ট শ্রেণীর ছবি দেখে আমরা অনুমান করতে পারি মধুসূদন কতটা নীচ চরিত্রের মানুষ। কুমু এইসব চিত্র দেখে তার মনেও স্বামী সম্পর্কে একই ধারণা হয়ে থাকে। কুমুর সাথে মোতির মার সুসম্পর্ক থাকার জন্য তার সাথেই নববধূর কালরাত্রি যাপনের দায়িত্ব পড়ল। যার জন্য মোতির মার সাথে কুমু শোবার ঘরে গেল। শ্বশুর বাড়ীতে একমাত্র মোতির মা ছিল কুমুর প্রতি সহানুভূতিশীল। সময়ে অসময়ে কুমুর প্রতি তার লক্ষ্য ছিল অবিস্মরণীয়। একমাত্র মোতির মা বাদে বাকী কোন ব্যক্তির সাথেই কুমু মেলামেশা করতে পারল না। তাই এখানে এসে পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে কুমু কিছুতেই পারছিল না। তাই একথা চিন্তা করে কুমুর মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। তাই মোতির মা কুমুকে বলে – “আমি কিছুক্ষণের জন্য যাই ঐ পাশের ঘরে-তুমি একটু কেঁদে নাও ভাই, চোখের জল যে বুক ভরে জমে উঠেছে।”৫৩

          কুমুকে এই সদুপদেশ দিয়ে মোতির মা এ ঘর ছেড়ে চলে গেল। একাকী কুমুর মনে হল এখন কান্নার সময় নয়, বড়ো দরকার হয়েছে নিজেকে ঠিক করা। কুমুর অন্তরে যে কাথাটা তাকে বারবার আঘাত করছিল তা হল তার নিজের কাছে নিজের অপমান। অর্থাৎ কুমু যে আত্মদহনে দগ্ধ হতে লাগল এটা আমরা অনুমান করতে পারি। এতকাল ধরে কুমু যা কিছু সংকল্প করে এসেছে ওর বিদ্রোহী মন সম্পূর্ণ তার উল্টো দিকে চলে গেছে। সেই অবাধ্য মনটাকে শাসন করবার একটু সময় পাচ্ছিল না, যার জন্য সে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কুমু তাই আর্তকণ্ঠে বলতে পারে - “ঠাকুর, বল দাও, বল দাও, আমার জীবন কালি করে দিয়ো না। আমি তোমার দাসী, আমাকে জয়ী করো, সে জয় তোমারই।”৫৪ মোতির মায়ের অনুপস্থিতে কুমুর একাকীত্বের সুযোগ পেয়ে তার কাছে একটি পরিণত বয়সী আঁটসাঁট গড়নের শ্যাম বর্ণ সুন্দরী বিধবা মহিলা প্রবেশ করে। এই মহিলাটি হল কুমুর জা শ্যামাসুন্দরী। সে কুমুর ঘরে ঢুকেই বললে - “মোতির মা তোমাকে একটু ছুটি দিয়েছে সেই ফাঁকে এসেছি, কাউকে তো কাছে ঘেঁষতে দেবে না, বেড়ে রাখবে তোমাকে-যেন সিঁধকাটি নিয়ে বেড়াচ্ছি, ওর বেড়া কেটে তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাব।”৫৫ শ্যামাসুন্দরী কুমুর স্বামীর বয়সের আধিক্যের খোঁটা দিয়ে কুমুর মনকে দূর্বল করার চেষ্টা করল। কুমু তার জা এর কাছে এসব ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শুনে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মধুসূদনের ভাগ্যে যে এত সুন্দরী বৌ জোটতে পারে সে কথা ভেবে শ্যামা অবাক হয়ে যায়। কারণ তার মতে মধুসূদন কুমুকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার যোগ্য নয়। শ্যামা তাই কুমুর মন বোঝার জন্য বলে – “সত্যি করে বলো ভাই, আমাদের বুড়ো দেওরটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”৫৬ শ্যামার এই প্রশ্ন শুনে কুমু অবাক হয়ে যায়, তাই কোন জবাব দিতে পারে না। কুমুর মৌনব্রত দেখে শ্যামা কিন্তু কুমুকে বিব্রত করার জন্য আশা ত্যাগ করে নি। শ্যামা তাই আবার কুমুকে বলে –“বুঝেছি, তা পছন্দ না হলেই বা কী, সাত পাক যখন ঘুরেছ তখন একুশ পাক উলটো ঘুরলেও ফাঁস খুলবে না?”৫৭ শ্যামার এই কথা শুনে কুমু এর অর্থ বুঝতে পারে নি। শ্যামা এর পর কুমুকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে থাকে এবং তাকে সাবধানও করে দেয়। শ্যামা জবাব দেয় – “খোলসা করে কথা বললেই কি দোষ হয় বোন? মুখ দেখে কি বুঝতে পারি নে? তা দোষ দেব না তোমাকে। ও আমাদের আপন বলেই কি চোখের মাথা খেয়ে বসেছি? বড়ো শক্ত হাতে পড়েছ বউ, বুঝে সুঝে চোলো।”৫৮ শ্যামাসুন্দরী কিছুক্ষণের জন্য এসে কুমুর মনের মধ্যে ভারি একটা বিস্বাদ জাগিয়ে দিয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ মোতির মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে শ্যামা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাই সে মোতির মাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে কিছু কথা শুনিয়ে এখান থেকে বিদায় নিল। আজকে কুমুর সবচেয়ে দরকার ছিল মায়ার আচরণ, সেইটাই সে মনে মনে গড়ার জন্য বসেছিল। তার ঠাকুরকে সে সহায় করবার জন্য চেষ্টা করছিল কিন্তু সে সময় শ্যামা এসে তার স্বপ্ন বোনা জালে ঘা মারল। তাই কুমু নিজের দূর্বল মনকে শক্ত করার জন্য মনে মনে খুব জোর করে নিজেকে বলতে লাগল - “স্বামীর বয়স বেশি বলে তাকে ভালবাসি নে, একথা কখনোই সত্যি নয়-লজ্জা লজ্জা! এ যে ইতর মেয়েদের মতো কথা। শিবের সঙ্গে সতীর বিয়ের কথা কি ওর মনে নেই? শিব নিন্দুকরা তার বয়স নিয়ে খোঁটা দিয়েছিল, কিন্তু সে কথা সতী কানে নেন নি।”৫৯ স্বামীর বয়স বা রূপ নিয়ে এ পর্যন্ত কুমুর মনে কোন চিন্তাই ছিল না। সাধারণত যে ভালোবাসা নিয়ে স্ত্রী পুরুষের বিবাহ সত্য হয়, যার মধ্যে রূপগুণ দেহমন সমস্তই মিলে আছে, তার যে প্রয়োজন আছে এ কথা কখনো ভাবেনি। পছন্দ করে নেওয়ার কথাটাকে কুমু তাই রঙ মাখিয়ে চাপা দিতে চায়।

          কুমু যখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এইসব ভাবতে থাকে ঠিক তখনই হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে ফুলকাটা জামা ও জরির পাড়ওয়ালা ধুতি পড়ে তার কাছে আবির্ভাব হল। তাকে দেখে কুমু কোলের উপর টেনে নিয়ে তার নাম জানতে চায়। ছেলেটি খুব ঘটা করে তার নাম জানালে শ্রী মোতিলাল ঘোষাল। বাড়ীর সকলের কাছে তার পরিচয় হাবলু বলে। কুমুর মন ভারাক্রান্ত হওয়ার জন্য তার বুকের ভিতরটা টনটন করছিল তখন এই ছেলেকে বুকে চেপে ধরে তার যেন প্রান ফিরে বাঁচল। সেই সময় কুমু এই ছেলেটিকে ঠাকুর ঘরের তার আরাধ্য গোপাল বলে মনে মনে ভাবতে লাগল। তার জন্য কুমুর মনে শান্তি বিরাজ করল। তাই কুমু হাবলুকে পেয়ে খুব আদর করতে লাগল। কুমু যত মধুসূদনের হৃদয় মধ্যে গ্রহণ করতে বাধা পায় ততই সে তার দেবতাকে দিয়ে তার স্বামীকে আবৃত করার চেষ্টা করে। রাত্রে কুমু মধুসুদনের রূঢ় আচরণের কথা চিন্তা করে কাঁদতে লাগল। মোতির মা কুমুর এই অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাই সে কোন কথা বলতে পারে না। কুমুর এই অবস্থার কথা মোতির মা এই প্রথম বুঝতে পারল যা সে ভাবতেও পারেনি। মোতির মা যেহেতু কুমুকে খুব ভালবাসত তাই তার দুঃখে সেও চিন্তিত হয়ে পড়ে। কুমুকে ভালবাসার জন্য মোতির মার পূর্ব ভূমিকা হয় তার দাদার মহত্ত্বের পরিচয়ে। পরের দিন সকালেই কুমু দাদার টেলিগ্রাম পেল। এখানে আসার পর থেকে কুমু দাদার জন্য খুবই চিন্তিত ছিল তাই টেলিগ্রামটি পেয়ে তার মনে সাময়িক শান্তি ফিরে এল। টেলিগ্রাম পড়ে কুমু তার দাদার শরীরের কোন খবর না পেয়ে আবার চিন্তা করতে লাগল। তাই কুমুর মনে দাদার বিপদের কথা সন্দেহ হতে লাগল। তার অনুমান হয় দাদা হয়তো তার বিপদের কথা কুমুকে গোপন রাখতে চায়। কুমুর মনে হয় যে দাদার খবর তার সবসময় প্রত্যক্ষগোচর ছিল, আজ ভাগ্যের পরিহাসে তার কাছে সবই অবরুদ্ধ। ফুলসজ্জার দিনে কুমুর মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। তাই সে চাইছিল একটু একাকী থেকে মনকে প্রস্তুত করে নেবে। কিন্তু সেই সুযোগ কুমু কিছুতেই জোগাড় করতে পারছিল না। বিপ্রদাসের শরীর খুব খারাপ থাকার জন্য কুমুর ফুলসজ্জার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারল না। তাই বিপ্রদাস তার প্রতিনিধি হিসাবে নবগোপালকে অনুষ্ঠানে পাঠিয়ে দিয়ে তার কর্তব্য পালন করে। বিপ্রদাসের কথাতে নবগোপাল এল কুমুর ফুলসজ্জার সওগাত পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। কুমু এই অনুষ্ঠানে তার বাপের বাড়ীর কাউকে দেখতে না পেয়ে খুব দুঃখ পেল। কুমুর মনে হল পূর্ব সংঘাতের জেরেই তারা কেউ এখানে উপস্থিত হয় নি। তাই কুমু মনে মনে বুঝলে - “সন্ধি এখনো হল না, হয়তো কোন কালে হবে না।”৬০ ফুলসজ্জার রাত্রিতে কুমুর বুকটা ভয়ে দুরদুর করে কাঁপতে লাগল। কুমুর ঠাণ্ডা হাত ঘামছে, মুখ বিবর্ণ হতে দেখা যায়। বিপদের সংকেত বুঝে কুমু তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মোতির মায়ের কাছে। মোতির মাকে কুমু অনুরোধ করে তাকে কিছু সময়ের জন্য নির্জন স্থানে নিয়ে যাবার জন্য। বিপদের সংকেত বুঝে মোতির মা কুমুকে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মধুসুদন শোবার ঘরে গিয়ে কুমুকে দেখতে পায়নি। কুমুর খোঁজ না পেয়ে বাড়ীর সকলে তাকে অনুসন্ধান করতে থাকে। এই খবর পেয়ে মোতির মা বিপদের আশঙ্কা বুঝে ভয় পেতে শুরু করে। কুমুর ঘরে ঢোকা অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও কিন্তু সে দরজা খুলল না। মোতির মা বিপদের সংকেত বুঝে তাই জোর করে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই দেখা গেল যে কুমু মুর্ছিত হয়ে মেঝের উপর পড়ে আছে।

          নববধূর মুর্ছা যাওয়ার খবর রটে গেল চারিদিকে গোলমাল পড়ে গেল। বাড়ীর সমস্ত লোক তাকে সুস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর যখন কুমুর চেতনা ফিরে এলো তখন সে বুঝতে পারল না সে কোথায় আছে। অজ্ঞানবশতঃ তাই কুমু তার দাদাকে ডাকতে থাকে। কুমুকে অভয়দান করে মোতির মা জানায় সে থাকতে তার কোন ভয় নেই। মোতির মা কুমুর মুখটা বুকের উপর তুলে নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। মোতির মায়ের অতি যত্নে কুমু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে পড়ল। কুমু এরপর ঠাকুরের নাম করে প্রনাম করতে লাগল। এ থেকেই সহজে অনুমান করা যায় যে কুমু কতটা দৈব্য নির্ভরশীল। মোতির মা লোকলজ্জা দূর করার জন্য কুমুকে শোবার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। এরই মধ্যে শ্যামাসুন্দরী কৌতূহলবশতঃ হাঁপাতে হাঁপাতে মধুসূদনকে নববধূর মুর্ছার ঘটনা সব জানায়। মধুসুদন এই কথা শুনে রাগে জ্বলে যায় এবং উত্তেজিত হয়ে তার কারণ জিজ্ঞাসা করে। শ্যামা মধুসুদনকে বেশি করে উত্তেজিত করার জন্য বলে – “তা তো বলতে পারিনে, দাদা দাদা করেই বউ হেদিয়ে গেল। তা একবার কি দেখতে যাবে?”৬১ কুমুর মুখে দাদার কথা শুনে মধুসুদন যে খুব বিরক্ত প্রকাশ করে এটা শ্যামার জানা ছিল। তাই মধুসুদন এই কথা শুনে অভিমান করে। শ্যামা তখন মধুসূদনকে ধৈর্য ধরার কথা বলে। মধুসুদন কুমুর প্রতি বিরক্ত হয়ে তাই বলে - “রোজ রোজ উনি মুর্ছা যাবেন আর আমি ওঁর মাথায় কবিরাজি তেল মালিশ করব এই জন্যেই কি ওঁকে বিয়ে করেছিলুম?”৬২ শ্যামাসুন্দরী মনে মনে মধুসুদনের প্রতি কামজ মোহে আকৃষ্ট হয়েছিল। তাই সে মধুসূদনকে একান্তে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু মধুসূদন শ্যামকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। এজন্য শ্যামার মনে খুব দুঃখ হত। তাই শ্যামা যে কোন প্রকারে মধুসুদন ও কুমুর সম্পর্কটাকে ছিন্ন করার জন্য পাগল হয়ে যায়। তাই শ্যামা, মধুসূদন ও কুমুকে একা পেলেই প্ররোচনা দিয়ে তাদেরকে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করে। মধুসূদনের বিরক্তির সুর শুনে তাই শ্যামা খুব আনন্দ হয়। কারণ সে তার উদ্দেশ্যের কিছুটা হলেও সফল হতে শুরু করে। তাই শ্যামা মধুসূদনের কাছে কুমুর প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেনা।

          মধুসূদন শ্যামার কাছে কুমুর কথা শুনে মন খারাপ করে বসে রইল। মধুসূদনের এই অবস্থা দেখে শ্যামা সুযোগ বুঝে তার প্রতি সমব্যাথি বলে নিজেকে প্রমান করতে চায়। কারণ শ্যামার ইচ্ছা ছিল এই সুযোগে মধুসূদনের মনের কোনে স্থান করে নেওয়ার। তাই শ্যামা বিগলিত সুরে বলতে পারে - “ঠাকুরপো, অমন মন খারাপ কোরো না, দেখে সইতে পারি নে।”৬৩ এর আগে মধুসূদনের এত কাছে গিয়ে শ্যামার স্বান্তনা দেওয়ার সাহস আমরা দেখতে পাইনি। শ্যামা আজ বুঝতে পেরেছে যে মধুসূদন আর আগের মতো নেই তার ভাবের পরিবর্তন হয়েছে। মধুসদনের দৃঢ়তা আজ নেই। আজ ও দুর্বল তাই নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্কতা ওর নেই। শ্যামা তাই এই সুযোগটাকে সদ ব্যবহার করার চেষ্টা করে। মধুসূদনের হাতে হাত দিয়ে শ্যামা অনুমান করে যে মধুসূদনের এতে বিরক্তিবোধ হয়নি। শ্যামাসুন্দরী আজ মধুসূদনের দুর্বল মানসিকতার সুযোগ নিয়ে তার নিকটে চলে গেল। তাই শ্যামা আজকে তার অনেক দিনের আশা পূর্ণ করতে পারে। স্বামীর প্রতি কুমুর অবহেলার জন্যই, মধুসূদন শ্যামাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যার ফলে শ্যামা ও মধুসূদনের একটা অবৈধ কামের সম্পর্কের আবির্ভাব দেখা যায়। যা কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য জীবনকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। নবদাম্পতির দাম্পত্য জীবনে কলহের দৃশ্য দেখা যায়। কুমু এরপর হঠাৎ স্বামীর ঘরে এলে তা দেখে শ্যামা লজ্জিত হয়ে চলে যায়। যাবার সময় বলে যায় - “ঐ আসছে বউ, আমি যাই ভাই। কিন্তু দেখো ওর সঙ্গে রাগারাগি কোরো না, আহা ও ছেলেমানুষ!”৬৪ শ্যামাসুন্দরীর এই কথার মধ্য দিয়ে কুমু ও মধুসূদন উভয়ের কাছে নিজের চরিত্রের সমন্বয় সাধন করার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। কুমু তার মনকে দৃঢ় করে পুনরায় স্বামীর কাছে ফিরে এলো কিন্তু স্বামীর কঠিন আচরণে আবার তার মন ভেঙ্গে গেল। মধুসূদন কঠিন স্বরে কুমুকে বলে – “বাপের বাড়ী থেকে মুর্ছো অভ্যেস করে এসেছ বুঝি? কিন্তু আমাদের এখানে ওটা চলতি নেই। তোমাদের ঐ নুরনগরি চাল ছাড়তে হবে।”৬৫ স্বামীর কাছে এই কথা শুনে কুমু কোন উত্তর দিল না। কুমুর মৌন অবস্থা দেখে মধুসূদন অবাক হয়ে আবার বেশি রেগে গেল। মধুসূদনের মনে মনে কুমুর প্রতি ভালবাসার জন্য একটা আশঙ্কা জেগেছে বলেই তার এই নিস্ফল রাগ। মধুসূদনের নানারকম অপমান জনিত কথা শুনে কুমু ধীরে ধীরে বলল – “তুমি আমাকে অপমান করতে চাও? হার মানতে হবে। তোমার অপমান মনের মধ্যে নেব না।”৬৬ কুমু কাকে লক্ষ্য করে এই কথা বলে তা মধুসূদন বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে যায়। মধুসূদন তখন বক্রোক্তি করে বললে - “তুমি তোমার দাদার চেলা, কিন্তু জেনে রেখো আমি তোমার সেই দাদার মহাজন, তাকে এক হাটে কিনে আর এক হাটে বেচতে পারি।”৬৭ মধুসূদন যে কুমুর দাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ একথা কুমুর মনে দেগে দেবার জন্য মুঢ় আর কোন কথা খুঁজে পেল না। তাছাড়া মধুসূদনের কাছে বিপ্রদাস যে একজন ক্ষুদ্র মানুষ তাই বলতে চায় মধুসুদন। স্বামীর মুখে দাদার প্রতি অপমানজনক কথা শুনে কুমু খুব দুঃখ পায়। যার ফলে স্বামীর প্রতি ক্ষুদ্রকনা মাত্র ভালোবাসা তার মনে ঠাই পেল না।

          কুমু দাদার প্রতি অপমান সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে আবেদন করে – “দেখো নিষ্ঠুর হও তো হোয়ো, কিন্তু ছোট হোয়ো না।”৬৮ কুমুর এই কথা শুনে মধুসূদন রেগে গিয়ে কর্কশকণ্ঠে বলে উঠল - “কী! আমি ছোটো! আর তোমার দাদা আমার চেয়ে বড়ো?”৬৯ কুমু তখন স্বামীকে জানায় তাকে বড়ো জেনেই সে তার ঘরে এসেছে। কুমুর কথা শুনে মধুসূদন ব্যঙ্গ করে বলে – “বড়ো জেনেই এসেছ, না টাকার লোভে?”৭০ নবদম্পতির মধ্যে এইভাবে কথা কাটাকাটি হতেই হঠাৎ কুমু রাগ করে খোলা ছাদের মধ্যে চলে যায়। ডঃ সুকুমার সেনের মতে- “মধুসূদন কুমুকে দৈব্যলব্ধ বস্তুর মতো ভাবিয়াছিল এবং কুমুর মন পাইবার জন্য সে বুদ্ধিবিবেচনা মতো চেষ্টাও করিয়াছিল। কিন্তু কুমুর অন্তরের সবচেয়ে কোমল স্থানে বারবার আঘাত করিয়া সে বিচ্ছেদকে বাড়াইয়াই চলিয়াছিল। বিপ্রদাসের উপর কুমুর অগাধ ভক্তি ও স্নেহ মনে পড়িলে মধুসূদনের মনে আগুন জ্বলিয়া যাইত।”৭১ ইচ্ছার বাইরে জোর করে কুমুকে নিজের বশবর্তী করা যে খুব সহজ নয় তা মধুসূদন অনুমান করতে পারে। দাদা বিপ্রদাসের কাছে সে ধৈর্যের দীক্ষা নিয়েছে। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করার জন্যই কুমু শ্বশুরবাড়িতে এসেছিল। কিন্তু যাকে সে সবকিছু আত্মসমর্পণ করতে চায় সে তো তার আত্মার ও আত্মসমর্পণের কোন মুল্য বোঝে না। উপরন্তু বারবার কুমুর মনে বেদনা দিয়া তার মনের আবরণকেই শক্ত করে তুলেছে। কুমু তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগল সে যদি ইহ জন্মে স্বামীর সহধর্মিণী নাই হতে পারে তবে দাসী রূপেই কর্তব্যকর্মে অটুট থাকবে। পরদিন কুমু ভোরে স্নান সেরে যখন তার দাদার টেলিগ্রামটি ব্যাগে রাখতে গেল তখন ঐ স্থানে তার নীলার আংটিটি দেখতে পেল না। কুমু তখন অনুমান করতে পারল যে আংটিটি কোথায় যেতে পারে? পূর্ব অভিজ্ঞতায় কুমু জানত যে আংটিটিকে তার স্বামী একেবারেই পছন্দ করত না। তাই এটা যে তার স্বামীই হস্তগত করেছে তাতে কুমুর মনে কোন সন্দেহ রইল না। সকাল বেলা মানস পুজার পর কুমুর মুখে একটি শান্তির ভাব এসেছিল সেটা মিলিয়ে গিয়ে চোখে আগুন জলে উঠল। স্বামীর এই আচরণে কুমুর মন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কুমু এই ঘটনা মোতির মাকে সব জানিয়ে নিজের মনকে হালকা করে। কুমুর কাছে সবকিছু শুনে মোতির মা জানায় যে স্বামী তার সাথে ঠাট্টা করে এসব করেছে পরে আবার ওটা দিয়ে দেবে। কুমু তখন বলে সে আর তা ফিরে নেবে না। মোতির মা বুঝতে পারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে রাগ অভিমানের পালা শুরু হয়। মোতির মা কুমুকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে কুমু কিন্তু অভুক্ত থেকে গেল।

          কুমু মধুসূদনের রূঢ় আচরণে দিনদিন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। কুমু বারাবার নিজের মনকে তৈরি করতে চাইলেও মধুসূদনের আচরণে তা বিনষ্ট হয়। কুমু তাই মোতির মাকে বিরহের স্বরে জানাতে পারে যে আজ থেকে তার নিজের মর্জি বলে কিছু থাকল না, যা কিছু রইল সব স্বামীর উপরে। তাই সে নিজেকে মধুসূদনের দাসী বলে ভাবতে লাগল। মধুসূদনের প্রতি বিদ্রূপ করে কুমুকে মোতির মাকে বলে – “স্ত্রী যাদের দাসী তারা কোন জাতের লোক?”৭২ মোতির মা তখন মধুসূদনের সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে কুমুকে জানায়। মধুসূদন শুধু অন্যকেই গোলামি করায় তা নয়, নিজের গোলামি নিজে করে। মধুসুদনের কোন ভুলের জন্য সে নিজেও তার প্রায়শ্চিত্ত করে। মোতির মা জানায় মধুসূদন আত্মীয় বলে কাউকে মানে না। এ বাড়ীতে কর্তা থেকে চাকর-চাকরানী পর্যন্ত সবাই গোলাম। মোতির মায়ের কাছে এই কথা শুনে কুমু চুপ করে থেকে বললে - “আমি সেই গোলামিই করব। আমার রোজকার খোরপোশ হিসেবমত রোজ রোজ শোধ করব। আমি এ বাড়ীতে বিনা মাইনের স্ত্রী বাঁদী হয়ে থাকব না। চলো আমাকে কাজে ভর্তি করে নেবে। ঘর কন্নার ভার তোমার উপরেই তো আমাকে তুমি তোমার অধীনে খাটিয়ে নিয়ো, আমাকে রানী বলে কেউ যেন ঠাট্টা না করে।”৭৩ কুমুর এই কথা শুনে মোতির মা তার সাথে ঠাট্টা করতে করতে নিয়ে চলে যায়। তখন ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কুমু বললে - “দেখো ভাই, নিজেকে দেব বলেই তৈরি হয়ে এসেছিলুম, কিন্তু ও কিছুতেই দিতে দিলে না। এখন দাসী নিয়েই থাকুক। আমাকে পাবে না?”৭৪ কুমু এই কথার দ্বারা বলতে চায় সে নিজের মনকে প্রস্তুত করেই এসেছিল স্বামীকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু স্বামী তার দৃঢ় আচরণে এই মন নিতে পারল না। তাই কুমু বলে এখন তার মন সে পাবে না, দেহ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। নবদম্পতির মধ্যে মানসিক মিল আর সম্ভব নয় তাই তাদের শারীরিক মিলনই এখন একমাত্র সম্পদ। মোতির মা তখন জানায় যে মধুসুদন হল কাঠুরের মত, সে গাছকে পায় না কাঠ পায়। কিন্তু মালী গাছকে রাখতে জানে, সে পায় ফুল, পায় ফল। কুমু কাঠুরের হাতে পড়েছে, সে ব্যবসাদার। তাই মধুসুদনের মনে কোন দরদ নেই কোথাও?

          এক সময় কুমু তার শোবার ঘরে ফিরে এসে দেখল তার টিপাইয়ের উপর এক শিশি লজেন্স। হাবলু এটি তার ত্যাগের অর্ঘ্য গোপনে রেখে গেছে। বালকের এই লজেন্সের ভাষায় একসঙ্গে ওকে কাঁদালে হাসালে। কুমু তখন হাবলুকে খুঁজতে বাইরে বেরিয়ে দেখে সে দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ মা তাকে এ ঘরে যাতায়াত করতে বারন করে দিয়েছিল। তাই হাবলু এই ঘর থেকে দূরে দুরেই থাকত। কুমু তখন হাবলুকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে তার কোলে বসাল। কুমু ঘরে গৃহসজ্জার মধ্যে পুতুল স্থানীয় যা কিছু ছিল তা দুজনে নাড়াচাড়া করে খেলতে লাগল। কুমু যখন বুঝতে পারল কাঁচের কাগজ চাপাটির প্রতি হাবলুর খুব কৌতূহল তাই সে তাকে ভালোবেসে ঐ কাগজ চাপাটি দিয়ে দেয়। হাবলু সেটি পেয়ে আহ্লাদ রাখতে না পেরে সেটা নয়েই লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেল। হাবলুর হাতে এই কাগজ চাপাটি দেখে মধুসুদন তা কেড়ে নেয় এবং তাকে চোর অপবাদ দিয়ে মারতেও ছাড়েনি। কুমুকে এই সব কথা মোতির মা জানায়। সে কুমুকে এও জানায় যে হাবলুকে চুরি যে আমি শেখাচ্ছি একথাও ক্রমে উঠবে। মোতির মায়ের মুখে মধুসুদনের এই নিষ্ঠুর আচরণ শুনে কুমু কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে রইল। হঠাৎ মধুসুদন ঘরে আসতেই তা দেখতে পেয়ে মোতির মা চলে গেল। মধুসুদন সেই কাগজ চাপাটি হাতে করে নিয়ে এসে যথাস্থানে রেখে দিল। এরপর নিশ্চিত প্রত্যয়ের কণ্ঠে শান্ত স্বরে বললে – “হাবলু তোমার ঘর থেকে এটা চুরি করে নিয়েছিল। জিনিসপত্র সাবধান করে রাখতে শিখো।”৭৫ মধুসুদন হাবলুকে একপ্রকার চোর বলেই গণ্য করল কিন্তু কুমু তার অভিমতকে স্বীকার করল না। প্রত্যুত্তরে কুমু তাকে জানায় ঐ দ্রব্যটি সে ভালোবেসে হাবলুকে দিয়েছিল। কুমুর এই কথা শুনে মধুসুদন রেগে গিয়ে গর্জন করে বলে- “এমনি করে ওর মাথা খেতে বসেছ বুঝি? একটা কথা মনে রেখো, আমার হুকুম ছাড়া জিনিসপত্র কাউকে দেওয়া চলবে না। আমি এলোমেলো কিছুই ভালবাসি নে।”৭৬ কুমুও রাগের মুখে স্বামীর প্রতিবাদ করে বলে – “তুমি নাও নি আমার নীলার আংটি?”৭৭ স্ত্রীর কথা শুনে মধুসুদন সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নেয়। এইভাবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খুব বাদানুবাদের ফলে তা চরম সীমায় পৌঁছে যায়। এতে তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের জেরে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে যায়। কুমু তখন স্বামীকে বলে- “তাতেও তোমার ঐ কাঁচের ঢেলাটার দাম শোধ হল না?”৭৮ প্রত্যুত্তরে মধুসুদন জানায় – “আমি তো বলেছিলুম, ওটা তুমি রাখতে পারবে না।”৭৯ তখন কুমু রুদ্ধ্বস্বরে বলে – “তোমার জিনিস তুমি রাখতে পারবে, আর আমার জিনিস আমি রাখতে পারব না।?”৮০ স্ত্রীর কথা শুনে মধুসদন দৃঢ় কণ্ঠে জানায় এ বাড়ীতে তোমার স্বতন্ত্র জিনিস বলে কিছু নেই। এই কথা শুনে রেগে গিয়ে কুমু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কুমু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে শ্যামা ঘরে প্রবেশ করে কুমুকে খুঁজতে থাকে। মধুসুদন তখন তাকে খোঁজার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। উত্তরে শ্যামা জানায়- সকাল থেকে ওর খাবার নিয়ে বসে আছি, এ বাড়ীতে এসে বউ কি খাওয়াও বন্ধ করবে? এই কথা শুনে মধুসূদন কুমুর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে। মধুসুদনের স্ত্রীর প্রতি অবহেলা লক্ষ্য করে শ্যামা ভিতরে ভিতরে খুশি হয়েও দেওরকে উপদেশ দিতে ছাড়েনি। শ্যামার এই উপদেশ শুনে মধুসূদন গর্জন করে বলে - “কিছু করতে হবে না, যাও চলে! খিদে পেলে আপনিই খাবে।”৮১ মধুসুদনের এই কথা শুনে শ্যামা যেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে চলে গেল। কারণ শ্যামা চেয়েছিল যে মধুসুদনের সাথে একাকী কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। মধুসুদনের মাথায় রক্ত চড়তে লাগল।

          স্বামীর প্রতি বিমুখ হয়ে কুমু এরপর ভাড়ার ঘরে আশ্রয় নিল। কুমুকে এখানে দেখে মোতির মা অবাক হয়ে গেল। কুমু তাকে বলল - “এ বাড়ীতে আমি সেজবাতি সাফ করব, আর এইখানে আমার স্থান।”৮২ মোতির মা তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত কুমুর জেদের কাছে তার চেষ্টা হার মেনে যায়। তখন মোতির মা তার সাথে শুতে চাইলে কুমু তার সেই আবেদনকে একেবারে অস্বীকার করে। মধুসূদন রাতে শুতে এসে সব খবর শুনল। প্রথমে সে স্ত্রীর অনুপস্থিতিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইল না। তাই সে যখন শুতে গিয়ে দেখল যে কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। প্রত্যেক শব্দেই সে তাই কুমুকে অনুভব করতে লাগল। তার যখন মনে হল যে কুমু দরজার বাইরে দাড়িয়ে আছে তাই সে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেখে কেউ কোথাও নেই। রাত যত বাড়তে থাকে মধুসুদনের মন তত ছটফট করতে থাকে। মধুসুদনের এই অবস্থা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি সে কুমুকে আন্তরিক ভাবে খুব ভালবাসত। বাইরে সে কুমুকে যেমন অবজ্ঞা প্রকাশ করত অন্তরে কিন্তু সে তাকে অবজ্ঞা করতে পারল না। অথচ সে তার নীতির কাছে হার মেনে এগিয়ে গিয়ে কোন কাজ করবে না এটা স্থির করে নিয়েছিল। মধুসূদন তাই পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু তার ঘুম এলো না। রাত যত বাড়তে লাগল তার মন তত ছটফট করতে লাগল। তাই সে উঠে পড়ে তার মনের কৌতূহলকে কিছুতেই সামলাতে পারল না। একটা লণ্ঠন হাতে নিয়ে কুমুর ঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। ঘরের সামনে এসে সে কিছুক্ষণ কান পেতে রইল, কিন্তু ভিতরে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তখন সে অতি সাবধানে দরজা খুলে দেখতে পায় কুমু মেঝের উপর মাদুর পেতে অচেতন ভাবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই মধুসূদন মন খারাপ করে চোরের মত সেখান থেকে পালিয়ে গেল। শ্যামা মধুসূদনকে সবসময় অনুসরণ করত এটা আমরা পূর্বেই জেনেছি। এত রাত্রেও শ্যামার নজর এড়াতে পারেনি মধুসূদন। শ্যামা মধুসূদনকে এত রাত্রে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু মধুসূদন শ্যামাকে এ নিয়ে কোন সদুত্তর দিল না। মধুসুদনের প্রতি একটা দূর্বলতা সবসময় শ্যামার মধ্যে ছিল। তাই শ্যামা একটু হেসে বললে - “আজ ঘুম থেকে উঠেই তোমার মতো ভাগ্যবান পুরুষের মুখ দেখলুম, আমার দিন ভালোই যাবে। ব্রত সফল হবে।”৮৩ শ্যামা এই কথা বলে তার মনের মানুষকে খুশি করতে চায়। মধুসূদন ও কুমু সুখে শান্তিতে সংসার করুক এটা শ্যামা কখনই চাইত না। তাই সে সব সময় তাদের সমস্ত গতিবিধির উপর নজর রাখত। শ্যামা আস্তে আস্তে মধুসূদনকে নিজের দিকে টানতে কিছুটা সফল হতে থাকে। তাই সে প্রাণপণ দিয়ে এই চেষ্টা করতে থাকে। এর জন্য নব দম্পতির জীবনে একটা অশান্তি সবসময় বিরাজ করতে থাকে। যার ফলে তাদের স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে কলহ সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

          মধুসূদন কুমুর ঘর থেকে হতাশ হয়ে এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাইরে লন্ঠনটা রাখলে, যদি কুমু আসে। কুমুর সেই সুপ্ত মুখ ও হাতখানা সে কিছুতেই ভুলতে পারল না। এসব কথা চিন্তা করে তার ঘুম হল না তাই সে উঠে গেল। মধুসূদন আলো জালিয়ে কুমুর ডেস্কের দেরাজ খুললে। তাতে সে একটি ব্যাগ দেখতে পেল। যার ভিতরে বিপ্রদাসের টেলিগ্রামটি দেখে মধুসুদনের মন ঈর্ষায় ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বিপ্রদাসকে মনে মনে লোপ করে দিলে। কুমুর মনে তার দাদার উপস্থিতিকে লুপ্ত করার জন্য মধুসূদন অস্থির হয়ে পড়ে। পুঁতির থলিটি আজ সে ফেলে দিতে পারল না। কারণ কুমু যে সাধারন মেয়ে নয় তা মধুসূদন আজ অনুমান করতে পারে। তাই সে বুঝতে পারে যে তাকে জোর করে কিছু করানো যাবে না। মধুসূদন তাই মনে মনে অনুমান করে - “কুমুদিনীকে নিজের জীবনের সঙ্গে শক্ত বাঁধনে জড়াবার একটা মাত্র রাস্তা আছে, সে কেবল সন্তানের মায়ের রাস্তা।”৮৪ মধুসূদন বুঝতে পারছিল যে আস্তে আস্তে তাদের দাম্পত্য জীবন একেবারে ছিন্ন হতে থাকে, তাই সে সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য এই কথা চিন্তা করে। কুমু যে এখন আর সাধারণ নেই অসাধারণ হয়ে উঠেছে এর জন্য মধুসূদন মোতির মাকেই দায়ী করে। কুমু যেহেতু সবসময় মোতির মায়ের সাথেই আলোচনা করত তাই মধুসুদনের ধারণা তার ইন্ধনেই কুমু এত বাড়বাড়ন্তের অবস্থা দেখা যায়। তাই মধুসূদন রাগের বশে নবীনের কাছে তার স্ত্রীর নামে অভিযোগ করতে পারে। মোতির মা যখনই কুমুকে অকৃত্রিম ভালোবাসার সঙ্গে আদর যত্ন করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল ঠিক তখনই বাড়ীর মেয়েরা এই ঘটনা নিয়ে মধুসূদনকে প্ররোচনা দিতে শুরু করে। মোতির মায়ের বিরুদ্ধে মধুসুদনের অভিযোগ তারই প্রকৃষ্ট ফল বলে অনুমান করা যায়। মধুসুদনের এই অভিযোগের কথা নবীন সঙ্গে সঙ্গে মোতির মাকে জানায় এবং তারা উভয়েই খুব ভয় পেয়ে যায়। কুমু কোন কিছুতেই এখানকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিল না, তাই সে খুব অস্বস্তি বোধ করল। মোতির মা, নবীন, এবং হাবলু ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকেই মনের মণিকোঠায় স্থান দিতে পারে নি। অনেকদিন দাদার চিঠি না পেয়ে কুমু অস্থির হয়ে উঠল। মোতির মা তাকে এই দুঃখ থেকে স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে কুমু মোতির মাকে অনুরোধ করে তার দাদাকে একটি টেলিগ্রাম করে দেবার জন্য। মোতির মা কুমুর এই অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেল। মোতির মা কুমুকে শোবার ঘরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে কুমুর সেই ঘরে কোন অধিকার নেই। কুমুর এই অবনতির কথা চিন্তা করে মোতির মার গিয়ে জানায় যে মধুসুদনের ডেস্কের মধ্যে খোঁজ করতে যে কুমুর কোন চিঠি সেখানে আছে কি? নবীন এই কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেল। উত্তরে মোতির মা জানায় নবীন যদি না যায় তবে সে নিজেই এই কাজটি করবে। নবীন তখন সাহসের সঙ্গে বলে দিনের বেলা অনেক লোক থাকে তাই রাতের বেলা সে এটি দেখে খবর দিতে পারবে। মোতির মা এরপর নবীনকে একখানি টেলিগ্রাম করতে বলে কুমুর দাদাকে। এই কথা শুনে নবীন জানায় যে দাদাকে জানিয়েই তা সে করবে। কিন্তু মোতির মা তার দাদাকে একথা জানাতে নিষেধ করে। নবীন একথা শুনে অবাক হয়ে যায় কারণ এ বাড়ীতে কোন কাজ কর্তাকে ছাড়া করা যায় না। কিন্তু স্ত্রীর কাছে নবীন তর্কে হার মেনে যায় এবং অফিসের দারোয়ানকে দিয়ে টেলিগ্রাম করতে দেয়। কুমুকে নবীনও খুব ভালবাসত। তার জন্যই সে এতবড় দুঃসাহসিক কাজের ভার নিতে পারল।

          কুমু ও মধুসুদনের মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে তাদের দুরত্ব আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। সেই সুযোগে শ্যামা মধুসুদনের সেবাযত্ন করে নিজেকে তার কাছে সর্বস্ব আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কিন্তু মধুসুদনের মনে এখনো কুমুর অবস্থান থাকার জন্য সে শ্যামাকে তেমন ভাবে গ্রাহ্য করল না। কিন্তু শ্যামা আশা ত্যাগ করল না, যথারীতি সেবাযত্ন চালিয়ে গেল। কারণ মধুসুদনের এই ব্যবহারে সে মনে দুঃখ পেয়ে ঈর্ষাতে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। শ্যামা প্রতিদিন মধুসুদনের আহারের সময় কাছে বসে সেবাযত্ন করে। শ্যামা মাঝে মাঝে তাকে কুমুর কথা বলে তার মনোভাব জানার চেষ্টা করে। মধুসূদন কুমুর জন্য অনেক অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু তবুও কুমুকে যে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে পায় না। যার জন্য মধুসুদনের মন আরো বেশি জটিল হতে শুরু করে। মধুসূদন হঠাৎ অফিসে মস্ত একটা জরুরী কাজ করবার ভান করে ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়ল। সামনে একটি খাতা দেখে সে লোকচক্ষুর প্রতারনা করার উদ্দেশ্যে সেটা খুলে বসল। এই খাতাতে তার বাড়ীর সমস্ত চিঠি ও টেলিগ্রাম রওনা হওয়ার দিনক্ষণ লেখা থাকে। খাতা খুলে সে দেখতে পেল যে আজকের তারিখে একটি কুমুর টেলিগ্রাম বিপ্রদাসের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই চিঠি দেখে মধুসূদনের মাথা খুব গরম হয়ে যায়। তাই রেগে গিয়ে তৎক্ষণাৎ দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে এই টেলিগ্রাম কোন ব্যক্তির দ্বারা পাঠানো হয়েছে। দারোয়ান সঙ্গে সঙ্গে নবীনের কথা বললে মধুসূদন তাকে ডাকতে বলে। মধুসূদনের তলব শুনে নবীন পাংশুবর্ণ মুখে এসে হাজির হয়। মধুসুদনের প্রশ্নের কোন উত্তর নবীন দিতে পারল না। কোন উত্তর না পেয়ে মধুসূদন সবেগে হাত নেড়ে নবীনকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করে দেয়।

          নবীন ঘরে গিয়ে মুখ শুকনো করে মোতির মাকে সব কিছু জানিয়ে দিল। নবীন তার স্ত্রীকে বলে যে তাদের এখানে বসবাস আর চলবে না, দাদা তাদের উভয়কেই এখান থেকে বিতাড়িত করবে। এখান থেকে তাদের বিতাড়নের সম্ভবানার কথা আলোচনা করতে থাকে নবীন ও তার স্ত্রী। নবীনের স্ত্রী এরপর স্বামীকে কর্তাবাবুর দেরাজ সন্ধান করতে বলে। মোতির মায়ের একথা শুনে নবীন চমকে যায়। তাই ভয়ের সঙ্গে সে হাত জোড় করে বলল - “দোহাই তোমার মেজোবউ–সাপের গর্তে হাতি দিতে যদি বলতে আমি দিতুম, কিন্তু দেরাজে না।”৮৫ নবীনের এই কথার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি সে তার দাদাকে অন্তর থেকে কতটা ভয় করত। তাই এই দুঃসাহাসিক কাজ করতে রাজী হল না। কিন্তু মোতির মা তার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে তার জেদের মধ্যেই স্থির হয়ে রইল। সে অনুমান করে যে এই দেরাজের মধ্যে কুমুর চিঠি বিদ্যমান আছে। স্ত্রীর কথাকে নবীন সম্পূর্ণ সমর্থন করে কিন্তু তার অন্তরে যে ভয় তা কিন্তু থেকেই যায়। কিন্তু তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার জন্যই নবীন এই দুঃসাহসিক কাজ করতে রাজী হয়। সেই রাত্রেই নবীনের কাছে মোতির মা খবর পায় যে কুমুর নামে একটা চিঠি ও একটা টেলিগ্রাম দেরাজে আছে। মোতির মা এই খবর পেয়ে আত্মদহনে দগ্ধ হতে লাগল। কারণ সে কুমুর দুরাবস্থার কথা চিন্তা করতে লাগল। এই গোপন ব্যাপারটি জানতে পেরে কুমু মধুসূদনের প্রতি সমস্ত আশা আখাঙ্খা ত্যাগ করে। সে জানতে পারে যে স্বামী তাকে শত্রুর চেয়ে বেশি ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখে। তাই তার মন একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তার এই অপমান যে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।

          কুমুর প্রতি মধুসূদনের এই কঠোর আচরণ দেখে কুমু চিন্তা করতে থাকে যে ঐ অপমান নিয়ে তার সারাজীবন এভাবে থাকা সম্ভব নয়। কঠিন দায়বশতঃ তাই কুমু পন করল যে তার মনের মধ্যে কিছুতেই সে আর পুনরায় আগুন জ্বলতে দেব না। তাই সে আজ নিজের মনকে স্থির করে পরবর্তীকালে সে সংসার ধর্মের সত্যপথে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ব্রতী করবে। এই জন্যই কুমু দরজা বন্ধ করে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে লাগল। তার এই কাজে সবচেয়ে সহায় হল তার দাদার উপদেশের কথা। তাই কুমু তার দাদার কাছ থেকে ধৈর্যের আশ্চর্য গভীরতা থেকেই শিক্ষা লাভ করতে চেষ্টা করল। কুমু নিজের মনকে একাগ্রতা করার জন্য সেই দুপুরে পুরো উপবাসী থেকে গেল। এরপর কুমু তার ঠাকুরের বিগ্রহ মূর্তিকে অন্তরের মধ্যে বসিয়ে ছাদের এককোণে গিয়ে আসন পেতে বসল। কুমু তার ঠাকুরের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বলতে পারে - “ঠাকুর, আর কখনো যেন তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ না ঘটে; তুমি আমাকে কাঁদিয়ে তোমার আপন করে রাখো।”৮৬ কুমুর এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে সে নিজেকে পূর্বের থেকে অনেকখানি সংযত করতে পেরেছে। অনেকদিন দাদার কোন সংবাদ না পেয়ে কুমুর মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। এমনি করে একদিকে অভিমানের বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মুক্তির আনন্দ, অন্যদিকে দাদার জন্য ভবনার পীড়িত হৃদয়ের ভার, দুইই একসঙ্গে নিয়ে আবার তার সেই কোটরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে। তার পাঠানো টেলিগ্রামের কোন উত্তর না পেয়ে কুমুর মন রহস্যে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ে। স্বামীর প্রতি কোন অধিকার দেখাতে না পেরে কুমু নিজেকে বারবার ধিক্কার দিতে লাগল। এদিকে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় না থাকার জন্য মধুসূদন তার ব্যবসার কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ল। কুমুর অস্তিত্বকে মধুসূদন তার মনে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারল না। তাই শোবার সময় বিছানায় যাবার আগে কুমুর জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু অনেক রাত্রি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কুমুর দেখা না পেয়ে মধুসূদন নিজেকে লজ্জিত বোধ করল। কুমুর এই সাহসের জন্য মধুসূদন মেজো বউ মোতির মাকেই সন্দেহ করে। তাই মধুসূদন রেগে গিয়ে গর্জনের সঙ্গে নবীনকে জানায় যে মেজো বউকে এখান থেকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। উত্তরে নবীন জানায় মেজো বউ তাতে সম্মত আছে। নবীনের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ মধুসূদন পুনরায় জানায় যে মেজোবউ এখান থেকে দেশে যেতে পারবে না। মধুসূদন নবীনকে বলে যে তার নাম করে বলতে এখন তার এখান থেকে যাওয়া চলবে না। যখন সময় বুঝব তখন যাবার দিন আমিই ঠিক করে দেব। নবীন দাদার পূর্বের কথা উল্লেখ করলে তা শুনে মধুসূদন রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দাদার উত্তেজিত অবস্থা দেখে নবীন ভয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

          রাত্রিবেলায় কুমুর চিন্তায় মধুসূদনের ঘুম হল না। তাই সে লণ্ঠন হাতে নিয়ে মধ্য রাত্রিতে কুমুর ঘরে যায়। কুমুর প্রতি সে খুব অন্যায় করছে একথা বারবার মনে করে মধুসূদন আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকে। এরদ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি যে স্থূল চরিত্রের মধুসূদনের কঠিন হৃদয়ের মধ্যে একটা তরতাজা মায়া-মমতা-ভালোবাসার অস্তিত্ব বর্তমান। এইজন্যই সে মধ্যরাত্রিতে ছুটে যায় কুমুর কাছে। মধুসূদন প্রথমে স্থির করল কুমুর অজ্ঞাতেই সে সারারাত তার পাশে জেগে বসে থাকবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না। মধুসূদন কুমুর বুকের উপর থেকে হাতটি সরিয়ে নিতেই সঙ্গে সঙ্গে কুমু পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মধুসূদন আর ধৈর্য ধরতে না পেরে কুমুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল - “বড়োবউ তোমার দাদার টেলিগ্রাম এসেছে।”৮৭ এই কথা শুনে কুমু দ্রুত ঘুম থেকে উঠে বসল এবং বিস্মিত চোখ মেলে মধুসূদনের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। স্বামীর কাছ থেকে টেলিগ্রামটি নিয়ে কুমু সঙ্গে সঙ্গে পড়তে লাগল। কুমু এরপর জিজ্ঞাসা করল যে দাদার কোন চিঠি এসেছে কি? উত্তরে মধুসুদন জানায় যে কোন চিঠি আসেনি। মধুসূদনের এই মিথ্যা কথা বলার কারণ হল যে কুমুর মনে তার দাদার অস্ত্বিত্বের লোপ। স্বামী স্ত্রী এই মধ্যরাত্রে এই ঘরে কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ কুমুর সংকোচ বোধ হল। কুমু যখন উঠব উঠব বোধ করছে তখন মধুসূদন হঠাৎ বলে উঠল - “বড়োবউ আমার উপর রাগ কোরো না।”৮৮ কুমু কোন উত্তর না দেওয়ার জন্য মধুসূদন পুনরায় বলে - “তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ?”৮৯ কুমু তখন উত্তরে জানায় যে কোন রাগ করে নি। মধুসূদনের এই আচরণ দেখে কুমু আশ্চর্য হয়ে যায়। এটাকে যে দৈব্যের বানী বলে মনে করতে থাকে। কুমুর মনে হল যে ঠাকুর হয়তো প্রার্থনায় রাজী হয়েছে। তাই নিজেকে আনন্দে আর নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। মধুসূদন এরপর কুমুকে ঘরে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কুমু তাতে রাজী হয়ে স্বামীর সাথে ঘরে যায়। কুমু ও মধুসূদনের জীবনের এই পর্যন্ত এই সময়টাকে আমরা একটা মিলনের দৃশ্য অনুভব করতে পারি। তারা নিজেদের মনের সমস্ত দ্বন্দ্ব ভুলে মনকে সূচিকা করে একে অপরের স্নেহে আবদ্ধ হয়ে যায়। কুমু মন দিয়ে সুখে শান্তিতে স্বামীর সাথে থাকার জন্য মনকে তৈরি করতে লাগল। তাই কুমু মোতির মায়ের সাথে সংসারের নানারকম কাজে সহায়তা করতে লাগল। কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য জীবন সুখের দেখে শ্যামার গাত্রজ্বালা শুরু হয়ে গেল। কুমু আনন্দের সঙ্গে মোতির মাকে জানায় কালরাত্রে মধুসূদন তাকে দাদার দেওয়া টেলিগ্রাম দেয়। কুমুর এই কথা শুনে মোতির মা কুমকে তার দাদার একটি চিঠির কথাও জানায় যা মধুসূদনের কাছে আছে। কুমু এই কথা বুঝতে পারে যে তার স্বামী এই চিঠির কথা গোপন করেছে। কুমু তখন মোতির মাকে এই চিঠি তার কাছে এনে দিতে অনুরোধ করে। উত্তরে মোতির মা জানায় সেই চিঠি মধুসূদনের দেরাজে আছে, তাই সেখান থেকে বের করা খুব সহজ কাজ নয়। মধুসূদনের এই চিঠির গোপনীয়তাকে কুমু ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই সে আবার স্বামীর প্রতি পুনরায় বিরূপ হয়ে যায়। মোতির মা হয়ত যদি কুমুকে এই খবর না জানাত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবন কিছুদিন সুখের হতে পারত। কিন্তু এই কথা শুনে কুমু তার স্বামীর প্রতি আর বিশ্বাস রাখতে পারল না। তাই তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে শুরু করল। মোতির মা কুমুকে জানায় যে মধুসূদন যখন অফিসে থাকবে সেই সময় গোপনে কুমু গিয়ে যেন তার দাদার চিঠি দেখে নেয়। এই কথা কুমু রাগে গর্জন করে বলতে থাকে - “নিজের চিঠিও কি চুরি করে পড়তে হবে?”৯০

          এতসব ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও কুমু নিজের রাগকে সংযত করার চেষ্টা করল। তাই ছাদে গিয়ে একটি গানকে বারবার গেয়ে মনকে স্থির করতে লাগল। কুমু হঠাৎ একদিন সকলের সামনেই মধুসূদনের দেরাজে গিয়ে তার দাদার চিঠি পড়তে লাগল। ঠিক সেই সময় কুমুকে এ স্থানে দেখে মধুসূদন অবাক হয়ে গেল। মধুসূদন তাকে এখানে আসার কারণ জানতে চাইল। উত্তরে কুমু জানায় তার দাদার চিঠির খোঁজ নিতেই সে এখানে এসেছে। মধুসূদন তখন বিড়ম্বিত হয়ে জানায় – “এ চিঠি আমিই তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলুম, সেই জন্য তোমার এখানে আসবার তো দরকার ছিল না।”৯১ কুমু একটুখানি চুপ থেকে মনকে শান্ত করে বলল - “এ চিঠি তুমি আমাকে পড়তে দিতে ইচ্ছে কর নি, সেজন্য এ চিঠি আমি পড়ব না। এই আমি ছিঁড়ে ফেললুম। কিন্তু এমন কষ্ট আমাকে আর কখনো দিয়ো না। এর চেয়ে কষ্ট আমার আর কিছু হতে পারে না।”৯২ এই কথা বলে কুমু মুখে কাপড় দিয়ে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল। মধুসূদনের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল আজ দুপুরে কুমুর সাথে সে অনেক কথা বলবে এবং তাকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে। কিন্তু এই চিঠিকে কেন্দ্র করে তার সেই আশা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়। পালের নৌকায় হঠাৎ পাল কেটে গেলে তার যে দশা হয় ঠিক সেইরকমই দশা এখন মধুসূদনের। তাই সে বেশি দেরি না করে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি অফিসে চলে গেল। অফিসে গিয়েও সে চিন্তা থেকে মুক্তি পেল না তাই কোন কাজ করতে না পেরে আজ অনেক আগেই অফিস থেকে বাড়ী ফিরে এল।

          সমস্ত ঘটনা শুনে নবীন ও মোতির মা বুঝতে পারল যে এবারে তাদের ভিত গেল ভেঙ্গে। তাই পালিয়ে বাঁচবার আশ্রয় তাদের আর কোথায় পাওয়া গেল না। এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে মোতির মায়ের কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু কুমুর কথা চিন্তা করে তার মন বিচলিত হয়ে উঠল। নবীন তার স্ত্রীকে জানায় যে তার দাদা এমন সুন্দর বউ ঘরে পেয়ে তাকে ঠিকমতো রাখতে পারল না, সমস্ত নষ্ট করে দিলে, ভালো জিনিসের ভাঙ্গা টুকরো দিয়েই অলক্ষ্মী বাসা বাঁধে। স্বামীর কথা শুনে মোতির মা বললে – “সে কথা তোমার দাদার বুঝতে দেরি হবে না। কিন্তু তখন ভাঙা আর জোড়া লাগবে না।”৯৩ মধুসূদন এরপর নবীনকে আবার তলব করল। সঙ্গে সঙ্গেই নবীন ও মোতির মা তার কাছে গেল। মধুসূদন জানতে চাইল কুমু কিভাবে তার দাদার চিঠির সন্ধান পেল? নবীন সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে জানায় এই খবর সে নিজেই দিয়েছে। নবীনের এই কথা শুনে মধুসূদন রাগে গর্জন করে বলে – “হঠাৎ তোমার এত সাহস বেড়ে উঠল কোথা থেকে?”৯৪ মধুসূদন এরপর তাদেরকে আদেশ দেয় যাতে তারা কাল সকালের ট্রেনেই দেশে চলে যায়। দাদার কথাতে সম্মত হয়ে নবীন সেখান থেকে চলে যায়। নবীন ও মোতির মায়ের শাস্তির খবর শুনে কুমু নিজেকে আত্মধিক্কার দিতে লাগল। কারণ সে জানত যে তার জন্যই আজ তাদের এই শাস্তির বিধান। তাই কুমু নিজেও তাদের সাথে রজবপুরে যাওয়ার জন্য জিনিসপত্র গোছাতে থাকে। কুমুর এই আচরণে মধুসূদন অবাক হয়ে যায়। মধুসূদন তখন সন্দেহ করে যে মোতির মা ও নবীন তাকে সঙ্গে যাবার জন্য খেপিয়ে তুলেছে। তাই মধুসূদন নবীনকে এইজন্য খুব ধমক দেন। নবীন কিন্তু দাদার কথায় আর কোন নরম মনোভাব না দেখিয়ে জোর গলায় জানায় - “বড়োবউরানীকে খেপাবার জন্যে সংসারে আর কারও দরকার হবে না, তুমি একাই পারবে। আমরা থাকলে তবু যদি বা কিছু ঠাণ্ডা রাখতে পারতুম, কিন্তু সে তোমার সইল না।”৯৫ এই কথা শুনে মধুসূদন রেগে তার ধারণাতেই স্থির থাকল। দুই ভাইয়ের মধ্যে এই নিয়ে খুব বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হল। মোতির মা এইসব কথা শুনে যখন কুমুর কাছে গেল তখন কুমু তাকে তাদের সঙ্গে রজবপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। মোতির মা বারবার কুমুকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কুমু কিন্তু তাদের সাথে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠল। শেষমেষ মোতির মা কুমুর কাছে হার মেনে নিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজী হয়ে গেল। মোতির মা ও কুমু একসাথে যখন কাপড় গোছাতে লাগল তখন হঠাৎ সেই ঘরে মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটে। মধুসূদন এসে কুমুকে হুকুম করে জানায় তার যাওয়া হবে না। কুমু সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর এই হুকুম স্বীকার করে নিল।

          মধুসূদন কুমুকে ভালোবেসে আংটি দিতে চাইলে কুমু তা নিতে অস্বীকার করে বলে - “আমার যে-আংটির দরকার ছিল সে তুমি পরতে বারণ করেছ, আর আমার আংটির দরকার নেই।”৯৬ কিন্তু কিছু পরে স্বামীর হুকুমের জেরে কুমু তিনটি আংটি পরতে রাজী হয় এবং মধুসূদন সেগুলি তাকে পরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর মধুসূদন ভেবে পেল না কি বলবে। তাই হঠাৎ তার মুখ লাল হয়ে উঠল এবং ধিক্কার দিয়ে কুমুকে বলে - আচ্ছা যাও। আবার রেগে বলল - “দাও আংটি গুলো ফিরিয়ে দাও।”৯৭ কুমু তৎক্ষণাৎ আংটি গুলি খুলে রেখে দিয়ে চলে গেলো। এতদিন মধুসূদনের জীবনযাত্রার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল কিন্তু বর্তমানে তার জীবনযাত্রায় হঠাৎ একটা অনিশ্চয়তা এসে সব গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছে। অফিস থেকে এসে বাড়ীতে রাত্রিটা যে কি করে কাটাবে তা সম্পূর্ণ তার কাছে অনিশ্চিত হয়ে যায়। রাত্রে মধুসূদন খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চিন্তায় কিছুতেই মধুসূদনের ঘুম আসতে চাইল না। রাত্রি যতই বাড়তে লাগল ততই মধুসূদনের ভিতরকার উপবাসী জীবটা অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে লাগল। মধুসূদন নিজেকে খুব একাকীত্বের সংকটে ভুগছিলেন। তাই মধুসূদন মধ্য রাত্রিতে কুমুর ঘরের দিকে গেল। সেখানে গিয়ে দরজা থেকে ভিতরে দুজন মহিলার আলাপ- আলোচনা শুনেই ফিরে গেল। সেখান থেকে যখন মধুসূদন ফিরছিল ঠিক তখনই তার নজরে পড়ে শ্যামাসুন্দরীকে। এত রাত্রে এখানে সে কি করছে একথা মধুসূদন শ্যামাকে জিজ্ঞাসা করে। শ্যামা উত্তরে জানায় যে তার পায়ের শব্দ শুনেই সে এখানে আসে। শ্যামার এই কথা শুনে মধুসূদন গর্জন করে বলে- “আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ো না, সাবধান করে দিচ্ছি। যাও শুতে।”৯৮ শ্যামা কয়দিন ধীরে ধীরে একটু একটু করে তার সাহসের ক্ষেত্র বাড়িয়ে চলেছিল। কিন্তু মধুসূদনের আজকের ভৎর্সনা শুনে সে অনুমান করল সে ভুল জায়গায় পা রেখেছে। শ্যামা তখন মধুসূদনকে কটাক্ষপাত করে চলে গেল। মধুসূদন এরপর ধৈর্য ধরতে না পেরে নবীনকে দিয়ে কুমুকে তার ঘরে তলব করে। কুমু তার ঘরে প্রবেশ করলে মধুসূদন তার কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করে। তাই মধুসূদন আর্তকণ্ঠে বলতে পারে –“আমাকে মাপ করো, আমি দোষ করেছি।”৯৯ মধুসূদনের এই অপ্রত্যাশিত মিনতি দেখে কুমু অবাক হয়ে যায়। মধুসূদন তখন স্ত্রীকে খুশি করার জন্য জানায় যে নবীন ও মোতির মাকে এবাড়ী ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না। তারা দুজন এবাড়ীতে তোমার সাথেই থাকবে।

          মধুসূদন সিন্ধান্ত নিয়েছিল যে নিজের মান খর্ব করেও কুমুর মান ভাঙাবার চেষ্টা করবে। স্বামীর এই কথা শুনে কুমু কোন উত্তর দিতে পারল না, বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। মধুসূদন হঠাৎ নবীন ও মোতির মাকে তার কাছে নিয়ে এসে তাদেরকে এ বাড়ীতে থাকার জন্য সব ঠিক করে ফেলল। নিজের সমস্ত আদর্শকে খর্ব করে মধুসূদন স্ত্রীকে খুশি করার চেষ্টা করল। মধুসূদন এরপর কুমুকে শোবার জন্য বিছানায় যেতে বললে কুমু জানায় তার মন এখনো তৈরি হয়নি তাই তার মন তৈরি হতে কিছু সময় প্রয়োজন। কুমুর এই কথা শুনে মধুসূদন প্রচণ্ড রেগে যায়। তাই মধুসূদন গর্জন করে বলতে পারে - “তুমি বলতে চাও, আমাকে তোমার ভালো লাগছে না।”১০০ মধুসূদন তখন কুমুকে জানায় যে তার দাদার কথাতেই সে এমন অবাধ্য হয়েছে। মধুসূদনের এই কথা শুনে কুমুর মনে ভীষণ রাগ হয়। তাই এই সময় তাদের উভয়ের মধ্যে নানারকম তর্কাতর্কিতে দুজনেই হতাশ হয়ে পড়ে। কুমুদিনী বিছানাতে না এসে ঘরের মধ্যেই দাড়িয়ে রইল। তখন মধুসূদন কুমুকে জিজ্ঞাসা করে – “বড়ো বউ, তোমার মন কি পাথরে গড়া?”১০১ কুমুর কোন উত্তর না পেয়ে মধুসূদন আবার কুমুকে বলে - “আমি তোমার অযোগ্য, কিন্তু আমাকে কি দয়া করবে না?”১০২ মধুসূদনের এই কথা শুনে কুমু লজ্জিত হয়ে স্বামীর পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইল। মধুসূদন তখন তাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে বুকে ধরে বলল – “না, তোমাকে আদেশ করব না, তুমি আপন ইচ্ছাতে আমার কাছে এসো।”১০৩ মধুসূদন বুঝতে পেরেছিল যে গায়ের জোরে কুমুর ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব নয়, তাই সে কুমুকে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিল। মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে একটা মেলবন্ধন আমরা পুনরায় লক্ষ্য করলাম। মধুসূদন এরপর কুমুর বাপের বাড়ীর শাড়ি গায়ে দেখে তার মনটা ভেঙ্গে গেল। তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমুকে শুতে যেতে বলে নিজে সোফায় বসে থাকল। কুমু এরপর ঠাকুরের উপর অভিমান করে। তাই সে নিজের অশুচিতা বা অসতীত্বের জন্য আজ তার প্রতি ভক্তি জাগল না। কুমু তাই বিদ্রোহিণী মনে বলতে পারে - “তোমাকে আমি সহ্য করব কি করে? কোন লজ্জায় আনব তোমার পূজা? তোমার ভক্তকে নিজে না গ্রহণ করে তাকে বিক্রি করে দিলে কোন দাসীর হাটে-যে হাটে মাছ মাংসের দরে মেয়ে বিক্রি হয়, যেখানে নির্মাল্য নেবার জন্যে কেউ শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজার অপেক্ষা করে না, ছাগলকে দিয়ে ফুলের বন মুড়িয়ে খাইয়ে দেয়।”১০৪ কুমুর এই প্রতিবাদী ভাবনায় আমরা বুঝতে পারি যে মধুসূদনের কামনা বাসনা ভরা মানসিকতাকে সে ভালো চোখে নেয় নি। কুমুর মনে মধুসূদনের যে ক্ষুদ্রখানি ভালোবাসা জমেছিল তা অকালে নষ্ট হয়ে গেল।

          কুমুর এই দুর্যোগ ভরা সময়ে শ্যামাসুন্দরী সুযোগ পেয়ে টিপ্পনী কাটতে থাকে। শ্যামা কুমুকে তার দাদার আসার খবর শুনিয়ে কুমুর মনকে বিহ্বল করে তোলে। শ্যামা এটা জাহির করতে চায় যে সে মধুসূদনের কত কাছের মানুষ। শ্যামা যখন জানতে পারল যে কুমু এই খবর জানে না তখন সে তার মনকে উসকিয়ে নানারকম কথা বলতে লাগল। কুমু এইসব কথা শুনে মধুসূদনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল। কুমু তখন হাবলুকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইল। কুমুর কাছে হাবলুর উপস্থিতিটাও মধুসূদনের চোখে সহ্য হল না। মধুসূদনের এই আচরণে কুমু মনে মনে খুব দুঃখিত হল। মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে এই নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব দেখা গেল। হাবলুর দেওয়া সাধারন একটি কাগজের মোড়ক নিয়েও তাদের উভয়ের মধ্যে অনেক তর্কাতর্কি হতে দেখা যায়। মধুসূদন সন্দেহ করে যে এই মোড়কটি কুমুর দাদা গোপনে তাকে পাঠিয়েছে। কুমু এই মোড়কটির সন্ধানের খবর মধুসূদনকে না জানালে মধুসূদন রাগে গর্জন করে উঠে। মধুসূদন তখন কুমুকে রুঢ় কণ্ঠে বলে – “এ তোমাদের নুরনগরি চাল, দাদার ইস্কুলে শেখা।”১০৫ মধুসূদন যখন জানতে পারল যে এই মোড়কটি হাবলু কুমুকে দিয়েছিল তখন সে নিজেকে লজ্জিত বোধ করল। মধুসূদন তারপর কুমুর হাত চেপে ধরে ঝাকানি দিয়ে বলল – “অসহ্য তোমার বাড়াবাড়ি।”১০৬ মধুসূদনের এই কথা শুনে কুমু রাগে লাল হয়ে গেল। কুমুর সাথে দ্বন্দ্বের ফলে মধুসূদনের নিজের অফিসের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কুমুর কাছে তার জীবন অতিবাহিত করা দুঃসহ হয়ে উঠল। এমন সময় শ্যামাসুন্দরী এসে কুমুকে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে কটাক্ষ করে এবং তাকে পরামর্শ দিতেও ভুলে না । কুমু এসব সহ্য করতে না পেরে নবীন ও মোতির মায়ের কাছে চলে যায়। সেখানে গিয়ে কুমু জানতে পারে যে তার দাদা কাল সত্যিই আসছে। দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কুমু চিন্তা ভাবনা করতে থাকলে নবীন তাকে আশ্বস্ত করে জানায় যে তার সব ব্যবস্থা সে করে দেবে। মধুসূদন কুমুকে আর সহ্য করতে পারল না। হঠাৎ মধুসূদন জ্যোতিষীর কাছ থেকে এসে কুমুর প্রতি তার মন সম্পূর্ণ কোমল হয়ে গেল। কুমুকে সে ঘরের লক্ষ্মী ভাবতে শুরু করল। আজ দাদার সাথে দেখা করার জন্য কুমুর মন একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল। কুমু খুব দয়ালু বশত মুরলী বেহারাকে একটি গরম জামা দান করে। মধুসূদন কুমুকে আবার পূর্বের মতো ভালোবাসার চেষ্টা করে। তাই তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কিছুটা হলেও মধুর হতে দেখা যায়।

          শ্যামাসুন্দরী মধুসূদনকে কাছে পাবার জন্য মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করলেও কিন্তু তাতে মধুসূদন বিরক্তিভাব দেখায়। ফলে শ্যামাসুন্দরীর মধ্যে প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতার সৃষ্টি হয়। মধুসূদন কুমুকে খুশি করার জন্য তার দাদার দেওয়া নীলার আংটিটি হাতে পরিয়ে দেয়। মধুসূদন এরপর কুমুর হাতে চুমু খেয়ে বলে – “ভুল করেছিলুম তোমার হাতের আংটি খুলে নিয়ে। তোমার হাতে কোনো জহরতে কোনো দোষ নেই।”১০৭ মধুসূদনের এই কথা শুনে শুধু কুমু নয় আমাদেরকেও অবাক করে দেয়। মধুসুদন কুমুকে তার বাপের বাড়ীর কালুদার সাথে দেখা করার জন্য বলে। কালুদার সাথে সাক্ষাৎ করে দাদার কথা শোনে কুমুর মনটা দাদার জন্য ছটফট করে উঠল। বাপের বাড়ীর স্মৃতিতে ভরে ওঠে তার মন। কুমু যখন বুঝতে পারল যে সে স্বামীর উপযোগী হতে পারছে না, তখন তাই সে বলতে পারে - “আমাকে তোমার করে নাও-হুকুম করো, শাস্তি দাও। আমার মনে হয় আমি তোমার যোগ্য নই।”১০৮ কুমুর মন ফিরে পাবার জন্য মধুসূদন কুমুর দাদার কাছ থেকে পাওয়া তার এসরাজটি এনে দেয়। এই ঘটনা থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে মধুসূদন কুমুর মন পাওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। মধুসূদন কুমুর এসরাজের বাজনা শুনে খুশি হয়ে কুমুকে কিছু দিতে চাইল। মধুসূদনের কাছে এতবড় সুযোগ পেয়ে কুমু মুরলী বেহারাকে শীতের কাপড় দিতে চায়। কুমুর কাছে এই কথা শুনে মধুসূদন অবাক হয়ে যায়। মধুসূদনের মন যদিও একটু আত্মত্যাগের ঢেউ উঠেছিল কিন্তু সামান্য বেহারার জন্য তুচ্ছ প্রার্থনায় ঠেকে গিয়ে আবার তলায় নেমে গেল।এই ঘটনার পর তাদের দুজনের মধ্যে সহজে কথাবার্তা বলা অসাধ্য হয়ে গেল। কুমুর কাছে উত্তেজনার কথা শুনে মোতির মায়ের ভয় লাগতে লাগল। কুমু এরপর প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়ল। মধুসূদনের ব্যবসা সব লণ্ডভণ্ড হতে লাগল। কিন্তু তাতে মধুসূদন খুব একটা মন দিতে পারল না। অফিসের কাজের ব্যস্ততায় কুমুকে তার দাদার চিঠি সে দিতে ভুলে যায়। কুমু যখন সেই চিঠি নবীনের কাছে পায় তখন দেখা গেল যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মধুসূদনের এই আচরণে কুমুর মন ভেঙ্গে যায়। তাই মধুসূদনকে সে ঘৃণার চোখে দেখতে লাগল। সে মনে মনে নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে লাগল। কুমু এই সংকটজনক অবস্থায় নিজের দাদাকেও ভুল বুঝতে লাগল। নবীন ও মোতির মা কুমুকে এই ভুল শোধরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করল। নবীনের কথা শুনে কুমু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে নিজেকে আরাম বোধ করল। দাদাকে ক্ষণকালের জন্য ভুল বোঝার জন্য কুমু নিজের উপর ধিক্কার দিল। নবীন কুমুকে তার দাদার কাছে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে কুমু প্রথমে তা অস্বীকার করে। কিন্তু নবীন নাছোড়বান্দা হয়ে কুমুকে শেষ পর্যন্ত তাতে রাজী করায়।

          রাত্রে মধুসূদন বাড়ী ফিরে অফিসের কাজে ব্যাস্ত থাকার সময় নবীন হঠাৎ গিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়। নবীন দাদাকে তার কাজে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলে মধুসূদন তা অস্বীকার করে। নবীন নানারকম কথাবার্তা বলে দাদার মনকে সহজ সরল করার চেষ্টা করতে লাগল। নবীন এরপর কুমুর বাপের বাড়ী যাওয়ার কথাটা মধুসূদনের কাছে পেশ করে। মধুসূদন এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাতে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়ে দেয়। নবীন এই সম্মতি আদায় করে খুশি হয়ে চলে যায়। কুমুকে তার দাদার কাছে চাওয়ার জন্য নবীনকেই সব দায়িত্ব দিয়ে দেয় মধুসূদন। রাত্রি যখন বাড়তে লাগল তখন মধুসূদনের কাজে বিরক্তি লাগল এবং মনে মনে কুমুর কাছে যেতে চাইল। তাই কাজ রেখে দিয়ে মধুসূদন শোবার ঘরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে সে দেখে কুমু তখন ঘুমোচ্ছে। মধুসূদন প্রথমে একটা আওয়াজ করাতেই কুমু হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে চমকে উঠে বসল। মধুসূদনকে দেখে কুমু বিস্মিত হল কারণ আজ তার এখানে আসার কোন কথা ছিল না। কুমুর ভাব দেখে মধুসূদন খুব রেগে গিয়ে বলে – “আমাকে কোনমতেই সইতে পারছ না, না?”১০৯ স্বামীর এ হেন কথা শুনে কুমু কোন উত্তর দিতে পারল না। মধুসূদন এরপর কুমুর দাদার প্রসঙ্গ তুলে তুলোধনা করতে লাগল। দাদার নাম শুনেই কুমু শক্ত হয়ে উঠল। কুমু জানায় যে তার দাদার কাছে সে যেতে চায়নি এবং এর জন্য সে কারো কাছে দরবার করতেও বলেনি। কুমু ও মধুসুদনের বাকবিতণ্ডা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। কুমুও আর অত সহজে মধুসূদনকে ছেড়ে দেয় না। কুমু সবচাইতে বেশি আঘাত পায় যখন মধুসূদন তাকে বিছানায় শোবার অধিকারের কথা বলে অপমান করে। এই কথা শোনে কুমু তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে চলে যায়। মধুসূদন তখন ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় শ্যামাসুন্দরীকেই শিকার করে নেয়। শ্যামার এতদিনের চেষ্টা সফল হয়ে যায়। মধুসূদন ও শ্যামার মিলনের দৃশ্য নবীন ও মোতির মায়ের চোখকে এড়িয়ে গেল না। তাই পরের দিন যখন কুমু বাপের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন নবীন ও তার স্ত্রী মনে করেছিল যে এইসময় কুমুর চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা। নবীন তাই কুমুকে তাড়াতাড়ি বাপের বাড়ী থেকে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করে। কুমু রাগে, দুঃখে, অপমানে, ঘৃণায় বাড়ী ছেড়ে দাদার কাছে চলে গেল। মধুসূদনের আদেশ ছিল যতদিন না সে ডেকে পাঠায় ততদিন কুমুর ফিরে আসার দরকার নেই।

          কুমু চলে যাবার পর মধুসূদন ও শ্যামাসুন্দরীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। এই দেখে শ্যামাও একটু একটু করে মধুসূদনের কাছে এগোতে লাগল। তারমধ্যে কোন সংযমবোধ কাজ করল না। মধুসূদন শ্যামাকে নিজের স্থান দিতে কোন কুণ্ঠাবোধ করল না। মধুসূদন ও শ্যামার এইসব কাণ্ড দেখে বাড়ীর সমস্ত কর্মচারীরা অবাক হয়ে গেল। মধুসূদন শ্যামাকে নিজের বিছানায় স্থান দিতেও কোন কুণ্ঠাবোধ করল না। নবীন ও মোতির মা এই দেখে চিন্তা করল যে এইসময় কুমুকে ডেকে না আনলে এবার আর ঠেকানো যাবে না। নবীন ও মোতির মা কুমুকে বাপের বাড়ীতে দেখতে গিয়ে বাড়ীর এই সমস্ত ঘটনা সব বিস্তারিত ভাবে জানিয়ে দেয়। মধুসূদন ও শ্যামার এই সম্পর্কের কথা শুনে কুমু একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তাই স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা একেবারেই লুপ্ত হয়ে যায়। বিপ্রদাস যখন মধুসূদনের এইসব নোংরামির খবর শুনে তখন সেও বিদ্রোহে গর্জন করে কুমুকে তার স্বামীর কাছে যেতে নিষেধ করে দেয়। কুমুর এই সংকটজনক অবস্থায় দাদা বিপ্রদাস তাকে বিদ্রোহের জন্য উজ্জীবিত করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জানা যায় যে কুমু সন্তানসম্ভবা। এরফলেই কুমু ও মধুসূদনের দাম্পত্য বিচ্ছেদ কেটে গিয়ে তাদের মিলন সংযোগ তৈরি হয়। অর্চনা মজুমদারের মতে – “সন্তান জন্মের পর মধুসূদনের সন্তানকে মধুসূদনের হাতেই তুলে দেবে বলে কুমুদিনী তার বিরূপ মন নিয়ে মধুসূদনের বাড়ীতে ফিরে এল।”১১০ সন্তানের জন্যই কুমু ও মধুসুদন তাদের বিরূপ মানসিকতাকে ছিন্ন করে মিলন মাধুর্যে মিশে যায়।









তথ্যসূত্র

৩১. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৩৭৩

৩২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৭৩

৩৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৭৫

৩৪. রবীন্দ্র রচনাবলী (নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯,দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৩৭৫

৩৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৮৬

৩৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৮৮

৩৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৮৮

৩৮. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯১

৩৯. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯১

৪০. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯১

৪১. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৩

৪২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৮

৪৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৮

৪৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৯৯

৪৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪০০

৪৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪০১

৪৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪০২

৪৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪০২

৪৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪০২

৫০. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৩

৫১. রবীন্দ্র রচনাবলী (নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯,দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪০৪

৫২. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৪

৫৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৫

৫৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৫-৪০৬

৫৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৫৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৬

৬০. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৯

৬১. ঐ পৃষ্ঠা-৪০৯

৬২. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৬৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৭০. ঐ পৃষ্ঠা-৪১০

৭১. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড), সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯, প্রথম আনন্দ সংস্করণ জানুয়ারি-১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৩৬৭-৩৬৮

৭২. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪১২

৭৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪১২

৭৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪১২

৭৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৭. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড), কামিনী প্রকাশনী, কলকাতা-৯, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৭৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮০. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮১. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮২. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৩

৮৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৪

৮৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪১৫

৮৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪২১

৮৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৩

৮৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৫

৮৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৬

৮৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৬

৯০. ঐ পৃষ্ঠা-৪২৮

৯১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩০

৯২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩০

৯৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩০

৯৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩১

৯৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৩

৯৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৪

৯৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৪

৯৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৫

৯৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৬

১০০. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৮

১০১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯

১০২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯

১০৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯

১০৪. রবীন্দ্র রচনাবলী(নবম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯,দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-৪৪০-৪৪১

১০৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৬

১০৬. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৬

১০৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪৫৬

১০৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪৫৮

১০৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪৬৯

১১০. রবীন্দ্র উপন্যাস পরিক্রমা,অর্চনা মজুমদার,দে’জ পাবলিশিং,কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ ১৯৭০, পৃষ্ঠা-১২৯

Thursday, July 19, 2018

‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)



‘চোখের বালি’ রবীন্দ্রনাথের এক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এখানে ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্র বিশ্লেষণে লেখক অনন্যপূর্ব গভীরতা ও কৌশল দেখিয়েছেন। এই প্রতিভা দক্ষিণহস্তের সুধাভাণ্ডে সুধার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও বামকরের বিষভাণ্ডও একেবারে শুন্য নয়। আশার পাতিব্রত্য, রাজলক্ষ্মীর পুত্রস্নেহ, অন্নপূর্ণার সাত্ত্বিকতা, বিহারীর উন্নত হৃদয় – এই মাধুর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে বিনোদিনীর বিলাসলীলা ও মহেন্দ্রের নগ্ন দূর্বলতার একটু তিক্ত রসও গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। অতিভোগে চোখের বালির আরম্ভ, অবসাদ ও উচ্ছৃঙ্খলতা এর দ্বিতীয় অবস্থা, প্রকৃত মাধুর্যে এর শেষ। এই জন্যে রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু সত্ত্বেও চোখের বালি ট্র্যাজেডি হতে পারেনি। ট্র্যাজেডি নয় বলিয়া এই উপন্যাসে করুণ রসের অভাব নাই। মহেন্দ্র আশাকে ত্যাগ, রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু, বিহারী ও বিনোদিনীর একক জীবন এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র ঘটনায় এই উপন্যাসের করুণাধারা প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ফল্গুধারার মতো বহমান। এই রচনায় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সম্পর্কে যথেষ্ট পরিপক্কতা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই উপন্যাস সম্পর্কে বলেন – ‘এই প্রথম আঁতের কথা বলিলাম।’ উপন্যাসে প্রধান চরিত্র মহেন্দ্র – বিহারী – আশা – বিনোদিনী এরা পরস্পরের মধ্যে মানসিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে কতকটা স্বভাবের তাড়নায়। বিনোদিনী বিধবা, আশা বিবাহিতা – এই দুই নারীতত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেছেন আশ্চর্য কৌশলে। সাহিত্যের যৌনতাকে ডেকে আনার জন্যে রবীন্দ্রনাথ সমাজ থেকে যথেষ্ট নিন্দাবাদ শুনেছিলেন। তবুও একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, চোখের বালি মানুষের অন্তর্জীবনের এক অভ্রান্ত দলিল। এই উপন্যাসে দাম্পত্যের মধ্যে যে কলহ বা অশান্তি আছে সেই চিত্রগুলি আমরা খোঁজার চেষ্টা করব।

উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পাই, মহেন্দ্রের মা রাজলক্ষ্মী তার ছেলের সাথে বিনোদিনীর বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মহেন্দ্র এই বিয়েতে প্রথমে রাজী হয় না। তখন রাজলক্ষ্মী ঐ একই প্রস্তাব বিহারীকে দেয় এবং বিহারীও ঐ প্রস্তাবকে স্বীকার করে না। তখন রাজলক্ষ্মী তার জন্মভূমি বারাসাতের গ্রাম সম্পর্কীয় এক ভ্রাতৃস্পুত্রের সঙ্গে উক্ত কন্যা বিনোদিনীর বিবাহ সম্পন্ন করলেন। কিছুদিন পর বিনোদিনী বিধবা হল। মহেন্দ্র এত বেশি মাতৃভক্ত যে সে বিয়ে করতে চায় না। কারণ তার ধারণা যে বিয়ে করলে বউ এসে তাদের মাতা-পুত্রের সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে দেবে। মাতা রাজলক্ষ্মী বিয়ের সম্বন্ধে পুত্রকে খুব একটা জোরও করতেন না। এই বিষয়ে রাজলক্ষ্মী ও মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার মধ্যে তর্কাতর্কি হয়ে বাদানুবাদ হয়ে যায়। মহেন্দ্র তার কাকিমা অন্নপূর্ণাকে খুব মান্য করত। মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার একটি পিতৃ-মাতৃহীন বোনঝি ছিল। অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের সঙ্গে তার বোনঝির বিবাহ দিয়ে কোনো সূত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে নিজের কাছে আনিয়া সুখী দেখতে চান। যদিও মহেন্দ্র বিবাহে নারাজ, তবু কাকির এই মনোগত ইচ্ছাটি তার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলে মনে হত। মহেন্দ্র অন্নপূর্ণাকে জানায়, যে বিহারীকে সে তার বোনঝির সঙ্গে বিবাহে রাজী করিয়ে দিয়েছে। তাই মেয়ে দেখিবার দিন ঠিক করার জন্য অনুরোধ করল। অন্নপূর্ণা এই কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। কারণ বিহারীকে সে খুব ভালভাবেই জানতেন। বিহারীকে অন্নপূর্ণা নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। এরপর একদিন মহেন্দ্র ও বিহারী অন্নপূর্ণার ঐ বোনঝিকে দেখতে গেল। মেয়ে দেখার পরেই সঙ্গে সঙ্গেই বিহারী তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যায়। কারণ বিহারী মেয়ে দেখার আগেই মনে মনে এই বিয়েতে রাজী হয়ে গিয়েছিল অন্নপূর্ণা দেবীর সম্মানার্থে। কারণ অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতই ভক্তি করতো। মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে যখন মেয়েটি তাদের জন্য পান সেজে নিয়ে এল, তখন সেই অবকাশে মহেন্দ্র ঐ কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখে নিল। এই অনাথিনীকে দেখে মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগল। তাই সে অনাথিনীর দিকে আর একবার ফিরে চাইল। এই অনাথিনী মেয়েটির নাম আশালতা। মেয়েটিকে দেখার পর মহেন্দ্র মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তাই মহেন্দ্র ব্যঙ্গচ্ছলে বিহারীকে বলে সে আমাকে বিয়ে করবে। বিহারী তখন বলে – “তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন – তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”১ এই কথাগুলি শুনে আমাদের মনে হয় যে বিহারী মহেন্দ্রকে অন্তর থেকে কতটা ভালবাসত। সে নিজের প্রিয় জিনিসও যে তৎক্ষণাৎ বন্ধুর জন্য ত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু মহেন্দ্র তখন বিহারীকে জানায় সে তার সাথে মসকরা করছে। সেই দিন সারারাত্রি মহেন্দ্র মনে মনে আশাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করল এবং কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। যাইহোক আশাকে দেখার পর তার উপর মহেন্দ্রের যে একটা দূর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই পরের দিন সকালে মহেন্দ্র বিহারীকে কাকিমার দোহায় দিয়ে অপ্রত্যক্ষ ভাবে আশাকে বিয়ে করার কথা জানায়। বিহারী মহেন্দ্রকে জানায় যে সেটা করলে তো সবথেকে ভাল হয়। বিহারীর কাছে সম্মতি পেয়ে মহেন্দ্র বাড়ি গিয়ে মাকে জানায় সে আশাকে বিয়ে করতে চায়। প্রথমে মা রাজলক্ষ্মী এতে কিছুতেই রাজী হতে চায় না। কারণ রাজলক্ষ্মী জানায় যে আশার তিনকুলে কেও নেই তাই তার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে সে সুখী হবে না। মহেন্দ্র কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে মাকে জানায় যে মেয়েটিকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই সে তাকে বিয়ে করতে চায়। মাতা রাজলক্ষ্মী এই ব্যাপারে অন্নপূর্ণার ষড়যন্ত্রকে ইঙ্গিত করে তাকে নানারকম কুরুচিকর ভাষায় গালাগালি দেয়। অন্নপূর্ণা এই সব কথা শুনে মহেন্দ্রের সঙ্গে আশার বিয়েতে রাজী হতে পারে না। এই কথা শুনে মহেন্দ্র, মা ও কাকিমার উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে চলে যায়। মহেন্দ্র ছোটবেলা থেকেই মায়ের আদরে লালিতপালিত। সে ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, তাই সে ভীষণ একগুঁয়ে। মা রাজলক্ষ্মী এই কথাটা খুব ভালোভাবেই জানত বলে অন্নপূর্ণার কাছে নতমস্তকে বলে – “যে যাহা চায়, না পাইলে যাহা খুশি করিতে পারে।”২ এরপর অন্নপূর্ণার কথায় বিহারী আশাকে মহেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দিতে রাজী হয়। বিহারী এই সিদ্ধান্তে যে কতটা মর্মাহত হয়েছিল তা জানা যায় তার কথাতেই। যখন সে বলে – “তুমি যেমন আদেশ করিবে তাহাই হইবে। কিন্তু আমাকে আর কখনো কাহারও সঙ্গে বিবাহের জন্য অনুরোধ করিয়ো না।”৩ এরপর রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা এবং মহেন্দ্রের মধ্যে নিষ্ঠুর নিগুঢ়নীরব ঘাত-প্রতিঘাত চলতে চলতে বিবাহের দিন শেষ হল।

আশা সজ্জিতসুন্দর দেহে লজ্জিতমুগ্ধ মুখে আপন নূতন সংসারে প্রথম পদার্পণ করল। তার এই দাম্পত্যের মধ্যে কোথাও যে কোনো কাঁটা আছে, তা তার সহজ সরল হৃদয়ে অনুমান করা গেল না। বরঞ্চ জগতে তাহার একমাত্র মাতৃস্থানীয় অন্নপূর্ণার কাছে আসিতেছে বলিয়া আশ্বাসে ও আনন্দে তার সর্বপ্রকার ভয় সংশয় সব দূর হয়ে গেল। রাজলক্ষ্মী বিয়ের পর মহেন্দ্রকে জানায় যে এখন বউমা কিছুদিন তার জ্যাঠার বাড়িতে গিয়ে থাকুক। কিন্তু মায়ের এই আদেশকে মহেন্দ্র কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাতা ও পুত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এইখানেই মাতা পুত্রের মধ্যে সুসম্পর্কের বন্ধন দূর্বল হতে শুরু করে। এরপর রাজলক্ষ্মী হঠাৎ অপরিমিত উৎসাহে নববধূকে ঘরকন্নার কাজ শেখাতে লাগলেন। ভাড়ার ঘর, রান্নার ঘর, ঠাকুর ঘরেই আশার দিনগুলি কাটতে লাগল। ক্রমান্বয়ে দেখা গেল রাজলক্ষ্মী পুত্রবধূ আশার উপর শারীরিক নির্যাতন করতে শুরু করল। এই দেখে অন্নপূর্ণার দুঃখের সীমা থাকল না, কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু মহেন্দ্র মায়ের এই আচরণ দেখে খুব রেগে যায়। তাই মহেন্দ্র মাকে উত্তেজিত ভাবে বলে – “বউকে ঘরের কাজে আমি দাসীর মতো খাটিতে দিতে পারিব না।”৪ তারপর সে মাকে দৃঢ় কণ্ঠে জানায় সে আশাকে লেখাপড়া শেখাতে চায়। এই কথা শুনে রাজলক্ষ্মী নববধূর হাত ধরে টেনে এনে মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপিত করিয়া দেন। এরপর তার যত রাগ তারই বহিঃপ্রকাশ অন্নপূর্ণার উপর দেখালেন। কারণ অন্নপূর্ণাকে রাজলক্ষ্মী সহ্য করতে পারত না। এরপর মহেন্দ্র স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নিজের কলেজ, লেখাপড়া, সামাজিকতা, এক্সামিন, বন্ধুকৃত্য সবকিছু জলাঞ্জলি দিল। স্ত্রীর উন্নতি সাধন করতে গিয়ে তাকে নিয়ে সে ঘরে প্রবেশ করল। কাজের প্রতি দৃকপাত বা লোকের প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্রও করল না। মহেন্দ্রের এইসব আচার-আচরণ দেখে রাজলক্ষ্মী ঈর্ষায় জ্বলে উঠে। তার ফলেই মাতা ও পুত্রের মধ্যে সম্পর্ক একেবারে চরমে উঠে গেল। সাময়িক মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবন অনেক মধুময় হয়ে উঠল। তারা সবসময় পাশাপাশি থেকে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল। এই জন্য তাদের দাম্পত্যের বন্ধন অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠল।

অনাথিনী আশালতা স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে দিন দিন জীবন সম্পর্কে সজীবতা লাভ করল। আসলে পূর্বে আশালতা এত ভালবাসা কারও কাছে পায় নি। তাই আশা নববধূযোগ্য লজ্জাভয় দূর করে দিয়ে সৌভাগ্যবতী স্ত্রীর মহিমায় মুহূর্তের মধ্যেই স্বামীর পদপ্রান্তে অসংকোচে আপন সিংহাসন অধিকার করল। ফলে পুনরায় রাজলক্ষ্মী ও অন্নপূর্ণার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটল। কারণ রাজলক্ষ্মীর ধারণা ছিল আশার এই বাড়বাড়ন্তের জন্য অন্নপূর্ণার যথেষ্ট ইন্ধন ছিল। মহেন্দ্র আশাকে নিজে লেখাপড়া শেখাতে লাগল। আশার লেখাপড়াতে বেশি মনোযোগ থাকার জন্য মহেন্দ্র সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এটাকেই বেশি গুরুত্ব দিল। ফলে মহেন্দ্রের নিজের লেখাপড়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। মহেন্দ্র আশাকে একটু বেশিই ভালোবাসত। তাইতো মহেন্দ্র বলতে পারে – “আমাকে ছাড়িয়া তুমি যত সহজে পড়া করতে পার, তোমাকে ছাড়িয়া তত সহজে আমি আমার পড়া করিতে পারি না।”৫ এই বক্তব্যটি মহেন্দ্রের স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় দেয়। মহেন্দ্র আশার প্রতি ভালোবাসার জন্য প্রিয় বন্ধু বিহারীর ঘরে প্রবেশ করা পর্যন্ত সহ্য করতে পারল না। কারণ সে শুধুমাত্র স্ত্রীর সাথেই সময় দিতে চাইল। মহেন্দ্র বিহারীকে একজন শত্রু হিসাবে ভাবতে শুরু করল। কারণ মহেন্দ্রের মনে একটা সন্দেহ ছিল যে, বিহারী মনে মনে আশাকে ভালোবাসত। এই কথা ভেবেই মহেন্দ্র প্রিয় বন্ধুকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। একসময় বিহারীর সঙ্গে আশার বিবাহ প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল; তাই মহেন্দ্রের মনে তাদের দুজনকে নিয়ে একটা সন্দেহ থেকেই যায়। মহেন্দ্রের এই আচরণ বিহারী অনুমান করতে পারত এবং মহেন্দ্র এই নিয়ে আমোদ করত।

মহেন্দ্র আশার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজলক্ষ্মী এটা ভালোচোখে দেখেনি। রাজলক্ষ্মী বাড়ি থেকে কয়দিন বারাসাতে যাওয়ার জন্য মহেন্দ্রের কাছে অনুমতি নিতে যায়। মহেন্দ্র এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষন না করেই মাকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দেয়। ছেলের এই আচরণে মায়ের মনে খুব দুঃখ হয়। তাই উদাসী মন নিয়েই রাজলক্ষ্মী কিছুদিনের জন্য বারাসাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। নিজের গ্রামে গিয়ে রাজলক্ষ্মীর কিছুটা অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও ছেলের প্রতি অভিমানবশতঃ কোলকাতায় আর ফিরতে চাইল না। গ্রামে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে না নেওয়ার জন্য রাজলক্ষ্মীর প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। এমন সময় বিনোদিনী এসে তাকে আশ্রয় দিল এবং তার সেবা শুশ্রূষা করতে লাগল। বিনোদিনীর সেবাযত্ন পেয়ে রাজলক্ষ্মী খুব খুশি হয়ে গেল। বিনোদিনীর সেবাযত্নে আহ্লাদিত হয়ে রাজলক্ষ্মী মনের আবেগে বলতে পারে – “মা, তুই আমার ঘরের বউ হলি নে কেন, তা হইলে তোকে বুকের মধ্যে করিয়া রাখিতাম।”৬ এরমধ্যে অন্নপূর্ণাও ঘরসংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে কাশীতে চলে যান। মহেন্দ্র ও আশার অবিশ্রাম মিলনের মধ্যে একটা শ্রান্তি ও দূর্বলতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মহেন্দ্র ঘরসংসারের প্রতি বিমুখ হয়ে ওঠে। গৃহের মধ্যে অনিয়মিত কার্যকলাপ ঘটতে থাকে। মহেন্দ্র ও আশা একাকী বসবাস করতে থাকায় তাদের মধ্যে একসময় বিরক্তিভাব চলে আসে। এইজন্যই মহেন্দ্র মাকে তাড়াতাড়ি আসার জন্য চিঠি লেখে। রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের চিঠি পেয়ে কলিকাতায় ফিরে এল। রাজলক্ষ্মী আসার সময় একাকী না এসে বিধবা বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে আসিল। এই বিনোদিনীর আগমনের মধ্য দিয়েই তাদের সংসারে বিষবৃক্ষের বীজ বপন হয়ে গেল। বিনোদিনীর উপস্থিতিতে আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবন আস্তে আস্তে কলুষিত হতে লাগল। যেহেতু বিনোদিনী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা তাই সে খুব সচেতন। এখানে এসে বিনোদিনী সংসারের সমস্ত কাজে ও রাজলক্ষ্মীর সেবাযত্নে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করে দিল। তার এই কাজকর্ম ও সেবাযত্ন দেখে রাজলক্ষ্মী তার প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ করতে থাকে। এইজন্যই রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে করত। তাই বিনোদিনীকে বিশ্বাস করে রাজলক্ষ্মী বাড়ির সমস্ত কাজের ভার তুলে দিলেন। তাছাড়া তিনি তার সংসারের সমস্ত দায়িত্ব বিনোদিনীকে দিতে কোনো দ্বিধাবোধ করল না। এই সুযোগটাকে বিনোদিনী নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে লাগল।

বিনোদিনীর সঙ্গে আশার অত্যধিক মেলামেশা মহেন্দ্র খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। তাই মহেন্দ্র তার মাকে বারবার অনুরোধ করে যাতে বিনোদিনীকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেওয়া হয়। ছেলের কথা শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে বিনোদিনীর আচরণ সংযত করতে বলল। বিনোদিনী যাতে সাবধান হয় একথাও রাজলক্ষ্মী বারবার জানিয়ে দেয়। তারপর থেকে বিনোদিনী অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্বক আশাকে দূরে দূরে রাখিল। বিনোদিনী আশাকে তাই অভিমান করে বলল – আমি ভাই কে? আমার মতো অবস্থার লোক আপন মান বাঁচিয়ে চলতে না জানলে, কোন দিন কী ঘটে বলা যায় কি? আশা কান্নাকাটি করলেও বিনোদিনী নিজের যায়গায় স্থির থাকে। এদিকে মহেন্দ্র, আশার সাংসারিক অপটুতায় ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। মহেন্দ্রের এই আচরণ আশালতা অন্তরে অনুমান করতে পারে। মহেন্দ্র প্রথমে বিনোদিনীকে সহ্য করতে পারত না। তাই সে বিনোদিনীর সাথে কথা বলত না। এইজন্য বিনোদিনীর মনে খুব দুঃখ হয়। কিন্তু আশালতা বিনোদিনীর সঙ্গে খুব ভালোভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আশালতাই বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রের বন্ধুত্ব সম্পর্ক তৈরি করার জন্য কারিগর হয়ে ওঠে। আশালতার এই প্রয়াসে মহেন্দ্র প্রথম প্রথম খুব অনীহা প্রকাশ করত। কিন্তু আশা তার লক্ষ্যে অবিচল থেকে যায়। আশালতার বারবার প্রয়াসে মহেন্দ্র ও বিনোদিনী পাশাপাশি আসতে শুরু করে। তারা উভয়েই পাশাপাশি আসার ফলে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আশালতা যেহেতু খুব সহজসরল গ্রাম্য মেয়ে তাই সে বুঝতে পারেনি যে স্বামীর সাথে বিনোদিনীর এই সম্পর্কই যে তাদের দাম্পত্য জীবনে গভীর প্রভাব পড়বে। এরপর বিনোদিনী দিনে দিনে মহেন্দ্রকে মনে মনে ভালোবাসতে শুরু করল। মহেন্দ্র ও আশার সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে বিনোদিনী ভিতরে ভিতরে হিংসায় জ্বলে ওঠে। সে ভাবে যে এই সুখের ঘরসংসার আমার হতে পারত, কিন্তু একটু ভুলের জন্য তা আজ সম্ভব হয়নি। তাই সে তাদের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে একটা অশান্তি করার চেষ্টা করল। আশার এই সুখের সংসারকে সে কোনভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। মহেন্দ্র ছোটবেলা থেকে যাকিছু কাছে দেখেছে, তাকেই সে নিজের বলে নিতে চেয়েছে। মহেন্দ্র এই স্বভাববশতই বিধবা বিনোদিনীকেও নিজের কাছে দেখে তাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিল। রাজলক্ষ্মী ও আশার পূর্ণ সমর্থনের ভিত্তিতে বিনোদিনী ভিতরে ভিতরে মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনে চোরাস্রোতের সৃষ্টি করতে থাকে।

আশা যখন প্রথম মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর মধ্যে সাক্ষাৎ করায় তারপর মহেন্দ্র কিন্তু খুব উদগ্রীব হয়ে যায়। আশাকে মহেন্দ্র বারবার জিজ্ঞাসা করে বিনোদিনীর প্রতিক্রিয়া। আশা ও মহেন্দ্রের কথোপকথন কালে হঠাৎ বিহারী এসে পড়ে। বিহারীর মানুষ চেনার ক্ষমতা একটু বেশিই ছিল। তাই সে বিনোদিনী সম্পর্কে আশাকে বলে – “বৌঠান লক্ষণ ভালো নয়। এসব ভোলাইবার কথা। তোমার চোখের বালিকে আমি দেখিয়াছি। আরো যদি ঘন ঘন দেখিতে পাই, তবে সেটাকে দুর্ঘটনা বলিয়া মনে করিব না, সে আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি। কিন্তু মহিনদা যখন এত করিয়া বেকবুল যাইতেছেন তখন বড়ো সন্দেহের কথা।”৭ আসলে বিহারী এই কথাটির সাহায্যে আশা ও মহেন্দ্র উভয়কেই আগেভাগে সাবধান করতে চেয়েছিল। বিহারীর আশার প্রতি একটু দূর্বলতা ছিল। তাই সে চাইত আশার দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয়, তাতে কোনো অশান্তি যেন না আসে। কিন্তু মহেন্দ্র মনে মনে বিনোদিনীর প্রতি একটা আকর্ষণের সৃষ্টি হয় যা আশার কাছে সে গোপন রাখে। আশা এরপর মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর বারবার সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়। মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে বিনোদিনী এসে পড়ায় তার গুরুত্ব মহেন্দ্রের কাছে বেড়ে যায়। বিনোদিনীকে তারা দুইজনেই খুব মান্য করতে লাগল। তারা তাদের দাম্পত্য জীবনের কোন সমস্যার সমাধানের জন্য বিনোদিনীকে বিচারক হিসাবে স্বীকৃতি দেবার চেষ্টা করত। বিনোদিনী খুব সচেতন, তাই এই সুযোগটাকে সে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাবার চেষ্টা করল। মহেন্দ্র ও রাজলক্ষ্মীকে সেবাযত্ন করে বিনোদিনী তাদের মনে নিজের স্থান করে নিল। মহেন্দ্রের মন আস্তে আস্তে আশার দিক থেকে ঘুরে গিয়ে বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণ বাড়তে লাগল। বিনোদিনী এটা খুব ভালোভাবেই অনুমান করতে পেরেছিল। তাই বিনোদিনী সাহস পেয়ে মাঝে মাঝে আশাকে মহেন্দ্রের কাছে ভৎর্সনা করতেও দ্বিধা বোধ করল না। বিনোদিনীর নিজের হাতে তৈরি পশমের জুতো এবং পশমের গলাবন্ধ মহেন্দ্রের কোমল মানসিক সংস্পর্শের মতো বেষ্টন করল। আশা তার নিজস্বতা হারাতে লাগল এবং কতকটা বিনোদিনীকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতে লাগল। আশা বুঝতে পারে যে মহেন্দ্র পূর্বের মতো আর তাকে ভালোবাসে না। কিন্তু তবুও সে স্বামীর প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারল না। আশালতা একবারও মনে ভাবে না যে বিনোদিনী তার দাম্পত্য জীবনের গভীরে ঢুকে কোন অশান্তি করতে পারে। মহেন্দ্র ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা করতে লাগল যাতে বিহারী তাদের ঘরে বেশি আসা যাওয়া না করে। বিহারী মহেন্দ্রের এই কৌশল খুব ভালোভাবেই অনুমান করতে পারে। কিন্তু আশার প্রতি দূর্বলতা বশতঃ সে অপমানিত হয়েও তাদের দাম্পত্য জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবাড়িতে আসা যাওয়া করতে লাগল। বিহারী ইঙ্গিতে আশাকে তার দাম্পত্য জীবনে সর্বনাশের কথা বলতে লাগল। তাই বিহারী বলতে পারে – “বৌঠান, চিকিৎসা করিয়া রোগ সারানোর চেয়ে রোগ না হইতে দেওয়াই ভালো।”৮ বিহারী তখন মনস্থির করল যে তার দূরে থাকা চলবে না, যেমন করে হোক ইহাদের মাঝখানে থেকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে।

বিহারী আহ্বান – অর্ভ্যথনার অপেক্ষা না রেখেই মহেন্দ্রের ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করতে লাগল। এমনকি বিহারী বিনোদিনীকেও অনুরোধ করে বলে – “এই ছেলেটিকে ইহার মা মাটি করিয়াছে, বন্ধু মাটি করিয়াছে, স্ত্রী মাটি করিতেছে – তুমিও সেই দলে না ভিড়িয়া একটা নতুন পথ দেখাও - দোহাই তোমার।”৯ বিহারী যে সমস্ত মাটি করতে এসেছে, এটা বিনোদিনীর বুঝতে বাকী রইল না। বিহারী তার বন্ধু মহেন্দ্রকে সাবধান করে বলে – “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও, করো – বরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে সরল হৃদয়া সাধ্বী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না।”১০ অর্থাৎ বিহারী মহেন্দ্রকে বিনোদিনীর ফাঁদে পড়া থেকে সাবধান করে দেয়। মহেন্দ্র বিহারীর এই কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে যায়। তাই মহেন্দ্র বিহারীকে জানায় যে তার এখানে আসা যাওয়া করা বিনোদিনীর ভালো লাগে না, তাতে সে বিরক্ত হয়। বিহারী তারপর বিনোদিনীর কাছে এসে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করে। এরপর বিনোদিনী এখান ছেড়ে বাড়ি যাবার কথা বললে মহেন্দ্র তাতে অপ্রত্যক্ষ ভাবে বাধা দেয়। তাই মহেন্দ্র ও আশার বারবার অনুরোধে বিনোদিনী এখানেই থেকে যায়। এই ঘটনার পর মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর সম্পর্ক অনেক গভীর হতে শুরু করে। মহেন্দ্রের মনে বিনোদিনীর প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। মহেন্দ্র তাই খড় কুটোর মতো বিনোদিনীকে ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর একটা অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক হতে দেখা যায়। বিনোদিনী মনে মনে বিহারীকে খুব সম্মান করত। বিহারীও বিনোদিনীর মধ্যে যোগাযোগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। যা দেখে মহেন্দ্র সহ্য করতে পারত না। বিনোদিনী কিন্তু মহেন্দ্রকে অগ্রাহ্য করেই নিজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বিহারীকে শ্রদ্ধা করতে লাগল। বিহারীও তাতে সমান ভাবে যোগ দিল। কারণ সে দেখল যে বিনোদিনীকে যদি মহেন্দ্রের মন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় তবে আশার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়ে উঠবে। বিহারীর মনে বিনোদিনীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি দিনে দিনে বাড়তে লাগল। সে পূর্বের ন্যায় বিনোদিনীকে আর অবজ্ঞা করত না। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে পূর্বের মতো কাছে পাবার জন্য চেষ্টা করলেও বিনোদিনী কিন্তু তাকে আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইল না। মহেন্দ্র এরপর আশাকে মানসিক ভাবে প্রতিপদে তীব্র আঘাত করতে লাগল। তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা অশান্তি যেন লেগে গেল। আশা বুঝতে পারে যে তার চারদিকেই সমস্ত যেন উলট পালট হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তা প্রতিকারের কোন উপায় তার জানা ছিল না।

বিনোদিনী বিহারীকে এত বিশ্বাস করতে শুরু করল যে কোন পরামর্শ সে বিহারীর কাছেই নিতে শুরু করল। বিনোদিনীর এই বাড়াবাড়ি দেখে মহেন্দ্র খুব বিরক্তি বোধ করল। বিনোদিনীর অভাব সে কোন মতেই মেনে নিতে পারছিল না। তাই তার মানসিক অবস্থা ক্রমশ অবনতি হতে লাগল। যার ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে ক্রমশ কালো মেঘ দেখা দিতে লাগল। আশার কিন্তু স্বামীর প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালোবাসা ছিল। যার জন্য সে স্বামীকে বলতে পারে – “আমাকে তোমার দাসীর মতো শাসন করো। আমাকে তোমার চরণাশ্রয়ের যোগ্য করিয়া লও।”১১ মহেন্দ্র রেগে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে কলেজের কাছেই একটি বাসা নিয়ে চলে গেল পড়ার অজুহাত দিয়ে। মহেন্দ্রের একটা জ্বালা বিনোদিনীর অন্তরে জ্বলছে, তা হিংসার না প্রেমের, না উভয়েরেই মিশ্রণ তা বিনোদিনী ঠিক ভেবে পায় না। তাই সে তীব্র আত্মশক্তিতে উচ্চারণ করতে পারে – “ সে যাইবে কোথায়? সে ফিরিবেই। সে আমার।”১২ মহেন্দ্রের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতে বিহারী মনে মনে খুব ব্যথিত হয়েছিল। তাই বিহারী বিনোদিনীকে বলতে পারে – “আশাকে তুমি দেখিয়ো। সে সরলা, কাহাকেও আঘাত করিতেও জানে না, নিজেকে আঘাত হইতে বাঁচাইতেও পারে না।”১৩ বিনোদিনী তখন বুঝতে পারে যে আশার জন্য করুণায় বিহারীর হৃদয় ব্যথিত, সে তার কাছে কেও নয়। আশার পথের কাঁটা দূর করবার জন্যই, আশার সমস্ত সুখ সম্পূর্ণ করিবার জন্যই বিহারীর জন্ম। এই কথা ভেবে বিনোদিনী খুব ভেঙ্গে পড়ে। তখন তার মনে আক্ষেপ হয়, যে কোন পুরুষকেই সে জয় করতে পারছে না। তাই এরপর সে সংহার মূর্তি ধারণ করল। মহেন্দ্র কলেজে থাকা কালীন আশার দেওয়া তিনখানি চিঠি পেল। চিঠিগুলি পড়ে সে বুঝতে পারল না যে চিঠিগুলি কে লিখেছে আশা না বিনোদিনী ! কারণ চিঠিতে যে বিষয় লেখা ছিল তা বিনোদিনীর বলে মনে হল। চিঠির বিষয় তার মনে একটা টানা পোড়েনের সৃষ্টি হল। এর মধ্যে বিহারী মহেন্দ্রকে তার কাছে গিয়ে বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে জানায় যে আশা তারজন্য কান্নাকাটি করছে। তাই মহেন্দ্র এই কথা শুনে বিহারীর সঙ্গে বাড়ি চলে আসে।

মহেন্দ্র ঘরে ফিরে আসা মাত্র তার মুখ দেখেই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের মতো একমুহূর্তেই কেটে গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করে লজ্জায় সে মহেন্দ্রের সামনে মুখ তুলতেই পারল না। এই চিঠির জন্য আশা মহেন্দ্রের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করল। মহেন্দ্র আশাকে পূর্বের মত কাছে টেনে নিল। বিনোদিনী তাই মহেন্দ্রের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করল। বিনোদিনীর এই আচরণ দেখে মহেন্দ্র খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। বিনোদিনী ঈর্ষায় এবার বাড়ি ছাড়বার জন্য নিতান্তই উঠে পড়ে লাগল। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীর সঙ্গে যে দুরত্ব তৈরি হয়েছিল তা দূর করার চেষ্টা করল। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীকে বারবার অনুরোধ করতে লাগল বাড়িতে থেকে যাবার জন্য। বিনোদিনী তখন অনুরাগের বশে বলে – “কিসের জন্য এত অনুনয়-বিনয়। আমি থাকিলেই কী, আর না থাকিলেই কী। আপনার তাহাতে কী আসে যায়।”১৪ মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণের ফলে তার হাত চেপে ধরে রুদ্ধ সজলস্বরে বলে – “যদি তাহাতে আমার আসে যায়, তবে তুমি থাকিবে?”১৫ বিনোদিনী মহেন্দ্রের এই ব্যবহারে অনুমান করতে পারে যে মহেন্দ্র তার প্রতি কতটা অনুরক্ত। সেই সুযোগে বিনোদিনী কথা দেয় যে যতক্ষণ না তোমরা আমাকে বিদায় দিবে ততক্ষণ আমি এবাড়িতে রইলাম। এতে আশা ও মহেন্দ্র খুব খুশি হয়। আশা বুঝতে পারল না যে এতে তার জীবনের কতবড় ক্ষতি হল। বিনোদিনীই যে তার দাম্পত্য জীবনের মাঝে কাঁটা হয়ে উঠবে তা সে কিছুতেই অনুমান করতে পারল না। বিহারী বিনোদিনীকে দেবীর মতো শ্রদ্ধা করতে লাগল। মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণের ফলে আশাকে আর সহ্য করতে পারল না। তাই তাদের দাম্পত্য জীবনে ঘন কুয়াশার আবির্ভাব দেখা দিল। মহেন্দ্র হঠাৎ তার কাকিমা অন্নপূর্ণা দেবীকে দেখা করার জন্য কাশী চলে যায়। মহেন্দ্রকে দেখে অন্নপূর্ণার যেমন আনন্দ হল, তেমনি আবার আশার সঙ্গে তার মায়ের কোনো বিরোধের সন্দেহ করে দুঃখও লাগল। কিন্তু মহেন্দ্র আশাকে নিয়ে তার মার সম্বন্ধে কোন অভিযোগের কথা না তোলায় অন্নপূর্ণার সমস্ত আশঙ্কা দূর হল। মহেন্দ্র কাশী থেকে বাড়ি ফেরার পরেই মাসীর সাথে একবার দেখা করার জন্য আশার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। মহেন্দ্র তাতে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতিও দিল। বিহারী এই খবর শুনে অবাক হয়ে গেল। তাই মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বিহারীর একটা সন্দেহ দেখা দিল। বিহারী তখন চাতুরীবশতঃ আশার সঙ্গে বিনোদিনীকে কাশীতে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিল। এই কথা শুনে মহেন্দ্র রাগে গর্জন করে উঠল। মহেন্দ্র তখন বুঝতে পারে সে যে বিনোদিনীকে ভালোবাসে তাকে দূর করার জন্যই বিহারীর এইরকম প্রস্তাব। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে যে ভালোবাসে তা উচ্চস্বরে অস্বীকার করে। তাছাড়া মহেন্দ্র বিহারীকে দৃঢ়কণ্ঠে বলে যে তুমি আশাকে ভালোবাসো। এই কথা শুনে বিহারী ক্ষোভে দুঃখে মহেন্দ্রের বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। বিহারী তাকে ভালোবাসে এই কথা শুনে আশা স্বামীর মুখের প্রতি লজ্জায় ঘৃণায় আর মুখ তুলতে পারছিল না। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ভালোবাসার কথা অস্বীকার করায় সে নিজেকে আর সংবরণ করিতে পারিল না। কারণ তার মনে হল এতে বিনোদিনী রাগবশতঃ তাকে বাদ দিয়ে বিহারীকে ভালোবাসতে পারে। মহেন্দ্র এই দোটানায় পড়ে তার নিজের উপর আর বিশ্বাস রাখতে পারে না। তাই তো সে আশাকে জিজ্ঞাসা করে – “চুনি, তুমি আমাকে কতখানি ভালোবাস ঠিক করিয়া বলো।”১৬

মহেন্দ্রের মধ্যে একটা ভালো মানুষী সত্ত্বাও যে ছিল তা আমরা দেখতে পায়। তাই তো সে আশাকে বলতে পারে – “ তুমি আর কাহাকেও বিবাহ করিলে ঢের বেশি সুখী হইতে পারিতে।”১৭ বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে অন্তর থেকে খুব ভালবেসে ছিল। তাই সে বিহারীকে চিঠি দিয়ে প্রেম নিবেদন করতেও দ্বিধা বোধ করে না। আশাকে বিহারী ভালোবাসে এই কথা শোনার পর বিহারী নিজেকে মনে মনে অপরাধী বলে ভাবতে শুরু করে। তাই বিহারী অনুরাগের বশে দেশ ছেড়ে পশ্চিমে চলে যায়। দারোয়ান বিহারীকে বাড়িতে না পেয়ে তার চিঠি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিনোদিনীর এই চিঠি মহেন্দ্র দারোয়ানের কাছে পেয়ে যায়। চিঠিটি পেয়ে মহেন্দ্র কৌতূহল বশতঃ সেটি খুলে পড়তে লাগল। চিঠিখানি পড়ে মহেন্দ্র বিনোদিনীর মনের গতি ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারল না। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীকে কাছে পাবার জন্য আকুল হয়ে গেল। মহেন্দ্র তখন স্থির করল নিজেকে ধরা দিয়া হোক বা না দিয়া হোক বিনোদিনীর মন যেকোন অবকাশে পুনরায় ফেরাতে হবে। আসলে মহেন্দ্র, আশা ও বিনোদিনী দুজনকেই কাছে পেতে চেয়েছিল। তাই তার জীবন ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল। বিনোদিনী তার পাঠানো পত্র খোলা অবস্থায় ফেরত পেল। তখন সে ভাবল যে বিহারী এই চিঠি পড়ে তার কোন উত্তর না দিয়েই তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই তার বিহারীর প্রতি মনে মনে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মহেন্দ্র কৌশলে হঠাৎ আশাকে কাশীতে তার মাসীর সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করল। এই কথা শুনে আশা চুপচাপ বসে রইল। আসলে বিনোদিনীর সঙ্গে সন্ধি করিবার জন্য বাধাহীন অবসর চেয়ে মহেন্দ্রের মন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অধীর হয়ে উঠেছিল। আশাকে চুপ করে থাকতে দেখে মহেন্দ্রের মনে রাগের সঞ্চার হল। মহেন্দ্র তাই আশাকে বলে – “আমার উপর মনে মনে তোমার কোন সন্দেহ জন্মিয়াছে নাকি। তাই আমাকে চোখে চোখে পাহারা দিয়া রাখিতে চাও?”১৮ হঠাৎ মহেন্দ্রের এই উগ্রতা দেখে আশা বিস্মিত ও ভীত হয়ে পড়ল। মহেন্দ্র কেন এত উগ্র হয়ে গেল তার কারণ সরল বালিকা আশার বোঝার কোন ক্ষমতা ছিল না। আশা এরপর মহেন্দ্রের কাছে ক্ষমা চায়। আশা মহেন্দ্রকে জানায় যে তার মাসীকে দেখতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু তোমাকে ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। মহেন্দ্র তখন আশাকে বলে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। মহেন্দ্র এই কথা যে অনুরাগের বশে জানায় তা আমরা অনুমান করতে পারি। তাই আশা মহেন্দ্রকে সন্দেহমুক্ত করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে কাশী যেতে রাজী হয়ে যায়। আশার জেদাজেদিতে মহেন্দ্র তাকে কাশী যেতে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেয়। আসলে মহেন্দ্র ভিতরে ভিতরে যেটা চাইছিল সেটাই সে অবশেষে পেল। মহেন্দ্র আশাকে ইঙ্গিতে জানায় সে তার অনেকখানি আপন। মহেন্দ্র তাই আশাকে বলে – “আচ্ছা যাও, কিন্তু তোমার চোখের আড়ালে আমি যদি নষ্ট হইয়া যাই, তাহা হইলে কী হইবে।”১৯ কিন্তু মহেন্দ্রের এই কথায় আশা কোন গুরুত্বই দিল না। আশা কাশী যাওয়ার পূর্বে মহেন্দ্রের সমস্ত ভার বিনোদিনীকে দিয়ে চলে গেল। সহজ সরল বালিকা আশা কোন দিন মনেও ভাবে না যে বিনোদিনী তার স্বামীকে তার থেকে আলাদা করে দিতে চায়। বিনোদিনী একাকী মহেন্দ্রকে তার পক্ষে নিয়ে নেবার একটা সুযোগ পেয়ে গেল।

আশা কাশী যাবার পর প্রথম প্রথম বিনোদিনী মহেন্দ্রের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করত। তাই সে মহেন্দ্রকে ফাঁকি দিয়া পালায়, ধরা দেয় না। রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে দেখে আদেশ করে যে মহেন্দ্রকে যেন সে চোখে চোখে রেখে সেবাযত্ন করে। বিনোদিনী প্রথমে তা অস্বীকার করলেও পরে তা মেনে নেয়। তাই বিনোদিনী মহেন্দ্রের সেবাযত্ন খুব ভালোভাবে করতে লাগল। মহেন্দ্র এতে খুশি হয়ে বিনোদিনীর প্রতি তার আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। বিনোদিনীকে তাই সে অন্তরের গভীরে স্থান দিতে লাগল। মহেন্দ্র সময়ে অসময়ে বিনোদিনীকে কাছে পেতে চাইল কিন্তু বিনোদিনীর তাতে তেমন সায় ছিল না। বিনোদিনীর উপর তাই মহেন্দ্রের অনুরাগের সৃষ্টি হয়। যারফলে মহেন্দ্র আশাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার জন্য চিঠি লিখে। আশা কাশীতে থাকার সময় হঠাৎ একদিন সেখানে বিহারী উপস্থিত হয়। বিহারীকে দেখে আশা মাসীকে জানায় সে যেন এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যায়। অন্নপূর্ণা কিন্তু বিহারীকে দেখে আশার এই বিরক্তি ভাবের কারণ অনুমান করতে পারে না। আশা তখন চিঠি দিয়ে এইসব ঘটনা মহেন্দ্রকে জানাতে দ্বিধাবোধ করে না। আশার অনুপস্থিতিতে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর ঘনিষ্ঠতা খুব বেড়ে গেল। তাদের মধ্যে একটা প্রনয়াসক্ত দেখা দিল। মহেন্দ্রের স্বভাব হল যাকে কাছে পায় তাকেই নিজের অধিকার বলে মনে করে। এইজন্যই সে বিনোদিনীকে কাছে পেয়ে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করে।

মহেন্দ্র মনে মনে সন্দেহ করত যে বিনোদিনী বিহারীকে খুব ভালোবাসে, তাই তার খুব হিংসা হত। এজন্যই সে বিহারীর কাছ থেকে বিনোদিনীকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর একান্তে ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য একদিন বিহারীর চোখে পড়ে যায়। বিহারী তখন বুঝতে পারে যে সে যেটা সন্দেহ করেছিল সেটাই ঠিক। মহেন্দ্র বিহারীকে তখন অনেক অপমান করল। বিহারী মহেন্দ্রের কাছে অপমানিত হয়ে কোন কথা বলল না। বিহারীকে অপমান করায় কিন্তু বিনোদিনীর খুব অসহ্য লাগল। তাই বিনোদিনী মনে মনে মহেন্দ্রকে খুব ঘৃণা করতে লাগল। বিনোদিনী বিহারীকে ধরতে এলে বিহারী বিনোদিনীকে ঠেলে দেয় এতে বিনোদিনীর হাত কেটে রক্ত বের হয়। বিহারীর এই আঘাতকে বিনোদিনী রাগ না করে বরং পরম সৌভাগ্য হিসাবে মেনে নেয়। বিহারীকে বিনোদিনী অন্তর থেকে ভালোবাসতো বলেই এটা সম্ভব। বিনোদিনীকে আবার মহেন্দ্র ভালোবাসার কথা বললে বিনোদিনী তা সুকৌশলে স্বীকারও করে। তাই বিনোদিনী মহেন্দ্রকে বলতে পারে – “মাথায় করিয়া রাখিব। ভালোবাসা আমি জন্মাবধি এত বেশি পাই নাই যে, চাই না বলিয়া ফিরাইয়া দিতে পারি।”২০ বিহারীর কাছে হঠাৎ গোপন রহস্যের কথা ধরা পড়ে যাওয়ায় মহেন্দ্রের মনে একটা মুক্তির আনন্দ উপস্থিত হল। মহেন্দ্র এরপর তাই আরও বেশি করে বিনোদিনীকে কাছে পেতে চাইল। মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর ঘনিষ্ঠতা দেখা সত্ত্বেও রাজলক্ষ্মী কোন ভ্রূক্ষেপই করল না। কারণ রাজলক্ষ্মী চাইত যেকোন মূল্যে তার সন্তান সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করুক। বিনোদিনীর কাছে রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ হল তার ছেলের যাতে কোন অসুবিধে না হয়।

মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি প্রনয়াসক্ত হলেও বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে তার মনে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। তাই তো বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে দিয়ে বিহারীকে ডেকে এনে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে চায়। বিনোদিনীর এইসব আচরণ মহেন্দ্রের ভালো লাগে না। আশা কাশী হতে বাড়ি ফিরে দেখল মহেন্দ্র তার সাথে পূর্বের মতো ব্যবহার করছে না। আশা এতে খুব মর্মাহত ও নিজেকে অপমানিত বোধ করে। বিনোদিনীকে মহেন্দ্র যে ভালোবাসিতে পারে এ সম্ভবনাও আশার মনে কখনও উদয় হয় নাই। সংসারের অভিজ্ঞতা তাহার কিছুই ছিল না। তাই পৃথিবী সংসার সমস্ত আশার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেল। আশা তখন অনুভব করল যে বিহারী যে কাশী গিয়েছিল সেই খবর পেয়েই হয়তো মহেন্দ্রের মনে রাগ হয়েছে। নানারকম ভাবনা চিন্তা করে আশা তার মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোন কিছুতেই সে নিজের মনকে শান্ত করতে পারল না। এই সব চিন্তা করতে করতে আশার হৃদস্পন্দন স্তব্দ হয়ে গেল। মহেন্দ্র আশা ও বিনোদিনী উভয়কেই আলাদা আলাদা দৃষ্টিতে নিজের অধিকারে রাখতে চায়। মহেন্দ্রের ধারণা হয় বিনোদিনীর সঙ্গে তার যে পবিত্র সম্বন্ধ তাতে তার দাম্পত্য জীবনের কোন ব্যাঘাত হবে না। হঠাৎ একদিন মধ্যরাত্রিতে মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণে তার ঘরে চলে যায়। বিনোদিনী মহেন্দ্রের এই আচরণ ভালো চোখে দেখেনি। আশা একদিন মহেন্দ্রের জামার পকেটে হাত দিতেই একখানি চিঠি পেয়ে যায়। চিঠিটি বিনোদিনী কর্তৃক মহেন্দ্রকে লেখা। চিঠিটি পড়ে স্বামীর প্রতি সন্দেহে আশার মন একেবারে ভেঙ্গে যায়। আশা অনুমান করে যে মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর একটা অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মহেন্দ্র যে বিনোদিনীকে ভালোবাসিতে পারে একথা আশা কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। তাই তো বিনোদিনী চিঠিতে মহেন্দ্রকে বলতে পারে – “একসময় মনে করিতে তুমি আশাকে ভালোবাসিতেছ, সেও মিথ্যা; এখন মনে করিতেছ তুমি আমাকে ভালোবাসিতেছ, এও মিথ্যা। তুমি কেবল নিজেকে ভালোবাসো।”২১ চিঠিখানি পড়ে আশার সমস্ত পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গেল।

রাজলক্ষ্মী সবকিছু বুঝতে পেরে বিনোদিনীকেই সমস্ত কিছুর জন্য দোষারোপ করতে লাগল। তখন বিনোদিনী উগ্র হয়ে বলে – “তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়া তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই? একবার ঠাওর করিয়া দেখো দেখি।”২২ বিনোদিনী একদিক থেকে ঠিকই বলেছিল। কারণ আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের অশান্তির জন্য রাজলক্ষ্মী কিছুটা হলেও দায়ী। কারণ রাজলক্ষ্মী যদি পূর্ণ যৌবনা বিধবা বিনোদিনীকে ঘরে এনে স্থান না দিত তাহলে হয়ত আশার দাম্পত্য জীবন এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠত না। বিনোদিনীর ঈর্ষায় তার দুই চক্ষে আগুন জ্বলে উঠল। বিনোদিনী চিন্তা করল সংসারে যদি অপরাধীই হতে হয় তবে অপরাধের যত লাঞ্ছনা তাই কেন ভোগ করবে? অপরাধের যত সুখ তা হতে কেন বঞ্চিত হবে। মহেন্দ্রকে মুখের উপর বিনোদিনী ঘৃণা করতে ইতস্ততঃ বোধ করে না। তাছাড়া মহেন্দ্রকে বিনোদিনী ভীরু কাপুরুষ বলে অপমানিত করে। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে তার সঙ্গে সমস্ত পরিত্যাগ করে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের অনুরোধ স্বীকার করে না। মহেন্দ্র কিন্তু জোর পূর্বক তাকে নিয়ে যেতে চায়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সেই মুহূর্তে বলে – “চারিদিকে আগুন জ্বালাইয়া তুলিয়াছ, এখন আর নিবাইতেও পারিবে না, পালাইতেও পারিবে না।”২৩ এই কথার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি যে মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণে কতটা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মহেন্দ্র মায়ের কাছেও এই কথা বলতে কোন দ্বিধা বোধ করে না। বিনোদিনী শেষমেষ তার সঙ্গে যেতে রাজী হয়।

বিনোদিনী হঠাৎ বিহারীর কাছে চলে যায়। বিনোদিনী বিহারীর কাছে গিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা প্রার্থনা করে। বিনোদিনী বিহারীকে জানায় যে মহেন্দ্র তাকে ভালোবাসে এবং তাকে নিয়ে সে গৃহত্যাগ করতে প্রস্তুত। বিনোদিনী বিহারীকে এও জানায় সে মহেন্দ্রকে ভালোবাসে না। বিনোদিনী বিহারীকে খুব ভালোবাসত বলেই এই অসময়ে একাকী তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে কোন দ্বিধাবোধ করে না। বিনোদিনী বলে তুমি যদি আশাকে ভালো না বাসিতে তবে আমার দ্বারা আশার আজ এমন সর্বনাশ হতো না। সবকিছু ঘটনা শোনার পর বিহারী বিনোদিনীকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ঘরে না দেখতে পেয়ে সেই রাত্রেই বিহারীর কাছে চলে যায়। সেখানে এসে সে বিহারীর কাছে বিনোদিনীর খোঁজ করে। কারণ মহেন্দ্রের মনে সন্দেহ হয়েছিল যে বিনোদিনী ভালোবাসার টানে বিহারীর কাছেই যাবে। মহেন্দ্র বিহারীর কাছে বিনোদিনীর খোঁজ নিতে চাইলেও কিন্তু বিহারী বিনোদিনীর কোন খবর দিতে পারল না। মহেন্দ্র হতাশ হয়ে সেখান থেকে ঝড়ের বেগে চলে গেল। বিনোদিনীকে গ্রামে গিয়ে পাড়ার লোকের অনেক ভর্ৎসনা সহ্য করতে হল। পাড়ার লোকে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর অবৈধ সম্পর্কের নানারকম কথা প্রচার করতে লাগল। বিনোদিনী এই সব কথা শুনে অধৈর্য হয়ে বিহারীকে একটা চিঠি দিল। চিঠির উত্তরের আশায় বিনোদিনী অস্থির হয়ে উঠল। গ্রামে বিনোদিনীর কাছে হঠাৎ মহেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল। মহেন্দ্রকে দেখে বিনোদিনী লোকলজ্জার ভয়ে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণে যেতে চাইল না। এই ঘটনা জানাজানি হতেই গ্রামের মধ্যে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হল। তাই বিনোদিনীর গ্রামে থাকা অসহ্য হয়ে উঠল। ফলে বিনোদিনী মহেন্দ্রের সাথে গ্রাম থেকে বিদায় নিল।

মহেন্দ্রের নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে রাজলক্ষ্মীর আহার নিদ্রা বন্ধ হল। এমন সময় মহেন্দ্র বিনোদিনীকে পটলডাঙার বাসায় রেখে নিজে বাড়ীতে ফিরে এল। মহেন্দ্র মাকে জানায় তার পড়ার সুবিধার্থে তাকে কলেজের কাছে বাসা নিয়েই থাকতে হবে। মা এতে সম্মতি দেয় কিন্তু জানায় বউমা যেন কোন কষ্ট না পায়। রাজলক্ষ্মী এখন আশাকে মেয়ের মতো খুব ভালবাসতে থাকে। তাই আশার নিয়ে তার চিন্তাভাবনা হয়। মহেন্দ্র সেই রাত্রিতেই কাউকে না জানিয়ে ঘর হতে বিদায় নিল। বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বশতঃ মহেন্দ্র আর ঘরে থাকতে পারল না। মহেন্দ্রের মনে এখন সমস্ত ধ্যান জ্ঞান শুধুমাত্র বিনোদিনী। বিনোদিনীর জন্য সে ঘর, সংসার, স্ত্রী, বন্ধু সমস্তকেই পরিত্যাগ করে। বিনোদিনী নিজেকে অসহায় মনে করে মহেন্দ্রের উপরেই ভরসা করতে থাকে। কিন্তু সে বিহারীকে কোনভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। বিনোদিনীর হৃদয় কোন অবস্থাতেই সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দিতে জানে না, নৈরাশ্যকে সে স্বীকার করে না। মহেন্দ্র বিনোদিনীর সঙ্গে একঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করলে বিনোদিনী তাতে রাজী হয় না। মহেন্দ্র বিনোদিনীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। তাই সে বলতে পারে – “আমি অত্যন্ত হতভাগ্য যে, আমি তোমাকে ভালোবাসিয়াছি।”২৪

মহেন্দ্র বিনোদিনীর উপেক্ষাকে সহ্য করতে না পেরে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। তাই সে ঠিক করে বিনোদিনীকে উপেক্ষার পরিবর্তে উপেক্ষা করবে। মহেন্দ্র বিনোদিনীর এই উদ্ধ্যতের জন্য বিহারীকেই দায়ী করে। কারণ মহেন্দ্র মনে করে তার প্রশ্রয়েই বিনোদিনীর এত বাড়বাড়ন্ত। তাই সে প্রতিশোধ নেবার জন্য বিহারীর ঘরে গেল। কিন্তু বিহারীকে ঘরে পাওয়া গেল না। বিহারীকে ঘরে না পেয়ে মহেন্দ্রের সন্দেহ বাড়তে লাগল। কিন্তু পরে বেয়ারার কাছে খবর পেল বিহারী চার-পাঁচ দিন আগে পশ্চিমে চলে গেছে। এই কথা শুনে মহেন্দ্রের সমস্ত সন্দেহ দূর হল। বিহারীর ঘরে মহেন্দ্র একখানা বিনোদিনীর চিঠি পেয়ে মনকে আর ঠিক রাখতে পারল না। মহেন্দ্র সেই চিঠিখানা এনে বিনোদিনীকে দিল। বিনোদিনী অনুমান করল যে বিহারী চিঠি পড়ে কোন উত্তর দিল না। তাই বিহারীর এই আচরণে বিনোদিনীর অভিমান হল। মহেন্দ্রের কাছে বিহারীর পশ্চিমে যাওয়ার খবর শুনে বিনোদিনীর বিশ্বাস হয় না। তাই সে পুনরায় খেমিকে বিহারীর খবর নিতে তার ঘরে পাঠায়। খেমির কথা শুনে বিনোদিনীর পূর্ণ বিশ্বাস হল। এথেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে বিনোদিনী মহেন্দ্রকে খুব একটা বিশ্বাস করত না। এদিকে রাজলক্ষ্মীর ধারণা হয় যে আশারই আচরণে ও স্বভাবদোষেই মহেন্দ্র বাড়ী ত্যাগ করেছে। এই জন্য রাজলক্ষ্মী আশাকে নানারকম ভাবে তিরস্কার করতে থাকে। আশা এই ভর্ৎসনা শুনে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদতে লাগল। মহেন্দ্র হঠাৎ পুনরায় লজ্জায় ঘৃণায় বাড়ীতে ফিরে এল। মহেন্দ্রকে দেখে আশা কিন্তু পূর্বের মতো তারসাথে আচরণ করতে পারল না। তার মনে হল মহেন্দ্র তার নয়, সে বিনোদিনীর। এই কথা ভেবে আশার হৃদয়ে গ্লানির সঞ্চার হল। তাই আশা কোনভাবেই মহেন্দ্রকে মনের মধ্যে স্থান দিতে পারল না। বিনোদিনীর মহেন্দ্র যেন আশার পক্ষে পরপুরুষ বলে অনুভূত হল। তাই সে মহেন্দ্রের ঘরে প্রবেশ করতে পারল না। মহেন্দ্রের প্রতি আশার এই আচরণে রাজলক্ষ্মী প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করল। মহেন্দ্র তার অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য আশাকে হৃদয়ে বাঁধতে চাইল। কিন্তু মহেন্দ্র ও আশার সম্পর্ক আর পূর্বের মতো সচল দেখা গেল না। কারণ আশা মহেন্দ্রকে আর পুরোপুরি মনে স্থান দিতে পারছিল না। রাজলক্ষ্মী বুঝতে পারল যে বউমা মহেন্দ্রকে পূর্বের মতো আর দৃঢ়বন্ধনে বাঁধতে পারছে না। মহেন্দ্র ঠিক করেছিল যে সাতদিন বিনোদিনীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না। রাজলক্ষ্মীর কথা মতো আশা বিহারীকে আসার জন্য অনুরোধ করে। আশার মুখে বিহারীর কথা শুনে মহেন্দ্রের হৃদয়ক্ষতে ঘা পড়ল। মহেন্দ্র ও আশার এরপর তর্কবিতর্কে তাদের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকে গেল। বিহারীর কথা মনে আসতেই মহেন্দ্রকে বিনোদিনীর সম্বন্ধে চিন্তা অধীর করে তুলল। মহেন্দ্রের সন্দেহ হল হয়তো বিহারী পশ্চিম থেকে এসে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। তাই মহেন্দ্রের প্রতিজ্ঞা রক্ষা হল না। রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডেকে বিহারীকে আসার জন্য অনুরোধ করল। মায়ের এইকথা শুনে মহেন্দ্র তখন নিজেকে বিশ্বের পরিত্যাক্ত বলে বোধ করল। মহেন্দ্র বিহারীর খোঁজে তার ঘরে গিয়ে বেয়ারার কাছে জানতে পারে যে বিহারী বালিতে একটি বাগান নিয়ে কাজে ব্যস্ত আছে। মহেন্দ্রের সন্দেহ হয় যে এরমধ্যে বিহারী ও বিনোদিনীর মধ্যে নিশ্চয় সাক্ষাৎ হয়েছে। বিহারীর কোন খবর না পেয়ে বিনোদিনী তার প্রতি সমস্ত আশা ভরসা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সে বুঝতে পারে যে মহেন্দ্রের আনুগত্যে তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের কাছে বিহারীর খবর জানতে চায়। মহেন্দ্র কোন খবর দিতে না পারায় বিনোদিনী তাকে প্রবল ভর্ৎসনা করে। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে বলে – “বন্ধুর ঠিকানা যদি বাহির করিতে না পার, তবে প্রেমের কথা আমার কাছে উচ্চারণ করিয়ো না। বিহারী – ঠাকুরপোর সঙ্গে তুমি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছ, তোমাকে কে বিশ্বাস করিতে পারে।”২৫ বিনোদিনীর ভর্ৎসনাতে মহেন্দ্র নিজেকে অপমান বোধ করে প্রবল গর্জে উঠে।

মহেন্দ্র তার সঙ্গে বিনোদিনীকে বাইরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। বিনোদিনী তাতে রাজী হল এই শর্তে কোন জায়গায় সে দুদিনের বেশি থাকবে না, শুধুমাত্র ঘুরে বেড়াবে। এদিকে মহেন্দ্র বিহারীকে সঙ্গে নিয়ে যাবার সংকল্প নিয়ে বাড়ী থেকে বেরোলেও তা ভুলে যায়। কোচম্যানের কাছে সমস্ত সংবাদ পেয়ে আশা ও রাজলক্ষ্মীর মন বিচলিত হয়ে পড়ে। রাজলক্ষ্মী অভিমানে ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমে চলে গেল। অন্নপূর্ণা কাশী থেকে বাড়ী ফিরে বিহারীকে নিজে গিয়ে বালি থেকে নিয়ে এল। বিহারীর প্রতি আশার যে অভিমান ছিল তা ক্রমেই কমে যেতে লাগল। মহেন্দ্রকে ছাড়া বিরহিণী আশাকে দেখে বিহারীর মন আকুল হয়ে উঠে। পশ্চিমে গিয়ে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়ে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। বিনোদিনী বারে বারে মহেন্দ্রকে বুঝিয়ে দেয় সে তাকে ভালোবাসে না। বিনোদিনীর মুখে বিহারীর কথা শুনে মহেন্দ্র রেগে যায়। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে তাই অবিচল মুখে বলে – “তোমার ভালোবাসার চেয়ে তোমার ছুরি আমার হৃদয়ে সহজে প্রবেশ করিবে।”২৬ বিহারীর প্রতি বিনোদিনী প্রবল ভালোবাসা প্রকাশ করতেই বলতে পারে – “কিন্তু যতদিন বিহারীর আশা আছে, ততদিন আমি মরিতে পারিব না।”২৭ বিনোদিনীর কাছে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে মহেন্দ্র স্থির করল সে বাড়ী ফিরে যাবে। বিনোদিনীর গৃহে হঠাৎ বিহারীর আবির্ভাব দেখা গেল। বিনোদিনী বিহারীকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু বিহারী তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। বিহারী বিনোদিনীকে অপবিত্র বলে বোধ করতে থাকে। বিনোদিনী তাকে জানায় যে, সে অপবিত্র নয়। সে কেবলমাত্র তার পথ চেয়েই বসে আছে। বিহারীর কাছে বিনোদিনী সমস্ত সংবাদ পেয়ে মহেন্দ্রের সমস্ত চাতুরী বুঝতে পারল। বিনোদিনীকে বিহারী বিশ্বাস করলে বিনোদিনী খুশিতে ভরে ওঠে। বিহারীর অবর্তমানে বিনোদিনী তার সমস্ত ঘটনা সে বলে।

বিনোদিনীর কাছে বিহারীকে দেখে মহেন্দ্র গর্জে উঠল। হিংসায় সে জ্বলে পুড়ে যেতে লাগল। মহেন্দ্র, বিহারী ও বিনোদিনীকে প্রবলভাবে ভর্ৎসনা করতে থাকে। বিহারী সেই সময় মহেন্দ্রকে জানায় সে বিনোদিনীকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক। বিহারীর এই কথা শুনে মহেন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে যায়। বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে এই বিয়ে করতে নিষেধ করে। কারণ সে জানায় যে বিধবাকে বিয়ে করলে সমাজে তাকে লাঞ্ছিত হতে হবে। বিহারী তখন বিনোদিনীকে ভালোবাসার কথা সরাসরি জানায়। বিহারী ও বিনোদিনীর মধ্যে মনের বন্ধন অটুট রইল। মহেন্দ্র বাড়ী ফিরে গেলেও বাড়ীতে তার কর্তৃত্ব পূর্বের মতো দেখা গেল না। মহেন্দ্র দেখে যে আশা এখন বাড়ীর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে। মহেন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকে। তাই সে মায়ের কাছে ক্ষমাভিক্ষা প্রার্থনা করে। মহেন্দ্রের মনে সমস্ত গ্লানি মুছে গিয়ে আবার পূর্বের মতো সব সম্পর্কের দ্বার খুলে গেল। মহেন্দ্র ও বিহারীর বন্ধুত্বের সম্পর্কের বন্ধন আরো দৃঢ় হল। অন্নপূর্ণা আশাকে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে বিনোদিনীকে নিয়ে কাশীতে চলে গেল। পূর্বের মতো আশা ও মহেন্দ্র দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করল। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ ছোটগল্পের অনেক মিল খুঁজে পায়। এই উপন্যাস ও ছোটগল্পটির রচনাকাল প্রায় সমকালীন। তাই এদের মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। নষ্টনীড়-এর ভূপতি, চারুলতা ও অমলের সঙ্গে চোখের বালির মহেন্দ্র, আশা, বিনোদিনী ও বিহারীর মিল খুঁজে পায়। দুইক্ষেত্রেই প্রেমের দুর্বার আকর্ষণকে আমাদের মনকে নাড়া দেয়।

ডঃ সুকুমার সেনের মতে – “সমাজের ও যুগযুগান্তরাগত সংস্কারের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ চোখের বালির বিষয়।”২৮

অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে – “বালবিধবা বিনোদিনীর চিত্তে পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার জাগরণ ও তার মানসিক পরিবর্তনের টানাপোড়েন এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।”২৯

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে – “চোখের বালিকে উপন্যাস সাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তক বলা যাইতে পারে। অতি আধুনিক উপন্যাসে বাস্তবতা যে বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, এখানেই তাহার সূত্রপাত। নৈতিক বিচার অপেক্ষা তথ্যানুসন্ধান ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণই ইহাতে প্রধান লক্ষ্য। ইহাতে যে প্রেম বর্ণিত হইয়াছে তাহা সমাজনীতির দিক হইতে বিগর্হিত – কিন্তু এই প্রেমের বিচারে কোনো নীতিকথার আড়ম্বর নাই, আছে কেবল ইহার ক্রমপরিণতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।”৩০



‘চোখের বালি’ উপন্যাসে মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবনে কলহের মূল কারণ হল বিনোদিনীর আবির্ভাব। বিনোদিনীকে যদি রাজলক্ষ্মী সঙ্গে করে নিয়ে না আসত তবে হয়তো মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের পরিণতি এত দুঃখের হতো না। বিনোদিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে রাজলক্ষ্মী নিজের পুত্রের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে। কিন্তু এখানে রাজলক্ষ্মী একজন নারী হয়ে অপর একজন নারীর মনস্তত্ত্বের কথা ভাবে না। তাই আমরা এই দাম্পত্য কলহের জন্য রাজলক্ষ্মীকেও দায়ী করতে পারি। এছাড়া বিনোদিনীর, আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের প্রতি প্রতিহিংসার জন্য তার ক্রমশ দুর্নিবার আকর্ষণও এই কলহের জন্য দায়ী। মহেন্দ্রের প্রধান দূর্বলতা তার মন যথেষ্ট সবল ছিল না। তার মানসিকসত্ত্বা অপরের আশ্রয় না পেলে দাঁড়াতে পারত না। মহেন্দ্রের দুর্বল মনের জন্য সে ক্রমশ বিনোদিনীর প্রতি প্রনয়াসক্ত হয়। তাই তাদের দাম্পত্য কলহের জন্য মহেন্দ্রকেও দায়ী করতে হয়। আশা সহজ সরল হওয়ার জন্য মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর সম্পর্ক তৈরি করতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। সে কখনো ভাবতে পারে না যে বিনোদিনীর জন্য তাদের দাম্পত্য জীবনে কখনো অশান্তি আসতে পারে। তাই সে বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের সম্পর্কে অনুঘটক রূপে কাজ করে। তাই তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য আশাও কম দায়ী নয়। পরিশেষে বলতে পারি যে এই উপন্যাসে মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য কলহের জন্য কোন একটি চরিত্রকে দায়ী করা যুক্তিসঙ্গত নয়। এই দাম্পত্য কলহের জন্য প্রায় সব চরিত্রই কোন না কোন ভাবে দায়ী।









তথ্যসূত্র


১. রবীন্দ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯, চতুর্থ প্রকাশ জুলাই,২০০৯, পৃষ্ঠা-৪৯৩

২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫

৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫

৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৬

৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৯

৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৩

৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৫

৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৮

৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৮

১০. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৯

১১. ঐ পৃষ্ঠা-৫২৭

১২. ঐ পৃষ্ঠা-৫২৯

১৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩০

১৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩৬

১৫. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩৬

১৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৪

১৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৪

১৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৭

১৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৮

২০. ঐ পৃষ্ঠা-৫৫৭

২১. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭২

২২. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৪

২৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৫

২৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫৯৩

২৫. ঐ পৃষ্ঠা-৬০৭

২৬. ঐ পৃষ্ঠা-৬২১

২৭. রবীন্দ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯,চতুর্থ প্রকাশ জুলাই,২০০৯, পৃষ্ঠা-৬২১

২৮. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড),সুকুমার সেন,আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯, প্রথম আনন্দ সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৩১৮

২৯. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা – ৭৩, পুনর্মুদ্রণ-২০০৫-২০০৬, পৃষ্ঠা-৪৯৯

৩০. বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, শ্রী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা- ৭৩, নতুন পুনর্মুদ্রণ ২০০৮-২০০৯, পৃষ্ঠা-৮৩