‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)
সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’
উপন্যাসটি প্রকৃত সামাজিক উপন্যাস। এই উপন্যাসটি গভীর রসাত্মক ও পরিণাম অত্যন্ত
বিষাদময়। এই উপন্যাসের পরিণামের জন্য দায়ী হল অনিবার্য রূপতৃষ্ণা রমণীরূপ মুগ্ধ
পুরুষের প্রবৃত্তি দমনে অক্ষমতা। এই উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পাই নগেন্দ্রনাথ
মহাধনবান ব্যক্তি, জমিদার। নগেন্দ্রনাথ ও সূর্যমুখীর মধ্যে একটি সুখের দাম্পত্য
জীবন দেখতে পাই। পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস ও মান্যতার দ্বারা তাদের
দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল দৃঢ়বদ্ধ। কিন্তু তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনে হঠাৎ এক ঘন মেঘ
হয়ে দেখা দেয় কুন্দনন্দিনী নামে এক অসহায় মেয়ের আবির্ভাব। যদিও প্রথমে নগেন্দ্রনাথ
কুন্দনন্দিনীকে সঙ্গে নিতে চায়নি, কিন্তু গ্রামের প্রতিবেশিদের চাপে তাকে কলকাতায়
তার মাসীর বাড়ি পৌঁছে দেবার অঙ্গীকার করে। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ কোলকাতায়
কুন্দনন্দিনীর মেসোর কোন সন্ধান পেলেন না। সুতরাং কুন্দনন্দিনী নগেন্দ্রনাথের গলায়
পড়িল। এর পর নগেন্দ্রনাথ কুন্দকে ত্যাগ করার জন্য আর একটি উপায় বের করেন তাঁর
সহোদরা ভগিনীর ঘরে গিয়ে তাকে রাখার জন্য অনুরোধ করেন। ভগিনীকে বলে পরে কুন্দকে
গোবিন্দপুরে সে নিয়ে যাবে। নগেন্দ্রনাথ এরপর কুন্দের সমস্ত কথা বর্ণনা করে সূর্যমুখীকে চিঠি লিখল। কিন্তু তেরো বছরের যৌবনা প্রারম্ভের কুন্দকে দেখে
নগেন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। কারণ নগেন্দ্রনাথ তাহার সুহৃত হরদেব ঘোষালকে পত্রে যে
কথাগুলি লেখে তাই এর প্রকৃষ্ট প্রমান। চিঠিতে নগেন্দ্রনাথ কুন্দনন্দিনীর রূপ
সম্পর্কে বলে - “বোধ হয় যেন কুন্দনন্দিনীতে পৃথিবী ছাড়া কিছু আছে, রক্ত মাংসের যেন
গঠন নয়; যেন চন্দ্রকর কি পুস্প সৌরভকে শরীরী করিয়া তাহাকে গড়িয়াছে। তাহার সঙ্গে
তুলনা করিবার সামগ্রী হঠাৎ মনে হয় না।’’১
নগেন্দ্রনাথ সূর্যমুখীকে যে চিঠি
লিখেছিল কিছুদিন পরে তাহার উত্তর পেল। উত্তরে সূর্যমুখী জানায় আমি তোমার চরণে কি দোষ করেছি যে তুমি আমাকে ছাড়া এতদিন
কোলকাতায় পড়ে আছো? আর যদি থাকই তবে কেন আমি নিকটে গিয়ে তোমার সেবা করিতে পারি না?
তোমার যদি অনুমতি পাই তবে আমি এখনই তোমার নিকট ছুটিব। সূর্যমুখীর এই কথার দ্বারা
আমরা বুঝতে পারি যে সে তার স্বামীকে কত ভালোবাসে। সূর্যমুখীর ভালোবাসা একেবারে
নিরেট ছিল বলেই সে এই কথাগুলি বলতে পারে। সূর্যমুখী এরপরেই পত্রে তামাশা করে বলেন -
“একটি বালিকা কুড়াইয়া পাইয়া কি আমাকে ভুলিলে? অনেক জিনিসের কাঁচারই আদর। নারিকেলের
ডাবই শীতল। এ অধম স্ত্রীজাতিও বুঝি কেবল কাঁচামিটে? নহিলে বালিকাটি পাইয়া আমায়
ভুলিবে কেন?”২ এই কথা গুলি সূর্যমুখী তামাশা করে বললেও আমাদের মনে হয়
যেন বিধাতা যেন তাকে দিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করে দেয়। সূর্যমুখী এরপর নগেন্দ্রের কাছে
কুন্দনন্দিনীকে ভিক্ষা চেয়ে তার কাছে নিয়ে যেতে অনুরোধ করে। সূর্যমুখী
কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে তারাচরনের বিবাহের পরিকল্পনা নগেন্দ্রনাথকে জানায়। তাই
সূর্যমুখী নগেন্দ্রনাথকে কুন্দকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী আসতে জানায়। এই খবর
শুনে নগেন্দ্রনাথ খুশি হয়। সূর্যমুখী আবার রসিকতা করে নগেন্দ্রনাথকে জানায় - “যদি
কুন্দকে স্বয়ং বিবাহ করিবার অভিপ্রায় করিয়া থাক, তবে বল, আমি বরণডালা সাজাইতে
বসি।”৩ সূর্যমুখীর দ্বারা কুন্দনন্দিনীর যে প্রস্তাব তা নগেন্দ্রনাথ ও
তার বোন কমলমনি উভয়ে সম্মত হলেন। সুতরাং স্থির হইল যে নগেন্দ্রনাথ বাড়ী যাবার সময়
কুন্দকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু কুন্দকে বাড়ী নিয়ে যাবার সিধান্তই নগেন্দ্র ও
সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনে বিষবৃক্ষ রোপণ হল। পরে নগেন্দ্র, সূর্যমুখী ও কমলমনি
এইজন্য হাহাকার করিবেন।
পূর্ব পরিকল্পনা মতো নগেন্দ্রের
সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর গোবিন্দপুরে চলে এলো। কুন্দ নগেন্দ্রের এতবড় বাড়ি দেখে
আশ্চর্য হয়ে গেল। সূর্যমুখীর ইচ্ছায় তারাচরণের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর বিবাহ হয়ে গেল।
সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে তারাচরণ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হল। দেবেন্দ্র কুন্দের সঙ্গে আলাপ করার জন্য
তারাচরণের নিকট আবেদন করল। তারাচরণ অনিচ্ছাবশতঃ দেবেন্দ্রকে কিছুদিন এড়িয়ে চলতে
লাগল। নানারকম সমস্যাকে দূর করে তারাচরণ ও কুন্দের দাম্পত্য জীবন তিন বছর কেটে
গেল। হঠাৎ কুন্দনন্দিনী বিধবা হল। জ্বর বিকারে তারাচরণের মৃত্যু হল। সূর্যমুখী কুন্দকে আপন বাড়ীতে নিয়ে এলো। এতেই
সত্যিকারের বিষবৃক্ষের বীজ বপন হল। এই কারনেই নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর দাম্পত্যজীবন
তিলে তিলে ধ্বংস হতে লাগল। এই ধ্বংসের ফলে তিনটি জীবন নষ্ট হয়ে গেল। কুন্দনন্দিনী
বাল বিধবা হওয়ার পর নগেন্দ্রের গৃহে সুখেই ছিল। কুন্দনন্দিনীর রূপে নগেন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে
গিয়েছিল। তাই কুন্দের প্রতি একটি রূপজ মোহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল নগেন্দ্রনাথের।
কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের এই মোহের আঁচ কিছুটা পেয়ে গিয়েছিল সূর্যমুখী। তাই সে
সমস্ত ঘটনা কমলমনিকে চিঠি দিয়ে জানায়। তার স্বামী যে এখন আর স্বাভাবিক নেই বরং
যথেষ্টই অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এই অনুমান করে সূর্যমুখীর প্রবল সন্দেহ হয়। এই
অবস্থা দেখে সূর্যমুখীর দশা যে কতটা করুন তা সে কমলকে জানায়। তার অন্তঃকরণের দুঃখ
কিছুটা লাঘব করবার জন্যই সে প্রানাধিক কমলমনিকে সব ঘটনা বিস্তারিত জানায়।
সূর্যমুখী কমলকে জানায় যে কুন্দ এখন আর বালিকা স্বরুপ নয় বরং সে এখন সুন্দরী
তরতাজা যুবতী। কুন্দের এই রুপেই যে নগেন্দ্রনাথকে পাগল করেছে তা সূর্যমুখী জানায়।
কুন্দের সৌন্দর্যেই সূর্যমুখীর সংসারে কাল হয়ে দেখা দিয়েছে।
সূর্যমুখী স্বামীকে খুব ভালবাসত তাই
স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণে মর্মাহত হয়ে পড়ে। সূর্যমুখী পৃথিবীতে স্বামী ছাড়া আর
কিছু ভাবতেই পারে না। পৃথিবীতে যা কিছু সম্পত্তি সে একমাত্র স্বামীকেই মনে করে।
এহেন স্বামীকে তার হৃদয় হতে কুন্দনন্দিনী কেড়ে নিতে চাইছিল। এতেই সূর্যমুখী দুঃখে
বিরহে মর্মাহত হয়ে পড়ে। সূর্যমুখী তাই বলতে পারে যে পৃথিবীতে তার যদি কোন অভিলাষ
থাকে, তবে সে তার স্বামীর স্নেহ। সেই স্বামীর স্নেহ হতে কুন্দনন্দিনী তাকে বঞ্চিত
করছে। এই জন্যই সূর্যমুখী ও নগেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনে অশান্তির বিষ ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের প্রধান মূলধন বিশ্বাস। বিশ্বাস যখন আর থাকে না তখন
দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে থাকে। সূর্যমুখী ও নগেন্দ্রের জীবনে কুন্দের
উপস্থিতি দাম্পত্য জীবনে অবিশ্বাসের কালো মেঘ দেখা দেয়। ফলে দাম্পত্য জীবনে কেউ
কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। মানব মনে যেখানেই সমাজের কোন বাধা দেয় সেখানেই যেন
বেশি করে তাকে আকৃষ্ট করে। তাইতো নগেন্দ্র সমাজ বহির্ভূত বালবিধবার রূপে মুগ্ধ হয়ে
আকৃষ্ট হয়। কুন্দনন্দিনী অন্য স্ত্রী লোকের মতো নগেন্দ্রর চোখে সামান্য নয়, সে তার
চোখে অসামান্য হয়ে ওঠে। তাইতো নগেন্দ্র কুন্দের প্রতি একবার চাইবার জন্য ব্যাকুল
হয়ে উঠে। এই দৃশ্য দেখেই সূর্যমুখীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। কারণ আমরা জানি কোন
নারীই চায়না তার স্বামী তাকে ছাড়া অন্য নারীকে বেশি গুরুত্ব দেয়। নগেন্দ্র যখন
কুন্দকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে তখন সূর্যমুখীর অন্তর্দাহ হতে দেখা যায়। ফলস্বরূপ
তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা ব্যবধানের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। সূর্যমুখী যে নগেন্দ্রকে কতটা সন্দেহ করত তা তার
বক্তব্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে তার পত্রে জানায় – “কুন্দনন্দিনীর জন্য তিনি আপনার
নিকট অপরাধী হইয়াছেন। এজন্য কখন কখন তাঁহার প্রতি অকারণ ভর্ৎসনা করেন। সে রাগ
তাঁহার উপর নহে- আপনার উপর। সে ভর্ৎসনা তাহাকে নহে, আপনাকে। আমি ইহা বুঝিতে পারি।”৪
কমল প্রত্যুত্তরে লিখিল তুমি পাগল
হয়েছ, নচেৎ স্বামীর হৃদয় প্রতি অবিশ্বাসীনী হবে কেন? কমল তখন সূর্যমুখীকে স্বামীর
প্রতি বিশ্বাস রাখার জন্য উপদেশ দিল। সূর্যমুখী স্থির করল যে সে কমলের কথা শুনিবে
অর্থাৎ স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসীনি হবে না। সূর্যমুখী বালির বাঁধ বাঁধিল।
সূর্যমুখীর মনে হল নগেন্দ্রনাথের কোন রাগ হয়েছে। তাই এইরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
নগেন্দ্রনাথের শরীর আস্তে আস্তে ভেঙ্গে যেতে থাকে। কুন্দনন্দিনীর কথা চিন্তা করে
নগেন্দ্রনাথ আহার নিদ্রা ত্যাগ করে। মাঝে মাঝে নগেন্দ্র মদ্যপান করতেও থাকে।
নগেন্দ্র এরপর একজন মাতালে পরিণত হয়ে উঠল। বিষয় সম্পত্তি সমস্ত কিছুর উপর তাঁহার
মোহ একেবারে মুছে গেল। কিছুদিনের মধ্যে নগেন্দ্রের সকল চরিত্র পরিবর্তিত হতে লাগল।
নির্মল আকাশে মেঘ দেখা দিল। এইসব দেখিয়া সূর্যমুখী গোপনে আঁচলে চোখ মুছতে লাগল।
সূর্যমুখী যদি তখনই কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করত তবে হয়তো নগেন্দ্রকে সৎ পথে নিয়ে আসা
যেত। কিন্তু সূর্যমুখীর কাল হল কমলের উপদেশ। কমলমনির উপদেশ মতো সূর্যমুখী স্বামীর
প্রতি বিশ্বাস রাখলেন। তার তখন মনে হল নগেন্দ্রের চিত্ত দুর্বল নয়, তার চিত্ত
অচলপর্বত - আমিই ভ্রান্ত বোধ হয়। কিন্তু সূর্যমুখীর অন্তর সে কথা বিশ্বাস করল না।
তাই সে অন্তরে দগ্ধ হতে লাগল একাকী চিন্তা করে। ফলস্বরূপ তাদের দাম্পত্য জীবন
অত্যধিক সন্দেহ প্রবণতার জন্য আস্তে আস্তে দুর্বল হতে লাগল। নগেন্দ্রের শরীরের
অবনতি হতে দেখা যায়। সূর্যমুখী নগেন্দ্রকে ঔষধ খেতে বললে নগেন্দ্র তা অস্বীকার
করে। সূর্যমুখী নগেন্দ্রকে তার শরীরের অসুখ সম্পর্কে জানতে চায়। নগেন্দ্র কোন
উত্তর দেয় না। তখন সূর্যমুখী নগেন্দ্রকে তার চেহারা দেখার জন্য একটি দর্পণ এনে
দিলে নগেন্দ্র বিরক্ত হয়ে সেটি দূরে নিক্ষেপ করলেন। দর্পণটি দূরে নিক্ষিপ্ত হয়ে
চূর্ণ হয়ে যায়।
বাস্তবে দর্পণটি চূর্ণ হলেও আমাদের
মনে হয় নগেন্দ্র তাদের দাম্পত্য জীবনকেই চূর্ণ করে দেয়। এই ঘটনায় সূর্যমুখীর চোখ
দিয়ে জল পড়তে লাগল। সূর্যমুখীকে কাঁদতে দেখে নগেন্দ্রর চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল এবং
সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করলেন। বহির্বাটীতে গিয়া নগেন্দ্র একজন ভৃত্যকে বিনা
অপরাধে প্রহার করলেন। ভৃত্যের সেই প্রহার সূর্যমুখীর অঙ্গে বাজল। পূর্বে নগেন্দ্র
অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলেন কিন্তু এখন কথায় কথায় তার রাগ। নগেন্দ্রর স্বাভাবিক
জীবন সবকিছু অস্বাভাবিক রূপে ধরা দিল। নগেন্দ্র বাড়ীর বাইরেই অধিক সময় কাটাতে
লাগল। নগেন্দ্রকে মদ্যপান করতে দেখে সূর্যমুখী বিস্মিত হল। নগেন্দ্রর এই অবস্থা
দেখে সূর্যমুখীর জীবন বিষময় হয়ে উঠল। নগেন্দ্রকে সূর্যমুখী অনেক অনুরোধ করা
সত্ত্বেও তার কোন কথাতে সে কর্ণপাত করল না। নগেন্দ্র তার বিষয় সম্পত্তি পর্যন্ত
দেখাশুনা একেবারে ছেড়ে দিল। নগেন্দ্র যে আস্তে আস্তে অধঃপতনের পথে যেতে চলেছে তা
সে নিজেও স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। তাই সে হরদেব ঘোষালকে একটি পত্রে বলতে পারেন
– “আমার উপর রাগ করিও না- আমি অধঃপাতে যাইতেছি।”৫ সূর্যমুখী যখন আর
সহ্য করতে পারছিল না তখন কমলমনিকে আর একখানি চিঠি দিল। চিঠির শেষে কুন্দনন্দিনী
লিখলেন – “একবার এসো! কমলমনি! ভগিনি! তুমি বই আর আমার সুহৃদ কেহ নাই। একবার এসো!”৬
এই চিঠিটা পেয়ে কমলমনি বুঝতে পারে যে সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবন শেষ হতে চলেছে।
তৎক্ষণাৎ কমলমনি এই বিষয় নিয়ে স্বামীর সাথে আলোচনা করে। পত্র পাঠ করে তৎক্ষণাৎ
কমলমনি গোবিন্দপুরে যাত্রা করলেন। কমলমনির হাসিমুখ দেখে সূর্যমুখীর চক্ষের জল
শুকাইল। কমলমনিকে সূর্যমুখীর সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করতেও দেখা যায়। কমলের সাথে
নগেন্দ্রকে স্বাভাবিক ব্যবহার করতেই দেখা গেল। কুন্দের সাথেও কমলের স্বাভাবিক
কথোপকথন দেখা গেল। কুন্দনন্দিনী কমলকে জানায় সে ভালো আছে। এইসব দেখে কমলের মনে
ভ্রম হয়। সে সূর্যমুখীর আশঙ্কার কথা বিশ্বাস করতে পারে না।
গোবিন্দপুরে কিছুদিন থাকার পর কমলমনি
বাড়ি যেতে চাইল। কিন্তু সূর্যমুখী তাকে আরো কিছুদিন থাকার জন্য অনুরোধ করল। তখন
কমলমনি সূর্যমুখীকে আশ্বস্ত করে জানায় - “তোমার কাজ না করিয়া যাইব না।”৭
কমলমনি কুন্দকেও খুব ভালোবাসতেন তাই কমলের যাওয়ার কথা শুনে কুন্দ আপনার ঘরে গিয়া
লুকিয়ে কাঁদিল। এই ঘটনা কমলের কাছে অজ্ঞাত থাকল না। কমল অন্ত্যন্ত স্নেহে কুন্দকে
তার কান্নার কারন জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে কুন্দ প্রথমে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার
চেষ্টা করে। কুন্দ অন্ত্যন্ত দুঃখে কমলকে জানায় সে ছাড়া তাকে আর কেউ ভালোবাসে না।
এই কথা শুনে কমল কুন্দকে সঙ্গে কলিকাতা নিয়ে যাবার কথা জানায়। কুন্দ কমলের কথাতে
রাজী হতে পারে না। এতেই কমলের মনে সন্দেহের ডানা বাঁধে। তাই তখন কুন্দকে
দ্বিধাহীনভাবে কমল জিজ্ঞাসা করে যে সে দাদাবাবুকে ভালোবাসে কি না? কমলের প্রশ্নের
উত্তরে কুন্দ কোন উত্তর দিতে পারে না। কেবল মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। এর ফলে কমল
বুঝে যায় সে যা সন্দেহ করেছে তা একেবারে ঠিক। তখন কমল দ্বিধাহীন ভাবে কুন্দকে বলতে
পারে - “বুঝিছি- মরিয়াছ। মর তাতে ক্ষতি নাই – কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেকে মরে যে?’’৮
কিন্তু কমল অন্তঃকরনের মধ্যে কুন্দনন্দিনীর দুঃখে দুঃখী, সুখে সুখী হল। কমল তখন
কুন্দকে সঙ্গে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল কারণ সে বুঝেছিল যে কুন্দ এখানে উপস্থিত থাকলে সূর্যমুখীর
দাম্পত্য জীবন পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কমলের অনেক সাধাসাধিতে কুন্দ তার সঙ্গে
কোলকাতায় যেতে রাজী হল। কমল মনে করল যে কুন্দ পরের মঙ্গলমন্দিরে আপনার প্রান বলি
দিল। কুন্দের শুভ বুদ্ধির উদয় দেখে কমল খুশি হল। এরপর প্রেমক্লিষ্টা সরলা বালিকা
স্বভাবা কুন্দনন্দিনীর চিত্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নগেন্দ্র ও
কুন্দের প্রথম সাক্ষাতেই নগেন্দ্রর অপরিমিত প্রেমোচ্ছ্বাসের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে - “এই সাক্ষাতের ফলে কুন্দনন্দিনীর সলজ্জ
প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও উভয়েরই মনোভাব যে আরও প্রবল ও দুর্দমনীয় হইয়া উঠিয়াছে
তাহাতে সন্দেহ নাই।”৯ নগেন্দ্র ও কুন্দ যেন পরস্পর পরস্পরের প্রতি দৃঢ়
বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কারণ তারা দুজন দুজনকে অন্তরের মধ্যে স্থান দিয়ে দিয়েছিল। তাইতো
এই বন্ধন কিছুতেই ভেঙ্গে যাবার নয়।
হীরা কর্তৃক
হরিদাসী বৈষ্ণবীর আসল পরিচয় আবিস্কার করে সূর্যমুখী। বৈষ্ণবীর সাথে কুন্দের
মেলামেশা দেখে সূর্যমুখীর কুন্দনন্দিনীর চরিত্রের প্রতি সন্দেহ হয়। সন্দেহের বশে
সূর্যমুখী কুন্দকে তিরস্কার করে। সূর্যমুখীর তিরস্কারের ফলে কুন্দনন্দিনী গৃহত্যাগ
করে পালিয়ে যায়। কিন্তু কুন্দের গৃহত্যাগের কারন নগেন্দ্র জানতে পারেনি। তাই
কুন্দের গৃহত্যাগের পরে কুন্দের প্রতি নগেন্দ্রের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
কুন্দের অদর্শনে নগেন্দ্র যেন পাগল হয়ে যায়। হীরার সঙ্গে কুন্দের দেখা হওয়াতে হীরা
তাকে নিজ গৃহে লুকিয়ে রাখে। কুন্দের নিরুদ্দেশ শুনে দত্ত বাড়ীতে হইচই পড়ে গেল।
হীরা কুন্দকে নিয়ে কি করবে প্রথমে কোন সিন্ধান্ত নিতে পারল না। সূর্যমুখীর প্রতি
হীরার হিংসা ছিল। তাই সে সূর্যমুখীকে জব্দ করার পরিকল্পনা করল। হীরা নগেন্দ্রর
সাথে সূর্যমুখীর অভিন্ন হৃদয় ভিন্ন করিবার পরিকল্পনা করিল। হীরা মনিব বাড়ীতে অন্য
এক দাসীর প্রতি অন্যায় করে সূর্যমুখীর সহানুভূতি না পেয়ে নিজের ইচ্ছাতেই নগেন্দ্রর
বাড়ীতে কাজ ছেড়ে দেয়। হীরা এরপর ছলনা করে কাঁদতে কাঁদতে নগেন্দ্রর কাছে যায়।
নগেন্দ্রের কাছে গিয়া হীরা সূর্যমুখীর প্রতি মিথ্যা অভিযোগ করে। হীরা নগেন্দ্রকে
এও জানাতেও ভোলেনি যে সূর্যমুখী অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছে বলেই কুন্দনন্দিনী
গৃহত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়েছে। হীরার মুখে এই কথা শুনে নগেন্দ্র সম্পূর্ণ বিশ্বাস
করে প্রচণ্ড রেগে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নগেন্দ্র সূর্যমুখীকে কিছুতেই আর সহ্য করতে
পারল না। তাই আমরা বলতে পারি সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনের অশান্তির জন্য হীরাও কম
দায়ী নয়। হীরার ইন্ধনে নগেন্দ্রর মনের আগুনে যেন ঘি পড়িল। হীরার কথার সত্যতা যাচাই
করার জন্য নগেন্দ্রনাথ সূর্যমুখীকে জিজ্ঞাসা করল। সূর্যমুখী নগেন্দ্রর সমস্ত
অভিযোগ স্বীকার করে নিল। সূর্যমুখী এর কারন হিসাবে জানায় যে বৈষ্ণবীর সঙ্গে
কুন্দের মেলামেশা তার ভালো লাগেনা তাই সে এই ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। নগেন্দ্র তখন
সূর্যমুখীকে এই ব্যবহারের জন্য সমর্থন করে। কিন্তু সূর্যমুখী নগেন্দ্রর কাছে ক্ষমা
প্রার্থনা করে। সূর্যমুখীর দূর্বলতা বশতঃ নগেন্দ্রনাথ বলে - “তোমায় বলিতে হইবে না।
আমি জানি, তুমি সন্দেহ করিয়াছিলে যে, আমি কুন্দনন্দিনীতে অনুরক্ত।”১০ নগেন্দ্রের
কাছে এই কথা শুনে সূর্যমুখী কাঁদতে লাগিল।
নগেন্দ্র যে
কুন্দের রূপের প্রতি আকৃষ্ট তা সে নিজেই সূর্যমুখীর কাছে স্বীকার করে নেয়। সে
সূর্যমুখীকে জানাতে ভোলেনি যে অনেক চেষ্টা করেও সে তার নিজ চিত্তকে বশ করতে
পারেনি। নগেন্দ্রের মুখে এই কথাগুলি শুনে সূর্যমুখীর বুকে শেল বিঁধিল। এই কথাগুলি
তার কানে খুব আঘাত করেছিল। নগেন্দ্র কুন্দকে এরপর যে কথাগুলি বলল তা বড়ই
বেদনাদায়ক। সে কুন্দকে জানায় সে সংসার ত্যাগ করে দেশান্তরে যাইবে। বাড়ী, ঘর, সংসার,
সূর্যমুখীতে তার আর কোন সুখ নেই। তার মনে এখন শুধু কুন্দনন্দিনীর মোহ অধিকার করে
আছে। নগেন্দ্র সূর্যমুখীকে জানায় যদি কুন্দকে কোনদিন ভুলতে পারে তবেই সে
সূর্যমুখীর কাছে আসবে নচেৎ তার সাথে এই শেষ সাক্ষাৎ। এই বেদনাদায়ক কথা শুনে
সূর্যমুখী ভূতলে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। সূর্যমুখী তখন নগেন্দ্রকে একমাস গৃহে থাকতে
বলেন এর মধ্যে সে প্রতিশ্রুতি দেয় কুন্দের খোঁজ দেবার জন্য। সূর্যমুখীর কথামতো
নগেন্দ্র রাজী হলেন। সূর্যমুখী মনে মনে বলিতেছিলেন - “আমার সর্বস্ব ধন!
তোমার পায়ের কাঁটাটি তুলিবার জন্য প্রাণ দিতে পারি। তুমি পাপ সূর্যমুখীর জন্য
দেশত্যাগী হইবে? তুমি বড়, না আমি বড়?”১১ কুন্দ যে হীরার গৃহে
লুকিয়ে আছে তা বুদ্ধির ছলে জানতে পারে মালতী। মালতী তখন কুন্দের সন্ধান
দেবেন্দ্রকে জানিয়ে দিল। এদিকে কুন্দনন্দিনী নগেন্দ্রনাথের অদর্শনে বিহ্বল হয়ে
পড়ল। নগেন্দ্রকে দেখতে না পেয়ে কুন্দ আবার সেই বাড়ীতে যাবার জন্য পরিকল্পনা করিল।
কুন্দ সিন্ধান্ত নিল যে সূর্যমুখী দূরীকৃত করলেও সে ঐ বাড়ীতে যাবেই। সূর্যমুখী
পুষ্পদ্যানে পুষ্প চয়ন করতে এসে কুন্দকে আবিস্কার করল। কুন্দকে পেয়ে সূর্যমুখীর
আনন্দের সীমা থাকে না। তাই সূর্যমুখী কুন্দকে বলে - “দিদি এসো! আর আমি তোমায়
কিছু বলিব না।”১২ সূর্যমুখী হাত ধরে কুন্দকে
অন্তঃপুরে নিয়ে গেল। কুন্দকে পেয়ে সূর্যমুখীর অন্তর্দাহ জ্বলন বন্ধ হল। পরিস্থিতি
বুঝে সূর্যমুখী নগেন্দ্রের সহিত কুন্দের বিবাহের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।
সূর্যমুখীর উদ্যোগ ও নগেন্দ্রের ইচ্ছায় শুভ বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়ে গেল। এখানেই
বিষবৃক্ষের একপর্ব শেষ হল। উদ্দাম বাসনা সমস্ত বাধা অতিক্রম করে আপনাকে
সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করল। এইবার ধীরে সুস্থে ফলভোগের পালা আরম্ভ হল। প্রবল
ক্রিয়ার স্বাভাবিক ফলই প্রবল প্রতিক্রিয়া।
সমস্ত ঘটনা
বিবৃত করে সূর্যমুখী কমলকে একটি চিঠি দিলেন। কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রের বিবাহের
মধ্যস্থতাকারী যে সে নিজেই তা জানিয়ে কমলকে এই বিবাহে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ
করেন। কমল পত্র পাঠ করে এর অর্থ কিছুই বুঝতে পারে না। পত্রের অর্থ সঠিক বুঝতে না
পেরে শ্রীশচন্দ্র নগেন্দ্রকে একটি চিঠি লিখল। এর উত্তরে নগেন্দ্র তাদের বিবাহের
কথা স্বীকার করে জানায় - “আমি এ বিবাহ করিব। যদি পৃথিবীর সকলে আমাকে ত্যাগ
করে,তথাপি আমি বিবাহ করিব। নচেৎ আমি উন্মাদ্গ্রস্ত হইব- তাহার বড় বাকীও নাই।”১৩
পত্রপাঠ করে কমলমণি ও শ্রীশচন্দ্র গোবিন্দপুরে যাত্রা করলেন। কমলমনি সূর্যমুখীর
কাছে সংবাদ পায় যে গতকাল নগেন্দ্র ও কুন্দের বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই বালবিধবা
কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রের বিবাহের ফলে নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর সুখের দাম্পত্য জীবন
ধ্বংস হয়ে যায়। কমলের আগমনের পর সূর্যমুখী তার নিকটে স্বামীর ব্যবহারে নিজ গভীর
মনোবেদনার পরিচয় দিলেন। এবং প্রত্যাখানের অসহ্য দুঃখবশে গৃহত্যাগ করে গেলেন।
সূর্যমুখী পত্রে তার গৃহত্যাগের কারন লিখে যায় এবং এও জানিয়ে যায় যে তার সন্ধান না
করার। কারন সে জানায় কুন্দ থাকিতে সে আর দেশে ফিরিবে না। সূর্যমুখীর এই দৃঢ়
প্রতিজ্ঞাতেই আমরা বুঝতে পারি যে কুন্দের উপস্থিতি তার অন্তরকে কতখানি বিদীর্ণ
করে। সূর্যমুখী কিন্তু এত দুঃখের পরও তার স্বামীর প্রতি কোন রাগ প্রকাশ করে না।
স্বামীর প্রতি ভক্তি তার চিরদিন অবিচল থাকবে বলে দৃঢ়কণ্ঠে সে জানায়। সূর্যমুখী যে
কতখানি দুঃখে বিরহে গৃহ ত্যাগ করে তা আমরা তার পত্র দ্বারাই বুঝতে পারি। পত্রে সে
জানায় - “তাঁহার নিকট আমি জন্মের মত বিদায় লইলাম, ইহাতেই জানিতে পারিবে যে, আমি কত
দুঃখে সর্বত্যাগিনী হইতেছি।”১৪ সূর্যমুখীর পলায়নের খবর গৃহের সবাই
জানাজানি হতেই সকলে তাহার খোঁজ করতে লাগলেন। সূর্যমুখীর নিরুদ্দেশের খবর শুনে
নগেন্দ্র বিচলিত হয়ে তাকে খোঁজার জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইলেন। দুই-তিন ঘণ্টা
সূর্যমুখীর কোন খবর না পেয়ে নগেন্দ্র নিজেও তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। এর দ্বারাই
আমরা বুঝতে পারি যে সূর্যমুখীর প্রতি নগেন্দ্রের আন্তরিক একটা আকর্ষণ ছিল। নগেন্দ্র অনেক খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও সূর্যমুখীর সন্ধান পেলেন না। কুন্দনন্দিনী নগেন্দ্রের
কাছে সূর্যমুখীকে ফিরে আনার জন্য অনুরোধ করলে, নগেন্দ্র হঠাৎ রেগে যায়। রেগে গিয়ে
কুন্দকে বলে - “ঐ কথাটি তুমি মুখে আনিও না। তোমার মুখে সূর্যমুখীর নাম শুনিলে আমার
অন্তর্দাহ হয় - তোমারই জন্য সূর্যমুখী আমাকে ত্যাগ করিয়া গেল।”১৫ নগেন্দ্রের
মুখে এই কথা শুনে কুন্দনন্দিনী খুবই ব্যাথিত হল। বিষবৃক্ষের বীজে তিনটি জীবন কেউই প্রকৃত
সুখী হতে পারল না। সবাই সুখ থেকে বঞ্চিত রইল। কুন্দ ও নগেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনও
বেশিদিন সুখী হল না। তাদের দাম্পত্য জীবনেও অবিশ্বাসের কালো ছায়া দেখা দিল।
নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীকে বলতে পারে - “আমাকে সূর্যমুখী বরাবর ভালবাসিত। বানরের
গলায় মুক্তার হার সহিবে কেন?- লোহার শিকলই ভাল।”১৬ নগেন্দ্রের মুখে এই
কথা শুনে কুন্দনন্দিনী রোদন স্থির করতে পারলেন না।
কুন্দকে
বিবাহ করা যে তার সবচেয়ে বড় ভুল তা নগেন্দ্র নিজেই স্বীকার করে। এই জন্যই যে
সূর্যমুখীকে হারালেন তা তিনি বুঝতে পারলেন। সূর্যমুখী ও কুন্দের তুলনা করতে গিয়ে
নগেন্দ্র বলে - “সূর্যমুখীকে পত্নী ভাবে পাওয়া বড় জোর কপালের কপালের কাজ। সকলেই
মাটি খোঁড়ে,কোহিনূর খোঁড়ে,কোহিনূর একজনের কপালেই উঠে। সূর্যমুখী সেই কোহিনূর।
কুন্দনন্দিনী কোন গুণে তাঁহার স্থান পূর্ণ করিবে?”১৭ কুন্দের প্রতি নগেন্দ্রের
ভালোবাসা হল তার রুপ তৃষ্ণা অর্থাৎ রুপের প্রতি মোহ কিন্তু সূর্যমুখীর প্রতি তার
ভালোবাসা হল চিরন্তন, যা সহজে মন থেকে যায় না। নগেন্দ্র এর পর বিষয় সম্পত্তি
দেওয়ানের উপর ভার দিয়ে গৃহত্যাগ করে পর্যটনে যাত্রা করিলেন। কুন্দ গোবিন্দপুরে
একাকী রয়ে গেল। এক ব্রহ্মচারী অন্ধকারে পথের মধ্যে অচৈতন্য সূর্যমুখীকে উদ্ধার
করে। হরমনির সেবা যত্নে সূর্যমুখী সুস্থ হয়ে ওঠে। সূর্যমুখীর কাশ রোগ হয়েছিল।
সূর্যমুখীর কথামতো নগেন্দ্রের ঠিকানায় ব্রহ্মচারী পত্রে নগেন্দ্রকে সমস্ত খবর চিঠি
দিয়ে জানালেন। সূর্যমুখীর ইচ্ছা হল মৃত্যুকালে যেন স্বামীর মুখ দেখিয়া মরি। এতেই
বোঝা যায় যে সূর্যমুখীর স্বামী ভক্তি কতখানি গাঢ়। নগেন্দ্র বাড়ীতে ছিল না বলে
পত্রটি প্রথমে দেওয়ানের নিকট আসে। দেওয়ান দ্বারা পত্রটি অনেকদিন পর নগেন্দ্রের
কাছে পৌঁছায়। পত্র পেয়েই নগেন্দ্র রানীগঞ্জে যাত্রা করিল সূর্যমুখীর খোঁজে।
নগেন্দ্র গ্রামে পৌঁছে প্রথমে শিবপ্রসাদ ব্রহ্মচারীর খোঁজ করিলেন। কিন্তু তার
সংবাদ না পেয়ে তিনি রামকৃষ্ণ কবিরাজের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং জানতে পারে যে
ব্রহ্মচারী এখানে নেই। এই সংবাদে নগেন্দ্র বিষণ্ণ হল। নগেন্দ্রকে রামকৃষ্ণ জানায়
যে হরমনির গৃহে সূর্যমুখী অগ্নিদাহে মারা গেছে। এই খবর শুনে নগেন্দ্র পুরো ভেঙ্গে
পড়েন। বিরহে নগেন্দ্র বলতে পারে - “আমার এতদিনে সব ফুরাইল।”১৮ একাকী
দুঃখে নগেন্দ্র গোবিন্দপুরে চলিল। নগেন্দ্র এর পর কমলের কাছে চলে যায়। এদিকে
গোবিন্দপুরে দত্ত বাড়ীতে বৃহৎ অট্টালিকা, ছয় মহল বাড়ী- নগেন্দ্র সূর্যমুখী বিনা সব
অন্ধকার হয়ে গেল।
কুন্দনন্দিনী
তার ভুল বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে যে সেই সব কিছু অনর্থের মুল। তাই সে সূর্যমুখীর
আশায় দিন অতিবাহিত করতে থাকে। তাই সে আত্মধিক্কারে মনে মনে বলত - “এখন শুধু শুধু
মরিয়া কি হইবে? যদি সূর্যমুখী ফিরিয়া আসে, তবে মরিব। আর তার সুখের পথে কাঁটা হব
না।”১৯ নগেন্দ্র গোবিন্দপুরে এলেও কুন্দের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন
করিল। নগেন্দ্রনাথের আদেশানুসারে পরিচারিকারা সূর্যমুখীর শয্যা গৃহে তাহার শয্যা
প্রস্তুত করলেন এবং নগেন্দ্র সেখানেই শয়ন করলেন। সেই গৃহে সূর্যমুখীর অতীত স্মৃতি
মনে করে নগেন্দ্রনাথ কাঁদতে লাগল। নগেন্দ্র ভূতলে মুর্ছিত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু সে
তার শিরোদেশে একটি উপাধানের অস্ত্বিত অনুভব করল। তিনি উপাধান স্পর্শ করে দেখলেন যে
এ তো উপাধান নয়, এ কোন মানুষের উরুদেশ। নগেন্দ্র কোমলতা অনুভব করায় বুঝতে পারল এ
কোন নারীর উরুদেশ। তখন নগেন্দ্র দেখতে পেল যে সূর্যমুখী মূর্ছিতা হয়ে তার মাথার
নীচে নিজের উরুদেশ রাখিয়া আছে। সূর্যমুখীর দেখা পেয়ে নগেন্দ্রনাথ যেন পুনর্জীবন
লাভ করল। নগেন্দ্র প্রথমে তাকে কুন্দনন্দিনী বলে ভ্রম হয়। পরে সূর্যমুখীর কথা বলতে
বলতে আবেগে বলে ফেলেন - “তুমি যদি সূর্যমুখী হইতে পারিতে তবে কি সুখ হইত!”২০
এই কথা শুনে সূর্যমুখী নিজ পরিচয় দেয়। সূর্যমুখীকে সাক্ষাৎ দেখে নগেন্দ্র প্রথমে
নিজেকে বিশ্বাস করতে পারেন না, পরে তার ভ্রম ভেঙ্গে যায়।
এই
উপন্যাসে নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনে নদীর চড়ার মত সম্পর্কের ওঠানামা
দেখতে পাওয়া যায়। মিলন ও বিরহের মধ্যে তাদের দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্ব দেখতে
পাওয়া যায়। সূর্যমুখী তার সমস্ত ঘটনা নগেন্দ্রকে জানায়। সূর্যমুখী ও নগেন্দ্রনাথের
মিলনের পরিস্থিতি দেখে কুন্দনন্দিনী আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। সে নিজেকে
অপরাধী বলে চিহ্নিত করে। নিজেকে দোষী মনে করে সে আর স্থির হয়ে থাকতে পারে না। তাই
সে অভিমানে হীরার বাক্স থেকে বিষ বের করে খেয়ে ফেলেন। কুন্দ এরপর নগেন্দ্রের সামনে
গেলে উভয়ের মধ্যে রাগ-অনুরাগের পালা শেষ হয়। কুন্দ যে কতটা দুঃখে নিজের জীবন শেষ
করতে বাধ্য হয় তা তার কথাতেই বুঝতে পারা যায়। সে নগেন্দ্রকে বলতে পারে - “কাল যদি
একবার আমার নিকেট এমনি করিয়া বসিতে- তবে আমি মরিতাম না।”২১ কুন্দনন্দিনী
বিষ পান করে মৃত্যু বরন করিল। নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনের পথের কাঁটা
কুন্দনন্দিনী বিদায় নিল। উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ অবধি এই তিনজনের দ্বন্দ্বের ফলে
উপন্যাসটি এগিয়ে চলেছে। কুন্দনন্দিনী যদি প্রবেশ না করত তবে হয়তো উপন্যাসটির এত
উত্তেজনা দেখা যেত না। গোটা উপন্যাস জুড়ে এই তিন চরিত্রের দাম্পত্য জীবনের যে কলহ
তা আমরা সুস্পষ্টভাবেই দেখতে পাই। তাই উপন্যাসটি এক উৎকৃষ্ট সামাজিক উপন্যাস রূপে
বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য স্থান করে নিয়েছে। উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্র চিত্রন
আমাদের বাস্তব সমাজের মুখচ্ছবি হয়ে দেখা দেয়। এই জন্যই এই উপন্যাসটি আমাদের মনকে এতটা
আন্দোলিত করতে পারে। ডঃ সুকুমার সেনের মতে আমরা বলতে পারি যে – এই উপন্যাসের ঘটনা
আড়ম্বর ও জটিলতা মুক্ত তবে কুটিলতাহীন নয়। নরনারীর অনুরাগ এখানে গঙ্গা যমুনার মতো
সাদা–কালো দুই ধারায় প্রবাহিত। এই ধারা বিবাহ সম্ভূত গাঢ় প্রেমের অপর ধারা-রুপজ
মোহজাত উৎকট বাসনার। তবে যুক্ত বেণীর মতো প্রয়োগে মিলিত হতে পারে নাই। বিষবৃক্ষ
নামটি বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধতা সুচক নয়। রূপজ লালসাই হইল এই বিষবৃক্ষ।
বঙ্কিমচন্দ্র বিধবা বিবাহে সম্মত ছিলেন না। এইজন্যই সামজিক স্বীকৃতি দিতেই তিনি কুন্দকে
বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেন। বঙ্কিম সমাজ স্বীকৃত বিবাহকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কুন্দকে
মেরে ফেলার ছক কষেন। এইজন্যই উপন্যাসটি সামাজিক উপন্যাস।
তথ্যসূত্র
১. বঙ্কিম রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র),শুভম প্রকাশনী,
কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ(কল্পতরু উৎসব)২০০৯,পৃষ্ঠা-২৩৪
২. ঐ, পৃষ্ঠা-২৩৪
৩. ঐ, পৃষ্ঠা-২৩৫
৪. ঐ, পৃষ্ঠা-২৪৭
৫. ঐ, পৃষ্ঠা-২৫০
৬. ঐ, পৃষ্ঠা-২৫০
৭. ঐ, পৃষ্ঠা-২৫৩
৮. ঐ, পৃষ্ঠা-২৫৪
৯. বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা,শ্রী শ্রীকুমার
বন্দ্যোপাধ্যায়,মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা-৭৩,নূতন
পুনর্মুদ্রণ-২০০৮-২০০৯,পৃষ্ঠা-৬৫
১০. বঙ্কিম রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র),শুভম প্রকাশনী,
কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ(কল্পতরু উৎসব)২০০৯,পৃষ্ঠা-২৭০
১১. ঐ, পৃষ্ঠা-২৭১
১২. ঐ, পৃষ্ঠা-২৭৪
১৩. ঐ, পৃষ্ঠা-২৭৮
১৪. ঐ, পৃষ্ঠা-২৮২
১৫. ঐ, পৃষ্ঠা-২৮৫
১৬. ঐ, পৃষ্ঠা-২৮৫
১৭. বঙ্কিম
রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র),শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ(কল্পতরু উৎসব)২০০৯,
ঐ,পৃষ্ঠা-২৮৫
১৮. ঐ,পৃষ্ঠা-২৯৬
১৯. ঐ,পৃষ্ঠা-৩০৬
২০. ঐ,পৃষ্ঠা-৩১০
২১. ঐ,পৃষ্ঠা-৩১৫













