** আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত **

কিছু কথা....

আপনাদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করতে হলে লেখাটি আমাকে ইমেইল করুন। আমি সেটা নির্দিষ্ট বিভাগে, আপনার নাম দিয়ে প্রকাশ করবো।

আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?

!! আমার ব্লগের সাথে যুক্ত থাকুন !!

ইমেইল এর মাধ্যমে সমস্ত পোষ্টের নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য, নিচের ফাঁকা ঘরে আপনার ইমেইল এড্রেস লিখে ‘সাবস্ক্রাইব’ বাটন-এ ক্লিক করুন।

Blank

Comming Soon

কবিতা সমগ্র

আমার নিজের ও কবিদের লেখা কবিতার সংরক্ষণ

Thursday, July 19, 2018

‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)



‘চোখের বালি’ রবীন্দ্রনাথের এক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এখানে ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্র বিশ্লেষণে লেখক অনন্যপূর্ব গভীরতা ও কৌশল দেখিয়েছেন। এই প্রতিভা দক্ষিণহস্তের সুধাভাণ্ডে সুধার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও বামকরের বিষভাণ্ডও একেবারে শুন্য নয়। আশার পাতিব্রত্য, রাজলক্ষ্মীর পুত্রস্নেহ, অন্নপূর্ণার সাত্ত্বিকতা, বিহারীর উন্নত হৃদয় – এই মাধুর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে বিনোদিনীর বিলাসলীলা ও মহেন্দ্রের নগ্ন দূর্বলতার একটু তিক্ত রসও গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। অতিভোগে চোখের বালির আরম্ভ, অবসাদ ও উচ্ছৃঙ্খলতা এর দ্বিতীয় অবস্থা, প্রকৃত মাধুর্যে এর শেষ। এই জন্যে রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু সত্ত্বেও চোখের বালি ট্র্যাজেডি হতে পারেনি। ট্র্যাজেডি নয় বলিয়া এই উপন্যাসে করুণ রসের অভাব নাই। মহেন্দ্র আশাকে ত্যাগ, রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু, বিহারী ও বিনোদিনীর একক জীবন এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র ঘটনায় এই উপন্যাসের করুণাধারা প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ফল্গুধারার মতো বহমান। এই রচনায় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সম্পর্কে যথেষ্ট পরিপক্কতা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই উপন্যাস সম্পর্কে বলেন – ‘এই প্রথম আঁতের কথা বলিলাম।’ উপন্যাসে প্রধান চরিত্র মহেন্দ্র – বিহারী – আশা – বিনোদিনী এরা পরস্পরের মধ্যে মানসিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে কতকটা স্বভাবের তাড়নায়। বিনোদিনী বিধবা, আশা বিবাহিতা – এই দুই নারীতত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেছেন আশ্চর্য কৌশলে। সাহিত্যের যৌনতাকে ডেকে আনার জন্যে রবীন্দ্রনাথ সমাজ থেকে যথেষ্ট নিন্দাবাদ শুনেছিলেন। তবুও একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, চোখের বালি মানুষের অন্তর্জীবনের এক অভ্রান্ত দলিল। এই উপন্যাসে দাম্পত্যের মধ্যে যে কলহ বা অশান্তি আছে সেই চিত্রগুলি আমরা খোঁজার চেষ্টা করব।

উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পাই, মহেন্দ্রের মা রাজলক্ষ্মী তার ছেলের সাথে বিনোদিনীর বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মহেন্দ্র এই বিয়েতে প্রথমে রাজী হয় না। তখন রাজলক্ষ্মী ঐ একই প্রস্তাব বিহারীকে দেয় এবং বিহারীও ঐ প্রস্তাবকে স্বীকার করে না। তখন রাজলক্ষ্মী তার জন্মভূমি বারাসাতের গ্রাম সম্পর্কীয় এক ভ্রাতৃস্পুত্রের সঙ্গে উক্ত কন্যা বিনোদিনীর বিবাহ সম্পন্ন করলেন। কিছুদিন পর বিনোদিনী বিধবা হল। মহেন্দ্র এত বেশি মাতৃভক্ত যে সে বিয়ে করতে চায় না। কারণ তার ধারণা যে বিয়ে করলে বউ এসে তাদের মাতা-পুত্রের সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে দেবে। মাতা রাজলক্ষ্মী বিয়ের সম্বন্ধে পুত্রকে খুব একটা জোরও করতেন না। এই বিষয়ে রাজলক্ষ্মী ও মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার মধ্যে তর্কাতর্কি হয়ে বাদানুবাদ হয়ে যায়। মহেন্দ্র তার কাকিমা অন্নপূর্ণাকে খুব মান্য করত। মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার একটি পিতৃ-মাতৃহীন বোনঝি ছিল। অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের সঙ্গে তার বোনঝির বিবাহ দিয়ে কোনো সূত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে নিজের কাছে আনিয়া সুখী দেখতে চান। যদিও মহেন্দ্র বিবাহে নারাজ, তবু কাকির এই মনোগত ইচ্ছাটি তার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলে মনে হত। মহেন্দ্র অন্নপূর্ণাকে জানায়, যে বিহারীকে সে তার বোনঝির সঙ্গে বিবাহে রাজী করিয়ে দিয়েছে। তাই মেয়ে দেখিবার দিন ঠিক করার জন্য অনুরোধ করল। অন্নপূর্ণা এই কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। কারণ বিহারীকে সে খুব ভালভাবেই জানতেন। বিহারীকে অন্নপূর্ণা নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। এরপর একদিন মহেন্দ্র ও বিহারী অন্নপূর্ণার ঐ বোনঝিকে দেখতে গেল। মেয়ে দেখার পরেই সঙ্গে সঙ্গেই বিহারী তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যায়। কারণ বিহারী মেয়ে দেখার আগেই মনে মনে এই বিয়েতে রাজী হয়ে গিয়েছিল অন্নপূর্ণা দেবীর সম্মানার্থে। কারণ অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতই ভক্তি করতো। মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে যখন মেয়েটি তাদের জন্য পান সেজে নিয়ে এল, তখন সেই অবকাশে মহেন্দ্র ঐ কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখে নিল। এই অনাথিনীকে দেখে মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগল। তাই সে অনাথিনীর দিকে আর একবার ফিরে চাইল। এই অনাথিনী মেয়েটির নাম আশালতা। মেয়েটিকে দেখার পর মহেন্দ্র মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তাই মহেন্দ্র ব্যঙ্গচ্ছলে বিহারীকে বলে সে আমাকে বিয়ে করবে। বিহারী তখন বলে – “তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন – তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”১ এই কথাগুলি শুনে আমাদের মনে হয় যে বিহারী মহেন্দ্রকে অন্তর থেকে কতটা ভালবাসত। সে নিজের প্রিয় জিনিসও যে তৎক্ষণাৎ বন্ধুর জন্য ত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু মহেন্দ্র তখন বিহারীকে জানায় সে তার সাথে মসকরা করছে। সেই দিন সারারাত্রি মহেন্দ্র মনে মনে আশাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করল এবং কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। যাইহোক আশাকে দেখার পর তার উপর মহেন্দ্রের যে একটা দূর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই পরের দিন সকালে মহেন্দ্র বিহারীকে কাকিমার দোহায় দিয়ে অপ্রত্যক্ষ ভাবে আশাকে বিয়ে করার কথা জানায়। বিহারী মহেন্দ্রকে জানায় যে সেটা করলে তো সবথেকে ভাল হয়। বিহারীর কাছে সম্মতি পেয়ে মহেন্দ্র বাড়ি গিয়ে মাকে জানায় সে আশাকে বিয়ে করতে চায়। প্রথমে মা রাজলক্ষ্মী এতে কিছুতেই রাজী হতে চায় না। কারণ রাজলক্ষ্মী জানায় যে আশার তিনকুলে কেও নেই তাই তার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে সে সুখী হবে না। মহেন্দ্র কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে মাকে জানায় যে মেয়েটিকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই সে তাকে বিয়ে করতে চায়। মাতা রাজলক্ষ্মী এই ব্যাপারে অন্নপূর্ণার ষড়যন্ত্রকে ইঙ্গিত করে তাকে নানারকম কুরুচিকর ভাষায় গালাগালি দেয়। অন্নপূর্ণা এই সব কথা শুনে মহেন্দ্রের সঙ্গে আশার বিয়েতে রাজী হতে পারে না। এই কথা শুনে মহেন্দ্র, মা ও কাকিমার উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে চলে যায়। মহেন্দ্র ছোটবেলা থেকেই মায়ের আদরে লালিতপালিত। সে ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, তাই সে ভীষণ একগুঁয়ে। মা রাজলক্ষ্মী এই কথাটা খুব ভালোভাবেই জানত বলে অন্নপূর্ণার কাছে নতমস্তকে বলে – “যে যাহা চায়, না পাইলে যাহা খুশি করিতে পারে।”২ এরপর অন্নপূর্ণার কথায় বিহারী আশাকে মহেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দিতে রাজী হয়। বিহারী এই সিদ্ধান্তে যে কতটা মর্মাহত হয়েছিল তা জানা যায় তার কথাতেই। যখন সে বলে – “তুমি যেমন আদেশ করিবে তাহাই হইবে। কিন্তু আমাকে আর কখনো কাহারও সঙ্গে বিবাহের জন্য অনুরোধ করিয়ো না।”৩ এরপর রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা এবং মহেন্দ্রের মধ্যে নিষ্ঠুর নিগুঢ়নীরব ঘাত-প্রতিঘাত চলতে চলতে বিবাহের দিন শেষ হল।

আশা সজ্জিতসুন্দর দেহে লজ্জিতমুগ্ধ মুখে আপন নূতন সংসারে প্রথম পদার্পণ করল। তার এই দাম্পত্যের মধ্যে কোথাও যে কোনো কাঁটা আছে, তা তার সহজ সরল হৃদয়ে অনুমান করা গেল না। বরঞ্চ জগতে তাহার একমাত্র মাতৃস্থানীয় অন্নপূর্ণার কাছে আসিতেছে বলিয়া আশ্বাসে ও আনন্দে তার সর্বপ্রকার ভয় সংশয় সব দূর হয়ে গেল। রাজলক্ষ্মী বিয়ের পর মহেন্দ্রকে জানায় যে এখন বউমা কিছুদিন তার জ্যাঠার বাড়িতে গিয়ে থাকুক। কিন্তু মায়ের এই আদেশকে মহেন্দ্র কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাতা ও পুত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এইখানেই মাতা পুত্রের মধ্যে সুসম্পর্কের বন্ধন দূর্বল হতে শুরু করে। এরপর রাজলক্ষ্মী হঠাৎ অপরিমিত উৎসাহে নববধূকে ঘরকন্নার কাজ শেখাতে লাগলেন। ভাড়ার ঘর, রান্নার ঘর, ঠাকুর ঘরেই আশার দিনগুলি কাটতে লাগল। ক্রমান্বয়ে দেখা গেল রাজলক্ষ্মী পুত্রবধূ আশার উপর শারীরিক নির্যাতন করতে শুরু করল। এই দেখে অন্নপূর্ণার দুঃখের সীমা থাকল না, কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু মহেন্দ্র মায়ের এই আচরণ দেখে খুব রেগে যায়। তাই মহেন্দ্র মাকে উত্তেজিত ভাবে বলে – “বউকে ঘরের কাজে আমি দাসীর মতো খাটিতে দিতে পারিব না।”৪ তারপর সে মাকে দৃঢ় কণ্ঠে জানায় সে আশাকে লেখাপড়া শেখাতে চায়। এই কথা শুনে রাজলক্ষ্মী নববধূর হাত ধরে টেনে এনে মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপিত করিয়া দেন। এরপর তার যত রাগ তারই বহিঃপ্রকাশ অন্নপূর্ণার উপর দেখালেন। কারণ অন্নপূর্ণাকে রাজলক্ষ্মী সহ্য করতে পারত না। এরপর মহেন্দ্র স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নিজের কলেজ, লেখাপড়া, সামাজিকতা, এক্সামিন, বন্ধুকৃত্য সবকিছু জলাঞ্জলি দিল। স্ত্রীর উন্নতি সাধন করতে গিয়ে তাকে নিয়ে সে ঘরে প্রবেশ করল। কাজের প্রতি দৃকপাত বা লোকের প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্রও করল না। মহেন্দ্রের এইসব আচার-আচরণ দেখে রাজলক্ষ্মী ঈর্ষায় জ্বলে উঠে। তার ফলেই মাতা ও পুত্রের মধ্যে সম্পর্ক একেবারে চরমে উঠে গেল। সাময়িক মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবন অনেক মধুময় হয়ে উঠল। তারা সবসময় পাশাপাশি থেকে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল। এই জন্য তাদের দাম্পত্যের বন্ধন অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠল।

অনাথিনী আশালতা স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে দিন দিন জীবন সম্পর্কে সজীবতা লাভ করল। আসলে পূর্বে আশালতা এত ভালবাসা কারও কাছে পায় নি। তাই আশা নববধূযোগ্য লজ্জাভয় দূর করে দিয়ে সৌভাগ্যবতী স্ত্রীর মহিমায় মুহূর্তের মধ্যেই স্বামীর পদপ্রান্তে অসংকোচে আপন সিংহাসন অধিকার করল। ফলে পুনরায় রাজলক্ষ্মী ও অন্নপূর্ণার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটল। কারণ রাজলক্ষ্মীর ধারণা ছিল আশার এই বাড়বাড়ন্তের জন্য অন্নপূর্ণার যথেষ্ট ইন্ধন ছিল। মহেন্দ্র আশাকে নিজে লেখাপড়া শেখাতে লাগল। আশার লেখাপড়াতে বেশি মনোযোগ থাকার জন্য মহেন্দ্র সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এটাকেই বেশি গুরুত্ব দিল। ফলে মহেন্দ্রের নিজের লেখাপড়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। মহেন্দ্র আশাকে একটু বেশিই ভালোবাসত। তাইতো মহেন্দ্র বলতে পারে – “আমাকে ছাড়িয়া তুমি যত সহজে পড়া করতে পার, তোমাকে ছাড়িয়া তত সহজে আমি আমার পড়া করিতে পারি না।”৫ এই বক্তব্যটি মহেন্দ্রের স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় দেয়। মহেন্দ্র আশার প্রতি ভালোবাসার জন্য প্রিয় বন্ধু বিহারীর ঘরে প্রবেশ করা পর্যন্ত সহ্য করতে পারল না। কারণ সে শুধুমাত্র স্ত্রীর সাথেই সময় দিতে চাইল। মহেন্দ্র বিহারীকে একজন শত্রু হিসাবে ভাবতে শুরু করল। কারণ মহেন্দ্রের মনে একটা সন্দেহ ছিল যে, বিহারী মনে মনে আশাকে ভালোবাসত। এই কথা ভেবেই মহেন্দ্র প্রিয় বন্ধুকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। একসময় বিহারীর সঙ্গে আশার বিবাহ প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল; তাই মহেন্দ্রের মনে তাদের দুজনকে নিয়ে একটা সন্দেহ থেকেই যায়। মহেন্দ্রের এই আচরণ বিহারী অনুমান করতে পারত এবং মহেন্দ্র এই নিয়ে আমোদ করত।

মহেন্দ্র আশার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজলক্ষ্মী এটা ভালোচোখে দেখেনি। রাজলক্ষ্মী বাড়ি থেকে কয়দিন বারাসাতে যাওয়ার জন্য মহেন্দ্রের কাছে অনুমতি নিতে যায়। মহেন্দ্র এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষন না করেই মাকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দেয়। ছেলের এই আচরণে মায়ের মনে খুব দুঃখ হয়। তাই উদাসী মন নিয়েই রাজলক্ষ্মী কিছুদিনের জন্য বারাসাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। নিজের গ্রামে গিয়ে রাজলক্ষ্মীর কিছুটা অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও ছেলের প্রতি অভিমানবশতঃ কোলকাতায় আর ফিরতে চাইল না। গ্রামে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে না নেওয়ার জন্য রাজলক্ষ্মীর প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। এমন সময় বিনোদিনী এসে তাকে আশ্রয় দিল এবং তার সেবা শুশ্রূষা করতে লাগল। বিনোদিনীর সেবাযত্ন পেয়ে রাজলক্ষ্মী খুব খুশি হয়ে গেল। বিনোদিনীর সেবাযত্নে আহ্লাদিত হয়ে রাজলক্ষ্মী মনের আবেগে বলতে পারে – “মা, তুই আমার ঘরের বউ হলি নে কেন, তা হইলে তোকে বুকের মধ্যে করিয়া রাখিতাম।”৬ এরমধ্যে অন্নপূর্ণাও ঘরসংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে কাশীতে চলে যান। মহেন্দ্র ও আশার অবিশ্রাম মিলনের মধ্যে একটা শ্রান্তি ও দূর্বলতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মহেন্দ্র ঘরসংসারের প্রতি বিমুখ হয়ে ওঠে। গৃহের মধ্যে অনিয়মিত কার্যকলাপ ঘটতে থাকে। মহেন্দ্র ও আশা একাকী বসবাস করতে থাকায় তাদের মধ্যে একসময় বিরক্তিভাব চলে আসে। এইজন্যই মহেন্দ্র মাকে তাড়াতাড়ি আসার জন্য চিঠি লেখে। রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের চিঠি পেয়ে কলিকাতায় ফিরে এল। রাজলক্ষ্মী আসার সময় একাকী না এসে বিধবা বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে আসিল। এই বিনোদিনীর আগমনের মধ্য দিয়েই তাদের সংসারে বিষবৃক্ষের বীজ বপন হয়ে গেল। বিনোদিনীর উপস্থিতিতে আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবন আস্তে আস্তে কলুষিত হতে লাগল। যেহেতু বিনোদিনী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা তাই সে খুব সচেতন। এখানে এসে বিনোদিনী সংসারের সমস্ত কাজে ও রাজলক্ষ্মীর সেবাযত্নে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করে দিল। তার এই কাজকর্ম ও সেবাযত্ন দেখে রাজলক্ষ্মী তার প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ করতে থাকে। এইজন্যই রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে করত। তাই বিনোদিনীকে বিশ্বাস করে রাজলক্ষ্মী বাড়ির সমস্ত কাজের ভার তুলে দিলেন। তাছাড়া তিনি তার সংসারের সমস্ত দায়িত্ব বিনোদিনীকে দিতে কোনো দ্বিধাবোধ করল না। এই সুযোগটাকে বিনোদিনী নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে লাগল।

বিনোদিনীর সঙ্গে আশার অত্যধিক মেলামেশা মহেন্দ্র খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। তাই মহেন্দ্র তার মাকে বারবার অনুরোধ করে যাতে বিনোদিনীকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেওয়া হয়। ছেলের কথা শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে বিনোদিনীর আচরণ সংযত করতে বলল। বিনোদিনী যাতে সাবধান হয় একথাও রাজলক্ষ্মী বারবার জানিয়ে দেয়। তারপর থেকে বিনোদিনী অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্বক আশাকে দূরে দূরে রাখিল। বিনোদিনী আশাকে তাই অভিমান করে বলল – আমি ভাই কে? আমার মতো অবস্থার লোক আপন মান বাঁচিয়ে চলতে না জানলে, কোন দিন কী ঘটে বলা যায় কি? আশা কান্নাকাটি করলেও বিনোদিনী নিজের যায়গায় স্থির থাকে। এদিকে মহেন্দ্র, আশার সাংসারিক অপটুতায় ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। মহেন্দ্রের এই আচরণ আশালতা অন্তরে অনুমান করতে পারে। মহেন্দ্র প্রথমে বিনোদিনীকে সহ্য করতে পারত না। তাই সে বিনোদিনীর সাথে কথা বলত না। এইজন্য বিনোদিনীর মনে খুব দুঃখ হয়। কিন্তু আশালতা বিনোদিনীর সঙ্গে খুব ভালোভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আশালতাই বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রের বন্ধুত্ব সম্পর্ক তৈরি করার জন্য কারিগর হয়ে ওঠে। আশালতার এই প্রয়াসে মহেন্দ্র প্রথম প্রথম খুব অনীহা প্রকাশ করত। কিন্তু আশা তার লক্ষ্যে অবিচল থেকে যায়। আশালতার বারবার প্রয়াসে মহেন্দ্র ও বিনোদিনী পাশাপাশি আসতে শুরু করে। তারা উভয়েই পাশাপাশি আসার ফলে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আশালতা যেহেতু খুব সহজসরল গ্রাম্য মেয়ে তাই সে বুঝতে পারেনি যে স্বামীর সাথে বিনোদিনীর এই সম্পর্কই যে তাদের দাম্পত্য জীবনে গভীর প্রভাব পড়বে। এরপর বিনোদিনী দিনে দিনে মহেন্দ্রকে মনে মনে ভালোবাসতে শুরু করল। মহেন্দ্র ও আশার সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে বিনোদিনী ভিতরে ভিতরে হিংসায় জ্বলে ওঠে। সে ভাবে যে এই সুখের ঘরসংসার আমার হতে পারত, কিন্তু একটু ভুলের জন্য তা আজ সম্ভব হয়নি। তাই সে তাদের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে একটা অশান্তি করার চেষ্টা করল। আশার এই সুখের সংসারকে সে কোনভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। মহেন্দ্র ছোটবেলা থেকে যাকিছু কাছে দেখেছে, তাকেই সে নিজের বলে নিতে চেয়েছে। মহেন্দ্র এই স্বভাববশতই বিধবা বিনোদিনীকেও নিজের কাছে দেখে তাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিল। রাজলক্ষ্মী ও আশার পূর্ণ সমর্থনের ভিত্তিতে বিনোদিনী ভিতরে ভিতরে মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনে চোরাস্রোতের সৃষ্টি করতে থাকে।

আশা যখন প্রথম মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর মধ্যে সাক্ষাৎ করায় তারপর মহেন্দ্র কিন্তু খুব উদগ্রীব হয়ে যায়। আশাকে মহেন্দ্র বারবার জিজ্ঞাসা করে বিনোদিনীর প্রতিক্রিয়া। আশা ও মহেন্দ্রের কথোপকথন কালে হঠাৎ বিহারী এসে পড়ে। বিহারীর মানুষ চেনার ক্ষমতা একটু বেশিই ছিল। তাই সে বিনোদিনী সম্পর্কে আশাকে বলে – “বৌঠান লক্ষণ ভালো নয়। এসব ভোলাইবার কথা। তোমার চোখের বালিকে আমি দেখিয়াছি। আরো যদি ঘন ঘন দেখিতে পাই, তবে সেটাকে দুর্ঘটনা বলিয়া মনে করিব না, সে আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি। কিন্তু মহিনদা যখন এত করিয়া বেকবুল যাইতেছেন তখন বড়ো সন্দেহের কথা।”৭ আসলে বিহারী এই কথাটির সাহায্যে আশা ও মহেন্দ্র উভয়কেই আগেভাগে সাবধান করতে চেয়েছিল। বিহারীর আশার প্রতি একটু দূর্বলতা ছিল। তাই সে চাইত আশার দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয়, তাতে কোনো অশান্তি যেন না আসে। কিন্তু মহেন্দ্র মনে মনে বিনোদিনীর প্রতি একটা আকর্ষণের সৃষ্টি হয় যা আশার কাছে সে গোপন রাখে। আশা এরপর মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর বারবার সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়। মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে বিনোদিনী এসে পড়ায় তার গুরুত্ব মহেন্দ্রের কাছে বেড়ে যায়। বিনোদিনীকে তারা দুইজনেই খুব মান্য করতে লাগল। তারা তাদের দাম্পত্য জীবনের কোন সমস্যার সমাধানের জন্য বিনোদিনীকে বিচারক হিসাবে স্বীকৃতি দেবার চেষ্টা করত। বিনোদিনী খুব সচেতন, তাই এই সুযোগটাকে সে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাবার চেষ্টা করল। মহেন্দ্র ও রাজলক্ষ্মীকে সেবাযত্ন করে বিনোদিনী তাদের মনে নিজের স্থান করে নিল। মহেন্দ্রের মন আস্তে আস্তে আশার দিক থেকে ঘুরে গিয়ে বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণ বাড়তে লাগল। বিনোদিনী এটা খুব ভালোভাবেই অনুমান করতে পেরেছিল। তাই বিনোদিনী সাহস পেয়ে মাঝে মাঝে আশাকে মহেন্দ্রের কাছে ভৎর্সনা করতেও দ্বিধা বোধ করল না। বিনোদিনীর নিজের হাতে তৈরি পশমের জুতো এবং পশমের গলাবন্ধ মহেন্দ্রের কোমল মানসিক সংস্পর্শের মতো বেষ্টন করল। আশা তার নিজস্বতা হারাতে লাগল এবং কতকটা বিনোদিনীকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতে লাগল। আশা বুঝতে পারে যে মহেন্দ্র পূর্বের মতো আর তাকে ভালোবাসে না। কিন্তু তবুও সে স্বামীর প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারল না। আশালতা একবারও মনে ভাবে না যে বিনোদিনী তার দাম্পত্য জীবনের গভীরে ঢুকে কোন অশান্তি করতে পারে। মহেন্দ্র ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা করতে লাগল যাতে বিহারী তাদের ঘরে বেশি আসা যাওয়া না করে। বিহারী মহেন্দ্রের এই কৌশল খুব ভালোভাবেই অনুমান করতে পারে। কিন্তু আশার প্রতি দূর্বলতা বশতঃ সে অপমানিত হয়েও তাদের দাম্পত্য জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবাড়িতে আসা যাওয়া করতে লাগল। বিহারী ইঙ্গিতে আশাকে তার দাম্পত্য জীবনে সর্বনাশের কথা বলতে লাগল। তাই বিহারী বলতে পারে – “বৌঠান, চিকিৎসা করিয়া রোগ সারানোর চেয়ে রোগ না হইতে দেওয়াই ভালো।”৮ বিহারী তখন মনস্থির করল যে তার দূরে থাকা চলবে না, যেমন করে হোক ইহাদের মাঝখানে থেকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে।

বিহারী আহ্বান – অর্ভ্যথনার অপেক্ষা না রেখেই মহেন্দ্রের ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করতে লাগল। এমনকি বিহারী বিনোদিনীকেও অনুরোধ করে বলে – “এই ছেলেটিকে ইহার মা মাটি করিয়াছে, বন্ধু মাটি করিয়াছে, স্ত্রী মাটি করিতেছে – তুমিও সেই দলে না ভিড়িয়া একটা নতুন পথ দেখাও - দোহাই তোমার।”৯ বিহারী যে সমস্ত মাটি করতে এসেছে, এটা বিনোদিনীর বুঝতে বাকী রইল না। বিহারী তার বন্ধু মহেন্দ্রকে সাবধান করে বলে – “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও, করো – বরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে সরল হৃদয়া সাধ্বী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না।”১০ অর্থাৎ বিহারী মহেন্দ্রকে বিনোদিনীর ফাঁদে পড়া থেকে সাবধান করে দেয়। মহেন্দ্র বিহারীর এই কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে যায়। তাই মহেন্দ্র বিহারীকে জানায় যে তার এখানে আসা যাওয়া করা বিনোদিনীর ভালো লাগে না, তাতে সে বিরক্ত হয়। বিহারী তারপর বিনোদিনীর কাছে এসে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করে। এরপর বিনোদিনী এখান ছেড়ে বাড়ি যাবার কথা বললে মহেন্দ্র তাতে অপ্রত্যক্ষ ভাবে বাধা দেয়। তাই মহেন্দ্র ও আশার বারবার অনুরোধে বিনোদিনী এখানেই থেকে যায়। এই ঘটনার পর মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর সম্পর্ক অনেক গভীর হতে শুরু করে। মহেন্দ্রের মনে বিনোদিনীর প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। মহেন্দ্র তাই খড় কুটোর মতো বিনোদিনীকে ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর একটা অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক হতে দেখা যায়। বিনোদিনী মনে মনে বিহারীকে খুব সম্মান করত। বিহারীও বিনোদিনীর মধ্যে যোগাযোগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। যা দেখে মহেন্দ্র সহ্য করতে পারত না। বিনোদিনী কিন্তু মহেন্দ্রকে অগ্রাহ্য করেই নিজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বিহারীকে শ্রদ্ধা করতে লাগল। বিহারীও তাতে সমান ভাবে যোগ দিল। কারণ সে দেখল যে বিনোদিনীকে যদি মহেন্দ্রের মন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় তবে আশার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়ে উঠবে। বিহারীর মনে বিনোদিনীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি দিনে দিনে বাড়তে লাগল। সে পূর্বের ন্যায় বিনোদিনীকে আর অবজ্ঞা করত না। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে পূর্বের মতো কাছে পাবার জন্য চেষ্টা করলেও বিনোদিনী কিন্তু তাকে আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইল না। মহেন্দ্র এরপর আশাকে মানসিক ভাবে প্রতিপদে তীব্র আঘাত করতে লাগল। তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা অশান্তি যেন লেগে গেল। আশা বুঝতে পারে যে তার চারদিকেই সমস্ত যেন উলট পালট হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তা প্রতিকারের কোন উপায় তার জানা ছিল না।

বিনোদিনী বিহারীকে এত বিশ্বাস করতে শুরু করল যে কোন পরামর্শ সে বিহারীর কাছেই নিতে শুরু করল। বিনোদিনীর এই বাড়াবাড়ি দেখে মহেন্দ্র খুব বিরক্তি বোধ করল। বিনোদিনীর অভাব সে কোন মতেই মেনে নিতে পারছিল না। তাই তার মানসিক অবস্থা ক্রমশ অবনতি হতে লাগল। যার ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে ক্রমশ কালো মেঘ দেখা দিতে লাগল। আশার কিন্তু স্বামীর প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালোবাসা ছিল। যার জন্য সে স্বামীকে বলতে পারে – “আমাকে তোমার দাসীর মতো শাসন করো। আমাকে তোমার চরণাশ্রয়ের যোগ্য করিয়া লও।”১১ মহেন্দ্র রেগে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে কলেজের কাছেই একটি বাসা নিয়ে চলে গেল পড়ার অজুহাত দিয়ে। মহেন্দ্রের একটা জ্বালা বিনোদিনীর অন্তরে জ্বলছে, তা হিংসার না প্রেমের, না উভয়েরেই মিশ্রণ তা বিনোদিনী ঠিক ভেবে পায় না। তাই সে তীব্র আত্মশক্তিতে উচ্চারণ করতে পারে – “ সে যাইবে কোথায়? সে ফিরিবেই। সে আমার।”১২ মহেন্দ্রের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতে বিহারী মনে মনে খুব ব্যথিত হয়েছিল। তাই বিহারী বিনোদিনীকে বলতে পারে – “আশাকে তুমি দেখিয়ো। সে সরলা, কাহাকেও আঘাত করিতেও জানে না, নিজেকে আঘাত হইতে বাঁচাইতেও পারে না।”১৩ বিনোদিনী তখন বুঝতে পারে যে আশার জন্য করুণায় বিহারীর হৃদয় ব্যথিত, সে তার কাছে কেও নয়। আশার পথের কাঁটা দূর করবার জন্যই, আশার সমস্ত সুখ সম্পূর্ণ করিবার জন্যই বিহারীর জন্ম। এই কথা ভেবে বিনোদিনী খুব ভেঙ্গে পড়ে। তখন তার মনে আক্ষেপ হয়, যে কোন পুরুষকেই সে জয় করতে পারছে না। তাই এরপর সে সংহার মূর্তি ধারণ করল। মহেন্দ্র কলেজে থাকা কালীন আশার দেওয়া তিনখানি চিঠি পেল। চিঠিগুলি পড়ে সে বুঝতে পারল না যে চিঠিগুলি কে লিখেছে আশা না বিনোদিনী ! কারণ চিঠিতে যে বিষয় লেখা ছিল তা বিনোদিনীর বলে মনে হল। চিঠির বিষয় তার মনে একটা টানা পোড়েনের সৃষ্টি হল। এর মধ্যে বিহারী মহেন্দ্রকে তার কাছে গিয়ে বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে জানায় যে আশা তারজন্য কান্নাকাটি করছে। তাই মহেন্দ্র এই কথা শুনে বিহারীর সঙ্গে বাড়ি চলে আসে।

মহেন্দ্র ঘরে ফিরে আসা মাত্র তার মুখ দেখেই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের মতো একমুহূর্তেই কেটে গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করে লজ্জায় সে মহেন্দ্রের সামনে মুখ তুলতেই পারল না। এই চিঠির জন্য আশা মহেন্দ্রের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করল। মহেন্দ্র আশাকে পূর্বের মত কাছে টেনে নিল। বিনোদিনী তাই মহেন্দ্রের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করল। বিনোদিনীর এই আচরণ দেখে মহেন্দ্র খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। বিনোদিনী ঈর্ষায় এবার বাড়ি ছাড়বার জন্য নিতান্তই উঠে পড়ে লাগল। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীর সঙ্গে যে দুরত্ব তৈরি হয়েছিল তা দূর করার চেষ্টা করল। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীকে বারবার অনুরোধ করতে লাগল বাড়িতে থেকে যাবার জন্য। বিনোদিনী তখন অনুরাগের বশে বলে – “কিসের জন্য এত অনুনয়-বিনয়। আমি থাকিলেই কী, আর না থাকিলেই কী। আপনার তাহাতে কী আসে যায়।”১৪ মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণের ফলে তার হাত চেপে ধরে রুদ্ধ সজলস্বরে বলে – “যদি তাহাতে আমার আসে যায়, তবে তুমি থাকিবে?”১৫ বিনোদিনী মহেন্দ্রের এই ব্যবহারে অনুমান করতে পারে যে মহেন্দ্র তার প্রতি কতটা অনুরক্ত। সেই সুযোগে বিনোদিনী কথা দেয় যে যতক্ষণ না তোমরা আমাকে বিদায় দিবে ততক্ষণ আমি এবাড়িতে রইলাম। এতে আশা ও মহেন্দ্র খুব খুশি হয়। আশা বুঝতে পারল না যে এতে তার জীবনের কতবড় ক্ষতি হল। বিনোদিনীই যে তার দাম্পত্য জীবনের মাঝে কাঁটা হয়ে উঠবে তা সে কিছুতেই অনুমান করতে পারল না। বিহারী বিনোদিনীকে দেবীর মতো শ্রদ্ধা করতে লাগল। মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণের ফলে আশাকে আর সহ্য করতে পারল না। তাই তাদের দাম্পত্য জীবনে ঘন কুয়াশার আবির্ভাব দেখা দিল। মহেন্দ্র হঠাৎ তার কাকিমা অন্নপূর্ণা দেবীকে দেখা করার জন্য কাশী চলে যায়। মহেন্দ্রকে দেখে অন্নপূর্ণার যেমন আনন্দ হল, তেমনি আবার আশার সঙ্গে তার মায়ের কোনো বিরোধের সন্দেহ করে দুঃখও লাগল। কিন্তু মহেন্দ্র আশাকে নিয়ে তার মার সম্বন্ধে কোন অভিযোগের কথা না তোলায় অন্নপূর্ণার সমস্ত আশঙ্কা দূর হল। মহেন্দ্র কাশী থেকে বাড়ি ফেরার পরেই মাসীর সাথে একবার দেখা করার জন্য আশার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। মহেন্দ্র তাতে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতিও দিল। বিহারী এই খবর শুনে অবাক হয়ে গেল। তাই মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বিহারীর একটা সন্দেহ দেখা দিল। বিহারী তখন চাতুরীবশতঃ আশার সঙ্গে বিনোদিনীকে কাশীতে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিল। এই কথা শুনে মহেন্দ্র রাগে গর্জন করে উঠল। মহেন্দ্র তখন বুঝতে পারে সে যে বিনোদিনীকে ভালোবাসে তাকে দূর করার জন্যই বিহারীর এইরকম প্রস্তাব। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে যে ভালোবাসে তা উচ্চস্বরে অস্বীকার করে। তাছাড়া মহেন্দ্র বিহারীকে দৃঢ়কণ্ঠে বলে যে তুমি আশাকে ভালোবাসো। এই কথা শুনে বিহারী ক্ষোভে দুঃখে মহেন্দ্রের বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। বিহারী তাকে ভালোবাসে এই কথা শুনে আশা স্বামীর মুখের প্রতি লজ্জায় ঘৃণায় আর মুখ তুলতে পারছিল না। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ভালোবাসার কথা অস্বীকার করায় সে নিজেকে আর সংবরণ করিতে পারিল না। কারণ তার মনে হল এতে বিনোদিনী রাগবশতঃ তাকে বাদ দিয়ে বিহারীকে ভালোবাসতে পারে। মহেন্দ্র এই দোটানায় পড়ে তার নিজের উপর আর বিশ্বাস রাখতে পারে না। তাই তো সে আশাকে জিজ্ঞাসা করে – “চুনি, তুমি আমাকে কতখানি ভালোবাস ঠিক করিয়া বলো।”১৬

মহেন্দ্রের মধ্যে একটা ভালো মানুষী সত্ত্বাও যে ছিল তা আমরা দেখতে পায়। তাই তো সে আশাকে বলতে পারে – “ তুমি আর কাহাকেও বিবাহ করিলে ঢের বেশি সুখী হইতে পারিতে।”১৭ বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে অন্তর থেকে খুব ভালবেসে ছিল। তাই সে বিহারীকে চিঠি দিয়ে প্রেম নিবেদন করতেও দ্বিধা বোধ করে না। আশাকে বিহারী ভালোবাসে এই কথা শোনার পর বিহারী নিজেকে মনে মনে অপরাধী বলে ভাবতে শুরু করে। তাই বিহারী অনুরাগের বশে দেশ ছেড়ে পশ্চিমে চলে যায়। দারোয়ান বিহারীকে বাড়িতে না পেয়ে তার চিঠি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিনোদিনীর এই চিঠি মহেন্দ্র দারোয়ানের কাছে পেয়ে যায়। চিঠিটি পেয়ে মহেন্দ্র কৌতূহল বশতঃ সেটি খুলে পড়তে লাগল। চিঠিখানি পড়ে মহেন্দ্র বিনোদিনীর মনের গতি ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারল না। মহেন্দ্র তখন বিনোদিনীকে কাছে পাবার জন্য আকুল হয়ে গেল। মহেন্দ্র তখন স্থির করল নিজেকে ধরা দিয়া হোক বা না দিয়া হোক বিনোদিনীর মন যেকোন অবকাশে পুনরায় ফেরাতে হবে। আসলে মহেন্দ্র, আশা ও বিনোদিনী দুজনকেই কাছে পেতে চেয়েছিল। তাই তার জীবন ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল। বিনোদিনী তার পাঠানো পত্র খোলা অবস্থায় ফেরত পেল। তখন সে ভাবল যে বিহারী এই চিঠি পড়ে তার কোন উত্তর না দিয়েই তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই তার বিহারীর প্রতি মনে মনে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মহেন্দ্র কৌশলে হঠাৎ আশাকে কাশীতে তার মাসীর সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করল। এই কথা শুনে আশা চুপচাপ বসে রইল। আসলে বিনোদিনীর সঙ্গে সন্ধি করিবার জন্য বাধাহীন অবসর চেয়ে মহেন্দ্রের মন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অধীর হয়ে উঠেছিল। আশাকে চুপ করে থাকতে দেখে মহেন্দ্রের মনে রাগের সঞ্চার হল। মহেন্দ্র তাই আশাকে বলে – “আমার উপর মনে মনে তোমার কোন সন্দেহ জন্মিয়াছে নাকি। তাই আমাকে চোখে চোখে পাহারা দিয়া রাখিতে চাও?”১৮ হঠাৎ মহেন্দ্রের এই উগ্রতা দেখে আশা বিস্মিত ও ভীত হয়ে পড়ল। মহেন্দ্র কেন এত উগ্র হয়ে গেল তার কারণ সরল বালিকা আশার বোঝার কোন ক্ষমতা ছিল না। আশা এরপর মহেন্দ্রের কাছে ক্ষমা চায়। আশা মহেন্দ্রকে জানায় যে তার মাসীকে দেখতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু তোমাকে ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। মহেন্দ্র তখন আশাকে বলে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। মহেন্দ্র এই কথা যে অনুরাগের বশে জানায় তা আমরা অনুমান করতে পারি। তাই আশা মহেন্দ্রকে সন্দেহমুক্ত করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে কাশী যেতে রাজী হয়ে যায়। আশার জেদাজেদিতে মহেন্দ্র তাকে কাশী যেতে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেয়। আসলে মহেন্দ্র ভিতরে ভিতরে যেটা চাইছিল সেটাই সে অবশেষে পেল। মহেন্দ্র আশাকে ইঙ্গিতে জানায় সে তার অনেকখানি আপন। মহেন্দ্র তাই আশাকে বলে – “আচ্ছা যাও, কিন্তু তোমার চোখের আড়ালে আমি যদি নষ্ট হইয়া যাই, তাহা হইলে কী হইবে।”১৯ কিন্তু মহেন্দ্রের এই কথায় আশা কোন গুরুত্বই দিল না। আশা কাশী যাওয়ার পূর্বে মহেন্দ্রের সমস্ত ভার বিনোদিনীকে দিয়ে চলে গেল। সহজ সরল বালিকা আশা কোন দিন মনেও ভাবে না যে বিনোদিনী তার স্বামীকে তার থেকে আলাদা করে দিতে চায়। বিনোদিনী একাকী মহেন্দ্রকে তার পক্ষে নিয়ে নেবার একটা সুযোগ পেয়ে গেল।

আশা কাশী যাবার পর প্রথম প্রথম বিনোদিনী মহেন্দ্রের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করত। তাই সে মহেন্দ্রকে ফাঁকি দিয়া পালায়, ধরা দেয় না। রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে দেখে আদেশ করে যে মহেন্দ্রকে যেন সে চোখে চোখে রেখে সেবাযত্ন করে। বিনোদিনী প্রথমে তা অস্বীকার করলেও পরে তা মেনে নেয়। তাই বিনোদিনী মহেন্দ্রের সেবাযত্ন খুব ভালোভাবে করতে লাগল। মহেন্দ্র এতে খুশি হয়ে বিনোদিনীর প্রতি তার আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। বিনোদিনীকে তাই সে অন্তরের গভীরে স্থান দিতে লাগল। মহেন্দ্র সময়ে অসময়ে বিনোদিনীকে কাছে পেতে চাইল কিন্তু বিনোদিনীর তাতে তেমন সায় ছিল না। বিনোদিনীর উপর তাই মহেন্দ্রের অনুরাগের সৃষ্টি হয়। যারফলে মহেন্দ্র আশাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার জন্য চিঠি লিখে। আশা কাশীতে থাকার সময় হঠাৎ একদিন সেখানে বিহারী উপস্থিত হয়। বিহারীকে দেখে আশা মাসীকে জানায় সে যেন এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যায়। অন্নপূর্ণা কিন্তু বিহারীকে দেখে আশার এই বিরক্তি ভাবের কারণ অনুমান করতে পারে না। আশা তখন চিঠি দিয়ে এইসব ঘটনা মহেন্দ্রকে জানাতে দ্বিধাবোধ করে না। আশার অনুপস্থিতিতে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর ঘনিষ্ঠতা খুব বেড়ে গেল। তাদের মধ্যে একটা প্রনয়াসক্ত দেখা দিল। মহেন্দ্রের স্বভাব হল যাকে কাছে পায় তাকেই নিজের অধিকার বলে মনে করে। এইজন্যই সে বিনোদিনীকে কাছে পেয়ে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করে।

মহেন্দ্র মনে মনে সন্দেহ করত যে বিনোদিনী বিহারীকে খুব ভালোবাসে, তাই তার খুব হিংসা হত। এজন্যই সে বিহারীর কাছ থেকে বিনোদিনীকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর একান্তে ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য একদিন বিহারীর চোখে পড়ে যায়। বিহারী তখন বুঝতে পারে যে সে যেটা সন্দেহ করেছিল সেটাই ঠিক। মহেন্দ্র বিহারীকে তখন অনেক অপমান করল। বিহারী মহেন্দ্রের কাছে অপমানিত হয়ে কোন কথা বলল না। বিহারীকে অপমান করায় কিন্তু বিনোদিনীর খুব অসহ্য লাগল। তাই বিনোদিনী মনে মনে মহেন্দ্রকে খুব ঘৃণা করতে লাগল। বিনোদিনী বিহারীকে ধরতে এলে বিহারী বিনোদিনীকে ঠেলে দেয় এতে বিনোদিনীর হাত কেটে রক্ত বের হয়। বিহারীর এই আঘাতকে বিনোদিনী রাগ না করে বরং পরম সৌভাগ্য হিসাবে মেনে নেয়। বিহারীকে বিনোদিনী অন্তর থেকে ভালোবাসতো বলেই এটা সম্ভব। বিনোদিনীকে আবার মহেন্দ্র ভালোবাসার কথা বললে বিনোদিনী তা সুকৌশলে স্বীকারও করে। তাই বিনোদিনী মহেন্দ্রকে বলতে পারে – “মাথায় করিয়া রাখিব। ভালোবাসা আমি জন্মাবধি এত বেশি পাই নাই যে, চাই না বলিয়া ফিরাইয়া দিতে পারি।”২০ বিহারীর কাছে হঠাৎ গোপন রহস্যের কথা ধরা পড়ে যাওয়ায় মহেন্দ্রের মনে একটা মুক্তির আনন্দ উপস্থিত হল। মহেন্দ্র এরপর তাই আরও বেশি করে বিনোদিনীকে কাছে পেতে চাইল। মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর ঘনিষ্ঠতা দেখা সত্ত্বেও রাজলক্ষ্মী কোন ভ্রূক্ষেপই করল না। কারণ রাজলক্ষ্মী চাইত যেকোন মূল্যে তার সন্তান সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করুক। বিনোদিনীর কাছে রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ হল তার ছেলের যাতে কোন অসুবিধে না হয়।

মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি প্রনয়াসক্ত হলেও বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে তার মনে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। তাই তো বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে দিয়ে বিহারীকে ডেকে এনে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে চায়। বিনোদিনীর এইসব আচরণ মহেন্দ্রের ভালো লাগে না। আশা কাশী হতে বাড়ি ফিরে দেখল মহেন্দ্র তার সাথে পূর্বের মতো ব্যবহার করছে না। আশা এতে খুব মর্মাহত ও নিজেকে অপমানিত বোধ করে। বিনোদিনীকে মহেন্দ্র যে ভালোবাসিতে পারে এ সম্ভবনাও আশার মনে কখনও উদয় হয় নাই। সংসারের অভিজ্ঞতা তাহার কিছুই ছিল না। তাই পৃথিবী সংসার সমস্ত আশার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেল। আশা তখন অনুভব করল যে বিহারী যে কাশী গিয়েছিল সেই খবর পেয়েই হয়তো মহেন্দ্রের মনে রাগ হয়েছে। নানারকম ভাবনা চিন্তা করে আশা তার মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোন কিছুতেই সে নিজের মনকে শান্ত করতে পারল না। এই সব চিন্তা করতে করতে আশার হৃদস্পন্দন স্তব্দ হয়ে গেল। মহেন্দ্র আশা ও বিনোদিনী উভয়কেই আলাদা আলাদা দৃষ্টিতে নিজের অধিকারে রাখতে চায়। মহেন্দ্রের ধারণা হয় বিনোদিনীর সঙ্গে তার যে পবিত্র সম্বন্ধ তাতে তার দাম্পত্য জীবনের কোন ব্যাঘাত হবে না। হঠাৎ একদিন মধ্যরাত্রিতে মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণে তার ঘরে চলে যায়। বিনোদিনী মহেন্দ্রের এই আচরণ ভালো চোখে দেখেনি। আশা একদিন মহেন্দ্রের জামার পকেটে হাত দিতেই একখানি চিঠি পেয়ে যায়। চিঠিটি বিনোদিনী কর্তৃক মহেন্দ্রকে লেখা। চিঠিটি পড়ে স্বামীর প্রতি সন্দেহে আশার মন একেবারে ভেঙ্গে যায়। আশা অনুমান করে যে মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর একটা অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মহেন্দ্র যে বিনোদিনীকে ভালোবাসিতে পারে একথা আশা কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। তাই তো বিনোদিনী চিঠিতে মহেন্দ্রকে বলতে পারে – “একসময় মনে করিতে তুমি আশাকে ভালোবাসিতেছ, সেও মিথ্যা; এখন মনে করিতেছ তুমি আমাকে ভালোবাসিতেছ, এও মিথ্যা। তুমি কেবল নিজেকে ভালোবাসো।”২১ চিঠিখানি পড়ে আশার সমস্ত পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গেল।

রাজলক্ষ্মী সবকিছু বুঝতে পেরে বিনোদিনীকেই সমস্ত কিছুর জন্য দোষারোপ করতে লাগল। তখন বিনোদিনী উগ্র হয়ে বলে – “তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়া তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই? একবার ঠাওর করিয়া দেখো দেখি।”২২ বিনোদিনী একদিক থেকে ঠিকই বলেছিল। কারণ আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের অশান্তির জন্য রাজলক্ষ্মী কিছুটা হলেও দায়ী। কারণ রাজলক্ষ্মী যদি পূর্ণ যৌবনা বিধবা বিনোদিনীকে ঘরে এনে স্থান না দিত তাহলে হয়ত আশার দাম্পত্য জীবন এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠত না। বিনোদিনীর ঈর্ষায় তার দুই চক্ষে আগুন জ্বলে উঠল। বিনোদিনী চিন্তা করল সংসারে যদি অপরাধীই হতে হয় তবে অপরাধের যত লাঞ্ছনা তাই কেন ভোগ করবে? অপরাধের যত সুখ তা হতে কেন বঞ্চিত হবে। মহেন্দ্রকে মুখের উপর বিনোদিনী ঘৃণা করতে ইতস্ততঃ বোধ করে না। তাছাড়া মহেন্দ্রকে বিনোদিনী ভীরু কাপুরুষ বলে অপমানিত করে। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে তার সঙ্গে সমস্ত পরিত্যাগ করে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের অনুরোধ স্বীকার করে না। মহেন্দ্র কিন্তু জোর পূর্বক তাকে নিয়ে যেতে চায়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সেই মুহূর্তে বলে – “চারিদিকে আগুন জ্বালাইয়া তুলিয়াছ, এখন আর নিবাইতেও পারিবে না, পালাইতেও পারিবে না।”২৩ এই কথার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি যে মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণে কতটা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মহেন্দ্র মায়ের কাছেও এই কথা বলতে কোন দ্বিধা বোধ করে না। বিনোদিনী শেষমেষ তার সঙ্গে যেতে রাজী হয়।

বিনোদিনী হঠাৎ বিহারীর কাছে চলে যায়। বিনোদিনী বিহারীর কাছে গিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা প্রার্থনা করে। বিনোদিনী বিহারীকে জানায় যে মহেন্দ্র তাকে ভালোবাসে এবং তাকে নিয়ে সে গৃহত্যাগ করতে প্রস্তুত। বিনোদিনী বিহারীকে এও জানায় সে মহেন্দ্রকে ভালোবাসে না। বিনোদিনী বিহারীকে খুব ভালোবাসত বলেই এই অসময়ে একাকী তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে কোন দ্বিধাবোধ করে না। বিনোদিনী বলে তুমি যদি আশাকে ভালো না বাসিতে তবে আমার দ্বারা আশার আজ এমন সর্বনাশ হতো না। সবকিছু ঘটনা শোনার পর বিহারী বিনোদিনীকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ঘরে না দেখতে পেয়ে সেই রাত্রেই বিহারীর কাছে চলে যায়। সেখানে এসে সে বিহারীর কাছে বিনোদিনীর খোঁজ করে। কারণ মহেন্দ্রের মনে সন্দেহ হয়েছিল যে বিনোদিনী ভালোবাসার টানে বিহারীর কাছেই যাবে। মহেন্দ্র বিহারীর কাছে বিনোদিনীর খোঁজ নিতে চাইলেও কিন্তু বিহারী বিনোদিনীর কোন খবর দিতে পারল না। মহেন্দ্র হতাশ হয়ে সেখান থেকে ঝড়ের বেগে চলে গেল। বিনোদিনীকে গ্রামে গিয়ে পাড়ার লোকের অনেক ভর্ৎসনা সহ্য করতে হল। পাড়ার লোকে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর অবৈধ সম্পর্কের নানারকম কথা প্রচার করতে লাগল। বিনোদিনী এই সব কথা শুনে অধৈর্য হয়ে বিহারীকে একটা চিঠি দিল। চিঠির উত্তরের আশায় বিনোদিনী অস্থির হয়ে উঠল। গ্রামে বিনোদিনীর কাছে হঠাৎ মহেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল। মহেন্দ্রকে দেখে বিনোদিনী লোকলজ্জার ভয়ে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি আকর্ষণে যেতে চাইল না। এই ঘটনা জানাজানি হতেই গ্রামের মধ্যে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হল। তাই বিনোদিনীর গ্রামে থাকা অসহ্য হয়ে উঠল। ফলে বিনোদিনী মহেন্দ্রের সাথে গ্রাম থেকে বিদায় নিল।

মহেন্দ্রের নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে রাজলক্ষ্মীর আহার নিদ্রা বন্ধ হল। এমন সময় মহেন্দ্র বিনোদিনীকে পটলডাঙার বাসায় রেখে নিজে বাড়ীতে ফিরে এল। মহেন্দ্র মাকে জানায় তার পড়ার সুবিধার্থে তাকে কলেজের কাছে বাসা নিয়েই থাকতে হবে। মা এতে সম্মতি দেয় কিন্তু জানায় বউমা যেন কোন কষ্ট না পায়। রাজলক্ষ্মী এখন আশাকে মেয়ের মতো খুব ভালবাসতে থাকে। তাই আশার নিয়ে তার চিন্তাভাবনা হয়। মহেন্দ্র সেই রাত্রিতেই কাউকে না জানিয়ে ঘর হতে বিদায় নিল। বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বশতঃ মহেন্দ্র আর ঘরে থাকতে পারল না। মহেন্দ্রের মনে এখন সমস্ত ধ্যান জ্ঞান শুধুমাত্র বিনোদিনী। বিনোদিনীর জন্য সে ঘর, সংসার, স্ত্রী, বন্ধু সমস্তকেই পরিত্যাগ করে। বিনোদিনী নিজেকে অসহায় মনে করে মহেন্দ্রের উপরেই ভরসা করতে থাকে। কিন্তু সে বিহারীকে কোনভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। বিনোদিনীর হৃদয় কোন অবস্থাতেই সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দিতে জানে না, নৈরাশ্যকে সে স্বীকার করে না। মহেন্দ্র বিনোদিনীর সঙ্গে একঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করলে বিনোদিনী তাতে রাজী হয় না। মহেন্দ্র বিনোদিনীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। তাই সে বলতে পারে – “আমি অত্যন্ত হতভাগ্য যে, আমি তোমাকে ভালোবাসিয়াছি।”২৪

মহেন্দ্র বিনোদিনীর উপেক্ষাকে সহ্য করতে না পেরে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। তাই সে ঠিক করে বিনোদিনীকে উপেক্ষার পরিবর্তে উপেক্ষা করবে। মহেন্দ্র বিনোদিনীর এই উদ্ধ্যতের জন্য বিহারীকেই দায়ী করে। কারণ মহেন্দ্র মনে করে তার প্রশ্রয়েই বিনোদিনীর এত বাড়বাড়ন্ত। তাই সে প্রতিশোধ নেবার জন্য বিহারীর ঘরে গেল। কিন্তু বিহারীকে ঘরে পাওয়া গেল না। বিহারীকে ঘরে না পেয়ে মহেন্দ্রের সন্দেহ বাড়তে লাগল। কিন্তু পরে বেয়ারার কাছে খবর পেল বিহারী চার-পাঁচ দিন আগে পশ্চিমে চলে গেছে। এই কথা শুনে মহেন্দ্রের সমস্ত সন্দেহ দূর হল। বিহারীর ঘরে মহেন্দ্র একখানা বিনোদিনীর চিঠি পেয়ে মনকে আর ঠিক রাখতে পারল না। মহেন্দ্র সেই চিঠিখানা এনে বিনোদিনীকে দিল। বিনোদিনী অনুমান করল যে বিহারী চিঠি পড়ে কোন উত্তর দিল না। তাই বিহারীর এই আচরণে বিনোদিনীর অভিমান হল। মহেন্দ্রের কাছে বিহারীর পশ্চিমে যাওয়ার খবর শুনে বিনোদিনীর বিশ্বাস হয় না। তাই সে পুনরায় খেমিকে বিহারীর খবর নিতে তার ঘরে পাঠায়। খেমির কথা শুনে বিনোদিনীর পূর্ণ বিশ্বাস হল। এথেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে বিনোদিনী মহেন্দ্রকে খুব একটা বিশ্বাস করত না। এদিকে রাজলক্ষ্মীর ধারণা হয় যে আশারই আচরণে ও স্বভাবদোষেই মহেন্দ্র বাড়ী ত্যাগ করেছে। এই জন্য রাজলক্ষ্মী আশাকে নানারকম ভাবে তিরস্কার করতে থাকে। আশা এই ভর্ৎসনা শুনে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদতে লাগল। মহেন্দ্র হঠাৎ পুনরায় লজ্জায় ঘৃণায় বাড়ীতে ফিরে এল। মহেন্দ্রকে দেখে আশা কিন্তু পূর্বের মতো তারসাথে আচরণ করতে পারল না। তার মনে হল মহেন্দ্র তার নয়, সে বিনোদিনীর। এই কথা ভেবে আশার হৃদয়ে গ্লানির সঞ্চার হল। তাই আশা কোনভাবেই মহেন্দ্রকে মনের মধ্যে স্থান দিতে পারল না। বিনোদিনীর মহেন্দ্র যেন আশার পক্ষে পরপুরুষ বলে অনুভূত হল। তাই সে মহেন্দ্রের ঘরে প্রবেশ করতে পারল না। মহেন্দ্রের প্রতি আশার এই আচরণে রাজলক্ষ্মী প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করল। মহেন্দ্র তার অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য আশাকে হৃদয়ে বাঁধতে চাইল। কিন্তু মহেন্দ্র ও আশার সম্পর্ক আর পূর্বের মতো সচল দেখা গেল না। কারণ আশা মহেন্দ্রকে আর পুরোপুরি মনে স্থান দিতে পারছিল না। রাজলক্ষ্মী বুঝতে পারল যে বউমা মহেন্দ্রকে পূর্বের মতো আর দৃঢ়বন্ধনে বাঁধতে পারছে না। মহেন্দ্র ঠিক করেছিল যে সাতদিন বিনোদিনীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না। রাজলক্ষ্মীর কথা মতো আশা বিহারীকে আসার জন্য অনুরোধ করে। আশার মুখে বিহারীর কথা শুনে মহেন্দ্রের হৃদয়ক্ষতে ঘা পড়ল। মহেন্দ্র ও আশার এরপর তর্কবিতর্কে তাদের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকে গেল। বিহারীর কথা মনে আসতেই মহেন্দ্রকে বিনোদিনীর সম্বন্ধে চিন্তা অধীর করে তুলল। মহেন্দ্রের সন্দেহ হল হয়তো বিহারী পশ্চিম থেকে এসে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। তাই মহেন্দ্রের প্রতিজ্ঞা রক্ষা হল না। রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডেকে বিহারীকে আসার জন্য অনুরোধ করল। মায়ের এইকথা শুনে মহেন্দ্র তখন নিজেকে বিশ্বের পরিত্যাক্ত বলে বোধ করল। মহেন্দ্র বিহারীর খোঁজে তার ঘরে গিয়ে বেয়ারার কাছে জানতে পারে যে বিহারী বালিতে একটি বাগান নিয়ে কাজে ব্যস্ত আছে। মহেন্দ্রের সন্দেহ হয় যে এরমধ্যে বিহারী ও বিনোদিনীর মধ্যে নিশ্চয় সাক্ষাৎ হয়েছে। বিহারীর কোন খবর না পেয়ে বিনোদিনী তার প্রতি সমস্ত আশা ভরসা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সে বুঝতে পারে যে মহেন্দ্রের আনুগত্যে তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের কাছে বিহারীর খবর জানতে চায়। মহেন্দ্র কোন খবর দিতে না পারায় বিনোদিনী তাকে প্রবল ভর্ৎসনা করে। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে বলে – “বন্ধুর ঠিকানা যদি বাহির করিতে না পার, তবে প্রেমের কথা আমার কাছে উচ্চারণ করিয়ো না। বিহারী – ঠাকুরপোর সঙ্গে তুমি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছ, তোমাকে কে বিশ্বাস করিতে পারে।”২৫ বিনোদিনীর ভর্ৎসনাতে মহেন্দ্র নিজেকে অপমান বোধ করে প্রবল গর্জে উঠে।

মহেন্দ্র তার সঙ্গে বিনোদিনীকে বাইরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। বিনোদিনী তাতে রাজী হল এই শর্তে কোন জায়গায় সে দুদিনের বেশি থাকবে না, শুধুমাত্র ঘুরে বেড়াবে। এদিকে মহেন্দ্র বিহারীকে সঙ্গে নিয়ে যাবার সংকল্প নিয়ে বাড়ী থেকে বেরোলেও তা ভুলে যায়। কোচম্যানের কাছে সমস্ত সংবাদ পেয়ে আশা ও রাজলক্ষ্মীর মন বিচলিত হয়ে পড়ে। রাজলক্ষ্মী অভিমানে ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমে চলে গেল। অন্নপূর্ণা কাশী থেকে বাড়ী ফিরে বিহারীকে নিজে গিয়ে বালি থেকে নিয়ে এল। বিহারীর প্রতি আশার যে অভিমান ছিল তা ক্রমেই কমে যেতে লাগল। মহেন্দ্রকে ছাড়া বিরহিণী আশাকে দেখে বিহারীর মন আকুল হয়ে উঠে। পশ্চিমে গিয়ে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়ে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। বিনোদিনী বারে বারে মহেন্দ্রকে বুঝিয়ে দেয় সে তাকে ভালোবাসে না। বিনোদিনীর মুখে বিহারীর কথা শুনে মহেন্দ্র রেগে যায়। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে তাই অবিচল মুখে বলে – “তোমার ভালোবাসার চেয়ে তোমার ছুরি আমার হৃদয়ে সহজে প্রবেশ করিবে।”২৬ বিহারীর প্রতি বিনোদিনী প্রবল ভালোবাসা প্রকাশ করতেই বলতে পারে – “কিন্তু যতদিন বিহারীর আশা আছে, ততদিন আমি মরিতে পারিব না।”২৭ বিনোদিনীর কাছে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে মহেন্দ্র স্থির করল সে বাড়ী ফিরে যাবে। বিনোদিনীর গৃহে হঠাৎ বিহারীর আবির্ভাব দেখা গেল। বিনোদিনী বিহারীকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু বিহারী তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। বিহারী বিনোদিনীকে অপবিত্র বলে বোধ করতে থাকে। বিনোদিনী তাকে জানায় যে, সে অপবিত্র নয়। সে কেবলমাত্র তার পথ চেয়েই বসে আছে। বিহারীর কাছে বিনোদিনী সমস্ত সংবাদ পেয়ে মহেন্দ্রের সমস্ত চাতুরী বুঝতে পারল। বিনোদিনীকে বিহারী বিশ্বাস করলে বিনোদিনী খুশিতে ভরে ওঠে। বিহারীর অবর্তমানে বিনোদিনী তার সমস্ত ঘটনা সে বলে।

বিনোদিনীর কাছে বিহারীকে দেখে মহেন্দ্র গর্জে উঠল। হিংসায় সে জ্বলে পুড়ে যেতে লাগল। মহেন্দ্র, বিহারী ও বিনোদিনীকে প্রবলভাবে ভর্ৎসনা করতে থাকে। বিহারী সেই সময় মহেন্দ্রকে জানায় সে বিনোদিনীকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক। বিহারীর এই কথা শুনে মহেন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে যায়। বিনোদিনী কিন্তু বিহারীকে এই বিয়ে করতে নিষেধ করে। কারণ সে জানায় যে বিধবাকে বিয়ে করলে সমাজে তাকে লাঞ্ছিত হতে হবে। বিহারী তখন বিনোদিনীকে ভালোবাসার কথা সরাসরি জানায়। বিহারী ও বিনোদিনীর মধ্যে মনের বন্ধন অটুট রইল। মহেন্দ্র বাড়ী ফিরে গেলেও বাড়ীতে তার কর্তৃত্ব পূর্বের মতো দেখা গেল না। মহেন্দ্র দেখে যে আশা এখন বাড়ীর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে। মহেন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকে। তাই সে মায়ের কাছে ক্ষমাভিক্ষা প্রার্থনা করে। মহেন্দ্রের মনে সমস্ত গ্লানি মুছে গিয়ে আবার পূর্বের মতো সব সম্পর্কের দ্বার খুলে গেল। মহেন্দ্র ও বিহারীর বন্ধুত্বের সম্পর্কের বন্ধন আরো দৃঢ় হল। অন্নপূর্ণা আশাকে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে বিনোদিনীকে নিয়ে কাশীতে চলে গেল। পূর্বের মতো আশা ও মহেন্দ্র দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করল। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ ছোটগল্পের অনেক মিল খুঁজে পায়। এই উপন্যাস ও ছোটগল্পটির রচনাকাল প্রায় সমকালীন। তাই এদের মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। নষ্টনীড়-এর ভূপতি, চারুলতা ও অমলের সঙ্গে চোখের বালির মহেন্দ্র, আশা, বিনোদিনী ও বিহারীর মিল খুঁজে পায়। দুইক্ষেত্রেই প্রেমের দুর্বার আকর্ষণকে আমাদের মনকে নাড়া দেয়।

ডঃ সুকুমার সেনের মতে – “সমাজের ও যুগযুগান্তরাগত সংস্কারের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ চোখের বালির বিষয়।”২৮

অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে – “বালবিধবা বিনোদিনীর চিত্তে পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার জাগরণ ও তার মানসিক পরিবর্তনের টানাপোড়েন এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।”২৯

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে – “চোখের বালিকে উপন্যাস সাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তক বলা যাইতে পারে। অতি আধুনিক উপন্যাসে বাস্তবতা যে বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, এখানেই তাহার সূত্রপাত। নৈতিক বিচার অপেক্ষা তথ্যানুসন্ধান ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণই ইহাতে প্রধান লক্ষ্য। ইহাতে যে প্রেম বর্ণিত হইয়াছে তাহা সমাজনীতির দিক হইতে বিগর্হিত – কিন্তু এই প্রেমের বিচারে কোনো নীতিকথার আড়ম্বর নাই, আছে কেবল ইহার ক্রমপরিণতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।”৩০



‘চোখের বালি’ উপন্যাসে মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য জীবনে কলহের মূল কারণ হল বিনোদিনীর আবির্ভাব। বিনোদিনীকে যদি রাজলক্ষ্মী সঙ্গে করে নিয়ে না আসত তবে হয়তো মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের পরিণতি এত দুঃখের হতো না। বিনোদিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে রাজলক্ষ্মী নিজের পুত্রের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে। কিন্তু এখানে রাজলক্ষ্মী একজন নারী হয়ে অপর একজন নারীর মনস্তত্ত্বের কথা ভাবে না। তাই আমরা এই দাম্পত্য কলহের জন্য রাজলক্ষ্মীকেও দায়ী করতে পারি। এছাড়া বিনোদিনীর, আশা ও মহেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনের প্রতি প্রতিহিংসার জন্য তার ক্রমশ দুর্নিবার আকর্ষণও এই কলহের জন্য দায়ী। মহেন্দ্রের প্রধান দূর্বলতা তার মন যথেষ্ট সবল ছিল না। তার মানসিকসত্ত্বা অপরের আশ্রয় না পেলে দাঁড়াতে পারত না। মহেন্দ্রের দুর্বল মনের জন্য সে ক্রমশ বিনোদিনীর প্রতি প্রনয়াসক্ত হয়। তাই তাদের দাম্পত্য কলহের জন্য মহেন্দ্রকেও দায়ী করতে হয়। আশা সহজ সরল হওয়ার জন্য মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর সম্পর্ক তৈরি করতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। সে কখনো ভাবতে পারে না যে বিনোদিনীর জন্য তাদের দাম্পত্য জীবনে কখনো অশান্তি আসতে পারে। তাই সে বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের সম্পর্কে অনুঘটক রূপে কাজ করে। তাই তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য আশাও কম দায়ী নয়। পরিশেষে বলতে পারি যে এই উপন্যাসে মহেন্দ্র ও আশার দাম্পত্য কলহের জন্য কোন একটি চরিত্রকে দায়ী করা যুক্তিসঙ্গত নয়। এই দাম্পত্য কলহের জন্য প্রায় সব চরিত্রই কোন না কোন ভাবে দায়ী।









তথ্যসূত্র


১. রবীন্দ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯, চতুর্থ প্রকাশ জুলাই,২০০৯, পৃষ্ঠা-৪৯৩

২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫

৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫

৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৬

৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৯

৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৩

৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৫

৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৮

৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৮

১০. ঐ পৃষ্ঠা-৫১৯

১১. ঐ পৃষ্ঠা-৫২৭

১২. ঐ পৃষ্ঠা-৫২৯

১৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩০

১৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩৬

১৫. ঐ পৃষ্ঠা-৫৩৬

১৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৪

১৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৪

১৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৭

১৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫৪৮

২০. ঐ পৃষ্ঠা-৫৫৭

২১. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭২

২২. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৪

২৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৫

২৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫৯৩

২৫. ঐ পৃষ্ঠা-৬০৭

২৬. ঐ পৃষ্ঠা-৬২১

২৭. রবীন্দ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),কামিনী প্রকাশনী,কলকাতা-৯,চতুর্থ প্রকাশ জুলাই,২০০৯, পৃষ্ঠা-৬২১

২৮. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড),সুকুমার সেন,আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯, প্রথম আনন্দ সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৩১৮

২৯. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা – ৭৩, পুনর্মুদ্রণ-২০০৫-২০০৬, পৃষ্ঠা-৪৯৯

৩০. বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, শ্রী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা- ৭৩, নতুন পুনর্মুদ্রণ ২০০৮-২০০৯, পৃষ্ঠা-৮৩

Wednesday, July 18, 2018

‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসটিও একটি সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসটি গভীর রসাত্মক ও পরিণাম অত্যন্ত বিষাদময়। উপন্যাসের পরিণাম বড়ই ট্রাজেডিপূর্ণ। এই উপন্যাসটি গার্হস্থ্য উপন্যাস মনে হলেও ইহা আসলে ক্রাইম উপন্যাস তবে নীতিগর্ভ। উপন্যাসের মুল বিষয় হল এক ধনবান ব্যাক্তির সুখী দাম্পত্য জীবন পরস্ত্রীর প্রতি কামজ মোহে কিভাবে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে পারে। উপন্যাসের শুরুতে দেখি জমিদার গোবিন্দলাল স্ত্রী ভ্রমরকে নিয়ে সুখেই দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। ভ্রমর বালিকা হওয়ায় সে অনেক সহজ সরল। তাই তাদের দাম্পত্যের মধ্যে কোন অশান্তি ছিল না। কিন্তু গোবিন্দলালের জীবনে হঠাৎ রোহিণীর উপস্থিতি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রোহিণী হল এক বিধবা কপটচারী নারী। সে পুরুষ মানুষকে কি ভাবে বশ করতে হয় তা খুব ভালো করে জানে। প্রথমে সে হরলালকে অন্ধমোহে বাঁধতে চাইলেও কিন্তু তাতে অসমর্থ হয়। এতেই তার প্রতিহিংসা অনেকখানি বেড়ে যায়। রোহিণী একদিন গোবিন্দলালের বারুণী পুকুরে জল আনতে যায়। রোহিণী তখন কুসুমিত কুঞ্জবনে ছায়াতলে গোবিন্দলালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। রোহিণী তখন ছলনা করে পুকুরের ঘাটে বসে কাঁদতে লাগল। গোবিন্দলাল পুস্পদ্যানের লতার অন্তরাল থেকে দেখতেছিলেন যে রোহিণী পুস্করিনীর ঘাটের রানায় বসে একাকী কাঁদছে। সন্ধ্যা হওয়া সত্ত্বেও রোহিণী যেহেতু কাঁদছিলেন তাই গোবিন্দলাল তখন রোহিণীর কাছে গেল এবং কান্নার কারন জিজ্ঞাসা করল। রোহিণী কিন্তু কোন উত্তর দিল না। গোবিন্দলাল রোহিণীর দুঃখের কারন জেনে তার উপকার করার কথা বললেও রোহিণী নীরব থাকে। গোবিন্দলাল হল পরোপকারী এবং সহানুভূতিশীল তাই রোহিণীকে বলে গেলেন – “তোমার যদি কোন বিষয়ে কষ্ট থাকে, তবে আজি হউক, কালি হউক, আমাকে জানাইও। নিজে না বলিতে পার, তবে আমাদের বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগের দ্বারায় জানাইও।”২২ এই কথা শুনে রোহিণী জানায় যে আজ নয় অন্য একদিন বলব। সেইদিন তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। গোবিন্দলাল তাতে স্বীকৃত হয়ে বাড়ী গেলেন।

সে রাত্রে রোহিণীর মনের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে ঘুম হল না। এর পর প্রতিদিনই রোহিণী কলসি কক্ষে নিয়ে বারুণী পুকুরে জল আনতে যায়। প্রতিদিনই পুস্পকানন মধ্যে গোবিন্দলালকে সে লক্ষ্য করে। এই ভাবে দেখা যায় গোবিন্দলালের মুখ রোহিণীর হৃদয়পটে দিনদিন গাঢ়তর বর্ণে অঙ্কিত হতে লাগল। ফলে রোহিণী সহসা গোবিন্দলালের প্রতি মনে মনে গোপনে প্রনয়াসক্ত হল। এই প্রনয়াসক্তই উপন্যাসের পরিণামের সুচনা। রোহিণী অতি বুদ্ধিমতী তাই তার মনের কথা অতি যত্নে গোপনে রাখল। কিন্তু আগুনের ন্যায় ইহা তার চিত্তকে দগ্ধ করতে লাগল। এতে রোহিণীর জীবনভার বহন করা দুঃসাধ্য হল। তখন রোহিণীর নিজেকে পৃথিবীর মধ্যে অসহ্য লাগল। রাত্রি দিন সে নিজের মৃত্যু কামনা করতে লাগল। রোহিণী তখন পৃথিবীর সুখ দুঃখ সম্পর্কে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পারে। রোহিণী গোবিন্দলালের প্রতি দূর্বলতা বশতঃ আসল উইল যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মন ছটফট করতে লাগল। কিন্তু তার উপযুক্ত উপায় খুঁজে পেল না। অনেক ভেবে চিন্তে এক উপায় বের করল যে উপায়ে আসল উইল চুরি করেছে সেই উপায়েই জাল উইল চুরি করে আসল উইল যথাস্থানে রেখে দেবে। জাল উইল চুরি করতে গিয়ে রোহিণী কৃষ্ণকান্তের কাছে ধরা পড়ে যায়। কৃষ্ণকান্ত রায় তাকে চুরির দায়ে বন্দী করে। এর পর রোহিণীকে এখানে আসার কারন জিজ্ঞাসা করে। রোহিণী সত্য কথা বললেও কৃষ্ণকান্ত রায় তা বিশ্বাস করে না। তাই দণ্ড স্বরূপ তাকে সে রাত্রে বন্দী করল।

গোবিন্দলাল তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসত, তাই তাকে সে আদর করে ভোমরা বা ভ্রমর বলে ডাকত। ভ্রমরও তার স্বামীকে খুব ভালোবাসত। তাই তাদের দাম্পত্য জীবন একপ্রকার সুখের ছিল। ভ্রমরের চাকরানী সম্প্রদায়েও বিশেষ আদর ছিল। তাই তারা তাকে মান্য করত। তার কারণ ভ্রমর একে ছেলে মানুষ তারপর ভ্রমর নিজে হাসিতে যত পটু, শাসনে তত পটু ছিলেন না। চাকরানীদের কাছেই ভ্রমর শুনতে পায় যে কর্তা মহাশয়ের শয়ন কক্ষে চুরি করতে এসে রোহিণী ধরা পড়ে কাছারির গারদে বন্দী আছে। তৎক্ষণাৎ ভ্রমর এই সংবাদ গোবিন্দলালকে জানায়। গোবিন্দলাল রোহিণীকে খুব বেশি বিশ্বাস করত তাই রোহিণীর চুরির খবর সে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। এমনকি ভ্রমরও রোহিণীকে নিরপরাধী বলে চিহ্নিত করল। আসলে ভ্রমর কোনকিছু নিজে মতামত দিত না, স্বামীর মতামতকেই সে নিজের মতামত হিসেবে গুরুত্ব দিত। রোহিণীকে গোবিন্দলালের বিশ্বাসের কারন হল রোহিণীর প্রতি সে মনে মনে কামজ মোহে অন্ধ ছিল। এই কামজ মোহেই তার জীবনের পরিণতি আস্তে আস্তে ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল। রোহিণী এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে গোবিন্দলালের মনে একটা শান্ত নীড় রচনা করতে থাকে। রোহিণীর প্রতি দূর্বলতা বশতঃই গোবিন্দলাল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য কৃষ্ণকান্তের কাছে ছুটে যায়।

গোবিন্দলাল সেখানে গিয়ে কৃষ্ণকান্তের কাছে সমস্ত ঘটনা জানতে চায়। গোবিন্দলালের কণ্ঠস্বর শুনে রোহিণী অবগুণ্ঠন ঈষৎ মুক্ত করে গোবিন্দলালের প্রতি ক্ষণিক কটাক্ষ করল। তখন গোবিন্দলাল তা দেখে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। গোবিন্দলাল রোহিণীর কটাক্ষের কারন খোঁজার চেষ্টা করল। শেষে গোবিন্দলাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে সেই কটাক্ষের অর্থ হল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আবেদন। গোবিন্দলাল মনে মনে রোহিণীর মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন। গোবিন্দলাল রোহিণীর সমস্ত বৃত্তান্ত জানার জন্য যখন পুনরাবৃত্তি করে তখন কৃষ্ণকান্ত মনে মনে গোবিন্দলালের আসল উদ্দেশ্য কিছু বুঝতে পেরেছিল। তাই সে মনে মনে বলে – “হয়েছে! ছেলেটা বুঝি মাগীর চাঁদপানা মুখখানা দেখে ভুলে গেল।”২৩ রোহিণীর সমস্ত কৃতকর্ম কৃষ্ণকান্ত গোবিন্দলালকে জানায়। কৃষ্ণকান্ত জানায় রোহিণী আসল উইল চুরি করতে এসে ধরা পড়ে গেলে তখন জাল উইল ছিঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু রোহিণী একথা স্বীকার করে না। গোবিন্দলাল তখন আসল খবর জানার জন্য রোহিণীকে বারবার জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু রোহিণী কোন কথা বলতে রাজী হয়নি। রোহিণীর প্রতি গোবিন্দলালের চিত্ত এতই আকৃষ্ট হয়েছিল যে মায়াবশতঃ সে রোহিণীকে এক ঘণ্টার জন্য জামিনে ছাড়িয়ে নিজ গৃহে নিয়ে যায়। এই ঘটনা দেখে কৃষ্ণকান্ত বাবুর পূর্বের অভিমত সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। তাই সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাড়ীতে রোহিণীকে দেখে ভ্রমর স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে রোহিণীর আগমনের কারন। ভ্রমরের এই জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারি যে রোহিণীকে বাড়ীতে দেখে ভ্রমরের মনে সন্দেহের ডানা বাঁধে। গোবিন্দলাল ভ্রমরকে তাই বলে যে তোমার যদি বিশ্বাস না হয় তবে তুমি আড়াল থেকে আমাদের কথা শুনে নিও। গোবিন্দলালের এই কথা শুনে ভ্রমর লজ্জায় সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ভ্রমরের এই সিন্ধান্তটাই সবচেয়ে ভুল হয়ে যায়। যা ভবিষ্যতে তার জীবনকে অশান্তির দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। সেই সুযোগে রোহিণী গোবিন্দলালের মনে জাল বিস্তার করতে থাকে। এতেই ঘনিয়ে আসে ভ্রমর ও গোবিন্দলালের দাম্পত্য জীবনে ঘন কুয়াশার আবির্ভাব। কিন্তু এই কালো ছায়ার কথা তারা দুজনেই কেউ আঁচ করতে পারেনি।

গোবিন্দলালের সাথে কথোপকথনে রোহিণী গোবিন্দলালের সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে সেই কাজে সে সাময়িক সফল হয়েছে। তার প্রমান পাই যখন গোবিন্দলাল রোহিণীকে বলতে পারে – “আমি অবিশ্বাসযোগ্য কথাতেও কখনও কখনও বিশ্বাস করি।”২৪ রোহিণী তখন মনে মনে বলে আমি তো মরতে বসেছি কিন্তু তোমায় একবার পরীক্ষা করে মরিব। গোবিন্দলাল রোহিণীকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে যে প্রাণপণে চেষ্টা করবে সেটা রোহিণীর বুঝতে বাকি থাকল না । সেই মুহূর্তেই রোহিণী বুঝতে পারল যে তার প্রতি গোবিন্দলালের ভিতরে ভিতরে একটা দূর্বলতার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিণীর কথাতেও গোবিন্দলাল বুঝতে পারে যে তার প্রতিও রোহিণী সমান ভাবে প্রনয়াসক্ত। গোবিন্দলাল তখন বুঝলেন - “যে মন্ত্রে ভ্রমর মুগ্ধ, এই ভুজঙ্গীও সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়াছে।”২৫ গোবিন্দলাল সমস্ত ঘটনা বুঝে অনুমান করে যে তাদের সংসারে ভবিষ্যতে অশান্তি হতে পারে। তাই তিনি রোহিণীকে দেশত্যাগ করে যেতে অনুমতি দেন। কারন যদি গোবিন্দলালের সঙ্গে রোহিণীর দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয় তবেই এই প্রণয়ের সম্মন্ধ ছিন্ন হতে পারে। তাই তো গোবিন্দলাল রোহিণীকে জানায় যে তার কলকাতায় থাকার সমস্ত ব্যবস্থা সে করে দেবে। এইরূপে কলঙ্ক বন্ধনে রোহিণীর প্রথম প্রণয় সম্ভাষণ হল।

রোহিণীর মুক্তির কথা বলতে এসে গোবিন্দলাল জ্যেষ্ঠ তাতের কাছে লজ্জায় বলতে পারল না। অবশেষে রোহিণী গোবিন্দলালের অনুগ্রহে কৃষ্ণকান্তের হাত থেকে মুক্তি পেল। গোবিন্দলাল রোহিণীর কলকাতায় যাওয়ার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করতে লাগল। হঠাৎ রোহিণী নিজের গ্রাম থেকে গোবিন্দলালকে ছেড়ে কলকাতায় যেতে রাজী হল না। এতেই যত সর্বনাশ হল গোবিন্দলালের দাম্পত্য জীবনে। গোবিন্দলালের প্রতি প্রণয়ে আবদ্ধ হয়ে রোহিণী লজ্জাহীন হয়ে পড়ে। তাই তো রোহিণী বলতে পারে- “আমি যাব না। কলিকাতায় যাব না। কলিকাতায় যাব না-কোথাও যাব না। যাই ত যমের বাড়ী যাব। আর কোথাও না।”২৬ এই সিন্ধান্তে রোহিণী স্থির থেকে দ্বার খুলে গোবিন্দলালের কাছে চলে গেল। গোবিন্দলালকেই সে জীবনের সুখ ও শান্তি হিসাবে মনে করতে লাগল। তাই তো গোবিন্দলালের কাছে রোহিণী কলকাতা যাওয়ার কথা অস্বীকার করে। গোবিন্দলাল তাকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করে, কিন্তু রোহিণী তাতে কোন কর্ণপাতই করে নি। আর এই জন্যই গবিন্দলালের চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ভ্রমর এসে গোবিন্দলালকে তার চিন্তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে গোবিন্দলাল জানায় যে এই মুহূর্তে সে একমাত্র রোহিণীর কথা চিন্তা করছে। গোবিন্দলালের এই কথা ভ্রমর কিছুতেই বিশ্বাস করে না। কারণ সে যুক্তি দেখায় যে, যাহাকে ভালোবাসে সে তাহাকে ভাবে। ভ্রমরের এই কথার সমর্থনে গোবিন্দলাল জানায় সে রোহিণীকে ভালোবাসে। গোবিন্দলালের এই কথাকে ভ্রমর রসিকতা বলে মনে করে তাই কোন গুরুত্ব দিতে চায় নি। ভ্রমর যদি এই সময় গোবিন্দলালের কথাটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবনের যে ঘন মেঘের আবির্ভাব হয়েছিল তাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা সম্ভব হত। ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনের পরিনাম এতটা দুর্বিসহ হয়ে উঠত না। গোবিন্দলাল সেই সময় ছলনা বশতঃ ভ্রমরকে কাতর কণ্ঠে জানায় “মিছে কথাই ভোমরা। আমি রোহিণীকে ভালবাসি না। রোহিণী আমায় ভালবাসে।”২৭ স্বামীর মুখ থেকে এই কথা শুনে ভ্রমর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে। তাই ভ্রমর রোহিণীর প্রতি বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা বলে তার অমঙ্গল কামনা করে। এমনকি ভ্রমর দাসী পাঠিয়ে তাকে বারুণী পুকুরে ডুবে মরার পরামর্শ দেয়। ভ্রমরের এই প্রস্তাবে রোহিণী রাজী হয়েছিল। এই ঘটনা জেনে গোবিন্দলাল ভ্রমরের প্রতি রেগে গর্জে উঠে। ভ্রমর তখন গোবিন্দলালকে বলে –“ভাবিও না। সে মরিবে না। যে তোমায় দেখিয়া মজিয়াছে- সে কি মরিতে পারে?”২৮

প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে গোবিন্দলাল অভ্যাসবশতঃ দিনের শেষে বারুণী তীরবর্তী পুস্পদ্যানে গিয়ে বিচরণ করতে লাগল। তিনি সমস্ত ফুলের গাছের সুগন্ধে আমোদিত হয়ে গেলেন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করলেন যে রোহিণী বারুণীতে জল নিতে আসছে। অনেকক্ষণ পর তিনি আবার লক্ষ্য করে দেখলেন যে ঘাটে কোন মানুষ নেই কেবল একটি কলসি জলে ভাসছে। তখন গোবিন্দলাল ঘাটে গিয়ে দেখলেন যে রোহিণী জলে ডুবে আছে। গোবিন্দলাল তখন জলে নেমে রোহিণীকে উদ্ধার করলেন। গোবিন্দলাল তাকে উদ্যানগৃহে নিয়ে গিয়ে সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তুললেন। রোহিণীকে ঔষধ দিলে তার শরীরে বল সঞ্চার হয়। রোহিণী অচৈতন্যবশতঃ গোবিন্দলালের প্রতি অনুরাগ করে তাকে উদ্ধার করে বাঁচানোর জন্য। রোহিণী অত্যন্ত বিদ্রুপাত্মক ভাবে জানায় তার কি মরারও অধিকার নেই। গোবিন্দলালকে রোহিণী জানায় সে যন্ত্রণার জন্য মরতে চায়। তার যন্ত্রণার কারণ গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করলে রোহিণী জানায়- “রাত্রিদিন দারুণ তৃষা,হৃদয় পুড়িতেছে-সম্মুখেই শীতল জল,কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না। আশাও নাই।”২৯ গোবিন্দলালের বাড়ী ফিরতে অনেক রাত্রি হয়ে গেলে ভ্রমর এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। এতেই বোঝা যায় যে ভ্রমর কিন্তু গোবিন্দলালকে সন্দেহ করে। সেদিন গোবিন্দলালকে দেখে সে কাতর হয়ে পড়ে। তাই ভ্রমর স্বামীর কাছে গভীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ভ্রমরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পরে বলবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়। কারণ হিসাবে জানায় যে ভ্রমর এখন বালিকা তাই দুই বৎসর পরে তাকে জানাবে। ভ্রমরের মন কিন্তু শান্ত হতে পারল না, দোলাচল বৃত্তিতে ভরে উঠল। সে তার ভবিষ্যতে অশনি সংকেত অনুমান করে কাঁদতে লাগল। তার বুকের ভিতর হতে অশনি সংকেত কিছুতেই নামল না।

গোবিন্দলাল বিষয় সম্পত্তির কাজে মহালে চলে গেলেন। তার যাবার কারণ হল রোহিণীকে মন থেকে মুছে ফেলা। কারণ তখন সে রোহিণীর কামজ মোহে আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই সে ভেবেছিল যে রোহিণীর থেকে দূরে চলে গেলেই তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে। যা তার জীবনের পক্ষে মঙ্গলদায়ক। ভ্রমর তার সাথে যেতে চাইলে সে তাকে নিয়ে যেতে চায়নি। একাকী ভ্রমর কোন কাজে মন দিতে পারল না। স্বামী বিনা ভ্রমর এমন দুঃখ পেল যে সে আহার, নিদ্রা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু ত্যাগ করল। দিনে দিনে ভ্রমর অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও কোন ঔষধ সে খেল না। ক্ষীরোদ চাকরানী তখন তাকে বলল তুমি যার জন্য এমন কিছু করছ সে চোখ বুজে রোহিণীকে ধ্যান করছে। এই কথা শুনে ভ্রমর রেগে যায় এবং ক্ষীরোদকে চড় মারে। ভ্রমর একবার মনে মনে ভাবে যে – “তুমি কি সেদিন এই কথা আমার কাছে গোপন করিয়াছিলে।”৩০ স্বামীর প্রতি ভ্রমরের যদিও কোনও অবিশ্বাস ছিল না। ভ্রমর মনে মনে ভাবে যে তার স্বামী যদি কোনদিন অবিশ্বাসী হয় তবে সেদিন সে জীবন ত্যাগ করবে। তারপর দেখা যায় পাড়ার সকলের মুখেই শোনা যায় গোবিন্দলাল ও রোহিণীর মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের কথা। এছাড়া সুরধুনীর কাছে ভ্রমর জানতে পারে যে গোবিন্দলাল সাত হাজার টাকার গহনা দিয়েছে। এরপর পাড়ার প্রায় সকলেই এসে বিরহকাতরা বালিকা ভ্রমরকে জানায় যে - তোমার স্বামী রোহিণীর প্রণয়াসক্ত। নানালোকের মুখে একই খবর শুনে ভ্রমর আর সহ্য করতে পারে না। তখন সে স্থির করে যে সে আত্মহত্যা করে প্রান বিসর্জন দিবে।

ভ্রমর ও রোহিণীর মনের জ্বালা এক হল। কথা যখন রটিল তখন রোহিণীও শুনিল যে গোবিন্দলাল তার গোলাম এবং সে তাকে সাত হাজার টাকার অলংকার দিয়েছে। এইসব কথা শুনে রোহিণী স্থির করে ভ্রমরই এইসব কথা রটনা করেছে। ভ্রমরকে সন্দেহ করে ভ্রমরের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠে রোহিণী। রোহিণী তখন একটি বেনারসী শাড়ি ও কিছু গয়না প্রতিবেশির কাছে নিয়ে ভ্রমরের কাছে গেল। রোহিণী এইসব দেখে জানায় যে গোবিন্দলাল তাকে এগুলি কিনে দিয়েছে। ভ্রমর তখন এইসব দেখে বিষের জ্বালায় জ্বলে উঠে। এইখানেই তাদের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে ব্যবধানের পরিধি বাড়তে থাকে। রোহিণী ভ্রমরকে একথাও জানায় যে গোবিন্দলাল তাকে তিন হাজার টাকা ও একটি শাড়ি দিয়েছে তখন ভ্রমরের মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না, সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে। এইসব দেখেই ভ্রমরের স্বামীর প্রতি কোন বিশ্বাস আর থাকে না। ভ্রমর তখন লাথি মেরে অলংকারগুলি ছড়িয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে কার্য সিদ্ধ করে রোহিণী সেখান থেকে প্রস্থান করে। এই ঘটনার পরেই ভ্রমর ও গোবিন্দলালের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনের সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে আরম্ভ করে। কারণ ভ্রমর পূর্বের মতো স্বামীর উপর আর বিশ্বাস রাখতে পারে না। ভ্রমর অবিশ্বাস বশতঃই সেই দিন রাত্রে স্বামীকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে চিঠি লিখতে বসল। ভ্রমর যে তার স্বামীকে আর বিশ্বাস করতে পারে না তার প্রমান পাই তার চিঠিতে সে স্বামীকে জানায় - “এখন তোমার উপর আমার ভক্তি নাই,বিশ্বাসও নাই। তোমার দর্শনে আমার আর সুখ নাই। তুমি যখন বাড়ী আসিবে,আমাকে অনুগ্রহ করিয়া খবর লিখিও - আমি কাঁদিয়া কাটিয়া যেমন করিয়া পারি, পিত্রালয়ে যাইব।”৩১ গোবিন্দলাল এই পত্র পেয়ে মাথায় বজ্রাঘাত সম অনুভব করলেন। ভ্রমর যে এই চিঠি তাকে লিখতে পারে প্রথমে তা তিনি বিশ্বাস করতেই পারছিল না। কিন্তু পরক্ষণেই ব্রহ্মানন্দের একখানি পত্র গোবিন্দলাল পেল। সেই পত্র পাঠ করে জানতে পারল যে গোবিন্দলাল ও রোহিণীর নিয়ে যে অবৈধ সম্পর্কের কথা প্রচার হয়েছে তা ভ্রমরের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। এইসব কথা শুনে গোবিন্দলাল কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে হঠাৎ বাড়ীতে চলে এলেন।

ভ্রমর গোবিন্দলালকে বিদেশে যেতে দিতেই তাদের মধ্যে একটা অবিশ্বাস ও মনোমালিন্য তৈরি হয়। যদি তারা একসঙ্গে থাকত তাহলে হয়তো এতটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হত না। ভ্রমরের ও গোবিন্দলালের এতটা ভ্রম ঘটত না। এই ভ্রমের ফলেই তাদের দাম্পত্য জীবনে সর্বনাশের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। গোবিন্দলালের বাড়ী আসার খবর পেয়েই বিরহিণী ভ্রমর তাকে না জনিয়েই কৌশলে বাপের বাড়ী চলে যায়। গোবিন্দলাল বাড়ী এসে ভ্রমরকে দেখতে না পেয়ে শুনলেন যে আজই ভ্রমর পিত্রালয়ে যাত্রা করেছে। এই খবর পেয়ে গোবিন্দলাল মনে মনে খুব আঘাত পেলেন ও অভিমানে ফেটে পড়লেন। তখন সে মনে মনে ভাবলেন - “এত অবিশ্বাস! না বুঝিয়া,না জিজ্ঞাসা করিয়া আমাকে ত্যাগ করিয়া গেল! আমি আর সে ভ্রমরের মুখ দেখিব না। যাহার ভ্রমর নাই, সে কি প্রাণধারণ করিতে পারে না?”৩২ ভ্রমরের প্রতি একটা বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল গোবিন্দলালের। এই ঘটনার পর সেই সব কিছু মন থেকে মুছে গেল। তাইতো অভিমানবশতঃ সে মাতাকে, ভ্রমরকে আনিতে নিষেধ করলেন। এখানেই দেখা যায় ভ্রমর ও গোবিন্দলাল দুজনের মধ্যে তাদের ভুল বোঝাবুঝিতে দাম্পত্য জীবনের ছেদ ঘটে। এই ছেদের জন্যই তাদের দাম্পত্য জীবনের স্থায়ী সর্বনাশ ঘটে। এই সময়টাকে আমরা তাদের দাম্পত্য কলহের টারনিং পয়েন্ট বলতে পারি। এই পরিস্থিতি যদি না ঘটত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবন এতটা অসুখী হয়ে উঠত না। গোবিন্দলাল তার প্রিয়তমা স্ত্রী ভ্রমরের সঙ্গে কলহ মনে করে দুঃখে বেদনায় কেঁদে ফেলল। কিন্তু পরক্ষণেই ভ্রমরের প্রতি তার রাগ হল। ভ্রমরকে ভুলবার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও গোবিন্দলাল কিছুতেই তাকে ভুলতে পারলেন না। তখন দুর্বুদ্ধি বশতঃ গোবিন্দলাল মনে করলেন যে ভ্রমরকে ভুলবার একমাত্র উপায় রোহিণীর চিন্তা। গোবিন্দলাল সত্যই রোহিণীর চিন্তা করতে লাগলেন। এতেই গোবিন্দলালের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনল। তিনি আপন ইচ্ছায় আপনি অনিষ্ট সাধনে প্রবৃত্ত হলেন।

ভ্রমরের অনুপস্থিতিতে, রোহিণীর সাথে গোবিন্দলালের মেলামেশা অনেক বেড়ে গেল। রোহিণীকে বাগানের বৈঠকখানায় পর্যন্ত গোবিন্দলাল নিয়ে গেল। তাদের অনেক মেলামেশাতে রোহিণী মনে মনে অনুমান করল যে গোবিন্দলাল তার রূপে মুগ্ধ এবং তার দ্বারা আকৃষ্ট। এইভাবে গোবিন্দলালের অধঃপতন খুব দ্রুত হতে লাগল। তার এইসব খবর কৃষ্ণকান্তের কানে গেল এবং তিনি শুনে দুঃখিত হলেন। কৃষ্ণকান্ত গোবিন্দলালের প্রতি ক্ষোভে তার নাম বাদ দিয়ে ভ্রমরের নামে নতুন উইল তৈরি করল। কৃষ্ণকান্তের এরপর মৃত্যু হইল। মৃত্যুতে ভ্রমর বাপের বাড়ী থেকে এলেও গোবিন্দলালের সঙ্গে তেমন কিছু কথা হল না। ভ্রমরের নামে অর্ধেক সম্পত্তি হয়ে যাওয়াতে গোবিন্দলালের খুব রাগ হল এবং এতেও তাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা দুরত্ব তৈরি করল। যদিও ভ্রমর এই সম্পত্তি তাকে লিখে দিতে চাইলেও গোবিন্দলাল তা নিতে অস্বীকার করে। ভ্রমর গোবিন্দলালের কাছে তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলেও গোবিন্দলাল তাকে ক্ষমা করতে পারে নি। এর দ্বারাই তাদের দাম্পত্য কলহ ক্রমশ বেড়ে যায়। গোবিন্দলাল মনে মনে ভাবতে থাকে - “এ কালো! রোহিণী কত সুন্দর! এর গুণ আছে, তার রূপ আছে। এতকাল গুণের সেবা করিয়াছি, এখন কিছুদিন রূপের সেবা করিব।– আমার এ অসার, এ আশাশূন্য,প্রয়োজনশূন্য জীবন ইচ্ছামত কাটাইব। মাটির ভাণ্ড যেদিন ইচ্ছা সেইদিন ভাঙিয়া ফেলিব।”৩৩ ভ্রমর তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও সে দৃঢ়কণ্ঠে ভ্রমরকে জানায় যে তাকে সে পরিত্যাগ করবে। এতেই বোঝা যায় যে ভ্রমরের প্রতি কোন ভালোবাসায় আকৃষ্ট করতে পারেনি গোবিন্দলালকে। ভ্রমরের প্রতি বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট না হয়ে তাই গোবিন্দলাল তাকে পরিত্যাগ করে যেতে পারে। গোবিন্দলাল তার মাকে কাশী পৌঁছে দিতে গিয়া নিজেও নিরুদ্দেশ হয়। অনেকদিন পর্যন্ত গোবিন্দলালের কোন সংবাদ পাওয়া যায় না।

প্রথম খণ্ডকে যদি নাটকীয় পরিভাষায় ক্রিয়ার ঊর্ধ্বগমন বলা যায় তাহলে দ্বিতীয় খণ্ডকে ক্রিয়ার অবরোহণ পর্ব নামে অভিহিত করা যেতে পারে। গোবিন্দলালের গৃহত্যাগ উভয় পর্যায়ের মাঝে শীর্ষবিন্দু হিসেবে অবস্থান করেছে। অনেকদিন পর কাশী থেকে গোবিন্দলালের পৌঁছানোর খবর এলো। কিন্তু ভ্রমর ও গোবিন্দলালের মধ্যে কোন পত্র বিনিময় হল না। গোবিন্দলালের গৃহের আমলাদের সাথে তার যোগাযোগ ঠিকই ছিল। তাই তার খবর আমলারা সবই পেত। কিছুদিন পর নাটকীয় ভাবে রোহিণী পীড়া থেকে আরোগ্যলাভের পর তারকেশ্বর যাওয়ার নাম করে অন্তর্ধান করলেন। ছয়মাস কেটে গেলেও ভ্রমর গোবিন্দলালের কোন খবর পেল না। এদিকে রোহিণীও নিরুদ্দেশ হয়ে বাড়ীতে আর ফিরল না। রোহিণীর অন্তর্ধানে ভ্রমরের সন্দেহ হল। সে বুঝতে পারল যে রোহিণী গোবিন্দলালের কাছে চলে গেছে। এই কথা মনে করে ভ্রমর প্রবল উৎকণ্ঠিত হয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ মন নিয়ে পিত্রালয়ে চলে গেল। কিন্তু পিত্রালয়েও ভ্রমর স্থির হয়ে থাকতে পারল না তাই সে আবার চলে এলো। ভ্রমর এরপর শাশুড়িকে পত্র লিখে জানতে পারল যে তিনিও ছেলের খবর জানেন না। গোবিন্দলালের চিন্তায় একবছর পর ভ্রমর অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থ ভ্রমরকে তার বাবা দেখতে এলেন। বাবা এসে তাকে রাজগ্রামে নিয়ে যেতে চাইলেন। ভ্রমরের বাবা বাড়ীর দেওয়ানের কাছে গোবিন্দলালের খবর জানতে চাইলে সে জানায় যে গোবিন্দলাল এখন অজ্ঞাতবাসে আছেন। গোবিন্দলালের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে মাধবীনাথ বাবু হরিদ্রা গ্রামের পোস্টঅফিসে উপস্থিত হলেন। মাধবীনাথ বাবু পোস্টমাস্টারকে কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে জানতে পারে যে ব্রহ্মানন্দের নামে মাঝে মাঝে চিঠি আসে। মাধবীনাথ এরপর হুমকি দিয়ে পোস্টমাস্টারের কাছ থেকে সব খবর নিয়ে নেয়। পোস্টমাস্টার ভীত হয়ে সমস্ত গোপন খবর মাধবীনাথকে জানিয়ে দেয়। মাধবীনাথ জানতে পারেন যে প্রসাদপুর থেকে প্রতি মাসে ব্রহ্মানন্দের নামে রেজেস্ট্রি চিঠি আসে। প্রসাদপুর হল যশোর জেলায়। মাধবীনাথ এর পর পুলিসের ভয় দেখিয়ে ব্রহ্মানন্দের কাছে রোহিণী ও গোবিন্দলালের ঠিকানা পায়। ভ্রমর খুব অসুস্থ থাকায় চিকিৎসা চলতে থাকে। মাধবীনাথ ভ্রমরকে নিয়ে রাজগ্রামে ফিরে এলেন। ভ্রমরের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে মাধবীনাথ কলকাতায় গেলেন।

সূর্যমুখীর পিতা মাধবীনাথ তাঁর আত্মীয় নিশাকর দাশকে নিয়ে প্রসাদপুর অভিমুখে যাত্রা করলেন। নিশাকরকে জানালেন তিনি নীলকুঠী কেনার জন্য সেখানে যাচ্ছেন। প্রসাদপুরের পাশেই চিত্রা নদীর এক নির্জন স্থানে একটি নীলকুঠী ছিল। বর্তমানে সেই নীলকুঠির প্রাসাদটি গোবিন্দলাল কিনে নিয়ে রোহিণীকে নিয়ে বিলাসিতা ভাবে জীবন যাপন করছিলেন। এই প্রাসাদে নিয়মিত গানবাজনা চলত বলে গোপন সুত্রে খবর পায় মাধবীনাথ। একদিন গানবাজনা চলতে চলতে হঠাৎ প্রাসাদের মধ্যে নিশাকর প্রবেশ করলে তাদের গানবাজনা অর্ধপথে থেমে যায়। গোবিন্দলাল ও রোহিণী প্রসাদপুরের নীলকুঠির দোতলায় বাস করত। গোবিন্দলাল সচরাচর কোন ব্যাক্তির সাথে দেখা করত না। তেমন যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ হত তবে একতলায় এসে দেখা করত। নিশাকর গোবিন্দলালের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গমন করলে গোবিন্দলালের দুই ভৃত্য সোনা ও রুপার সঙ্গে দেখা হল। নিশাকরকে উভয়েই জানায় যে তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাতের কোন অনুমতি নেই। নিশাকর রূপোকে এক টাকা ঘুষ দিলে রূপো টাকাটা নিয়ে গোবিন্দলালকে আগন্তুকের খবর দিতে গেল। সেই সময় নিশাকর বাগানে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ দোতালায় রোহিণীকে দেখতে পেল। রোহিণীও নিশাকরকে লক্ষ্য করছিল। নিশাকরের রূপে মুগ্ধ হয়ে রোহিণী তার প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে রোহিণীর সঙ্গে নিশাকরের দৃষ্টি বিনিময় কিছু অর্থদ্যোতক হয়। এদিকে রূপো গোবিন্দলালকে আগন্তুকের কথা জানালে সে সাক্ষাতের অক্ষমতা প্রকাশ করে। নিশাকর রুপোর আসতে দেরি দেখে সটান দোতলায় বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে। ঘরে গিয়ে নিশাকর একসঙ্গে গোবিন্দলাল, রোহিণী ও গায়ক গায়িকাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন। নিশাকরকে দেখে গোবিন্দলাল অত্যন্ত রুষ্ট হলেন। কিন্তু তবুও তা প্রকাশ না করেই ভদ্রতার সহিত নিশাকরের আগমনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নিশাকর তখন কৌশলে জানায় যে ভ্রমরের বিষয় সম্পত্তি বিলি হবে শুনে সে হরিদ্রাগ্রামে গিয়েছিল। গিয়ে সে জানতে পারে যে ভ্রমর ঘোষণা করেছে যে গোবিন্দলালের অনুমতি পেলে তবেই সে বিষয় সম্পত্তি বিলি করতে শুরু করবে। এই জন্যই নিশাকর তার কাছে এই অভিমত জানার জন্যই এসেছে। প্রায় দুই বছর পর ভ্রমরের কথা শুনে গোবিন্দলাল অন্যমনস্ক হল। নিশাকর অনুমতি পত্র হিসাবে একটি চিঠি লিখে দিতে বলল। নিশাকরের কথায় গোবিন্দলাল রাজী হল না। ফলে নিশাকর হতাশ হয়েই চলে গেলেন। অন্যমনস্কতা দুর করার জন্য গোবিন্দলাল তার ওস্তাদকে গান গাইতে বলে নিজে তবলা বাজাতে শুরু করল । কিন্তু মানসিক দুশ্চিন্তার জন্য গানের তাল বারবার কেটে যেতে লাগল । গোবিন্দলাল এরপর তবলা ছেড়ে সেতার বাজাতে গিয়েও ব্যর্থ হল । তাই সে নোবেল পড়ার জন্য চেষ্টা করেও পুনরায় ব্যর্থ হল । সব কিছুতেই ব্যর্থ হওয়ার কারণ হল ভ্রমরের নাম শুনে তিনি মনে মনে খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল । ফলে তিনি কোন কিছুতেই মনসংযোগ করতে পারছিল না । তাই বিরক্ত হয়ে গোবিন্দলাল বিশ্রামের জন্য শয়নগৃহে গেল । শয়নগৃহে গিয়ে তিনি সোনাকে জানায় সে এখন ঘুমোবে, তাই তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে । এরপর দ্বার বন্ধ করে তিনি গভীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। গোবিন্দলালের এই কান্নার কারণ আমরা ঠিক বুঝতে পারি না। ভ্রমরের জন্য এই কান্না নাকি তার নিজের দুরবস্থার জন্যই তিনি আকুল হয়ে কেঁদেছেন। তাই এই কান্নার কারণ আমাদের কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়।

গোবিন্দলালের সঙ্গে যখন নিশাকর কথা বলতে আসে ঠিক তখনি রোহিণী পাশের ঘরে গিয়েছিল। সেখান থেকে সে নিশাকরকে লক্ষ্য করছিল। নিশাকরও তা দেখতে পেয়েছিল। নিশাকর একবার দেখেই রোহিণীর মন আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। তাই সে গোবিন্দলালকে ভুলে নিশাকরকে কাছে পেতে চাইছিল। নিশাকরকে এখান থেকে চলে যেতে দেখে রোহিণী রূপোকে পাঁচ টাকা বখশিশ দিয়ে জানায় যে, সে ঐ বাবুটিকে বাগানের মধ্যে অপেক্ষা করতে বলে। একটু একাকী হলেই সে তার সাথে দেখা করবে। নিশাকর নানা কলা কৌশলে একতলায় অপেক্ষা করছিল। রূপো গিয়ে তাকে রোহিণীর কথা বললে এবং একান্তে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে বসালো। নিশাকর তখন এখানে এমন ভাবে অপেক্ষা করতে রাজী হল না। কারণ যে কোন সময় এখানে বাবু এসে যেতে পারে। তাই সে নির্জন জায়গায় যেতে চায়। নিশাকর রূপোকে জানিয়ে দেয় রাত্রে রোহিণী কুঠির নিকটে নদীর বাঁধা ঘাটে এসে তার সঙ্গে যেন দেখা করে আসে। সে ঐ নদীর বাঁধা ঘাটেই রোহিণীর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে। এই কথা শুনে রূপো গিয়ে তৎক্ষণাৎ রোহিণীকে জানালে, রোহিণী প্রথমে সামান্য ইতস্ততঃ বোধ করতে লাগল। অবশেষে নিশাকরের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। রূপো চলে যাবার পর নিশাকর চালাকি করে সোনার সঙ্গে দেখা করে একটি ষড়যন্ত্র করে নেয় যাতে রোহিণী ও গোবিন্দলালের সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। গোবিন্দলাল কার্যসিদ্ধির জন্য সোনাকেও টাকা ঘুষ দেয়। সোনাকে স্থান,কাল, পাত্র সবকিছুই গোবিন্দলাল সোনাকে অগ্রিম জানিয়ে দেয়। গোবিন্দলালকে যেন এই সব তথ্য সব জানিয়ে দেওয়া হয় এই মর্মে তার সাথে নিশাকরের চুক্তি হল। নিশাকরের এই চুক্তিতে সোনা তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেল। কারণ প্রথমত গোবিন্দলাল এই কাজের জন্য তাকে কিছু টাকা ঘুষ দিয়েছিল, দ্বিতীয়ত সেই সময় সোনার সাথে রোহিণীর মনোমালিন্য চলছিল।

নিশাকর রোহিণীর এই সর্বনাশ করতে বাধ্য হল তার দুটি কারণ হল - প্রিয় বন্ধুর কন্যার উপকার ও পাপীর পাপের দণ্ডদান। এমন সময় পূর্ব পরিকল্পনা মতো নিশাকরের নিকট রোহিণী এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু রোহিণীর আসতে একটু দেরি হয়ে যায়। রোহিণী এসে নিশাকরকে জানায় যে, গোবিন্দলালকে ভুলতে না পেরে সে এদেশে তার সাথে এসেছে এবং তাকে ভুলতে না পেরে সে এখানে এইসময় এসেছে। রোহিণীর এই কথা শুনে আমরা বুঝতে পারি নিশাকরের প্রতি রোহিণী ভালোবাসায় আকৃষ্ট হয়ে যায় । নিশাকরের জন্য সে যে প্রান বিসর্জন দিতে পারে তাও সে জানাতে ভোলেনি। ঠিক সেই সময় ওই স্থানে গোবিন্দলাল এসে রোহিণীর সবকথা আড়াল থেকে শুনতে লাগল। এই কথা শুনেই গোবিন্দলাল সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে পিছনদিক থেকে রোহিণীর গলা টিপে ধরল। রোহিণী অনুমান করতে পারল তার যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়ে গেছে। রোহিণী গোবিন্দলালের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য নিশাকরের সাহায্য নিতে গিয়ে দেখল নিশাকর সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। রোহিণী তাই নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়। গোবিন্দলাল তখন রেগে গিয়ে রোহিণীকে ধরে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় । রোহিণীকে নিয়ে গিয়ে ক্ষুব্ধ কম্পিত স্বরে গোবিন্দলাল বলে যে - তার জন্য সে ঐশ্বর্য, সম্পদ, চরিত্র, এমনকি তার প্রানের চেয়ে প্রিয় পত্নী ভ্রমরকে সে ত্যাগ করে চলে এসেছে। কিন্তু তার মর্যাদা রোহিণী আজ আর রাখেনি। রোহিণী গোবিন্দলালের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এই কথা ভেবেই গোবিন্দলালের মাথা গরম হয়ে যায়। তাই সে রোহিণীকে সজোরে পদাঘাত করে। এই পদাঘাত সহ্য করে রোহিণী কাঁদতে থাকে। তখন গোবিন্দলাল রোহিণীকে জিজ্ঞাসা করে যে তার মরবার সাহস আছে কি না? উত্তরে সঙ্গে সঙ্গে রোহিণী জানায় তার মরবার সাহস আছে। রোহিণীর মুখে এই কথা শুনে গোবিন্দলাল সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল বার করল। গোবিন্দলাল যে তাকে হত্যা করতে পারে তা রোহিণী কখনই ভাবতে পারে না। কিন্তু পরে রোহিণী যখন জানতে পারে যে গোবিন্দলাল তাকে হত্যা করতে ইচ্ছুক। তখন রোহিণী গোবিন্দলালের কাছে প্রানভিক্ষা আবেদন করে। গোবিন্দলাল রোহিণীর কার্যকলাপে এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল যে তার আবেদনে কোন কর্ণপাতই করল না। তাই গোবিন্দলাল তৎক্ষণাৎ পিস্তল নিক্ষেপ করে সঙ্গে সঙ্গে রোহিণীকে হত্যা করল। গুলির শব্দ শুনে তার ভৃত্যেরা সব ছুটে এসে দেখল যে রোহিণী মৃত অবস্থায় পড়ে আছে এবং গোবিন্দলাল পলাতক। পরদিন থানা থেকে দারোগা মৃত্যুর তদন্ত করতে এসে মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। হত্যাকারীকে অনেক অনুসন্ধান করেও তারা কোথাও খুঁজে পেল না। প্রসাদপুরে গোবিন্দলালের আসল পরিচয় কেউ জানত না তাই তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে গেল। থানা থেকে তাই তাকে ফেরার বলে ঘোষণা করা হল।

অন্য দিকে দেখা যায় রোগগ্রস্ত হয়েও ভ্রমরের কিন্তু মৃত্যু হয় নি। হরিদ্রা গ্রামে পুলিশ এসে গোবিন্দলালের খোঁজ করে তাকে পাওয়া যায় নি। স্বামীর বিপদের কথা শুনে ভ্রমর তার মঙ্গল কামনা করল। ভ্রমর চাইল গোবিন্দলাল এই সময় হরিদ্রা গ্রামে না এসে কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিক। স্বামীর কথা ভেবেই ভ্রমর বাপের বাড়ী থেকে হরিদ্রা গ্রামে গেল। নানারকম চিন্তায় দিন দিন ভ্রমরের শরীর ক্রমশ ভেঙ্গে যেতে লাগল। মৃত্যুর ঘটনার পঞ্চম বৎসরে ভ্রমরের কাছে খবর এল গোবিন্দলাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তাই তাকে বিচারের জন্য যশোরে নিয়ে আসা হয়েছে। গোবিন্দলাল তার দেওয়ানকে চিঠি লিখে আবেদন জানায় তাকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। দেওয়ানের কাছে ভ্রমর এই কথা শুনে তার পিতাকে হরিদ্রা গ্রামে আসার জন্য অনুরোধ জানায়। স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার টানে ভ্রমর পিতার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য পাঠায়। কন্যার আবেদনে সাড়া দিয়ে মাধবীনাথ যশোরে গিয়ে সাজানো সাক্ষীদের সাথে গোপনে দেখা করেন। সাক্ষীদেরকে টাকার লোভ দেখিয়ে মিথ্যা কথা বলতে রাজী করানো হয়। প্রথমে এই কাজে রাজী হয়ে সাক্ষীরা ভয় পেতে শুরু করলে মাধবীনাথ তাদের অভয়দান করলেন। ফলে প্রমানের অভাবে জজসাহেব গোবিন্দলালকে বেকসুর খালাস করে দেয়। কিন্তু গোবিন্দলাল খালাস হয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মাধবীনাথ অনেক অনুসন্ধান করে ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে বাড়ী ফিরলেন। পিতার কাছে গোবিন্দলালের নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে ভ্রমর কাঁদতে লাগল। গোবিন্দলাল প্রসাদপুরে তার নিজ সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় চলে গেল। গোবিন্দলালের যখন অর্থ সংকট দেখা দিল তখন ভ্রমরের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে একখানি চিঠি পাঠালো। ভ্রমর কিন্তু কোন অর্থ সাহায্য না করে অপর একটি চিঠি লিখে তা জানিয়ে দিল। চিঠিতে ভ্রমর জানায় যে গোবিন্দলাল যেন নিজে ফিরে এসে তার নিজ সম্পত্তির ভার গ্রহণ করে। গোবিন্দলালের আসার আগেই সে যে পিত্রালয়ে চলে যাবে একথা জানাতেও সে ভোলে নি। গোবিন্দলাল পত্র পেয়ে দুঃখিত হয়ে জানায় যে সে কলকাতায় থাকবে, তাই তাকে সেখানে যেন মাসে মাসে কিছু অর্থ সাহায্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অসুস্থ শরীর থাকা সত্ত্বেও ভ্রমরের জেদ কিন্তু ষোলোআনায় বজায় ছিল। ভ্রমরের যেমন জেদ ছিল ঠিক তেমনি আমরা গোবিন্দলালের জেদও দেখতে পাই। এই জন্যই তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যবধান বাড়তে থাকে। উভয়ের মধ্যে যদি কেউ একটু সংযত হতে পারত তাহলে হয়ত তাদের সম্পর্কের এতটা অবনতি ঘটত না।

এরপর ভ্রমরের পীড়া খুব জটিল আকার ধারন করল। সকলেই বুঝতে পারল যে তার মৃত্যু আসন্ন। বিরহিণী ভ্রমর জেদের বসে শেষ পর্যন্ত ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল। বড়বোন যামিনীর কাছে ভ্রমর অন্তিম কামনার কথা জানালো ফাল্গুনের পূর্ণিমাতে যেন তার মৃত্যু হয়। ওই নির্ধারিত দিনে রাত্রিবেলায় সকলকে সরিয়ে দিয়ে ভ্রমর শুধু যামিনীর সাথেই কথা বলতে চাইল। ভ্রমর প্রকৃতির নানা রকম সৌন্দর্যের কথা যামিনীর কাছে জানতে চাইল। যামিনীকে সে তার বিছানাতে ফুল ছড়িয়ে দিতে বলল। ভ্রমরের শেষ ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর আগে গোবিন্দলালের সঙ্গে শেষবারের জন্য সাক্ষাৎ। ভ্রমর তার মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে স্বামীর জন্য মর্মাহত হয়ে পড়ে। যামিনী তখন ভ্রমরকে জানায় তার যদি ইচ্ছা থাকে তবে সে তার স্বামীর সাথে তার সাক্ষাৎ করে দেবে। ভ্রমরের গভীর পীড়ার খবর এর আগে গোবিন্দলালকে দেওয়া হয়নি। অন্য কোন সুত্র ধরে গোবিন্দলাল জানতে পারে ভ্রমর অসুস্থ। তাই সে স্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য হরিদ্রা গ্রামে চলে আসে। কিন্তু গোবিন্দলাল লজ্জায় ভ্রমরের কাছে যেতে পারে নি। যামিনীর কাছে গোবিন্দলালের কথা শুনে ভ্রমর তার স্বামীর সাথে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে যায়। তাই গোবিন্দলাল নীরবেই ভ্রমরের কাছে যায়। স্বামীকে দেখে ভ্রমর কাঁদতে কাঁদতে প্রনাম করে তার কাছে ভিক্ষা মার্জনা করে। গোবিন্দলাল ও ভ্রমরের এই সাক্ষাতেই তাদের নিঃস্ব জীবনকে আবার যেন নবরূপে সঞ্চিত করল। গোবিন্দলাল কোন কথাই বলতে পারল না। উভয়েই পরস্পরের হাত ধরে রইল। অবশেষে ভ্রমর শান্তিতে মৃত্যুবরণ করল।

ভ্রমরের শেষ কৃত্য সম্পন্ন হল। প্রবল মর্ম পীড়ায় গোবিন্দলাল আত্মদহনে দগ্ধ হতে লাগল। সে কারো সাথে কথা না বলে একাকী থাকতে লাগল। গোবিন্দলাল তার জীবনে দুটি রমণীকে ভালবেসেছিল। ভ্রমরের গুন অবহেলা করে রোহিণীর রুপ ও যৌবনের প্রতি সে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু রোহিণী তাকে চিরশান্তি দিতে অক্ষম হয়। রোহিণী কখনই ভ্রমরের মতো আন্তরিক ভাবে গোবিন্দলালকে ভালবাসতে পারেনি। একথা গোবিন্দলাল বুঝতে পেরে রোহিণীকে হত্যা করেছে। রোহিণীর মৃত্যুর পর গোবিন্দলাল যদি ক্ষমা প্রার্থী হয়ে ভ্রমরের কাছে এসে তার দোষ স্বীকার করে নিত তাহলে হয়ত তাদের সম্পর্ক পুনরায় পুনর্জীবন লাভ করত। এত তাড়াতাড়ি তাদের দাম্পত্য জীবনের গভীর পরিণতি ঘটত না। কিন্তু গোবিন্দলাল লজ্জা ও অহংকারের কাছে মাথানত করতে পারেনি। তাই তার খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। তাছাড়া গোবিন্দলাল কলকাতা থেকে যখন অর্থ সাহায্য চেয়ে ভ্রমরকে চিঠি দেয় তখন ভ্রমর যদি নিজের জেদকে একটু সংযত করে স্বামীকে ভালোবাসা জানিয়ে গৃহে আসার জন্য অনুরোধ করত তাহলে হয়ত গোবিন্দলাল ঘরে ফিরে আসত। সেই সময় গোবিন্দলাল বাড়ী ফিরে এলে তাদের দাম্পত্য জীবনে কিছুটা হলেও শান্তি বিরাজ করত। উভয়ের দাম্পত্য জীবন সুখের হলে হয়ত ভ্রমরকে মর্মান্তিক ভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হত না। পরিশেষে আমরা সম্পূর্ণ বিচার বিশ্লেষণ করে বলতে পারি যে ভ্রমর ও গোবিন্দলালের দাম্পত্য কলহের জন্য কেউ একক ভাবে দায়ী নয়। যদিও তাদের এই পরিণতির জন্য রোহিণীর মধ্যস্থতাকে কিছুটা হলেও দায়ী করা যায়। কিন্তু ভ্রমর ও গোবিন্দলালের জেদ ও অহংকার একটু যদি সংযত করা যেত তাহলে হয়ত রোহিণীর উপস্থিতি খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারত না। উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের বাস্তব সমাজ জীবনের নানান খুঁটি নাটি পরিস্থিতি এখানে আমরা লক্ষ্য করতে পারি। তাই উপন্যাসটিকে আমরা বাংলা সাহিত্যে এক উৎকৃষ্ট সামাজিক উপন্যাসের মর্যাদা দিতে পারি।









তথ্যসূত্র


২২. বঙ্কিম রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র), শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ (কল্পতরু উৎসব) ২০০৯, ঐ,পৃষ্ঠা-৫৫২

২৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬০

২৪. বঙ্কিম রচনাবলী (উপন্যাস সমগ্র), শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ (কল্পতরু উৎসব) ২০০৯, পৃষ্ঠা-৫৬২

২৫. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৩

২৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৫

২৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৭

২৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৮

২৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭১

৩০. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৪

৩১. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৭-৫৭৮

৩২. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৯

৩৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৮৪-৫৮৫

Thursday, June 28, 2018

‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)




‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসটি প্রকৃত সামাজিক উপন্যাস। এই উপন্যাসটি গভীর রসাত্মক ও পরিণাম অত্যন্ত বিষাদময়। এই উপন্যাসের পরিণামের জন্য দায়ী হল অনিবার্য রূপতৃষ্ণা রমণীরূপ মুগ্ধ পুরুষের প্রবৃত্তি দমনে অক্ষমতা। এই উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পাই নগেন্দ্রনাথ মহাধনবান ব্যক্তি, জমিদার। নগেন্দ্রনাথ ও সূর্যমুখীর মধ্যে একটি সুখের দাম্পত্য জীবন দেখতে পাই পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস ও মান্যতার দ্বারা তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল দৃঢ়বদ্ধ। কিন্তু তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনে হঠাৎ এক ঘন মেঘ হয়ে দেখা দেয় কুন্দনন্দিনী নামে এক অসহায় মেয়ের আবির্ভাব। যদিও প্রথমে নগেন্দ্রনাথ কুন্দনন্দিনীকে সঙ্গে নিতে চায়নি, কিন্তু গ্রামের প্রতিবেশিদের চাপে তাকে কলকাতায় তার মাসীর বাড়ি পৌঁছে দেবার অঙ্গীকার করে। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ কোলকাতায় কুন্দনন্দিনীর মেসোর কোন সন্ধান পেলেন না। সুতরাং কুন্দনন্দিনী নগেন্দ্রনাথের গলায় পড়িল। এর পর নগেন্দ্রনাথ কুন্দকে ত্যাগ করার জন্য আর একটি উপায় বের করেন তাঁর সহোদরা ভগিনীর ঘরে গিয়ে তাকে রাখার জন্য অনুরোধ করেন। ভগিনীকে বলে পরে কুন্দকে গোবিন্দপুরে সে নিয়ে যাবেনগেন্দ্রনাথ এরপর কুন্দের সমস্ত কথা বর্ণনা করে সূর্যমুখীকে চিঠি লিখলকিন্তু তেরো বছরের যৌবনা প্রারম্ভের কুন্দকে দেখে নগেন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লকারণ নগেন্দ্রনাথ তাহার সুহৃত হরদেব ঘোষালকে পত্রে যে কথাগুলি লেখে তাই এর প্রকৃষ্ট প্রমান। চিঠিতে নগেন্দ্রনাথ কুন্দনন্দিনীর রূপ সম্পর্কে বলে - “বোধ হয় যেন কুন্দনন্দিনীতে পৃথিবী ছাড়া কিছু আছে, রক্ত মাংসের যেন গঠন নয়; যেন চন্দ্রকর কি পুস্প সৌরভকে শরীরী করিয়া তাহাকে গড়িয়াছে। তাহার সঙ্গে তুলনা করিবার সামগ্রী হঠাৎ মনে হয় না।’’
নগেন্দ্রনাথ সূর্যমুখীকে যে চিঠি লিখেছিল কিছুদিন পরে তাহার উত্তর পেলউত্তরে সূর্যমুখী জানায় আমি তোমার চরণে কি দোষ করেছি যে তুমি আমাকে ছাড়া এতদিন কোলকাতায় পড়ে আছো? আর যদি থাকই তবে কেন আমি নিকটে গিয়ে তোমার সেবা করিতে পারি না? তোমার যদি অনুমতি পাই তবে আমি এখনই তোমার নিকট ছুটিব। সূর্যমুখীর এই কথার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে সে তার স্বামীকে কত ভালোবাসে। সূর্যমুখীর ভালোবাসা একেবারে নিরেট ছিল বলেই সে এই কথাগুলি বলতে পারে। সূর্যমুখী এরপরেই পত্রে তামাশা করে বলেন - “একটি বালিকা কুড়াইয়া পাইয়া কি আমাকে ভুলিলে? অনেক জিনিসের কাঁচারই আদর। নারিকেলের ডাবই শীতল। এ অধম স্ত্রীজাতিও বুঝি কেবল কাঁচামিটে? নহিলে বালিকাটি পাইয়া আমায় ভুলিবে কেন?” এই কথা গুলি সূর্যমুখী তামাশা করে বললেও আমাদের মনে হয় যেন বিধাতা যেন তাকে দিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করে দেয়। সূর্যমুখী এরপর নগেন্দ্রের কাছে কুন্দনন্দিনীকে ভিক্ষা চেয়ে তার কাছে নিয়ে যেতে অনুরোধ করে। সূর্যমুখী কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে তারাচরনের বিবাহের পরিকল্পনা নগেন্দ্রনাথকে জানায়। তাই সূর্যমুখী নগেন্দ্রনাথকে কুন্দকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী আসতে জানায়। এই খবর শুনে নগেন্দ্রনাথ খুশি হয়। সূর্যমুখী আবার রসিকতা করে নগেন্দ্রনাথকে জানায় - “যদি কুন্দকে স্বয়ং বিবাহ করিবার অভিপ্রায় করিয়া থাক, তবে বল, আমি বরণডালা সাজাইতে বসি।” সূর্যমুখীর দ্বারা কুন্দনন্দিনীর যে প্রস্তাব তা নগেন্দ্রনাথ ও তার বোন কমলমনি উভয়ে সম্মত হলেন। সুতরাং স্থির হইল যে নগেন্দ্রনাথ বাড়ী যাবার সময় কুন্দকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু কুন্দকে বাড়ী নিয়ে যাবার সিধান্তই নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনে বিষবৃক্ষ রোপণ হল। পরে নগেন্দ্র, সূর্যমুখী ও কমলমনি এইজন্য হাহাকার করিবেন।
পূর্ব পরিকল্পনা মতো নগেন্দ্রের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর গোবিন্দপুরে চলে এলো। কুন্দ নগেন্দ্রের এতবড় বাড়ি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। সূর্যমুখীর ইচ্ছায় তারাচরণের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর বিবাহ হয়ে গেল। সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে তারাচরণ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হলদেবেন্দ্র কুন্দের সঙ্গে আলাপ করার জন্য তারাচরণের নিকট আবেদন করল। তারাচরণ অনিচ্ছাবশতঃ দেবেন্দ্রকে কিছুদিন এড়িয়ে চলতে লাগল। নানারকম সমস্যাকে দূর করে তারাচরণ ও কুন্দের দাম্পত্য জীবন তিন বছর কেটে গেল। হঠাৎ কুন্দনন্দিনী বিধবা হল। জ্বর বিকারে তারাচরণের মৃত্যু হলসূর্যমুখী কুন্দকে আপন বাড়ীতে নিয়ে এলো। এতেই সত্যিকারের বিষবৃক্ষের বীজ বপন হল। এই কারনেই নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর দাম্পত্যজীবন তিলে তিলে ধ্বংস হতে লাগল। এই ধ্বংসের ফলে তিনটি জীবন নষ্ট হয়ে গেল। কুন্দনন্দিনী বাল বিধবা হওয়ার পর নগেন্দ্রের গৃহে সুখেই ছিলকুন্দনন্দিনীর রূপে নগেন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই কুন্দের প্রতি একটি রূপজ মোহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল নগেন্দ্রনাথের। কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের এই মোহের আঁচ কিছুটা পেয়ে গিয়েছিল সূর্যমুখী। তাই সে সমস্ত ঘটনা কমলমনিকে চিঠি দিয়ে জানায়। তার স্বামী যে এখন আর স্বাভাবিক নেই বরং যথেষ্টই অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এই অনুমান করে সূর্যমুখীর প্রবল সন্দেহ হয়। এই অবস্থা দেখে সূর্যমুখীর দশা যে কতটা করুন তা সে কমলকে জানায়। তার অন্তঃকরণের দুঃখ কিছুটা লাঘব করবার জন্যই সে প্রানাধিক কমলমনিকে সব ঘটনা বিস্তারিত জানায়। সূর্যমুখী কমলকে জানায় যে কুন্দ এখন আর বালিকা স্বরুপ নয় বরং সে এখন সুন্দরী তরতাজা যুবতী। কুন্দের এই রুপেই যে নগেন্দ্রনাথকে পাগল করেছে তা সূর্যমুখী জানায়। কুন্দের সৌন্দর্যেই সূর্যমুখীর সংসারে কাল হয়ে দেখা দিয়েছে।
সূর্যমুখী স্বামীকে খুব ভালবাসত তাই স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণে মর্মাহত হয়ে পড়ে। সূর্যমুখী পৃথিবীতে স্বামী ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারে না। পৃথিবীতে যা কিছু সম্পত্তি সে একমাত্র স্বামীকেই মনে করে। এহেন স্বামীকে তার হৃদয় হতে কুন্দনন্দিনী কেড়ে নিতে চাইছিল। এতেই সূর্যমুখী দুঃখে বিরহে মর্মাহত হয়ে পড়ে। সূর্যমুখী তাই বলতে পারে যে পৃথিবীতে তার যদি কোন অভিলাষ থাকে, তবে সে তার স্বামীর স্নেহ। সেই স্বামীর স্নেহ হতে কুন্দনন্দিনী তাকে বঞ্চিত করছে। এই জন্যই সূর্যমুখী ও নগেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনে অশান্তির বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের প্রধান মূলধন বিশ্বাস। বিশ্বাস যখন আর থাকে না তখন দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে থাকে। সূর্যমুখী ও নগেন্দ্রের জীবনে কুন্দের উপস্থিতি দাম্পত্য জীবনে অবিশ্বাসের কালো মেঘ দেখা দেয়। ফলে দাম্পত্য জীবনে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। মানব মনে যেখানেই সমাজের কোন বাধা দেয় সেখানেই যেন বেশি করে তাকে আকৃষ্ট করে। তাইতো নগেন্দ্র সমাজ বহির্ভূত বালবিধবার রূপে মুগ্ধ হয়ে আকৃষ্ট হয়। কুন্দনন্দিনী অন্য স্ত্রী লোকের মতো নগেন্দ্রর চোখে সামান্য নয়, সে তার চোখে অসামান্য হয়ে ওঠে। তাইতো নগেন্দ্র কুন্দের প্রতি একবার চাইবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। এই দৃশ্য দেখেই সূর্যমুখীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। কারণ আমরা জানি কোন নারীই চায়না তার স্বামী তাকে ছাড়া অন্য নারীকে বেশি গুরুত্ব দেয়। নগেন্দ্র যখন কুন্দকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে তখন সূর্যমুখীর অন্তর্দাহ হতে দেখা যায়। ফলস্বরূপ তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা ব্যবধানের সৃষ্টি হতে দেখা যায়সূর্যমুখী যে নগেন্দ্রকে কতটা সন্দেহ করত তা তার বক্তব্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে তার পত্রে জানায় – “কুন্দনন্দিনীর জন্য তিনি আপনার নিকট অপরাধী হইয়াছেন। এজন্য কখন কখন তাঁহার প্রতি অকারণ ভর্ৎসনা করেন। সে রাগ তাঁহার উপর নহে- আপনার উপর। সে ভর্ৎসনা তাহাকে নহে, আপনাকে। আমি ইহা বুঝিতে পারি।”
কমল প্রত্যুত্তরে লিখিল তুমি পাগল হয়েছ, নচেৎ স্বামীর হৃদয় প্রতি অবিশ্বাসীনী হবে কেন? কমল তখন সূর্যমুখীকে স্বামীর প্রতি বিশ্বাস রাখার জন্য উপদেশ দিল। সূর্যমুখী স্থির করল যে সে কমলের কথা শুনিবে অর্থাৎ স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসীনি হবে না। সূর্যমুখী বালির বাঁধ বাঁধিল। সূর্যমুখীর মনে হল নগেন্দ্রনাথের কোন রাগ হয়েছে। তাই এইরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছে। নগেন্দ্রনাথের শরীর আস্তে আস্তে ভেঙ্গে যেতে থাকে। কুন্দনন্দিনীর কথা চিন্তা করে নগেন্দ্রনাথ আহার নিদ্রা ত্যাগ করে। মাঝে মাঝে নগেন্দ্র মদ্যপান করতেও থাকে। নগেন্দ্র এরপর একজন মাতালে পরিণত হয়ে উঠল। বিষয় সম্পত্তি সমস্ত কিছুর উপর তাঁহার মোহ একেবারে মুছে গেল। কিছুদিনের মধ্যে নগেন্দ্রের সকল চরিত্র পরিবর্তিত হতে লাগল। নির্মল আকাশে মেঘ দেখা দিল। এইসব দেখিয়া সূর্যমুখী গোপনে আঁচলে চোখ মুছতে লাগল। সূর্যমুখী যদি তখনই কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করত তবে হয়তো নগেন্দ্রকে সৎ পথে নিয়ে আসা যেত। কিন্তু সূর্যমুখীর কাল হল কমলের উপদেশ। কমলমনির উপদেশ মতো সূর্যমুখী স্বামীর প্রতি বিশ্বাস রাখলেন। তার তখন মনে হল নগেন্দ্রের চিত্ত দুর্বল নয়, তার চিত্ত অচলপর্বত - আমিই ভ্রান্ত বোধ হয়। কিন্তু সূর্যমুখীর অন্তর সে কথা বিশ্বাস করল না। তাই সে অন্তরে দগ্ধ হতে লাগল একাকী চিন্তা করে। ফলস্বরূপ তাদের দাম্পত্য জীবন অত্যধিক সন্দেহ প্রবণতার জন্য আস্তে আস্তে দুর্বল হতে লাগল। নগেন্দ্রের শরীরের অবনতি হতে দেখা যায়। সূর্যমুখী নগেন্দ্রকে ঔষধ খেতে বললে নগেন্দ্র তা অস্বীকার করে। সূর্যমুখী নগেন্দ্রকে তার শরীরের অসুখ সম্পর্কে জানতে চায়। নগেন্দ্র কোন উত্তর দেয় না। তখন সূর্যমুখী নগেন্দ্রকে তার চেহারা দেখার জন্য একটি দর্পণ এনে দিলে নগেন্দ্র বিরক্ত হয়ে সেটি দূরে নিক্ষেপ করলেন। দর্পণটি দূরে নিক্ষিপ্ত হয়ে চূর্ণ হয়ে যায়।
বাস্তবে দর্পণটি চূর্ণ হলেও আমাদের মনে হয় নগেন্দ্র তাদের দাম্পত্য জীবনকেই চূর্ণ করে দেয়। এই ঘটনায় সূর্যমুখীর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সূর্যমুখীকে কাঁদতে দেখে নগেন্দ্রর চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল এবং সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করলেন। বহির্বাটীতে গিয়া নগেন্দ্র একজন ভৃত্যকে বিনা অপরাধে প্রহার করলেন। ভৃত্যের সেই প্রহার সূর্যমুখীর অঙ্গে বাজল। পূর্বে নগেন্দ্র অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলেন কিন্তু এখন কথায় কথায় তার রাগ। নগেন্দ্রর স্বাভাবিক জীবন সবকিছু অস্বাভাবিক রূপে ধরা দিল। নগেন্দ্র বাড়ীর বাইরেই অধিক সময় কাটাতে লাগল। নগেন্দ্রকে মদ্যপান করতে দেখে সূর্যমুখী বিস্মিত হল। নগেন্দ্রর এই অবস্থা দেখে সূর্যমুখীর জীবন বিষময় হয়ে উঠল। নগেন্দ্রকে সূর্যমুখী অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার কোন কথাতে সে কর্ণপাত করল না। নগেন্দ্র তার বিষয় সম্পত্তি পর্যন্ত দেখাশুনা একেবারে ছেড়ে দিল। নগেন্দ্র যে আস্তে আস্তে অধঃপতনের পথে যেতে চলেছে তা সে নিজেও স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। তাই সে হরদেব ঘোষালকে একটি পত্রে বলতে পারেন – “আমার উপর রাগ করিও না- আমি অধঃপাতে যাইতেছি।” সূর্যমুখী যখন আর সহ্য করতে পারছিল না তখন কমলমনিকে আর একখানি চিঠি দিল। চিঠির শেষে কুন্দনন্দিনী লিখলেন – “একবার এসো! কমলমনি! ভগিনি! তুমি বই আর আমার সুহৃদ কেহ নাই। একবার এসো!” এই চিঠিটা পেয়ে কমলমনি বুঝতে পারে যে সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবন শেষ হতে চলেছে। তৎক্ষণাৎ কমলমনি এই বিষয় নিয়ে স্বামীর সাথে আলোচনা করে। পত্র পাঠ করে তৎক্ষণাৎ কমলমনি গোবিন্দপুরে যাত্রা করলেন। কমলমনির হাসিমুখ দেখে সূর্যমুখীর চক্ষের জল শুকাইল। কমলমনিকে সূর্যমুখীর সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করতেও দেখা যায়। কমলের সাথে নগেন্দ্রকে স্বাভাবিক ব্যবহার করতেই দেখা গেল। কুন্দের সাথেও কমলের স্বাভাবিক কথোপকথন দেখা গেল। কুন্দনন্দিনী কমলকে জানায় সে ভালো আছে। এইসব দেখে কমলের মনে ভ্রম হয়। সে সূর্যমুখীর আশঙ্কার কথা বিশ্বাস করতে পারে না।
গোবিন্দপুরে কিছুদিন থাকার পর কমলমনি বাড়ি যেতে চাইল। কিন্তু সূর্যমুখী তাকে আরো কিছুদিন থাকার জন্য অনুরোধ করল। তখন কমলমনি সূর্যমুখীকে আশ্বস্ত করে জানায় - “তোমার কাজ না করিয়া যাইব না।” কমলমনি কুন্দকেও খুব ভালোবাসতেন তাই কমলের যাওয়ার কথা শুনে কুন্দ আপনার ঘরে গিয়া লুকিয়ে কাঁদিল। এই ঘটনা কমলের কাছে অজ্ঞাত থাকল না। কমল অন্ত্যন্ত স্নেহে কুন্দকে তার কান্নার কারন জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে কুন্দ প্রথমে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। কুন্দ অন্ত্যন্ত দুঃখে কমলকে জানায় সে ছাড়া তাকে আর কেউ ভালোবাসে না। এই কথা শুনে কমল কুন্দকে সঙ্গে কলিকাতা নিয়ে যাবার কথা জানায়। কুন্দ কমলের কথাতে রাজী হতে পারে না। এতেই কমলের মনে সন্দেহের ডানা বাঁধে। তাই তখন কুন্দকে দ্বিধাহীনভাবে কমল জিজ্ঞাসা করে যে সে দাদাবাবুকে ভালোবাসে কি না? কমলের প্রশ্নের উত্তরে কুন্দ কোন উত্তর দিতে পারে না। কেবল মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। এর ফলে কমল বুঝে যায় সে যা সন্দেহ করেছে তা একেবারে ঠিক। তখন কমল দ্বিধাহীন ভাবে কুন্দকে বলতে পারে - “বুঝিছি- মরিয়াছ। মর তাতে ক্ষতি নাই – কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেকে মরে যে?’’ কিন্তু কমল অন্তঃকরনের মধ্যে কুন্দনন্দিনীর দুঃখে দুঃখী, সুখে সুখী হল। কমল তখন কুন্দকে সঙ্গে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল কারণ সে বুঝেছিল  যে কুন্দ এখানে উপস্থিত থাকলে সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবন পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কমলের অনেক সাধাসাধিতে কুন্দ তার সঙ্গে কোলকাতায় যেতে রাজী হল। কমল মনে করল যে কুন্দ পরের মঙ্গলমন্দিরে আপনার প্রান বলি দিল। কুন্দের শুভ বুদ্ধির উদয় দেখে কমল খুশি হল। এরপর প্রেমক্লিষ্টা সরলা বালিকা স্বভাবা কুন্দনন্দিনীর চিত্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নগেন্দ্র ও কুন্দের প্রথম সাক্ষাতেই নগেন্দ্রর অপরিমিত প্রেমোচ্ছ্বাসের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে - “এই সাক্ষাতের ফলে কুন্দনন্দিনীর সলজ্জ প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও উভয়েরই মনোভাব যে আরও প্রবল ও দুর্দমনীয় হইয়া উঠিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই।” নগেন্দ্র ও কুন্দ যেন পরস্পর পরস্পরের প্রতি দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কারণ তারা দুজন দুজনকে অন্তরের মধ্যে স্থান দিয়ে দিয়েছিল। তাইতো এই বন্ধন কিছুতেই ভেঙ্গে যাবার নয়।
হীরা কর্তৃক হরিদাসী বৈষ্ণবীর আসল পরিচয় আবিস্কার করে সূর্যমুখী। বৈষ্ণবীর সাথে কুন্দের মেলামেশা দেখে সূর্যমুখীর কুন্দনন্দিনীর চরিত্রের প্রতি সন্দেহ হয়। সন্দেহের বশে সূর্যমুখী কুন্দকে তিরস্কার করে। সূর্যমুখীর তিরস্কারের ফলে কুন্দনন্দিনী গৃহত্যাগ করে পালিয়ে যায়। কিন্তু কুন্দের গৃহত্যাগের কারন নগেন্দ্র জানতে পারেনি। তাই কুন্দের গৃহত্যাগের পরে কুন্দের প্রতি নগেন্দ্রের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। কুন্দের অদর্শনে নগেন্দ্র যেন পাগল হয়ে যায়। হীরার সঙ্গে কুন্দের দেখা হওয়াতে হীরা তাকে নিজ গৃহে লুকিয়ে রাখে। কুন্দের নিরুদ্দেশ শুনে দত্ত বাড়ীতে হইচই পড়ে গেল। হীরা কুন্দকে নিয়ে কি করবে প্রথমে কোন সিন্ধান্ত নিতে পারল না। সূর্যমুখীর প্রতি হীরার হিংসা ছিল। তাই সে সূর্যমুখীকে জব্দ করার পরিকল্পনা করল। হীরা নগেন্দ্রর সাথে সূর্যমুখীর অভিন্ন হৃদয় ভিন্ন করিবার পরিকল্পনা করিল। হীরা মনিব বাড়ীতে অন্য এক দাসীর প্রতি অন্যায় করে সূর্যমুখীর সহানুভূতি না পেয়ে নিজের ইচ্ছাতেই নগেন্দ্রর বাড়ীতে কাজ ছেড়ে দেয়। হীরা এরপর ছলনা করে কাঁদতে কাঁদতে নগেন্দ্রর কাছে যায়। নগেন্দ্রের কাছে গিয়া হীরা সূর্যমুখীর প্রতি মিথ্যা অভিযোগ করে। হীরা নগেন্দ্রকে এও জানাতেও ভোলেনি যে সূর্যমুখী অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছে বলেই কুন্দনন্দিনী গৃহত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়েছে। হীরার মুখে এই কথা শুনে নগেন্দ্র সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে প্রচণ্ড রেগে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নগেন্দ্র সূর্যমুখীকে কিছুতেই আর সহ্য করতে পারল না। তাই আমরা বলতে পারি সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনের অশান্তির জন্য হীরাও কম দায়ী নয়। হীরার ইন্ধনে নগেন্দ্রর মনের আগুনে যেন ঘি পড়িল। হীরার কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য নগেন্দ্রনাথ সূর্যমুখীকে জিজ্ঞাসা করল। সূর্যমুখী নগেন্দ্রর সমস্ত অভিযোগ স্বীকার করে নিল। সূর্যমুখী এর কারন হিসাবে জানায় যে বৈষ্ণবীর সঙ্গে কুন্দের মেলামেশা তার ভালো লাগেনা তাই সে এই ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। নগেন্দ্র তখন সূর্যমুখীকে এই ব্যবহারের জন্য সমর্থন করে। কিন্তু সূর্যমুখী নগেন্দ্রর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। সূর্যমুখীর দূর্বলতা বশতঃ নগেন্দ্রনাথ বলে - “তোমায় বলিতে হইবে না। আমি জানি, তুমি সন্দেহ করিয়াছিলে যে, আমি কুন্দনন্দিনীতে অনুরক্ত।”১০ নগেন্দ্রের কাছে এই কথা শুনে সূর্যমুখী কাঁদতে লাগিল।
নগেন্দ্র যে কুন্দের রূপের প্রতি আকৃষ্ট তা সে নিজেই সূর্যমুখীর কাছে স্বীকার করে নেয়। সে সূর্যমুখীকে জানাতে ভোলেনি যে অনেক চেষ্টা করেও সে তার নিজ চিত্তকে বশ করতে পারেনি। নগেন্দ্রের মুখে এই কথাগুলি শুনে সূর্যমুখীর বুকে শেল বিঁধিল। এই কথাগুলি তার কানে খুব আঘাত করেছিল। নগেন্দ্র কুন্দকে এরপর যে কথাগুলি বলল তা বড়ই বেদনাদায়ক। সে কুন্দকে জানায় সে সংসার ত্যাগ করে দেশান্তরে যাইবে। বাড়ী, ঘর, সংসার, সূর্যমুখীতে তার আর কোন সুখ নেই। তার মনে এখন শুধু কুন্দনন্দিনীর মোহ অধিকার করে আছে। নগেন্দ্র সূর্যমুখীকে জানায় যদি কুন্দকে কোনদিন ভুলতে পারে তবেই সে সূর্যমুখীর কাছে আসবে নচেৎ তার সাথে এই শেষ সাক্ষাৎ। এই বেদনাদায়ক কথা শুনে সূর্যমুখী ভূতলে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। সূর্যমুখী তখন নগেন্দ্রকে একমাস গৃহে থাকতে বলেন এর মধ্যে সে প্রতিশ্রুতি দেয় কুন্দের খোঁজ দেবার জন্য। সূর্যমুখীর কথামতো নগেন্দ্র রাজী হলেন। সূর্যমুখী মনে মনে বলিতেছিলেন - “আমার সর্বস্ব ধন! তোমার পায়ের কাঁটাটি তুলিবার জন্য প্রাণ দিতে পারি। তুমি পাপ সূর্যমুখীর জন্য দেশত্যাগী হইবে? তুমি বড়, না আমি বড়?”১১ কুন্দ যে হীরার গৃহে লুকিয়ে আছে তা বুদ্ধির ছলে জানতে পারে মালতী। মালতী তখন কুন্দের সন্ধান দেবেন্দ্রকে জানিয়ে দিল। এদিকে কুন্দনন্দিনী নগেন্দ্রনাথের অদর্শনে বিহ্বল হয়ে পড়ল। নগেন্দ্রকে দেখতে না পেয়ে কুন্দ আবার সেই বাড়ীতে যাবার জন্য পরিকল্পনা করিল। কুন্দ সিন্ধান্ত নিল যে সূর্যমুখী দূরীকৃত করলেও সে ঐ বাড়ীতে যাবেই। সূর্যমুখী পুষ্পদ্যানে পুষ্প চয়ন করতে এসে কুন্দকে আবিস্কার করল। কুন্দকে পেয়ে সূর্যমুখীর আনন্দের সীমা থাকে না। তাই সূর্যমুখী কুন্দকে বলে - “দিদি এসো! আর আমি তোমায় কিছু বলিব না।”১২ সূর্যমুখী হাত ধরে কুন্দকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেল। কুন্দকে পেয়ে সূর্যমুখীর অন্তর্দাহ জ্বলন বন্ধ হল। পরিস্থিতি বুঝে সূর্যমুখী নগেন্দ্রের সহিত কুন্দের বিবাহের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সূর্যমুখীর উদ্যোগ ও নগেন্দ্রের ইচ্ছায় শুভ বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়ে গেল। এখানেই বিষবৃক্ষের একপর্ব শেষ হল। উদ্দাম বাসনা সমস্ত বাধা অতিক্রম করে আপনাকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করল। এইবার ধীরে সুস্থে ফলভোগের পালা আরম্ভ হল। প্রবল ক্রিয়ার স্বাভাবিক ফলই প্রবল প্রতিক্রিয়া।
সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে সূর্যমুখী কমলকে একটি চিঠি দিলেন। কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রের বিবাহের মধ্যস্থতাকারী যে সে নিজেই তা জানিয়ে কমলকে এই বিবাহে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করেন। কমল পত্র পাঠ করে এর অর্থ কিছুই বুঝতে পারে না। পত্রের অর্থ সঠিক বুঝতে না পেরে শ্রীশচন্দ্র নগেন্দ্রকে একটি চিঠি লিখল। এর উত্তরে নগেন্দ্র তাদের বিবাহের কথা স্বীকার করে জানায় - “আমি এ বিবাহ করিব। যদি পৃথিবীর সকলে আমাকে ত্যাগ করে,তথাপি আমি বিবাহ করিব। নচেৎ আমি উন্মাদ্গ্রস্ত হইব- তাহার বড় বাকীও নাই।”১৩ পত্রপাঠ করে কমলমণি ও শ্রীশচন্দ্র গোবিন্দপুরে যাত্রা করলেন। কমলমনি সূর্যমুখীর কাছে সংবাদ পায় যে গতকাল নগেন্দ্র ও কুন্দের বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই বালবিধবা কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রের বিবাহের ফলে নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর সুখের দাম্পত্য জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। কমলের আগমনের পর সূর্যমুখী তার নিকটে স্বামীর ব্যবহারে নিজ গভীর মনোবেদনার পরিচয় দিলেন। এবং প্রত্যাখানের অসহ্য দুঃখবশে গৃহত্যাগ করে গেলেন। সূর্যমুখী পত্রে তার গৃহত্যাগের কারন লিখে যায় এবং এও জানিয়ে যায় যে তার সন্ধান না করার। কারন সে জানায় কুন্দ থাকিতে সে আর দেশে ফিরিবে না। সূর্যমুখীর এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞাতেই আমরা বুঝতে পারি যে কুন্দের উপস্থিতি তার অন্তরকে কতখানি বিদীর্ণ করে। সূর্যমুখী কিন্তু এত দুঃখের পরও তার স্বামীর প্রতি কোন রাগ প্রকাশ করে না। স্বামীর প্রতি ভক্তি তার চিরদিন অবিচল থাকবে বলে দৃঢ়কণ্ঠে সে জানায়। সূর্যমুখী যে কতখানি দুঃখে বিরহে গৃহ ত্যাগ করে তা আমরা তার পত্র দ্বারাই বুঝতে পারি। পত্রে সে জানায় - “তাঁহার নিকট আমি জন্মের মত বিদায় লইলাম, ইহাতেই জানিতে পারিবে যে, আমি কত দুঃখে সর্বত্যাগিনী হইতেছি।”১৪ সূর্যমুখীর পলায়নের খবর গৃহের সবাই জানাজানি হতেই সকলে তাহার খোঁজ করতে লাগলেন। সূর্যমুখীর নিরুদ্দেশের খবর শুনে নগেন্দ্র বিচলিত হয়ে তাকে খোঁজার জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইলেন। দুই-তিন ঘণ্টা সূর্যমুখীর কোন খবর না পেয়ে নগেন্দ্র নিজেও তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। এর দ্বারাই আমরা বুঝতে পারি যে সূর্যমুখীর প্রতি নগেন্দ্রের আন্তরিক একটা আকর্ষণ ছিলনগেন্দ্র অনেক খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও সূর্যমুখীর সন্ধান পেলেন না। কুন্দনন্দিনী নগেন্দ্রের কাছে সূর্যমুখীকে ফিরে আনার জন্য অনুরোধ করলে, নগেন্দ্র হঠাৎ রেগে যায়। রেগে গিয়ে কুন্দকে বলে - “ঐ কথাটি তুমি মুখে আনিও না। তোমার মুখে সূর্যমুখীর নাম শুনিলে আমার অন্তর্দাহ হয় - তোমারই জন্য সূর্যমুখী আমাকে ত্যাগ করিয়া গেল।”১৫ নগেন্দ্রের মুখে এই কথা শুনে কুন্দনন্দিনী খুবই ব্যাথিত হল। বিষবৃক্ষের বীজে তিনটি জীবন কেউই প্রকৃত সুখী হতে পারল না। সবাই সুখ থেকে বঞ্চিত রইল। কুন্দ ও নগেন্দ্রের দাম্পত্য জীবনও বেশিদিন সুখী হল না। তাদের দাম্পত্য জীবনেও অবিশ্বাসের কালো ছায়া দেখা দিল। নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীকে বলতে পারে - “আমাকে সূর্যমুখী বরাবর ভালবাসিত। বানরের গলায় মুক্তার হার সহিবে কেন?- লোহার শিকলই ভাল।”১৬ নগেন্দ্রের মুখে এই কথা শুনে কুন্দনন্দিনী রোদন স্থির করতে পারলেন না।
কুন্দকে বিবাহ করা যে তার সবচেয়ে বড় ভুল তা নগেন্দ্র নিজেই স্বীকার করে। এই জন্যই যে সূর্যমুখীকে হারালেন তা তিনি বুঝতে পারলেন। সূর্যমুখী ও কুন্দের তুলনা করতে গিয়ে নগেন্দ্র বলে - “সূর্যমুখীকে পত্নী ভাবে পাওয়া বড় জোর কপালের কপালের কাজ। সকলেই মাটি খোঁড়ে,কোহিনূর খোঁড়ে,কোহিনূর একজনের কপালেই উঠে। সূর্যমুখী সেই কোহিনূর। কুন্দনন্দিনী কোন গুণে তাঁহার স্থান পূর্ণ করিবে?”১৭ কুন্দের প্রতি নগেন্দ্রের ভালোবাসা হল তার রুপ তৃষ্ণা অর্থাৎ রুপের প্রতি মোহ কিন্তু সূর্যমুখীর প্রতি তার ভালোবাসা হল চিরন্তন, যা সহজে মন থেকে যায় না। নগেন্দ্র এর পর বিষয় সম্পত্তি দেওয়ানের উপর ভার দিয়ে গৃহত্যাগ করে পর্যটনে যাত্রা করিলেন। কুন্দ গোবিন্দপুরে একাকী রয়ে গেল। এক ব্রহ্মচারী অন্ধকারে পথের মধ্যে অচৈতন্য সূর্যমুখীকে উদ্ধার করে। হরমনির সেবা যত্নে সূর্যমুখী সুস্থ হয়ে ওঠে। সূর্যমুখীর কাশ রোগ হয়েছিল। সূর্যমুখীর কথামতো নগেন্দ্রের ঠিকানায় ব্রহ্মচারী পত্রে নগেন্দ্রকে সমস্ত খবর চিঠি দিয়ে জানালেন। সূর্যমুখীর ইচ্ছা হল মৃত্যুকালে যেন স্বামীর মুখ দেখিয়া মরি। এতেই বোঝা যায় যে সূর্যমুখীর স্বামী ভক্তি কতখানি গাঢ়। নগেন্দ্র বাড়ীতে ছিল না বলে পত্রটি প্রথমে দেওয়ানের নিকট আসে। দেওয়ান দ্বারা পত্রটি অনেকদিন পর নগেন্দ্রের কাছে পৌঁছায়। পত্র পেয়েই নগেন্দ্র রানীগঞ্জে যাত্রা করিল সূর্যমুখীর খোঁজে। নগেন্দ্র গ্রামে পৌঁছে প্রথমে শিবপ্রসাদ ব্রহ্মচারীর খোঁজ করিলেন। কিন্তু তার সংবাদ না পেয়ে তিনি রামকৃষ্ণ কবিরাজের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং জানতে পারে যে ব্রহ্মচারী এখানে নেই। এই সংবাদে নগেন্দ্র বিষণ্ণ হল। নগেন্দ্রকে রামকৃষ্ণ জানায় যে হরমনির গৃহে সূর্যমুখী অগ্নিদাহে মারা গেছে। এই খবর শুনে নগেন্দ্র পুরো ভেঙ্গে পড়েন। বিরহে নগেন্দ্র বলতে পারে - “আমার এতদিনে সব ফুরাইল।”১৮ একাকী দুঃখে নগেন্দ্র গোবিন্দপুরে চলিল। নগেন্দ্র এর পর কমলের কাছে চলে যায়। এদিকে গোবিন্দপুরে দত্ত বাড়ীতে বৃহৎ অট্টালিকা, ছয় মহল বাড়ী- নগেন্দ্র সূর্যমুখী বিনা সব অন্ধকার হয়ে গেল।
কুন্দনন্দিনী তার ভুল বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে যে সেই সব কিছু অনর্থের মুল। তাই সে সূর্যমুখীর আশায় দিন অতিবাহিত করতে থাকে। তাই সে আত্মধিক্কারে মনে মনে বলত - “এখন শুধু শুধু মরিয়া কি হইবে? যদি সূর্যমুখী ফিরিয়া আসে, তবে মরিব। আর তার সুখের পথে কাঁটা হব না।”১৯ নগেন্দ্র গোবিন্দপুরে এলেও কুন্দের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করিল। নগেন্দ্রনাথের আদেশানুসারে পরিচারিকারা সূর্যমুখীর শয্যা গৃহে তাহার শয্যা প্রস্তুত করলেন এবং নগেন্দ্র সেখানেই শয়ন করলেন। সেই গৃহে সূর্যমুখীর অতীত স্মৃতি মনে করে নগেন্দ্রনাথ কাঁদতে লাগল। নগেন্দ্র ভূতলে মুর্ছিত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু সে তার শিরোদেশে একটি উপাধানের অস্ত্বিত অনুভব করল। তিনি উপাধান স্পর্শ করে দেখলেন যে এ তো উপাধান নয়, এ কোন মানুষের উরুদেশ। নগেন্দ্র কোমলতা অনুভব করায় বুঝতে পারল এ কোন নারীর উরুদেশ। তখন নগেন্দ্র দেখতে পেল যে সূর্যমুখী মূর্ছিতা হয়ে তার মাথার নীচে নিজের উরুদেশ রাখিয়া আছে। সূর্যমুখীর দেখা পেয়ে নগেন্দ্রনাথ যেন পুনর্জীবন লাভ করল। নগেন্দ্র প্রথমে তাকে কুন্দনন্দিনী বলে ভ্রম হয়। পরে সূর্যমুখীর কথা বলতে বলতে আবেগে বলে ফেলেন - “তুমি যদি সূর্যমুখী হইতে পারিতে তবে কি সুখ হইত!”২০ এই কথা শুনে সূর্যমুখী নিজ পরিচয় দেয়। সূর্যমুখীকে সাক্ষাৎ দেখে নগেন্দ্র প্রথমে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারেন না, পরে তার ভ্রম ভেঙ্গে যায়।
এই উপন্যাসে নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনে নদীর চড়ার মত সম্পর্কের ওঠানামা দেখতে পাওয়া যায়। মিলন ও বিরহের মধ্যে তাদের দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্ব দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যমুখী তার সমস্ত ঘটনা নগেন্দ্রকে জানায়। সূর্যমুখী ও নগেন্দ্রনাথের মিলনের পরিস্থিতি দেখে কুন্দনন্দিনী আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। সে নিজেকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করে। নিজেকে দোষী মনে করে সে আর স্থির হয়ে থাকতে পারে না। তাই সে অভিমানে হীরার বাক্স থেকে বিষ বের করে খেয়ে ফেলেন। কুন্দ এরপর নগেন্দ্রের সামনে গেলে উভয়ের মধ্যে রাগ-অনুরাগের পালা শেষ হয়। কুন্দ যে কতটা দুঃখে নিজের জীবন শেষ করতে বাধ্য হয় তা তার কথাতেই বুঝতে পারা যায়। সে নগেন্দ্রকে বলতে পারে - “কাল যদি একবার আমার নিকেট এমনি করিয়া বসিতে- তবে আমি মরিতাম না।”২১ কুন্দনন্দিনী বিষ পান করে মৃত্যু বরন করিল। নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর দাম্পত্য জীবনের পথের কাঁটা কুন্দনন্দিনী বিদায় নিল। উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ অবধি এই তিনজনের দ্বন্দ্বের ফলে উপন্যাসটি এগিয়ে চলেছে। কুন্দনন্দিনী যদি প্রবেশ না করত তবে হয়তো উপন্যাসটির এত উত্তেজনা দেখা যেত না। গোটা উপন্যাস জুড়ে এই তিন চরিত্রের দাম্পত্য জীবনের যে কলহ তা আমরা সুস্পষ্টভাবেই দেখতে পাই। তাই উপন্যাসটি এক উৎকৃষ্ট সামাজিক উপন্যাস রূপে বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য স্থান করে নিয়েছে। উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্র চিত্রন আমাদের বাস্তব সমাজের মুখচ্ছবি হয়ে দেখা দেয়। এই জন্যই এই উপন্যাসটি আমাদের মনকে এতটা আন্দোলিত করতে পারে। ডঃ সুকুমার সেনের মতে আমরা বলতে পারি যে – এই উপন্যাসের ঘটনা আড়ম্বর ও জটিলতা মুক্ত তবে কুটিলতাহীন নয়। নরনারীর অনুরাগ এখানে গঙ্গা যমুনার মতো সাদা–কালো দুই ধারায় প্রবাহিত। এই ধারা বিবাহ সম্ভূত গাঢ় প্রেমের অপর ধারা-রুপজ মোহজাত উৎকট বাসনার। তবে যুক্ত বেণীর মতো প্রয়োগে মিলিত হতে পারে নাই। বিষবৃক্ষ নামটি বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধতা সুচক নয়। রূপজ লালসাই হইল এই বিষবৃক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্র বিধবা বিবাহে সম্মত ছিলেন না। এইজন্যই সামজিক স্বীকৃতি দিতেই তিনি কুন্দকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেন। বঙ্কিম সমাজ স্বীকৃত বিবাহকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কুন্দকে মেরে ফেলার ছক কষেন। এইজন্যই উপন্যাসটি সামাজিক উপন্যাস।




তথ্যসূত্র

. বঙ্কিম রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র),শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ(কল্পতরু উৎসব)২০০৯,পৃষ্ঠা-২৩৪
.                   ঐ,    পৃষ্ঠা-২৩৪
.                  ঐ,    পৃষ্ঠা-২৩৫
.                   ঐ,    পৃষ্ঠা-২৪৭
.                  ঐ,    পৃষ্ঠা-২৫০
.                  ঐ,    পৃষ্ঠা-২৫০
.                   ঐ,    পৃষ্ঠা-২৫৩
.                  ঐ,    পৃষ্ঠা-২৫৪
. বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা,শ্রী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা-৭৩,নূতন পুনর্মুদ্রণ-২০০৮-২০০৯,পৃষ্ঠা-৬৫
১০. বঙ্কিম রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র),শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ(কল্পতরু উৎসব)২০০৯,পৃষ্ঠা-২৭০
১১.                  ঐ,    পৃষ্ঠা-২৭১
১২.                 ঐ,    পৃষ্ঠা-২৭৪
১৩.                 ঐ,    পৃষ্ঠা-২৭৮
১৪.                 ঐ,    পৃষ্ঠা-২৮২
১৫.                 ঐ,    পৃষ্ঠা-২৮৫
১৬.                 ঐ,    পৃষ্ঠা-২৮৫
১৭.    বঙ্কিম রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র),শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ(কল্পতরু উৎসব)২০০৯, ঐ,পৃষ্ঠা-২৮৫
১৮.                         ঐ,পৃষ্ঠা-২৯৬
১৯.                         ঐ,পৃষ্ঠা-৩০৬
২০.                         ঐ,পৃষ্ঠা-৩১০
২১.                         ঐ,পৃষ্ঠা-৩১৫

Friday, June 15, 2018

কবিতার দুলাইন



কবিতার দুলাইন

রূপেশ মাহাত
তোকে খুঁজি পুরানো গল্পে, ভাঙাচোরা উপন্যাসে
টিভির পর্দায়, দাম্পত্যে
কখনও সুবোধ পরামানিকের সেলুনে অব্যক্ত
কবিতার দুলাইনের ফাঁকে, চিৎকার করে
শুনিয়ে যাস্, নেই তুই শুক সারির দলে।

চায়ের দোকানে বসে বিনি পয়সায় রাস্তায়
দেখা তামাসা; বিড়ির ধোঁয়ায় হারিয়ে
যাওয়া ব্যথায়,
কখনও রাঙ্গামাটির দেশের বধ্যভূমির
রাঙ্গা পায়ের তলে কীট পোকারা ভোঁকাট্টা
বলে শুনিয়ে যায় তুই নেই 'বিদ্বজনের' দলে।

তবুও লগা দিয়ে পেড়ে নেব সমস্ত কোলাহল, দুর্বলতা,
পড়ে থাকবে ঝরে যাওয়া ফলে আমার সৃষ্টির বীজ বারণ।




মানসপত্র পত্রিকা, কলকাতা, ২৬ শে জানুয়ারী, ২০১৫ সাল

ঈশ্বর প্রতিভূ শিশু


ঈশ্বর প্রতিভূ শিশু

রূপেশ মাহাত
শীতের কালো চাদর নিয়ে নেমে এল
রাত্রির পসার, দূর থেকে শেয়াল, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,
প্যাঁচার আর্তনাদে ভেসে আসছে
শেষ বেলার গান।
লিওনার্দোর ঈশ্বর প্রতিভূ শিশু তখন ধীরে
ধীরে শয়তানে রূপান্তরিত হয়।
দামিনীর দেহে আঁচড়, মাটি ভেজা উষ্ণতার ক্ষরণে
হারিয়ে যাচ্ছে শীতল প্রাণ,
নগ্ন সকালে গোবরজল ছিটিয়ে
শুদ্ধ করার কাজে ছুটেছে কারা!
নুইয়ে পড়া শিউলি গাছ তখনও হাসছে,
বলছে তোদের সূর্যফোটা হাসি মিলিয়ে যাবে
আমার প্রসব যন্ত্রণায়।




মানসপত্র পত্রিকা, কলকাতা, ২৬ শে জানুয়ারী, ২০১৫ সাল