** আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত **

কিছু কথা....

আপনাদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ করতে হলে লেখাটি আমাকে ইমেইল করুন। আমি সেটা নির্দিষ্ট বিভাগে, আপনার নাম দিয়ে প্রকাশ করবো।

আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?

!! আমার ব্লগের সাথে যুক্ত থাকুন !!

ইমেইল এর মাধ্যমে সমস্ত পোষ্টের নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য, নিচের ফাঁকা ঘরে আপনার ইমেইল এড্রেস লিখে ‘সাবস্ক্রাইব’ বাটন-এ ক্লিক করুন।

Blank

Comming Soon

কবিতা সমগ্র

আমার নিজের ও কবিদের লেখা কবিতার সংরক্ষণ

Friday, July 27, 2018

কবে যে আমি বড়ো হব



কবে যে আমি বড়ো হব
মঙ্গলা বাউরী


কবে যে আমি বড়ো হব
                            দিদির মতন লম্বা হব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   দিদির মতন চুড়িদার পরব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   একলা একলা খেলতে যাব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   পার্কে গিয়ে ফুচকা খাব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   মোটা মোটা বই পড়ব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   ভূত পেতনির ছবি আঁকব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   বাসে চড়ে ঘুরতে যাব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   সব বড়োদের ফিলম দেখব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   ছোট ভাইদের পড়া ধরব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   গানের জলসা শুনতে পাব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   বড়ো অফিসে কাজ করব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   ছোট ছেলেদের তুমি বলব।
কবে যে আমি বড়ো হব
                                   সত্যিকারের বড়ো হব।
একটা কিছু করতে হবে
                                   যাতে নিজেই শান্তি পাব।
যদি দেখি আমার পাশে
                                   কেউ দুঃখে কাঁদছে বসে,
তার চোখের জল মোছাতে
                                   পারব না কি বড়ো হতে?



প্রকাশিত - আশা পত্রিকা (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ)

স্বপ্ন



স্বপ্ন
জগ্ননাথ পাল


স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন দেখি স্বপ্নকে নিয়ে,
স্বপ্ন ছিল জীবন সাজাই ভালোবাসা দিয়ে।।
দুচোখ খুলে আজ যে আমি স্বপ্নকে দেখি,
স্বপ্ন নিয়ে তাই আজকে এই কবিতা লেখি।।
জীবন শুধু জীবন নয়, স্বপ্নেরই এক দেশ,
স্বপ্নহীন মানুষ এখানে হয়েছে গো নিঃশেষ।।
যেখানে স্বপ্ন, সেখানে আশা, সেখানেই হবে জয়,
স্বপ্ন দেখে জীবন কাটাই, করি না তো তাই ভয়।।
স্বপ্ন তো এক জলপরীর মতো, সুন্দর অপরূপ,
স্বপ্ন যে হলো আবেগ প্রবণ জীবনেরেই স্বরূপ।।
জীবন তো এক ছোট্ট সময় স্বপ্ন দেখার জন্য
স্বপ্ন যেদিন স্বার্থক হবে সেদিন হব ধন্য।।



প্রকাশিত - আশা পত্রিকা (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ)

Thursday, July 26, 2018

আমি সেই মেয়ে




আমি সেই মেয়ে
প্রতিমা মাহাত

আমি সেই মেয়ে,
যার সমস্ত জীবনই পরাধীন
স্বাধীনতার সুখ যার অজানা
আমি সেই মেয়ে,
যে আগে ভাগ্যের কাছে পরাজিত
নিজের কাছে লাঞ্ছিত
আমি সেই মেয়ে,
লজ্জার অন্তরালে যার প্রেম
আজও অব্যক্ত।
আমি সেই মেয়ে,
যার জীবনে কোন লক্ষ্য নেই
শুধু বেঁচে থাকা ছাড়া,
আমি সেই মেয়ে,
যে এই পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে
কিন্তু প্রতিবাদহীন নিস্পৃহ।



প্রকাশিত - আশা পত্রিকা (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ)

বাংলা আমার




বাংলা আমার
রিমা ভট্টাচার্য্য

বাংলা আমার মাতৃভাষা
সবার চেয়ে সেরা।
সবুজ, শ্যামল এদেশ আমার
স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা।
বাংলা আমার মায়ের মুখে
মিষ্টি মধুর বোল।
কিংবা ক্ষেতে সদ্য পাকা
ধানের দোদুল দোল।
বাংলা আমার দূর অজানা
বাঁধন হারা ঘুড়ি।
বিশ্বব্যাপী এই ভাষাটির
নেই তো কোনো জুড়ি।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা
প্রাণের দোলায় গাঁথা।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে মোরা
পেয়েছি স্বাধীনতা।



প্রকাশিত - আশা পত্রিকা (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ)

দুর্গাপূজা



দুর্গাপূজা
বহ্নি চক্রবর্তী



বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে সবে
দুর্গাপূজা আসতে আর কতই দিন না আছে!
একটি পার্বণ আসে তো আর একটি পার্বণ যায়
সব বাঙালী বলে উঠে দুর্গাপূজা আয়।
মাঠ বন সব ভরে গেছে কাশফুল আর ঘাসে
টুকরো টুকরো মেঘগুলো যে আকাশ বেয়ে ভাসে।
ঢ্যাং কুড়কুড় ঢাকের আওয়াজ শিশুরা সব নাচে
দুর্গা মায়ের আশীর্বাদে মানুষরা সব বাঁচে।



প্রকাশিত - আশা পত্রিকা (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ)

বৃষ্টি





বৃষ্টি
শিউলি দাশ



বৃষ্টি মানে মাটির ভেজা গন্ধ,
বৃষ্টি মানে নতুন চলার ছন্দ।
বৃষ্টি মানে আকাশ ভাঙা সুখ,
বৃষ্টি মানে ঝাপসা তোমার মুখ।
বৃষ্টি মানে মেঘলা ভারী দিন,
বৃষ্টি মানে তোমার কাছে ঋণ।
বৃষ্টি মানে চোখের জলের দাগ,
বৃষ্টি মানে স্মৃতির অনুরাগ।
বৃষ্টি মানে নিঝুম দু-চোখ বেয়ে,
বৃষ্টি মানে বৃষ্টি ভেজা মেয়ে।



প্রকাশিত - আশা পত্রিকা (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ)

যদি না থাকত




যদি না থাকত
সুমন সাহানা


যদি না থাকত
ছাতা?
বল কী করে বাঁচত
মাথা।
যদি না থাকত
জুতো?
তবে কী পরে বেরোত
ভুতো।
যদি না থাকত
গাড়ি?
বাবা কী চড়ে ফিরত
বাড়ি।
যদি না থাকত
ফোন?
কথা বলত কী করে
বোন।
যদি না থাকত
টিভি?
"চুপ, খবর শুনতে
দিবি।"
পৃথিবীই নেই,
বেশ,
তবে শুরু কোথা?
সব শেষ।


প্রকাশিত - আশা পত্রিকা (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ)

Monday, July 23, 2018

‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


‘গৃহদাহ’ উপন্যাসটি অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এক অনবদ্য সামাজিক দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস। ত্রিকোণ প্রেম যে নরনারীর জীবনে কি ভয়াবহ পরিণতি ঘটতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমান এই উপন্যাসটি। ত্রিকোণ প্রেমের মধ্য দিয়ে যে সমাজে নরনারীর জীবন যে কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে তা উপন্যাসটিতে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গুলি হল মহিম,সুরেশ,অচলা ও কেদারবাবু। উপন্যাসের শুরুতেই দেখতে পাই মহিম ও সুরেশ খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তারা একে অপরকে ছাড়া পরিপূর্ণ ছিল না। সুরেশ ধনীর সন্তান কিন্তু মহিম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দুই বন্ধুর মধ্যে ব্রাহ্ম মেয়ে অচলার উপস্থিতি তাদের সুসম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরতে শুরু করে। মহিম অচলাকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন একদিনের জন্যেও সুখের হয়নি। কারণ অচলার সঙ্গে সুরেশরও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই এই তিনজনের মধ্যে একটা ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরই পরিণামে মহিম অচলার দাম্পত্য জীবনে গভীর অশান্তির সৃষ্টি হয়। আমরা এই উপন্যাসে মহিম ও অচলার দাম্পত্য কলহের চিত্রগুলি সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার প্রচেষ্টা করব। ডঃ সুকুমার সেনের মতে - “গৃহদাহের সমস্যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও কৃত্রিম, এবং প্লটপরিকল্পনার শৈথিল্যে সে কৃত্রিমতা ঢাকা পড়িতে পারে নাই। স্বামিনিষ্ঠা হইতে যে প্রেম নারী হৃদয়ে জন্মায় তাহার মূল সুদুরবিসারী, তাহা প্রতিদিনের ভুলভ্রান্তি মান-অভিমান সহ্য করিয়া টিকিয়া থাকে, এবং অবস্থার বিপাকে এমন নারীর দেহ অশুদ্ধি ঘটিলেও তাহার পাতিব্রত্যের হানি হয় না। ইহাই গৃহদাহের তত্ত্বকথা।”১৮ উপন্যাসের শুরুতেই আমরা লক্ষ্য করি মহিম ও সুরেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তারা একে অপরকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসত। হঠাৎ দেখা যায় মহিম এক ব্রাহ্ম মেয়ে অচলার প্রেমে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনা শুনে সুরেশ মহিমকে এই বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু মহিম সুরেশের কথাতে কোন গুরুত্ব না দিয়ে অবিচল থেকে যায়। মহিমের এই স্থির মনোভাব লক্ষ্য করে সুরেশ তাই রেগে গিয়ে বলতে পারে - “তুমি সমস্ত জগতের বরেণ্য পূজনীয়, হিন্দুর সন্তান হয়ে কিনা একটি রমণীর মোহে জাত দেবে।”১৯ সুরেশের এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে সুরেশ নিজের ধর্ম সম্পর্কে কতটা সচেতন। সুরেশ এর পর মহিমকে নানারকম বিদ্রুপ করতে ছাড়েনি। তাই সুরেশ মহিমকে তার ভবিষ্যৎবানী করে বলতে পারে - “কিন্তু দুঃসময়ে সে যদি না তোমাকে ছেড়ে চলে আসে ত আমার নামের বদলে যা ইচ্ছে বলে ডেক, আমি দুঃখ করব না।”২০ সুরেশ মহিমকে একথাও বলতে ভুলেনি যে সে তার মঙ্গল ভিন্ন কখনো অমঙ্গল কামনা করতে পারেনি। সুরেশ এরপর মহিমকে একমাস সময় দিল যেন এই সময়ের মধ্যে সে অচলার সঙ্গে কোন দেখাশুনা না করে। এই সময়ের মধ্যে সে মহিমের জন্য ভালো মেয়ের সন্ধান করতে থাকে। এই সময়ে সুরেশ যদি মেয়ের সন্ধান দিতে না পারে তবে সে তাকে বলে তোমার যা ইচ্ছে তাই হবে। এই কথা শুনে মহিম কোন কথাই বলল না। কিন্তু সুরেশ যে মহিমের শুভকামনায় কিরূপ মর্মান্তিক বিচলিত হয়েছে, তা মহিম সম্পূর্ণভাবে অনুমান করতে পারে। সুরেশ মহিমের ব্রাহ্ম মন্দিরে যাওয়া নিয়ে বিদ্রুপ করতে থাকে। সুরেশ ছিল নাস্তিক, অর্থাৎ ঠাকুর দেবতায় সে বিশ্বাস করত না। মহিম তাই সুরেশকে খোঁচা দিয়ে বলতে থাকে যে তুমি তো ঠাকুর দেবতা মান না তাহলে আমি ব্রাহ্মের মন্দিরে যাই আর হিন্দুর মন্দিরে যাই, তাতে তোমার কি আসে যায়। এই প্রশ্নের উত্তরে সুরেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলে - “যা নেই তা আমি মানিনে। ভগবান নেই , ঠাকুর দেবতা মিছে কথা! কিন্তু যা আছে, তাদের তো অস্বীকার করিনে। সমাজকে আমি শ্রদ্ধা করি, মানুষকে পূজা করি। আমি জানি মানুষের সেবা করাই মনুষ্য জন্মের চরম সার্থকতা। যখন হিন্দুর ঘরে জন্মেছি তখন হিন্দু সমাজ রক্ষা করাই আমার কাজ।”২১ সুরেশের এই কথার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি যে সুরেশ তার ধর্মকে অন্তর থেকে কতটা ভালবাসে। তাই সে একথাও বলতে ভোলেনি যে প্রান থাকতে আমি তোমাকে ব্রাহ্ম ঘরে বিবাহ করতে দেব না। কিন্তু এইসব কথা শুনেও মহিম কিন্তু নিজের সিন্ধান্তে অটল থেকে যায়। সুরেশ মহিমকে এরপর বলে ব্রাহ্মরা আমাদের সমাজকে সন্দ বলে ফেলে গেছে। এই কারণের জন্যেই সুরেশ ব্রাহ্মদের একেবারে সহ্য করতে পারে না। সুরেশের এই কথা শুনে মহিমের দৃঢ়চেতা মন কিছুটা কোমল হতে শুরু করে।

এই ঘটনার কিছুদিন পর সুরেশ মহিমের বাসায় এসে খবর পেল যে মহিম সকালবেলা বাইরে বেরিয়েছে কিন্তু এখনো ফিরে নাই। এই কথা শুনে সুরেশ মনে মনে অনুমান করল যে মহিম নিশ্চয় পটল ডাঙ্গায় কেদার মুখুজ্যের বাড়ীতে অচলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। এই কথা সন্দেহ করতে তার মনে কোন সংশয় দেখা যায় না। তাই সে তখন মহিমের প্রতি রেগে বিদ্বেষে জ্বলতে থাকে। এই অবস্থায় সুরেশের বুকের মধ্যে আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাতের মত প্রজ্জলিত হয়ে উঠল। সে তৎক্ষণাৎ কোন বিচার বিবেচনা না করেই গাড়িতে উঠে পটলডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সুরেশ সেখানে গিয়ে খবর পেল যে মহিম আজ দশ বারো দিন সেখানে আসেনি। এই কথা শুনে সুরেশের উত্তপ্ত মন কিছুটা হলেও শীতল হয়ে গেল। সুরেশ এরপর কেদার মুখুজ্যের সঙ্গে মহিমের বিষয়ে বিশদে আলোচনা করতে লাগল। মহিমের একমাত্র সম্বল একটা ভাঙ্গা চালের বাড়ী ছাড়া তেমন কোন কিছু নেই তা সুরেশ কেদারবাবুকে জানিয়ে দেয়। এই কথা শুনে কেদারবাবু অবাক হয়ে যায়। তিনি এইসব সম্বন্ধে যে জ্ঞাত নয় তা সুরেশকে জানায়। এছাড়াও মহিমের আর্থিক পরিস্থিতি এবং নানারকম আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি সুরেশ সুস্পষ্টভাবে কেদারবাবুকে জানিয়ে দেয়। কেদারবাবু সুরেশের এইসব কথা শুনে হতচকিত হয়ে যান। তাই মহিমের প্রতি কেদারবাবুর বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। সুরেশ এইসব গোপন কথা কেদারবাবুকে জানিয়ে দিয়ে তার কাছে খুব প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। সুরেশ ও কেদারবাবুর এইসব কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ অচলা প্রবেশ করে। অচলাকে দেখে সুরেশ মুগ্ধ হয়ে যায়। অচলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে সুরেশ তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হতে শুরু করে। সুরেশের কথা শুনে কেদারবাবু মহিমের প্রতি কতটা বিরূপ হয়েছিল তা তার কথাতেই অনুমান করা যায়। যখন তিনি অচলাকে বলেন – “কে জানত, সে এমন বিশ্বাসঘাতক, এমন মিথ্যাবাদী।”২২ বাবার মুখে এই কথা শুনে অচলার মুখ পাণ্ডুর হয়ে গেল। কারণ অচলা মহিমকে আন্তরিক ভাবে খুব ভালবাসত। তাই ভালোবাসার মানুষের প্রতি এই অকথ্য কথা শুনে তার খুব খারাপ লাগল। অচলা নিজে মহিমকে খুব বিশ্বাস করত। কারণ অচলাকে মহিম তার দুরাবস্থার কথা গোপন রাখেনি। তাই তাকে বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যাবাদী বলাতে অচলার অসহ্য যন্ত্রণা হয়ে থাকে।

সুরেশের মুখে মহিম সম্পর্কে এই কথাগুলি শুনে কেদারবাবু সুরেশকে খুব বিশ্বাস করতে লাগল। তাই সুরেশের প্রতি কেদারবাবুর একটা দূর্বলতা দেখা দিল। সুরেশ এই ব্যাপারটা অনুমান করে সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে এরপর প্রতিদিন কেদারবাবুর গৃহে যাতায়াত করতে লাগল। দিনে দিনে কেদারবাবুর সাথে সুরেশের সম্পর্কের উন্নতি হতে লাগল। এই বাড়ীতে নিত্য নৈমিত্তিক আসা যাওয়া করার সুবাদে সুরেশ ও অচলার মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হতে লাগল। প্রথম প্রথম অচলা সুরেশের মুখে মহিমের সম্পর্কে খারাপ কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারত না। কিন্তু সুরেশ অনেকরকম কলাকৌশলে অচলাকে মহিমের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করে। এইজন্যই সুরেশ অচলাকে বলে - “সে যে আপনাকে একখানা অস্বচ্ছল ভাঙা মেটে বাড়ীতে টেনে নিয়ে যেতে চায়, সে কথা কি আপনাকে তার বলা কর্তব্য নয়?”২৩ সুরেশ এই কথা গুলি বলে অচলার মনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু অচলা এই কথা শুনে কোন উত্তরই দেয় না। অচলার জবাব না পেয়েও সুরেশ অনুমান করল যে তার কথায় কাজ হয়েছে। অর্থাৎ অচলাকে মহিমের প্রতি কিছুটা হলেও বিরূপ মনোভাব তৈরি করতে সে সক্ষম হয়েছে। সুরেশ এরপর অচলার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি দেখাবার চেষ্টা করে। সুরেশ অচলার কাছে জানতে পারে যে অচলাকে মহিম তার সব খবরই পূর্বেই জানিয়ে দেয়। অচলার মুখে এইসব কথা শুনে সুরেশ লজ্জায় পড়ে যায় এবং নিজেকে অপরাধী মনে করে অচলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু অচলা সুরেশের এই আচরণে নিজেকে লজ্জিত মনে করে। তাই অচলা সুরেশকে বলে যে মহিমের সম্বন্ধে আপনার কোন কাজই আমি অন্যায় বলে ভাবতে পারিনি। অচলার মুখে এই কথা শুনে সুরেশের মনের জোর বেড়ে যায়। এছাড়াও অচলা সুরেশকে মাঝে মাঝে তাদের বাড়ী আসার জন্য অনুরোধ করে। এই কথা শুনে সুরেশ মনে মনে খুব আনন্দিত হয়। কারণ এই সুযোগটাই সে প্রার্থনা করছিল। এখান থেকে সুরেশ বাড়ী ফিরে সেখানে মহিমকে দেখে অবাক হয়ে গেল। মহিম তখন জানায় সুরেশ যেহেতু তার বাড়ীতে খোঁজ করতে গিয়েছিল তাই সে তার সাথে দেখা করতে এখানে এসেছে। সুরেশ যে পটলডাঙ্গায় কেদারবাবুর বাড়ীতে গিয়েছিল এই কথা মহিমের কাছে গোপন করে দেয়। সুরেশ তখন মহিমকে অনুরোধ করে কাল একবার পটলডাঙ্গায় যাওয়ার জন্য। উত্তরে মহিম বলে যে কাল সকালের গাড়িতে সে বাড়ী চলে যাবে। সুরেশ কিন্তু কাল তাকে সেখানে যাবার জন্য অনেক অনুরোধ করে। সুরেশের এই বারবার অনুরোধ করার কারণটা মহিমের মনে একটা খটকা লাগে। মহিমকে রাজী করাতে না পেরে অবশেষে সুরেশ নিজে গিয়ে মহিমের কথা সেখানে বলে আসার জন্য অনুমতি চায়। সুরেশের এই কথা শুনে মহিম অবাক হয়ে যায়। এর যথার্থ কোন কারণ সে অনুমান করতে পারে না।

সুরেশ মনে মনে অসংশয় অনুভব করতে লাগল যে এই কয়দিন মহিম যে অচলার কাছে যায় নি তা তার অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারে নাই বলেই তা সম্ভব হয়েছে। এই কথা অনুভব করে আজ আর তার ভালো লাগল না। কারণ একদিন না একদিন হাসি গল্পে উপহাসে সব কথা অচলার কানে গিয়ে পৌঁছাবে। তখন সব জেনে গিয়ে অচলা সুরেশকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকবে। এইসব কথা চিন্তা ভাবনা করে সুরেশের ভিতর কাঁপতে লাগল। তাই সে এই সমস্যার সমাধান করার জন্য সকালবেলায় কেদারবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হল। সুরেশ সেখানে গিয়ে খবর পেল যে কেদারবাবু বাড়ীতে নেই কিন্তু অচলা বাড়ীতেই আছে। সুরেশের প্রয়োজন তো অচলার সঙ্গেই তাই সে মনে মনে খুব খুশি হল। বেয়ারা খবর দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে সুরেশের কাছে অচলা প্রবেশ করল। সুরেশ প্রথমেই অচলাকে জানায় যে মহিমকে সে এখানে আসার জন্য অনেক অনুরোধ করলেও তা অগ্রাহ্য করে সে বাড়ী চলে গেল। উত্তরে অচলা জানায় তার বাড়ীতে বিশেষ কোন কাজের জন্য হয়তো সে যেতে বাধ্য হয়েছে। অচলার এই কথা শুনে সুরেশ কিন্তু খুশি হয়নি। কারণ সে চেয়েছিল যে এই কথা শুনে অচলা উত্তেজিত হয়ে উঠবে। তাই সে অচলাকে পুনরায় জানায় যে দু এক মিনিটের জন্য এখানে এসে আপনাকে তা বলে যাওয়া তার কর্তব্য ছিল। সুরেশের এই কঠিন কথা শুনেও কিন্তু অচলা মহিমের প্রতি যথেষ্ট আস্থা দেখায়। অচলার এই অবস্থা দেখে সুরেশ ভিতরে ভিতরে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যায়। তাই সে তখন অচলার প্রতি নিজের আস্থা অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই সে অচলাকে বলে যে মহিম ও আপনাকে আমি পৃথক করে দেখিনে। আপনারা দুজনেই আজ থেকে আমার অভিন্ন। অচলার প্রতি এই সহানুভূতি দেখিয়ে সুরেশ অচলার মনে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করেন। উত্তরে অচলা জানায় যে – “আপনাকে যাচাই করার শুভদিন না আসা পর্যন্ত আমি কিন্তু আপনার বন্ধুকেই দোষী করতে পারব না সুরেশবাবু।”২৪ সুরেশ এরপর অচলার সহানুভূতি পাওয়ার জন্য অতিতে সে মহিমের যে উপকার করেছিল তার বিশদ বর্ণনা দিতে লাগল। সুরেশ নানারকম ভাবে মহিমের দোষ ত্রুটি আলোচনা করে অচলাকে বিরক্ত করার প্রচেষ্টা করল। কিন্তু মহিমের ভুল ত্রুটিকে অচলা তেমন কোন গুরুত্ব দিতে বাধ্য হল না। তাই সুরেশ অশ্রুকণ্ঠে বলতে পারে - “যখন জনেনই তখন এই ভিক্ষা আজ আমাকে দিন যে, অজ্ঞানে যে শত্রুতা আপনাদের করেছি, সে অপরাধ আর যেন আমার বুকে না বেঁধে।”২৫ সুরেশের এই কথা অচলার নিজের অন্তরটা যেন দুলে উঠে। অচলা তার অশ্রুকে আর বাগ মানাতে পারল না। কেদারবাবু হঠাৎ চলে এলে তাকেও সুরেশ মহিমের বাড়ী যাবার খবর জানিয়ে দেয়। মহিমের কথা শুনে কেদারবাবু রেগে যায়। কেদারবাবুর এই আচরণ দেখে সুরেশ ভিতরে খানিকটা খুশি হয়। অচলার মতো কেদারবাবুও সুরেশকে মাঝে মাঝে তাদের বাড়ী আসার জন্য অনুরোধ করে। সুরেশের কাছে যে তিনি কৃতজ্ঞ তা বারে বারে কেদারবাবু বলতে লাগলেন। সুরেশ এরপর প্রায় দিনই কেদারবাবুর বাড়ীতে যাতায়াত করতে লাগল। অচলার সঙ্গে সুরেশের মেলামেশাতে তাদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরি হতে দেখা যায়। যে ব্রাহ্মদের সুরেশ এক মুহূর্ত দেখতে পারত না সেই ব্রাহ্ম মেয়ে অচলার প্রতি দূর্বলতাবশতঃ সে ব্রাহ্ম ঘরে খাওয়া দাওয়া করতেও লাগল। এতেই বোঝা গেল যে অচলার প্রতি সুরেশ কতটা অনুরক্ত হয়ে উঠেছিল। অচলাকে যে সে অনেক গুরুত্ব দিয়ে মান্য করত সে কথা সুরেশ অচলার কাছে প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করল না। সুরেশের এই কথা শুনে অচলা হতচকিত হয়ে গেল। সুরেশ অচলার প্রতি এতটাই পাগল হয়ে উঠেছিল যে অচলার হাত ধরতেও তার কোন কুণ্ঠাবোধ হয়নি। সুরেশ অচলাকে কাছে টেনে দিতেই অচলা সুরেশের গায়ের উপর এসে পড়ল। এই আলিঙ্গন অবস্থায় অচলা নিজেকে লজ্জিত বোধ করল। সুরেশের এই ব্যাবহারে আমরা বুঝতে পারি যে সুরেশ অচলার প্রতি কতটা গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। সুরেশের আলিঙ্গনে কিন্তু অচলাকে আমরা বাধা দিতে লক্ষ্য করিনি। তাই এই আচরণের জন্য অচলার ক্ষীণ হলেও যে সহমত ছিল তা বলা যায়। কেদারবাবু হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করলে অচলা ভয়ে তাদের আলিঙ্গন জোর করে ছাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে। অচলার প্রতি মোহের বশে সুরেশ কেদারবাবুর বাড়ীতে খাবার খেতেও বাদ দিল না। আহারাদির পর সুরেশ কেদারবাবুর বাড়ীতে বিশ্রাম নিলেন। কিন্তু সুরেশের ঘুম এল না। ঘরের বাইরে মধ্যাহ্ন সূর্য আকাশে জ্বলতে লাগল এবং ভিতরে আত্মসংযমের আত্মগ্লানি ততোধিক ভীষণ তেজে সুরেশের বুকের ভিতর জ্বলতে লাগল। এমনি করে সমস্ত বেলাটা অন্তরে বাইরে পুড়িয়া আধমরা হয়ে যখন সে উঠে বসল তখন জানালা খুলে দেখল যে, তখন বেলা পড়ে গেছে। কেদারবাবু এসে তাকে ঘুমের কথা জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে জানায় যে দিনে তার ঘুমের অভ্যেস নেই তাই সে ঘুমোতে পারেনি। কেদারবাবু এরপর সুরেশের কাছে অনুমতি নেয় যে কোন গড়িমসি না করে সবকিছু স্পষ্ট করে মহিমকে একটা চিঠি লিখে জানানো প্রয়োজন। কেদারবাবুর এই কথাটা শুনে সুরেশের পিঠের উপর মর্মান্তিক চাবুকের মতো যেন মারল, তাই সে তৎক্ষণাৎ চমকে উঠল। সুরেশের এই আচরণ দেখে কেদারবাবু সুরেশকে বলে যে নিষ্ঠুর কর্তব্য কি করে করতে হয় তা তো তুমিই আমাকে শিক্ষা দিয়েছ। অতএব এখন তো তোমার এখান থেকে পিছন ফিরলে চলবে না। কেদারবাবুর এই কথাকে সহমত জানিয়ে সুরেশ বলে যে এই ব্যাপারে অচলার মতামত একবার নেওয়া প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্তে অচলার যে পুরোপুরি মতামত আছে তা কেদারবাবু সুরেশকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। তাই আজ রাতের মধ্যে এই কাজটা কেদারবাবু সেরে ফেলতে চান। সুরেশ তখন বলে যে এত তাড়াহুড়ো না করে দু একদিন দেখে নেওয়া দরকার। সুরেশের এই কথা শুনে কেদারবাবু রেগে গিয়ে বলে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আর কোন প্রয়োজন নেই। কারণ মহিমের সব জেনেশুনে কেদারবাবু আর তার হাতে মেয়েকে সমর্পণ করতে পারবেন না। তাই এই বিশ্রী ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করা যায় ততই মঙ্গল। সুরেশ তখন ভয়ে তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে এতে কেদারবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যায়। এই কথা শুনে সুরেশের মুখ দিয়ে একটা আরামের নিঃশ্বাস পড়ল। কিন্তু সে আর কোন কথা না বলে প্রায় চুপচাপ থেকে গেল। কেদারবাবু সুরেশের আচরণে সম্পূর্ণ ব্যপারটা মনে মনে অনুমান করতে পারলেন। এই অনুমান যাচাই করার জন্য সে অন্ধকারে ঢিল ফেলিল। সুরেশ যে তার কত উপকারী বন্ধু সেকথা কেদারবাবু বারবার সুরেশকে জানাতে ভুললেন না। কেদারবাবুর এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরেই আবার বলে যে এর চেয়েও তারা দুজন তার কাছে বড় উপকার প্রত্যাশা করছেন। কেদারবাবুর এই কথার অর্থ সুরেশ বুঝতে পারে না। কেদারবাবু একথা বলতেও ভোলেনি যে তারা ব্রাহ্ম হলেও তার মেয়ে অচলা কিন্তু মনে প্রানে হিন্দুই রয়ে গেছে। কেদারবাবুর এই কথা শুনে সুরেশ কিছুটা অনুমান করতে পারে। কেদারবাবু আরও বলে অচলা যে ব্রাহ্মগিরি একেবারেই পছন্দ করে না। কেদারবাবুর এই কথা বলার মূল উদ্দেশ্যটা সুরেশ পুরোপুরি আন্দাজ করতে পারে তাই সে একথা শুনে বিস্ময়ে মুখ তুলে চায়। কেদারবাবু এরপর সরাসরি সুরেশকে বলে যে মেয়ের একটি সম্বন্ধ যেমন তোমার হাতে ভেঙ্গে গেল তেমনই আর একটি নতুন সম্বন্ধ তোমাকেই গড়ে তুলতে হবে। সুরেশ এতে রাজী হয় এবং তা করার জন্য সে যে প্রাণপণ চেষ্টা করবে তা বলতে দ্বিধা করে না।

কেদারবাবু সমাজের গোলযোগের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য খুব তাড়াতাড়ি অচলার বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু তিনি জানেন যে অচলা একগুঁয়ে মেয়ে তাই তার মতামত না নিয়ে একাজ সম্পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ কেদারবাবু ভালোভাবেই জানতেন যে অচলা খুব সহজে মহিমকে ত্যাগ করবে না। তাই অচলার বিয়েতে তার মতকেই তিনি প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেন। কেদারবাবুর এই কথা শুনে সুরেশের মনে আবার আঘাত লাগলো, তাই সে অচেতন হয়ে গেল। দুপুরের সময় তার নিজের উচ্ছৃঙ্খল প্রণয় নিবেদনের বীভৎস আচরণ স্মরণ করে নিদারুণ লজ্জায় সমস্ত মুখ তার রাঙা না হয়ে কালিবর্ণ হয়ে গেল। সুরেশের এই অন্যমনস্কতা দেখে কেদারবাবু নতুন একটা চাল চেলে সুরেশকে বিশ্বাসী বলে মহান করে তুললেন। কেদারবাবু বলেন যাকে সারাজীবন কাছ থেকেও একতিল বিশ্বাস হয় না কিন্তু তোমাকে দু-ঘণ্টার মধ্যে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হয়। কেদারবাবু যে তার মনের গোপন কথা নিঃসংশয়ে তাকে বলতে পারে একথা সরাসরি তার কাছে স্বীকার করে নেয়। নিজের দুর্দশা দুরবস্থার কাহিনী বন্ধুবান্ধব থাকতে সুরেশকে বলতে তার কোন সংকোচবোধ হয় না। কেদারবাবু এর জন্য গুঢ় কারণকেই দায়ী করে। কেদারবাবু তাই তার নিজের ব্যক্তিগত সমস্ত অভাব অভিযোগের কথা তার কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। বর্তমানে তার আর্থিক পরিস্থিতির কথাও তিনি সুরেশের কাছে গোপন করলেন না।এই অভাব অভিযোগের মধ্য দিয়েও তিনি যে খুব কষ্ট করে তার মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলেছেন একথা জানাতেও ভোলেনি। তার এই আর্থিক অনটনের কথা তিনি আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি কিন্তু সুরেশকে বিশ্বাসী মনে করে সবকিছু খোলা মনে জানিয়ে দেন। কেদারবাবুর এই আচরণে আমরা অনুমান করতে পারি যে তিনি সুরেশকে খুব কাছের মানুষ ভাবতে শুরু করেন। এই কথাটিই কেদারবাবু সুরেশকে পরোক্ষ ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমরা পূর্বেই জেনেছি যে সুরেশ হল পরোপকারী। অন্যের বিপদে সে নিজেকে সে স্থির রাখতে পারে না সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানেও তার বিরুদ্ধাচরণ ঘটতে দেখা গেল না। কেদারবাবুর আর্থিক অবনতির কথা শুনে সুরেশ জানতে চাইল যে বর্তমানে তার ঋণের পরিমাণের কথা। কেদারবাবু সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলে যে এখন তার ঋণের পরিমাণ হল তিন-চার হাজার টাকা। এই কথা শুনে সুরেশ তৎক্ষণাৎ তা দিয়ে সাহায্য করার কথা ঘোষণা করল। কেদারবাবু তার এই কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। তাই সে সুরেশকে যে জামাতা করতে ইচ্ছুক তা ইঙ্গিতে জানিয়ে দেন। এই কথা শুনে সুরেশ ও অচলা দুজনেই সে সময় লজ্জায় পড়ে যায়। কেদারবাবু এরপর পরেরদিন সুরেশকে এখানে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করে দেয়। ফলে আমরা লক্ষ্য করি যে প্রায় দিনই সুরেশ তার বাড়ীতে আসা যাওয়া শুরু করে দেয়। তাই অচলার সঙ্গে সুরেশের মেলামেশিতে একটা গভীর সম্পর্কের ভীত গড়তে শুরু করে।

কেদারবাবু সুরেশকে যে কি বন্ধনে বান্ধতে চাইছেন তা সুরেশ সবকিছু বুঝতে পেরে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে না বোঝার ভান করে অচলার কাছে জানতে চায়। কারণ সে অচলাকে জিজ্ঞাসা করে অচলার মনের কথাটা যাচাই করার চেষ্টা করে। কিন্তু অচলা এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর দেয়নি। সুরেশ তখন সঠিক উত্তর না পেয়ে অচলাকে বলে যে তোমার বাবা যদি আমাদের বিয়ে দিতে সম্মত হয় তাতে তোমার মত আছে কিনা? সুরেশের এই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ অচলা নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেয় যে তাকে বিয়ে করা তার কোনদিনই সম্ভব নয়। এইভাবেই কৌশলে সুরেশ অচলার মন বোঝার চেষ্টা করে। তাই সুরেশ বুঝে যায় যে অচলাকে তার নিজের করে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই কথা শুনে সুরেশের মন হতাশ হয়ে যায়। এরপর অচলা দীপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দেয় সে মহিমকে যদি না পায় তবুও কোন অবস্থাতেই সে সুরেশকে মনের কোনে স্থান দিতে পারবে না। অচলার এতবড় অহংকারের কথা শুনে সুরেশ মনে খুব আঘাত পায়। কিন্তু সুরেশ তার দুঃখের কথা অচলার কাছে প্রকাশ করে না। এরপর অচলা ও সুরেশের মধ্যে কেদারবাবুকে টাকা ধার দেওয়ার ব্যপারে কিছুক্ষণ আলোচনা চলল। অচলা সুরেশকে বলে যে তুমি আমাকে নিজের করে না পেলে হয়তো আর বাবাকে অতগুলো টাকা ধার দিতে চাইবে না। অচলার এই কথা শুনে সুরেশ রাজী হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে যে তোমাকে আমি পাই বা না পাই তোমার বাবাকে যে টাকা দেব বলে কথা দিয়েছি তা দেবই। সুরেশ এরপর বলে যে আমি যে কোন মানুষকে বিপদে পড়লে সাহায্য করে থাকি। তাতে আমি কোন স্বার্থ দেখি না। সুরেশ এই কথার দ্বারা বোঝাতে চায় যে সে পরোপকারী। সে অচলাকে একথাও বলে সে খুব বেশি ভদ্রলোক না হলেও খুব বেশি ছোট নয়। তাই সে কেদারবাবুকে সাহায্য করতে চেয়েছে যখন সে তা জীবন দিয়েও করবে। এই সাহায্যে যে অচলার কোন গুরুত্ব নেই তা সুরেশ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে দেয়। এই কথার মধ্য দিয়ে সুরেশ যে একজন মহৎ ব্যাক্তি তাই সে অচলার কাছে ব্যক্ত করে। কারণ এই কথা ভেবে যদি অচলা তার প্রতি কিছুটা হলেও আকৃষ্ট হয় এই কৌশল তাই সে ব্যবহার করল। কিন্তু সে জানায় যে কেদারবাবু এরপর এই টাকাটা তার কাছে নিতে রাজী হবেন কিনা এটাই তার এখন সন্দেহ হচ্ছে। সুরেশ যে অনেক টাকার মালিক, তাই তার এই ক্ষুদ্র টাকা ফেরৎ না পেলেও কিছু আসে যায়নি। একথা সে অচলাকে সগর্বে জানিয়ে দেয়। এই টাকাটা যদি অচলার সুখের জন্য কোন কাজে লাগে তাহলে তা ভেবে সে নিজেকে খুব সুখী মনে করবে। সেই কাজে এই টাকাটা দিতে সুরেশের মনে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ হবে না। এই কথার দ্বারা সুরেশ বোঝাতে চাইল যে সে অচলাকে অন্তর থেকে কতটা ভালোবাসে। তাই সে অচলার সুখের জন্য যে কোন স্বার্থত্যাগ করতে পারে।

কেদারবাবুকে টাকাটা দেওয়া পর্যন্ত অচলা যেন তার মতামতের কথা বাবাকে না জানায় তার জন্য সুরেশ তাকে বারবার অনুরোধ করে। অচলা যে টাকার লোভে এই বিয়েতে মত দিল না একথা শুনে তার প্রতি সুরেশের শ্রদ্ধা যে আরো বেড়ে গেল তা দৃঢ়কণ্ঠে বলে। অচলা এই বিয়েতে মত দিলে সুরেশ যে ভয়ে পিছিয়ে দাঁড়াত একথা বলতেও সে দ্বিধা করেনি। তার যে, কোন কাজেই অসম্ভব নয় তা সুরেশ জানিয়ে দেয়। এই কথাগুলির মধ্য দিয়ে সুরেশ অচলার কাছে সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করে। তাছাড়া সে যে একজন সৎ ব্যাক্তি তাও জানাতে চায়। সুরেশ এরপর তার কৃতকর্মের জন্য ব্যথিত হয়ে অচলার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেয়। সুরেশ চলে যাবার পর অচলার দুই চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। সুরেশকে যে অচলা মনের কোনে একটা জায়গা দিয়ে ফেলেছিল তা এই ঘটনার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি। অচলা প্রথম থেকেই মহিমকে মনে প্রানে ভালোবাসত অন্যদিকে আবার নতুন করে সুরেশের সঙ্গে সংস্পর্শে আসার ফলে তাকেও মনে খানিকটা জায়গা দিয়ে ফেলেছিল। এইজন্য অচলার মন দোলাচল প্রবৃত্তিতে ভরে উঠেছিল। অচলার মনে দোলাচল প্রবৃত্তির ফলে শুধু তার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল তাই নয় সাথে সাথে মহিম ও সুরেশের জীবনেও গভীর প্রভাব দেখা যায়। কেদারবাবু বাড়ীতে এসে যখন অচলার কাছে জানতে পারে যে সুরেশ চলে গেছে তাছাড়া কালকে এখানে আসার জন্য অচলা বলেনি। তৎক্ষণাৎ কেদারবাবু রেগে গিয়ে অচলাকে খুব তিরস্কার করেন। অচলা এরপর বাবার কাছে জানতে চায় যে কোন শর্তে তিনি সুরেশবাবুর কাছে টাকাটা নিতে চাইছেন। এই কথা শুনে কেদারবাবু হতভম্ব হয়ে কোন উত্তর দিতে পারেনি। এরপর পিতা ও কন্যার মধ্যে টাকা নেবার রহস্য নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। কেদারবাবু যে সুরেশকে অচলার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছেন তা তিনি ইঙ্গিতে মেয়েকে জানিয়ে দেন। অচলা পিতার উদ্দেশ্যের কথা সব বুঝতে পেরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অচলা সমস্ত ব্যপারটা গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত মনের মধ্যে স্পষ্ট করে উপলব্ধি করবার জন্য সেখানেই স্তব্ধ হয়ে গেল। অচলা তখন গভীরভাবে ভাবতে লাগল যে দুজন বন্ধু আজ তার মনের মধ্যে স্থান নিয়েছে তাদের যে কোন একজনকে তাকে ত্যাগ করতেই হবে। কিন্তু দুজনের মধ্যে কাকে সে ত্যাগ করবে তা ভেবে পায় না। এই নিয়ে তার মনের মধ্যে দোলাচলতার সৃষ্টি হয়। কারণ মহিমের সঙ্গে তার অনেকদিনের পরিচয়। মহিমের সঙ্গে সে মনেপ্রাণে জড়িয়ে তাকে যে জীবনের প্রিয়পাত্র হিসাবেই মনে করে নিয়েছিল। তাই সে মহিমকে ত্যাগ করার কথা এর পূর্বে কখনো ভাবেনি। অন্যদিকে কিছুদিন ধরে সুরেশের সাথে পরিচয়ের ফলে অচলার তার সাথে একটা বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠে। সুরেশের পরোপকারী মহান ব্যক্তিত্বকে মনে করেও অচলা তাকে কিছুটা হলেও ভালোবেসে ফেলে। তাই তাকেও ত্যাগ করতে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।

পূর্বের কথামতোই সুরেশ কেদারবাবুকে টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন। এইজন্য কেদারবাবুর ভাবগতিক মনে হয় যে তার মনের এত স্ফূর্তি বুঝি যুবক বয়সেও ছিলনা। তার ফলে সুরেশ পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিল। তাই কেদারবাবুর বাড়ীতে সুরেশের অবাধ যাতায়াত চলতে থাকে। অচলার সাথে তার কথা বার্তা হলেও কিন্তু অচলা তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু যেহেতু সে তার বাবাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে তাই অচলা তাকে তা প্রকাশ করত না। মহিমের অনুপস্থিতে যে অচলার মন ভারাক্রান্ত তা সে সুরেশকে বুঝিয়ে দেয়। সুরেশের সাথে মেলামেশা করলেও অচলার মনে কিন্তু মহিমের স্থান ছিল সর্বাগ্রে। অচলা পরক্ষণেই উলটো সুরে কথা বলে মহিমকে চিঠি লিখতে বাধা দেওয়ার কথা বলে। এই কথা অচলার মুখে শুনে সুরেশ নিজেকে দোষী ভেবে আত্মদহনে দগ্ধ হয়ে ছটফট করতে থাকে। তখন অচলা তৎক্ষণাৎ সুরেশকে জানায় যে আপনার কোন দোষ নেই একথা আমি খুব ভালোভাবে বিশ্বাস করি। অচলার মুখে এই কথা শুনে সুরেশ বুকে কিছুটা বল পায়। অচলা যে তাকে খুব শ্রদ্ধা করে তাও দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করে। অচলার এই করুণামিশ্রিত কথা শুনে সুরেশের চোখে জল এসে যায়। এইজন্য অচলাকে না পাবার জন্য সুরেশ অচলার কাছে খুব দুঃখ করতে থাকে। অচলা সুরেশের দুঃখের কথা শুনে বিগলিত হয়ে বলে সে কোন দিনই তার বাবার অবাধ্য নয় তাই সে বাবার কথা অনুযায়ী সুরেশরই অধিকারিণী। এই কথা শুনে সুরেশ মনে খুব আনন্দিত হয়ে অচলাকে কাছে টেনে বারবার চুম্বন করতে থাকে। সুরেশ আনন্দের সহিত তাই বলতে পারে – “এই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার অচলা, এর বেশি আর চাইনে। কিন্তু এটুকু থেকে যেন আমাকে বঞ্চিত করো না।”২৬ এইভাবে সুরেশকে প্রশ্রয় দিয়ে অচলা নিজের জীবনকে আর বেশি জটিল করে তোলে।

একদিন সন্ধ্যে বেলা বায়োস্কোপ দেখে ফেরার পথে যখন সুরেশ অচলার হাত ধরে তাকে নিচে নামায় তখন উভয়েই একসঙ্গে চেয়ে দেখে তাদের সামনেই মহিম দাঁড়াইয়া আছে। মহিমকে দেখে তারা দুজনেই যেন পাথরে রূপান্তরিত হয়ে গেল। মহিম সুরেশকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। উত্তরে সুরেশ প্রথমে কোন সদুত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে ঢোক গিলে মহিমের সাথে সৌজন্যমূলক কিছু আচরণ করতে লাগল। মহিমের এতদিন কোন খোঁজ খবর না পেয়ে তারা সবাই যে খুব উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল তা সুরেশ জানায় মহিমকে। এইজন্য তারা সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল একথা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে। মহিম এরপর অচলার কাছে জানতে চাইল যে কোন সুত্রে তাদের সাথে সুরেশের আলাপ পরিচয় হয়ে উঠল। উত্তরে অচলা মুখ তুলিয়া ঠিক যেন মরিয়া হয়ে বলে তিনি তার বাবাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এর চাইতে সে বেশি কিছু বলতে পারবে না। তাই সে বাকি কথা তার বাবার কাছে জানার জন্য অনুরোধ করল। অচলার মুখে এইসব কথা শুনে মহিম সঙ্গে সঙ্গে সুরেশের কাছে তার টাকা ধার দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। সুরেশ তখন মহিমকে খুব অসংলগ্ন ভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করে। সুরেশের এই কথার অর্থ মহিম কিছু বুঝতে পারে না। তাই মহিম তার কাছে পরিষ্কার ভাবে জানতে চাইল। সুরেশ কিন্তু কোন কথা স্পষ্ট করে বলল না। সবকিছু ঘটনাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। মহিম সবচেয়ে অবাক হয়ে গেল যে ব্রাহ্মদের সুরেশ দেখতে পারত না সেই ব্রাহ্ম পরিবারের দুঃখে সে আর্থিক সাহায্য করেছে। তাই সে বারবার সুরেশের কাছে এর যথার্থ কারণ জানতে চাইল। মহিমের কথার উত্তর দিতে না পেরে সুরেশ তা এড়িয়ে যাবার জন্য খুব সুচতুর ভাবে বাড়ী যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। সুরেশ এরপর জানায় যে এইসবের স্পষ্ট উত্তর সে কেদারবাবুর কাছে পেয়ে যাবে। মহিম তখন বলে যে এইসব উত্তর তার শোনার খুব কৌতূহল ছিল কিন্তু কেদারবাবুর অপেক্ষায় বসে থাকবার তার এখন সময় নেই। তাই মহিম কেদারবাবুকে অপেক্ষা না করে বাড়ী চলে গেল। মহিম যেতে যেতে বাইরে অচলাকে দেখতে পেল কিন্তু তারা উভয়েই কথা বলল না।

মহিম কতকগুলি জরুরি ঔষধ কিনে নিয়েই রাতের গাড়িতেই বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সুরেশ মহিমের বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখে যে সে আর সেখানে ফিরে আসেনি। সুরেশ একদিন বিকেলবেলা কেদারবাবুর বাড়ীতে চা খেতে খেতে এইসব খবর নিয়েই আলোচনা করতে লাগল। কিন্তু সেই সময়েই দুর্গ্রহের মতো ধীরে ধীরে মহিম আসিয়া অকস্মাৎ ঘরের কাছে দাঁড়াইল। মহিমকে লক্ষ্য করে তারা সকলেই মুখ তুলে চাইল এবং সকলের মুখের ভাবে একটা পরিবর্তন দেখা দিল। কেদারবাবু বিরস মুখে প্রায় জোর করেই একটু হেসে মহিমকে অভ্যর্থনা করলেন। এতদিন বাড়ীতে থাকার কারণ কেদারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে মহিম জানায় যে বাড়ীতে তার বিশেষ কাজ ছিল। সুরেশ এরপর মহিমকে চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। একথার উত্তর মহিম দেওয়ার পূর্বেই অচলা জানিয়ে দেয় সে চা খায় না। অচলার মহিমের ব্যপারে কথা বলাটা সুরেশ খুব ভালোভাবে দেখেনি। কিন্তু মনে মনে সে দুঃখ পেয়েই চুপচাপ থেকে গেল। মহিমের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে অচলা যে কতটা সচেতন তা আমরা লক্ষ্য করতে পারি। এর দ্বারাই আমরা অনুমান করতে পারি মহিমকে সে অন্তর থেকে কতটা ভালবাসত। চা খাওয়ার পর তাদের আজ সকলের বায়োস্কোপ দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তাই কেদারবাবু অচলাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বলেন। কিন্তু অচলা সঙ্গে সঙ্গে জানায় যে আজকে সে বায়োস্কোপ দেখতে যাবে না। অচলার মুখে এই কথা শুনে কেদারবাবু আশ্চর্য হয়ে যায়। অচলার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে সুরেশের মনে অভিমান হয়ে যায়। কিন্তু তখনকার মতো সব অভিমান ও ক্রোধকে সুরেশ সংযত করে নেয়। তাই সে অচলাকে পুনরায় যাবার জন্য অনুরোধ না করে কেদারবাবুকেই নিয়ে যেতে চায়। তারা উভয়েই অনুমান করে যে অচলার হয়তো শরীর খারাপ হয়ে থাকবে। যার জন্য সে যেতে চাইছে না। একথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে অচলা বলে তার শরীর ঠিকই আছে। এই অবস্থায় কেদারবাবু অস্বস্তিতে পড়ে নানারকম কৌশল খুঁজে অচলার না যাবার কারণ খুঁজতে থাকে। কিন্তু অচলা তার কোন অসুবিধাকেই মেনে নিতে চায়নি। অচলার এই রকম আচরণ দেখে কেদারবাবু রেগে গিয়ে অচলাকে তাদের সঙ্গে যাবার জন্য জোর করতে থাকে। বাবার এই উগ্রমূর্তি দেখে অচলা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কেদারবাবুর এই আচরণ দেখে সুরেশ বিরক্ত হল এবং যাবার জন্য অনুমতি চাইল। কারণ অচলাকে জোর করে রাজী করাতে সুরেশ ইচ্ছুক ছিল না। কেদারবাবু এরপর নিজের অভদ্র আচরণে মনে মনে লজ্জিত হল এবং সুরেশের কথায় রাগ করলেন। কিন্তু সেই রাগটা স্বয়ং সুরেশকে দেখাতে না পেরে তা তিনি মহিমের উপর রাগ দেখালেন। মহিমের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে কেদারবাবু জানায় যে তারা এখন ব্যস্ত আছে তাই এখন সে এখান থেকে যেতে পারে। তাকে পরে এসে কথা বলার জন্য জানায়। মহিম এই কথা শুনে অপমানিত হয়ে বলে আপনার কি আমার সাথে বিশেষ কোন কাজ আছে? এই কথা শুনে কেদারবাবু বলে যে তার সাথে দু একটা বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। এই কথা শুনে মহিম বাড়ী চলে যায়।

সুরেশ ও কেদারবাবু এরপর বাইরে চলে গেলেন। সুরেশ কেদারবাবুকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। মহিম কিছুদূর যেতে পিছন থেকে একটি ডাক শুনতে পেল। তখন সে পিছন ফিরে দেখে যে অচলাদের বাড়ীর বেয়ারা তাকেই ডাকছে, তাই সে এই ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বেয়ারা এসে মহিমকে জানায় আপনাকে দিদিমণি একবার তার কাছে যেতে বলল। এই কথা শুনে মহিম অচলার কাছে ফিরে এলো। মহিমকে কাছে পেয়ে অচলা বলে - “তুমি কি তোমার কসাই বন্ধুর হাতে আমাকে জবাই করবার জন্য রেখে গেলে? যে তোমার উপর এতবড় অকৃতজ্ঞতা করতে পারলে, তার হাতে আমাকে ফেলে যাচ্ছো কি করে?”২৭ এই কথা বলেই অচলা মহিমের কাছে ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। অচলার এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি সে সুরেশকে কতটা ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখত। সে মহিমকে এই কথা বলে নিজের দুঃখকে কিছুটা হলেও লাঘব করার চেষ্টা করে। তাছাড়া মহিমকে সে একটু সচেতন হয়ার জন্য আবেদন করে। অচলা তারপর তার ডানহাতটি টেনে নিয়ে নিজের আঙুল থেকে সোনার আংটিটি খুলে তাহার আঙ্গুলে পরিয়ে দিল। এই আচরণ দ্বারা অচলা বোঝাতে চাইল যে, সে মহিমের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে দিল। মহিম যেন কোন অবস্থাতেই তাকে ভুলে না যায় তাই আংটিটি স্মৃতি হিসাবে তার কাছে থাকবে। অচলা এরপর মহিমের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে একটি নমস্কার করে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে চলে গেল। মহিম কোন কথা বলতে না পেরে চুপচাপ বাড়ী ছেড়ে চলে গেল। মহিম পথ চলতে চলতে সুরেশের পূর্ব আচরণের কথা অনুমান করতে পারল। কেদারবাবু যে টাকার লোভেই সুরেশকে এতটা আপন করে তুলেছেন তা বুঝতে মহিমের মনে কোন সংশয় দেখা দেখা দিল না। সুরেশ যাকে ভালোবাসে তাকে পাওয়ার জন্য সে কি যে দিতে না পারে তা মহিমের খুব ভালভাবেই জানা ছিল। তাই কেদারবাবুর সাথে সুরেশের এতদুর সম্পর্কের কারণ তার জানতে বাকি রইল না। এত বাধা বিরুদ্ধ ভেদ করে অচলা যে আবার তার কাছে ফিরে আসতে পারবে এটা মহিম বিশ্বাস করতে পারল না। স্মৃতিস্বরুপ অচলার দেওয়া সোনার আংটির দিকে চেয়েও মহিমের কিছুমাত্র সান্ত্বনা লাভ হল না। তাই মহিমের মন ছটফট করতে লাগল। সে মনে করল এই ব্যাপারটা একটা স্থায়ী সমাধান তাড়াতাড়ি করা দরকার। তাই সে সিন্ধান্ত নিল যা হবার তা হক, কিন্তু এই সমস্যার চরম একটা মীমাংসা খুব তাড়াতাড়ি প্রয়োজন। মহিম এইজন্য এর সমাধানের জন্য প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য মহিম কেদারবাবু বাসায় গেলেও বাড়ীতে কাউকে দেখতে পেল না। তাই খালি হাতেই মহিমকে ফিরতে হল। কিন্তু সে এত সহজে হার মানবার পাত্র নয় তাই পরের দিনই আবার সে কেদারবাবুর বাড়ীতে যায়। কেদারবাবুকে নমস্কার করে ঘরে ঢুকতেই সে দূরে দেখতে পেল খোলা জানালার ধারে একটা সোফার উপর পাশাপাশি বশে আছে অচলা ও সুরেশ। তারা তখন উভয়েই একটি ছবির বই নিয়ে দেখিতেছিল। কেদারবাবু মহিমের কাছে প্রথমেই তার আর্থিক অবস্থার কথা জানতে চায় এবং এনিয়ে তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতেও ছাড়েনি। কেদারবাবু মহিমকে নানারকম উপদেশ দিতে থাকে। এইসব শুনে মহিম ভিতরে ভিতরে খুব অসহিষ্ণু হয়ে উঠে। কেদারবাবু এরপর সুরেশ ও অচলাকে এইঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে অনুরোধ করে। কারণ সে মহিমের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে একাকী আলোচনা করতে চায়। কেদারবাবুর কথা শুনে সুরেশ উঠে পড়লেও অচলা কিন্তু এখান থেকে যেতে রাজী হল না। অচলা তার বাবাকে সরাসরি জানিয়ে দেয় যে তার এখানে থাকাটা খুব প্রয়োজন। অচলার এই আচরণে সুরেশের রাগ হয় এবং সে তাই এই ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যায়। নিজ কন্যার এই আচরণে কেদারবাবুও খুশি হলেন না কিন্তু মনকে সংযত করে চুপ করে গেলেন। কেদারবাবু মহিমকে এখন কোন দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে নিষেধ করলেন কারণ তাতে সে অকর্মণ্য হয়ে যাবে। নিজের উন্নতি সাধন করে কৃতী হয়ে দায়িত্ব নেবার পরামর্শ দেয় কেদারবাবু। মহিম এই কথা শুনে বলে যে আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য, কিন্তু আপনার কন্যার কি তাই ইচ্ছা? কেদারবাবু এরপর মহিমের অসহায়তার কথা বলে, এজন্যই সে তার মেয়েকে মহিমের হাতে তুলে দিতে রাজী নয়। এইসব নিয়ে আলোচনা করে মহিম ও কেদারবাবুর মধ্যে বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মহিম কেদারবাবুর মমতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জানায় সে অচলার নিজস্ব মতামত না জেনে সে এই সিদ্ধান্ত থেকে এক পা নড়বে না। এই কথা শুনে অচলা কোন কথা বলতে পারে না। মহিম উদগ্রীব হয়ে অচলার কাছে এর উত্তর জানতে চাইল। এরই মধ্যে সুরেশ প্রবেশ করে তার এক পরিচিত বন্ধুর প্লেগ রোগের আক্রান্তের খবর জানায়। সেই বন্ধুর উদ্দেশ্যে তাকে এখুনি ছুটে সেখানে যেতে হবে। তাই সুরেশ সেখানে যাবার সময় মহিমকেও যাবার জন্য একবার অনুরোধ করে। মহিম সেখানে যেতে না চাইলে সুরেশ তাকে যথেষ্ট ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে। মহিমের ঐ অপমান অচলা মেনে নিতে পারেনি বলে, সে সুরেশকেও এর পাল্টা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে ছাড়েনি। মহিমের যে ঐ প্লেগ রোগীর কাছে যাওয়া হবে না তাও অচলা দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দেয়। অচলার ঐ কথা শুনে সুরেশের মুখ কালিবর্ণ হয়ে গেল। অচলার এই রুঢ় আচরণে তার পিতা মনে মনে আশঙ্কিত হয়ে পড়লেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুরেশ ও অচলার মধ্যে তর্কবিতর্ক এমন জায়গায় পৌঁছায় যা অভাবনীয়। অচলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে মহিমের উপর তার একটা অধিকার আছে। তাই তার ভালো মন্দ বিচার করে অচলা। এইজন্যই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মহিম ঐ প্লেগ রোগীর কাছে সে কিছুতেই যেতে দিতে পারে না। সুরেশকে যে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না তাও অচলা জানাতে কোন দ্বিধাবোধ করেনি।

সুরেশ এরপর অচলার কাছে তার সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট ভবে জানতে চায়। অচলা জানিয়ে দেয় সে তাকে কোন দিন মেনে নিতে পারবে না। এটাই তার স্থির সিদ্ধান্ত। এই কথা শুনে সুরেশ রেগে গিয়ে কেদারবাবু ও অচলাকে অশ্রাব্য কথা বলতে শুরু করে। তাদের তিনজনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা যেন রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। কেদারবাবুর টাকা ধার নেওয়ার জন্য সে যথেষ্ট কথা শোনায়। সুরেশের এই কথা শুনে কেদারবাবু ও অচলা খুব দুঃখ পেয়ে ভেঙ্গে পড়ে। কেদারবাবু সুরেশের এইরূপ দেখে অবাক হয়ে যায়। সুরেশ যে এত খারাপ হতে পারে কেদারবাবু কোনদিন ভাবতেও পারেনি। কেদারবাবু ও অচলাকে যতরকম ভাবে অপমান করা যায় তাই করে সুরেশ সেখান থেকে চলে গেল। মহিম এই ঘটনার কোন খবরই পেল না। কেদারবাবু বাধ্য হয়ে অবলীলাক্রমে কন্যার সঙ্গে মহিমের বিবাহের সম্মতি দিলেন। অচলার প্রতি স্নেহে, প্রেমে, কৃতজ্ঞতায় মহিমের সমস্ত হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। মহিম চিরদিনই নিঃশব্দ প্রকৃতির লোক তাই সে আবেগ উচ্ছ্বাস কোনদিন প্রকাশ করিতে পারে না। কেদারবাবু মন স্থির করলেন যে মেয়ের বিয়েতে কোনরকম ধূমধাম হৈচৈ করবেন না। তাই তিনি শুভকর্মের আয়োজন যতটা নিঃশব্দ হইতে পারে, তাহার ত্রুটি করেন নাই। সুরেশ যে হঠাৎ এসে আবার কোন কাণ্ড ঘটাতে পারে সেই দুশ্চিন্তা কিন্তু কেদারবাবুর মনে রয়ে গেল। অচলা হঠাৎ সংবাদপত্রে সুরেশের খবর দেখে এবং পিতাকে সেই খবরের কথা আগ্রহের সঙ্গে জানায়। পিতা ও কন্যা সংবাদপত্রে সুরেশের মহৎ কাজের খবর পেয়ে আনন্দিত হয়। তখন কেদারবাবু অনুমান করে যে সেদিন সুরেশ তাদের সাথে ঐ রকম খারাপ ব্যবহার করার পর অনুতপ্ত হয়েই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু অচলা তার পিতার কথাকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করতে পারল না। অচলা পিতাকে বলে যে পরকে উপকার করা তার একটা স্বভাব তাই সে মুমুর্ষ রোগীর সেবা করার জন্যই সেখানে চলে গেছে। পরের বিপদে ঝাপিয়ে পড়া যে তার এটা কোন নতুন ঘটনা নয় সে কথাও অচলা পিতাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই অচলা পিতাকে খুশি করার জন্যই তার মতকেই মেনে নেয়। সুরেশের এই মহৎ কাজের পরিচয় পেয়ে কেদারবাবুর মনে সুরেশের প্রতি পুনরায় আস্থা জেগে উঠে। যার জন্য তাদের পূর্বের সমস্ত বাদ-বিবাদের কথা ভুলে যায়। কেদারবাবু সুরেশের প্রতি সৌজন্যের জন্য অচলাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে খবর নেওয়ার কথা বলে। বাবার এই মতামতে নিজেই উৎসাহী হয়ে যখন অচলা টেলিগ্রামের জন্য কাগজ আনতে যায়, ঠিক সেই সময়েই সামনেই সুরেশকে দেখতে পায়। সুরেশের শুষ্ক, শ্রীহীন চেহারা দেখে অচলা চমকে যায়। অচলা তখন সুরেশের কাছে তার কুশল সংবাদ জানতে চায়। অচলার সামনে পূর্বের কৃতকর্মের কথা ভেবে সুরেশ লজ্জিত হয়ে পড়ে। তাই সুরেশ আর্তকণ্ঠে অচলাকে জিজ্ঞাসা করে তার আচরণের জন্য তাকে সে মাফ করতে পেরেছে কিনা? উত্তরে অচলা ওষ্ঠাধারে একটুখানি হাসির সঙ্গে বলে সে প্রয়োজন তার হয় নি। অচলার মুখে এই কথা শুনে সুরেশ খুশি হয়। অচলা এরপর সুরেশকে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে যায়।

সুরেশ কেদারবাবুকে বলে যে মহিমের পত্রে বিবাহের সংবাদ শুনেই সে তাড়াতাড়ি এখানে চলে এসেছে। সুরেশের এই কথা শুনে কেদারবাবু লজ্জায় চঞ্চল হয়ে উঠলেন। কিন্তু অচলার মুখের ভাবে তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। সুরেশ এরপর ফরজাবাদের বিপদ সংকুল ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ দিতে লাগল। সেখানে তার যে কোন বিপদ হয়নি তাও কেদারবাবুকে জানায়। কিন্তু হঠাৎ সুরেশের ক্ষতের ব্যান্ডেজটি পড়ে যাওয়ায় তা দেখে কেদারবাবু চমকে উঠেন। তৎক্ষণাৎ ঐ ব্যান্ডেজটি তুলে অচলা সুরেশের ক্ষতে নিজে বেন্ধে দেয়। অনেকদিন পর কেদারবাবুর বাড়ীতে এসে ভদ্র ব্যভহার পেয়ে সুরেশ মনে খুব শান্তি পেল। অচলা ও মহিমের বিবাহ খুব ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেল। বিবাহ সভায় সুরেশকে এক পলকের জন্য দেখা গিয়েছিল কিন্তু তারপর আর দেখা গেল না। বিয়ের পর অচলা স্বামীর সঙ্গে স্বামীর গ্রামের বাড়ীতে এসে উপস্থিত হল। অচলা এই প্রথম কোন পল্লীগ্রাম নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেল। পালকি থেকে নেমে পল্লীগ্রামের মেটে বাড়ীর খড়গুলো, স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার দরজা যে এতই সংকীর্ণ ক্ষুদ্র – উপরে বাঁশের আড়া ও মাচা এত কদাকার ইহা অচলা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। এইসব গৃহে জীবন যাপন করিতে হইবে উপলব্ধি করে তার বুক যেন ভেঙ্গে গেল। স্বামীসুখ, বিবাহের আনন্দ সমস্তই একমুহূর্তে মায়া মরীচিকার মত তার হৃদয় থেকে বিলীন হয়ে গেল। অচলার শ্বশুর বাড়ীতে স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না। তাই পাড়ার এক ঠানদিদি এসে বরবধূকে বরণ করে চলে গেল। মহিম যে কোথায় চলে গেল তাকে দেখতে না পেয়ে অচলা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। জীবনের সমস্ত স্বাদ গন্ধ তার অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যার সময় মহিম মৃণালকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ী ফিরে এল। মৃণাল অচলাকে দেখে তার রূপের প্রশংসা করতে লাগল। মৃণাল ঠাট্টা তামাশা করতে খুব ভালবাসত। মৃণাল যেহেতু পাড়াগাঁয়ের একজন সহজ সরল মেয়ে তাই তার ঠাট্টা তামাসার মধ্যে কোন রহস্য ছিলনা। মৃণাল তাই মহিমকে ঠাট্টা করে বলে – “আমাকে বিয়ে করলে ঠকে মরতে ভাই।”২৮ মৃণালের এই ঠাট্টা শুনে মহিম বিরক্ত প্রকাশ করে।

মৃণাল এরপর নববধূ অচলাকেও ঠাট্টা করতে বাদ দেয়নি। অচলাকে ঠাট্টা তামাসা করে মৃণাল বলে যে মহিমের সাথে তার বিয়ে হবার কথা ছিল কিন্তু মা ষড়যন্ত্র করে তাদের এই বিয়ে সম্পূর্ণ হতে দেয়নি। যার জন্য তাকে একজন বুড়োর সাথে ঘর করতে হচ্ছে তা সে অচলাকে অকপটে জানায়। অচলা যেন তাকে সতীন ভেবে রাগ না করে একথাও বলতে ভোলেনি মৃণাল। এইসব ঠাট্টা তামাসা করে সমস্ত ঘরটা আলো করে মৃণাল দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। এইসব হাসি ঠাট্টার সঙ্গে অচলার কোন পূর্ব ধারণা ছিল না। তাই মৃণালের সব পরিহাসই তার কাছে কাঁটার মতো বিঁধতে লাগলো। যার জন্য লজ্জায় সে একেবারে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। এতবড় নির্লজ্জ প্রগলভতা যে কোন স্ত্রীলোক পৃথিবীতে থাকতে পারে তা অচলা কোনদিন ভাবতেও পারেনি। কিন্তু তবুও তাহার মনে হইতে লাগিল ইহার আগমনে তাহার নির্বাসণের অর্ধেক বেদনা যেন দূর হয়ে গেল। মৃণালের পরিচয় এবং মহিমের সঙ্গে তার সম্বন্ধ জানার জন্য অচলা উৎসুক হয়ে উঠল। মৃণাল নিজেই তার পরিচয় অচলার কাছে জানায়। মৃণালের পরিচয়ে অচলার মনে নানারকম রহস্যের সৃষ্টি হয়। যদিও মৃণালের ঠাট্টা তামাসা শুনে অচলার তাকে ভালো লেগে যায়। মৃণাল যে ঠাট্টা তামাসায় খুব পারদর্শী তা নিজেই অচলার কাছে স্বীকার করে নেয়। উত্তরে অচলা তাকে জানায় যে এইসব ঠাট্টা তামাসা কোন ভদ্রমহিলা উচ্চারন করতে পারেনা। অচলার এই কথাতেও মৃণাল কিন্তু কোন লজ্জিত হল না। কিছুক্ষণ মেলামেশার পর মৃণাল অচলাকে ছোট বোন হিসাবে মেনে নেয়। এই পল্লীগ্রামে তার ভবিষ্যৎ জীবন যে কেমন অতিবাহিত হবে তা অচলা এই বাড়ীতে পা দিয়েই অনুমান করতে পারে। তাই সে নিজের একাকীত্ব দূর করার জন্য মৃণালের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। মৃণাল এরপর অচলাকে জিজ্ঞাসা করে পূর্বে সে মহিমের এইসব কথা জানত কিনা? তখন অচলা জানায় মহিমের এইসব কথা আমাকে আগে না বলার জন্য আমি মহিমের প্রতি আশ্চর্য বোধ করছি। অচলা এরপর মহিমের সাথে মৃণালের বিয়ের ব্যপারে স্পষ্ট করে জানতে চায়। মৃণাল সেই সময় অন্যমনস্কতার জন্য তাদের বিয়ের কথা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করে। মৃণালের এই দুরকম কথার জন্য অচলার মনে রহস্যের ডানা বাঁধে এবং আরো বেশি জটিল হয়ে যায়। অচলা তখন মৃণালকে বলে তোমাদের দুইজনের বিবাহ হলেই বোধহয় ভালো হত। অচলার এই কথা শুনে অনুমান করা যায় যে এই ব্যপারটি নিয়ে কতটা গভীরে চিন্তা করে। অচলার এই কথা শুনে মৃণালের মনে আঘাত লাগে। সে তখন অচলার মুখের প্রতি চোখ তুলে বলে সেই বিয়ে ভাগ্যে ছিল না বলেই বোধহয় হয়নি। এই বিয়েতে তাদের বাধার কারণ জানতে চায় অচলা। অচলার প্রশ্নের ধরন শুনে মৃণাল হঠাৎ চমকে যায়। আসলে অচলা যে এই ব্যাপারটি সত্য বলে মেনে নিবে তা মৃণাল ভাবতেও পারেনি। মৃণাল তাই অচলাকে আস্বস্ত করার জন্য তার মুখের দিকে চেয়ে বলে তুমি এসব ব্যাপার নিয়ে কি উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছ? মৃণালের সব ঠাট্টা তামাসা গুলোকে যে অচলা অতি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে তা মৃণাল এবার বুঝতে পারে। তাই মৃণাল অচলাকে স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসের মনোভাব ত্যাগ করার জন্য উপদেশ দেয়। মৃণালের এই উপদেশের দ্বারা তার পাতিব্রত্যের যথার্থ চিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে।

অচলার এই অসহায়ত্ব বোধ করে মৃণাল তাকে একেবারে আপন করে নিল। মৃণাল তাই অচলাকে সমাজের আচার আচরণ কর্তব্য সম্বন্ধেও উপদেশ দিতে লাগল। মৃণাল তাই অচলাকে ঘর পরিষ্কার করতে বলল কিন্তু তাতে তার দাসীরা আপত্তি জানায় এবং সেই কাজ তারা নিজেরা করতে চায়। মৃণাল দাসীদের এই আচরণে বিরক্ত হয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিতে থাকে। মৃণালকে খুশি করার জন্য অচলা সঙ্গে সঙ্গে ঘর পরিষ্কার করার জন্য নিজের হাতে ঝাঁটা তুলে নেয়। অচলার এই ব্যবহারে মৃণাল খুশি হয়ে যায়। তাই এরপর মৃণালের সঙ্গে অচলার হাসি ঠাট্টা চলতে দেখা যায়। মৃণাল অচলাকে পুনরায় উপদেশ দেয় যেদিন সে স্বামী পুত্র ঘরকন্না নিয়ে নাবার খাবার সময় পাবে না, শুধু তখনি তো এই মেয়ে মানুষ জন্মটার যথার্থ সার্থক হবে। তাই মৃণাল অচলাকে আশীর্বাদ করে যেন সে স্বামীপুত্র, ঘরসংসার নিয়ে সুখে জীবনযাপন করতে পারে। মৃণালের উপস্থিতি অচলা ও হরির মাকে একাকীত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি দেয়। মৃণাল অচলার সাথে হাসি ঠাট্টা করতে করতে বাড়ী যাবার কথা বারবার বলতে থাকায় অচলার মনে ভারি পীড়া দিতে লাগল। কারণ মৃণালের কাজে, কথায়, আচারে ব্যবহারে এতবড় একটা সহজ আত্মীয়তা ছিল, যার আড়ালে স্বছন্দে দাঁড়াইয়া অচলা উঁকি মারিয়া তাহার নতুন জীবনের অচেনা ঘর কন্নাকে চিনে নেবার সময় পেয়েছিল। এর চেয়েও মৃণালকে তার ভাল করে ও বিশেষ করে চিনে নেবার সময় পেয়েছিল। মৃণালের সাংসারিক অবস্থা যে ভালো ছিল না, তা তার সম্পূর্ণ অলংকার বর্জিত হাত দুখানির দিকে চাইলেই অনুমান করা যায়। মৃণালের জীবনের কোন প্রতিকুলতাই যে দুঃখ দিয়া তার জীবনযাত্রার পথে অবসন্ন করে বসিয়ে দিতে পারে না। হৃদয়ের আনন্দ নিরানন্দ ছাড়া বাইরের কোন কিছুর যেন অস্তিত্ব নাই- এমনি এই সহজ সরল মূর্খ পাড়া গাঁয়ের মেয়েটার ভাব। মৃণালের সংস্পর্শে বেশ কয়েকদিন থাকিয়া অচলা বেশ বুঝতে পারছিল যে পদ্ম যেমন পাঁকের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াও সমস্ত মলিনতার অতীত, ঠিক তেমনি যেন এই লেখাপড়া না জানা দরিদ্র পল্লীলক্ষ্মীটিও সর্বপ্রকার সাংসারিক দুঃখ দরিদ্রের ক্রোড়ে অহোরাত্র বাস করেও সমস্ত বেদনা – যন্ত্রণার উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। মৃণালের না আছে দেহের ক্লান্তি, না আছে মুখের শ্রান্তি। অনবরত সে নানারকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। সুতরাং অচলাকেও সে সকল অনভস্ত্য কাজের মধ্যে অবিশ্রান্ত টেনে নিয়ে চলেছিল। অচলা সব কাজে অনভস্ত্য হলেও কিন্তু কোন কাজে অনীহা দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। অচলা এটাকে বড় লজ্জা বলে মনে মনে বোধ করত।

এখান থেকে মৃণালের বাড়ী যাবার কথা শুনে অচলা তাকে তামাসা করে বলে - “বাপের বাড়ী এসে কে এত শীঘ্র ফিরে যায় বল তো? তা হবে না – আমি যতদিন না কলকাতায় ফিরে যাব, ততদিন তোমাকে থাকতেই হবে।”২৯ অচলার এই কথা শুনে মৃণাল তার সাংসারিক দুঃখের কাহিনী সব স্পষ্ট করে তাকে জানিয়ে দেয়। বৃদ্ধ স্বামী ও অসুস্থ শাশুড়ির সেবা করতে করতে যে তার প্রান ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছে তা মৃণাল দুঃখের সঙ্গে অচলাকে জানায়। তাছাড়া তার শাশুড়ির যে তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে তাও মৃণাল অসংকোচে জানিয়ে দেয়। মৃণাল যে পৃথিবীতে কোন মানুষকে ভালবাসতে পারে না একথা অচলা বিশ্বাস করতে পারে না। মৃণাল এখান থেকে যাই যাই করতে করতে আরো কিছুদিন এখানে কেটে যায়। এই দেখে অচলা বুঝতে পারল যে যাবার দিকে তার মুখে যত তাড়া, কাজের দিকে তত নয়। এখান থেকে চলে যেতে তার যে মন চায় না তা অচলা বুঝতে পারে। তাই অচলার মৃণালের পূর্বের ঠাট্টা তামাসা গুলি সত্যি মনে হতে শুরু করে। মহিমের প্রতি আর যে একটা দূর্বলতা আছে তা অচলার মনে সন্দেহ হয়। এখানে এসে মৃণালের সাথে মহিমের হাসি ঠাট্টার কথা শুনে অচলার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠেছে, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে সূচ ফুটতে লাগল। অচলা তার মনকে যতই এইসব ঘটনা মিথ্যা বলে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে কিন্তু তখনই কোথা হইতে সংশয়ের বিপরীত তর্ক তাহার হৃদয়ের মধ্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারবার মুখ তুলে তাহাকে ভেংচাইতে থাকে। মহিমের অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য এইখানে যেন অতিশয় বাড়াবাড়ি বলে অচলার মনে হয়। তার মনে হয় যে ভিতরে যদি কোন কারনেই নেই তবে মহিম মৃণালের তামাসাকে মেনে নিতে অস্বীকার করছেই বা কেন? অচলা লক্ষ্য করে মৃণালের রহস্যলাপের সুত্রপাতের মহিম লজ্জিত মুখে কোনমতে তাড়াতাড়ি অন্যত্র পালিয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। মহিমের এই আচরণ দেখে অচলার মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয় যেটাকে সে কোন মতেই মন থেকে দূর করতে পারে না। অচলার তখন মৃণালের এখানে পড়ে থাকার জন্য কোন গোপন সম্পর্কের কথা মাথায় আসে। তার মনে হয় নিশ্চয়ই মহিমের প্রতি মৃণালের একটা দূর্বলতা আছে তাই সে তাকে ছেড়ে নিজের ঘর যেতে চাইছে না। মৃণাল রান্না করে নিজের হাতে মহিমকে খাবার দিত এটা অচলা আর মেনে নিতে পারছিল না। তাই সে মৃণালকে রান্না করা থেকে মুক্তি দেবার কথা বলে নিজে রান্না করতে চাইল। কারণ এই অধিকার যে পরহস্তের থেকে কেড়ে নিয়ে নিজ হাতে নিতে চাইল।

অচলার রান্না করার আগ্রহ দেখে মৃণাল প্রথমে নানা অজুহাতে তাকে বাধা দিতে লাগল । কিন্তু দৃঢ়চেতা অচলা মৃণালের কোন যুক্তিকেই গুরুত্ব দিল না। অচলার নিজ হাতে রান্না করার আগ্রহের কারণ মৃণাল কিছুই বুঝতে পারল না। তাই সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ে মৃণাল হাসি চাপিয়া কৃত্রিম অভিমানের সুরে ঘাড় নাড়িয়া বলিল - “বা রে মেয়ে। একে একে বুঝি তুমি আমার সব কেড়ে নিতে চাও?”৩০ মৃণালের এই কথা শুনে অচলা তাদের মধ্যেকার গোপন সম্পর্কের যে রহস্য তা আরো বেড়ে যায়। মৃণাল নিজেকে বারবার সতীন বলে পরিচয় দেওয়াতেই অচলার বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় ব্যাথায় সজোরে ঘা দিল। তাই অচলা এক মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে সংক্ষেপে বলল সে আজকে নিজের হাতে রান্না করবেই। এই কথা শুনে মৃণাল বুঝতে পারল যে অচলার খুব রাগ হয়েছে। তাই সে বেশি তর্কবিতর্ক না করে বিষণ্ণ মুখে একটুখানি চুপ করে থাকে। মৃণাল পরক্ষণে অচলাকে রান্না করতে অনুমতি দিয়ে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলল। তাদের এই তর্কবিতর্কের সময় মহিম যে ঘরেই আছে তা তারা উভয়েই ভুলে গিয়েছিল। তাই তারা উভয়েই তাকে দেখে অপ্রতিভ হয়ে গেল। মহিম তখন অচলাকে জানায় মৃণাল এখানে যে কয়েকদিন আছে সেই রান্না করুক, এতে তার আপত্তি কেন? অচলা যে কেন মৃণালকে রান্না করতে নিষেধ করেছিল তার কারণ মহিমের জানা ছিল। কিন্তু সে কথা মহিম স্পষ্ট করে বলতে পারিল না। মহিমের এই কথা শুনে অচলার মন আরও জ্বলে উঠল এবং তার সন্দেহ উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। কিন্তু অচলা রাগ চেপে বলল সে রাঁধতে যাচ্ছে বলেই এই বাদানুবাদ। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে একপ্রকার জোর করেই রান্না করতে চলে গেল। অচলা রান্না করতে খুব ভালো জানলেও কিন্তু মনে দুশ্চিন্তার জন্য মন দিয়ে তা করতে পারল না। অচলার মনে অনবরত একটা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। তাই তার বিগত দিনের সমস্ত ঘটনা নড়তে চড়তে কেবলই খচখচ করে বিঁধতে লাগল। তখন তার মনে সংকোচ বোধ হয় যে মহিম তাকে কোনদিনই তেমন করিয়া ভালোবাসিতে পারে নাই। তার বিবাহের পূর্বে সুরেশকে নিয়ে যে সংঘর্ষ উপস্থিত হয়েছিল তা খুঁটিয়া খুঁটিয়া মনে করিয়া আজ সহসা সে যেন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেল, যে মহিম তার প্রতি চিরদিনই উদাসীন। এমনকি পিতার অভিমতে যখন তার সুরেশের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক হয়েছিল তখনও মহিমকে সে কোন বিচলিত হতে দেখে নি। এইসব চিন্তা ভাবনা করে অচলা স্থির সিন্ধান্ত নিল যে মহিম তাকে কখনই মন থেকে ভালবাসতে পারেনি। এইসব চিন্তা ভাবনা করে অচলার মন বিচকিত হয়ে পড়ে। খবার সময় মৃণাল খাবার খেতে আসেনি, তাই দেখে অচলা তার খোঁজ করতে যায়। মৃণালের কাছে গিয়ে অচলা জানতে পারে যে তার জ্বর হয়েছে। মৃণালের জ্বর আসার কথা অচলা বিশ্বাস করে না। তাই সে ভাবে যে মৃণাল রাগের জন্য খেতে চাইছে না। একথা মৃণালকে অচলা সরাসরি জানিয়েও দেয়। মৃণাল তখন তার স্বামীর দিব্য দিয়ে প্রমান করার চেষ্টা করে যে সে রাগ করে নাই।

অচলা এরপর মৃণালের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলল তা খুবই রুঢ় প্রকৃতির কিন্তু মৃণাল তাতেও কোনকিছু মনে করল না। মৃণাল যে ব্রাহ্ম মেয়ের হাতে খেতে চায় না একথা বলতেও অচলা দ্বিধাবোধ করল না। অচলার এইসব কথা শুনে মৃণাল হত বুদ্ধির মত স্তব্ধ হয়ে যায়। খানিক পরে মৃণালের সে ভাব কেটে গেলেও নির্বাক হয়েই বসে রইল। মৃণালের শাশুড়ি অতিশয় শুচিবাই প্রকৃতির মহিলা, তাই সে বিশ্বাস করে মৃণালের রান্না করা খাবার খায়। এই জন্য মৃণালের মনে সংকোচ হয় সে যদি জানতে পারে যে মৃণাল অন্য ধর্মের হাতে ছোঁয়া খাবার খেয়েছে তবে তিনি তার হাতে আর জলস্পর্শ করবে না। এই কারণের জন্যই মৃণাল অচলার রান্না করা খাবার খেতে চাইছিল না। অচলা এই কথা জানতে পারলে পাছে দুঃখ পায় তাই সে একথা প্রকাশ না করে কৌশলে তা এড়িয়ে যায়। কারণ অচলা যদি একথা সত্য জানতে পারত তবে তার মুখ দিয়া কোন কথা উচ্চারন হইত না। মৃণালের কাছ থেকে অচলা চলে গিয়ে রান্না ঘরের কাজকর্ম করে শুয়ে পড়ল। মৃণাল ও অচলা বাকবিতণ্ডার ফলে তাদের উভয়েই সেইদিন দুপুর বেলা না খেয়ে অভুক্ত অবস্থায় থেকে গেল। বিকেলবেলায় মৃণাল হঠাৎ বাড়ী যাওয়ার সিন্ধান্ত নিল। তাই মৃণাল যাওয়ার পূর্বে অচলাকে নমস্কার করতে যায়। কিন্তু পূর্বের ঝগড়ার জেরে তার সাথে অচলা কোন কথা বলল না। সেখান থেকে মৃণাল এরপর মহিমের কাছে গিয়ে জানায় সে যেন আর একবার তাকে এখানে নিয়ে আসে। মহিমের সাথে সাক্ষাৎ করেই মৃণাল দুঃখ নিয়েই স্বামীর ঘরে চলে যায়। মৃণালের হঠাৎ চলে যাওয়াতে অচলা অবাক হয়ে যায়। তাই সে মনে মনে খুব দুঃখ পায়। মহিম উত্তেজিত হয়ে অচলাকে জানায় মৃণালের সঙ্গে যে তোমার বনিবনাও হবে না, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ মৃণালের সাথে কোনদিন কারো ঝগড়া হয় নি। মহিমের কথা শুনে অচলা রেগে গিয়ে বলে আমার সঙ্গে যে পাড়া সুদ্ধ লোকের চিরকাল ঝগড়া হয় তাই বা কে বললো? মহিমের কথাতে অচলা যে কতখানি রেগে গিয়েছিল তা আমরা তার এই কথার মধ্য দিয়ে অনুমান করতে পারি। এইসব কথা বাদ দিয়ে মহিম এরপর অচলার অভুক্ত থাকার কারণ জানতে চাইলে অচলা সঙ্গে সঙ্গে রেগে জ্বলে যায়। অচলা তখন মহিমকে ইঙ্গিতে জানাতে চায় সে তার চেয়ে মৃণালকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। একথা শুনে মহিম যেন আকাশ থেকে পড়ল। অচলা মহিমকে একথা জানাতেও দ্বিধাবোধ করে না যে সে জেনে শুনেই তাকে মৃণালকে দিয়ে অপমান করেছে। কারণ অচলার ধারণা মহিম নিশ্চয়ই জানত যে মৃণাল তার হাতের ছোঁয়া খাবার খেতে চাইবে না। তাই অচলা তার এই অপমানের জন্য মহিমকেই দায়ী করে। অচলা ও মহিমের নববিবাহিত জীবনে মৃণালের আবির্ভাবের পর থেকেই তাদের মধ্যে একটা অবিশ্বাস বোধ কাজ করে। মৃণালের উপস্থিতিতে তার মুখে মহিমকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা শুনে অচলার মনে স্বামী সম্পর্কে একটা রহস্য ডানা বাঁধে। যা তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা বিশাল অশান্তির সৃষ্টি হয়। এই জন্যই তাদের দাম্পত্য কলহের চিত্র আমাদের চোখে ধরা পড়ে। মহিমের সাথে মৃণালের সম্পর্কের কথা ভেবে অচলার মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মহিম অচলাকে তাদের এই সম্পর্কের কথা স্পষ্টভাবে কিছু জানায় নি। এই জন্যই অচলার মন আরো জটিল হতে শুরু করে। যা তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য অনেকখানি দায়ী। মহিম যদি স্পষ্টভাবে তাদের সম্পর্কের কথা আচলাকে জানিয়ে দিত, তাহলে হয়তো অচলা এতখানি ভেঙ্গে পড়ত না। পরিবর্তে যখনি সেই কথা উঠেছে তখনি মহিম যেন সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। মহিমের এই আচরণে অচলার সন্দেহ আরও বেশি জোরালো হয়।

উপন্যাসের ষোড়শ পরিচ্ছেদে হঠাৎ আমরা দেখতে পাই মহিমের গ্রামের কুঁড়ে ঘরে সুরেশের আবির্ভাব। কিছুক্ষণ আগে অচলা ও সুরেশের মধ্যে যে বাদানুবাদের কথা চলছিল তার কিছুটা অংশ সুরেশ বাইরে থেকেই শুনেছিল। অচলার রুঢ় ব্যাবহারের ইঙ্গিত সে বাইরে থেকেই প্রায় সবই শুনে। তাই সুরেশ অচলা সম্পর্কে মহিমকে সচেতন করে দেয়। সুরেশের মুখে এইসব কথা শুনে মহিম লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। সুরেশ এরপর মহিম ও অচলার সম্পর্ক সম্বন্ধে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে দ্বিধাবোধ করেনা। কিছুক্ষণ পর অচলা হঠাৎ দরজা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করে হাসিমুখেই সুরেশের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। অচলার প্রফুল্ল হাসিমুখে সুখসৌভাগ্যের প্রসন্ন বিকাশ কল্পনা করে সুরেশের বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় জ্বলিয়া উঠিল। কারণ দাম্পত্য জীবনে মহিম ও অচলা সুখে থাক এটা সুরেশ মন থেকে কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সুরেশ অচলার কাছে তাদের পূর্বে ঝগড়ার কারণ জানতে চাইল। অচলা তখন সুরেশের মুল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পেরে তাকে বিদ্রুপ করে। অচলার মুখে রুঢ় কথা শুনে সুরেশ গম্ভীর হয়ে গেল। সৌজন্যের আচরণে তাদের উভয়ের শ্লেষের এই সকল প্রচ্ছন্ন ঘাত প্রতিঘাতে মনে মনে মহিম খুব অধীর হয়ে গেল। কি করিয়া তাদের মধ্যে এই ঘাত প্রতিঘাত বন্ধ করবে তা মহিম চিন্তা করতে পারল না। অচলার সঙ্গে তর্কে পরাস্ত হয়ে হঠাৎ সুরেশই তার প্রতিকার চেয়ে হাত জোড় করল। মহিমের বাড়ীর দুরাবস্থার কথা টেনে এনে সুরেশ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। অচলা সহ্য করতে না পেরে তার যথার্থ উত্তর কড়া ভাষায় শুনিয়ে দেয়। অচলার সাথে কোন কথাতেই পেরে না উঠে একসময় সুরেশ চুপচাপ হয়ে যায়। অচলা সেখান থেকে চলে যেতেই সুরেশের বুকের জ্বালাটা যেন বেড়ে গেল। সুরেশ মহিমের গৃহে প্রবেশ করতেই তাদের নব দম্পতির কলহের যে সুচনা হয়েছিল তা তাকে সাময়িক মনের শান্তি দিলেও তা কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারল না। যার জন্য সুরেশ ভিতরে ভিতরে জ্বলে যেতে লাগল। অচলার বিয়ের পর সুরেশ নিজেকে আত্মসংযম করে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার মনে হয় আত্মসংযম তার সত্য বস্তু নয়, এটা তার আত্মপ্রতারণা। তাই এক সপ্তাহ না কাটিতেই এই মিথ্যা সংযমের মোহ তার বিস্ফারিত হৃদয় হইতে ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হয়ে তাকে সম্পূর্ণ রূপে সংকুচিত করে আনতে লাগল। মন তাহার বারবার বলিতে লাগল যে এই স্বার্থ ত্যাগের ফলে সে নিজে কি পেল?

সুরেশ তাই পীড়িত মন নিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনকে অভিশাপ দিতে লাগল। সে মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল যে তাদের দাম্পত্য জীবনে যেন তারা কেউই সুখী না হয়। তাই সে তাদের দাম্পত্য জীবনের চিত্র দেখার কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে অবশেষে মহিমের ঘরে এসে উপস্থিত হল। সুরেশ এরপর শান্তশিষ্ট মহিমকে তার সামাজিক অবনতির কথা স্মরণ করে দিতে লাগল। সমাজের সাথে তার যে কোন বিরোধ দেখা যায় নি একথা মহিম অকপটে জানিয়ে দেয়। উত্তরে সুরেশ জানায় সমাজের কোন ব্যাক্তি যে তার বাড়িতে খেতে আসেনি এটা কি যথেষ্ট অপমানকর নয়? তখন মহিম জানায় যে কোন ব্যাক্তিকে সে খাবার জন্য নিমন্ত্রণই করেনি। তাই তাদের আসার কোন কথাই উঠে না। তাদের বউভাতের অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ না করার জন্য সুরেশ যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করে। মহিম তখন জানায় যে যেহেতু তাদের বউভাতের কোন অনুস্থানেই তারা করেনি, তাই সেখানে নিমন্ত্রণের কথা আসে না। দুই বন্ধুতে এই নিয়ে তীব্র বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। সুরেশ চাই যে কোন ইস্যু তৈরি করে মহিমের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তাকে বিড়ম্বনায় ফেলা। তাই মহিম সুরেশের প্রশ্নগুলি খুব সতর্ক ভাবে শুনে শান্ত মাথায় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। এরপর মহিম টিউশন পড়ার জন্য যেতে চাইল। কিন্তু অচলা সুরেশকে বিশ্বাস করত না বলে মহিমকে আজ সেখানে যেতে নিষেধ করল। কারণ একাকী অচলাকে পেয়ে সুরেশ যদি কোন খারাপ ব্যবহার করে বসে। কারণ পূর্বের অভিজ্ঞতায় অচলার এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। অচলা যে সুরেশকে মনে মনে খুব ভয় করত তা সে প্রকাশ না করে বলে যে অতিথিকে ফেলে রেখে তোমার আজ যাওয়া হবে না। মহিম তখন অচলাকে জানায় যে তাতে অতিথি সৎকারের কোন অসুবিধা হবে না, কারণ তুমি তো রইলে। মহিমের কথার উত্তরে অচলা বলে সে অতিথিকে ঠিকঠাক সময় দিতে পারবে না কারণ রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। অচলার শত বাধা সত্ত্বেও মহিম দৃঢ়চেতা মন নিয়েই পড়াতে চলে গেল। মহিমের এই আচরণ নিয়ে সুরেশ অচলার অসম্মানের কথা মনে করিয়ে দেয়। অচলা নিজেও বুঝতে পারে যে মহিম তার অনুরোধ কোনদিনই শোনে না। সুরেশের উপস্থিতিতে তার এই অপমান আরও বেশি করে মনে আঘাত দিতে লাগল। রাত্রে শোবার ঘরে মহিম অচলার কাছে জানতে চায় যে সুরেশ এখানে কতদিন থাকবে? এই কথা শুনে অচলা নিমেষে জ্বলে উঠল। কঠোর কণ্ঠে অচলা স্বামীর কাছে একথা বলার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। অচলার মুখে এই কথা শুনে মহিম অবাক হয়ে যায় কারণ সে সোজা ভাবেই কথাটির উত্তর জানতে চেয়েছিল, তাতে কোন রহস্যের আবরণ ছিল না। মহিমের প্রশ্নের ধরনে অচলা মনে করেছিল যে মহিম তাদের দুজনের পুরানো সম্পর্কের কথা হয়তো এখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই অচলা স্বামীর সংকীর্ণ মনোভাবের প্রশ্ন শুনেই রেগে গিয়েছিল। স্বামী স্ত্রীর বোঝাপড়ার অভাবে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি আমরা লক্ষ্য করতে পারি।

সকালে মৃণালের সাথে এবং পরে সুরেশের ব্যঙ্গবিদ্রূপের জেরে অচলার মন ভালো ছিল না। তারপর আবার স্বামীর মুখে অবিশ্বাসের কথা শুনে অচলা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল। এইসব চিন্তা করে সেই রাত্রে অচলার ঘুম আসল না। তাহার মনের মধ্যে সারাদিন যে বিরক্ত উত্তরোত্তর জমা হয়ে উঠতেছিল, সামান্য একটা কলহের আকারে তা বাহির হয়ে যেতে পারলে সে হয়ত নিজেকে সুস্থ বোধ করত। কিন্তু এমন করে তার মুখ বন্ধ করে দেওয়ায় সে নিজের মধ্যেই শুধু অন্তরদগ্ধ হয়ে পুড়তে লাগল। এইসব ঘটনা কল্পনা করে অচলা নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে গভীর রাত্রি পর্যন্ত বিনিদ্র থেকে ছটফট করতে লাগল। সকালে উঠে অচলা বাইরে এসে দেখে সুরেশ বহুক্ষণ পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া ঘরের সমস্ত জানালা খুলে একখানা চেয়ার টেনে কলেজের বইখানি পড়ছে। অচলাকে দেখে সুরেশ অনুমান করতে পারে যে সারারত্রি তার ঘুম হয়নি। অচলার চোখের নিচে কালি পড়িয়াছে, গণ্ড পাংশু, ওষ্ঠ মলিন – সে যত দেখতে লাগল ততই তাহার দুই চক্ষু ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হতে লাগল। কিন্তু দৃষ্টি কিছুতেই ফেরাতে পারল না। সুরেশের চাহনির ভঙ্গিতে অচলা বিস্মিত হইল কিন্তু এর অর্থ কিছুই বুঝতে পারল না। অচলা এরপর তার সাথে সৌজন্যমূলক বাক বিনিময় করল। তারপর সুরেশকে জানায় যে রাত্রে ঘুম না হওয়ায় নিজের পোড়া মুখ লোকের সামনে দেখাতে লজ্জিত মনে হয়। সুরেশ এই সুযোগে মহিমের কর্তব্যহীনতার কথা বলে অচলার মনকে বিষিয়ে দিতে চায়। কিন্তু অচলা তাতে তেমন কোন গুরুত্ব দেয় নি। সুরেশ তখন বুঝতে পারে যে অচলা তার কাছে সবকিছু গোপন করার চেষ্টা করছে। তাই অচলার কাছে সুরেশ স্পষ্ট করে কিছু জানতে চায়। সুরেশ সাহস পেয়ে এরপর অচলাকে জিজ্ঞাসা করে সে এখানে সুখে আছে কি? উত্তরে অচলা আরক্ত হয়ে জানায় যে এই প্রশ্ন করা আপনার উচিত হয়নি। আমি যে এখানে সুখে থাকতে পারি না একথা আপনার মনে হওয়াই অন্যায়। অচলার এই আচরণ সুরেশ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তাই সে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। সুরেশ তাই দুঃখের সঙ্গে অচলাকে বলতে পারে - “কেবল মাস দুই পূর্বে এ ভাবনা ভাবা শুধু যে আমার উচিত ছিল না তাই নয়, এ ভাবনায় অধিকার ছিল। আজ দুমাস পরে সব অধিকার যদি ঘুচে থাকে ত থাক, সে নালিশ করিনে এখন শুধু সত্যি কথাটা জেনে যেতে চাই। এসে পর্যন্ত একবার মনে হচ্ছে জিতেছ, একবার মনে হচ্ছে হেরেছ, আমার মনটা ত তোমার অজানা নেই- একবার সত্যি করে বলত অচলা কি?”৩১ সুরেশের মুখে এইসব কথা শুনে অচলার অশ্রুর ঢেউ পর্যন্ত ফেনাইয়া উঠল। কিন্তু প্রাণপণে তাহাদের শক্তি প্রতিহত করে অচলা বেগে মাথা নেড়ে বলল সে ভালো আছে। এরপর সুরেশের নিজের কথা বলে অচলার মন বোঝার চেষ্টা করে। অচলা সুরেশের সাথে তাদের পূর্বের কথা আলোচনা করতে বিরক্ত বোধ করে। অচলা তাই একসময় সেখান থেকে পালানোর কথা চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু সুরেশ অচলার এই মনোভাব অনুমান করে তার পালানোর পথ দুই হাত দিয়ে রুদ্ধ করে বলে যে তার সব কথা তাকে শুনতেই হবে। সুরেশের চোখে সেই দৃষ্টি দেখে অচলা শিউরে ওঠে। কিন্তু ভয়ে তার কথা সে শুনতে রাজী হয়। সুরেশ তখন অচলাকে জানায় যে তার ভয়ের কোন কারণ নেই সে তার গায়ে হাত দেবে না কারণ সেই জ্ঞানটা তার মধ্যে এখনো বর্তমান আছে।

তাই সুরেশ অচলাকে দৃঢ় ভাবে বলে - “আমি তোমার উপর সমস্ত অধিকার হারালেও, আমার উপর তোমার সমস্ত অধিকার বর্তমান আছে।”৩২ উত্তরে অচলা জানায় যে একথা মনে রেখে তার কোন লাভ নেই। একথা যেন সজোরে আঘাত করিয়া সুরেশকে পলকের জন্য বিবর্ণ করে ফেলল। সেই মুহূর্তে অচলা নিজেও অনুভব করল, অনুতাপের কথা তার নিজের পিঠের উপর সজোরে আসিয়া পড়িল। তাই ক্ষণকাল চুপ থেকে অচলা কোমল কণ্ঠে বলিল - “সুরেশবাবু, এসব কথা আমারও শোনা পাপ, আপনারও বলা উচিত নয়। কেন আপনি এসব কথা তুলে আমাকে দুঃখ দিচ্ছেন?”৩৩ অচলার এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে সে পূর্বের কথা ভুলে নতুন করে জীবনটাকে শুরু করতে চায়। অচলা যে কারও দুঃখ অনুভব করতে পারে তা নিয়ে সুরেশ সংশয় প্রকাশ করে। উত্তরে অচলা জানায় যে পাষাণ নয়, তাই তার মনে দুঃখ বিরাজ করে। অচলার এই কথা শুনে সুরেশ সন্তুষ্ট প্রকাশ করে। অচলার এই কথাকেই সে চিরজীবনের সম্বল করে বাঁচার রসদ খুঁজে পায়। সুরেশ তখন অচলার দুঃখের বোঝা বহন করতে সম্মত হয়। এই কথা শুনে অচলা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ ঘরে মহিম প্রবেশ করে। মহিমকে দেখে সুরেশ ও অচলা চমকে গেল। অচলা লজ্জায় পাশের ঘরে চলে গেল। কিন্তু মহিম কোন কিছু না বুঝতে পেরে হতবুদ্ধির মতো দাড়িয়ে রইল। মানবচিত্ত যে অবস্থায় সবার চেয়ে বেশি অসংকোচে ও অবলীলাক্রমে মিথ্যা উদ্ভাবন করতে পারে, সুরেশের তখন সেই অবস্থা। সে মহিমের কাছে তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চোখ মুছে হাসির সঙ্গে উদারভাবে স্বীকার করল সে সত্যিই ভারি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু মহিম তার জন্য কোন উদ্বেগ প্রকাশ করল না, এমনকি তার কারণ পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসা করল না। সুরেশ নিজেই এবার কেদারবাবুর মেয়ের প্রতি অভিমানের কথা মহিমকে বলতে থাকে। আসলে সুরেশ চাতুরী করে মুল ঘটনাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। মহিম কিন্তু সুরেশের এইসব কথা শুনতে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করে। তার জন্যই সুরেশের কথাকে কোন গুরুত্ব দিতে চায়নি। মহিম চলে যেতেই সুরেশ যেন এক লজ্জার মুখ থেকে হাঁপ ছেড়ে বেঁচে গেল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার অযাচিত জবাবদিহির সমস্ত নিস্ফলতা রাগে অভিমানে সারা শরীরে জ্বালা করতে লাগল।

মহিম ও সুরেশের কথোপকথনের সমস্ত বৃত্তান্ত অচলা আড়াল থেকে শুনেছিল। তাই অচলা মহিমকে জিজ্ঞাসা করিল যে - “আমার বাবা তোমার কাছে এমন কিছু গুরুতর অপরাধ করেছেন?”৩৪ এই প্রশ্নের কোন অর্থ বুঝতে না পেরে মহিম কোন উত্তর দিল না। তাই অচলা পুনরায় এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। মহিম তখন অচলাকে বলে কথাগুলোর অর্থ বোঝা তার পক্ষে কঠিন, তাই সে কোন উত্তর দিতে পারবে না। অচলার বাবার অসুখের খবরে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য মহিমের প্রতি যথেষ্ট রাগ করে অচলা। অচলার এই কথা মহিম কিছুতেই মানতে রাজী হয়নি। অচলার বাবার শরীর নিয়ে আলোচনা করায় তাদের স্বামী স্ত্রীর কথোপকথনে যথেষ্ট রাগ অভিমানের দৃশ্য দেখা যায়। এতে তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহ একটা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। অচলার বাবাকে মহিম গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য অচলার মনে খুব আঘাত লাগে। তাই সে বারে বারে মহিমকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। অচলা তখন মহিমের সাথে এ নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করতে চাইলে মহিম সরাসরি জানায় তার এখন সময় নেই। মহিমের ব্যস্ততা দেখে অচলা খুব রেগে যায়। কারণ সে চাইছিল যে মহিমের সঙ্গে বোঝাপড়া ভালোভাবে করে নিয়ে নিজের মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করবে। মহিম বাইরে চলে গেলে অচলা সুরেশর খবর নিতে তার ঘরে যায়। অচলাকে দেখেই সুরেশ অনুমান করতে পারে যে মহিমের সঙ্গে নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটিয়ে এসেছে। কিন্তু সুরেশ সাহস করে তার মনের কৌতূহল জিজ্ঞাসা করতে পারে না। সুরেশকে জামা কাপড় গোছাতে দেখে অচলা অবাক হয়ে যায় এবং কারণ জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে সুরেশ জানায় যে আজই তাকে বাড়ী ফিরে যেতে হবে। সুরেশের বাড়ী ফেরার কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। এতে অচলা কোন বাধা দেবার চেষ্টা না করে বরং তাকে এই কাজে সে সাহায্য করে। মহিমের সাথে সুরেশের কেদারবাবু সম্পর্কে যে আলোচনা হয়েছিল তা জানার জন্য অচলা সুরেশের কাছে কৌতূহল দেখায়। তখন সুরেশ ও অচলার এই নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হতে দেখা গেল। সুরেশ প্রথমে অনুমান করে যে মহিম বোধহয় এই ঘটনাটা সম্পর্কে অচলাকে সম্পূর্ণ জানায়। কিন্তু অচলা অকপটে জানায় যে মহিম তাকে কিছুই বলেনি, সে নিজেই লুকিয়ে তাদের কথা শুনেছে। সুরেশ মহিমকে একথা বলার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। অচলা তখন এর জন্য নিজের স্বার্থ দেখে সুরেশকে ক্ষমা চাইতে নিষেধ করল। অচলার ধারণা তার মঙ্গলের জন্যই সুরেশ এই কথাগুলি মহিমকে জানায়। সুরেশ যা করেছে তার জন্য অচলা তাকে সরাসরি সমর্থন করতে তার কোন দ্বিধা বোধ হয়নি।

সুরেশ যে এই লজ্জার জন্যই এখনি বাড়ী যেতে চাইছে তাই অনুমান করে অচলা তাকে আরও দুদিন থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। সুরেশের প্রতি অচলার মন যে কতটা বিহ্বল হয়েছিল তা অনুমান করা যায় যখন সে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারে - “বাড়ী আপনার বন্ধুর একার নয়, এর উপর আমারও তো কিছু অধিকার আছে। সেই জোরে আজ আমি নিমন্ত্রণ করছি, আমার অতিথি হয়ে অন্ততঃ আর কিছুদিন থাকুন।”৩৫ অচলার সাহস দেখে সুরেশ খুশি হয়ে গেল। অচলা যে তাকে অন্তর থেকে এতটা ভালোবাসে তা সুরেশ ভালোভাবেই অনুমান করতে পারে। এরই মধ্যে মহিম এসে অচলাকে ব্যাগ গোছানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে, অচলা কোন উত্তর দেয়নি। বরং সুরেশকেই লক্ষ্য করে পূর্ব প্রসঙ্গের সুত্র ধরে তার সাথে কথা বলতে লাগল। সুরেশ যে তার পরম আত্মীয় তাই তাকে আজ বাড়ী যেতে দেবে না বলে অচলা দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে দেয়। সুরেশের বাড়ী যাবার নিয়ে আলোচনা করেও অচলা ও মহিমের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদের কথা চলতে থাকে। অচলা ও মহিমের এই অশান্তি দেখে সুরেশ মনে মনে খুব খুশি হয়। তাই সে অচলার কথা শুনে আরও দুদিন এখানে থেকে যেতে সম্মত হয়ে যায়। মহিম ও অচলার দাম্পত্য কলহের জন্য আমরা এজন্য সুরেশকে দায়ী করতে পারি। সুরেশ যদি এই সময় তাদের মধ্যে উপস্থিত না থাকত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য কলহের সীমাটা এতটা অতিক্রম করত না। সুরেশ যদি তাদের দাম্পত্য জীবনের মঙ্গল আশা করত তাহলে অচলার কথা শুনে আরও সেখানে থেকে যেতে রাজী হয়ে জেত না। কারণ সুরেশই তাদের দাম্পত্য জীবনের অভিশাপ। তাই তার উপস্থিতি যে তাদের পক্ষে ভয়ানক তা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। রাত্রে অচলা ও মহিমের মধ্যে তর্ক বিতর্কের ফলে অচলাকে সুরেশের নিয়ে কথা বলে মহিম। এই কথা শুনে অচলা যথেষ্ট অপমানিত হয়। তাই সে মহিমকে সরাসরি জানিয়ে দেয় এত অপমান সহ্য করে সে মহিমের সাথে সংসার করতে পারবে না। এইজন্যই সে এখান থেকে তার বাবার কাছে চলে যেতে চায়। অচলার এই সিদ্ধান্তে আমরা যথেষ্ট অনুমান করতে পারি তদের দাম্পত্য জীবনে কলহের কতখানি তীব্রতা আকার নিয়েছে। অচলার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে মহিম ভয় পেয়ে যায়। তাই সে অচলাকে ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করে। সে বুঝতে পারে তাহলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। মহিম তাকে একথাও বলে সে যদি ভুল করে তাকে ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়ী চলে যায়, তবে কোনদিন তার ভুল ভাঙ্গে তখন সে তাকে জানাতে বলে, তাহলে সে সব অভিমান ভুলে তাকে তখনই নিয়ে আসবে। মহিমের এই কথা শুনে অচলার চোখ দিয়া একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। অচলা তাই মহিমকে জানায় মানুষের বারবার ভুল হয় না। তাই মহিমকে আর সে কষ্ট স্বীকার করতে হবে না। মহিম এরপর অচলার সঙ্গে কথায় পেরে না উঠে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। অচলা তখন রাগের বশে মহিমকে জানায় আমার সঙ্গে তুমি যদি তামাসা কর তাহলে ভুল করছ কারণ আমি কাল-পরশু এখান থেকে চলে যাব। মহিম তখন অচলাকে বলে আমি তোমাকে এখান থেকে যেতে দিতে চায়নি। মহিমের এই কথা শুনে অচলা রেগে গিয়ে বলে তুমি আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে এখানে ধরে রাখবে? সেটা তোমার দ্বারা কখনই সম্ভব হবে না।

অচলার এই কথা শুনে মহিম বলে কাল পরশু এখন অনেক দেরি আছে তাই তখন বিবেচনা করে দেখা যাবে। মহিম এই কথা অচলাকে বলে সেই সময় শান্ত করার চেষ্টা করে। এই নিয়ে জাতে আর বেশি আলোচনা না হয় তাই তাতে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে। পরদিন অচলার কাছে সুরেশ বাড়ী যাবার জন্য অনুমতি নিতে চাইলে উত্তরে অচলা তাকে বলে সেও কাল তার সাথে একসাথেই কলকাতায় ফিরে যাবে। অচলার হঠাৎ এই কথা শুনে সুরেশ অবাক হয়ে যায়। সুরেশ মনে মনে তাদের দাম্পত্য জীবনের একটা গভীর রহস্যের কথা চিন্তা করে। কিন্তু অচলা তাকে জানায় যে তার বাবাকে অসুস্থতার জন্য একবার দেখতে যাবে। সুরেশ কিন্তু অচলার এই সিন্ধান্তের কথা একটা রহস্যের অনুমান ক্রেতে পারে। সুরেশ মহিমকে জানায় সে আজই বাড়ী যাবে তাছাড়া সে অচলার কাল কোলকাতায় যাবার কথাও জিজ্ঞাসা করে। মহিম তখন রেগে গিয়ে তাকে আজই তার সাথে পাঠিয়ে দেবার কথা বলে। স্বামীর মুখে এই কথা শুনে অচলার খুব অভিমান হয় তাই সে সুরেশকে আজকের দিনটা থেকে যেতে অনুরোধ করে কারণ কালকে সে তার সাথেই কোলকাতায় যেতে চায়। স্ত্রীর ওদ্ধত্য দেখে সুরেশের মুখে বিবর্ণ হয়ে যায়। তাই সে মাথা হেট করে বলতে লাগল তার এখানে আর থাকার কোন প্রয়োজন নেই। সুরেশকে এই কথা বলতে শুনে অচলা ব্যাথিত হয়ে ওঠে। তাই অচলা কোনদিক লক্ষ্য না করে সুরেশকে বলিতে লাগল - “তোমার আমি কোন কাজেই লাগলুম না সুরেশবাবু, কিন্তু তুমি ছাড়া আর আমাদের অসময়ে বন্ধু কেউ নেই। তুমি বাবাকে গিয়ে বল, এরা আমাকে বন্ধ করে রেখেছে, কোথাও যেতে দেবে না,- আমি এখানে মরে যাবো। সুরেশবাবু আমাকে তোমরা নিয়ে যাও- যাকে ভালবাসিনে তার ঘর করবার জন্য আমাকে তোমরা ফেলে রেখে দিয়ো না।”৩৬ অচলার এই কথা শুনে সুরেশের খুব রাগ হয়। তাই সে মহিমকে বলে - “তুমি জানো মহিম, উনি ব্রাহ্ম মহিলা। নামে স্ত্রী হলেও ওর উপর পাশবিক অত্যাচার বলপ্রয়োগের তোমার অধিকার নেই।”৩৭ সুরেশের এই কথার প্রতিবাদ করে মহিম সঙ্গে সঙ্গে জানায় সে অচলার সে অচলার প্রতি কোনদিনই পাশবিক অত্যাচার করেনি। সে অচলাকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দিয়েছে একথাও নিঃসংশয়ে জানিয়ে দেয়। তাই সে সুরেশকে অনুরোধ করে কাল যেন সে সঙ্গে করেই অচলাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। বিকেল বেলায় অচলা ঘরে প্রবেশ করে টেবিলের উপর একটি ক্ষুদ্র চিঠি দেখতে পায়। চিঠিতে বার তারিখ উল্লেখ নেই কিন্তু মৃণাল কর্তৃক মহিমের যে এই চিঠি তা অচলা বুঝতে পারে। মৃণাল মহিমকে লিখেছে - “মেজদামশাই গো করছ কি? পরশু থেকে তোমার পথ চেয়ে চেয়ে তোমার মৃণালের দুটি চোখ ক্ষয়ে গেল যে।”৩৮ এই চিঠিটা পড়িয়া অচলার, মহিম ও মৃণালকে নিয়ে যে সন্দেহ ছিল তা আবার জোরালো হল। অচলার মনে সন্দেহ হল মৃণাল কেন মহিমের পথ চেয়ে বসে থাকার কথা বলে? এইজন্য মহিমের প্রতি অচলার যে অবশিষ্ট শ্রদ্ধাটুকু ছিল তাও এবার সব চলে গেল। অচলার মনে হয় মহিম মৃণালের প্রতি আকৃষ্ট বলেই, তাকে সে সহ্য করতে পারে না। তাই এই ঘটনার পর অচলার এখান থেকে কলকাতায় যাবার ইচ্ছাটা আবার জোরদার হয়। সুরেশের আশা পর্যন্ত এমনই একটা উৎকট ও অবিচ্ছিন্ন কলহের ধারা এ বাড়ীতে বয়ে চলেছিল যে তার সঙ্গে মাতামাতি করে অচলা বাকি সব ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু আজ মৃণালের দুই ছত্র চিঠি পড়ে আরো পুরান সংশয়কে নতুনভাবে তার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিল।

সেইদিন রাত্রে অচলা স্বামীর সঙ্গে অভিমানে জন্য একাকী দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। মহিম ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে অচলার দরজার সম্মুখে দাড়িয়ে দেখল, কপাট বন্ধ তাই ঠেলে দেখল তা ভিতর থেকে বন্ধ। মহিম তখন বার দুই ডেকে কোন উত্তর না পেয়ে তার শান্তি ভঙ্গ করার চেষ্টা করল না। কিন্তু অতি কঠিন পরীক্ষার দায় হইতে আপাততঃ ছুটি পেয়ে নিজেও যেন বেঁচে গেল। মহিম সেখান থেকে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু অচলার অভাব তার মনকে গভীরভাবে আঘাত করল যার জন্য তার ঘুম আসল না। সে তখন উঠে গিয়ে অচলাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসার জন্য চিন্তা করল। কিন্তু এইসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে হঠাৎ মহিম ঘুমিয়ে পড়ে। মহিমের ঘুম ভেঙ্গে গেলেও কিন্তু সে উঠতে পারল না। কারণ তার বাড়ীতে যে আগুন জলতে দেখে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সেই কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে তার মাথার ভিতর দিয়া সমস্ত পৃথিবী যেন খেলিয়া গেল। মহিম তখন এই অবস্থায় অচলাকে বাঁচানোর জন্য তার ঘরের দিকে ছুটে যায়। কারণ তখনও পর্যন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। মহিমের ঘরে এই আগুন কার দ্বারা লাগানো হয়েছিল তা আমাদের কাছে অজ্ঞাতেই থেকে যায়। মহিম এই আগুন লাগার ঘটনাটা নিরর্থক চেঁচামেচি না করে অসময়ে পাড়ার লোককে জাগানোর কথা চিন্তা করল না। কারণ মহিম বুঝতে পেরেছিল এই আগু আর বেশিদূর ছড়াতে পারবে না। মহিম অচলার ঘরটিতে আগুন লাগার সম্ভাবনা দেখে অচলার ঘরের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগল। ভিতর থেকে অচলা জানায় সে ভালো আছে। মহিম তখন অচলাকে ঘরে আগুন লাগার কথাটা জানিয়ে দেয়। ঘরে আগুনের কথা শুনে অচলা চিৎকার করে উঠে এবং তারপর সে আর কোন কথা বলতে পারে না। এই ভয়টাই মহিমের ছিল কারণ সে জানত যে ঘরে আগুন লাগা এর আগে অচলা কোনদিন দেখেনি। এই জন্যই আগুনের দৃশ্য দেখে অচলার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। সমস্ত ঘরে বিশাল আগুন দেখে অচলার সংজ্ঞা হারিয়ে যেতে লাগল। ঠিক সেই সময় মহিম জ্বলন্ত ঘরে হঠাৎ ঘরে ঢুকে গিয়ে মূর্ছিতা স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। মহিম এরপর বাড়ীর অন্য সকলকে সাবধান করার জন্য চিৎকার করতে লাগল। মহিমের চিৎকার শুনে সুরেশ পাংশু মুখে বাইরে বের হয়ে এল। অচলা তখন ভয় পেয়ে দুই হাত দিয়ে স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আগুন যখন বড় ঘরের চালে লাগল তখন মহিম অচলার গহনা গুলি উদ্ধারের জন্য যেতে চাইল। কিন্তু অচলা এই বিপদের মধ্যে তাকে সেখানে যেতে দিতে বাধা দিতে লাগল। অচলা তাই স্বামীকে বলে - “প্রতিশোধ নেবার এই কি সময় পেলে? কিছুতেই ওর মধ্যে তোমাকে আমি যেতে দেব না। যাক সব পুড়ে যাক।”৩৯

অচলার এই কথাটির মধ্য দিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে স্বামীকে সে খুব ভালবাসত। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার টানেই অচলা তাকে বাধা দেয়। কিন্তু দৃঢ়চেতা মহিম স্ত্রীর বাধা অতিক্রম করে সেই আগুনে মধ্যে ছুটে চলে গেল। এতক্ষণ পর্যন্ত সুরেশ স্থির ভাবেই দাড়িয়ে ছিল কিন্তু হঠাৎ সে এখান থেকে পালাবার জন্য প্রস্তুতি করতেই অচলা তার কোঁচার খুঁট ধরে ফেলে কঠোর কণ্ঠে বলে - আপনি কোথায় যাবেন? অচলার এই প্রশ্ন শুনে সুরেশ হতভম্ব হয়ে, সঠিক কোন উত্তর দিতে পারে নাই। অচলা তখন এই আগুন লাগানোর জন্য সুরেশকেই সন্দেহ করে। তাই অচলা দৃঢ়ভাবে সুরেশকে বলতে পার - “তিনি গেলেন তার জিনিস বাঁচাতে। আপনি কে? আপনাকে যেতে আমি কোনমতেই দেব না।”৪০ অচলার এই কথার মধ্যে স্নেহ, ভালোবাসার কোন স্থান ছিল না। এ যেন সে অনধিকারীর উৎপাতকে তিরস্কার করে দমন করে। মহিম অচলার সব গহনা গুলি উদ্ধার করে এসে অচলার পায়ের কাছে সেগুলি রেখে দেয়। পরের দিন সকালে স্বামীর মুখের প্রতি চেয়ে অচলার বুকের ভিতরটা হাহারবে কেঁদে উঠল। কারণ সে বুঝতে পারে তাকে সময়ে অসময়ে না বুঝে সে অনেক দুঃখ দিয়েছে। এইসব পূরানো কথা ভেবে অচলার প্রান আকুল হয়ে উঠল। গ্রামের লোক চারিদিকে ঘুরে ফিরে চেঁচামেচি করিতেছিল। তারা এইসব ঘটনা আলোচনা করে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সমালোচনা করতে লাগল। গ্রামের লোকের কিছুদূরে মহিম দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার পুড়ে যাওয়া ঘরের দিকে চেয়ে রইল এবং তা দেখে তার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। সমস্তই সে শুনতে পাচ্ছিল কিন্তু কৌতূহল বন্ধ করার মত মনের অবস্থা তার ছিল না। অন্য জাতীতে মহিম বিয়ে করেছে বলে এ নিয়ে গ্রামের লোকেরা নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে এবং এই বিপদের জন্য তাকেই তারা দায়ী করে। মহিমের এই ভুলের জন্য গ্রামের লোকেরা তাকে অচলাকে বাপের বাড়ী পৌঁছিয়ে দিয়ে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য জানায়। গ্রামের লোকের মুখে এই কথা শুনে মহিম সঙ্গে সঙ্গে রেগে যায় এবং যথেষ্ট প্রতিবাদ করে। মহিমের কথা শুনে গ্রামবাসীরা যা বলল তা মুখে উচ্চারণের যোগ্য নয়। অচলা এইসব কথাবার্তা শুনে বারবার কাঁদতে লাগল। মহিম অচলাকে বাড়ী যাবার জন্য ব্যবস্থা করলে অচলা কিন্তু মহিমকে ছেড়ে যেতে চায়নি। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার বন্ধনের জন্য অচলা তাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। অচলার কথা শুনে মহিম নিজে কোন সিন্ধান্ত গ্রহণ করতে না পেরে অচলাকেই পরামর্শ দিতে বলে। উত্তরে অচলা কিন্তু কোন ভালো উপদেশ দিতে পারে না। মহিম ও অচলা এখন কোথায় বসবাস করবে তা তারা সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অচলার মনে একবার সেই মুহূর্তে মৃণালের কথা মনে পড়ে কিন্তু লজ্জায় তা স্বামীর কাছে সে উচ্চারন করতে পার না। তাই অচলা মহিমকে তার সাথে কলকাতায় যেতে বলে। কারণ অচলা জানায় তোমার এখানে শুভানুধ্যায়ী লোকের বড় অভাব, তাই তোমাকে এখানে একা রেখে কিছুতেই যেতে পারব না। তাই অচলা স্বামীকে দৃঢ় কণ্ঠে জানাতে পারে - “আমার গলায় ছুরি দিলেও, এখানে তোমাকে একলা ফেলে রেখে আমি যেতে পারব না।”৪১ অচলার এই কথা শুনে তার মধ্যে আমরা গ্রাম বাংলার গ্রাম্য সতী লক্ষ্মী নারীর মতোই তাকে মনে হয়।

মহিমের ভিতরটা তোলপাড় করতে শুরু করল তাই সে কোন স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারল না। অচলা তখন তাকে বেশি ভাবনা চিন্তা করতে বারণ করে। অচলা বলে যে তার গয়না গুলো দিয়ে পশ্চিমে তারা একটা বাড়ী অনায়াসে কিনতে পারবে। স্বামীর সমস্ত ভার অচলা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। মহিম তখন অচলাকে জানায় সে এইসময় তার সাথে যেতে পারবে না। অচলা স্বামীর কথায় সম্মত হয়ে সন্ধ্যের সময় যেতে চায়। অচলা মনে মনে অনুমান করে যদি তার স্বামী তার সাথে না যায় তবে সে মৃণালের বাড়ীতে রাত্রি যাপন করবে। এই কথা মনে করে অচলার মুখশ্রী গম্ভীর ও বিবর্ণ হয়ে গেল। স্ত্রীর এই মনের সন্দেহ কিন্তু মহিম বুঝতে পারল না। মহিম তখন অচলাকে জিজ্ঞাসা করে সে কলকাতার কোথায় যাবে? উত্তরে অচলা বলে তার বাবার কাছে। একথা শুনে মহিম সেখানে যেতে সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে। অচলা তখন মহিমকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। অবশেষে সে তাকে বলে দু একদিন থেকে তার পশ্চিমে চলে যাবে। কিন্তু তাতেও রাজী হল না। অচলা জানত যে মহিম হল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একবার যা সিন্ধান্ত নেয় তার কোন পরিবর্তন হয় না। তাই অচলা বলে তাহলে তারা এখান থেকেই পশ্চিমে চলে যাবে। অচলা তার গয়না বিক্রির কথা বললে মহিম তাতে বাধা দেয়। মহিমের কথা শুনে অচলা একটা গুরুতর আঘাত ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর অচলা বলে কেন পারবে না তা সে জানতে চায়। কিন্তু মহিম কোন উত্তর না দেওয়ার জন্য উভয়েই তারা নিস্তব্ধ হয়ে রইল। এরপর অচলা রেগে গিয়ে স্বামীকে অনেকগুলো প্রশ্ন করে আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরল। মহিম তখন অচলাকে বলে - “তুমি যা দিতে চাচ্চো, তা নিতে পারলে আজ আমার সুখের সীমা থাকত না। কিন্তু কিছুতেই নিতে পারিনে। দুঃখ দেখে তোমার মতো আরও একজন আরও ঢের বেশি আমাকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেও যেমন দয়া, এও তেমন দয়া, কিন্তু এতে না তোমাদের, না আমার কারও শেষ পর্যন্ত ভালো হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।”৪২ এই কথা শুনে অচলা আর সহ্য করতে পারল না।অচলা কান্না ভুলে গিয়ে এর যথার্থ প্রতিবাদ করার জন্যই জ্বলন্ত চোখ দুটি উপরে তুলিবা মাত্র স্বামীর দিকে চেয়ে দেখতে পেল যে সেখান থেকে কিছুদূরে একটি নিমগাছের তলায় সুরে হাতে মাথা রেখে আকাসের দিকে মুখ তুলে চুপ করে পড়ে আছে। অচলা এই দৃশ্য দেখে কোন প্রতিবাদ করতে পারল না এবং উদ্ধত্য মাথা তার এমনিতেই নিচ হয়ে গেল। মহিম কিছুক্ষণ থেমেই বলল - “অচলা নিজেকে রিক্ত করে দান করবার অনেক দুঃখ, কিন্তু ঝোঁকের ওপর হয়ত তাই এক মুহূর্তে পারা যায়, কিন্তু তার ফলভোগ হয় সারা জীবন ধরে। আমি জানি একটা ভুলের জন্য তোমাদের মনস্তাপের অবধি নেই। আবার একটা ভুল হয়ে গেলে, তুমি না পারবে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে, না পারবে আমাকে মাফ করতে। এই ক্ষতি সইবার মতো সম্বল তোমার নেই, একথা আজ টের না পেতে পার, দুদিন পরে পারবে। তাই তোমার কাছ থেকে কিছুই আমি নিতে পারব না।”৪৩

মহিমের এই কথাগুলি শুনে হয় যে অচলার পূর্বের সমস্ত অভিযোগগুলি তার মনকে বিচলিত করে তুলেছিল। তাই মহিম হয়ত পূর্বের ভুল আর করতে চায়নি বলেই এই সিন্ধান্ত নেই। স্বামীর মুখে এই কথাগুলি শুনে অচলার বুকের ভিতর বিঁধিল। স্বামী যে তাকে এখনো আপন করে নিতে পারেনি একথা অনুমান করে অচলা। এর জন্য সে মৃণালকে দায়ী করে তার স্মৃতিতে রাগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তাই অচলাও এবার মহিমকে কঠিন কণ্ঠে বলতে পারে – “তুমি এতক্ষণ ধরে যা বোঝাচ্ছ সে আমি বুঝেছি। হয়ত তোমার কথাই সত্যি নয়ত তোমার মুখ দেখে দয়া হওয়াতেই আমার যথা সর্বস্ব দিতে চেয়েছিলুম। হয়ত দুদিন পরে আমাকে সত্যি এরজন্য আমাকে অনুতাপ করতে হতো, সব ঠিক, কিন্তু দ্যাখো অপরের মনের ইচ্ছে বুঝে নেবার মত যত বুদ্ধিই তোমার থাক, তোমাকে বুঝিয়ে দেবার জিনিস আছে। স্ত্রীর জিনিস জোর করে নেওয়া তো দুরের কথা, হাত পেতে নেবার সম্বল তোমারই বা কি আছে? আর তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না। এতুকু বুদ্ধি যে এখনো তোমাতে বাকি আছে, আজ থেকে তাই আমার সান্ত্বনা। কিন্তু যেখানেই থাকি, একদিন না একদিন তোমাকে সব কথা বুঝতেই হবে। হবেই হবে।”৪৪ অচলা এই কথাগুলি বলে হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে কান্না বন্ধ করতে লাগল। ঘরে আগুন লাগার পর থেকে সুরেশ নিজেকে অপরাধী মনে করে কারও সাথে তেমন ভাবে কথা বলতে পারল না। রাত্রের ট্রেনে অচলা ও সুরেশকে স্টেশনে ছাড়তে গেল মহিম। মহিম ও অচলার মধ্যে গয়না নেওয়াকে কেন্দ্র করে যে কথাবার্তা হয় তাতে তাদের উভয়ের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝির একটা পরিচয় আমরা লক্ষ্য করি। মহিম ও অচলার দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই আমরা তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির জন্যই অশান্তি হতে দেখা যায়। মহিমের দৃঢ়চেতা মনোভাবের জন্যও অচলা তাকে আপন করে নিতে পারেনি। মৃণালের ঠাট্টা তামাসায় মহিমকে কেন্দ্র করে তার যা কথা সে সব শুনে মনে গভীর সন্দেহ দেখা যায়। উপন্যাসে আমরা অচলার দোলচল প্রবৃত্তির জন্যও তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের চিত্র দেখতে পাই। এইসব কারণের জন্যই উভয়ের মধ্যে দাম্পত্য জীবন একদিনের জন্যও সুখের হতে পারেনি। যা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে - “অচলা মহিমকে আঁকড়ে ধরতে পারনি, সুরেশকেও প্রত্যাখান করতে পারেনি। সে মৃণালকে সব কথা যথাসময়ে বলতে পারেনি- শুধু মৃণালকেই নয়, যথাসময়ে কোন কথা ঠিক ভাবে ঘোষণা করতে না পারার ফলেও অচলার আচার আচরণ –কথাবার্তায় সমঞ্জস্য হারিয়ে গেছে।”৪৫ মহিম ও অচলার দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য আমরা প্রধানত অচলাকেই দায়ী করতে পারি। কারণ দোলাচল প্রবৃত্তির জন্যই তাএর দাম্পত্য জীবনে কোনদিন সুখের হতে পারেনি। অচলা এর দ্বারা শুধু নিজের জীবনকেই শেষ করেনি বরং সাথে সাথে মহিম ও সুরেশের জীবনের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। অচলা এই দুই পুরুষকেই একসাথে নিয়ে চলতে গিয়েই সব অশান্তির সৃষ্টি হয়। অচলা কিন্তু তার ভুল কখনো শোধরানোর চেষ্টা করেনি। যা উপন্যাসটিকে একটি ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। মহিম ও অচলার দাম্পত্য জীবনের কলহের জন্য সুরেশও কম দায়ী নয়। নব দাম্পতি যখন বিয়ে করে গ্রামের বাড়ীতে চলে যায়। বিয়ের সাতদিনের মধ্যে প্রতিহিংসা পরায়ণ মন নিয়ে সুরেশ সেখানে উপস্থিত হয়। সেইসময় ঐখানে যদি সুরেশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা না যেত তবে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবনের অবস্থাটা এতটা শোচনীয় হত না। কারণ সুরেশের উপস্থিতি সেখানে আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করেছে। তাই সুরেশের জন্যই অচলা মন দিয়ে ঘর সংসার করতে না পেরে তার সাথে কলকাতায় ফিরে যেতে চেয়েছে। উপন্যাসের মধ্যে এইসব নানারকম কারনেই আমরা অচলা ও মহিমের দাম্পত্য জীবনে কলহের চিত্র খুঁজে পাই।




তথ্যসূত্র

১৮. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (পঞ্চম খণ্ড), সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-৯, প্রথম আনন্দ সংস্করণ ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-২২৭
১৯. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড), অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯, দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা-৪৩৫
২০. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৫
২১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৬
২২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৩৯
২৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪১
২৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৮
২৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৪৯
২৬. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড),অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯, দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা- ৪৬০
২৭. ঐ পৃষ্ঠা-৪৬৩
২৮. ঐ পৃষ্ঠা-৪৮০
২৯. ঐ পৃষ্ঠা-৪৮৫
৩০. ঐ পৃষ্ঠা-৪৮৬
৩১. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৪
৩২. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫
৩৩. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৫
৩৪. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৬
৩৫. ঐ পৃষ্ঠা-৪৯৮
৩৬. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড), অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯,দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা- ৫০২
৩৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫০২
৩৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৩
৩৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৮
৪০. ঐ পৃষ্ঠা-৫০৮
৪১. ঐ পৃষ্ঠা-৫১০
৪২. ঐ পৃষ্ঠা-৫১১
৪৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫১১
৪৪. ঐ পৃষ্ঠা-৫১১
৪৫. বাংলা উপন্যাসের কালান্তর, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং,কলকাতা-৭৩, সপ্তম সংস্করণ নভেম্বর ২০১৬, অগ্রহায়ণ ১৪২৩, পৃষ্ঠা-১৯৩

‘দত্তা’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)


‘দত্তা’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)

সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)


বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী। ১৯০৩ সালে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প মন্দির শরৎচন্দ্রেরই রচনা। তখন কেউ অনুমান করতে পারেনি যে এই গল্পলেখকই কালে রবীন্দ্রনাথকে জনপ্রিয়তায় ম্লান করে দেবেন। ১৩১৯-২০ সনের ‘যমুনা’ পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালের ভারতী পত্রিকায় ‘বড়দিদি’ নামে শরৎচন্দ্রের একটি বড় গল্প প্রকাশিত হলে এটি পড়ে সাধারণ পাঠক মনে করেছিল, রবীন্দ্রনাথই বোধ হয় ছন্মনামে এই কাহিনীবিন্যাস রচনা করেছেন। কিন্তু এই গল্পটি যখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পড়ে দেখলেন তখন তিনি অনুমান করলেন এই গল্পটি যিনিই লিখে থাকুন, তিনি একজন অসাধারণ শিল্পী। আস্তে আস্তে অপরিচয়ের মেঘ সরে গেল। শরৎচন্দ্র স্নিগ্ধ আলোকে নিজের পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথের পাশেই উদিত হলেন। মাত্র বাইশ বৎসরেই সাহিত্য সাধনার মধ্যে তাঁর তিরিশখানি উপন্যাস ও গল্পসংকলন পাঠকসমাজে অসাধারণ প্রভাববিস্তার করেছিল। তিরিশ বৎসরেরও কম সময়ের মধ্যে এতগুলি শ্রেষ্ঠ ও বিচিত্র গ্রন্থ রচনা করে শরৎচন্দ্র অদ্ভুত মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন দেখছি অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যিক অল্প কিছুদিন সাহিত্য গগনে আতশ বাজির রোশনাই সৃষ্টি করেই কালের স্রোতে নিভে যান। কিন্তু শরৎচন্দ্র দীর্ঘদিন কথাসাহিত্যের সাধনা করেছেন, দীর্ঘতর দিন জনপ্রিয়তা রক্ষা করেছেন, এবং সম্প্রতি বাংলা কথাসাহিত্যের অভূতপূর্ব রূপান্তর হলেও সাধারণ পাঠক সমাজে এখনও তিনি একচ্ছত্র সম্রাট। শরৎচন্দ্রের দত্তা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি। উপন্যাসটি পুরোপুরি রোমান্টিক ধরনের সরস গল্প। শরৎচন্দ্র এটিকে ছোটগল্পের উপযোগী কাহিনীকে টানিয়া বুনিয়া দীর্ঘায়িত করেছেন। চার্লস গারভিসের ‘লিওলা ডেলস ফরচুন’ উপন্যাস কাহিনীর সঙ্গে শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’র মিল গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়। শরৎচন্দ্র যে এই উপন্যাসটি প্লটের জন্য খানিকটা ইংরেজী ঔপন্যাসিকের কাছে ঋণী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উপন্যাসের রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী যে পুরোপুরি বাঙালী এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে চরিত্র দুটির পরিস্ফুটতায় ইংরেজীর রঙ অনুভব করা যায়। উপন্যাসের ‘দয়াল’ চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের গোরার পরেশবাবুর ছাঁচে ঢালা। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলি হল বিজয়া, নরেন্দ্রনাথ, বিলাসবিহারী, রাসবিহারী ও দয়াল। উপন্যাসটিতে বিজয়া, নরেন্দ্রনাথ ও বিলাসের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র প্রকটিত হতে দেখা যায়। তাদের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বেই কলহের চিত্র আমরা লক্ষ্য করতে পারি।

উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই জগদীশ, বনমালী ও রাসবিহারী খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। জগদীশ যেমন ছিল সবচেয়ে মেধাবী, তাহার অবস্থাও ছিল সবচেয়ে মন্দ। তার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পিতা যজমানি করে বিয়া পৈতা দিয়াই সংসার চালাইত। বনমালীর পিতাকে লোকে বিত্তশালী ব্যক্তি বলিয়া জানিত। কিন্তু তিনি পল্লীগ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন। রাসবিহারীদেরও অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল। তাহারা তিন বন্ধু ঝড় জল উপেক্ষা করেই পায়ে হেঁটে প্রত্যহ বাড়ী হইতে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করিত। এমনি করেই তিনবন্ধু একসঙ্গে এন্ট্রান্স পাশ করেছিল। বটতলায় বসে ন্যাড়া বটকে সাক্ষী করে তিনবন্ধু প্রতিদিন প্রতিজ্ঞা করত, জীবনে কখনও তাহারা পৃথক হবে না, কখনও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে না এবং উকিল হয়ে তিনজনেই একটা বাড়ীতে থাকবে। তিনজনে রোজগার করে সমস্ত টাকা একটা সিন্দুকে জমা করবে এবং তাই দিয়ে দেশের কাজ করবে। এ তো গেল তাদের তিন বন্ধুর ছেলেবেলার কল্পনা। কিন্তু বড় হয়ে তাহারা এই কাল্পনিক প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারল না। বন্ধুত্বের প্রথম পাকটা এলাইয়া গেল বি.এ. ক্লাসে। কেশব সেনের তখন কলিকাতায় প্রচন্ড প্রতাপ। বক্তৃতার খুব জোর। সে জোর পাড়াগাঁয়ের ছেলে তিনটি হঠাৎ সামলাইতে পারিল না – ভেসে গেল। এরফলেই বনমালী ও রাসবিহারী প্রকাশ্যে ব্রাহ্মধর্ম দীক্ষা নিয়ে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইলেন। কিন্তু জগদীশ ধর্মের কথা চিন্তা করে তা পারল না। কিছুকাল পর পিতার মৃত্যুতে বনমালী কৃষ্ণপুরের জমিদার ও রাসবিহারী তাহাদের রাধাপুরের সমস্ত বিষয়-আশয়ের একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে গেল। কিছুকাল পরে এই দুই বন্ধু ব্রাহ্ম পরিবারে বিবাহ করে বিদৃষী ভার্য্যা নিয়ে গৃহে ফিরে এলেন। কিন্তু জগদীশের সে সুবিধা হল না। সে যথাসময়ে আইন পাশ করে, এক গৃহস্থ ব্রাহ্মণের এগারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করে অর্থোপার্জনের নিমিত্ত এলাহাবাদে চলে যেতে হল। গ্রামের লোকের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে বনমালী গ্রাম ছেড়ে কলিকাতায় এসে বাস করল এবং জমিদারির উপর নির্ভর না করে ব্যবসা শুরু করে দিলেন। রাসবিহারীর অল্প আয় তাই সে গ্রামের লোকের অত্যাচার সহ্য করে গ্রামের থেকে গেল। অতএব তিন বন্ধুর একজন এলাহাবাদে, একজন রাধাপুরে এবং আর একজন কলিকাতায় বাসা করায়, আজীবন অবিবাহিত থেকে এক বাড়িতে বাস করে, এক সিন্দুকে টাকা জমা করে দেশ উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞাটা আপাততঃ স্থগিত রইল।

জগদীশের ছেলে হইলে সে বনমালীকে সুসংবাদ দিয়ে এলাহাবাদ থেকে চিঠিতে জানাল, তোমার মেয়ে হলে, তাকে পুত্রবধূ করব। কারণ তার দয়াতেই সে উকিল হয়ে সুখে আছে একথা কোনদিন ভুলে নাই। বনমালী উত্তরে জানাল যে এই আবেদন রাজী। তাছাড়া জগদীশের ছেলের দীর্ঘজীবন কামনা করলেন। এই ঘটনার দুই বছর পূর্বে তার অপর বন্ধু রাসবিহারীর যখন ছেলে হয়, সেও ঠিক এই প্রার্থনাই করেছিল। ব্যবসা বানিজ্য করে বনমালী এখন মস্ত ধনী। তাই সবাই তার মেয়েকে ঘরে আনতে চায়।

এই ঘটনার পঁচিশ বৎসর পর বনমালী খুব বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। কয়েক বৎসর নানারকম রোগে ভুগে এইবার শয্যা আশ্রয় করিয়া টের পেলেন, আর বোধ হয় উঠতে হবে না। তিনি চিরদিনই ভগবৎপরায়ণ ও ধর্মভীরু ছিলেন। একমাত্র সন্তান বিজয়ার বিবাহ দিয়ে যেতে পারলেন না এটা মনে করে কিছু ক্ষুণ্ণ হলেন। বিজয়াকে সে খুব ভালবাসত তাইতো ছেলের অনুপস্থিতি তাহার মনে কোন দুঃখ ছিল না। বিজয়াকেই সে তার প্রানের চেয়ে প্রিয় মনে করতেন। বিজয়ার উপর এতবড় সম্পত্তি রেখে যেতে তার মনে কোন দ্বিধা নেই কারণ সে বিশ্বাস করত যে তার মেয়ে সব কিছু তার বজায় রাখতে সক্ষম হবে। বনমালী মৃত্যুর আগে মেয়ে বিজয়াকে একটা অনুরোধ করে যায় যে – “জগদীশ যাই করুক আর যাই হোক, সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু তাকে ভালবাসি। দেনার দায়ে তার বাড়ীঘর কখনো বিক্রী করে নিস নে। তার একটি ছেলে আছে – তাকে চোখে দিখিনি, কিন্তু শুনেছি, সে বড় সৎ ছেলে। বাপের দোষে তাকে নিরাশ্রয় করিস নে মা, এই আমার শেষ অনুরোধ।”১ বাবার এই কথা শুনে বিজয়া অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল যে তোমার আদেশ আমি কোন দিন অমান্য করব না। জগদীশবাবু যতদিন বাঁচবেন, তাকে তোমার মতই মান্য করব। কিন্তু তার অবর্তমানে তার সমস্ত বিষয় ছেলেকে ছেড়ে দিতে রাজী হয়নি। কারণ সে জানায় ঐ ছেলে যদি লেখাপড়া শিখে থাকেন তবে অনায়াসেই পিতৃ-ঋণ শোধ করতে পারবেন। মেয়ের কথা শুনে বনমালী জানায় যে তার পিতার ঋণের পরিমাণ অনেক বেশী। তাই ছেলেমানুষ হয়ে তা শোধ করতে পারবে না। উত্তরে বিজয়া জানায় যে পিতার এই ঋণ শোধ করতে পারে না সে কুসন্তান, তাকে বেশী প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

বনমালী তার এই সুশিক্ষিতা তেজস্বিনী মেয়েকে খুব ভালোভাবেই চিনতেন। তাই বেশী পীড়াপীড়ি না করে মেয়ের উপরেই সমস্ত ভার দিয়ে দিলেন। মেয়েকে সে বিশেষ কোন আদেশ দিয়ে আবদ্ধ করে যেতে চায় না। বনমালী এই মেয়েকে বলে যে তার মেয়ের জন্মের আগে জগদীশ তার কাছে মেয়েকে ছেলের সঙ্গে বিবাহ দিতে চায়। তখন আমি বন্ধুর কথায় রাজী হয়েছিলাম বলে তিনি যেন মেয়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। তার এই কন্যাটি ছোট বেলায় মাতৃহীন হইয়াছিল বলে মাতাপিতা উভ্যের স্থান তিনিই পূর্ণ করেছিলেন। তাই বাবার কথা শুনে কোন সংকোচ বোধ না করে বিজয়া বলেছিল যে বাবা তুমি তাকে শুধু মুখের কথা দিয়েছিলে, মনের কথা দাও নি। মেয়ের এই কথা শুনে বনমালী এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে বিজয়া বলে তাহলে তো তার সাথে একবার সাক্ষাৎ করতে চাইতে? বনমালী জানায় যে রাসবিহারীর কাছে সে শুনেছিল যে ছেলেটি নাকি তার মায়ের মতো দুর্বল, তাই ডাক্তারেরা তার দীর্ঘজীবনের কোন আশায় করেনি। এই সব কথা শুনেই বনমালী তার সাথে দেখা করতে চায়নি। তার সাথে দেখা না করে বনমালী মনে করে যে তার বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। সেই সময় বনমালী যে জগদীশকে তার মনের কথাই দিয়েছিল তা বিজয়াকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়। তারপর একটু থেমে বললেন – আজ জগদীশকে সবাই জানে, একটা অকর্মণ্য জুয়াড়ি, অপদার্থ মাতাল। কিন্তু এই জগদীশেই একদিন তাদের সকলের চেয়েই ভালছেলে ছিল। সে প্রতিটি মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পারত। এই ভালোবাসায় তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জগদীশের স্ত্রী ছিলেন সতীলক্ষ্মী। তার মৃত্যুতে শোকে জগদীশ পাগল হয়ে গেছে। তার স্ত্রী মৃত্যুকালে পুত্র নরেনকে আশীর্বাদ করে বলে যেন ভগবানের উপর তার অচল বিশ্বাস থাকে। পরে দেখা গেছে নাকি মায়ের এই আশীর্বাদ টুকু ছেলে নরেন একেবারে নিষ্ফল করে নাই। নরেন এইটুকু বয়সেই ভগবানকে তার মায়ের মতোই ভালবাসতে শিখেছে। বনমালী তার মেয়েকে নরেন সম্পর্কে জানায় সে একজন ডাক্তার কিন্তু ডাক্তারি করে না। এখন সে তার মামার কাছে বর্মায় থাকে। বিলাসবাবুর আগমন সংবাদ ভৃত্য আলো দিতে এসে জানিয়ে যায়। বিলাসবিহারী হল রাসবিহারীর পুত্র। বনমালী ব্যবসায়ীর শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের জমিদারী অনেক বাড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সেসমস্ত তত্ত্বাবধানের ভার বাল্যবন্ধু রাসবিহারীর উপরেই ছিল। এই জন্যেই বিলাসের এই বাটীতে আসা-যাওয়া আরম্ভ হয়েছিল।

দুইমাস হল বনমালীর মৃত্যু হয়েছে। বিজয়া একা হয়ে যাওয়ায় তার দেশের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা রাসবিহারীই করতে লাগল এবং সেই সূত্রে তার একপ্রকার অভিভাবক হয়ে বসলেন। কিন্তু যেহেতু রাসবিহারী গ্রামে থাকতেন সেই জন্য তার পুত্র বিলাসবিহারীর উপরেই বিজয়ার সমস্ত খবরদারীর ভার পড়ল। সেই তার প্রকৃত অভিভাবক হয়ে উঠল। একদিন হঠাৎ বিলাসবাবু বৃদ্ধ মাতাল জগদীশের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন। জগদীশ বিজয়ার পিতৃবন্ধু ছিলেন। বিলাস তখন বিজয়াকে জানায় যে জগদীশ মুখুজ্জ্যে তার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন, কিন্তু তিনি তার মুখ পর্যন্ত দেখতেন না। জগদীশবাবু টাকা ধার করতে দুবার এসেছিল। কিন্তু তার বাবা চাকর দিয়ে তাকে বাড়ীর বাইরে বার করে দিয়েছিলেন। বিলাসের পিতা জগদীশবাবুকে সহ্য করতে পারতেন না, একথা শুনে বিজয়া তাকে একপ্রকার সমর্থন করেন। বিজয়ার কথা শুনে বিলাসবাবু খুব উৎসাহিত হয়েছিল। তাই বিলাসবাবুকে বলতে শুনি – বন্ধুই হোক আর যাই হোক দুর্বলতার বশে কোন মতেই ব্রাহ্মসমাজে চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিৎ নয়। বিলাসবাবু তখন বিজয়াকে জানায় এখন যদি জগদীশবাবুর পুত্র তার বাবার সমস্ত ঋণ শোধ করতে না পারে তবে আইন মতে তার সম্পত্তি আমাদের হাতে নেওয়া উচিত। তাই সেটা ছেড়ে দেবার আমাদের কোন অধিকার নেই। কারণ সেই টাকায় আমরা সমাজের অনেক সৎকার্য করতে পারি। এছাড়া জগদীশবাবু কিংবা তার ছেলে আমাদের সমাজভুক্ত নয় যে তার উপর কোন প্রকার দয়া করা আবশ্যক। বিজয়ার সম্মতি পেলেই রাসবিহারীবাবু এইসব ঠিক করে ফেলবেন বলেই বিলাসকে এখানে পাঠিয়েছেন। তখন বিজয়া মৃত পিতার শেষ কথাগুলো স্মরণ করে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ সাহস করে জবাব দিতে পারল না। বিজয়াকে ইতস্ততঃ করতে দেখে বিলাস রেগে গিয়ে বলল আপনাকে ইতস্ততঃ করতে আমি কোন মতেই দিব না। অর্থাৎ এই কর্মে সে যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তা জানিয়ে দিল। বিজয়া যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব করে মহাপাপ করেছেন তা বিলাস জানিয়ে দেয়। বিলাস এরপর জানায় সে ঠিক করেছে যে ঐ বাড়ীটায় ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেবে। বিলাস এরপর বিজয়াকে পিতার পূর্ব কথা মনে করিয়ে দিয়ে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। তাই আপনার পিতার প্রতিশোধ নিয়ে এই কাজ করা উচিত। বিজয়া এই কথা শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এই কাজ করে তার কত নামধাম হবে তা মনে করিয়ে দেয় বিলাস। হিন্দুরা স্বীকার করবে যে ব্রাহ্মসমাজে মানুষ আছে, হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে। যাকে তারা নির্যাতন করে দেশ থেকে বিদায় করে দিয়েছিল, সেই মহাত্মারই মহীয়সী কন্যা তাদের মঙ্গলের জন্য এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে এর জয়গান হবে। এত বড় নামের লোভ সংবরণ করা বিজয়ার পক্ষে সম্ভব হল না। কিন্তু পিতার কথাগুলি মনে করে দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। বিজয়া এরপর জগদীশবাবুর ছেলের কথা বিলাসের কথা জানতে চাইল।

বিলাস বিজয়াকে জানায় যে তার ছেলে বর্তমানে গ্রামেই আছে। বিলাস তার বিশ্রী চেহারার বর্ণনা বিজয়াকে জানায়। জগদীশ বাবুর বাড়ীটা দখল করে নিলে কেউ গোলমাল করবে না কারণ তার প্রতি কোন ব্যক্তিরই কোন সহানুভূতি ছিল না। বিলাস বিজয়াকে একথা জোর করে আশ্বাস দেয়। বিলাস বিজয়াকে কিছুদিনের জন্য গ্রামে যাওয়ার জন্য আবেদন জানায়। বিজয়া বিলাসের কাছে এর কারণ জানতে চায়। উত্তরে বিলাস জানায় তার প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। প্রজাদের এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করা যে মহাপাপ তা তাকে জানিয়ে দেয়। এই কথা শুনে বিজয়ার সমস্ত মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়া এরপর জানায় সে পিতার কাছে জেনেছে তাদের গ্রামের বাড়ী বসবাসের অযোগ্য। এই কথা শুনে বিলাস জানায় সে দশ দিনের মধ্যে ঐ ঘরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বসবাসের যোগ্য করে দেবে। বিলাস রুঢ় কণ্ঠে জানায় যে আপনাকে সামনে রেখে আমি যে কি করতে পারি তা বোধ করি সীমা – পরিসীমা নেই। বিজয়াকে গ্রামে যেতে রাজী করিয়ে বিলাস প্রস্থান করল। কিন্তু বিজয়া সেখানেই চুপ করে বসে রইল। বিজয়া এই গ্রামের যেসব কথা পিতার কাছে শুনেছে তা স্মরণ করতে লাগল। তখন গ্রামের কথা শুনে তাহার কিছুমাত্র মনযোগ আকর্ষণ করতে পারত না। কিন্তু আজ ঐ গ্রামের কথা মনে করে তার আকর্ষণ বেড়ে গেল। কারণ সে অনুমান করল যে ঐ বাড়ীতে তার সাত পুরুষের বাস। তাই সেই বাড়ীর প্রতি তাহার একটা আকর্ষণ দেখা গেল। বিজয়ার পরলোক গত পিতৃদেবের সমস্ত গ্রাম সম্বন্ধে কথা গুলি স্মরণ করে তাহার প্রছন্ন বেদনার অকস্মাৎ এক মুহূর্তেই তাহার মনের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই কথা চিন্তা করতে করতে সে অনুমান করে যে ভিটার সঙ্গে তার জন্মাবধী পরিচয় নাই, তা আজ তাকে দুর্নিবার শক্তিতে টানতে লাগল।

বহুকাল পর জমিদার বাটি বিলাসের তত্ত্বাবধানে মেরামত হতে লাগল। কলকাতা থেকে বিচিত্র আসবাব পত্র গরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে প্রতিদিন আসতে লাগল। জমিদারের একমাত্র কন্যা দেশে বাস করতে আসবেন, ঐ সংবাদ প্রচারিত হওয়া মাত্র কেবল কৃষ্ণপুর নয় আশে পাশের সমস্ত গ্রামের মানুষ হৈ চৈ করতে লাগল। ঘরের পাশে জমিদারের বাস চিরদিনেই লোকের অপ্রিয় তাতে জমিদারের না থাকাটাই প্রজাদের কাছে একটা অভ্যাস হইয়া দাঁড়িয়েছে। সুতরাং নতুন করে তার বাস করবার বাসনটা সকলের কাছেই একটা অন্যায় উৎপাতের মত প্রতিভাত হল। গ্রামের লোকের কাছে একটা জনশ্রুতি ছিল যে জমিদার কন্যার সঙ্গে রাসবিহারীর পুত্র বিলাসের বিবাহ স্থির হয়ে গেছে। পূর্ব পরিকল্পনার মতই শরৎকালের প্রারম্ভেই এ মধুর প্রভাতে মস্ত দুই ওয়েলারবাহিত খোলা ফিটনে চড়ে তরুণী কন্যা নরনারীর সভয় কৌতূহল দৃষ্টির মাঝখানে পিতৃ পিতামহের পুরাতন আবাসস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। পাঁচ ছয়দিন পর একদিন বিজয়া চা পানের পর বিলাস বাবুর সঙ্গে বিষয় সম্পত্তি সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতেছিলেন, বেহারা আসিয়া জানাল একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তখন তাকে এইখানে নিয়ে আসতে বলল। বেহারার পিছনে একজন চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবক তার কাছে বসল। এই লোকটির আচরণে বিন্দুমাত্র সংকোচ দেখা গেল না। তাহার আগমনে বিলাস ও বিজয়া উভয়েই বিস্মিত হয়ে গেল। সে নিজের পরিচয় বলতে গিয়ে জানায় যে পূর্ণ গাঙ্গুলি তাহার মামা, বিজয়ার প্রতিবেশী এবং পাশের বাড়িটাই তার। সে বিজয়াকে প্রশ্ন করল যে পিতৃ-পিতামহের কালের দুর্গা পূজো না কি আপনি বন্ধ করে দিতে চান? এর মানে কি? তার প্রশ্ন শুনে বিজয়া বিজয়া আশ্চর্য এবং মনে মনে বিরক্ত হল কিন্তু কোন উত্তর দিল না। বিলাস উত্তর দিয়ে জানায় যে আপনি কি মামার হয়ে ঝগড়া করতে এসেছেন না কি? কিন্তু কার সাথে কথা বলতে এসেছেন, তা ভুলে যাবেন না। আগন্তুক বিলাসের এই কথা শুনে হেসে জিভ কেটে বলে সে সব আমি সব বুঝি এবং এখানে ঝগড়া করতেও আসিনি। বরং এই কথাটি আমার বিশ্বাস হয়নি বলেই ভাল করে যাচাই করার জন্যই এসেছি। উত্তরে বিলাস জানায় যে তার বিশ্বাস না হওয়ার কারণ কি? আগন্তুক তখন বলে নিরর্থক প্রতিবেশীর ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার জন্য সে একথা মন থেকে বিশ্বাস করতেও পারেনি। ধর্মমত নিয়ে তর্ক বিতর্ক বিলাসের কাছে ছোট বেলা হতেই খুব দক্ষ। বিলাস তাই তার এই কথা শুনে উৎসাহে প্রদীপ্ত হয়ে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের কণ্ঠে বলে - “আপনার কাছে নিরর্থক বোধ হলেই যে কারও কাছে তার অর্থ থাকবে না, কিম্বা আপনি ধর্ম বললেই সকলে তাকে শিরোধার্য করে মেনে নেবে, তার কোন হেতু নেই। পুতুল পুজো আমাদের কাছে ধর্ম নয়, এবং তার নিষেধ করাটাও আমরা অন্যায় বলে মনে করিনে।”২ বিলাসের এই কথা শুনে আগন্তুক তখন বিজয়ার সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। তার বিস্ময় বিজয়াকে মনে মনে আঘাত করল। কিন্তু সে ভাব গোপন করে সহজ ভাবেই বিলাসের মতামতকেই সমর্থন করল। আগন্তুক তখন হতাশ হয়ে জানায় সে তার কাছে এই সিন্ধান্ত আশা করেনি। আগন্তুক এরপর বলে এই পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের সমস্ত আপনার প্রজারা আনন্দ করে তাই তা আপনি বন্ধ করে দেবেন না। এই জন্যই আপনার এই কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনে। দুঃখী প্রজাদের কথা শুনে বিজয়ার কোমল হৃদয় ব্যাথায় ভরে গেল। আগন্তুকের বেশি কথা বলা দেখে বিলাস বিরক্ত হয়ে বলে আপনার সঙ্গে তর্ক করার আমাদের কোন সময় নেই। বিলাস এও জানায় আপনাদের পুজো করার ব্যপারে আমাদের কোন বাধা নেই, কিন্তু ঢাক ঢোল পিটিয়ে রত্রিদিন কানের কাছে বাজানোতে বাধা আছে। বিলাসের সাথে আগন্তুকের এই ব্যাপারে কথা কাটাকাটিতে ঝগড়া খুব চরম সীমায় পৌঁছায়। বিলাসের বাবাকে অপমান করার জন্য আগন্তুকের উপর বিলাস খুব রেগে যায়। বিলাসের এই রূপ দেখে কিন্তু আগন্তুকের ভয়ের কোন চিহ্নমাত্র চেখা গেল না। তাদের উভয়ের বাকবিতণ্ডা দেখে বিজয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। আগন্তুকের প্রতি বিলাসের এই খারাপ ব্যবহার দেখে বিজয়া লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়া এরপর বিলাসকে বলে মাত্র তিন চারদিন তারা একটু গোলমাল করলে কোন অসুবিধা হবে না। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়। পরিশেষে বিজয়া আগন্তুককে জানিয়ে দেয় প্রতি বছরের মতো এবছরেও তারা তাদের পুজো করুক, তাতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। বিজয়ার এই কথা শুনে আগন্তুক ও বিলাসবাবু উভয়েই বিস্ময়ে অবাক হয়ে বিজয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একথা বলে দেওয়া দরকার যে এই অপরিচিত যুবকটিই তাদের সর্বপ্রধান আসামী জগদীশের পুত্র নরেন্দ্রনাথ।

বিজয়া এরপর বিলাসের কাছে জানতে চাইল ঐ তালুকটা নেওয়ায় আপনার বাবার মতামত কি? বিলাস সঙ্গে সঙ্গে তার বাবার মতামতকে সমর্থন করে। বিলাসের পিতার মতামতকে অগ্রাহ্য করে বিজয়া আগন্তুককে পুজো করার অনুমতি দিলে তাতে বিলাস মনে মনে ক্ষুণ্ণ হয়। তাই বিলাস রেগে গিয়ে বিজয়াকে বলে - “বেশ, আপনার এস্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান নিন, কিন্তু এরপরে বাবাকে আমায় সাবধান করে দিতেই হবে, নইলে পুত্রের কর্তব্যে আমার ত্রুটি হবে।”৩ বিলাসের এই অচিন্তনীয় রুঢ় ব্যবহারে বিজয়া বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। বিজয়া এজন্য বিলাসের কাছে তার আচরণের জন্য সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে নেয়। তাই বিজয়া ভেবেছিল বিলাস বুঝি এরপর এনিয়ে আর কোন কথা বলবে না। কিন্তু বিলাস আবার জানায় যে পূর্ণ গাঙ্গুলিকে জানিয়ে দিন যে পূর্বের অনুমতিটিই যেন সে মেনে চলে, অর্থাৎ পুজো যেন বন্ধ করে। বিজয়া এই কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয় একথা জানাতে দ্বিধা বোধ করে না। এই কথা শুনে বিলাস খুব রেগে যায়। তাই সে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারে - “আপনি যদি তাকে সমস্ত গ্রামের মধ্যে অশ্রদ্ধার পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তাহলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।”৪ বিলাস যে কতটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে পারে তা আমরা তার এই কথাতেই অনুমান করতে পারি। বিলাসের এই কথা শুনে বিজয়ার অন্তরটা অকস্মাৎ ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু সে নিজেকে আত্মসংযম করে নিল। বিজয়া তাই শান্তভাবেই জবাব দিল আপনি যা পরেন করবেন কিন্তু অপরের ধর্মে কর্মে আমি বাধা দিতে পারব না। এই নিয়ে তাদের আলোচনা করতে করতে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে অবনতি দেখা যায়। বিজয়া ও বিলাসের মধ্যে ঝগড়া একটা চরম জায়গায় পৌঁছে যায়। বিজয়ার আচরণে রাসবিহারীও বিরক্ত হয়ে যায়। তাই তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেবার কথা বলে হুমকি দেয় বিজয়াকে। তার কথা শুনে বিজয়া কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকে যায়, যেন সে তার অপরাধটা একপ্রকার স্বীকার করে নেয়। বিজয়ার এই কোমল ভাব দেখে রাসবিহারী খুশি হয়ে বিষয় সংক্রান্ত অন্যান্য কথাবার্তা সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকল। জগদীশের বাড়ীটা খুব তাড়াতাড়ি দখল করে সমাজকে দান করার কথা বললেন। জগদীশের সাথে বিজয়ার বাবার ঋণ সম্পর্কে শর্তের সমস্ত কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় রাসবিহারী। এই কথা শুনে বিজয়া জানায় জগদীশ বাবুর ছেলেকে একবার এখানে ডেকে আরও কিছুদিন সময় দিয়ে দেখলে হয় না, যদি কোন উপায়ে তা ফিরিয়ে নিতে পারে। বিজয়ার এই কথা শুনে জগদীশ ছেলের প্রতি একটা দুর্বলতার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। বিজয়া যে এই বাড়ীটা দখল করতে ইচ্ছুক নয় তার এই সহানুভূতি সম্পন্ন কথা শুনেই অনুমান করা যায়। কিন্তু জগদীশের ছেলে যে তার কোন ব্যবস্থা করতে পারবে না, তা রাসবিহারী সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াকে জানিয়ে দেয়। পিতার কথা শেষ না হতেই বিলাস গর্জন করে বলে সে পারলেই আমরা দেব কেন? কারণ তার সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। তাই সেই বাড়ী এখন আইনত আমাদের। বিলাস এরপর জগদীশ বাবু সম্পর্কে নানারকম কুরুচিকর মন্তব্য করে। বিলাসের এই আচরণে বিজয়া মনে মনে খুব দুঃখ পায়। তাই বিজয়া রাসবিহারীর মুখের দিকে চেয়ে শান্ত কণ্ঠে জানায়, জগদীশ বাবু আমার বাবার বন্ধু ছিলেন, তার সম্বন্ধে সসম্মানে কথা বলতে বাবা আমাকে আদেশ দিয়ে গেছেন। বিলাস এরপর পুনরায় গর্জন করে উঠে। তাই রাসবিহারী তাকে চুপ করতে বললেন। বিলাস তখন রেগে গিয়ে বলে - “এসব বাজে সেন্টিমেন্ট আমি কিছুতেই সইতে পারিনে - তা সে কেউ রাগই করুক, আর যাই করুক। আমি সত্য কথা বলতে ভয় পাইনে, সত্য কাজ করতে পেছিয়ে দাঁড়ায়নে।”৫

রাসবিহারী তখন উভয় পক্ষকেই শান্ত করবার চেষ্টা করল। বিজয়া বলে তার বাবা মৃত্যুর পূর্বে তাকে আদেশ করে গিয়েছিলেন, ঋণের দায়ে তার বাল্য বন্ধুর প্রতি যেন আমি অত্যাচার না করি। একথা বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস বলে তবে তিনি কেন সমস্ত দেনাটা নিজে ছেড়ে দিয়ে গেলেন না শুনি? বিলাসের কথার কোন উত্তর না দিয়ে রাসবিহারীকে পুনরায় বিজয়া বলে জগদীশ বাবুর পুত্রকে ডেকে পাঠিয়ে সমস্ত কথা জানানো হয়, এই আমার ইচ্ছে। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস তাকে বিদ্রূপ করতে লাগল। বিজয়া এর কোন উত্তর দিল না। রাসবিহারী একাজ করতে পারবে কিনা তা জানতে চাইল। রাসবিহারী অতিশয় ধূর্ত লোক। তাই তিনি ছেলের ঔদ্ধ্যতের জন্য মনে মনে বিরক্ত হলেও বাইরে বিজয়ার মতকেই সমীচীন প্রমান করবার জন্য চেষ্টা করলেন। বিজয়ার সাথে বিলাসের তর্কবিতর্কের জন্য তাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। তাই তার একে অপরকে আর সহ্য করতে পারছিল না। দিঘড়ায় স্বর্গীয় জগদীশ বাবুর বাড়ীটা সরস্বতীর পরপারে। আজ হঠাৎ বিজয়া বিকেল বেলায় দারোয়ান কানাই সিংকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বাইরে বের হলেন। বিজয়া চলিতে চলিতে হঠাৎ একস্থানে এসে তার চোখে পড়ল নদীর মধ্যে গোটাকয়েক বাঁশ একত্র করে পরপারের জন্য একটা সেতু প্রস্তুত করা আছে। এটি ভালো করে দেখবার জন্য বিজয়া যখন জলের ধারে পৌঁছল তখন দেখতে পেল কিছু দূরে বসিয়া একজন খুব মনোযোগ সহকারে মাছ ধরিতেছে। বিজয়ার সাড়া পেয়ে লোকটি মুখ তুলিয়া নমস্কার করল। যে মাছ ধরছিল সে যে সেইদিনের সেই আগন্তুক, পূর্ণ বাবুর ভাগিনেয় তা বিজয়া চিনতে পারল। বিজয়া তখন প্রতি নমস্কার করে তার কাছে এসে কথাবার্তা বলল। বিজয়া তাকে তার বাড়ীর সন্ধান জানতে চাইল। সে তখন জানায় তার বাড়ী দিঘড়ায়, এই বাঁশের পুল দিয়ে যেতে হয়। গ্রামের নাম শুনিয়া বিজয়া তাকে জিজ্ঞাসা করে তার জগদীশ বাবুর ছেলের সাথে পরিচয় আছে কিনা? বিজয়া যে জগদীশ বাবুর বাড়িটি দেনার দায়ে কিনে নিয়েছে তা জানিয়ে দেয় ঐ লোকটি। বিজয়া তখন তাকে জিজ্ঞাসা করে যে ঐ বাড়িটি কেমন? বাড়িটি যে খুব ভালো তা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় ঐ লোকটি। লোকটি তখন বিজয়াকে ঐ বাড়িটির দিকে নিয়ে যায়। পথে যেতে যেতে নরেন সম্পর্কে অনেক কথা জানতে চায় বিজয়া। বিজয়া তখন ঐ ভদ্রলোককে জানায় নরেন বাবুকে দেনাটা শোধ করে দেওয়ার জন্য। উত্তরে ভদ্রলোকটি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয় তা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলে বিজয়া অনুমান করে যে তার সাথে নরেনের খুব ভালো পরিচয় আছে। বিজয়ার এই কথা শুনে ভদ্রলোকটি শুধু হাসল কিন্তু কোন কথা বলল না। ভদ্রলোকটি এরপর চলে যেতেই বিজয়া কিছুক্ষণ বিমনা হয়ে গিয়েছিল। বিজয়া এরপর রাসবিহারীকে নোটিশ দিয়ে জগদীশ বাবুর ঘরটি দখল রদ করতে বলে। এই কথা শুনে রাসবিহারী অবাক হয়ে যায়। বিজয়া বলে তিনি হয়ত অপমানের ভয়ে এখানে আসতে পারেন নি। কারণ তিনি ভেবেছেন নিশ্চয় তার প্রার্থনা আমরা মঞ্জুর করব না। বিজয়া এরপর রাসবিহারীকে নোটিশ করতে বলে জানায় এটাই তার শেষ অনুরোধ। কিন্তু রাসবিহারী বিজয়ার এই অনুরোধ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সে জানায় আমার কাছে কর্তব্য বোধ সবচেয়ে বড় তা সে যত কঠিনই হোক না কেন। এদিকে বিলাস এই বাড়িটি দখল করার জন্য পিতাকে জোরজবরদস্তি করতে থাকে। পুত্রের কথা শুনে রাসবিহারী কোন কথা বলে না। বিজয়াও খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নীরবে সম্মতি দিল বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার পরদুঃখে স্নেহ কোমল নারীচিত্ত রাসবিহারীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও বিলাসের প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল।

রাসবিহারী এরপর বিজয়াকে বলে বিলাস যা করতে চেয়েছিল, তা স্বার্থের জন্যেও নয়,রাগের জন্যেও নয়, শুধু কর্তব্য বলেই চেয়েছিল। তারপর রাসবিহারী নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য জানায় একদিন আমার বিষয়, তোমার বাবার বিষয় সব এক হয়েই তোমাদের দুজনের হাতে পড়বে, যেদিন বুদ্ধি দেবার জন্যে এ বুড়োকেও খুঁজে পাবে না। তিনি এই কথার দ্বারা বিজয়াকে বলতে চাইলেন যে বিজয়া ও বিলাসের বিবাহ বন্ধনে এক সুত্রে জীবন যাপনের কথা। রাসবিহারী মনে মনে ইচ্ছা ছিল নিজের ছেলের সাথে বিবাহ দেবার। রাসবিহারীর এই অকাট্য যুক্তির কথা শুনে বিজয়া কোন বিরুদ্ধাচরণ না করে চুপচাপ থেকে গেল। নিজের ছেলের মহান কৃতিত্বকে বোঝানোর জন্য তাই রাসবিহারী জানায় সে ছেলেমানুষ হলেও কিন্তু অনেকদুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজ করে। তাই মাঝে মাঝে জমিদারির কাজ ওর চাল বুঝতে আমাকেও স্তম্ভিত হয়ে চিন্তা করতে হয়। এই কথা শুনে বিজয়া কোন উত্তর দিল না। রাসবিহারী তখন বলে এই সমাজ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় বিলাস যে কিরকম উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তা মুখে প্রকাশ করে বলা যায় না। রাসবিহারী পুত্রের কাজ বড়াই করে বলে বিজয়াকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। কারণ বিজয়ার সম্পত্তির প্রতি রাসবিহারীর একটা লোভ ছিল। তাই যদি বিজয়াকে ছেলের বউ করা যায় তবে তার সমস্ত সম্পত্তি তাদের আয়ত্তে চলে যাবে। পরের দিন বিজয়া আবার দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে ঘুরতে চলে গেল। বিজয়া দেখে ঠিক সেইখানে আজও সেই লোকটি মাছ ধরছিল। এদিন কিন্তু তার সাথে কোন কথা না বলে চলে যেতে চাইছিল কিন্তু কানাই সিং তার সাথে কথা বলল। দারয়ানের কথা কানে যাওয়ামাত্রই তার মুল পর্যন্ত বিজয়ার আরক্ত হয়ে উঠল। বিজয়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে ভদ্রলোকটি তার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখে। কথা বলতে বলতে একবার নিজেকে ডাক্তার বলে ফেললেও কিন্তু পরক্ষণে তা অস্বীকার করে জানায় তার প্রতিবেশী একজন ডাক্তার। বিজয়া অনুমান করে যে জগদীশ বাবুর ছেলে নরেন এই ভদ্রলোকটির একজন বন্ধু। ভদ্রলোকটি বিজয়াকে জানায় যে নরেনবাবু তার দরিদ্র কৃষকদের চাষবাস নিয়ে লেখাপড়া শেখায় বিনামূল্যে। বিজয়া নরেন বাবুর গৃহে স্কুলের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। গরীব চাষিদের সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করার শিক্ষাই দিতে তার এই স্কুল। ভদ্রলোকটি বিজয়াকে জানায় ওই স্কুল দেখতে যাবার জন্য অনুরোধ করে। লোকটি বলে মাঠের মাঝখানে গাছের তলায় বাপ-ব্যাটা –ঠাকুরদায় মিলে সেখানে পাঠশালা বসে। এইসব কথা শুনে বিজয়া তৎক্ষণাৎ সেখানে যাবার জন্য উদ্যত হয়ে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই কৌতূহল দমন করে বলল না আজ থাক। এরপর বিজয়াকে খানিকটা এগিয়ে দিতে আসে ঐ ভদ্রলোকটি। মিনিট পাঁচ ছয় বিজয়া কোন কথা বলিল না, ভিতরে ভিতরে তার কেমন যেন লজ্জা করিতে লাগল অথচ এই লজ্জার কারণ সে কিছু খুঁজে পেল না। লোকটি এরপর বিজয়াকে বলে - “আপনি ধর্মের জন্যই যখন তার বাড়ীটা নিচ্ছেন – এই ক’বিঘে জমি যখন ভালো কাজেই লাগছে তখন এটা ত আপনি অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারেন?”৬ এইকথা গুলি বলে লোকটি মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। উত্তরে বিজয়া জানায় এই অনুরোধ করার আপনার কোন অধিকার আছে কি তার তরফ থেকে। লোকটি তখন স্পষ্টভাবে বলে এ অধিকার দেবার ওপর নির্ভর করে না, নেবার ওপর নির্ভর করে। এই অনুরোধ গৃহীত হলে তার নিজস্ব কোন লাভ হবে না। তাই সে নিরন্ন দরিদ্র কৃষকদের কথা ভেবেই এই অনুরোধ জানায়। তাদের সেবার অধিকার সকলেরই আছে,তাই সে নরেনের কাছে অনুমতি চাইতে যাবে না। ভদ্রলোকটি তার কথার ইঙ্গিতে বিজয়াকে বুঝিয়ে দিতে চায় সেই হল নরেন বাবু। কিন্তু বিজয়া তা বুঝতে পারেনি। বিজয়ার সাথে ভদ্রলোকটির কথাবার্তার মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের উৎপত্তি দেখতে পায়। কিন্তু এরমধ্যেই দুইদিন ঐ ভদ্রলোকের সাথে খোলামেলা কথা বলে বিজয়ার তার প্রতি একটা আকর্ষণের সৃষ্টি হয়।

বাড়ীর মধ্যে এসে বিজয়ার দুইটা কথা মনকে সর্বাপেক্ষা অধিক আচ্ছন্ন করিল, তার মধ্যে একটা হল ঐ ভদ্রলোকটির নাম না জানা এবং দ্বিতীয় হল দুইদিন পরে তিনি কোথায় চলে যাবেন। এই দুটি প্রশ্ন তার শতবার মুখে এসে পড়লেও কেবল লজ্জাতেই মুখ বাধিল। বিজয়ার এই আচরণ দেখে আমরা অনুমান করতে পারি ঐ ভদ্রলোকটির প্রতি তার মন খুব আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। তাই বিজয়ার মনে শুধু তার কথাই চিন্তা করতে লাগল। এমন সময় পরেশের মা এসে বিজয়াকে জানায় বিলাসবাবু বহুক্ষণ ধরে বাইরে বসবার ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই কথা শুনে বিজয়ার মন শ্রান্তি ও বিরক্তিতে ভরে গেল। বিলাসবাবুই যে এ বাড়ীর ভবিষ্যৎ কর্তৃপক্ষ, এ সংবাদ আত্মীয় পরিজন কারও জানতে বাকি ছিল না। সেই কারনেই তার আদর যত্নের ত্রুটি হতে পারত হত না। বিজয়া কোন কথা না বলে উপরে তার ঘরে চলে গেল। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে বিজয়া বিলাসবাবুর ঘরে গেল। বিলাস বলে - “তুমি নিশ্চয় ভেবেছ, আমি রাগ করে এতদিন আসিনি। যদিও রাগ আমি করি নে, কিন্তু করলেও যে সেটা আমার পক্ষে কিছুমাত্র অন্যায় হত না, সে আজ আমি তোমার কাছে প্রমান করব।”৭ বিলাস এতদিন বিজয়াকে আপনি বলিয়া ডাকিত কিন্তু আজ হঠাৎ তুমি সম্বোধনের কারণ কিছুমাত্র উপলব্ধি করতে না পারলেও বিজয়া যে অখুশি হয়নি তা তার মুখ দেখে বোঝা গেল। কিন্তু সে কোন কথা না বলে ঘরের মধ্যে এসে বসে পড়ল। বিলাস অচলাকে জানায় তাদের ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা সে বড়দিনের ছুটিতে করতে চায়। এরজন্য সে সমস্ত ঠিক করে ফেলেছে, এমনকি নিমন্ত্রণ করা পর্যন্ত হয়ে গেছে একথা বিজয়াকে জানায়। তার জন্য তাকে কাল থেকে খুব ঘুরতে হয়েছে। এরপর এই অনুষ্ঠান করা তার একটা তালিকা কাগজে লেখা বিজয়াকে দেখতে দেয় বিলাস। কিন্তু বিজয়া এতে খুব একটা কৌতূহল প্রকাশ না করে চুপচাপ থেকে গেল। বিজয়ার এই মৌন অবস্থা দেখে বিলাস অবাক হয়ে তার কারণ জিজ্ঞাসা করল। বিজয়া তখন ধীরে ধীরে বলল- আমি ভাবছি, আপনি যে নিমন্ত্রণ করে এলেন, এখন তাদের কি বলা যায়? বিজয়ার এই কথার কোন অর্থ বুঝতে পারল না বিলাস। বিজয়া তখন জানায় মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে সে এখনো কিছু স্থির করে উঠতে পারেনি। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস রাগে গর্জে উঠে। তাই তো বিলাস বিজয়াকে বলে – “তার মানে কি? তুমি কি ভেবেছ, এই ছুটির মধ্যে না করতে পারলে আর শীঘ্র করা যাবে? তারা ত কেউ তোমার – ইয়ে নন যে, তোমার যখন সুবিধে হবে, তখনই তারা এসে হাজির হবে? মন স্থির হয়নি, তার অর্থ কি শুনি?”৮ বিলাসের রাগে চোখ দুটি জ্বলতে লাগল। বিজয়া বহুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকে আস্তে আস্তে বলল - “আমি ভেবে দেখলুম, এখানে এ নিয়ে সমারোহ করবার দরকার নেই।”৯ বিজয়ার কথা শুনে বিলাস জানায় এই কাজ সমারোহ তারা করবে না। বরং তার কাজ নিঃশব্দে সমাধা করবার জ্ঞান তার আছে। তোমাকে সে জন্য চিন্তা করতে হবে না। বিজয়া তখন মৃদু কণ্ঠে জানায় যে এখানে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কোন সার্থকতা নেই। তাই সেটা হবে না। বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস রেগে যায় এবং বিজয়া যে সত্যিই ব্রাহ্ম মহিলা এতে সে সন্দেহ প্রকাশ করে। বিজয়া এই কথা শুনে তীব্র আঘাতে যেন চমকে মুখ তুলে চায় কিন্তু আপনাকে সংযত করে বলে আপনি বাড়ী গিয়ে শান্ত হয়ে ফিরে এলে তার পরে আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হবে - এখন থাক। বিলাস এরপর বিজয়ার সংস্রব একেবারে পরিত্যাগ করার কথা বলে ধমক দিতে লাগল। বিজয়া এই কথা শুনে তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। তাই বিজয়া নিঃসংশয়ে বলতে পারে - “আপনার দায়িত্ব বোধ যখন এত বেশি, তখন আমার অনিচ্ছায় যাদের নিমন্ত্রণ করে অপদস্থ করবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের ভার নিজেই বহন করুন, আমাকে অংশ নিতে অনুরোধ করবেন না।”১০ বিজয়ার এই কথা শুনে বিলাস দুই চক্ষু প্রদীপ্ত করে জোর গলায় বলে – “আমি কাজের লোক - কাজই ভালোবাসি, খেলা ভালোবাসিনে - তা মনে রেখো বিজয়া।”১১ বিজয়া স্বাভাবিক শান্ত সুরে তার এই কথা গ্রহণ করে। এই কথার মধ্যে যে শ্লেষটুকু ছিল তা বিলাসকে একেবারে উন্মত্ত করিয়া দিল। তাই সে চিৎকার করে বলে আচ্ছা, তুমি যাতে না ভোলো তার আমি চেষ্টা করব। কিছুক্ষণ পর বিজয়া জানায় যে এ বাড়ী যে নিতেই হবে তা কিন্তু এখনো স্থির হয়নি। এই কথা শুনে বিলাস রাগে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। তাই সে রাগে মাটিতে জোরে পা ঠুকিয়া পুনরায় চিৎকার করে বলে – হয়েছে, একশবার হয়েছে। আমি সমাজের মান্য ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করে এনে তাদের অপমান করতে পারব না- এ বাড়ী আমাদের চাইই। এ আমি করে তবে ছাড়ব- এই তোমাকে আজ আমি জানিয়ে গেলুম। বিলাসের এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে এই বাড়ীতে ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করার জন্য সে কতটা উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল। বিজয়ার সাথে বিলাসের এই ঘর দখল করা নিয়ে যে বাকবিতণ্ডা হয় তা চরম পর্যায়ে চলে যায়। তাই তাদের মধ্যে যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল তা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। বিলাস যে মনে মনে বিজয়াকে বিয়ে করার সংকল্প করে তা যেন তার মন থেকে একেবারে শেষ হয়ে যায়। বিজয়া কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তেই অটুট থেকে যায়। বিলাসের ঔদ্ধত্যের কাছে সে কিন্তু মাথা নিচু করেনি। তাই এখানে আমরা বিজয়ার আচরণ দেখে মনে হয় সে একজন মালিকের ভুমিকায় উত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই সে তার কর্মচারীকে গুরুত্বহীন ভাবে দেখতে শুরু করে।
জগদীশ বাবুর বাড়ীটা বিজয়ার দখল করার কোন ইচ্ছেই ছিল না। কারণ তার বাবা মৃত্যুকালে তাকে যে উপদেশ দিয়েছিল তাকে মান্যতা দেবার জন্যই সে এমন আচরণ করে। সেইদিন হতে বিজয়ার মনের মধ্যে এই আশাটা অনুক্ষণ যেন তৃষ্ণার মত জাগছিল যে, সেই অপরিচিত লোকটি যাবার পূর্বে একবার অন্তত তার বন্ধুকে নিয়ে তার কাছে অনুরোধ করতে আসবে। তাদের মধ্যে যা কথা হয়েছিল সমস্ত গুলি তার অন্তরের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটি শব্দ পর্যন্ত বিজয়া ভুলে যায় নাই। বিজয়ার এই আচরণে আমরা লক্ষ্য করে অনুমান করে বলতে পারি যে বিজয়া এই ভদ্রলোকটির প্রতি একটা ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তাই সে তার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। নদী তিরের পথে এখন আর তার সাথে বিজয়ার সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মনে মনে আশা করত যে, একবার না একবার তিনি তার কাছে দেখা করতে আসবেনই। বিলাসের সাথে বিজয়ার যে বিরাট তর্কাতর্কি হয় তা জেনেও রাসবিহারী কোন গুরুত্বই দেয় নি। তাই সে বিজয়ার কাছে এমন ভাব দেখায় যেন ছেলের সঙ্গে যে ইতিমধ্যে তার কোন কথা হয়েছে তার আভাস ছিল না। এই নিয়ে যে আর কোন প্রকার আন্দোলন উঠতে পারে তা যেন তার মনেই আসতে পারে না। তাই বিজয়া তার কাছে নিজেই কথাটা উত্থাপন করিতে পারিল না। পৌষের ঠিক প্রথম দিনটিতে পিতা পুত্র একসঙ্গে বিজয়ার সঙ্গে দেখা করলেন। রাসবিহারী বিজয়াকে জানায় আর বেশি দিন নেই তাই তাড়াতাড়ি সমস্ত গুছিয়ে ফেলতে হবে। বিজয়া তখন একটু বিস্মৃত হয়ে বলে সে নিজের ইচ্ছায় চলে না গেলে, কিছুই হতে পারে না। রাসবিহারী তৎক্ষণাৎ বিজয়াকে জানায় কালকে নরেন বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে। এই কথা শুনে বিজয়ার বুকের ভিতর খুব আঘাত লাগল। রাসবিহারীকে বিজয়া জিজ্ঞাসা করে তার জিনিসগুলোর খবর? এই কথা শুনে বিলাস সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রূপ করে। বিলাসের কথা শুনে বিজয়া চুপ করে থাকে কিন্তু তার মুখের উপর একটা বেদনার চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। তাই বিজয়ার এই দৃশ্য দেখে রাসবিহারী ছেলেকে রেগে গিয়ে বলে – “ওটা তোমার দোষ বিলাস। মানুষ যেমন অপরাধীই হোক ভগবান তাকে যত দণ্ডই দিন, তার দুঃখে আমাদের দুঃখিত হওয়া, সমবেদনা প্রকাশ করা উচিত। আমি বলছিনে যে, তুমি অন্তরে তার জন্যে কষ্ট পাচ্ছ না, কিন্তু বাইরেও সেটা প্রকাশ করা কর্তব্য।”১২ রাসবিহারীর এই কথা দ্বারা বিজয়ার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে নিজের ছেলেকে তার কাছে জাহির করার চেষ্টা করে। বিলাস এরপর নরেনের কথা শুনে রেগে গিয়ে পুনরায় বিজয়াকে বিদ্রূপ করে। তার পিতা তখন বারবার তার এই আচরণে তাকে অপমান করে। পিতার কথা শুনে বিলাস বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা অনুতপ্ত না হয়ে জবাবা দেয় - “পরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, পরের ক্লেশ নিবারন করার শিক্ষা আমার আছে, কিন্তু যে দাম্ভিক লোক বাড়ী বয়ে অপমান করে যায়, তাকে আমি মাফ করিনে। অত ভণ্ডামি আমার নেই।”১৩ তার জবাব শুনে রাসবিহারী ও বিজয়া উভয়েই অবাক হয়ে যায়। বিলাস এরপর বিজয়াকে জানিয়ে দেয় পূর্ণবাবুর ভাগিনেয়টিই যে আসলে জগদীশ বাবুর পুত্র নরেন।

নরেনের এই পরিচয় পেয়ে বিজয়ার সমস্ত মুখ মুহূর্তের মধ্যে একেবারে শুষ্ক বিবর্ণ হয়ে যায়। এদিকে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য জগদীশ বাবুর ঘরটি মন্দিরের জন্য ও ওপর ঘরগুলি অতিথিদের জন্য সজ্জিত করার কাজ চলতে থাকে। এই কাজে বিলাস নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তত্ত্বাবধান করে। নরেনের পরিচয় জানতে পেরেই তার জন্য বিজয়ার মন ছটফট করতে থাকে। তাই সে নরেনের খবর জানার জন্য আকুল হয়ে শেষ পর্যন্ত পরেশকে তার কাছে পাঠায়। নরেনের খবর সে যদি এনে দেয় তবে তাকে একটি কাপড় দেবার লোভ দেখায় বিজয়া। পরেশ যখন এই খবর আনতে গেল তখন থেকেই বিজয়া খবরের আশায় শূন্য দৃষ্টিতে সেইদিকে চেয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইল। নরেনের খবর জানার জন্য বিজায়র কৌতূহল আর ধরা দিচ্ছিল না। তাই সে অধীর আগ্রহে পথপানে চেয়ে রইল। বিজয়ার এই আচরণ দেখে আমরা অনুমান করতে পারি যে নরেনের প্রতি তার মনে একটা দুর্বলতা ছিল। পরেশ এসে বিজয়াকে জানায় নরেন সেখানে নেই, কোথায় চলে গেছে। এই কথা শুনে বিজয়া অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ বারান্দার মধ্যে নরেনের আবির্ভাব ঘটে। সে ঘরে পা দিয়েই হাত তুলে সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াকে নমস্কার করে। নরেন তখন বিজয়াকে বলে আপনি কেন নরেন বাবুর খবর জানতে চান? তার সাথে কি কোন দরকার আছে? আসলে নরেন জানত যে বিজয়া তার প্রকৃত পরিচয় জানে না। তাই বিজয়া নরেনের এই ছলচাতুরী দেখে তাকে বিদ্রুপের সঙ্গে বলে দরকার না থাকলে কেউ কি কারো খবর জানতে চায়? নরেন যখন নিজের পরিচয় ইঙ্গিতে জানায় তখন বিজয়া সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে কারণ সে পূর্বেই বিলসের কাছে এই পরিচয় পেয়েছিল। বিজয়া তখন নরেনকে বলে এই সত্য পরিচয়টি অনেকদিন পূর্বেই আপনার মুখ থেকে বার হওয়া উচিত ছিল। বিজয়ার এই কথা শুনে নরেনের মুখ মলিন হয়ে গেল। বিজয়া তাই নরেনকে বিদ্রূপ করে জানায় - “অন্য পরিচয়ে নিজের আলোচনা শোনা, আর লুকিয়ে আড়ি পেতে শোনা দুটোই কি সমান বলে আপনার মনে হয় না?”১৪ বিজয়ার মুখে এই কথা শুনে নরেন লজ্জায় একেবারে কালো হতে গেল। নরেন এরপর অকপটে জানায় আপনার সঙ্গে অনেকরকম আলোচনার মধ্যে নিজের আলোচনাও ছিল বটে, কিন্তু তাতে আমার মন্দ কোন অভিপ্রায় ছিল না। শেষ দিনটাতে আপনাকে আমার পরিচয় দেব বলে মনেও করেছিলাম কিন্তু হয়ে উঠল না। নরেন এসব কথা বলে নিজের দোষ ত্রুটি সমস্ত স্বীকার করে নেয়। নরেন এরপর বাড়ী যেতে চাইলে বিজয়া তাকে কিছুতেই যেতে দেয় না। তাই বিজয়া তাকে খাবার খাইয়ে তবেই বিদায় করে। নরেনের প্রতি আচরণ দেখে বিজয়ার মনে একটা ভালোবাসার গভীর আকর্ষণ আমরা অনুভব করতে পারি। বিজয়া তখন নরেনকে জিজ্ঞাসা করে সে কবে বর্মায় যাচ্ছে? উত্তরে নরেন জানায় পরশুদিন সে চলে যাবে। এরপর সে বলতে থাকে, তবু আপনার আচরণ দেখে বাইরের কারোর বলবার জো নেই যে আমি আপনার লোক নই। আসলে বিজয়ার সেবাযত্ন দেখে নরেন অভিভুত হয়ে যায়। তাই সে বিজয়ার গুণগান করতে ছাড়ে না। নরেনের যাবার পূর্বে সে বিজয়াকে জানায় আজকের এই দিনটা তার চিরকাল মনে থাকবে। নরেন যাবার সময় বিজয়া তাকে একটু দাঁড়াতে বলে। নরেন ফিরে এসে দাঁড়াতেই বিজয়া তার মাইক্রোস্কোপটা কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাই সে তার দাম জিজ্ঞাসা করে? নরেন উত্তরে জানায় সে পাঁচশো টাকার বেশি দামে তা কিনলেও এখন কিন্তু দু-আড়াইশো টাকায় বিক্রি করতে চায়। নরেনের বিক্রি করার আগ্রহ দেখে বিজয়া খুব ব্যাথিত হয়। এবং জিজ্ঞাসা করে এত কম দামে সেটা বিক্রি করার কারণ? নরেন উত্তরে জানায় যে তার এখন টাকার খুব প্রয়োজন। তাই শুনে বিজয়া ঐ যন্ত্রটা কেনবার আগ্রহ দেখায়। তাই সে পরের দিন এই যন্ত্রটা নরেনকে দেখাতে বলে। পরের দিন দুশো টাকার বিনিময়ে এই যন্ত্রটা নরেন বিজয়াকে বিক্রি করে দেয়। নরেন এই যন্ত্রটা সমস্ত ব্যবহার করতে শিখিয়ে দেয় বিজয়াকে। কিন্তু এই যন্ত্রটা সম্পর্কে বিজয়া কিছুই বুঝতে পারে না। বিজয়া তাই ব্যবহার করতে না পেরে যন্ত্রটিকে খারাপ বলে উপহাস করে। কিন্তু পরক্ষণে যন্ত্রটি নিজের কাছেই রেখে দেয় বিজয়া। সেদিনও বিজয়া নরেনকে ঘরে বসিয়ে না খাইয়ে ছাড়ে না। বিজয়া তখন যন্ত্রটি নিতে চায়নি। বিজয়ার এই ব্যবহার দেখে নরেন রেগে গিয়ে বলে তবে কেন আমাকে এত কষ্ট করে এটা বয়ে নিয়ে আনতে বললে। নরেনের এই কথা শুনে বিজয়া জানায় কষ্ট তো আমার জন্য করেননি, করেছেন নিজের জন্য। নরেনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিজয়া পুনরায় বলে - “আচ্ছা, আমিই না হয় নেব, আপনাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। আপনি খেতে আরম্ভ করুন।”১৫ এই কথা শুনে নরেন নিজেকে অপমানিত বোধ করে বলে আপনাকে আমার প্রতি দয়া করতে তো আমি অনুরোধ করিনি। নরেনের এই কথা শুনে আমরা বুঝতে পারি সে অভিমানের সুরে বিজয়াকে একথা বলে। বিজয়া তখন বিদ্রূপ করে বলতে থাকে আজ না করলেও সেদিন কিন্তু মামার হয়ে অনুরোধ করতে এসেছিলেন। এই কথা শুনে নরেন দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারে - “সে পরের জন্যে, নিজের জন্যে নয়। এ অভ্যাস আমার নেই।”১৬ এই কথাটা যে খুব সত্য তা বিজয়া এতদিন বুঝতে বাকি ছিল না। তাই তার এই কথা শুনে বিজয়ার একটু গায়েও লাগিল। বিজয়া ও নরেনের এই কথোপকথনের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না বরং তাদের মধ্যে একটা অভিমানের ছোঁয়া দেখা যায়। তার একে অপরের প্রতি মনে মনে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। তাই তাদেরকে মাঝে মাঝে ঠাট্টা তামাশা করতেও আমরা লক্ষ্য করি।

বিজয়া যে যন্ত্রটাকে এই মাত্র ভাঙা বলিয়া উপহাস করেছিল তার সাহায্যেই কি অপূর্ব এবং অদ্ভুত ব্যপার না তার দৃষ্টিগোচর হল। নরেন তাকে বোঝাতে শুরু করলে হঠাৎ সে বুঝতে পারে যে বিজয়া তা না শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। বিজয়া প্রত্যুত্তরে জানায় সে তার কথা সব মন দিয়ে শুনছে। নরেন তাকে জিজ্ঞাসা করলে বিজয়া কোন উত্তর দিতে না পেরে জানায় যে একদিনে সব জানা সম্ভব নয়। বিজয়া এরপরে নরেনের কাছে ছবি আঁকা শেখার জন্য কৌতূহল প্রকাশ করে। নরেন তখন জানায় অন্যমনস্ক হয়ে কোন শিক্ষাই শেখা যায় না। আসলে বিজয়া এইসব বলে নরেনের মনটাকে যাচাই করার চেষ্টা করেছিল। বিজয়া যে নরেনকে ভিতরে ভিতরে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল তা তার এই আচরণ দেখেই আমরা অনুমান করতে পারি। বিজয়া তখন ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে আমি যদি কিছুই শিখতে না পারি তবে আমার মাথায় সত্যিই শিং বেরোবে। বিজয়ার এই কথা শুনে নরেন হেসে ফেটে পড়ল, এবং বলল এটাই হল আপনার উচিত শাস্তি। বিজয়া ও নরেনের কথা বলতে বলতে রাত্রি হয়ে যায়। তাই বিজয়া উঠে গিয়ে আলো আনতে যায়। বিজয়া দ্রুতপদে বাহির হতেই সম্মুখেই রাসবিহারী ও বিলাসকে বসে থাকতে দেখে অকস্মাৎ যেন ভূত দেখে থেমে গেল। বিলাসের মুখের উপর কে যেন এক ছোপ কালি মাখিয়ে দিয়েছে। বিজয়ার নরেনের সাথে মেলামেশা দেখে বিলাস খুব রেগে যায়। কারণ সে বিজয়াকে নিজের বাগদত্তা হিসাবে মনে করত। কিন্তু বিজয়া যে তাকে অন্তর থেকে ভালবাসত না এটা তার ধারনা ছিল না। রাসবিহারী তখন বিজয়াকে জানায় তারা প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছে। তুমি ওঘরে নরেনের সাথে ব্যাস্ত থাকায় আমরা তোমাকে ডাকি নি। রাসবিহারী তখন বিজয়াকে বলে নরেন তোমার কাছে কি চাইতে এসেছে? পাশের ঘরে যেন শব্দ না পৌঁছায় তার জন্য বিজয়া মৃদুস্বরে জানায় একটা মাইক্রোস্কোপ উনি বিক্রি করে বর্মায় যেতে চান। সে যন্ত্রটিই তিনি আমাকে দেখাচ্ছিলেন। বিলাস এই কথা শুনে গর্জন করে বলে – ঠকাবার আর জায়গা পেলে না। বিলাসের কথা অগ্রাহ্য করে বিজয়া জানিয়ে দেয় সেই যন্ত্রটি সে নিতে চায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিলাস যে চেঁচামেচি করে নরেনকে বিদ্রূপ করতে থাকে তা নরেন ওঘরে বসে শুনতে পায়। বিলাসের ইচ্ছায় ছিল যাতে তার সব কথা ওঘরে পৌঁছায়। রাসবিহারী সব কথা শুনে কালিপদকে বলতে পাঠায় যে এসব ফন্দি এখানে খাটবে না। কিন্তু যাকে বলতে হবে সে নিজের কানেই সমস্ত শুনেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই কালিপদ যাওয়ার উপক্রম করতেই বিজয়া তাকে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জানায় তুমি শুধু আলো দিয়ে এসো গে, যা বলবার আমি নিজেই বলব। বিলাস তখন শ্লেষের সঙ্গে পিতাকে বলে - “কেন বাবা, তুমি মিথ্যে অপমান হতে গেলে ওর হয় ত এখনো কিছু দেখিয়ে নিতে বাকি আছে।”১৭ এও কথা শুনে রাসবিহারী কোন কথা বললেন না। কিন্তু ক্রোধে বিজয়ার মুখ রাঙা হয়ে গেল। এটা বিলাস লক্ষ্য করেও মাইক্রোস্কোপ নিয়ে নানারকম বিদ্রূপ করে জোরে জোরে হাসতে লাগল। নরেনকে বিজয়ার কাল খাওয়ানোর কথা সে জানতে পেরেছিল এবং আজ তাদের উচ্চহাস্যও সে নিজের কানে শুনেছিল। তাছাড়া বিজয়ার আজকের বেশভূষার পারিপাট্যও দেখে বিলাস আশ্চর্য হয়ে গেল। এই সব দেখে শুনে বিলাস ঈর্ষায় জ্বলে মরতেছিল। তাই তার দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিল না। কারণ এই সব দেখে বিলাস অনুমান করতে পেরেছিল যে নরেনকে বিজয়া মনের মধ্যে স্থান দিয়ে দেয়। বিজয়ার আচরণ দেখে সে অনুমান করে যে নরেনের প্রতি গভীরভাবে বিজয়া প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। বিজয়া যে তাকে একেবারে গুরুত্বই দিতে চায়নি সেটাও বিলাস বুঝতে পারে। রাসবিহারী যখন বিজয়াকে জানায় যে নরেনকে বল কাল এসে যেন টাকাটা নিয়ে যায়। বিজয়া তখন বলে যে আপনার সঙ্গে আমি কাল কথা বলব। কারণ তার বাড়ী যেতে রাত হয়ে যাচ্ছে – আবার অনেক দূরে যেতে হবে, তাই ওর সঙ্গে আমার কিছু আলোচনা করবার আছে। বিজয়ার এই কথা শুনে বৃদ্ধ রাসবিহারী মনে মনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেও বাইরে তার কোন প্রকাশ করলেন না। তিনি চেয়ে দেখলেন তার পুত্রের চোখ দুটি অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝক ঝক করছে এবং কি একটা বলবার জন্য যেন যুদ্ধ করছে। পুত্রের এই অবস্থা লক্ষ্য করে রাসবিহারী পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে কালকে আসার কথা বলেই চলে গেল। বিজয়া এরপর নরেনের কাছে গিয়ে বলে আপনি সমস্ত কথা নিজের কানে শুনেছেন বলেই বলছি যে, আপনার সম্বন্ধে তারা যে সব অসম্মানের কথা বলেছেন, যে তাদের অনধিকার চর্চা। বিজয়ার এই কথা শুনে আমরা অনুমান করতে পারি যে নরেনের প্রতি কতটা সহানুভূতিসম্পন্ন। তাই বিজয়া তাদের অপকর্মের জন্য প্রতিশোধ নেবারও কথা ঘোষণা করে। কারণ তার ভালোবাসার মানুষকে অপমান করায় তার মনে খুব আঘাত লাগে। কিন্তু নরেন তার জন্য তাদের সাথে বিজয়া কোন খারাপ ব্যবহার করে এটা করতে সে নিষেধ করে। নরেন এরপর যেতে চাইলে, বিজয়া তাকে কাল বা পরশু একবার আসবার জন্য অনুরোধ করে। উত্তরে নরেন জানায় তার সময় হবে না। এই কথা শুনে বিজয়ার দুই চোখের মধ্যে জল পড়িতে লাগিল। বিজয়াকে কোন কথা বলতে না শুনে নরেন মনে করে সে তার প্রতি রাগ করেছে। তাই নরেন তাকে বলে আপনি নিজে এত হাসতে পারেন, আর আপনারই এত সামান্য কথায় রাগ হয়? নরেন এরপর তাকে জানায় যে আপনাকে আমার সর্বদা মনে পড়বে- আপনি ভারি হাসতে পারেন। নরেনের এই শেষ কথা শুনে বিজয়ার চোখের জল বাগ মানতে না পেরে টপটপ করে মাটির উপর ঝরে পড়ল। হাত দিয়ে মুছতে গেলে পাছে নরেন বুঝতে পারে তাই নিঃশব্দে নতমুখে দাড়িয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নরেন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বিজয়ার চিবুক তুলে ধরে লক্ষ্য করলেন যে বিজয়া কাঁদছে। তখন বিজয়া দ্রুতবেগে পিছনে গিয়ে তার চোখ মুছে ফেলল। বিজয়ার এই কান্নার কারণ নরেন তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। এইসব ব্যাপার তার বুদ্ধিতে বোঝা গেল না। বিজয়া যে নরেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে হারানোর আশঙ্কায় কেঁদে ওঠে তা সে কোনমতেই অনুমান করতে পারেনি। কারণ নরেনের এই ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। বিজয়া নরেনকে মাইক্রোস্কোপের ব্যাগটা হাতে তুলতে দেখে রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠে ওটা আমার, আপনি রেখে দিন। এই কথা বলেই বিজয়া কান্না আর চাপাতে না পেরে দ্রুতপদে ঘর হতেই বেরিয়ে গেল। বিজয়ার এই আচরণ খুব গভীর ভালোবাসার লক্ষণ। কাউকে অন্তর থেকে ভালো না বাসলে এইভাবে তার উদ্দেশ্যে কাঁদতে পারা সম্ভব নয়। তাই এখানে আমরা স্পষ্টই অনুভব করি থাকি বিজয়া নরেনকে গভীরভাবে ভালোবাসে। অনুভুতি লক্ষ্য করা যায় না একথা অস্বীকার করা যাবে না।

বিলাসবিহারীর প্রচণ্ড কীর্তিতে পল্লীগ্রামে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার শুভদিন আগত হয়ে গেল। একে একে সমস্ত অতিথিগনের সমাগম ঘটতে লাগল। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে সমস্ত অতিথিদের কাছে রাসবিহারী ঘোষণা করে দেয় যে বিলাস ও বিজয়া কিছুদিনের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। এই কথা শুনে বিজয়া ক্ষোভে, বিরক্তিতে, ভয়ে তার কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। কিন্তু সে স্পষ্টভাবে কিছু প্রকাশ করল না। বিজয়ার এই মৌন অবস্থাকে রাসবিহারী তার সম্মতি হিসাবে মেনে নেয়। তাই সে অথিতিদিগকে জানিয়ে দেয় যে ফাল্গুন মাসেই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হবে। বিজয়া সঙ্গে সঙ্গে বাবার মৃত্যুর এক বছরের কথা বলতেই রাসবিহারী সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে তা বৈশাখ মাসে হবে। রাসবিহারী এরপর বিজয়াকে জানিয়ে দেয় তিনি নরেনকে তার টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন তাই বিজয়া যেন আর তা না দেয়। এই কথা শুনে বিজয়া বলে তিনি দুবার নেবার লোক নন। এমন একদিন ছিল, যখন বিলাসের হাতে আত্মসমর্পণ করা বিজয়ার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ছিল না। কিন্তু আজ শুধু বিলাস কেন পৃথিবীর কোন লোকের মধ্যে কেবল একটিমাত্র লোক ছাড়া আর কেহ স্পর্শ করেছে একথা ভাবলেও তার সর্বাঙ্গ ঘৃণায় ও লজ্জায় এমনকি পাপে সে ভয় পেয়ে গেল। তাই শুধুমাত্র নরেনকেই মনে মনে চিন্তা করতে থাকে। বিলাসের সাথে বিজয়ার বিয়ে পাকা হলেও কিন্তু তাকে মনে মনে ঘৃণা করত। তাই আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পাই দয়াল ও তার ভাইঝি নলিনী কৌশলে বিজয়ার সাথে নরেনের বিয়ে দেয়। তার আগে আমরা দেখতে পাই বিলাসের সাথে বিজয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্য তাদের মেলামেশা বেড়ে যায়। এইজন্য বিজয়াকে বিরক্ত না করে নরেন তাদের বাড়ীতে যাওয়া আসা প্রায় ছেড়ে দেয়। কিন্তু দয়াল বাবুর বাড়ীতে তার তার যাতায়াত বাড়তে থাকে। এই জন্যই নরেনের সঙ্গে দয়ালের ভাইঝি নলিনীর মেলামেশাতে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা অনুমান করে বিজয়া ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিন্তু দয়ালবাবু বিজয়ার বাবার পুরানো পত্র দেখে যে তিনি তার মেয়েকে জগদীশ বাবুর ছেলের সাথে বিয়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। তাই তিনি কোন ভুল না করে স্বর্গীয় বনমালীবাবুকে শ্রদ্ধা জানাতেই এরপর বিজয়াকে নরেনের সাথে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। দয়ালবাবু ও তার ভাইঝির সাহায্য নিয়ে অবশেষে বিজয়া ও নরেনের বিবাহ সম্পন্ন করে। বিজয়া তার ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়।



তথ্যসূত্র

১. শরৎ রচনাবলী(দ্বিতীয় খণ্ড), অশোক বুক এজেন্সী, কলকাতা-৯, দশম প্রকাশ-২০১২, পৃষ্ঠা-৩৩৪
২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪০
৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪২
৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪৩
৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৪৪
৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫১
৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
৮. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
৯. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৩
১০. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৪
১১. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৪
১২. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৫
১৩. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৫
১৪. ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৯
১৫. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৫
১৬. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৫
১৭. ঐ পৃষ্ঠা-৩৬৭