
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে দাম্পত্য কলহের খুঁটিনাটি চিত্র (নিজের ভাষায়)
সৌমেন রায় (এম.ফিল গবেষণারত, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসটিও একটি সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসটি গভীর রসাত্মক ও পরিণাম অত্যন্ত বিষাদময়। উপন্যাসের পরিণাম বড়ই ট্রাজেডিপূর্ণ। এই উপন্যাসটি গার্হস্থ্য উপন্যাস মনে হলেও ইহা আসলে ক্রাইম উপন্যাস তবে নীতিগর্ভ। উপন্যাসের মুল বিষয় হল এক ধনবান ব্যাক্তির সুখী দাম্পত্য জীবন পরস্ত্রীর প্রতি কামজ মোহে কিভাবে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে পারে। উপন্যাসের শুরুতে দেখি জমিদার গোবিন্দলাল স্ত্রী ভ্রমরকে নিয়ে সুখেই দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। ভ্রমর বালিকা হওয়ায় সে অনেক সহজ সরল। তাই তাদের দাম্পত্যের মধ্যে কোন অশান্তি ছিল না। কিন্তু গোবিন্দলালের জীবনে হঠাৎ রোহিণীর উপস্থিতি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রোহিণী হল এক বিধবা কপটচারী নারী। সে পুরুষ মানুষকে কি ভাবে বশ করতে হয় তা খুব ভালো করে জানে। প্রথমে সে হরলালকে অন্ধমোহে বাঁধতে চাইলেও কিন্তু তাতে অসমর্থ হয়। এতেই তার প্রতিহিংসা অনেকখানি বেড়ে যায়। রোহিণী একদিন গোবিন্দলালের বারুণী পুকুরে জল আনতে যায়। রোহিণী তখন কুসুমিত কুঞ্জবনে ছায়াতলে গোবিন্দলালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। রোহিণী তখন ছলনা করে পুকুরের ঘাটে বসে কাঁদতে লাগল। গোবিন্দলাল পুস্পদ্যানের লতার অন্তরাল থেকে দেখতেছিলেন যে রোহিণী পুস্করিনীর ঘাটের রানায় বসে একাকী কাঁদছে। সন্ধ্যা হওয়া সত্ত্বেও রোহিণী যেহেতু কাঁদছিলেন তাই গোবিন্দলাল তখন রোহিণীর কাছে গেল এবং কান্নার কারন জিজ্ঞাসা করল। রোহিণী কিন্তু কোন উত্তর দিল না। গোবিন্দলাল রোহিণীর দুঃখের কারন জেনে তার উপকার করার কথা বললেও রোহিণী নীরব থাকে। গোবিন্দলাল হল পরোপকারী এবং সহানুভূতিশীল তাই রোহিণীকে বলে গেলেন – “তোমার যদি কোন বিষয়ে কষ্ট থাকে, তবে আজি হউক, কালি হউক, আমাকে জানাইও। নিজে না বলিতে পার, তবে আমাদের বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগের দ্বারায় জানাইও।”২২ এই কথা শুনে রোহিণী জানায় যে আজ নয় অন্য একদিন বলব। সেইদিন তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। গোবিন্দলাল তাতে স্বীকৃত হয়ে বাড়ী গেলেন।
সে রাত্রে রোহিণীর মনের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে ঘুম হল না। এর পর প্রতিদিনই রোহিণী কলসি কক্ষে নিয়ে বারুণী পুকুরে জল আনতে যায়। প্রতিদিনই পুস্পকানন মধ্যে গোবিন্দলালকে সে লক্ষ্য করে। এই ভাবে দেখা যায় গোবিন্দলালের মুখ রোহিণীর হৃদয়পটে দিনদিন গাঢ়তর বর্ণে অঙ্কিত হতে লাগল। ফলে রোহিণী সহসা গোবিন্দলালের প্রতি মনে মনে গোপনে প্রনয়াসক্ত হল। এই প্রনয়াসক্তই উপন্যাসের পরিণামের সুচনা। রোহিণী অতি বুদ্ধিমতী তাই তার মনের কথা অতি যত্নে গোপনে রাখল। কিন্তু আগুনের ন্যায় ইহা তার চিত্তকে দগ্ধ করতে লাগল। এতে রোহিণীর জীবনভার বহন করা দুঃসাধ্য হল। তখন রোহিণীর নিজেকে পৃথিবীর মধ্যে অসহ্য লাগল। রাত্রি দিন সে নিজের মৃত্যু কামনা করতে লাগল। রোহিণী তখন পৃথিবীর সুখ দুঃখ সম্পর্কে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পারে। রোহিণী গোবিন্দলালের প্রতি দূর্বলতা বশতঃ আসল উইল যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মন ছটফট করতে লাগল। কিন্তু তার উপযুক্ত উপায় খুঁজে পেল না। অনেক ভেবে চিন্তে এক উপায় বের করল যে উপায়ে আসল উইল চুরি করেছে সেই উপায়েই জাল উইল চুরি করে আসল উইল যথাস্থানে রেখে দেবে। জাল উইল চুরি করতে গিয়ে রোহিণী কৃষ্ণকান্তের কাছে ধরা পড়ে যায়। কৃষ্ণকান্ত রায় তাকে চুরির দায়ে বন্দী করে। এর পর রোহিণীকে এখানে আসার কারন জিজ্ঞাসা করে। রোহিণী সত্য কথা বললেও কৃষ্ণকান্ত রায় তা বিশ্বাস করে না। তাই দণ্ড স্বরূপ তাকে সে রাত্রে বন্দী করল।
গোবিন্দলাল তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসত, তাই তাকে সে আদর করে ভোমরা বা ভ্রমর বলে ডাকত। ভ্রমরও তার স্বামীকে খুব ভালোবাসত। তাই তাদের দাম্পত্য জীবন একপ্রকার সুখের ছিল। ভ্রমরের চাকরানী সম্প্রদায়েও বিশেষ আদর ছিল। তাই তারা তাকে মান্য করত। তার কারণ ভ্রমর একে ছেলে মানুষ তারপর ভ্রমর নিজে হাসিতে যত পটু, শাসনে তত পটু ছিলেন না। চাকরানীদের কাছেই ভ্রমর শুনতে পায় যে কর্তা মহাশয়ের শয়ন কক্ষে চুরি করতে এসে রোহিণী ধরা পড়ে কাছারির গারদে বন্দী আছে। তৎক্ষণাৎ ভ্রমর এই সংবাদ গোবিন্দলালকে জানায়। গোবিন্দলাল রোহিণীকে খুব বেশি বিশ্বাস করত তাই রোহিণীর চুরির খবর সে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। এমনকি ভ্রমরও রোহিণীকে নিরপরাধী বলে চিহ্নিত করল। আসলে ভ্রমর কোনকিছু নিজে মতামত দিত না, স্বামীর মতামতকেই সে নিজের মতামত হিসেবে গুরুত্ব দিত। রোহিণীকে গোবিন্দলালের বিশ্বাসের কারন হল রোহিণীর প্রতি সে মনে মনে কামজ মোহে অন্ধ ছিল। এই কামজ মোহেই তার জীবনের পরিণতি আস্তে আস্তে ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল। রোহিণী এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে গোবিন্দলালের মনে একটা শান্ত নীড় রচনা করতে থাকে। রোহিণীর প্রতি দূর্বলতা বশতঃই গোবিন্দলাল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য কৃষ্ণকান্তের কাছে ছুটে যায়।
গোবিন্দলাল সেখানে গিয়ে কৃষ্ণকান্তের কাছে সমস্ত ঘটনা জানতে চায়। গোবিন্দলালের কণ্ঠস্বর শুনে রোহিণী অবগুণ্ঠন ঈষৎ মুক্ত করে গোবিন্দলালের প্রতি ক্ষণিক কটাক্ষ করল। তখন গোবিন্দলাল তা দেখে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। গোবিন্দলাল রোহিণীর কটাক্ষের কারন খোঁজার চেষ্টা করল। শেষে গোবিন্দলাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে সেই কটাক্ষের অর্থ হল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আবেদন। গোবিন্দলাল মনে মনে রোহিণীর মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন। গোবিন্দলাল রোহিণীর সমস্ত বৃত্তান্ত জানার জন্য যখন পুনরাবৃত্তি করে তখন কৃষ্ণকান্ত মনে মনে গোবিন্দলালের আসল উদ্দেশ্য কিছু বুঝতে পেরেছিল। তাই সে মনে মনে বলে – “হয়েছে! ছেলেটা বুঝি মাগীর চাঁদপানা মুখখানা দেখে ভুলে গেল।”২৩ রোহিণীর সমস্ত কৃতকর্ম কৃষ্ণকান্ত গোবিন্দলালকে জানায়। কৃষ্ণকান্ত জানায় রোহিণী আসল উইল চুরি করতে এসে ধরা পড়ে গেলে তখন জাল উইল ছিঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু রোহিণী একথা স্বীকার করে না। গোবিন্দলাল তখন আসল খবর জানার জন্য রোহিণীকে বারবার জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু রোহিণী কোন কথা বলতে রাজী হয়নি। রোহিণীর প্রতি গোবিন্দলালের চিত্ত এতই আকৃষ্ট হয়েছিল যে মায়াবশতঃ সে রোহিণীকে এক ঘণ্টার জন্য জামিনে ছাড়িয়ে নিজ গৃহে নিয়ে যায়। এই ঘটনা দেখে কৃষ্ণকান্ত বাবুর পূর্বের অভিমত সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। তাই সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাড়ীতে রোহিণীকে দেখে ভ্রমর স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে রোহিণীর আগমনের কারন। ভ্রমরের এই জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারি যে রোহিণীকে বাড়ীতে দেখে ভ্রমরের মনে সন্দেহের ডানা বাঁধে। গোবিন্দলাল ভ্রমরকে তাই বলে যে তোমার যদি বিশ্বাস না হয় তবে তুমি আড়াল থেকে আমাদের কথা শুনে নিও। গোবিন্দলালের এই কথা শুনে ভ্রমর লজ্জায় সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ভ্রমরের এই সিন্ধান্তটাই সবচেয়ে ভুল হয়ে যায়। যা ভবিষ্যতে তার জীবনকে অশান্তির দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। সেই সুযোগে রোহিণী গোবিন্দলালের মনে জাল বিস্তার করতে থাকে। এতেই ঘনিয়ে আসে ভ্রমর ও গোবিন্দলালের দাম্পত্য জীবনে ঘন কুয়াশার আবির্ভাব। কিন্তু এই কালো ছায়ার কথা তারা দুজনেই কেউ আঁচ করতে পারেনি।
গোবিন্দলালের সাথে কথোপকথনে রোহিণী গোবিন্দলালের সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে সেই কাজে সে সাময়িক সফল হয়েছে। তার প্রমান পাই যখন গোবিন্দলাল রোহিণীকে বলতে পারে – “আমি অবিশ্বাসযোগ্য কথাতেও কখনও কখনও বিশ্বাস করি।”২৪ রোহিণী তখন মনে মনে বলে আমি তো মরতে বসেছি কিন্তু তোমায় একবার পরীক্ষা করে মরিব। গোবিন্দলাল রোহিণীকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে যে প্রাণপণে চেষ্টা করবে সেটা রোহিণীর বুঝতে বাকি থাকল না । সেই মুহূর্তেই রোহিণী বুঝতে পারল যে তার প্রতি গোবিন্দলালের ভিতরে ভিতরে একটা দূর্বলতার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিণীর কথাতেও গোবিন্দলাল বুঝতে পারে যে তার প্রতিও রোহিণী সমান ভাবে প্রনয়াসক্ত। গোবিন্দলাল তখন বুঝলেন - “যে মন্ত্রে ভ্রমর মুগ্ধ, এই ভুজঙ্গীও সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়াছে।”২৫ গোবিন্দলাল সমস্ত ঘটনা বুঝে অনুমান করে যে তাদের সংসারে ভবিষ্যতে অশান্তি হতে পারে। তাই তিনি রোহিণীকে দেশত্যাগ করে যেতে অনুমতি দেন। কারন যদি গোবিন্দলালের সঙ্গে রোহিণীর দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয় তবেই এই প্রণয়ের সম্মন্ধ ছিন্ন হতে পারে। তাই তো গোবিন্দলাল রোহিণীকে জানায় যে তার কলকাতায় থাকার সমস্ত ব্যবস্থা সে করে দেবে। এইরূপে কলঙ্ক বন্ধনে রোহিণীর প্রথম প্রণয় সম্ভাষণ হল।
রোহিণীর মুক্তির কথা বলতে এসে গোবিন্দলাল জ্যেষ্ঠ তাতের কাছে লজ্জায় বলতে পারল না। অবশেষে রোহিণী গোবিন্দলালের অনুগ্রহে কৃষ্ণকান্তের হাত থেকে মুক্তি পেল। গোবিন্দলাল রোহিণীর কলকাতায় যাওয়ার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করতে লাগল। হঠাৎ রোহিণী নিজের গ্রাম থেকে গোবিন্দলালকে ছেড়ে কলকাতায় যেতে রাজী হল না। এতেই যত সর্বনাশ হল গোবিন্দলালের দাম্পত্য জীবনে। গোবিন্দলালের প্রতি প্রণয়ে আবদ্ধ হয়ে রোহিণী লজ্জাহীন হয়ে পড়ে। তাই তো রোহিণী বলতে পারে- “আমি যাব না। কলিকাতায় যাব না। কলিকাতায় যাব না-কোথাও যাব না। যাই ত যমের বাড়ী যাব। আর কোথাও না।”২৬ এই সিন্ধান্তে রোহিণী স্থির থেকে দ্বার খুলে গোবিন্দলালের কাছে চলে গেল। গোবিন্দলালকেই সে জীবনের সুখ ও শান্তি হিসাবে মনে করতে লাগল। তাই তো গোবিন্দলালের কাছে রোহিণী কলকাতা যাওয়ার কথা অস্বীকার করে। গোবিন্দলাল তাকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করে, কিন্তু রোহিণী তাতে কোন কর্ণপাতই করে নি। আর এই জন্যই গবিন্দলালের চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ভ্রমর এসে গোবিন্দলালকে তার চিন্তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে গোবিন্দলাল জানায় যে এই মুহূর্তে সে একমাত্র রোহিণীর কথা চিন্তা করছে। গোবিন্দলালের এই কথা ভ্রমর কিছুতেই বিশ্বাস করে না। কারণ সে যুক্তি দেখায় যে, যাহাকে ভালোবাসে সে তাহাকে ভাবে। ভ্রমরের এই কথার সমর্থনে গোবিন্দলাল জানায় সে রোহিণীকে ভালোবাসে। গোবিন্দলালের এই কথাকে ভ্রমর রসিকতা বলে মনে করে তাই কোন গুরুত্ব দিতে চায় নি। ভ্রমর যদি এই সময় গোবিন্দলালের কথাটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবনের যে ঘন মেঘের আবির্ভাব হয়েছিল তাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা সম্ভব হত। ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনের পরিনাম এতটা দুর্বিসহ হয়ে উঠত না। গোবিন্দলাল সেই সময় ছলনা বশতঃ ভ্রমরকে কাতর কণ্ঠে জানায় “মিছে কথাই ভোমরা। আমি রোহিণীকে ভালবাসি না। রোহিণী আমায় ভালবাসে।”২৭ স্বামীর মুখ থেকে এই কথা শুনে ভ্রমর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে। তাই ভ্রমর রোহিণীর প্রতি বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা বলে তার অমঙ্গল কামনা করে। এমনকি ভ্রমর দাসী পাঠিয়ে তাকে বারুণী পুকুরে ডুবে মরার পরামর্শ দেয়। ভ্রমরের এই প্রস্তাবে রোহিণী রাজী হয়েছিল। এই ঘটনা জেনে গোবিন্দলাল ভ্রমরের প্রতি রেগে গর্জে উঠে। ভ্রমর তখন গোবিন্দলালকে বলে –“ভাবিও না। সে মরিবে না। যে তোমায় দেখিয়া মজিয়াছে- সে কি মরিতে পারে?”২৮
প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে গোবিন্দলাল অভ্যাসবশতঃ দিনের শেষে বারুণী তীরবর্তী পুস্পদ্যানে গিয়ে বিচরণ করতে লাগল। তিনি সমস্ত ফুলের গাছের সুগন্ধে আমোদিত হয়ে গেলেন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করলেন যে রোহিণী বারুণীতে জল নিতে আসছে। অনেকক্ষণ পর তিনি আবার লক্ষ্য করে দেখলেন যে ঘাটে কোন মানুষ নেই কেবল একটি কলসি জলে ভাসছে। তখন গোবিন্দলাল ঘাটে গিয়ে দেখলেন যে রোহিণী জলে ডুবে আছে। গোবিন্দলাল তখন জলে নেমে রোহিণীকে উদ্ধার করলেন। গোবিন্দলাল তাকে উদ্যানগৃহে নিয়ে গিয়ে সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তুললেন। রোহিণীকে ঔষধ দিলে তার শরীরে বল সঞ্চার হয়। রোহিণী অচৈতন্যবশতঃ গোবিন্দলালের প্রতি অনুরাগ করে তাকে উদ্ধার করে বাঁচানোর জন্য। রোহিণী অত্যন্ত বিদ্রুপাত্মক ভাবে জানায় তার কি মরারও অধিকার নেই। গোবিন্দলালকে রোহিণী জানায় সে যন্ত্রণার জন্য মরতে চায়। তার যন্ত্রণার কারণ গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করলে রোহিণী জানায়- “রাত্রিদিন দারুণ তৃষা,হৃদয় পুড়িতেছে-সম্মুখেই শীতল জল,কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না। আশাও নাই।”২৯ গোবিন্দলালের বাড়ী ফিরতে অনেক রাত্রি হয়ে গেলে ভ্রমর এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। এতেই বোঝা যায় যে ভ্রমর কিন্তু গোবিন্দলালকে সন্দেহ করে। সেদিন গোবিন্দলালকে দেখে সে কাতর হয়ে পড়ে। তাই ভ্রমর স্বামীর কাছে গভীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ভ্রমরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পরে বলবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়। কারণ হিসাবে জানায় যে ভ্রমর এখন বালিকা তাই দুই বৎসর পরে তাকে জানাবে। ভ্রমরের মন কিন্তু শান্ত হতে পারল না, দোলাচল বৃত্তিতে ভরে উঠল। সে তার ভবিষ্যতে অশনি সংকেত অনুমান করে কাঁদতে লাগল। তার বুকের ভিতর হতে অশনি সংকেত কিছুতেই নামল না।
গোবিন্দলাল বিষয় সম্পত্তির কাজে মহালে চলে গেলেন। তার যাবার কারণ হল রোহিণীকে মন থেকে মুছে ফেলা। কারণ তখন সে রোহিণীর কামজ মোহে আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই সে ভেবেছিল যে রোহিণীর থেকে দূরে চলে গেলেই তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে। যা তার জীবনের পক্ষে মঙ্গলদায়ক। ভ্রমর তার সাথে যেতে চাইলে সে তাকে নিয়ে যেতে চায়নি। একাকী ভ্রমর কোন কাজে মন দিতে পারল না। স্বামী বিনা ভ্রমর এমন দুঃখ পেল যে সে আহার, নিদ্রা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু ত্যাগ করল। দিনে দিনে ভ্রমর অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও কোন ঔষধ সে খেল না। ক্ষীরোদ চাকরানী তখন তাকে বলল তুমি যার জন্য এমন কিছু করছ সে চোখ বুজে রোহিণীকে ধ্যান করছে। এই কথা শুনে ভ্রমর রেগে যায় এবং ক্ষীরোদকে চড় মারে। ভ্রমর একবার মনে মনে ভাবে যে – “তুমি কি সেদিন এই কথা আমার কাছে গোপন করিয়াছিলে।”৩০ স্বামীর প্রতি ভ্রমরের যদিও কোনও অবিশ্বাস ছিল না। ভ্রমর মনে মনে ভাবে যে তার স্বামী যদি কোনদিন অবিশ্বাসী হয় তবে সেদিন সে জীবন ত্যাগ করবে। তারপর দেখা যায় পাড়ার সকলের মুখেই শোনা যায় গোবিন্দলাল ও রোহিণীর মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের কথা। এছাড়া সুরধুনীর কাছে ভ্রমর জানতে পারে যে গোবিন্দলাল সাত হাজার টাকার গহনা দিয়েছে। এরপর পাড়ার প্রায় সকলেই এসে বিরহকাতরা বালিকা ভ্রমরকে জানায় যে - তোমার স্বামী রোহিণীর প্রণয়াসক্ত। নানালোকের মুখে একই খবর শুনে ভ্রমর আর সহ্য করতে পারে না। তখন সে স্থির করে যে সে আত্মহত্যা করে প্রান বিসর্জন দিবে।
ভ্রমর ও রোহিণীর মনের জ্বালা এক হল। কথা যখন রটিল তখন রোহিণীও শুনিল যে গোবিন্দলাল তার গোলাম এবং সে তাকে সাত হাজার টাকার অলংকার দিয়েছে। এইসব কথা শুনে রোহিণী স্থির করে ভ্রমরই এইসব কথা রটনা করেছে। ভ্রমরকে সন্দেহ করে ভ্রমরের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠে রোহিণী। রোহিণী তখন একটি বেনারসী শাড়ি ও কিছু গয়না প্রতিবেশির কাছে নিয়ে ভ্রমরের কাছে গেল। রোহিণী এইসব দেখে জানায় যে গোবিন্দলাল তাকে এগুলি কিনে দিয়েছে। ভ্রমর তখন এইসব দেখে বিষের জ্বালায় জ্বলে উঠে। এইখানেই তাদের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে ব্যবধানের পরিধি বাড়তে থাকে। রোহিণী ভ্রমরকে একথাও জানায় যে গোবিন্দলাল তাকে তিন হাজার টাকা ও একটি শাড়ি দিয়েছে তখন ভ্রমরের মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না, সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে। এইসব দেখেই ভ্রমরের স্বামীর প্রতি কোন বিশ্বাস আর থাকে না। ভ্রমর তখন লাথি মেরে অলংকারগুলি ছড়িয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে কার্য সিদ্ধ করে রোহিণী সেখান থেকে প্রস্থান করে। এই ঘটনার পরেই ভ্রমর ও গোবিন্দলালের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনের সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে আরম্ভ করে। কারণ ভ্রমর পূর্বের মতো স্বামীর উপর আর বিশ্বাস রাখতে পারে না। ভ্রমর অবিশ্বাস বশতঃই সেই দিন রাত্রে স্বামীকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে চিঠি লিখতে বসল। ভ্রমর যে তার স্বামীকে আর বিশ্বাস করতে পারে না তার প্রমান পাই তার চিঠিতে সে স্বামীকে জানায় - “এখন তোমার উপর আমার ভক্তি নাই,বিশ্বাসও নাই। তোমার দর্শনে আমার আর সুখ নাই। তুমি যখন বাড়ী আসিবে,আমাকে অনুগ্রহ করিয়া খবর লিখিও - আমি কাঁদিয়া কাটিয়া যেমন করিয়া পারি, পিত্রালয়ে যাইব।”৩১ গোবিন্দলাল এই পত্র পেয়ে মাথায় বজ্রাঘাত সম অনুভব করলেন। ভ্রমর যে এই চিঠি তাকে লিখতে পারে প্রথমে তা তিনি বিশ্বাস করতেই পারছিল না। কিন্তু পরক্ষণেই ব্রহ্মানন্দের একখানি পত্র গোবিন্দলাল পেল। সেই পত্র পাঠ করে জানতে পারল যে গোবিন্দলাল ও রোহিণীর নিয়ে যে অবৈধ সম্পর্কের কথা প্রচার হয়েছে তা ভ্রমরের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। এইসব কথা শুনে গোবিন্দলাল কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে হঠাৎ বাড়ীতে চলে এলেন।
ভ্রমর গোবিন্দলালকে বিদেশে যেতে দিতেই তাদের মধ্যে একটা অবিশ্বাস ও মনোমালিন্য তৈরি হয়। যদি তারা একসঙ্গে থাকত তাহলে হয়তো এতটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হত না। ভ্রমরের ও গোবিন্দলালের এতটা ভ্রম ঘটত না। এই ভ্রমের ফলেই তাদের দাম্পত্য জীবনে সর্বনাশের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। গোবিন্দলালের বাড়ী আসার খবর পেয়েই বিরহিণী ভ্রমর তাকে না জনিয়েই কৌশলে বাপের বাড়ী চলে যায়। গোবিন্দলাল বাড়ী এসে ভ্রমরকে দেখতে না পেয়ে শুনলেন যে আজই ভ্রমর পিত্রালয়ে যাত্রা করেছে। এই খবর পেয়ে গোবিন্দলাল মনে মনে খুব আঘাত পেলেন ও অভিমানে ফেটে পড়লেন। তখন সে মনে মনে ভাবলেন - “এত অবিশ্বাস! না বুঝিয়া,না জিজ্ঞাসা করিয়া আমাকে ত্যাগ করিয়া গেল! আমি আর সে ভ্রমরের মুখ দেখিব না। যাহার ভ্রমর নাই, সে কি প্রাণধারণ করিতে পারে না?”৩২ ভ্রমরের প্রতি একটা বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল গোবিন্দলালের। এই ঘটনার পর সেই সব কিছু মন থেকে মুছে গেল। তাইতো অভিমানবশতঃ সে মাতাকে, ভ্রমরকে আনিতে নিষেধ করলেন। এখানেই দেখা যায় ভ্রমর ও গোবিন্দলাল দুজনের মধ্যে তাদের ভুল বোঝাবুঝিতে দাম্পত্য জীবনের ছেদ ঘটে। এই ছেদের জন্যই তাদের দাম্পত্য জীবনের স্থায়ী সর্বনাশ ঘটে। এই সময়টাকে আমরা তাদের দাম্পত্য কলহের টারনিং পয়েন্ট বলতে পারি। এই পরিস্থিতি যদি না ঘটত তাহলে হয়তো তাদের দাম্পত্য জীবন এতটা অসুখী হয়ে উঠত না। গোবিন্দলাল তার প্রিয়তমা স্ত্রী ভ্রমরের সঙ্গে কলহ মনে করে দুঃখে বেদনায় কেঁদে ফেলল। কিন্তু পরক্ষণেই ভ্রমরের প্রতি তার রাগ হল। ভ্রমরকে ভুলবার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও গোবিন্দলাল কিছুতেই তাকে ভুলতে পারলেন না। তখন দুর্বুদ্ধি বশতঃ গোবিন্দলাল মনে করলেন যে ভ্রমরকে ভুলবার একমাত্র উপায় রোহিণীর চিন্তা। গোবিন্দলাল সত্যই রোহিণীর চিন্তা করতে লাগলেন। এতেই গোবিন্দলালের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনল। তিনি আপন ইচ্ছায় আপনি অনিষ্ট সাধনে প্রবৃত্ত হলেন।
ভ্রমরের অনুপস্থিতিতে, রোহিণীর সাথে গোবিন্দলালের মেলামেশা অনেক বেড়ে গেল। রোহিণীকে বাগানের বৈঠকখানায় পর্যন্ত গোবিন্দলাল নিয়ে গেল। তাদের অনেক মেলামেশাতে রোহিণী মনে মনে অনুমান করল যে গোবিন্দলাল তার রূপে মুগ্ধ এবং তার দ্বারা আকৃষ্ট। এইভাবে গোবিন্দলালের অধঃপতন খুব দ্রুত হতে লাগল। তার এইসব খবর কৃষ্ণকান্তের কানে গেল এবং তিনি শুনে দুঃখিত হলেন। কৃষ্ণকান্ত গোবিন্দলালের প্রতি ক্ষোভে তার নাম বাদ দিয়ে ভ্রমরের নামে নতুন উইল তৈরি করল। কৃষ্ণকান্তের এরপর মৃত্যু হইল। মৃত্যুতে ভ্রমর বাপের বাড়ী থেকে এলেও গোবিন্দলালের সঙ্গে তেমন কিছু কথা হল না। ভ্রমরের নামে অর্ধেক সম্পত্তি হয়ে যাওয়াতে গোবিন্দলালের খুব রাগ হল এবং এতেও তাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা দুরত্ব তৈরি করল। যদিও ভ্রমর এই সম্পত্তি তাকে লিখে দিতে চাইলেও গোবিন্দলাল তা নিতে অস্বীকার করে। ভ্রমর গোবিন্দলালের কাছে তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলেও গোবিন্দলাল তাকে ক্ষমা করতে পারে নি। এর দ্বারাই তাদের দাম্পত্য কলহ ক্রমশ বেড়ে যায়। গোবিন্দলাল মনে মনে ভাবতে থাকে - “এ কালো! রোহিণী কত সুন্দর! এর গুণ আছে, তার রূপ আছে। এতকাল গুণের সেবা করিয়াছি, এখন কিছুদিন রূপের সেবা করিব।– আমার এ অসার, এ আশাশূন্য,প্রয়োজনশূন্য জীবন ইচ্ছামত কাটাইব। মাটির ভাণ্ড যেদিন ইচ্ছা সেইদিন ভাঙিয়া ফেলিব।”৩৩ ভ্রমর তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও সে দৃঢ়কণ্ঠে ভ্রমরকে জানায় যে তাকে সে পরিত্যাগ করবে। এতেই বোঝা যায় যে ভ্রমরের প্রতি কোন ভালোবাসায় আকৃষ্ট করতে পারেনি গোবিন্দলালকে। ভ্রমরের প্রতি বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট না হয়ে তাই গোবিন্দলাল তাকে পরিত্যাগ করে যেতে পারে। গোবিন্দলাল তার মাকে কাশী পৌঁছে দিতে গিয়া নিজেও নিরুদ্দেশ হয়। অনেকদিন পর্যন্ত গোবিন্দলালের কোন সংবাদ পাওয়া যায় না।
প্রথম খণ্ডকে যদি নাটকীয় পরিভাষায় ক্রিয়ার ঊর্ধ্বগমন বলা যায় তাহলে দ্বিতীয় খণ্ডকে ক্রিয়ার অবরোহণ পর্ব নামে অভিহিত করা যেতে পারে। গোবিন্দলালের গৃহত্যাগ উভয় পর্যায়ের মাঝে শীর্ষবিন্দু হিসেবে অবস্থান করেছে। অনেকদিন পর কাশী থেকে গোবিন্দলালের পৌঁছানোর খবর এলো। কিন্তু ভ্রমর ও গোবিন্দলালের মধ্যে কোন পত্র বিনিময় হল না। গোবিন্দলালের গৃহের আমলাদের সাথে তার যোগাযোগ ঠিকই ছিল। তাই তার খবর আমলারা সবই পেত। কিছুদিন পর নাটকীয় ভাবে রোহিণী পীড়া থেকে আরোগ্যলাভের পর তারকেশ্বর যাওয়ার নাম করে অন্তর্ধান করলেন। ছয়মাস কেটে গেলেও ভ্রমর গোবিন্দলালের কোন খবর পেল না। এদিকে রোহিণীও নিরুদ্দেশ হয়ে বাড়ীতে আর ফিরল না। রোহিণীর অন্তর্ধানে ভ্রমরের সন্দেহ হল। সে বুঝতে পারল যে রোহিণী গোবিন্দলালের কাছে চলে গেছে। এই কথা মনে করে ভ্রমর প্রবল উৎকণ্ঠিত হয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ মন নিয়ে পিত্রালয়ে চলে গেল। কিন্তু পিত্রালয়েও ভ্রমর স্থির হয়ে থাকতে পারল না তাই সে আবার চলে এলো। ভ্রমর এরপর শাশুড়িকে পত্র লিখে জানতে পারল যে তিনিও ছেলের খবর জানেন না। গোবিন্দলালের চিন্তায় একবছর পর ভ্রমর অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থ ভ্রমরকে তার বাবা দেখতে এলেন। বাবা এসে তাকে রাজগ্রামে নিয়ে যেতে চাইলেন। ভ্রমরের বাবা বাড়ীর দেওয়ানের কাছে গোবিন্দলালের খবর জানতে চাইলে সে জানায় যে গোবিন্দলাল এখন অজ্ঞাতবাসে আছেন। গোবিন্দলালের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে মাধবীনাথ বাবু হরিদ্রা গ্রামের পোস্টঅফিসে উপস্থিত হলেন। মাধবীনাথ বাবু পোস্টমাস্টারকে কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে জানতে পারে যে ব্রহ্মানন্দের নামে মাঝে মাঝে চিঠি আসে। মাধবীনাথ এরপর হুমকি দিয়ে পোস্টমাস্টারের কাছ থেকে সব খবর নিয়ে নেয়। পোস্টমাস্টার ভীত হয়ে সমস্ত গোপন খবর মাধবীনাথকে জানিয়ে দেয়। মাধবীনাথ জানতে পারেন যে প্রসাদপুর থেকে প্রতি মাসে ব্রহ্মানন্দের নামে রেজেস্ট্রি চিঠি আসে। প্রসাদপুর হল যশোর জেলায়। মাধবীনাথ এর পর পুলিসের ভয় দেখিয়ে ব্রহ্মানন্দের কাছে রোহিণী ও গোবিন্দলালের ঠিকানা পায়। ভ্রমর খুব অসুস্থ থাকায় চিকিৎসা চলতে থাকে। মাধবীনাথ ভ্রমরকে নিয়ে রাজগ্রামে ফিরে এলেন। ভ্রমরের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে মাধবীনাথ কলকাতায় গেলেন।
সূর্যমুখীর পিতা মাধবীনাথ তাঁর আত্মীয় নিশাকর দাশকে নিয়ে প্রসাদপুর অভিমুখে যাত্রা করলেন। নিশাকরকে জানালেন তিনি নীলকুঠী কেনার জন্য সেখানে যাচ্ছেন। প্রসাদপুরের পাশেই চিত্রা নদীর এক নির্জন স্থানে একটি নীলকুঠী ছিল। বর্তমানে সেই নীলকুঠির প্রাসাদটি গোবিন্দলাল কিনে নিয়ে রোহিণীকে নিয়ে বিলাসিতা ভাবে জীবন যাপন করছিলেন। এই প্রাসাদে নিয়মিত গানবাজনা চলত বলে গোপন সুত্রে খবর পায় মাধবীনাথ। একদিন গানবাজনা চলতে চলতে হঠাৎ প্রাসাদের মধ্যে নিশাকর প্রবেশ করলে তাদের গানবাজনা অর্ধপথে থেমে যায়। গোবিন্দলাল ও রোহিণী প্রসাদপুরের নীলকুঠির দোতলায় বাস করত। গোবিন্দলাল সচরাচর কোন ব্যাক্তির সাথে দেখা করত না। তেমন যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ হত তবে একতলায় এসে দেখা করত। নিশাকর গোবিন্দলালের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গমন করলে গোবিন্দলালের দুই ভৃত্য সোনা ও রুপার সঙ্গে দেখা হল। নিশাকরকে উভয়েই জানায় যে তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাতের কোন অনুমতি নেই। নিশাকর রূপোকে এক টাকা ঘুষ দিলে রূপো টাকাটা নিয়ে গোবিন্দলালকে আগন্তুকের খবর দিতে গেল। সেই সময় নিশাকর বাগানে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ দোতালায় রোহিণীকে দেখতে পেল। রোহিণীও নিশাকরকে লক্ষ্য করছিল। নিশাকরের রূপে মুগ্ধ হয়ে রোহিণী তার প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে রোহিণীর সঙ্গে নিশাকরের দৃষ্টি বিনিময় কিছু অর্থদ্যোতক হয়। এদিকে রূপো গোবিন্দলালকে আগন্তুকের কথা জানালে সে সাক্ষাতের অক্ষমতা প্রকাশ করে। নিশাকর রুপোর আসতে দেরি দেখে সটান দোতলায় বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে। ঘরে গিয়ে নিশাকর একসঙ্গে গোবিন্দলাল, রোহিণী ও গায়ক গায়িকাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন। নিশাকরকে দেখে গোবিন্দলাল অত্যন্ত রুষ্ট হলেন। কিন্তু তবুও তা প্রকাশ না করেই ভদ্রতার সহিত নিশাকরের আগমনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নিশাকর তখন কৌশলে জানায় যে ভ্রমরের বিষয় সম্পত্তি বিলি হবে শুনে সে হরিদ্রাগ্রামে গিয়েছিল। গিয়ে সে জানতে পারে যে ভ্রমর ঘোষণা করেছে যে গোবিন্দলালের অনুমতি পেলে তবেই সে বিষয় সম্পত্তি বিলি করতে শুরু করবে। এই জন্যই নিশাকর তার কাছে এই অভিমত জানার জন্যই এসেছে। প্রায় দুই বছর পর ভ্রমরের কথা শুনে গোবিন্দলাল অন্যমনস্ক হল। নিশাকর অনুমতি পত্র হিসাবে একটি চিঠি লিখে দিতে বলল। নিশাকরের কথায় গোবিন্দলাল রাজী হল না। ফলে নিশাকর হতাশ হয়েই চলে গেলেন। অন্যমনস্কতা দুর করার জন্য গোবিন্দলাল তার ওস্তাদকে গান গাইতে বলে নিজে তবলা বাজাতে শুরু করল । কিন্তু মানসিক দুশ্চিন্তার জন্য গানের তাল বারবার কেটে যেতে লাগল । গোবিন্দলাল এরপর তবলা ছেড়ে সেতার বাজাতে গিয়েও ব্যর্থ হল । তাই সে নোবেল পড়ার জন্য চেষ্টা করেও পুনরায় ব্যর্থ হল । সব কিছুতেই ব্যর্থ হওয়ার কারণ হল ভ্রমরের নাম শুনে তিনি মনে মনে খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল । ফলে তিনি কোন কিছুতেই মনসংযোগ করতে পারছিল না । তাই বিরক্ত হয়ে গোবিন্দলাল বিশ্রামের জন্য শয়নগৃহে গেল । শয়নগৃহে গিয়ে তিনি সোনাকে জানায় সে এখন ঘুমোবে, তাই তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে । এরপর দ্বার বন্ধ করে তিনি গভীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। গোবিন্দলালের এই কান্নার কারণ আমরা ঠিক বুঝতে পারি না। ভ্রমরের জন্য এই কান্না নাকি তার নিজের দুরবস্থার জন্যই তিনি আকুল হয়ে কেঁদেছেন। তাই এই কান্নার কারণ আমাদের কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়।
গোবিন্দলালের সঙ্গে যখন নিশাকর কথা বলতে আসে ঠিক তখনি রোহিণী পাশের ঘরে গিয়েছিল। সেখান থেকে সে নিশাকরকে লক্ষ্য করছিল। নিশাকরও তা দেখতে পেয়েছিল। নিশাকর একবার দেখেই রোহিণীর মন আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। তাই সে গোবিন্দলালকে ভুলে নিশাকরকে কাছে পেতে চাইছিল। নিশাকরকে এখান থেকে চলে যেতে দেখে রোহিণী রূপোকে পাঁচ টাকা বখশিশ দিয়ে জানায় যে, সে ঐ বাবুটিকে বাগানের মধ্যে অপেক্ষা করতে বলে। একটু একাকী হলেই সে তার সাথে দেখা করবে। নিশাকর নানা কলা কৌশলে একতলায় অপেক্ষা করছিল। রূপো গিয়ে তাকে রোহিণীর কথা বললে এবং একান্তে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে বসালো। নিশাকর তখন এখানে এমন ভাবে অপেক্ষা করতে রাজী হল না। কারণ যে কোন সময় এখানে বাবু এসে যেতে পারে। তাই সে নির্জন জায়গায় যেতে চায়। নিশাকর রূপোকে জানিয়ে দেয় রাত্রে রোহিণী কুঠির নিকটে নদীর বাঁধা ঘাটে এসে তার সঙ্গে যেন দেখা করে আসে। সে ঐ নদীর বাঁধা ঘাটেই রোহিণীর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে। এই কথা শুনে রূপো গিয়ে তৎক্ষণাৎ রোহিণীকে জানালে, রোহিণী প্রথমে সামান্য ইতস্ততঃ বোধ করতে লাগল। অবশেষে নিশাকরের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। রূপো চলে যাবার পর নিশাকর চালাকি করে সোনার সঙ্গে দেখা করে একটি ষড়যন্ত্র করে নেয় যাতে রোহিণী ও গোবিন্দলালের সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। গোবিন্দলাল কার্যসিদ্ধির জন্য সোনাকেও টাকা ঘুষ দেয়। সোনাকে স্থান,কাল, পাত্র সবকিছুই গোবিন্দলাল সোনাকে অগ্রিম জানিয়ে দেয়। গোবিন্দলালকে যেন এই সব তথ্য সব জানিয়ে দেওয়া হয় এই মর্মে তার সাথে নিশাকরের চুক্তি হল। নিশাকরের এই চুক্তিতে সোনা তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেল। কারণ প্রথমত গোবিন্দলাল এই কাজের জন্য তাকে কিছু টাকা ঘুষ দিয়েছিল, দ্বিতীয়ত সেই সময় সোনার সাথে রোহিণীর মনোমালিন্য চলছিল।
নিশাকর রোহিণীর এই সর্বনাশ করতে বাধ্য হল তার দুটি কারণ হল - প্রিয় বন্ধুর কন্যার উপকার ও পাপীর পাপের দণ্ডদান। এমন সময় পূর্ব পরিকল্পনা মতো নিশাকরের নিকট রোহিণী এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু রোহিণীর আসতে একটু দেরি হয়ে যায়। রোহিণী এসে নিশাকরকে জানায় যে, গোবিন্দলালকে ভুলতে না পেরে সে এদেশে তার সাথে এসেছে এবং তাকে ভুলতে না পেরে সে এখানে এইসময় এসেছে। রোহিণীর এই কথা শুনে আমরা বুঝতে পারি নিশাকরের প্রতি রোহিণী ভালোবাসায় আকৃষ্ট হয়ে যায় । নিশাকরের জন্য সে যে প্রান বিসর্জন দিতে পারে তাও সে জানাতে ভোলেনি। ঠিক সেই সময় ওই স্থানে গোবিন্দলাল এসে রোহিণীর সবকথা আড়াল থেকে শুনতে লাগল। এই কথা শুনেই গোবিন্দলাল সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে পিছনদিক থেকে রোহিণীর গলা টিপে ধরল। রোহিণী অনুমান করতে পারল তার যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়ে গেছে। রোহিণী গোবিন্দলালের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য নিশাকরের সাহায্য নিতে গিয়ে দেখল নিশাকর সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। রোহিণী তাই নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়। গোবিন্দলাল তখন রেগে গিয়ে রোহিণীকে ধরে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় । রোহিণীকে নিয়ে গিয়ে ক্ষুব্ধ কম্পিত স্বরে গোবিন্দলাল বলে যে - তার জন্য সে ঐশ্বর্য, সম্পদ, চরিত্র, এমনকি তার প্রানের চেয়ে প্রিয় পত্নী ভ্রমরকে সে ত্যাগ করে চলে এসেছে। কিন্তু তার মর্যাদা রোহিণী আজ আর রাখেনি। রোহিণী গোবিন্দলালের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এই কথা ভেবেই গোবিন্দলালের মাথা গরম হয়ে যায়। তাই সে রোহিণীকে সজোরে পদাঘাত করে। এই পদাঘাত সহ্য করে রোহিণী কাঁদতে থাকে। তখন গোবিন্দলাল রোহিণীকে জিজ্ঞাসা করে যে তার মরবার সাহস আছে কি না? উত্তরে সঙ্গে সঙ্গে রোহিণী জানায় তার মরবার সাহস আছে। রোহিণীর মুখে এই কথা শুনে গোবিন্দলাল সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল বার করল। গোবিন্দলাল যে তাকে হত্যা করতে পারে তা রোহিণী কখনই ভাবতে পারে না। কিন্তু পরে রোহিণী যখন জানতে পারে যে গোবিন্দলাল তাকে হত্যা করতে ইচ্ছুক। তখন রোহিণী গোবিন্দলালের কাছে প্রানভিক্ষা আবেদন করে। গোবিন্দলাল রোহিণীর কার্যকলাপে এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল যে তার আবেদনে কোন কর্ণপাতই করল না। তাই গোবিন্দলাল তৎক্ষণাৎ পিস্তল নিক্ষেপ করে সঙ্গে সঙ্গে রোহিণীকে হত্যা করল। গুলির শব্দ শুনে তার ভৃত্যেরা সব ছুটে এসে দেখল যে রোহিণী মৃত অবস্থায় পড়ে আছে এবং গোবিন্দলাল পলাতক। পরদিন থানা থেকে দারোগা মৃত্যুর তদন্ত করতে এসে মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। হত্যাকারীকে অনেক অনুসন্ধান করেও তারা কোথাও খুঁজে পেল না। প্রসাদপুরে গোবিন্দলালের আসল পরিচয় কেউ জানত না তাই তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে গেল। থানা থেকে তাই তাকে ফেরার বলে ঘোষণা করা হল।
অন্য দিকে দেখা যায় রোগগ্রস্ত হয়েও ভ্রমরের কিন্তু মৃত্যু হয় নি। হরিদ্রা গ্রামে পুলিশ এসে গোবিন্দলালের খোঁজ করে তাকে পাওয়া যায় নি। স্বামীর বিপদের কথা শুনে ভ্রমর তার মঙ্গল কামনা করল। ভ্রমর চাইল গোবিন্দলাল এই সময় হরিদ্রা গ্রামে না এসে কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিক। স্বামীর কথা ভেবেই ভ্রমর বাপের বাড়ী থেকে হরিদ্রা গ্রামে গেল। নানারকম চিন্তায় দিন দিন ভ্রমরের শরীর ক্রমশ ভেঙ্গে যেতে লাগল। মৃত্যুর ঘটনার পঞ্চম বৎসরে ভ্রমরের কাছে খবর এল গোবিন্দলাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তাই তাকে বিচারের জন্য যশোরে নিয়ে আসা হয়েছে। গোবিন্দলাল তার দেওয়ানকে চিঠি লিখে আবেদন জানায় তাকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। দেওয়ানের কাছে ভ্রমর এই কথা শুনে তার পিতাকে হরিদ্রা গ্রামে আসার জন্য অনুরোধ জানায়। স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার টানে ভ্রমর পিতার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য পাঠায়। কন্যার আবেদনে সাড়া দিয়ে মাধবীনাথ যশোরে গিয়ে সাজানো সাক্ষীদের সাথে গোপনে দেখা করেন। সাক্ষীদেরকে টাকার লোভ দেখিয়ে মিথ্যা কথা বলতে রাজী করানো হয়। প্রথমে এই কাজে রাজী হয়ে সাক্ষীরা ভয় পেতে শুরু করলে মাধবীনাথ তাদের অভয়দান করলেন। ফলে প্রমানের অভাবে জজসাহেব গোবিন্দলালকে বেকসুর খালাস করে দেয়। কিন্তু গোবিন্দলাল খালাস হয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মাধবীনাথ অনেক অনুসন্ধান করে ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে বাড়ী ফিরলেন। পিতার কাছে গোবিন্দলালের নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে ভ্রমর কাঁদতে লাগল। গোবিন্দলাল প্রসাদপুরে তার নিজ সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় চলে গেল। গোবিন্দলালের যখন অর্থ সংকট দেখা দিল তখন ভ্রমরের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে একখানি চিঠি পাঠালো। ভ্রমর কিন্তু কোন অর্থ সাহায্য না করে অপর একটি চিঠি লিখে তা জানিয়ে দিল। চিঠিতে ভ্রমর জানায় যে গোবিন্দলাল যেন নিজে ফিরে এসে তার নিজ সম্পত্তির ভার গ্রহণ করে। গোবিন্দলালের আসার আগেই সে যে পিত্রালয়ে চলে যাবে একথা জানাতেও সে ভোলে নি। গোবিন্দলাল পত্র পেয়ে দুঃখিত হয়ে জানায় যে সে কলকাতায় থাকবে, তাই তাকে সেখানে যেন মাসে মাসে কিছু অর্থ সাহায্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অসুস্থ শরীর থাকা সত্ত্বেও ভ্রমরের জেদ কিন্তু ষোলোআনায় বজায় ছিল। ভ্রমরের যেমন জেদ ছিল ঠিক তেমনি আমরা গোবিন্দলালের জেদও দেখতে পাই। এই জন্যই তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যবধান বাড়তে থাকে। উভয়ের মধ্যে যদি কেউ একটু সংযত হতে পারত তাহলে হয়ত তাদের সম্পর্কের এতটা অবনতি ঘটত না।
এরপর ভ্রমরের পীড়া খুব জটিল আকার ধারন করল। সকলেই বুঝতে পারল যে তার মৃত্যু আসন্ন। বিরহিণী ভ্রমর জেদের বসে শেষ পর্যন্ত ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল। বড়বোন যামিনীর কাছে ভ্রমর অন্তিম কামনার কথা জানালো ফাল্গুনের পূর্ণিমাতে যেন তার মৃত্যু হয়। ওই নির্ধারিত দিনে রাত্রিবেলায় সকলকে সরিয়ে দিয়ে ভ্রমর শুধু যামিনীর সাথেই কথা বলতে চাইল। ভ্রমর প্রকৃতির নানা রকম সৌন্দর্যের কথা যামিনীর কাছে জানতে চাইল। যামিনীকে সে তার বিছানাতে ফুল ছড়িয়ে দিতে বলল। ভ্রমরের শেষ ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর আগে গোবিন্দলালের সঙ্গে শেষবারের জন্য সাক্ষাৎ। ভ্রমর তার মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে স্বামীর জন্য মর্মাহত হয়ে পড়ে। যামিনী তখন ভ্রমরকে জানায় তার যদি ইচ্ছা থাকে তবে সে তার স্বামীর সাথে তার সাক্ষাৎ করে দেবে। ভ্রমরের গভীর পীড়ার খবর এর আগে গোবিন্দলালকে দেওয়া হয়নি। অন্য কোন সুত্র ধরে গোবিন্দলাল জানতে পারে ভ্রমর অসুস্থ। তাই সে স্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য হরিদ্রা গ্রামে চলে আসে। কিন্তু গোবিন্দলাল লজ্জায় ভ্রমরের কাছে যেতে পারে নি। যামিনীর কাছে গোবিন্দলালের কথা শুনে ভ্রমর তার স্বামীর সাথে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে যায়। তাই গোবিন্দলাল নীরবেই ভ্রমরের কাছে যায়। স্বামীকে দেখে ভ্রমর কাঁদতে কাঁদতে প্রনাম করে তার কাছে ভিক্ষা মার্জনা করে। গোবিন্দলাল ও ভ্রমরের এই সাক্ষাতেই তাদের নিঃস্ব জীবনকে আবার যেন নবরূপে সঞ্চিত করল। গোবিন্দলাল কোন কথাই বলতে পারল না। উভয়েই পরস্পরের হাত ধরে রইল। অবশেষে ভ্রমর শান্তিতে মৃত্যুবরণ করল।
ভ্রমরের শেষ কৃত্য সম্পন্ন হল। প্রবল মর্ম পীড়ায় গোবিন্দলাল আত্মদহনে দগ্ধ হতে লাগল। সে কারো সাথে কথা না বলে একাকী থাকতে লাগল। গোবিন্দলাল তার জীবনে দুটি রমণীকে ভালবেসেছিল। ভ্রমরের গুন অবহেলা করে রোহিণীর রুপ ও যৌবনের প্রতি সে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু রোহিণী তাকে চিরশান্তি দিতে অক্ষম হয়। রোহিণী কখনই ভ্রমরের মতো আন্তরিক ভাবে গোবিন্দলালকে ভালবাসতে পারেনি। একথা গোবিন্দলাল বুঝতে পেরে রোহিণীকে হত্যা করেছে। রোহিণীর মৃত্যুর পর গোবিন্দলাল যদি ক্ষমা প্রার্থী হয়ে ভ্রমরের কাছে এসে তার দোষ স্বীকার করে নিত তাহলে হয়ত তাদের সম্পর্ক পুনরায় পুনর্জীবন লাভ করত। এত তাড়াতাড়ি তাদের দাম্পত্য জীবনের গভীর পরিণতি ঘটত না। কিন্তু গোবিন্দলাল লজ্জা ও অহংকারের কাছে মাথানত করতে পারেনি। তাই তার খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। তাছাড়া গোবিন্দলাল কলকাতা থেকে যখন অর্থ সাহায্য চেয়ে ভ্রমরকে চিঠি দেয় তখন ভ্রমর যদি নিজের জেদকে একটু সংযত করে স্বামীকে ভালোবাসা জানিয়ে গৃহে আসার জন্য অনুরোধ করত তাহলে হয়ত গোবিন্দলাল ঘরে ফিরে আসত। সেই সময় গোবিন্দলাল বাড়ী ফিরে এলে তাদের দাম্পত্য জীবনে কিছুটা হলেও শান্তি বিরাজ করত। উভয়ের দাম্পত্য জীবন সুখের হলে হয়ত ভ্রমরকে মর্মান্তিক ভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হত না। পরিশেষে আমরা সম্পূর্ণ বিচার বিশ্লেষণ করে বলতে পারি যে ভ্রমর ও গোবিন্দলালের দাম্পত্য কলহের জন্য কেউ একক ভাবে দায়ী নয়। যদিও তাদের এই পরিণতির জন্য রোহিণীর মধ্যস্থতাকে কিছুটা হলেও দায়ী করা যায়। কিন্তু ভ্রমর ও গোবিন্দলালের জেদ ও অহংকার একটু যদি সংযত করা যেত তাহলে হয়ত রোহিণীর উপস্থিতি খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারত না। উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের বাস্তব সমাজ জীবনের নানান খুঁটি নাটি পরিস্থিতি এখানে আমরা লক্ষ্য করতে পারি। তাই উপন্যাসটিকে আমরা বাংলা সাহিত্যে এক উৎকৃষ্ট সামাজিক উপন্যাসের মর্যাদা দিতে পারি।
তথ্যসূত্র
২২. বঙ্কিম রচনাবলী(উপন্যাস সমগ্র), শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ (কল্পতরু উৎসব) ২০০৯, ঐ,পৃষ্ঠা-৫৫২
২৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬০
২৪. বঙ্কিম রচনাবলী (উপন্যাস সমগ্র), শুভম প্রকাশনী, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ (কল্পতরু উৎসব) ২০০৯, পৃষ্ঠা-৫৬২
২৫. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৩
২৬. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৫
২৭. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৭
২৮. ঐ পৃষ্ঠা-৫৬৮
২৯. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭১
৩০. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৪
৩১. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৭-৫৭৮
৩২. ঐ পৃষ্ঠা-৫৭৯
৩৩. ঐ পৃষ্ঠা-৫৮৪-৫৮৫






ধন্যবাদ গল্পটি নিজ ভাষায় গুছিয়ে লেখার জন্য। আমি কি অন্য সকল উপন্যাসের সারসংক্ষেপ এখানে পাব?
ReplyDeleteআপনার দরকারি গল্পটি কমেন্টে লিখে জানাতে পারেন। আমি অবশ্যই তা প্রকাশের চেষ্টা করব। আপনার নিজস্ব কিছু লেখা প্রকাশ করতে চাইলে মেইল করতে পারেন। ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান কমেন্টের জন্য।
ReplyDeleteকৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের ভ্রমর চরিত্র ta pawa jabe sir🙏
ReplyDeleteকৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে প্রেম-বিরহ একসূত্রে গাঁথা কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের আলোকে উক্তিটি আলোচনা কর।
ReplyDelete